বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্ব

বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্ব

বৌদ্ধমত অনুযায়ী অবিদ্যা বা মিথ্যাজ্ঞান জরা-মরণাদির মূল কারণ। তাই নির্বাণার্থীর প্রথম কাজ হলো অবিদ্যা দূরীকরণ। আর সম্যক্ জ্ঞানের দ্বারাই অবিদ্যার নাশ হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধমতে সর্ববিধপুরুষার্থ লাভের একমাত্র উপায় হলো সম্যক্ জ্ঞান অর্জন। চারটি বৌদ্ধ সম্প্রদায় মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক তাঁদের নিজ নিজ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে বুদ্ধ-বচনের তাৎপর্য গ্রহণ করেছেন। এর ফলে কোন কোন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে কোন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ই নিত্য স্থায়ী জ্ঞাতারূপে আত্মাকে স্বীকার করেননি।

বৌদ্ধ দর্শনের বিবর্তনের প্রথম পর্বে আমরা পাই সর্বাস্তিবাদী সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক সম্প্রদায়। এই দুই সম্প্রদায় বস্তুতান্ত্রিক হলেও স্থায়ীরূপে প্রতীত বস্তুকে পৃথক পৃথক ধর্মের দ্বারাই ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের মতে ধর্ম পৃথকভাবে সৎ, ধর্মের দ্বারা গঠিত স্থায়ী বস্তু অসৎ। যোগাচার ও মাধ্যমিক সম্প্রদায়ও এই ব্যাপারে একমত। মাধ্যমিক সম্প্রদায় পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাগতিক বস্তুর জ্ঞানের মূল্যকে যদিও অস্বীকার করেছেন, তবুও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাগতিক বস্তুর জ্ঞানের মূল্যকে অস্বীকার করেননি। জ্ঞানতত্ত্বে তাঁদের এই অবস্থান অদ্বৈত-বেদান্ত সম্প্রদায়ের জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে তুলনীয়। অদ্বৈত বেদান্ত পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎকে মিথ্যা বলে মনে করলেও জাগতিক বিষয়ের জ্ঞানের ব্যাপারে ভাট্ট-মীমাংসাসম্মত জ্ঞানতত্ত্বকে স্বীকার করেছেন।

এ প্রেক্ষিতে বৌদ্ধ জ্ঞানতত্ত্বের বিচারে বৌদ্ধাচার্য বসুবন্ধু, দিঙনাগ, ধর্মকীর্তি, শান্তরক্ষিত ও কমলশীল প্রবর্তিত প্রমাণতত্ত্বই বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্ব রূপে গ্রহণ করা যায়। এই প্রমাণতত্ত্ব একাধারে যোগাচার-সৌত্রান্তিক-বৈভাষিক প্রমাণতত্ত্ব রূপে গৃহীত হয়েছে। বসুবন্ধুর ‘বাদবিধি’, দিঙনাগের ‘প্রমাণ-সম্চ্চুয়’, ধর্মকীর্তির ‘ন্যায়বিন্দু’ ও ‘প্রমাণবার্ত্তিক’, শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ বৌদ্ধ প্রমাণতত্ত্বের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আকরগ্রন্থ।

বৌদ্ধমতে প্রমাণ
বৌদ্ধরা সম্যক্ জ্ঞানকেই প্রমাণ বলেছেন। সম্যক্ জ্ঞান হলো যথার্থ জ্ঞান। বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি তাঁর ‘ন্যায়বিন্দু’তে বলেছেন-

‘সম্যগ্জ্ঞানপূর্বিকা পুরুষার্থসিদ্ধিঃ ইতি।’ (ন্যায়বিন্দু)
অর্থাৎ : হেয়-উপাদেয় বা পুরুষার্থের সিদ্ধি যথার্থ বা সম্যক্ জ্ঞানের দরুন হয়ে থাকে।

পুরুষের অর্থ পুরুষার্থ। যার কামনা করা হয় তা অর্থ। এই অর্থ হেয় বা উপাদেয়, এই দুই ধরনেরই হয়ে থাকে। হেয় হচ্ছে ত্যাগের যোগ্য এবং উপাদেয় গ্রহণের যোগ্য।
প্রমাণের স্বরূপ হচ্ছে সম্যগ্জ্ঞান, যা পূর্বে অধিগত (=লাভ) করা হয়নি। করণবাচ্যে প্র-মা ধাতুর সাথে ল্যুট্ প্রত্যয়ের যোগে ‘প্রমাণ’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়েছে। সন্দেহ, বিপর্যয় নামক দোষ রহিত হয় বলে সম্যগ্জ্ঞানকে প্রমাণ বলা হয়েছে। সম্যগ্জ্ঞান হলো অবিসংবাদক জ্ঞান। অবিসংবাদক অর্থ অনুভবের দ্বারা অবাধিত। এই অর্থে একটি জ্ঞান তখনই অবিসংবাদক হবে যখন তা আমাদের প্রবৃত্তিকে বাধিত বা প্রতারিত করবে না। তাই ‘প্রমাণবার্ত্তিকে’ ধর্মকীর্তি বলেছেন-
‘প্রমাণম্ অবিসংবাদি জ্ঞানম্’। (প্রমাণবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : অবিসংবাদি জ্ঞানই প্রমাণ।

আবার যে জ্ঞান প্রাপক তাই হলো অবিসংবাদক। একটি জ্ঞানকে তখনই প্রাপক বলা হয় যখন তা সফল প্রবৃত্তির জনক হয় কিংবা পুরুষার্থসিদ্ধির কারণ হয়। ধর্মকীর্তি অবিসংবাদের অর্থ করেছেন- অর্থক্রিয়ার উপর স্থিত হওয়া, অর্থাৎ কাল্পনিক জ্ঞানের উপর নয়। তাই কোন কোন জ্ঞানের প্রমাণ হয় প্রয়োগ বা অর্থক্রিয়ারূপ ব্যবহারের দ্বারা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জল বিষয়ক একটি জ্ঞান তখনই প্রাপক হবে যখন তা আমার তৃষ্ণা নিবারণের প্রবৃত্তিকে সফল করবে। তৃষ্ণা নিবারণের প্রবৃত্তি যদি সফল না হয় তাহলে জলের জ্ঞানকে প্রাপক জ্ঞান বলা যায় না। যেমন- মরীচিকায় জলের জ্ঞান। সম্যগ্জ্ঞান হলো সেই জ্ঞান যা আমাদের সফল প্রবৃত্তির জনক বা পুরুষার্থসিদ্ধির সহায়ক।

বস্তুত জ্ঞান কোন বস্তুকে উৎপন্ন করে প্রাপ্ত করায় না, কিন্তু বস্তুতে পুরুষের প্রবৃত্তি ঘটিয়ে থাকে এবং বস্তুকে লাভ করায়। অতএব বিষয়ের বোধ হওয়া হচ্ছে প্রমাণের ফল, কেননা বিষয়ের জ্ঞান হলে পর পুরুষের প্রবৃত্তি হয় এবং বিষয়টির প্রাপ্তি হয়। এভাবে প্রমাণের ব্যাপার সমাপ্ত হয়। কেননা যে জ্ঞানের দ্বারা প্রথমত বিষয়ের বোধ হয় তার দ্বারা মানুষ প্রবৃত্ত হয়ে বিষয়কে লাভ করে থাকে।
সংশয় ও বিপর্যাস জ্ঞান অবিসংবাদক হয় না। যেমন- স্থাণু বা পুরুষ এরূপ সংশয়জ্ঞান হয় এবং মরীচিকাতে জলজ্ঞান হচ্ছে বিপর্যাস জ্ঞান। এই দুইপ্রকার জ্ঞান অবিসংবাদক নয় বলে প্রমাণরূপে গণ্য হয় না।

প্রমাণ সংখ্যা :
অন্যান্য ভারতীয় দার্শনিক শব্দ, উপমান, অর্থাপত্তি প্রভৃতি কয়েকটি প্রমাণকে মেনেছেন। কিন্তু ধর্মকীর্তি তথা বৌদ্ধ দার্শনিকরা অর্থক্রিয়া বা প্রয়োগকে পরম সত্যের কষ্টিপাথর বলে মেনেছেন এবং একারণে অর্থক্রিয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রমাণকেই তাঁরা যথার্থ প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। সায়ণ মাধবাচার্য ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে বলেছেন-


‘ততশ্চার্থো দ্বিবিধঃ- গ্রাহ্যোহধ্যবসেয়শ্চ। তত্র গ্রহণং নির্বিকল্পকরূপং প্রমাণম্, কল্পনাপোঢ়ত্বাৎ। অধ্যবসায়ঃ সবিকল্পকরূপোহপ্রমাণম্, কল্পনাজ্ঞানত্বাৎ। (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : অতএব অর্থ দুই প্রকার- গ্রাহ্য ও অধ্যবসায়। তার মধ্যে নির্বিকল্পকরূপ গ্রহণ প্রমাণ। যেহেতু তা কল্পনারহিত। সবিকল্পকরূপ অধ্যবসায় অপ্রমাণ। যেহেতু তা কল্পনাজ্ঞান।

বৌদ্ধমতে বিষয় দুই প্রকার- গ্রাহ্য ও অধ্যবসায়। গ্রহণের বিষয়ই গ্রাহ্য। ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ জন্য যে জ্ঞান হয় তার নাম গ্রহণ। এই গ্রহণ বা জ্ঞান দুই প্রকার- সবিকল্পক জ্ঞান ও নির্বিকল্পক জ্ঞান। তার মধ্যে নির্বিকল্পক জ্ঞানকেই প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করা হয়, কারণ তাতে পরমার্থসৎ স্বলক্ষণমাত্রই বিষয় হয়। পাঁচ প্রকার কল্পনার (নাম, জাতি, গুণ, ক্রিয়া ও দ্রব্য) কোন কল্পনাই তাতে নেই। অন্যদিকে সবিকল্পকরূপ অধ্যবসায় অপ্রমাণ। নির্বিকল্পক জ্ঞানের পরে সবিকল্পক জ্ঞান হয় এবং তা কল্পনাজ্ঞান বলে বৌদ্ধরা তাকে ভ্রান্ত ও অপ্রমাণ বলেন। তাই বলা হয়েছে-
‘বিকল্পো বস্তুনির্ভাসাদসংবাদাদুপপ্লবঃ’ ইতি।
অর্থাৎ : যাতে বস্তু এরূপে বা ঐরূপে প্রতীত হয় এবং কল্পিত বলে বস্তু যে জ্ঞানে ভিন্ন ব্যক্তির নিকট ভিন্নরূপে প্রতীত হয় তা হচ্ছে সবিকল্পক ও ভ্রান্তজ্ঞান। ঐ জ্ঞান কল্পিত বলে সেখানে ঐকমত্য না থাকায় তাকে ভ্রান্ত বলা হয়। (বিকল্পঃ অর্থ সবিকল্পক জ্ঞান বা কল্পনা, সংবাদ অর্থ সকলের ঐকমত্য জ্ঞান, উপপ্লব অর্থ ভ্রম।)
.

অর্থক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে পদার্থকে পৃথক পৃথকভাবে দেখলে শব্দ ইত্যাদির প্রয়োগ ছাড়াই তাকে স্বলক্ষণে পাওয়া যায়, অথবা কয়েকটি পদার্থের মধ্যে সাদৃশ্যকে বিচার করলে তাকে সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে পাওয়া যায়। এভাবে বিষয়ের দুটি প্রকার হওয়া থেকে প্রমাণও দুই প্রকার হয়। একটি প্রত্যক্ষ, অন্যটি অনুমান। ধর্মকীর্তি বলেন- প্রত্যক্ষের আধার বস্তুর স্বলক্ষণ, অর্থাৎ অর্থক্রিয়ার সামর্থ্য; অনুমানের আধার সামান্যলক্ষণ অর্থাৎ অর্থক্রিয়ার অসামর্থ্য। তাই বৌদ্ধমতে বলা হয়েছে-
‘দ্বিবিধং সম্যগ্ জ্ঞানম্ প্রত্যক্ষমনুমানঞ্চ।’
অর্থাৎ : সম্যগ্জ্ঞান দ্বিবিধ- প্রত্যক্ষ ও অনুমান।

প্রত্যক্ষের বিষয় স্বলক্ষণ এবং অনুমানের বিষয় সামান্যলক্ষণ। নামজাত্যাদিশূন্য অসাধারণ ক্ষণিক বস্তুস্বরূপ হলো স্বলক্ষণ। অপরদিকে নামজাত্যাদিবিশিষ্ট স্থায়ী বিষয় হলো সামান্যলক্ষণ। স্বলক্ষণের উপর নামজাত্যাদি আরোপিত হয়ে সামান্যলক্ষণ বস্তু বা বিষয় গঠিত হয়। প্রত্যক্ষের দ্বারা কেবল স্বলক্ষণ এবং অনুমানের দ্বারা কেবল সামান্যলক্ষণের জ্ঞান হতে পারে। প্রমাণের এইরূপ ব্যবস্থার পারিভাষিক নাম প্রমাণ-ব্যবস্থা। এই প্রমাণ-ব্যবস্থায় বৌদ্ধমতে প্রমাণ দ্বিবিধ- (ক) প্রত্যক্ষ ও (খ) অনুমান।
.

(ক) প্রত্যক্ষ প্রমাণ
বৌদ্ধাচার্য দিঙনাগ তাঁর ‘প্রমাণসমুচ্চয়ে’ প্রত্যক্ষের লক্ষণ দিতে গিয়ে বলেছেন-
‘প্রত্যক্ষম্ কল্পনাপোঢ়ং নামজাত্যাদ্যসংযুতম্’। (প্রমাণসমুচ্চয়)
অর্থাৎ : নামজাত্যাদি কল্পনা-অবিশিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানই হলো প্রত্যক্ষজ্ঞান।

তার মানে, প্রত্যক্ষজ্ঞান হওয়ার জন্য জ্ঞানকে অবশ্যই কল্পনারহিত হতে হবে। এই কল্পনা কী ? বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি কল্পনার সংজ্ঞায় বলেছেন-
‘অভিলাপ-সংসর্গ-যোগ্য-প্রতিভাস-প্রতীতিঃ কল্পনা।’ (ন্যায়বিন্দু-১/৫)
অর্থাৎ : অভিলাপের দ্বারা সম্বন্ধ যোগ্যের প্রতিভাসরূপ প্রতীতি হচ্ছে কল্পনা।

যার দ্বারা অভিধান করা যায় তা হচ্ছে অভিলাপ অর্থাৎ বাচক শব্দ। অভিলাপের সাথে সংসর্গ (=সম্বন্ধ) অভিলাপসংসর্গ, অর্থাৎ একটি জ্ঞানে অভিধানাকারের সাথে গ্রাহ্যাকাররূপে অভিধেয়-আকারের মিলন। এভাবে যখন একটি জ্ঞানে বাচ্য ও বাচক উভয়ের আকার প্রতিভাসিত (=সন্নিবিষ্ট) হয় তখন বাচক ও বাচ্য সম্পৃক্ত (=সংসর্গযুক্ত) হয়ে যায়। তাই ধর্মকীর্তির কল্পনার সরল ব্যাখ্যাটি হলো- ‘বিষয়ের বা বস্তুর যে জ্ঞান শব্দার্থের থেকে জন্মায় তা সেই বিষয়েরই কল্পনা।’ একইভাবে দিঙনাগ তাঁর ‘প্রমাণসমুচ্চয়ে’র স্বোপজ্ঞবৃত্তিতে কল্পনার স্বরূপের প্রতিপাদন করতে গিয়ে বলেছেন-
‘অর্থ কল্পনা চ কীদৃশ্য চেদাহ নামজাত্যাদিযোজনা।’ (প্রমাণসমুচ্চয়বৃত্তি)
অর্থাৎ : অর্থে যে নাম ও জাত্যাদির যোজনা, অর্থাৎ যোগ, তাই কল্পনা।

অতএব, যে জ্ঞানে বস্তুর স্বরূপ পদার্থ প্রকাশযোগ্য শব্দের বিষয় নয় সেসব জ্ঞানই প্রত্যক্ষ। তার মানে এটি হচ্ছে নির্বিকল্পক জ্ঞান। কেননা নির্বিকল্পক জ্ঞান জাতি, দ্রব্য, গুণ, কর্ম ও নাম- এই পাঁচ প্রকার বিকল্পের দ্বারা যুক্ত হয় না। এই বিকল্পগুলোই হচ্ছে শব্দের প্রকাশযোগ্য বিষয়। কোন বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষের ফলে ঐ বস্তুটির একটি বিশেষ আকৃতি আমাদের মনে গ্রথিত হয়, এবং তা কল্পনা-রহিত। অতএব কল্পনারহিত জ্ঞান মানে অজ্ঞাত অর্থ প্রকাশক জ্ঞান। প্রথম দেখার পর বস্তুটির প্রতিবিম্বের একটা স্থায়ী ছাপ মস্তিষ্কে পড়ে, এরপর মস্তিষ্কে সংস্কাররূপী পূর্বদৃষ্ট যে প্রতিবিম্ব সংরক্ষিত থাকে তা থেকেই পরবর্তীকালে একটি নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি হয়- এবং কল্পনার সূত্রপাত হয়। অতঃপর বিভিন্ন বিকল্পের মাধ্যমে বস্তুটির জ্ঞানে সামান্যলক্ষণজনিত বৈশিষ্ট্য আরোপিত হয়ে সবিকল্পক জ্ঞান হয়ে ওঠে। কল্পনা আরোপিত বলে এই সবিকল্পক জ্ঞানকে বৌদ্ধমতে প্রত্যক্ষ বলে স্বীকার করা হয় না।

নাম, জাতি, গুণ, ক্রিয়া ও দ্রব্য- এই পাঁচটি বিকল্প বা কল্পনাকে ‘পঞ্চকল্পনা’ বলা হয়। এই পঞ্চকল্পনারহিত জ্ঞানের বিষয়কে বলা হয় স্বলক্ষণ। কারণ এই স্বলক্ষণ থেকেই বস্তুর আত্মবৈশিষ্ট্য জানা যায়। এইরূপ স্বলক্ষণের জ্ঞানকে বলা হয় প্রত্যক্ষ। ধর্মকীর্তি ‘ন্যায়বিন্দু’ গ্রন্থে প্রত্যক্ষের লক্ষণে বলেছেন-
‘প্রত্যক্ষম্ কল্পনাপোঢ়ম্ অভ্রান্তম্’। (ন্যায়বিন্দু-১/৪)
অর্থাৎ : কল্পনাপোঢ় বা কল্পনারহিত ও অভ্রান্ত জ্ঞানই হলো প্রত্যক্ষজ্ঞান।

দিঙনাগের লক্ষণে ‘অভ্রান্ত’ পদটির উল্লেখ নেই। তবে দিঙনাগ ভ্রান্তজ্ঞানকে যেহেতু কল্পনার অন্তর্গত করেছেন সেহেতু তাঁর মতে কল্পনারহিত জ্ঞানই হলো অভ্রান্তজ্ঞান। ‘প্রমাণবার্ত্তিকে’ ধর্মকীর্তি এইরূপ প্রত্যক্ষকে নির্বিকল্পক বলে উল্লেখ করেছেন। দিঙনাগও প্রত্যক্ষ বলতে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষকেই বুঝিয়েছেন। সায়ণ মাধবাচার্য ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে এই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষের বর্ণনায় এমন বৌদ্ধ উক্তিই উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
‘তদুক্তম্-
কল্পনাপোঢ়মভ্রান্তং প্রত্যক্ষং নির্বিকল্পকম্ ।
বিকল্পোবস্তুনির্ভাসাদসংবাদাদুপপ্লবঃ।। ইতি।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : তাই বলা হয়েছে- কল্পনারহিত অভ্রান্ত অর্থাৎ অর্থক্রিয়াসমর্থ বস্তুস্বরূপে অবিপর্য্যস্ত নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষই প্রমাণ। বিকল্প অর্থাৎ সবিকল্পক জ্ঞান অবস্তু নির্ভাসস্বরূপ ও সংবাদরহিত বলে উপপ্লব অর্থাৎ মিথ্যা।

ধর্মকীর্তির সংজ্ঞাটিকে আরেকটু খোলাশা করে বললে বলা যায়- ‘ইন্দ্রিয় মন ও বিষয়ের সংযোগে সম্পূর্ণভাবে কল্পনা-রহিত জ্ঞান তথা যা অজ্ঞাত অর্থের প্রকাশ করে তাই প্রত্যক্ষ, এবং তা কেবলমাত্র প্রতি অক্ষের দ্বারা সিদ্ধ।’ এইভাবে প্রত্যক্ষ সেই অবিসংবাদী (= অর্থক্রিয়ার অনুসরণকারী) অজ্ঞাত অর্থের প্রকাশক জ্ঞান, যা কিনা বিষয় সম্পর্কের দ্বারা আগের মুহূর্তেই হয়, যখন কল্পনা সেখানে প্রাধান্য পায় না।

এখানে উল্লেখ্য যে, সংস্কৃত ব্যাকরণ-দর্শনের মহারথী প্রাচীন বৈয়াকরণ ভর্ত্তৃহরি তাঁর বিখ্যাত ‘বাক্যপদীয়’ গ্রন্থে শব্দজ্ঞান প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে-
‘ন সোহস্তি প্রত্যয়ো লোকে যঃ শব্দানুগাদৃতে।
অনুবিদ্ধমিব জ্ঞানং সর্বং শব্দেন ভাসতে।।’ (বাক্যপদীয়-১/১২৩)
অর্থাৎ : সংসারে এমন কোন জ্ঞান নেই যা শব্দব্যতিরেকে হয়। সকল প্রকার জ্ঞানই যেন শব্দের দ্বারা অনুবিদ্ধ হয়ে প্রকাশ পায়।

কিন্তু ভর্ত্তৃহরির এই প্রসিদ্ধ মত মেনে নিলে সবিকল্পক জ্ঞানকেও প্রমাণ বলে মানতে হয়। এই মতের বিরোধিতা করে বৌদ্ধ দার্শনিকরা বলেন, সম্মুখের ঘট উচ্চারিত হলে সেই ঘটের নিকটবর্তী ভূতল প্রভৃতির জ্ঞান উচ্চারণরহিত অনুভূত হয়। সেখানে কোন শব্দানুবিদ্ধতা থাকে না। কেননা একসাথে দুটি বিকল্পের জ্ঞান হয় না। যদি বলা হয়, কল্পনাজ্ঞান বিষয় থেকে উৎপন্ন হয় তবে তার দ্বারা ঘটাদি বিষয়ও দৃষ্ট হবে। ফলে অন্ধ ব্যক্তির রূপদর্শনের আপত্তি হবে, কিন্তু অন্ধ রূপ দর্শন করতে পারে না। তাই ভর্ত্তৃহরির মত খণ্ডন করে বৌদ্ধাচার্য বলেছেন-
‘শাব্দ্যাং বুদ্ধাবর্থস্য প্রত্যক্ষ ইব প্রতিভাসাভাবাদ্ নাস্তি কল্পনায়া অর্থসাক্ষাৎকারিত্বম্’ ইতি।
অর্থাৎ : শাব্দী বুদ্ধিতে বিষয়ের প্রত্যক্ষের মতো প্রতিভাস হয় না বলে কল্পনা বিষয়ের সাক্ষাৎকারী হয় না।

যা ভ্রম নয় তা অভ্রান্ত। ভ্রান্ত জ্ঞানও বিষয়ের সাক্ষাৎকারী হয় না। কেননা ভ্রান্ত জ্ঞানটি তথা অর্থক্রিয়াক্ষম বস্তুস্বরূপটি নিয়ত দেশ ও কালের আকারে হয়ে থাকে। ফলে বিপরীত প্রতিভাসমান ভ্রান্ত জ্ঞান সাক্ষাৎকারী হয় না। এ প্রসঙ্গে বৌদ্ধাচার্য ধর্মকীর্তি বলেছেন-
‘তিমিরাশুভ্রমণনৌযানসংক্ষোভাদ্যনাহিতবিভ্রমং জ্ঞানং প্রত্যক্ষম্’। (ন্যায়বিন্দু-১/৬)
অর্থাৎ : তিমির (চক্ষুরোগ), শীঘ্রতার দরুন ঘূর্ণন, নৌকার গতি, বাতাদি প্রকোপ দ্বারা ভ্রম উৎপন্ন করে না এমন হচ্ছে প্রত্যক্ষ।

মোটকথা হচ্ছে, ভ্রান্তি বা কল্পনা বিষয়ের সাক্ষাৎকারী হয় না বলে এরকম জ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞান নয়। সুতরাং দেখা যায় যে, বৌদ্ধমতে প্রত্যক্ষমাত্রই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ এবং এই নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষই প্রমাণ। সবিকল্পক প্রত্যক্ষ এই মতে ভ্রান্তজ্ঞান।

বৌদ্ধমতে প্রত্যক্ষজ্ঞান চার প্রকার। এই চার প্রকার প্রত্যক্ষ হলো- (১) ইন্দ্রিয়-বিজ্ঞান বা ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ, (২) মনোবিজ্ঞান বা মানস-প্রত্যক্ষ, (৩) আত্ম-সংবেদন বা স্বসংবেদন-প্রত্যক্ষ ও (৪) যোগিজ্ঞান বা যোগী-প্রত্যক্ষ।

(১) ইন্দ্রিয়জ্ঞান-প্রত্যক্ষ : ইন্দ্রিয়ের অর্থাৎ ইন্দ্রিয় জন্য জ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয়জ্ঞান। বৌদ্ধন্যায়ে জ্ঞানই হচ্ছে প্রমাণ, ইন্দ্রিয় নয়। যাঁরা ইন্দ্রিয়কে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন, যেমন মীমাংসক কুমারিলভট্ট ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ বিষয়ে ‘শ্লোকবার্ত্তিকে’ বলেছেন-
‘যদ্বেন্দ্রিয়ং প্রমাণং স্যাত্তস্য বার্থেন সঙ্গতিঃ’। (শ্লোকবার্ত্তিক-১/১/৪/৬০)
অর্থাৎ : বিষয়ের সাথে সঙ্গতি থাকায় ইন্দ্রিয়কে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলা হয়।

কিন্তু ইন্দ্রিয়কে প্রমাণরূপে স্বীকারকারী মীমাংসকদের এই মতকে বৌদ্ধ দার্শনিকরা স্বীকার করেন না। বৌদ্ধমতে চক্ষু প্রভৃতি পঞ্চ-ইন্দ্রিয়কে আশ্রয় করে বাহ্য রূপ প্রভৃতি পাঁচটি বিষয়ের আলম্বন হচ্ছে ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ। তারমধ্যে চক্ষুর্বিজ্ঞান হচ্ছে রূপবিষয়। এভাবে শব্দবিষয় হচ্ছে শ্রোত্রবিজ্ঞান, গন্ধবিষয় হচ্ছে ঘ্রাণবিজ্ঞান, রসবিষয় হচ্ছে জিহ্বাবিজ্ঞান এবং স্পর্শবিষয় হচ্ছে কায়বিজ্ঞান। ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ এই ব্যপদেশের অসাধারণ কারণটি হচ্ছে নিমিত্ত।

বৌদ্ধাচার্য ধর্মকীর্তি তাঁর ‘প্রমাণবার্ত্তিকে’ ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জ্ঞান নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে-
‘নানা রকম চিন্তনকে দূর করে স্থিরচিত্তে পুরুষ যখন শুধু রূপকে দেখে তখন তাকেই বলে ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ জ্ঞান (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/১২৪)। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ হওয়ার ‘পর যখন সে কিছু কল্পনা করে তখন সে জানতে পারে আমার মনে এই কল্পনা হলো; কিন্তু এই কথা পূর্বোক্ত ইন্দ্রিয়-জ্ঞানের সময়ে মনে হয় না (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/১২)। ‘তাই সমস্ত ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষই হয় (ব্যক্তি-) বিশেষের ক্ষেত্রে; বিশেষ বস্তুর স্বরূপ সামান্যলক্ষণ থেকে মুক্ত স্ব-লক্ষণ মাত্র, তাই তার মধ্যে শব্দের প্রয়োগ হতে পারে না (প্রমাণবার্ত্তিক-৫/১২৭)। ‘ঘট বস্তু, ঘট শব্দটি তার বাচক, এইভাবে বাচ্য-বাচকের সম্বন্ধের মধ্যে যে পদার্থ প্রতিভাসিত হয়, তাই-ই বাচ্য-বাচকের সম্বন্ধ নির্ণয় করে (আর যে সময়ে বাচ্য-বাচকের সম্বন্ধের প্রতি কল্পনা প্রসারিত হয়) তখনই ইন্দ্রিয়ের সামনে থেকে বস্তু দূরে সরে যায় (এবং মন তার সংস্কারের ভিতর নতুন ও পুরাতন কল্পনা চিত্রকে মিশ্রিত করে নামকরণের চেষ্টায় নিযুক্ত হয়) (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/১২৯)।

ধর্মকীর্তি আরো বলেছেন-
‘শঙ্করস্বামী প্রমুখ কয়েকজন বৌদ্ধ প্রমাণ-শাস্ত্রী প্রত্যক্ষজ্ঞান ইন্দ্রিয়জাত হওয়াতে তা শব্দজ্ঞানবর্জিত শিশুর জ্ঞানের মতে কল্পনা-বর্জিত জ্ঞান বলেছেন। শিশুর জ্ঞান কল্পনা-রহিত হওয়ায় বাচ্য-বাচকরূপে শব্দ-অর্থের সম্বন্ধে সঙ্কেত (=বিকল্প) জ্ঞান তার হয় না। এঁদের মতে কল্পনার সম্পূর্ণ অভাব থাকায় শিশুর সব জ্ঞানই কেবলমাত্র প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং শিশুর সংকেত জানবার কোন উপায় না থাকলে তার সংকেত-জ্ঞান হওয়া সম্ভব নয় (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/১৪১-৪২)।

(২) মানস-প্রত্যক্ষ : বৌদ্ধাচার্য দিঙনাগ তাঁর ‘প্রমাণসমুচ্চয়ে’ মানস-প্রত্যক্ষের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘পদার্থের প্রতি অনুরাগ (কল্পনা-রহিত জ্ঞান) ইত্যাদি হলো মানস-প্রত্যক্ষ।
কিন্তু মানস-প্রত্যক্ষে যদি প্রথমে প্রথমে ইন্দ্রিয় দ্বারা লব্ধ অর্থকে (জ্ঞানকেই) গ্রহণ করা হয় তাহলে মানস-প্রত্যক্ষ স্বতন্ত্র প্রত্যক্ষ থাকে না, কেননা এই অবস্থায় প্রথম জ্ঞাত অর্থের প্রকাশক হওয়ায় তা আর অজ্ঞাত-অর্থের প্রকাশক নয়, অতএব তা প্রমাণও নয়। যদি ইন্দ্রিয়জ্ঞান দ্বারা অ-দৃষ্টকে (অর্থাৎ মানস-প্রত্যক্ষকে) মানা যায় তাহলে অন্ধেরও রূপাদির দর্শন হওয়া সম্ভব মানতে হবে। তাই ভাট্টমীমাংসক কুমারিল দিঙনাগের মানস-প্রত্যক্ষের লক্ষণে দোষ দেখিয়ে তাঁর ‘শ্লোকবার্ত্তিকে’ বলেছেন যে, গৃহীতগ্রাহী হওয়ায় মানস প্রত্যক্ষ প্রমাণ হতে পারে না।
এসব চিন্তা করে বৌদ্ধাচার্য ধর্মকীর্তি মানস-প্রত্যক্ষের লক্ষণ ব্যাখ্যায় বলেছেন-
‘স্ববিষয়ানন্তরবিষয় সহকারিণেন্দ্রিয়জ্ঞানেন সমনন্তরপ্রত্যয়েন জনিতং তন্মনোবিজ্ঞানম্ ইতি’। (ন্যায়বিন্দু-১/৯)
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয়ের যে জ্ঞান হয় তাকে অনন্তর-প্রত্যয় করে যে চেতনা উৎপন্ন হয় তাই-ই মানস-প্রত্যক্ষ।

ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান থেকে ভিন্ন বিষয়কে মানস-প্রত্যক্ষে গ্রহণ করা হয়, অতএব তা জ্ঞান অর্থের প্রকাশক নয়, একই সঙ্গে মন দ্বারা প্রত্যক্ষ রূপাদির জ্ঞান ইন্দ্রিয় থেকে জ্ঞাত রূপাদির সঙ্গে সংবদ্ধ, যা কিনা অন্ধ ব্যক্তি দেখতে পায় না; অতএব অন্ধের (রূপ-দেখবার) প্রশ্ন ওঠে না। বৌদ্ধমতে প্রত্যেক প্রত্যক্ষ জ্ঞানে তার একটি ক্ষণ থাকলে তা ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বিষয়ক্ষণের পরবর্তী ক্ষণ হয়। ইন্দ্রিয়জ্ঞান ও বিকল্পজ্ঞানের মধ্যে মৌলিক ভেদ স্থাপন করে প্রমাণবাদের সহকারিরূপে মানস-প্রত্যক্ষ উপযোগী হয়। ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে বাহ্য ঘট প্রভৃতি, তার পরবর্তী। ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বিষয় হতে মনোজ্ঞান বা মানস-প্রত্যক্ষের বিষয় ভিন্ন হয় বলে জ্ঞাত বস্তুর গ্রহণ করায় আরোপিত অপ্রমাণতা দূর হয়ে যায়।

ইন্দ্রিয়জ্ঞানের বিষয় (প্রথম ক্ষণ) হতে উৎপন্ন (উপাদেয় ভূত) বস্তুর দ্বিতীয় ক্ষণই মনোজ্ঞানের বিষয় স্বীকার করা হয়েছে। সেকারণে দোষপ্রসঙ্গ নিরাকৃত হয়। ফলে মানস জ্ঞানের দ্বারা ইন্দ্রিয়জ্ঞানে অগৃহীত অন্য বস্তু (=বিষয়ান্তরের) গ্রহণ হয় বলে অন্ধ বধির প্রভৃতি প্রসঙ্গ থাকে না। মানসজ্ঞান হচ্ছে ইন্দ্রিয়জন্য। অন্ধ প্রভৃতির রূপাদি বিষয়-আলম্বনক ইন্দ্রিয়জ্ঞান হয় না। ফলে ইন্দ্রিয়জ্ঞান হতে উৎপন্ন মানস জ্ঞান সম্ভব নয়। জ্ঞানত্বের দিক দিয়ে সমান এবং অব্যবহিতত্বের দিক দিয়ে অনন্তর (=পরবর্তী) সেই প্রত্যয় হেতু হওয়ায় সমনন্তর প্রত্যয় হয়। সমনন্তর প্রত্যয় দ্বারা উৎপন্ন। সমনন্তর-প্রত্যয়টি বিশেষণ হওয়ায় মানস প্রত্যয়ের প্রসঙ্গ নিরস্ত হয়। সূক্ষ্ম কালে উৎপন্ন হয় বলে সাধারণ মানুষ দেখতে পারে না ও ব্যবহারের অঙ্গ বলে স্বীকার করায় অব্যবহারিত্ব নামক দোষ যুক্তিযুক্ত নয়।

(৩) স্বসংবেদন প্রত্যক্ষ : বৌদ্ধাচার্য দিঙনাগ স্বসংবেদন-প্রত্যক্ষের লক্ষণ নিরূপণ করতে গিয়ে তাঁর ‘প্রমাণসমুচ্চয়ে’ বলেছেন-
‘অর্থরাগাদি স্বসংবিত্তিরকল্পিকা’- (প্রমাণসমুচ্চয়)
অর্থাৎ : (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ সম্বন্ধে জ্ঞান যখন অন্তরগ্রাহ্য জ্ঞানে পরিণত হয়), তখন অর্থের প্রতি যে রাগাদি অনুভূত হয়, সেই কল্পনা-রহিত জ্ঞানকেই বলে স্বসংবেদন-প্রত্যক্ষ।

স্বসংবেদন-প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে দিঙনাগের এই অর্থকে অধিকতর স্পষ্ট করে ধর্মকীর্তি বলেছেন- 
‘রাগ (সুখ) ইত্যাদি যে স্বরূপকে আমরা অনুভব করি তা অন্য কোন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না, এবং তার স্বরূপের ক্ষেত্রে বাচ্য-বাচক কোন সংকেত প্রযোজ্য হতে পারে না, তার যে আন্তরিক সংবেদন হয় তা প্রকটিত হতে অক্ষম।’ (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/২৪৯)

এইভাবে অজ্ঞাত অর্থের প্রকাশক, কল্পনা-রহিত তথা অবিসংবাদী হওয়ায় আমরা যে রাগ-সুখাদি অনুভব করি সেই স্বসংবেদন-প্রত্যক্ষও ইন্দ্রিয় এবং মানস-প্রত্যক্ষ থেকে ভিন্ন। ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের মাধ্যমে আমরা কোন বিশেষ বিষয় বা বস্তুর রঙ-রূপ-গন্ধ সম্পর্কে জ্ঞান প্রাপ্ত হই; মানস-প্রত্যক্ষের দ্বারা সেই জ্ঞান আরও পরিণত হয় এবং ঐ নির্দিষ্ট বিষয় সম্বন্ধে অনুভূতিকে আরও তীক্ষ্ণ করে। অতএব ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ ও মানস-প্রত্যক্ষ বিশেষভাবেই বস্তুসম্বন্ধীয়। কিন্তু স্বসংবেদন প্রত্যক্ষের মাধ্যমে আমরা ইন্দ্রিয়জ্ঞান এবং তারও পরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রাগ দ্বেষ বা সুখ-দুঃখের …সন্ধান পাই।

(৪) যোগী-প্রত্যক্ষ : বৌদ্ধগণ উপরিউক্ত তিন প্রকার প্রত্যক্ষ ছাড়াও অতিরিক্ত একটি প্রত্যক্ষের কথা স্বীকার করেন, যার নাম যোগী-প্রত্যক্ষ। যোগী-প্রত্যক্ষের দ্বারা যোগীদের ভাবী বিষয়ের জ্ঞান হয়। অজ্ঞাত প্রকাশক অবিসংবাদী- প্রত্যক্ষের এই বিশেষণ এখানেও গ্রহণ করে বলা হয়েছে যে, যোগীদের এই জ্ঞান ভাবনা-চিন্তা থেকে উদ্ভূত, কল্পনা-রহিত, স্পষ্টতই বিভাসিত। যে জ্ঞানের মধ্যে ভ্রম বা বিকল্প (কল্পনা) মিশ্রিত থাকে তা স্পষ্ট পদার্থরূপে বিভাসিত হতে পারে না। সমাধি (=একাগ্রচিত্ততা) প্রভৃতি ভাবনা দ্বারা প্রাপ্ত যতো জ্ঞান আছে তার সবই কিন্তু যোগী-প্রত্যক্ষের প্রমাণের মধ্যে পড়ে না, বরং ‘তার মধ্যে সেই চিন্তাপ্রসূত জ্ঞান প্রত্যক্ষ-প্রমাণের দ্বারা অভিপ্রেত; বাকি সবই ভ্রম।’- (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/২৮৬)। তাই ধর্মকীর্তির মতে-
‘ভূতার্থভাবনাপ্রকর্ষপর্যন্তজং যোগিজ্ঞানং চ ইতি’।
অর্থাৎ : যথার্থ বিষয়ের ভাবনার প্রকর্ষ পর্যন্ত হতে যোগীদের উৎপন্ন জ্ঞান হচ্ছে চতুর্থ প্রকার প্রত্যক্ষ।

যোগ হচ্ছে সমাধি যার অর্থ চিত্তের একাগ্রতা। এখানে যোগ বলতে সমস্ত বস্তুর যথার্থ জ্ঞানাত্মক প্রজ্ঞাকেও বুঝানো হয়েছে। যোগ যার আছে সে হচ্ছে যোগী। যোগীর যে জ্ঞান হয় তা হচ্ছে প্রত্যক্ষ। সেই জ্ঞান কিরূপ? এই জিজ্ঞাসায় বলা হচ্ছে যে, যথার্থ বস্তুর ভাবনার প্রকর্ষপর্যন্ত। যথার্থ বস্তু হচ্ছে প্রমাণের দ্বারা নিশ্চিত বিষয়। ভাবনা হচ্ছে বার বার মনে সমাবেশ। ভাবনার প্রকর্ষ বলতে ভাব্যমান বিষয়ের জ্ঞানের পরিষ্কার প্রকাশের আরম্ভ। প্রকর্ষপর্যন্ত বলতে প্রকর্ষের চরমাবস্থার পূর্বাবস্থাকে বুঝানো হয়েছে, যখন পরিষ্কার প্রকাশে কিছুটা অপূর্ণত্ব থাকে। কেননা পরিষ্কার আভাস যে-যাবৎ অপূর্ণ থাকে সে-যাবৎ তাতে প্রকর্ষের তারতম্য থাকে। যখন পরিষ্কার আভাস পূর্ণ হয় তখন প্রগতি হয় না। এভাবে পূর্ণাবস্থার পূর্ববর্তী অবস্থাকে পরিষ্কার আভাসের প্রকর্ষপর্যন্ত বলা হয়। যথার্থ ভাবনার প্রকর্ষপর্যন্ত হতে ভাব্যমান বিষয়ের সন্নিহিতের মত পরিষ্কার আকারের গ্রহণকারী যে জ্ঞান হয় তা হচ্ছে কল্পনারহিত ও অভ্রান্ত যোগীজ্ঞান নামক প্রত্যক্ষ।
.

প্রত্যক্ষাভাস :
বৌদ্ধমতে চার প্রকার প্রত্যক্ষের আলোচনায় দেখা যায় যে, নির্বিকল্পক জ্ঞানের বিষয়ীভূত যে বস্তু তা হচ্ছে সত্য। কেননা নির্বিকল্পক জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলা হয়েছে। গ্রাহ্য হতে ভিন্ন সবিকল্পক জ্ঞানের বিষয়ীভূত অধ্যবসেয় বস্তু নয়, কিন্তু তুচ্ছ। গ্রহণ হতে ভিন্ন যে সবিকল্পক জ্ঞানের বিষয়ীভূত অধ্যবসায়াত্মক তা প্রমাণ নয়। সবিকল্পক জ্ঞান শব্দজ, লিঙ্গজ বা ইন্দ্রিয়জন্য হলে তাকে প্রমাণ বলা হয় না। যেমন- ‘আমাদের গ্রামে নদীতীরে পাঁচটি ফল আছে’ এরূপ শব্দ শুনে শ্রোতা অন্যত্র পূর্বদৃষ্ট তীরের সদৃশাকার তীর কল্পনা করে। সেখানে সেরূপ ফলগুলির কল্পনা করে। এভাবে অনুগত আকারের সদৃশগ্রাহী শাব্দজ্ঞান কল্পিত বিষয় বলে প্রমাণ হয় না। লীন বিষয়ের জ্ঞাপক বলে লিঙ্গ শব্দের দ্বারা ধূম প্রভৃতিকে বুঝানো হয়। তার জন্য জ্ঞান হচ্ছে অনুমিতি। পর্বতে ধূম দেখে মহানস বা পাকশালা প্রভৃতিতে পূর্বদৃষ্ট অগ্নির সদৃশাকার অগ্নি সেখানে কল্পনা করা হয়। সুতরাং এই জ্ঞানও পূর্বের মতো কল্পিত বিষয় বলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়। এরূপ ইন্দ্রিয়জ সবিকল্পক জ্ঞান কল্পিত বিষয়ক হয় বলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়।

কিন্তু এমন জ্ঞানও আছে যা প্রত্যক্ষ-প্রমাণ নয় কিন্তু দেখলে (আপাতদৃষ্টিতে) প্রত্যক্ষ বলে মনে হয়; তাকে বলে প্রত্যক্ষাভাস। এক্ষেত্রে আভাস অর্থ ভ্রম বা অসত্য। প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে এরূপ প্রত্যক্ষাভাসের সঙ্গে পরিচিত না থাকলে আমাদের ভুল পথে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বৌদ্ধাচার্য দিঙনাগ তাঁর ‘প্রমাণসমুচ্চয়ে’ এরকম চারটি প্রত্যক্ষাভাসের কথা বলেছেন-
‘ভ্রান্তিসংবৃত্তিসজ্ জ্ঞানং অনুমানানুমানিকম্ ।
স্মার্তাভিলাপিকং চেতি প্রত্যক্ষাভং সতৈমিরম্’।। (প্রমাণসমুচ্চয়)
অর্থাৎ : অনুমান ও আনুমানিকের সংকেতবাদী ভ্রান্তি, সংবৃত্তি ও স্মার্তাভিলাপিক জ্ঞান এবং বিকারযুক্ত তৈমিরি জ্ঞান- এই চারটি প্রত্যক্ষাভাস।

মরীচিকায় জলের জ্ঞান ভ্রান্তিজ্ঞান, নামমাত্র দ্রব্যের রূপগুণাদির জ্ঞান সংবৃত্তি বা ব্যবহারিক জ্ঞান, অনুমান ও আনুমানিকের সংকেতবাদী স্মৃতির অভিলাপযুক্ত জ্ঞান হচ্ছে স্মার্তাভিলাপিক জ্ঞান, এবং ইন্দ্রিয় বিকারযুক্ত জ্ঞান হলো তৈমিরি জ্ঞান। বৌদ্ধমতে এসব জ্ঞান প্রত্যক্ষাভাস বলে তা প্রত্যক্ষজ্ঞানে আসতে পারে না। ফলে এসব প্রমাণ বলে স্বীকৃত হয় না।
.

(খ) অনুমান প্রমাণ
বৌদ্ধমতে জ্ঞানগত বস্তুস্বারূপ্যই প্রমাণ। একমাত্র ইন্দ্রিয় সন্নিকর্ষই জ্ঞানগত বস্তুস্বারূপ্যের জনক হতে পারে। এজন্য একমাত্র প্রত্যক্ষই যথার্থ প্রমাণ পদবাচ্য। কিন্তু বৌদ্ধগণ অনুমানকেও প্রমাণ বলেন। অনুমানকে প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষে ধর্মকীর্তি ‘প্রমাণবার্ত্তিকে’ বলেছেন- অনুমিতি ব্যাপ্তিপূর্বক হওয়ায় অনুমানের দ্বারাও যথাযথ বিষয় লাভ করা যায় এবং অনুমান প্রাপক হয়। এই কারণে অনুমানকেও প্রমাণ বলে স্বীকার করতে হয়।
যেমন, অগ্নির জ্ঞান দুইভাবে হতে পারে। এক, তার নিজের স্বরূপে, যেমন হয় অগ্নি প্রত্যক্ষ করলে; দ্বিতীয়ত, অন্যের রূপে যেমন রান্নাঘরের ধূম দেখলে অন্য আর এক রকম অগ্নির রূপের ধারণা হয় এবং এই দ্বিতীয় রূপে ধূম-চিহ্ন যুক্ত যে অগ্নির জ্ঞান হয়- সেটা অনুমান। প্রথমত অগ্নি-প্রত্যক্ষ দ্বারা, অর্থাৎ তার স্বরূপ থেকে, দ্বিতীয়ত তার পরোক্ষ রূপ ধোঁয়া থেকে; প্রথমটি প্রমাণ, দ্বিতীয়টি অনুমান। কিন্তু পদার্থের স্বরূপ এবং পর-রূপ দুই প্রকারেই হয়, অতএব প্রমাণের বিষয়ও দুই প্রকার হয়- এক, প্রত্যক্ষ প্রমাণের বিষয়, দ্বিতীয়, অনুমানের বিষয়। তাই ধর্মকীর্তি বলেছেন-
‘বস্তুর স্বরূপের মধ্যে কল্পনাহীন প্রত্যক্ষ প্রমাণের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তার যে সামান্য রূপ, তাকে কল্পনা ব্যতীত গ্রহণ করা যায় না, তাই সামান্য জ্ঞানের জন্য অনুমানের দরকার হয়’ (প্রমাণবার্ত্তিক-৩/৭৫)।
আর ‘ন্যায়বিন্দুটীকা’য় ধর্মোত্তরও বলেছেন-
‘অর্থ অবিনাভাবিত্বাৎ অনুমানমপি পরিচ্ছিন্নমর্থং প্রাপয়ৎ প্রমাণমিতি।’ (ন্যায়বিন্দুটীকা)
অর্থাৎ : অনুমিতি বিকল্পবিজ্ঞান হলেও অনুমিতির দ্বারা যে প্রবৃত্তি উৎপন্ন হয় তা যথাযথ বস্তুর প্রাপক হয় বলে অনুমিতির প্রামাণ্য স্বীকার করতে হয়।

বৌদ্ধাচার্য দিঙনাগ তাঁর ‘প্রমাণসমুচ্চয়’ গ্রন্থে এবং ধর্মকীর্তি তাঁর ‘ন্যায়বিন্দু’ গ্রন্থে অনুমানের কোন সামান্যলক্ষণ নির্দেশ করেননি। ‘ন্যায়বিন্দুটীকা’য় ধর্মোত্তর বলেছেন, স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান অত্যন্ত ভিন্ন হওয়ায় অনুমানের সামান্যলক্ষণ দেয়া সম্ভব নয়। স্বার্থানুমান জ্ঞানাত্মক ও পরার্থানুমান বাক্যাত্মক হওয়ায় অভিন্ন তথা একটিমাত্র লক্ষণের দ্বারা উভয়প্রকার অনুমান নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে ‘অনুমান’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকেই অনুমানের সামান্যলক্ষণ নির্ধারিত হতে পারে।
‘অনু’পূর্বক ‘মা’ ধাতুর করণবাচ্যে বা ভাববাচ্যে ল্যুট্ প্রত্যয় যোগে ‘অনুমান’ শব্দটি নিষ্পন্ন হয়। ‘অনু’ উপসর্গের অর্থ পশ্চাৎ এবং ‘মা’ ধাতুর অর্থ জ্ঞান। সুতরাং ভাববাচ্যে ল্যুট্ প্রত্যয় করে ‘অনুমান’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় পশ্চাৎজ্ঞান। করণবাচ্যে ল্যুট্ প্রত্যয় করে ‘অনুমান’ শব্দের অর্থ হয় পশ্চাৎজ্ঞানের করণ। বৌদ্ধমতে প্রমাণ ও প্রমিতি অভিন্ন হওয়ায় অনুমান ও অনুমিতির করণের ভেদ বৌদ্ধজ্ঞানতত্ত্বে নগন্য। ধর্মোত্তর বলেছেন, নিশ্চিত লিঙ্গগ্রহণ এবং হেতু ও সাধ্যের ব্যাপ্তিসম্বন্ধ স্মরণের পরবর্তী প্রমাণ বলেই এর নাম অনুমান।

অনুমিতির লক্ষণ :
প্রমাণবার্ত্তিকে ধর্মকীর্তি বলেছেন, দুটি ধর্মের অন্বয় ও ব্যাতিরেক সম্বন্ধ বশত কোন স্থানে একটি ধর্ম দর্শন করে অপর ধর্মটির প্রতীতিই হলো অনুমিতি বা অনুমান। অর্থাৎ কোন পদার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত পদার্থ থেকে- যেমন অগ্নি ও ধূম সম্পর্কযুক্ত- মূল বিষয় জ্ঞান হয়, একেই বলে অনুমান। পর্বতে ধূম দর্শন করে  এবং ধূম ও অগ্নির ব্যাপ্তি স্মরণ করে পর্বতটি বহ্নিমান বলে যে জ্ঞান তাই অনুমান।
সুতরাং দেখা যায় যে, বৌদ্ধরা অনুমিতিকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন কারণ, তাঁদের মতে অনুমিতিতে অর্থাৎ অনুমিত্যাত্মক যে জ্ঞান তাতে প্রবৃত্তিবিষয়ীভূতার্থ-প্রদর্শকত্বরূপ অবিসংবাদকত্ব আছে। অনুমানের ক্ষেত্রে তিন প্রকার লিঙ্গ দর্শন এবং পক্ষে সাধ্যের নিশ্চয় থেকে লোকে তাতে প্রবৃত্ত হয় এবং ফল লাভ করে। সুতরাং প্রত্যক্ষে যেমন অবিসংবাদকত্ব থাকায় তা প্রমাণ বলে স্বীকৃত হয়েছে, তেমনি অনুমিতিতেও বা অনুমিত্যাত্মক জ্ঞানে প্রবৃত্তিবিষয়ীভূতার্থ-প্রদর্শকরূপে অবিসংবাদকত্ব আছে বলে অনুমিত্যাত্মক জ্ঞানটিরও প্রমাত্ব স্বীকৃত হয়েছে।

সায়ণ মাধবীয় ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ বলা হয়েছে যে-
‘নামজাতিগুণদ্রব্যক্রিয়ারূপেণ পঞ্চধা।
লিঙ্গদর্শনতো জ্ঞানং লিঙ্গিন্যত্রানুমানতা।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : সেই প্রমাণকেই কল্পনা বলা হয় যার দ্বারা লিঙ্গের (=হেতুর) দর্শন হতে নাম, জাতি, গুণ, দ্রব্য এবং ক্রিয়ারূপ লিঙ্গীর (=সাধ্যের) জ্ঞান হয়। এই কল্পনাকে অনুমান বলা হয়।

পদার্থের যে ধর্মকে দেখে কল্পনা দ্বারা তার অস্তিত্বকে আমরা অনুভব করি তাই-ই হেতু বা লিঙ্গ। ধর্মকীর্তি বলেছেন, হেতু তিন প্রকার- কার্য, স্বভাব, অনুপলব্ধি হেতু।
ধোঁয়া দেখে অগ্নির অনুমান কার্য হেতু, কেননা ধোঁয়া অগ্নির কার্য। বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে এটা বৃক্ষ। শাখা-পত্রাদিই বৃক্ষের স্বরূপ, তার এই স্বভাব হেতু দ্বারাই বোঝা যায় যে এটা বৃক্ষ। ‘ভূতলে ঘট নেই’- উপলব্ধিযোগ্য স্বরূপ থাকা সত্ত্বেও তা উপলব্ধি না হওয়ায় এটা অনুপলব্ধি হেতুর উদাহরণ। ঘট এমন একটা বস্তু যা সেখানে থাকলে তা দেখা যাবে, তা না দেখতে পাওয়ার (-উপলব্ধি না হওয়ার) অর্থ এই যে সেটা উক্ত স্থানে নেই। এক্ষেত্রে ঘটের অনুপলব্ধি হেতু হয়ে তার না থাকা সিদ্ধ করেছে।

অনুমান দ্বারা কোন কথা বা উপলব্ধি সিদ্ধ করার জন্য কার্য, স্বভাব, অনুপলব্ধি এই তিনপ্রকার হেতুর প্রয়োজন এজন্য যে, ধর্ম ব্যতীত ধর্মী (=সাধ্য, যেমন অগ্নি, বৃক্ষ বা ঘট) কখনও সম্ভব নয়- এদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমরা জানি যে ‘অগ্নি ও ধূমের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য’। ‘যার শাখা-পত্র আছে তাই বৃক্ষ’। ‘চোখ দিয়ে যে ঘট দেখতে পাওয়া যায় তা থাকলে অবশ্যই দেখা যাবে, না দেখতে পাওয়ার অর্থ তা সেখানে নেই’। অতএব এই ত্রিরূপসম্পন্ন লিঙ্গ বা হেতুর তিনটি ধর্ম- (১) পক্ষে বৃত্তিত্ব বা পক্ষে সত্ত্ব (=থাকা), (২) সপক্ষে বৃত্তিত্ব বা সপক্ষে সত্ত্ব এবং (৩) বিপক্ষে অবৃত্তিত্ব বা বিপক্ষে অসত্ত্ব (=না থাকা)।

হেতুর পক্ষে বৃত্তিত্বকে বলা হয় ‘পক্ষধর্মতা’। এই পক্ষধর্মতাবিশিষ্ট হেতু যখন ব্যাপ্তিবিশিষ্ট হয় তখনই তা অনুমিতির জনক হয়। তাই অনুমিতিকে ব্যাপ্তিবিশিষ্ট ও পক্ষধর্মতাবিশিষ্ট হেতুজন্য সাধ্যের নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান বলা হয়।

চার্বাকদের কোন কোন সম্প্রদায় অনুমান প্রমাণকে স্বীকার করেন না এবং ব্যাপ্তিজ্ঞানকে তাঁরা অপ্রতিষ্ঠিত বলেছেন। যেমন দেখা যায়, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে সায়ন মাধবাচার্য এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
‘অত্র বৌদ্ধৈরভিধীয়তে। যদভ্যধায়ি-অবিনাভাবো দুর্বোধ ইতি। তদসাধীয়ঃ, তাদাত্ম্য-তদুৎপত্তিভ্যাম্ অবিনাভাবস্য সুজ্ঞানত্বাৎ।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : এ বিষয়ে বৌদ্ধগন বলছেন- এই যে চার্বাক বলেছেন–অবিনাভাব দুর্বোধ্য, তা কিন্তু সাধু নয়। যেহেতু তাদাত্ম্য ও তদুৎপত্তি দ্বারা সহজেই অবিনাভাবকে জানা যায়।

চার্বাকরা যে ব্যাপ্তিজ্ঞান বা অবিনাভাবকে অপ্রতিষ্ঠিত বলেছেন তা খণ্ডন করতে গিয়ে ধর্মকীর্তি তাঁর ‘প্রমাণবার্ত্তিকে’র ব্যাপ্তিচিন্তায় (৩৩) বলেছেন, কার্য-কারণভাব ও স্বভাব বা তাদাত্ম্যের মাধ্যমে ব্যাপ্তি বা অবিনাভাব প্রতিষ্ঠিত হতে পারে-
‘কার্য্য-কারণ-ভাবাদ্ বা স্বভাবাদ্ বা নিয়ামকাৎ।
অবিনাভাব-নিয়মোহদর্শনান্ ন ন দর্শনাৎ।।’ (প্রমাণবার্ত্তিক)
অর্থাৎ : সাধ্য ও হেতুর অব্যাভিচারের সাধক কার্য-কারণ-ভাব ও স্বভাব থেকে অবিনাভাবের নিশ্চয় হয়। সাধ্যাভাবের অধিকরণে হেতুর অদর্শনমাত্র থেকে বা সাধ্য ও সাধনের সহভাব দর্শনমাত্র থেকে অবিনাভাবের নিশ্চয় হয় না।

কার্য-কারণভাবকে বলা হয় ‘তদুৎপত্তি’ এবং স্বভাবকে বলা হয় ‘তাদাত্ম্য’। কারণ ছাড়া যেমন কার্য হয় না তেমনি স্বভাবী ছাড়া স্বভাব থাকে না। সুতরাং কার্য ও স্বভাবের সঙ্গে কারণ ও স্বভাবীর নিশ্চিত অবিনাভাব বা ব্যাপ্তিজ্ঞান সম্ভব। কার্য-কারণভাবকে বৌদ্ধরা ‘পঞ্চকারণী’ প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রেক্ষিতে ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে বলা হয়েছে-
‘তস্মাৎ তদুৎপত্তি নিশ্চয়েন অবিনাভাবো নিশ্চীয়তে। তদুৎপত্তি-নিশ্চয়শ্চকার্য্য-হেত্বোঃ প্রত্যক্ষোপলম্ভানুপলম্ভ-পঞ্চক-নিবন্ধনঃ।’
‘কার্য্যস্য উৎপত্তেঃ প্রাক্ অনুপলম্ভঃ, কারণোপলম্ভে সতি উপলম্ভঃ, উপলম্ভস্য পশ্চাৎ কারণানুপলম্ভাৎ অনুপলম্ভঃ ইতি পঞ্চকারণ্যা ধূম-ধূমধ্বজয়োঃ কার্য্য-কারণ-ভাবো নিশ্চীয়তে।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ :
অতএব তদুৎপত্তির নিশ্চয়ের দ্বারা অবিনাভাবের নিশ্চয় হয়। তদুৎপত্তির নিশ্চয়টি কার্য ও হেতুর প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ও অনুপলব্ধি পঞ্চক থেকে হয়ে থাকে।
সেই উপলব্ধি-অনুপলব্ধি পঞ্চক হচ্ছে- কার্যের উৎপত্তির পূর্বে তার অনুপলব্ধি, কারণের উপলব্ধিতে কার্যের উপলব্ধি, উপলব্ধ কার্যের পরে কারণের অনুপলব্ধি থেকে কার্যের অনুপলব্ধি- এই পাঁচটি কারণ থেকে ধূম ও ধূমধ্বজ বহ্নির কার্য-কারণ-ভাবের নিশ্চয় হয়।

এই মতে পঞ্চকারণী প্রক্রিয়াটি হলো- (১) কার্যোৎপত্তির আগে কারণের অনুপলব্ধি, (২) কারণের উপলব্ধি, (৩) কার্যের উপলব্ধি, (৪) কারণের অনুপলব্ধি, (৫) কার্যের অনুপলব্ধি। এই পঞ্চকারণী প্রক্রিয়ার দ্বারা ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

আবার (অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক) তাদাত্ম্যের দ্বারাও ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যেমন, শিংশপাত্ব (শিশুগাছ) এবং বৃক্ষত্বের মধ্যে তাদাত্ম্য বর্তমান। সুতরাং শিংশপাত্ব ও বৃক্ষত্বের মধ্যে নিশ্চিত ব্যাপ্তিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এ বিষয়টিই ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে উক্ত হয়েছে-
‘তথা তাদাত্ম্য নিশ্চয়েনাপি অবিনাভাবো নিশ্চীয়তে।…’ ‘শিংশপা-বৃক্ষয়োশ্চ তাদাত্ম্য-নিশ্চয়ো ‘বৃক্ষোহয়ং শিংশপা’ ইতি সামানাধিকরণ্য-বলাৎ উপপদ্যতে।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : সেইরূপ তাদাত্ম্য নিশ্চয়ের দ্বারাও অবিনাভাবের নিশ্চয় হয়।… শিংশপা ও বৃক্ষের তাদাত্ম্য নিশ্চয় ‘এই বৃক্ষটি শিংশপা’–এই সামানাধিকরণ্য-প্রতীতির বলে উৎপন্ন হয়।

অনুমানের ভেদ :
অনুমানের বিভাগ নির্দেশ করতে গিয়ে বৌদ্ধাচার্য ধর্মকীর্তি তাঁর ‘ন্যায়বিন্দু’তে বলেছেন-
‘অনুমানং দ্বিধা। স্বার্থং পরার্থং চ।’ (ন্যায়বিন্দু)
অর্থাৎ : অনুমান দ্বিবিধ- স্বার্থ ও পরার্থ।

বৌদ্ধমতে স্বার্থ ও পরার্থ- এই দুই প্রকার অনুমান স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান অত্যন্ত ভিন্ন হওয়ায়, অর্থাৎ স্বার্থানুমান জ্ঞানাত্মক ও পরার্থানুমান বাক্যাত্মক হওয়ায়, উভয়প্রকার অনুমানের অভিন্ন তথা একটিমাত্র লক্ষণ নিরূপণ করা সম্ভব নয় তা বৌদ্ধাচার্যদের উক্তিতে আগেই বলা হয়েছে। তবে এই দুই প্রকার অনুমানের মধ্যে পার্থক্য হলো, স্বার্থানুমানের ক্ষেত্রে আশ্রয়বাক্য উল্লেখ না করলেও চলে। কিন্তু পরার্থানুমানের ক্ষেত্রে আশ্রয়বাক্যের উল্লেখ প্রয়োজন। কারণ, স্বার্থানুমান নিজ জ্ঞানের জন্য করা হয় এবং পরার্থানুমান অপরের নিকট কোন কিছু প্রমাণের নিমিত্ত প্রয়োজন হয়।
স্বার্থানুমানের পরিচয় দিতে গিয়ে বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মোত্তর বলেছেন-
‘স্বস্মৈ ইদং স্বার্থং।’ (ন্যায়বিন্দুটীকা)
অর্থাৎ : নিজের প্রয়োজনে যে অনুমান তাই স্বার্থানুমান।

এখানে ‘স্ব’-এর অর্থ নিজ এবং ‘অর্থ’ পদের অর্থ এখানে প্রয়োজন। সুতরাং বলা যায়, স্বার্থানুমানের সাহায্যে জ্ঞাতা নিজেই অর্থের জ্ঞান লাভ করে। অপরদিকে পরার্থানুমান হলো অপরের প্রয়োজন সাধক। যে বাক্যসমূহ প্রয়োগ করে অপরের নিকট সাধ্যসিদ্ধি প্রতিপাদন করা হয় তাই পরার্থানুমান। পরার্থানুমানের লক্ষণে ধর্মকীর্তি বলেছেন-
‘ত্রিরূপলিঙ্গাখ্যাননং পরার্থানুমানং’।
অর্থাৎ : ত্রিরূপ লিঙ্গের আখ্যান বা উল্লেখই হলো পরার্থানুমান।

ত্রিরূপ হলো- অন্বয়, ব্যতিরেক ও পক্ষধর্ম। এইরূপ ত্রিরূপ লিঙ্গ যখন বাক্যাকারে উপস্থাপিত হয় তখন তাকে বলা হয় পরার্থানুমান। যেহেতু অপরের উপপত্তির জন্য এই অনুমান, তাই একে পরার্থানুমান বলা হয়। স্বার্থানুমান জ্ঞানাত্মক, কিন্তু পরার্থানুমান বাক্যাত্মক বা শব্দাত্মক। ধর্মকীর্তি অবশ্য স্বার্থানুমানের ক্ষেত্রেও অনুমেয় পদার্থের জ্ঞান ত্রিরূপ লিঙ্গহেতুক বলেছেন।
অন্বয় ও ব্যতিরেক বস্তুত সপক্ষবৃত্তি ও বিপক্ষাবৃত্তি। প্রকৃতপক্ষে পক্ষবৃত্তি, সপক্ষবৃত্তি ও বিপক্ষাবৃত্তি- এই ত্রিবিধ লিঙ্গের জ্ঞান যে কোন অনুমানের ক্ষেত্রেই প্রয়োজন। স্বার্থানুমানের ক্ষেত্রে তা বাক্যাকারে প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না, কিন্তু পরার্থানুমানের ক্ষেত্রে বাক্যাকারে প্রকাশিত ত্রিবিধ লিঙ্গের বাক্যার্থবোধ থেকেই অপরের সাধ্যনিশ্চয় হয়।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال