অর্থাপত্তি প্রমাণ | মীমাংসা দর্শন,

অর্থাপত্তি প্রমাণ 



মীমাংসাদর্শনে অর্থাপত্তি একটি স্বতন্ত্র প্রমা ও প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত। যা স্বীকার না করলে কোনো একটি অপ্রত্যক্ষ বিষয়কে ব্যাখ্যা করা যায় না তার স্বীকৃতিকে অর্থাপত্তি বলে। কোনো বিষয় যখন জ্ঞাত কোনো কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না, তখন সেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে হলে অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করা হয়। এই অজ্ঞাত কারণের কল্পনাই হলো অর্থাপত্তি।

তাই বলা হয়-
‘অর্থাদ্ আপদ্যতে ইত্যর্থাপত্তিঃ’।
অর্থাৎ : কোন অর্থ বা বিষয়ের অনুপপত্তি অর্থাৎ অসংগতি পরিহার করার জন্য উপপাদক অর্থান্তরের কল্পনাই অর্থাপত্তি।
অর্থাপত্তি শব্দের প্রথম ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘অর্থস্য আপত্তিঃ’ অর্থাৎ, অর্থের আপত্তি। এরূপ ব্যুৎপত্তি অনুসারে অর্থাপত্তি শব্দ একপ্রকার যথার্থ জ্ঞানকে বোঝায়। অর্থাপত্তি শব্দের দ্বিতীয় ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘অর্থস্য আপত্তিঃ যস্মাৎ’ অর্থাৎ, অর্থের আপত্তি যার থেকে হয়। এরূপ ব্যুৎপত্তি অনুসারে অর্থাপত্তি শব্দ একপ্রকার প্রমাণকে বোঝায়। বলাবাহুল্য, উভয়ক্ষেত্রেই আপত্তি শব্দের অর্থ হলো কল্পনা। অতএব, কোন প্রমাণলব্ধ অর্থের (বিষয়ের) উপপত্তি বা সঙ্গতি রক্ষার জন্য অর্থান্তর (বিষয়ান্তর) কল্পনাকে বলে অর্থাপত্তি।
বেদান্ত দর্শনেও অর্থাপত্তিকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হয়। বেদান্ত দর্শনের অন্যতম গ্রন্থ ‘বেদান্তপরিভাষা’য় বলা হয়েছে-
‘উপপাদ্যজ্ঞানেন উপপাদক-কল্পনমর্থাপত্তিঃ।’- (বেদান্তপরিভাষা)
অর্থাৎ : উপপাদ্যের জ্ঞানের দ্বারা উপপাদকের কল্পনা হলো অর্থাপত্তি।
যেটা ব্যতীত যা অনুপপন্ন, সেটিই তার উপপাদক। এখানে উপপাদ্যের জ্ঞান হলো কারণ এবং উপপাদকের জ্ঞান হলো ফল।
মীমাংসক নারায়ণ ভট্ট তাঁর ‘মানমেয়োদয়’ গ্রন্থে অর্থাপত্তির স্বতন্ত্র কোন লক্ষণ না দিয়ে ভাষ্যোক্ত লক্ষণটিই উল্লেখ করে বলেন-
‘অন্যথানুপপত্ত্যা যদুপপাদককল্পনম্ ।
তদর্থাপত্তিরিত্যেবং লক্ষণং ভাষ্যভাষিতম্ ।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : অন্যপ্রকারে অনুপপত্তি হলে তার নিরসনের জন্য যে উপপাদকের কল্পনা, তাই অর্থাপত্তি।

দুইটি প্রমাণের পরস্পর বিরোধ বা উপপত্তির অভাবকে অনুপপত্তি বলে। ‘অনুপপত্তি’, ‘অসিদ্ধি’, ‘অসম্ভব’ ও ‘অযুক্ত’ এই শব্দগুলি সমার্থক। যার অভাবে কোন প্রমাণসিদ্ধ বিষয় অসম্ভব হয় তাকে শেষোক্ত বিষয়ের উপপাদক বলে। অর্থাৎ উপপাদকের জ্ঞানের দ্বারা কোন অনুপপত্তি নিরস্ত হয়ে উপপাদ্যের উপপত্তি হয়। যার অনুপপত্তি বিষয়ান্তরকল্পনা ব্যতীত দূরীভূত হয় না, তাকে উপপাদ্য বলে। অর্থাৎ উপপাদকের দ্বারা উপপাদ্যের অনুপপত্তি দূর হয়। উপপাদকের কল্পনা বলতে এখানে এক বিশেষ ধরনের জ্ঞানকেই বোঝানো হয়। এই কল্পনা ইংরেজি ‘ইমাজিনেশন’ নয়। এখানে উপপাদকের কল্পনা যথার্থ ও অনধিগত বিষয়ক জ্ঞান এবং তা ভাট্টমীমাংসক স্বীকৃত অপর সকল প্রমাণ থেকে বিলক্ষণ-প্রমাণ হওয়ায়, ভাট্টরা তাকে স্বতন্ত্র প্রমাণের মর্যাদা দিয়ে থাকেন। অর্থাপত্তি বা উপপাদক কল্পনার মূলে থাকে অনুপপত্তি। বস্তুত স্থল-বিশেষে অনুপপত্তি না হলে তার নিরাসপূর্বক উপপত্তির উদ্দেশ্যে কেউ উপপাদক কল্পনা করার আবশ্যকতা বোধ করতো না, এবং সেক্ষেত্রে অর্থাপত্তি নামক একটি বিলক্ষণ প্রমাণ স্বীকার করারও কোন সার্থকতা থাকে না। তাই মীমাংসামতে অনুপপত্তি বলতে কী বোঝায়, সেই অনুপপত্তি কিভাবে হয় এবং কিভাবেই বা তা নিরস্ত হয়, দৃষ্টান্তপূর্বক তা বিচার করা যেতে পারে।
নারায়ণ ভট্ট বলেন, দুটি প্রমাণের বিরোধই অনুপপত্তি। একটি অসাধারণ প্রমাণের সঙ্গে একটি সাধারণ প্রমাণের বিরোধ হলে অবিরুদ্ধ অংশে যে জ্ঞান, তাই অর্থাপত্তি।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দেবদত্ত নামক এক ব্যক্তি খুব স্থূল বা মোটা। সে সুস্থ, সুতরাং তার স্থূল হওয়া কোন রোগের জন্য নয়। আবার যথার্থভাবে অনুসন্ধান করে জানা গেছে যে, সে দিনে কিছু খায় না। এক্ষেত্রে দেবদত্তের স্থূল হওয়া ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, কারণ অসঙ্গতি হয়। ‘স্থূল দেবদত্ত দিনে খায় না’- এরূপ ঘটনা যদি কেউ দেখে অথবা কোন আপ্তব্যক্তির মুখ থেকে শোনে তাহলে ‘দেবদত্তের স্থূল হওয়া’- এই অনুপপত্তির সমাধানে কল্পনা করতে হয় যে দেবদত্ত রাত্রে উৎকৃষ্ট ভোজন করে। এক্ষেত্রে রাত্রে ভোজনের জ্ঞানই হলো অর্থাপত্তি প্রমা।
এই রাত্রে ভোজনের জ্ঞান প্রত্যক্ষ অথবা অনুমান অথবা অন্য কোন প্রমাণের দ্বারা যেহেতু সম্ভব নয়, সেহেতু অর্থাপত্তি নামক পঞ্চম প্রমাণ অবশ্যস্বীকার্য। রাত্রে ভোজনের সঙ্গে ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ না হওয়ায় এই জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বলা যায় না। আবার রাত্রি ভোজনব্যাপ্য হেতুতে পক্ষধর্মতা নিশ্চয়রূপ পরামর্শের অভাব থাকাকালে উৎপন্ন হওয়ায় এরূপ প্রমাজ্ঞানকে অনুমিতিও বলা যায় না। এরূপ জ্ঞানকে উপমিতিও বলা যায় না, কারণ সেখানে সাদৃশ্য জ্ঞান নেই এবং অতিদেশবাক্যস্মরণ নেই সেখানে এটি উৎপন্ন হয়। ঐ প্রমাজ্ঞানকে শাব্দবোধও বলা যায় না কারণ ‘স্থূল দেবদত্ত দিনে খায় না’- এরূপ বাক্যে রাত্রিভোজনবোধক কোন পদ নেই। সুতরাং ঐ বিজাতীয় প্রমাজ্ঞানের জনককে অতিরিক্ত প্রমাণ বলতে হবে। এভাবেই অর্থাপত্তি প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে রাত্রিভোজন হলো স্থূলত্বের উপপাদক। কারণ রাত্রিভোজন স্বীকার না করলে দিনে অভোজনকারী ব্যক্তির স্থূলত্ব ব্যাখ্যা করা যায় না। অপরপক্ষে দিনে অভোজনকারীর স্থূলত্ব হলো উপপাদ্য।
মীমাংসকমতে অর্থাপত্তি দু’প্রকার- দৃষ্ট-অর্থাপত্তি ও শ্রুত-অর্থাপত্তি
যে স্থলে দৃষ্ট উপপাদ্যের অনুপপত্তির জ্ঞান দ্বারা উপপাদকের কল্পনা করা হয় সেই স্থলে তাকে দৃষ্টার্থাপত্তি বলা হয়। যেমন, ধরা যাক আমরা জানি যে দেবদত্ত জীবিত আছে। কেউ তার সন্ধান করায় উত্তরে বলা হলো যে, দেবদত্ত বাড়িতে নেই। এ অবস্থায় দুটি যথার্থ জ্ঞানের মধ্যে বিরোধ হয়। এই বিরোধের সমাধান তখনই সম্ভব যদি আমরা বলি যে দেবদত্ত অন্য কোথাও আছে। অর্থাৎ, দেবদত্তের বাড়িতে না থাকা উপপন্ন হয় যদি আমরা তার বাইরে থাকা কল্পনা করি। এটাই দৃষ্ট-অর্থাপত্তি।
অপরপক্ষে, যে স্থলে শ্রুত উপপাদ্যের অনুপপত্তি হওয়ায় জ্ঞানের জন্য উপপাদকের কল্পনা করা হয়, তাকে শ্রুতার্থাপত্তি বলা হয়। শ্রুত-অর্থাপত্তি সেখানেই হয় যেখানে আমরা অপূর্ণ বাক্যের অন্বয় করার জন্য শব্দের অধ্যাহার করি। যেমন ধরা যাক কেউ বাড়ির বাইরে যাচ্ছে। এমন সময় কেউ তাকে বললো- ‘দরজাটা’। এই অপূর্ণ বাক্য শুনে শ্রোতা বুঝে যায় দরজাটা বন্ধ করতে হবে। দরজাটা পদের পর ‘বন্ধ করো’ এই পদের কল্পনা করলে ‘দরজাটা বন্ধ করো’ এইরূপ বাক্যের অর্থ উপপন্ন হতে পারে। একেই বলা হয় শ্রুত-অর্থাপত্তি।
কারো মতে শ্রুত-অর্থাপত্তি আবার দু’প্রকার- অভিধানানুপত্তি এবং অভিহিতানুপত্তি। বাক্যের এক অংশ শুনে যদি অন্য অংশ কল্পনা করা হয়, তা হলো অভিধানানুপত্তি। আর যেখানে বাক্যের অর্থ দ্বারা অবগত অর্থ অনুপপন্ন হয় বলে অন্য অর্থের কল্পনা করতে হয় তখন সেটি হলো অভিহিতানুপপত্তি।
নৈয়ায়িকরা যেহেতু অর্থাপত্তি প্রমাণ স্বীকার করেন না সেহেতু তাঁরা বলেন যে রাত্রিভোজন কল্পনারূপ প্রমা জ্ঞান অনুমানের দ্বারাই হতে পারে।
উক্ত পূর্বপক্ষ খণ্ডন প্রসঙ্গে মীমাংসকরা বলেন, উক্ত স্থলকে অনুমান বললে ব্যাপ্তিজ্ঞানটি হবে ‘যারা দিনে অভুক্ত হয়েও স্থূলকায় তারা রাত্রিভোজনকারী’। কিন্তু ব্যভিচার থাকায় উক্ত ব্যাপ্তি অযথার্থ। যেমন যোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা দিনে বা রাতে অভুক্ত হয়েও স্থূলকায় হতে পারেন। সুতরাং, কেবলমাত্র অর্থাপত্তি প্রমাণের দ্বারাই ‘দেবদত্ত রাত্রে ভোজন করে’ এরূপ নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান হওয়ায় অর্থাপত্তি প্রমাণ অবশ্যস্বীকার্য।
এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে নৈয়ায়িকরা আবার বলেন যে, ঐরূপ জ্ঞানস্থলে অন্বয়ব্যাপ্তি সম্ভব না হলেও ব্যতিরেক ব্যাপ্তি সম্ভব। ব্যতিরেক ব্যাপ্তিটি এরূপ- ‘যে রাত্রিভোজন করে না, সে দিনে না খেলে স্থূল হয় না যেমন উপবাসরত তপস্বী।’ এই ব্যতিরেক ব্যাপ্তি জ্ঞানের দ্বারা রাত্রিভোজনের অনুমিতি সম্ভব হওয়ায় অর্থাপত্তিকে অতিরিক্ত প্রমাণরূপে স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।
বস্তুত ব্যতিরেক ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠিত হলে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে অর্থাপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু ব্যতিরেক ব্যাপ্তি প্রমাণসিদ্ধ কিনা এই বিবাদের মীমাংসা না হওয়ায় অর্থাপত্তি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال