ঈশ্বরপ্রসঙ্গে সাংখ্যমত

ঈশ্বরপ্রসঙ্গে সাংখ্যমত


দার্শনিক মহলে মহর্ষি কপিল প্রবর্তিত সাংখ্য দর্শনকে নিরীশ্বর সাংখ্য এবং পতঞ্জলি প্রবর্তিত যোগ দর্শনকে সেশ্বর সাংখ্য বলা হয়। তবে এটি সর্বসম্মত মত নয়। কেননাসাংখ্য দর্শন নিরীশ্বরবাদী কিনাসে বিষয়ে সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। বলা হয়প্রাচীন সাংখ্যাচার্যরা নিরীশ্বরবাদী এবং পরবর্তী সাংখ্যাচার্যরা ঈশ্বরবাদী।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সাংখ্যপ্রবচনসূত্রে বলা হয়েছে
ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমাণাভাবাৎ।’– (সাংখ্যপ্রবচনসূত্র/৯২)
অর্থাৎ প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ।
.
এক্ষেত্রে উক্ত সূত্রটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভাষ্যকার বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বলেন– ‘প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধ’– এই উক্তি থেকে একথা প্রমাণিত হয় না যেসাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর অস্বীকৃত হয়েছেন। বরংএর দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যেসাংখ্য দর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হলেও কোন প্রমাণের দ্বারা তা সিদ্ধ বা প্রমাণ করা যায় না।
 .
এখানে উল্লেখ্যষোড়শ শতকের ঈশ্বরবাদী সাংখ্য দার্শনিক বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যের ভূমিকায় বলেই দিয়েছিলেন যে,-
সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যের গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কলামাত্রই অবশিষ্ট আছে;  আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।
 .
সাংখ্যের কলামাত্র অবশিষ্টকে অমৃতবাক্যের দ্বারা পূর্ণ করার ফলাফল সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়এর প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়।
তার ফলে দর্শন আর যাই হোক সাংখ্যদর্শন থাকেনি– বেদান্তমতে বা অন্তত প্রায়বেদান্তমতে পরিণত হয়েছিলো। কেননা,  নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর দর্শনে পরিণত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি;  শেষপর্যন্ত তিনি বেদান্তের সঙ্গে সাংখ্যের প্রায় সমস্ত মৌলিক প্রভেদই উড়িয়ে দেবার আয়োজন করেছিলেন।– (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ভারতীয় দর্শনপৃষ্ঠা২৩)
 .
নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর সাংখ্যে রূপায়নপ্রচেষ্টা পরবর্তীকালের অন্যান্য ঈশ্বরবাদী ভাষ্যকারদের মধ্যেও লক্ষ্য করা যায়। যেমন সাংখ্যের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক তত্ত্ব পুরুষতত্ত্বে সাংখ্যকারিকা অনুযায়ীই পুরুষবহুত্ব স্বীকৃত হলেও সাংখ্যকারিকার অন্যতম ভাষ্যকার গৌড়পাদ তাঁর গৌড়পাদভাষ্যে সংশ্লিষ্ট কারিকার ব্যাখ্যায় ঠিক বিপরীত মতই প্রস্তাব করেছেন যে (সূত্র– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ভারতীয় দর্শনপৃষ্ঠা২৪)-
অনেকং ব্যক্তমেকব্যক্তং তথা পুমানপ্যেকঃ।’– (গৌড়পাদভাষ্য)
অর্থাৎ ব্যক্ত অনেকঅব্যক্ত একসেই প্রকার পুরুষও এক।
 .
প্রাচীন আধ্যাত্মবাদী বা ব্রহ্মবাদী দার্শনিকদের কাছে সাংখ্য যে কেবল নিরীশ্বরবাদী দর্শনই ছিলোতাই নয়বেদ বা শ্র“তিবিরোধী দর্শন হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের বিখ্যাত অদ্বৈতবেদান্তবাদী দার্শনিক শংকরাচার্যও প্রাচীন আস্তিক মতের সমর্থনে সাংখ্যকে বেদমূলক দর্শন বলে স্বীকার করতে সম্মত হননি। প্রাচীন আস্তিক মতের প্রধান দার্শনিক উদ্যোক্তা হলেন ‘ব্রহ্মসূত্র’প্রণেতা বাদরায়ণ। বাদরায়ণও সাংখ্যদর্শনকে বেদান্তদর্শনের অর্থাৎ উপনিষদ বা শ্রুতিপ্রতিপাদ্য তত্ত্বের প্রধানতম প্রতিপক্ষ বলেই গ্রহণ করেছিলেন।
 .
সাংখ্যগণিতের একটি সরল হিসেব থেকেই একথা স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। ব্রহ্মসূত্রে মোট ৫৫৫টি সূত্র আছে। তার মধ্যে অন্তত ৬০টি সূত্র প্রধানতই সাংখ্যখণ্ডন উদ্দেশ্যে রচিত। তুলনায় বাকি সব বিরুদ্ধমত খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বাদরায়ণ মোট ৪৩টি সূত্র রচনা করেছেন তার মধ্যে জৈনমত খণ্ডনে মোট ৪টি সূত্র। এবং সমস্ত রকম বৌদ্ধমত খণ্ডনে মোট ১৫টি সূত্র দেখা যায়। এই হিসেবটুকু থেকেই বোঝা যায় সূত্রকারের কাছে বিরুদ্ধমত হিসেবে সাংখ্যর গুরুত্ব কতখানি ছিল। সাংখ্য যদি প্রকৃতই শ্র“তিমূলক হয় তা হলে শ্রুতিতত্ত্বর ব্যাখ্যায় সাংখ্যখণ্ডনে এমন উৎসাহ কেন ?’- (ভারতীয় দর্শন,পৃষ্ঠা২২দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)
 .
তাছাড়া ব্রহ্মসূত্রের মূল পরিকল্পনায়ও দেখা যায়গ্রন্থের শুরুতে প্রথম চারটি সূত্রে বাদরায়ণ ব্রহ্ম বিষয়ে কয়েকটি মূল কথা ব্যাখ্যা করে এরপর পঞ্চম সূত্রেই বলেছেন
ঈক্ষতেঃ ন অশব্দম্ ।’– (ব্রহ্মসূত্র//)
শংকরাচার্যেরব্যাখ্যানুযায়ীসূত্রটিরঅর্থ জগতের আদি কারণের চিন্তাদর্শন ইত্যাদির কথা শাস্ত্রে আছে– এই ব্রহ্ম চেতনপদার্থ। কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত অচেতন প্রধানের কথা শাস্ত্রে নাই বলে অচেতন প্রকৃতি বা প্রধানকে জগৎসৃষ্টির আদি কারণ বললে তা অশাস্ত্রীয় উক্তি হবে।
 .
মোটকথাআধুনিক বিদ্বানদের মতেআদিতে বেদরিরুদ্ধ দর্শনের মধ্যে সাংখ্যের স্থানই প্রধান ছিলো। লুপ্তপ্রায় মূল গ্রন্থের অভাবে পরবর্তীকালের ঈশ্বরবাদী দার্শনিকদের হাতে তার ব্যাখ্যাগুলি নিজেদের মতো করে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। প্রকৃতপক্ষে আদিতে সাংখ্য দর্শনের জন্ম হয়েছে নিরীশ্বরবাদী দর্শন হিসেবেই। সাংখ্যকারিকায় ঈশ্বরের কোন প্রসঙ্গ নেই। এমনকি সায়ন মাধবাচার্যও তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’এর সাংখ্যপ্রস্থান শেষ করেছেন এই বলে যে
এতচ্চ নিরীশ্বরসাংখ্যশাস্ত্রম্ ।’– (সাংখ্যপ্রস্থানম্সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ এইভাবে নিরীশ্বর সাংখ্যশাস্ত্রের প্রবর্তক কপিলের মত প্রদর্শিত হলো।
 .
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রসঙ্গে সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদের প্রেক্ষিতে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে ও পক্ষে সাংখ্য দর্শনে বিভিন্ন যুক্তির উপস্থাপন ঘটেছে।
.
ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে যুক্তি
প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকদের মতে ঈশ্বর বলে কেউ নেইপ্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। এই মতবাদ স্থাপনের জন্য তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে কতকগুলি যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
 .
(সাংখ্যমতে মহৎ তত্ত্ব থেকে মহাভূত পর্যন্ত এই জগৎ সৃষ্টি প্রকৃতিরই কার্য। কার্য থাকলে এর পেছনে কারণও থাকবে। পরিণামী প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ। তাই জগৎকারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই।
 .
(কোন কর্ম সম্পাদনে কর্তার একটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। জগৎ কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে জগৎ সৃষ্টির দ্বারা ঈশ্বরের কোন্ উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছেতা বলতে হয়। কিন্তু জগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে ঈশ্বরের কোন উদ্দেশ্য সাধনের কথাই আমরা বলতে পারি না।
প্রথমতজীবের প্রতি করুণাবশত ঈশ্বও জগৎ সৃষ্টি করতে পারেন নাকারণ জগৎ সৃষ্টির পূর্বে জীবের প্রতি করুণার প্রশ্নই ঊঠে না। আর যদি তিনি জীবের ভাবী কল্যাণের কথা ভেবে জগৎ সৃষ্টি করতেনতাহলে জগতে বহুবিধ দুঃখের আবির্ভাব হতো না।
দ্বিতীয়তজগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে ঈশ্বরের কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে নাকারণ তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ। পূর্ণ ঈশ্বরের কোন অপূর্ণ ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।
সুতরাং জীবের প্রতি করুণা বা ব্যক্তিগত কোন স্বার্থসিদ্ধি জগৎ সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বরের প্রবৃত্তির নিয়ামক হতে পারে না।
 .
(ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলে তাঁকে পুরুষ রূপেই স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ঈশ্বর মুক্ত বা বদ্ধ কোন পুরুষ রূপেই স্বীকৃত হতে পারেন না। তিনি যদি বদ্ধ পুরুষ হনতাহলে তিনিও দুঃখত্রয়ের অধীন হবেন। কিন্তু ঈশ্বর কখনো দুঃখের অধীন হতে পারেন না। আবার ঈশ্বর যদি মুক্ত হন তাহলে তাঁকে নিত্যমুক্তই বলতে হয়। তিনি যদি নিত্যমুক্তই হনতাহলে জগতের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না।
 .
প্রাচীন সাংখ্যাচার্যদের উপরিউক্ত যুক্তির সাহায্যে বাচস্পতি মিশ্রঅনিরুদ্ধ প্রমুখ দার্শনিকরা সিদ্ধান্ত করেছেন যেসাংখ্য নিরীশ্বরবাদী। এই মতেঅচেতন প্রকৃতি স্বভাববশেই জগৎ রূপে পরিণাম প্রাপ্ত হয়। তার এইরূপ স্বভাবের কারণ হলো পুরুষের ভোগ ও মোক্ষ সম্পাদন। গোবৎসের নিমিত্ত যেমন গাভীর দুগ্ধ ক্ষরণ হয়তেমনি সাংখ্যকারিকার একবিংশ কারিকা অনুযায়ী– (‘পুরুষস্য দর্শনার্থং কৈবল্যার্থং তথা প্রধানস্যপুরুষের ভোগ ও মোক্ষের নিমিত্তই প্রকৃতি পরিণাম প্রাপ্ত হয়। এই পরিণামের কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই।
 .
ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি
সাংখ্য দার্শনিকদের মধ্যে কোন কোন আধুনিক ব্যাখ্যাকার ঈশ্বর সম্বন্ধে উপরিউক্ত নিরীশ্বরবাদী সাংখ্যমত গ্রহণ করেন নি। যেমন– বিজ্ঞানভিক্ষুর মতে সাংখ্য ঈশ্বরবাদী। তিনি মনে করেনসাংখ্যপ্রবচনসূত্রকার ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথা কোথাও বলেন নি। ঈশ্বরের নাস্তিত্বই যদি সূত্রকারের অভিপ্রেত হতোতাহলে তিনি প্রমাণের অভাবে ঈশ্বর অসিদ্ধির কথা না বলে সরাসরি ঈশ্বরের নাস্তিত্বের কথাই বলতেন। বিজ্ঞানভিক্ষুর মতেসূত্রকারের বক্তব্য থেকে একথাই মনে হয় যেসাংখ্য সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করলেও ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের মতো জগৎস্রষ্টারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের বিরোধী।
 .
ঈশ্বরবাদী সাংখ্যাচার্যদের মতেঈশ্বর হলেন আদি পুরুষ। পুরুষ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় জগৎ সৃষ্টি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তবে তাঁরই ইচ্ছায় প্রকৃতির মধ্যে চাঞ্চল্য ঘটে এবং প্রকৃতি ক্রিয়াশীল হয়। চুম্বকের সান্নিধ্যে লৌহ যেমন চুম্বকধর্মবান বলে প্রতিভাত হয়তেমনি চৈতন্যময় পুরুষের সান্নিধ্যে প্রকৃতিতে চেতনার প্রতিফলন ঘটে। এর ফলে প্রকৃতিতে চাঞ্চল্য দেখা দেয় এবং জগৎরূপে প্রকৃতির পরিণাম ঘটে। তাই প্রকৃতির গতিময়তার হেতুরূপে সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা যেতে পারে। তাছাড়া স্মৃতি ও শ্রুতি থেকেও ঈশ্বরের অস্তিত্বেও কথা জানতে পারা যায়।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال