জৈনদর্শন: ভারতের প্রাচীন নাস্তিক্য ধর্মদর্শনের এক অমূল্য রত্ন
জৈনদর্শন ভারতের প্রাচীন নাস্তিক্য ধর্মদর্শন। তীর্থঙ্কর, অহিংসা, কর্মফল ও মোক্ষের ধারণা জানুন।
Keywords: জৈনদর্শন, তীর্থঙ্কর, মহাবীর, অহিংসা, কর্মফল, পুনর্জন্ম, নাস্তিক্য ধর্ম, শ্বেতাম্বর, দিগম্বর, ভারতীয় দর্শন, ঋষভদেব, পার্শ্বনাথ, মোক্ষ, সর্বজ্ঞাতাবাদ
ভূমিকা
জৈনদর্শন ভারতের প্রাচীনতম নাস্তিক্য ধর্মদর্শনগুলির মধ্যে একটি, যা অহিংসা, কর্মফল এবং মোক্ষের পথে জীবাত্মার স্বাধীনতার উপর জোর দেয়। ‘জিন’ শব্দ থেকে জৈনদর্শনের নামকরণ হয়েছে, যার অর্থ ‘বিজয়ী’—যিনি রাগ, দ্বেষ, কামনা-বাসনা ইত্যাদি ষড়রিপুকে জয় করেছেন। জৈন ঐতিহ্যে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের কথা উল্লেখ করা হয়, যাঁরা মুক্তি লাভ করে জগতের জন্য পথপ্রদর্শক হয়েছেন। এই তীর্থঙ্করদের মধ্যে প্রথম ঋষভদেব এবং শেষ মহাবীর, যিনি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। এই ব্লগ পোস্টে আমরা জৈনদর্শনের উৎপত্তি, মূলনীতি, তীর্থঙ্করদের ঐতিহ্য, এবং এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। আরও তথ্যের জন্য আমার ইউটিউব চ্যানেল MDJ Blog দেখুন।
জৈনদর্শনের উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
জৈনদর্শনের উৎপত্তি প্রাচীন ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে। বৈদিক ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদী কর্মকাণ্ড ও জটিল আচার-অনুষ্ঠানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জৈনদর্শন ও বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব ঘটে। তবে, কালানুক্রমে জৈনদর্শন বৌদ্ধধর্মের চেয়েও প্রাচীন বলে বিবেচিত হয়। জৈন ঐতিহ্যে বলা হয়, এই ধর্ম সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই প্রচলিত। চব্বিশজন তীর্থঙ্করের পারম্পর্য এই ধর্মের প্রাচীনত্বের প্রমাণ। প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেব, যিনি ভাগবত পুরাণে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে উল্লিখিত, এবং শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর (৫৬৯-৪৮৫ খ্রীষ্টপূর্ব) এই ধর্মের প্রধান প্রবর্তক।
উদ্ধৃতি: “যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্বদর্শী, তিনি জিন” (কল্পসূত্র)
অর্থ: যিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বদর্শী, তিনিই জিন।
জৈনদর্শন বেদের প্রামাণ্য বা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্ব “
জৈনদর্শনের মূলনীতি
জৈনদর্শনের কেন্দ্রীয় দর্শন হলো অহিংসা, সত্য ও আত্মার স্বাধীনতা। এই দর্শনের মূল কথা হলো জগৎ যেমন আমরা প্রত্যক্ষ করি, তেমনই সত্য। জগতের সবকিছুকে জৈনরা জীব ও অজীব—দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন।
- জীব ও অজীব: জীব হলো চেতন সত্তা, যার মধ্যে আত্মা রয়েছে। এই আত্মা অবিনাশী এবং ঈশ্বরের সৃষ্ট নয়। অজীব হলো জড় পদার্থ, যেমন—পরমাণু, কাল, আকাশ।
- অহিংসা: জৈনধর্মের প্রাণকেন্দ্র হলো অহিংসা। জৈনরা বিশ্বাস করেন, প্রতিটি জীবের আত্মা সমান মর্যাদার। তাই কোনো জীবের প্রতি হিংসা করা নিষিদ্ধ।
- পঞ্চ মহাব্রত: মহাবীর পার্শ্বনাথের চারটি মহাব্রত (অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, অপরিগ্রহ)-এর সঙ্গে ব্রহ্মচর্য যোগ করে পাঁচটি মহাব্রত প্রবর্তন করেন। এই ব্রতগুলি হলো জৈন সাধনার ভিত্তি।
- কর্মফল ও পুনর্জন্ম: জৈনরা বিশ্বাস করেন, জীবের কর্ম অনুযায়ী তার জন্ম ও জীবন নির্ধারিত হয়। কঠিন তপস্যা ও সংযমের মাধ্যমে জীব মোক্ষ লাভ করতে পারে।
- স্যাদ্বাদ (অনেকান্তবাদ): জৈনদর্শনের একটি অনন্য তত্ত্ব হলো স্যাদ্বাদ, যা বলে যে সত্য বহুমুখী। কোনো বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়।
উদ্ধৃতি: “স্যাদস্তি, স্যান্নাস্তি, স্যাদস্তি চ নাস্তি চ” (তত্ত্বার্থসূত্র)
অর্থ: সত্য একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়—আছে, নেই, এবং আছে ও নেই উভয়ই।
তীর্থঙ্করদের ঐতিহ্য
জৈন ঐতিহ্যে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের উল্লেখ রয়েছে, যাঁরা জীবের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য হলেন:
- ঋষভদেব (আদিনাথ): প্রথম তীর্থঙ্কর, যিনি মনুবংশীয় নাভিরাজের পুত্র ছিলেন। যজুর্বেদ-এ তাঁর উল্লেখ রয়েছে, যা জৈনদর্শনের প্রাচীনত্ব নির্দেশ করে।
- পার্শ্বনাথ (৮১৭-৭৪৭ খ্রীষ্টপূর্ব): তেইশতম তীর্থঙ্কর, যিনি কাশীরাজ অশ্বসেনের পুত্র ছিলেন। তিনি কঠোর তপস্যার মাধ্যমে কৈবল্য লাভ করেন এবং পরেশনাথ পাহাড়ে দেহত্যাগ করেন।
- মহাবীর (৫৬৯-৪৮৫ খ্রীষ্টপূর্ব): চব্বিশতম তীর্থঙ্কর, যিনি জৈনধর্মের প্রধান প্রবর্তক। তিনি বৈশালীতে জ্ঞাতৃবংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ত্রিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে বারো বছরের কঠিন তপস্যার পর সর্বজ্ঞতা লাভ করেন।
উদ্ধৃতি: “মহাবীর সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, সমুদয় জ্ঞান ও দর্শন জানেন” (কল্পসূত্র).
মহাবীরের শিক্ষা অহিংসা, সংযম এবং তপস্যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। তিনি নগ্ন অবস্থায় তপস্যা করতেন, যার জন্য তাঁকে বৌদ্ধ ত্রিপিটকে নিগণ্ঠ নাতপুত্ত বলা হয়।
জৈনদর্শনের সম্প্রদায়: শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর
জৈনধর্ম পরবর্তীকালে দুটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়—শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর। এই বিভাজন মূলত আচার-অনুষ্ঠানের পার্থক্যের কারণে।
- শ্বেতাম্বর: এই সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা শ্বেতবস্ত্র পরিধান করেন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, মহাবীরের শিষ্যদের মধ্যে গৃহী ও ভিক্ষু উভয়ই ছিলেন। শ্বেতাম্বররা মোক্ষের জন্য বস্ত্রধারণে কোনো বাধা দেখেন না।
- দিগম্বর: এই সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকেন, কারণ তাঁরা বিশ্বাস করেন, সত্যিকারের সন্ন্যাসে সম্পূর্ণ অপরিগ্রহ পালন করা উচিত। দিগম্বররা মনে করেন, মোক্ষের জন্য পুরুষ জন্ম প্রয়োজন।
উদ্ধৃতি: “সরজোহরণা ভৈক্ষভুজো লুঞ্চিতমূর্ধজাঃ। শ্বেতাম্বরাঃ ক্ষমাশীলা নিঃসঙ্গা জৈনসাধবঃ” (সর্বদর্শনসংগ্রহ, মাধবাচার্য)
অর্থ: শ্বেতাম্বর জৈন সাধুরা ক্ষমাশীল ও আসক্তিশূন্য, যাঁরা ভিক্ষান্ন গ্রহণ করেন।
দিগম্বর ও শ্বেতাম্বরদের মধ্যে প্রাচীনত্ব নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দিগম্বররা বলেন, শ্বেতাম্বর সম্প্রদায় ৭৯ খ্রীষ্টাব্দে উৎপত্তি লাভ করে, যখন শ্বেতাম্বররা দাবি করেন, দিগম্বর সম্প্রদায় ৮২ খ্রীষ্টাব্দে শিবভূতির মাধ্যমে শুরু হয়।
জৈন সাহিত্য ও দার্শনিক অবদান
জৈনদর্শনের সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। জৈন আগমগ্রন্থ বা সিদ্ধান্তগ্রন্থ প্রাচীন অর্ধমাগধী প্রাকৃত ভাষায় রচিত। পরবর্তীকালে জৈন দার্শনিকরা সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন। কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ও তাদের রচয়িতা:
- তত্ত্বার্থসূত্র (উমাস্বাতি, ১ম শতক): জৈন দর্শনের মূল তত্ত্বগুলি—জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধ, সংবর, নির্জরা ও মোক্ষ—এই গ্রন্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর উভয় সম্প্রদায়ের কাছে গৃহীত।
- কল্পসূত্র (ভদ্রবাহু): তীর্থঙ্করদের জীবনী ও জৈন সন্ন্যাসীদের আচার-নিয়ম এই গ্রন্থে উল্লিখিত।
- ন্যায়াবতার (সিদ্ধসেন দিবাকর): জৈন ন্যায়শাস্ত্রের উপর প্রাকৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ।
- প্রমাণমীমাংসা (হেমচন্দ্র সূরি): জৈন তর্কশাস্ত্র ও প্রমাণশাস্ত্রের উপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
জৈন দার্শনিকরা স্যাদ্বাদ ও নয় পদার্থের তত্ত্বের মাধ্যমে ভারতীয় দর্শনে অপরিসীম অবদান রেখেছেন। কুন্দকুন্দাচার্য, সমন্তভদ্র, এবং হেমচন্দ্র সূরির মতো দার্শনিকরা জৈন তর্কশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন।
জৈনধর্মের প্রভাব ও সমাজে অবদান
জৈনধর্ম ভারতীয় সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। অহিংসার নীতির কারণে জৈনরা কৃষিকাজ ত্যাগ করে বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন, যা ভারতের বণিক সম্প্রদায়ের বিকাশে সহায়ক হয়। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেন, “জৈনরা স্বধর্মের প্রেরণায় স্বেচ্ছায় কৃষি ত্যাগ করে বাণিজ্য গ্রহণ করেছেন।”
জৈনরা শিক্ষা, সাহিত্য, এবং স্থাপত্যেও অবদান রেখেছেন। গুজরাট ও রাজস্থানের জৈন মন্দিরগুলি, যেমন—দিলওয়ারা মন্দির, ভারতীয় স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। জৈন সাহিত্যে গণিত, জ্যোতিষ এবং ভূগোলের আলোচনাও রয়েছে, যা প্রাচীন ভারতের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার প্রমাণ।
জৈনদর্শনের সমালোচনা ও বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে তুলনা
বৌদ্ধ ত্রিপিটকে জৈনদর্শনের সমালোচনা লক্ষ করা যায়। বুদ্ধের শিষ্য আনন্দ জৈন তীর্থঙ্করদের সর্বজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, যেমন—সর্বজ্ঞ হয়েও কেন তাঁরা শূন্য ঘরে ভিক্ষা চাইতে যান বা পথের হদিস জিজ্ঞাসা করেন? তবে, জৈনরা এই সমালোচনার জবাবে বলেন, এগুলো অদৃষ্টাধীন।
জৈন ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে মিল থাকলেও পার্থক্য উল্লেখযোগ্য। বৌদ্ধরা অনাত্মবাদে বিশ্বাসী, যেখানে জৈনরা জীবাত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। জৈনদর্শন বেদ ও ঈশ্বরের প্রামাণ্য অস্বীকার করলেও, তীর্থঙ্করদের সর্বজ্ঞতা ও তাঁদের পূজায় গুরুত্ব দেয়।
উপসংহার
জৈনদর্শন ভারতের প্রাচীন নাস্তিক্য ধর্মদর্শনের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। অহিংসা, সংযম, এবং স্যাদ্বাদের মতো তত্ত্বগুলি এই দর্শনকে অনন্য করে তুলেছে। তীর্থঙ্করদের ঐতিহ্য ও মহাবীরের শিক্ষা ভারতীয় সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। জৈন সাহিত্য ও দার্শনিক চিন্তাধারা ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে এক অমূল্য অবদান। আরও তথ্যের জন্য আমার ইউটিউব চ্যানেল MDJ Blog ভিজিট করুন এবং জৈনদর্শনের গভীরতা সম্পর্কে জানুন।
রেফারেন্স:
- তত্ত্বার্থসূত্র, উমাস্বাতি।
- কল্পসূত্র, ভদ্রবাহু।
- সর্বদর্শনসংগ্রহ, মাধবাচার্য।
- Jain World
- Bharat Discovery