সাংখ্য-দর্শনের ভূমিকা

ভূমিকা


ভারতীয় ষড়দর্শনের অন্যতম সাংখ্যদর্শন বা সাংখ্যশাস্ত্রকে প্রাচীনতম ভারতীয় দর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মহর্ষি কপিল হচ্ছেন এই দর্শনের সূত্রকার। তাই সাংখ্যকে কখনও কখনও কপিলমত বা কপিলদর্শন নামেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকেকপিলের শিষ্য ছিলেন আসুরি এবং আসুরির শিষ্য ছিলেন পঞ্চশিখ। কথিত আছে যেমুনি কপিল দুঃখে জর্জরিত মানুষের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাঁর শিষ্য আসুরিকে পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান সাংখ্যশাস্ত্র প্রদান করেছিলেন। আসুরি সেই জ্ঞান পঞ্চশিখকে প্রদান করেন। এরপর পঞ্চশিখএর দ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র নানাভাবে বহু শিষ্যের মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
পঞ্চশিখএর কাছ থেকে শিষ্যপরম্পরাক্রমে মুনি কপিল প্রণীত এই সাংখ্যশাস্ত্র ভালোভাবে জেনে ঈশ্বরকৃষ্ণ আর্য্যা ছন্দে ‘সাংখ্যকারিকা’ নামে যে গ্রন্থ রচনা করেনতাই এখন পর্যন্ত সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন প্রামাণিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। সাংখ্যদর্শনের পরিচয় প্রসঙ্গে সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ বলেন
এতৎ পবিত্রমগ্র্যাং মুনিরাসুরয়েহনুম্পয়া প্রদদৌ।
আসুরিরপি পঞ্চশিখায় তে চ বহুধা কৃতং তন্ত্রম্ ।। (সাংখ্যকারিকা৭০)
অর্থাৎকপিল মুনি দয়াপরবশ হয়ে এই পবিত্র ও সর্বোৎকৃষ্ট (জ্ঞানআসুরিকে প্রদান করেনআসুরিও পঞ্চশিখকে (এই জ্ঞান দান করেনএবং তার (অর্থাৎ পঞ্চশিখদ্বারা সাংখ্যশাস্ত্র বহুভাবে শিষ্য মধ্যে প্রচার হয়েছিলো।
.
সাংখ্যদর্শন কতোটা প্রাচীন তা নিয়ে বহুমত থাকলেও এর প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য শ্র“তিস্মৃতিপুরাণ ইত্যাদিতে সাংখ্য দর্শনের বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (আনুমানিক ২০০১০০ খ্রিষ্টপূর্বকপিল একজন খ্যাতনামা ঋষি এবং সেই উপনিষদে তাঁর দর্শনের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ভাগবতে কপিল মুনিকে চব্বিশজন অবতারের একজন বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাঁর পিতার নাম কর্দম ঋষি এবং মাতার নাম দেবহুতি। আবার মহাভারতে কপিল ও আসুরির সাংখ্যমতের উল্লেখ পাওয়া যায় ভালোভাবেই। মহাভারতের শান্তিপর্বে আচারজ্ঞ পিতামহ ভীষ্মের জবানিতে সাংখ্যমত সম্পর্কিত যে দীর্ঘ উদ্ধৃতি রয়েছেতার খানিকটা এরকম
 .
তত্র পঞ্চশিখো নাম কাপিলেয়ো মহামুনিঃ।
পরিধাবন্মহীং কৃৎস্নাং জগাম মিথিলামথ।। (শান্তিপর্ব ২১৫/)
অর্থাৎ সেই সময়ে কপিলানাম্নী কোন ব্রাহ্মণীর পুত্র মহর্ষি পঞ্চশিখ সমগ্র পৃথিবী পর্যটন করে পরে মিথিলানগরে এলেন।
.
ঋষীণামাহুরেকং যং কামাদবসিতং নৃষু।
শাশ্বতং সুখমত্যন্তমন্বিচ্ছন্তং সুদুর্ল্লভম্ ।। (শান্তিপর্ব ২১৫/)
অর্থাৎ সেই যে পঞ্চশিখ ঋষিদের মধ্যে অদ্বিতীয় ও মনুষ্যমধ্যে সকল কামনা থেকে বিরত ছিলেন এবং নিত্যঅত্যন্ত ও অতিদুর্লভ নির্বাণমুক্তি কামনা করতেনতা সেকালের লোকেরা বলতো।
.
যমাহুঃ কপিলং সাংখ্যাঃ পরমর্ষিং প্রজাপতিম্ ।
স মন্যে তেন রূপেণ বিস্মাপয়তি হি স্বয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব ২১৫/)
অর্থাৎ সাংখ্যমতাবলম্বীরা যাঁকে মহর্ষি ও প্রজাপতি কপিল বলেনআমি মনে করিস্বয়ং সেই কপিলই পঞ্চশিখরূপে এসে জ্ঞানালোকের প্রভাবে সকল লোককে বিস্ময়াপন্ন করছেনতাও তখন কেউ কেউ বলতো।
.
তমাসীনং সমাগম্য কাপিলং মণ্ডলং মহৎ।
পুরুষাবস্থমব্যক্তং পরমার্থং ন্যবেদয়ৎ।। (শান্তিপর্ব ২১৫/১১)
অর্থাৎ একদা আসুরি আপন তপোবনে উপবিষ্ট ছিলেনএমন সময়ে সাংখ্যমতাবলম্বী বহুতর মুনি সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পুরুষরূপ অব্যক্তপরম পদার্থ বলবার জন্য নিবেদন করলেন।
.
যত্তদেকাক্ষরং ব্রহ্ম নানারূপং প্রদৃশ্যতে।
আসুরির্মণ্ডলে তস্মিন্ প্রতিপেদে তদব্যয়ম্ ।। (শান্তিপর্ব ২১৫/১৩)
অর্থাৎ সেই যে একাক্ষরময় ব্রহ্ম নানাপ্রাণীতে নানারূপে দৃষ্ট হনসেই অবিনশ্বর ব্রহ্মের বিষয় আসুরি সেই মুনিগণের নিকট বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন।
.
এতন্মে ভগবানাহ কাপিলেয়স্য সম্ভবম্ ।
তস্য তৎ কাপিলেয়ত্বং সর্ববিত্ত্বমনুত্তমম্ ।। (শান্তিপর্ব ২১৫/১৬)
অর্থাৎ ভগবান্ মার্কণ্ডেয় এই পঞ্চশিখের উৎপত্তি এবং তাঁর কাপিলেয়ত্ব ও সর্বশ্রেষ্ঠ সর্বজ্ঞত্ব বিষয় আমাকে বলেছিলেন।
.
মহাভারতে সাংখ্যমতের বিস্তৃত আলোচনা থেকে এ দর্শনের প্রভাব ও প্রাচীনত্ব সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় অবশ্যই। অন্যদিকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রাচীন সূত্রগ্রন্থ ‘চরকসংহিতা’র দার্শনিক অনুক্রমে এই সাংখ্যশাস্ত্রেরই ভিত্তি পরিলক্ষিত হয়। যেমন
সত্ত্বমাত্মা শরীরঞ্চ ত্রয়মেতাত্রিদণ্ডবৎ।
লোকন্তিষ্ঠতি সংযোগাৎ তত্র সর্ব্বং প্রতিষ্ঠিতম্ ।।
স পুমাং শ্চেতনং তচ্চ তচ্চাধিকরণং স্মৃতম্ ।
বেদস্যাস্য তদর্থংহি বেদোহয়ং সম্প্রকাশিতঃ।। (চরকসংহিতা প্রথম অধ্যায়পৃষ্ঠা)
অর্থাৎ মনআত্মা ও শরীর– এরা ত্রিদণ্ডের ন্যায়। অর্থাৎ যেমন তিনটি দণ্ডের সংযোগে একটি ত্রিদণ্ড (ত্রিপদী বা তেপায়াপ্রস্তুত হয় এবং তার উপর দ্রব্যাদি রাখা যায়তেমনি মনআত্মা ও শরীরের সংযোগেই লোক সকল জীবিত রয়েছে এবং এই সংযোগের উপরই কর্মফলবিষয়বাসনা সুখদুঃখজ্ঞানাজ্ঞান প্রভৃতি সবকিছু নির্ভর করছে। এদের সংযুক্ত অবস্থাকেই পুরুষ বলে। এই পুরুষই চেতনতিনিই সুখ দুঃখাদির আধার এবং এরই জন্য এই আয়ুর্বেদ প্রকাশিত হয়েছে।
.
বৈদিক সংস্কৃতিতে সকল শাস্ত্রের সার বলে কথিত প্রাচীন মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতায়ও সাংখ্যদর্শনের প্রচুর ব্যবহার দেখা যায়। মূলত মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের দার্শনিক প্রপঞ্চটাই সংখ্যদর্শন ভিত্তিক। যেমন
তেষামিদন্তু সপ্তানাং পুরুষাণাং মহৌজসাম্ ।
সূক্ষ্মাভ্যো মূর্তিমাত্রাভ্যঃ সম্ভবত্যব্যয়াদ্ব্যয়ম্ ।। (মনুসংহিতা /১৯)
অর্থাৎ মহত্ত্বঅহঙ্কারতত্ত্ব এবং পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটি অনন্তকার্যক্ষম শক্তিশালী পুরুষতুল্য পদার্থের সূক্ষ্ম মাত্রা থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছেঅবিনাশী পুরুষ (পরমাত্মাথেকে এই রকম অস্থির জগতের উৎপত্তি হয়েছে।
.
আদ্যাদ্যস্য গুণং ত্বেষামবাপ্নোতি পরঃ পরঃ।
যো যো যাবতিথশ্চৈষাং স স তাব˜গুণঃ স্মৃতঃ।। (মনুসংহিতা /২০)
অর্থাৎ আকাশাদি পঞ্চভূতের মধ্যে পরপর প্রত্যেকে পূর্বপূর্বের গুণ গ্রহণ করে। এদের মধ্যে যে সৃষ্টিক্রমে যে স্থানীয়সে ততগুলি গুণ পায়। প্রথম ভূত আকাশের ১ গুণ,- শব্দ। দ্বিতীয় ভূত বায়ুর ২ গুণ,- শব্দ ও স্পর্শ। তৃতীয় ভূত অগ্নির ৩ গুণ– শব্দস্পর্শ এবং রূপ। চতুর্থ ভূত জলের ৪ গুণ– শব্দস্পর্শরূপ এবং রস। পঞ্চম ভূত পৃথিবীর ৫ গুণ– শব্দস্পর্শরূপরস এবং গন্ধ।
.
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের বিখ্যাত প্রামাণিক গ্রন্থ কৌটিল্য প্রণীত ‘অর্থশাস্ত্র’এ সাংখ্যদর্শনের প্রশস্তি দেখা যায়। কৌটিল্য সাংখ্যশাস্ত্রকে অনুমোদিত বিদ্যাচতুষ্টয়ের অন্যতম আন্বীক্ষিকীর অন্তর্গত শাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন
সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী’। (অর্থশাস্ত্র//)
অর্থাৎ সাংখ্যযোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্র উক্ত আন্বীক্ষিকীবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।
.
কৌটিল্যের এই বিদ্যাচতুষ্টয় হলো
আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ’। (অর্থশাস্ত্র//)
অর্থাৎ আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্যজুঃসামবেদাত্মক বেদবিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষিপশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যাএবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)
.
কৌটিল্যের মতে আন্বীক্ষিকী সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ
প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। (অর্থশাস্ত্র//)
অর্থাৎ আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষেউপায়তুল্যসকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।
.
এসব প্রাচীন সাহিত্যে সাংখ্যমতের বহুতর উল্লেখ থেকে অনুমান করাটা অসম্ভব নয় যেঅন্তত খ্রিষ্টপূর্ব চারশ বছরের পূর্ব থেকেই ভারতীয় দর্শন জগতে সাংখ্যদর্শনের জোরালো উপস্থিতি ছিলো। এবং প্রাচীন পুঁথিপত্রে এদর্শনের প্রভাব এতো ব্যাপক ও বিশাল যেসাংখ্যমতের পেছনে অতি সুদীর্ঘ যুগের ঐতিহ্য স্বীকার না করলে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। ফলে সাংখ্যদর্শনকে খুবই প্রাচীন বলে স্বীকার করা অমূলক হবে না। আধুনিক বিদ্বানদের কেউ কেউ সাংখ্যকে গৌতম বুদ্ধের চেয়ে অনেক প্রাচীন কালের দর্শন বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে সাংখ্যসম্প্রদায়ের প্রবর্তক কপিলের নাম থেকেই বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর নামকরণ হয়েছিলো।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال