যোগাচার বৌদ্ধদর্শন : বিজ্ঞানবাদ
মহাযান বৌদ্ধধর্মের আরেকটি প্রধান সম্প্রদায় হচ্ছে যোগাচার (yogachara) বা বিজ্ঞানবাদ ভাববাদী সম্প্রদায় (idealistic school)। এই সম্প্রদায় থেরাবাদী বৌদ্ধধর্মের পূর্ণ বস্তুবাদ (realism) এবং মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের ব্যবহারিক বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান করে এক অধিক জটিল অবস্থা স্বীকার করে। এই মতানুসারে, মানুষ যা প্রত্যক্ষ করে তার অস্তিত্ব নেই, বিষয় জ্ঞান হতে অভিন্ন এবং জ্ঞানভেদে বাসনাবৈচিত্র্য হচ্ছে কারণ। বিজ্ঞান বা চেতনাকেই একমাত্র সত্য বলে গ্রহণ করে বলে এই মতবাদকে বলা হয় বিজ্ঞানবাদ। আবার যোগ ও আচরণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করায় এই মতবাদকে যোগাচারবাদও বলা হয়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে এই মতের উত্থান।
অসঙ্গ (৩৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও বসুবন্ধু এই পাঠান ভ্রাতৃদ্বয়কে যোগাচার ধর্ম ও দর্শনের প্রথম ও দ্বিতীয় আচার্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কারো কারো মতে অসঙ্গের গুরু (সম্ভাব্য) মৈত্রেয়নাথকে বিজ্ঞানবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলা হলেও তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে এবং এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। ‘লঙ্কাবতারসূত্র’ -কে বিজ্ঞানবাদের মুখ্য গ্রন্থ মানা হয়। পরবর্তীকালে শান্তরক্ষিত ও কমলশীল এই মতবাদের সমর্থনে যুক্তি দিয়েছেন।
.
অসঙ্গ (৩৫০ খ্রি.) ও বসুবন্ধুর জীবনী :
পেশাওয়ারের এক ব্রাহ্মণ বংশে অসঙ্গের জন্ম। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা বসুবন্ধু ছিলেন বৌদ্ধ জগতের প্রধান দার্শনিকদের অন্যতম। অসঙ্গের বেশ কয়েকটি গ্রন্থই লুপ্ত হয়েছে। তাঁর ‘অভিধর্মকোষ’ একটি অতি প্রাচীন গ্রন্থ যার মধ্যে তিনি সর্বাস্তিবাদ দর্শনের সুশৃঙ্খল আলোচনা করেছেন এবং বসুবন্ধু এই অভিধর্মকোষের ওপর বিস্তৃত ভাষ্য রচনা করেছেন। বিজ্ঞানবাদের ওপর লিখিত অসঙ্গের বিখ্যাত গ্রন্থ হচেছ ‘যোগাচারভূমিবস্তুসংগ্রহণী’ বা যোগাচার ভূমিশাস্ত্র। এই বিশাল গ্রন্থে যোগাচার মতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এবং এ গ্রন্থেই অসঙ্গ এই সম্প্রদায়কে যোগাচার নামে উল্লেখ করেছেন। যোগাচারভূমি কোন সুসংবদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থ নয়, বরং অধিকমাত্রায় বৌদ্ধ সদাচার, যোগ তথা ধর্মতত্ত্বের বিস্তৃত আলোচনা মাত্র। অসঙ্গের এই মতাবাদের উপর লিখিত বসুবন্ধুর রচিত সুবিশাল গ্রন্থ ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ হচ্ছে বিজ্ঞানবাদের মৌলিক গ্রন্থ। বসুবন্ধুই এই মতবাদের নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানবাদ। অসঙ্গ তাঁর গ্রন্থে সাধনমার্গের কথা বেশি বলেছেন আর বসুবন্ধু দার্শনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাই এই সম্প্রদায়ের সাধনচর্চাকে যোগাচার এবং দার্শনিক মতবাদকে বিজ্ঞানবাদ বলা হয়।
.
বসুবন্ধু ছিলেন ‘মধ্যযুগীয় ন্যায়শাস্ত্রের জনক’ দিঙনাগের গুরু। তিনি নিজেও বাদ-বিবাদ নামে ন্যায়ের ওপর একটি রচনা প্রস্তুত করেছিলেন। এছাড়া বসুবন্ধু সমুদ্রগুপ্তের পুত্র চন্দ্রগুপ্তের (বিক্রমাদিত্যের) অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
বসুবন্ধুর পরে যোগাচার সম্প্রদায়ে আবির্ভূত বিখ্যাত আচার্যরা হলেন খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের দিঙনাগ (৩৪৫-৪২৫ খ্রি.), ষষ্ঠ শতকের ধর্মকীর্তি (৬০০ খ্রি.), গুণমতি ও স্থিরমতি, সপ্তম শতকের শীলভদ্র (নালন্দায় অধ্যক্ষ ছিলেন) এবং তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহনকারী প্রসিদ্ধ চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬৩৩ খ্রি.) যিনি চীনা ভাষায় বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি নামে এক বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। একাদশ শতকের বৌদ্ধপণ্ডিত ধর্মপালও যোগাচার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
.
বিজ্ঞানবাদের দার্শনিক মত :
বৌদ্ধদর্শনে বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ ভাব বা চেতনা। অসঙ্গ ছিলেন ক্ষণিক বিজ্ঞানবাদী। এই বিজ্ঞানবাদ অসঙ্গের পূর্বেও ‘লঙ্কাবতারসূত্র’ এবং ‘সন্ধিনির্মোচনসূত্র’-এর মতো মহাযান সূত্রে পাওয়া যায়। এসব সূত্রকে বুদ্ধবচন বলা হয়। যদিও অধিকাংশ মহাযান সূত্রের ন্যায় এগুলিও বুদ্ধের নামে পরবর্তীকালে রচিত বলে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন উল্লেখ করেছেন। লঙ্কাদ্বীপের সম্ভাব্য সমন্তকূট পর্বতের ওপর বসে বুদ্ধ লঙ্কাবতারসূত্রের উপদেশ দিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। বৌদ্ধদের বিজ্ঞানবাদ মূলত বুদ্ধের ‘সব্বং অনিচ্চং’ (সবই অনিত্য) বা ক্ষণিকবাদের সঙ্গে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর স্থির ভাববাদের মিশ্রন মাত্র। (ভারতীয় দর্শনের সাথে গ্রিক দর্শনের এই মিশ্রন গান্ধার-প্রবাসী গ্রিকদের (১৪০ খ্রিস্টপূর্ব) দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিলো বলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। এ প্রেক্ষিতে তিনি গ্রিক শিল্পরীতিতে নির্মিত প্রাচীন গান্ধার ভাস্কর্যকে নমুনা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন)।
.
বিজ্ঞানবাদ বিজ্ঞানকেই (চেতনা) পরম বলে মেনেছে এবং অসঙ্গ তাঁর যোগাচারভূমিতে এই বিজ্ঞানবাদের আলোচনায় বুদ্ধ কথিত পঞ্চেন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক) পঞ্চবিজ্ঞান (চক্ষু-বিজ্ঞান, শ্রোত্র-বিজ্ঞান, ঘ্রাণ-বিজ্ঞান, জিহ্বা-বিজ্ঞান, কায়-বিজ্ঞান) তথা মন নামক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কৃত অনুভূতি বিষয়ক মনোবিজ্ঞানের অতিরিক্ত এক সপ্তম আলয়-বিজ্ঞানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই আলয় বিজ্ঞান হলো সেই তরঙ্গায়িত সমুদ্র, যার থেকে তরঙ্গের মতোই সমস্ত জড়-চেতন বস্তু প্রকাশ ও বিলীন হতে থাকে। তাঁর মতে, বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ, জড় চেতনার জগতে যা কিছু আছে সবই এই আলয়-বিজ্ঞানের পরিণাম। বিজ্ঞান সমষ্টিকে বলে আলয়-বিজ্ঞান, এর থেকে ঢেউ-এর প্রবাহের মতো জগৎ ও সমগ্র জাগতিক বস্তু উৎপন্ন হয়। এই বিশ্ব-বিজ্ঞান বা আলয়-বিজ্ঞান থেকে যেমন জড়-জগৎ উৎপন্ন হয় তেমনি প্রবৃত্তি বিজ্ঞান অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয় বিজ্ঞান এবং ষষ্ঠ মন সৃষ্টি হয়।
.
যোগাচার বিজ্ঞানবাদের দার্শনিক সিদ্ধান্ত :
বিজ্ঞানবাদ একদিকে শূন্যবাদ এবং অপরদিকে সর্বাস্তিবাদের বিরোধিতা করে স্বকীয় সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করেছে। যোগাচার দর্শনের মূল বক্তব্য হলো একমাত্র বিজ্ঞান বা চেতনাই পরমার্থ সৎ। সুতরাং এর অতিরিক্ত কোন বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বাহ্য জগতে যেসব বস্তুর অস্তিত্বের কথা আমরা চিন্তা করি, সেগুলি আমাদের মনের ভাব বা ধারণামাত্র। অর্থাৎ যেসব ঘট, পট ইত্যাদি বাহ্যবস্তু আমরা দেখি অথবা আনন্দ বিষাদ ইত্যাদি আন্তর বস্তু আমরা উপলব্ধি করি, তাদের কোন পারমার্থিক সত্তাই নেই। এ সব কিছুই হলো বিজ্ঞানেরই আকার বা পরিণাম। অর্থাৎ এই মতানুসারে বিজ্ঞান বা চেতনাই বাহ্যবস্তু বা আন্তর বস্তুরূপে প্রতীয়মান হয়।
.
যোগাচার দর্শনের দুটি দিক- নঞর্থক ও সদর্থক। নঞর্থক দিক থেকে তাঁরা শূন্যবাদ ও সর্বাস্তিবাদ খণ্ডন করেছেন। অন্যদিকে সদর্থক দিক থেকে তাঁরা বিজ্ঞানবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
.
মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদ খণ্ডন : মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদ অনুসারে মন বা জড়বস্তু বলে কোন পদার্থের অস্তিত্ব নেই, সবই শূন্য। মনোজগৎ ও জড়জগৎ উভয়ই মিথ্যা।
এই শূন্যবাদ খণ্ডনে যোগাচারবাদীরা বলেন, শূন্যবাদীরা যদি শূন্যবাদের সত্যতা প্রমাণ করতে চান তাহলে তাদেরকে যুক্তির দ্বারা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যুক্তির দ্বারা মত প্রতিষ্ঠা করলে তারা মনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। কারণ যুক্তিবিচার মনেরই কাজ।
.
আবার বিজ্ঞানবাদী অসঙ্গের মতে পারমার্থিক সত্য হচ্ছে অদ্বয় এবং এই অদ্বয়ের লক্ষণ পাঁচটি-
.
অসঙ্গ (৩৫০ খ্রি.) ও বসুবন্ধুর জীবনী :
পেশাওয়ারের এক ব্রাহ্মণ বংশে অসঙ্গের জন্ম। তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা বসুবন্ধু ছিলেন বৌদ্ধ জগতের প্রধান দার্শনিকদের অন্যতম। অসঙ্গের বেশ কয়েকটি গ্রন্থই লুপ্ত হয়েছে। তাঁর ‘অভিধর্মকোষ’ একটি অতি প্রাচীন গ্রন্থ যার মধ্যে তিনি সর্বাস্তিবাদ দর্শনের সুশৃঙ্খল আলোচনা করেছেন এবং বসুবন্ধু এই অভিধর্মকোষের ওপর বিস্তৃত ভাষ্য রচনা করেছেন। বিজ্ঞানবাদের ওপর লিখিত অসঙ্গের বিখ্যাত গ্রন্থ হচেছ ‘যোগাচারভূমিবস্তুসংগ্রহণী’ বা যোগাচার ভূমিশাস্ত্র। এই বিশাল গ্রন্থে যোগাচার মতবাদের বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এবং এ গ্রন্থেই অসঙ্গ এই সম্প্রদায়কে যোগাচার নামে উল্লেখ করেছেন। যোগাচারভূমি কোন সুসংবদ্ধ দার্শনিক গ্রন্থ নয়, বরং অধিকমাত্রায় বৌদ্ধ সদাচার, যোগ তথা ধর্মতত্ত্বের বিস্তৃত আলোচনা মাত্র। অসঙ্গের এই মতাবাদের উপর লিখিত বসুবন্ধুর রচিত সুবিশাল গ্রন্থ ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ হচ্ছে বিজ্ঞানবাদের মৌলিক গ্রন্থ। বসুবন্ধুই এই মতবাদের নাম দিয়েছেন বিজ্ঞানবাদ। অসঙ্গ তাঁর গ্রন্থে সাধনমার্গের কথা বেশি বলেছেন আর বসুবন্ধু দার্শনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাই এই সম্প্রদায়ের সাধনচর্চাকে যোগাচার এবং দার্শনিক মতবাদকে বিজ্ঞানবাদ বলা হয়।
.
বসুবন্ধু ছিলেন ‘মধ্যযুগীয় ন্যায়শাস্ত্রের জনক’ দিঙনাগের গুরু। তিনি নিজেও বাদ-বিবাদ নামে ন্যায়ের ওপর একটি রচনা প্রস্তুত করেছিলেন। এছাড়া বসুবন্ধু সমুদ্রগুপ্তের পুত্র চন্দ্রগুপ্তের (বিক্রমাদিত্যের) অধ্যাপকরূপে নিযুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা যায়।
বসুবন্ধুর পরে যোগাচার সম্প্রদায়ে আবির্ভূত বিখ্যাত আচার্যরা হলেন খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকের দিঙনাগ (৩৪৫-৪২৫ খ্রি.), ষষ্ঠ শতকের ধর্মকীর্তি (৬০০ খ্রি.), গুণমতি ও স্থিরমতি, সপ্তম শতকের শীলভদ্র (নালন্দায় অধ্যক্ষ ছিলেন) এবং তাঁর কাছে শিক্ষাগ্রহনকারী প্রসিদ্ধ চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬৩৩ খ্রি.) যিনি চীনা ভাষায় বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি নামে এক বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। একাদশ শতকের বৌদ্ধপণ্ডিত ধর্মপালও যোগাচার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
.
বিজ্ঞানবাদের দার্শনিক মত :
বৌদ্ধদর্শনে বিজ্ঞান শব্দটির অর্থ ভাব বা চেতনা। অসঙ্গ ছিলেন ক্ষণিক বিজ্ঞানবাদী। এই বিজ্ঞানবাদ অসঙ্গের পূর্বেও ‘লঙ্কাবতারসূত্র’ এবং ‘সন্ধিনির্মোচনসূত্র’-এর মতো মহাযান সূত্রে পাওয়া যায়। এসব সূত্রকে বুদ্ধবচন বলা হয়। যদিও অধিকাংশ মহাযান সূত্রের ন্যায় এগুলিও বুদ্ধের নামে পরবর্তীকালে রচিত বলে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন উল্লেখ করেছেন। লঙ্কাদ্বীপের সম্ভাব্য সমন্তকূট পর্বতের ওপর বসে বুদ্ধ লঙ্কাবতারসূত্রের উপদেশ দিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা হয়। বৌদ্ধদের বিজ্ঞানবাদ মূলত বুদ্ধের ‘সব্বং অনিচ্চং’ (সবই অনিত্য) বা ক্ষণিকবাদের সঙ্গে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর স্থির ভাববাদের মিশ্রন মাত্র। (ভারতীয় দর্শনের সাথে গ্রিক দর্শনের এই মিশ্রন গান্ধার-প্রবাসী গ্রিকদের (১৪০ খ্রিস্টপূর্ব) দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিলো বলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। এ প্রেক্ষিতে তিনি গ্রিক শিল্পরীতিতে নির্মিত প্রাচীন গান্ধার ভাস্কর্যকে নমুনা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন)।
.
বিজ্ঞানবাদ বিজ্ঞানকেই (চেতনা) পরম বলে মেনেছে এবং অসঙ্গ তাঁর যোগাচারভূমিতে এই বিজ্ঞানবাদের আলোচনায় বুদ্ধ কথিত পঞ্চেন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক) পঞ্চবিজ্ঞান (চক্ষু-বিজ্ঞান, শ্রোত্র-বিজ্ঞান, ঘ্রাণ-বিজ্ঞান, জিহ্বা-বিজ্ঞান, কায়-বিজ্ঞান) তথা মন নামক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কৃত অনুভূতি বিষয়ক মনোবিজ্ঞানের অতিরিক্ত এক সপ্তম আলয়-বিজ্ঞানকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই আলয় বিজ্ঞান হলো সেই তরঙ্গায়িত সমুদ্র, যার থেকে তরঙ্গের মতোই সমস্ত জড়-চেতন বস্তু প্রকাশ ও বিলীন হতে থাকে। তাঁর মতে, বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ, জড় চেতনার জগতে যা কিছু আছে সবই এই আলয়-বিজ্ঞানের পরিণাম। বিজ্ঞান সমষ্টিকে বলে আলয়-বিজ্ঞান, এর থেকে ঢেউ-এর প্রবাহের মতো জগৎ ও সমগ্র জাগতিক বস্তু উৎপন্ন হয়। এই বিশ্ব-বিজ্ঞান বা আলয়-বিজ্ঞান থেকে যেমন জড়-জগৎ উৎপন্ন হয় তেমনি প্রবৃত্তি বিজ্ঞান অর্থাৎ পঞ্চেন্দ্রিয় বিজ্ঞান এবং ষষ্ঠ মন সৃষ্টি হয়।
.
যোগাচার বিজ্ঞানবাদের দার্শনিক সিদ্ধান্ত :
বিজ্ঞানবাদ একদিকে শূন্যবাদ এবং অপরদিকে সর্বাস্তিবাদের বিরোধিতা করে স্বকীয় সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠা করেছে। যোগাচার দর্শনের মূল বক্তব্য হলো একমাত্র বিজ্ঞান বা চেতনাই পরমার্থ সৎ। সুতরাং এর অতিরিক্ত কোন বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। বাহ্য জগতে যেসব বস্তুর অস্তিত্বের কথা আমরা চিন্তা করি, সেগুলি আমাদের মনের ভাব বা ধারণামাত্র। অর্থাৎ যেসব ঘট, পট ইত্যাদি বাহ্যবস্তু আমরা দেখি অথবা আনন্দ বিষাদ ইত্যাদি আন্তর বস্তু আমরা উপলব্ধি করি, তাদের কোন পারমার্থিক সত্তাই নেই। এ সব কিছুই হলো বিজ্ঞানেরই আকার বা পরিণাম। অর্থাৎ এই মতানুসারে বিজ্ঞান বা চেতনাই বাহ্যবস্তু বা আন্তর বস্তুরূপে প্রতীয়মান হয়।
.
যোগাচার দর্শনের দুটি দিক- নঞর্থক ও সদর্থক। নঞর্থক দিক থেকে তাঁরা শূন্যবাদ ও সর্বাস্তিবাদ খণ্ডন করেছেন। অন্যদিকে সদর্থক দিক থেকে তাঁরা বিজ্ঞানবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
.
মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদ খণ্ডন : মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদ অনুসারে মন বা জড়বস্তু বলে কোন পদার্থের অস্তিত্ব নেই, সবই শূন্য। মনোজগৎ ও জড়জগৎ উভয়ই মিথ্যা।
এই শূন্যবাদ খণ্ডনে যোগাচারবাদীরা বলেন, শূন্যবাদীরা যদি শূন্যবাদের সত্যতা প্রমাণ করতে চান তাহলে তাদেরকে যুক্তির দ্বারা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যুক্তির দ্বারা মত প্রতিষ্ঠা করলে তারা মনের অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। কারণ যুক্তিবিচার মনেরই কাজ।
.
আবার বিজ্ঞানবাদী অসঙ্গের মতে পারমার্থিক সত্য হচ্ছে অদ্বয় এবং এই অদ্বয়ের লক্ষণ পাঁচটি-
‘ন সন্ন চাসন্ন তথা ন চান্যথা ন জায়তে ব্যেতি ন চাবহীয়তে।
ন বর্ধতে নাপি বিশুধ্যতে পুনর্বিশুধ্যতে তৎপরমার্থলক্ষণম্ ।।’ ইতি। (সূত্রালঙ্কার)
অর্থাৎ : পরমার্থ সৎ নয়, অসৎ নয় এবং অন্য রূপও কিছু নয়, তার উৎপত্তি ও বিনাশ কিছুই নেই এবং তার ক্ষয়বৃদ্ধিও নেই। সে পরমাত্মাকে বিশোধন করে, একথা বলা যায় না। কেননা প্রাকৃতিক ক্লেশ তাকে স্পর্শ করে না। তবে আগন্তুক উপক্লেশের প্রভাব হতে সে মুক্ত নয়।
.
পরমার্থের এই যে লক্ষণ প্রদত্ত হয়েছে তা মাধ্যমিকের দৃষ্টিভঙ্গি হতে খুব একটা পৃথক নয়। এখানে মাধ্যমিক ও বিজ্ঞানবাদ উভয়ে প্রায় একমতাবলম্বী হলেও শূন্যবাদীদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানবাদীদের বক্তব্য হলো, স্বয়ংবেদ্য জ্ঞানকে অস্বীকার করলে জগৎ অন্ধকার স্তুপে পরিণত হয়। জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই প্রকাশক হতে পারে না। এই জ্ঞানকে অস্বীকার করা হলে বস্তুর প্রকাশের সম্ভাবনাও অন্তর্হিত হয়। এ প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি বলেছেন-
পরমার্থের এই যে লক্ষণ প্রদত্ত হয়েছে তা মাধ্যমিকের দৃষ্টিভঙ্গি হতে খুব একটা পৃথক নয়। এখানে মাধ্যমিক ও বিজ্ঞানবাদ উভয়ে প্রায় একমতাবলম্বী হলেও শূন্যবাদীদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানবাদীদের বক্তব্য হলো, স্বয়ংবেদ্য জ্ঞানকে অস্বীকার করলে জগৎ অন্ধকার স্তুপে পরিণত হয়। জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই প্রকাশক হতে পারে না। এই জ্ঞানকে অস্বীকার করা হলে বস্তুর প্রকাশের সম্ভাবনাও অন্তর্হিত হয়। এ প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দার্শনিক ধর্মকীর্তি বলেছেন-
‘অপ্রত্যক্ষোপলম্ভস্য নার্থদৃষ্টিঃ প্রসিধ্যতি।’
অর্থাৎ : যে স্বয়ংবেদ্য জ্ঞানকে অস্বীকার করে তার পক্ষে কোন তত্ত্বই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
.
সর্বাস্তিবাদ খণ্ডন : সর্বাস্তিবাদ অনুসারে বাহ্যজগৎ এবং মনোজগৎ উভয়েরই অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ এই মতবাদ অনুযায়ী বাহ্যবস্তুর মননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে।
এই সর্বাস্তিবাদী বক্তব্যের বিরুদ্ধে যোগাচার বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা একাধিক যুক্তির অবতারণা করেছেন। তাঁরা বলেন, যদি বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকারও করা হয়, ওই বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। কারণ বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে বাহ্যবস্তুটি হয় অংশহীন একটি পরমাণু হবে, নতুবা একটি সাবয়ব যৌগিক বস্তু হবে। যদি সেটি পরমাণু হয় তাহলে তাকে প্রত্যক্ষ করা যাবে না। কারণ পরমাণু প্রত্যক্ষগোচর নয়।
সর্বাস্তিবাদ খণ্ডন : সর্বাস্তিবাদ অনুসারে বাহ্যজগৎ এবং মনোজগৎ উভয়েরই অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ এই মতবাদ অনুযায়ী বাহ্যবস্তুর মননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে।
এই সর্বাস্তিবাদী বক্তব্যের বিরুদ্ধে যোগাচার বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা একাধিক যুক্তির অবতারণা করেছেন। তাঁরা বলেন, যদি বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকারও করা হয়, ওই বাহ্যবস্তুকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। কারণ বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হলে বাহ্যবস্তুটি হয় অংশহীন একটি পরমাণু হবে, নতুবা একটি সাবয়ব যৌগিক বস্তু হবে। যদি সেটি পরমাণু হয় তাহলে তাকে প্রত্যক্ষ করা যাবে না। কারণ পরমাণু প্রত্যক্ষগোচর নয়।
.
আবার যৌগিক বস্তুও পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না। কারণ কোন যৌগিক বস্তুর সকল অংশ যুগপৎ প্রত্যক্ষগোচর হয় না, কেননা ইন্দ্রিয়ের সাথে তার সর্বাংশের সংযোগ হয় না। কেবলমাত্র একটি অবয়ব বা অংশ জ্ঞানের বিষয় হলে ঘটাদি বিষয়ের অংশমাত্রকেই ঘট বলতে হয়। সুতরাং অবয়বিরূপে বাহ্যবস্তুকে অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, পরমাণু কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয় ? পরমাণু যদি অংশবিহীন হয় তাহলে তাদের মধ্যে সংযোগ হয় না। কারণ পদার্থের একটি অংশের সঙ্গেই অপর অংশের সংযোগ হয়। পরমাণুর অংশ না থাকায় তাদের সংযোগ হয় না। অতএব বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
.
এক্ষেত্রে সর্বাস্তিবাদী (সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক) দার্শনিকদের মতে জ্ঞানে বিষয় প্রকাশিত হয়। অতএব জ্ঞান হলো বিষয়ের প্রকাশক। প্রকাশ্য ও প্রকাশক যেহেতু পরস্পর সাপেক্ষ, সেহেতু জ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করলে বিষয়ের অস্তিত্বও স্বীকার করতে হয়।
জবাবে বিজ্ঞানবাদীরা বলেন, জ্ঞান বিষয়রহিত। যেমন আকাশে দুটি চন্দ্র না থাকলেও তা আমাদের বিষয় হয়। অর্থাৎ প্রকাশ্য বিষয় না থাকলেও প্রকাশক জ্ঞান থাকতে পারে। সুতরাং প্রকাশক জ্ঞান আছে বলেই প্রকাশ্য বাহ্যবস্তু আছে একথা প্রমাণিত হয় না।
.
আপত্তি হতে পারে, কোন বিষয়ই যদি না থাকে তাহলে বিভিন্ন মানুষের জ্ঞান ভিন্ন ভিন্ন হয় কেন ? বিষয়ই জ্ঞানে আকারের সমর্পক হয় অর্থাৎ জ্ঞানে যে ভেদ দেখা যায় তা বিষয়ের প্রতিবিম্বনের দরুণ হয়ে থাকে। বিষয়কে অবলম্বন না করে জ্ঞানের বৈচিত্র্য সাধিত হতে পারে না। জ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যেখানে বিষয়টি আছে সেখানে যে ব্যক্তি আছে একমাত্র তারই সেই বিষয়ের জ্ঞান হবে। একে দেশনিয়ম বলে। আবার বিষয়ের জ্ঞান সর্বদা সর্বকালে হয় না। একে জ্ঞানের কালনিয়ম বলে। যেমন আকাশে দুটি চন্দ্র সব ব্যক্তি সর্বকালে দেখে না। এই দেশনিয়ম ও কালনিয়ম প্রমাণ করে যে আমরা জ্ঞানের স্রষ্টা নই। বাহ্যবস্তুই জ্ঞানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আকার আরোপ করে।
.
এ আপত্তির উত্তরে বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা বলেন, আমাদের মানসিক অবস্থা তিন প্রকার- জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। স্বপ্নজ্ঞানও জাগ্রত অবস্থার মতোই জ্ঞান। স্বপ্নজ্ঞানে যেসব বিষয় আমাদের জ্ঞানের বিষয় হয় যেমন স্বর্গ, বাহ্যজগতে তার কোন অস্তিত্ব নেই। যদিও তাতে দেশনিয়ম, কালনিয়ম, অর্থক্রিয়াকারিত্ব সবই আছে। সুতরাং জাগ্রত অবস্থায় আমরা ঘট, পট প্রভৃতি যে সব বিষয় প্রত্যক্ষ করি সেগুলিও বাহ্যজগতে নেই। সুতরাং সব বস্তুই জ্ঞানাকার বা বিজ্ঞানেরই আকার। ‘লঙ্কাবতারসূত্র’ অনুসারে বিজ্ঞান হতে অতিরিক্ত সমস্ত ধর্ম হচ্ছে অসৎ (=অলীক)। কাম বা বস্তু, রূপ, অরূপ এই তিনটি আসলে বিজ্ঞানের বিকল্প। বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে কোন বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব নেই। যা কিছু আছে তা সকলই বিজ্ঞান।
.
যোগাচার দার্শনিকদের মতে, বস্তু ও বস্তুর চেতনা ভিন্ন নয়। বসুবন্ধু তাঁর ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ গ্রন্থে বলেছেন-
আবার যৌগিক বস্তুও পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না। কারণ কোন যৌগিক বস্তুর সকল অংশ যুগপৎ প্রত্যক্ষগোচর হয় না, কেননা ইন্দ্রিয়ের সাথে তার সর্বাংশের সংযোগ হয় না। কেবলমাত্র একটি অবয়ব বা অংশ জ্ঞানের বিষয় হলে ঘটাদি বিষয়ের অংশমাত্রকেই ঘট বলতে হয়। সুতরাং অবয়বিরূপে বাহ্যবস্তুকে অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো, পরমাণু কিভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয় ? পরমাণু যদি অংশবিহীন হয় তাহলে তাদের মধ্যে সংযোগ হয় না। কারণ পদার্থের একটি অংশের সঙ্গেই অপর অংশের সংযোগ হয়। পরমাণুর অংশ না থাকায় তাদের সংযোগ হয় না। অতএব বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
.
এক্ষেত্রে সর্বাস্তিবাদী (সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক) দার্শনিকদের মতে জ্ঞানে বিষয় প্রকাশিত হয়। অতএব জ্ঞান হলো বিষয়ের প্রকাশক। প্রকাশ্য ও প্রকাশক যেহেতু পরস্পর সাপেক্ষ, সেহেতু জ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করলে বিষয়ের অস্তিত্বও স্বীকার করতে হয়।
জবাবে বিজ্ঞানবাদীরা বলেন, জ্ঞান বিষয়রহিত। যেমন আকাশে দুটি চন্দ্র না থাকলেও তা আমাদের বিষয় হয়। অর্থাৎ প্রকাশ্য বিষয় না থাকলেও প্রকাশক জ্ঞান থাকতে পারে। সুতরাং প্রকাশক জ্ঞান আছে বলেই প্রকাশ্য বাহ্যবস্তু আছে একথা প্রমাণিত হয় না।
.
আপত্তি হতে পারে, কোন বিষয়ই যদি না থাকে তাহলে বিভিন্ন মানুষের জ্ঞান ভিন্ন ভিন্ন হয় কেন ? বিষয়ই জ্ঞানে আকারের সমর্পক হয় অর্থাৎ জ্ঞানে যে ভেদ দেখা যায় তা বিষয়ের প্রতিবিম্বনের দরুণ হয়ে থাকে। বিষয়কে অবলম্বন না করে জ্ঞানের বৈচিত্র্য সাধিত হতে পারে না। জ্ঞানের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, যেখানে বিষয়টি আছে সেখানে যে ব্যক্তি আছে একমাত্র তারই সেই বিষয়ের জ্ঞান হবে। একে দেশনিয়ম বলে। আবার বিষয়ের জ্ঞান সর্বদা সর্বকালে হয় না। একে জ্ঞানের কালনিয়ম বলে। যেমন আকাশে দুটি চন্দ্র সব ব্যক্তি সর্বকালে দেখে না। এই দেশনিয়ম ও কালনিয়ম প্রমাণ করে যে আমরা জ্ঞানের স্রষ্টা নই। বাহ্যবস্তুই জ্ঞানে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আকার আরোপ করে।
.
এ আপত্তির উত্তরে বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা বলেন, আমাদের মানসিক অবস্থা তিন প্রকার- জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি। স্বপ্নজ্ঞানও জাগ্রত অবস্থার মতোই জ্ঞান। স্বপ্নজ্ঞানে যেসব বিষয় আমাদের জ্ঞানের বিষয় হয় যেমন স্বর্গ, বাহ্যজগতে তার কোন অস্তিত্ব নেই। যদিও তাতে দেশনিয়ম, কালনিয়ম, অর্থক্রিয়াকারিত্ব সবই আছে। সুতরাং জাগ্রত অবস্থায় আমরা ঘট, পট প্রভৃতি যে সব বিষয় প্রত্যক্ষ করি সেগুলিও বাহ্যজগতে নেই। সুতরাং সব বস্তুই জ্ঞানাকার বা বিজ্ঞানেরই আকার। ‘লঙ্কাবতারসূত্র’ অনুসারে বিজ্ঞান হতে অতিরিক্ত সমস্ত ধর্ম হচ্ছে অসৎ (=অলীক)। কাম বা বস্তু, রূপ, অরূপ এই তিনটি আসলে বিজ্ঞানের বিকল্প। বলা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে কোন বাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব নেই। যা কিছু আছে তা সকলই বিজ্ঞান।
.
যোগাচার দার্শনিকদের মতে, বস্তু ও বস্তুর চেতনা ভিন্ন নয়। বসুবন্ধু তাঁর ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘অবিভাগোহপি বুদ্ধ্যাত্মা বিপর্য়াসিতদর্শনৈঃ।
গ্রাহ্যগ্রাহকসংবিত্তিভেদবানিব লক্ষ্যতে।।’ ইতি।
অর্থাৎ : জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের ভেদ মিথ্যা, অবিদ্যার দ্বারা সৃষ্ট। বস্তুত তাদের মধ্যে কোন ভেদ নেই।
.
কারণ, যদি নীল রং এবং নীল রং-এর চেতনা ভিন্ন হতো তাহলে যখন আমরা নীল রং দেখি তখন নীল রং-এর জ্ঞান হতো না। কিন্তু এরকম কখনো হয় না। তাই আমাদের স্বীকার করতে হবে যে নীল রং এবং নীল রঙের চেতনা এক এবং অভিন্ন। এদের মধ্যে যে ভেদ-প্রতীতি হয় তা ভ্রান্ত। এ প্রেক্ষিতে বসুবন্ধু বলেছেন-
‘সহোপলম্ভনিয়মাদভেদো নীলতদ্ধিয়োঃ।
ভেদশ্চ ভ্রান্তিবিজ্ঞানৈর্দৃশ্যেতেন্দাবিবাদ্বয়ে।।’ (বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি)
অর্থাৎ : সহোপলম্ভ নিয়মবশতই আমরা সর্বদা নীল এবং নীল রঙের জ্ঞানকে অভিন্ন বলে জানি। ভ্রান্তিবশতই তাদের মধ্যে ভেদ প্রতীতি হয়, তিমির ব্যাধির (চক্ষুরোগ) দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি যেমন অনস্তিত্বশীল বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে, তেমনি অনাদি বাসনাযুক্ত জীব জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের বিচিত্র ভেদ প্রত্যক্ষ করে।
.
জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়ের সমকালীন উপলব্ধিকে বলে সহোপলম্ভ নিয়ম। এই নিয়মই প্রমাণ করে জ্ঞানের বিষয় এবং বিষয়ের জ্ঞান এক এবং অভিন্ন। যদি জ্ঞানের সাথে জ্ঞেয় বিষয়ের ভেদ থাকতো তবে তাদের মধ্যে কোন সম্বন্ধ হতো না। তাই বলা হয়েছে-
‘নন্যোহনুভাব্যো বুদ্ধ্যাস্তি তস্যা নানুভবোহপরঃ।
গ্রাহ্যগ্রাহকবৈধুর্যাৎ স্বয়ং সৈব প্রকাশতে।।’ ইতি।
অর্থাৎ : জ্ঞানব্যতিরিক্ত কোন পৃথক জ্ঞেয় পদার্থ নেই। জ্ঞানের কোন পৃথক জ্ঞান বা অনুভব নেই। গ্রাহ্য ও গ্রাহক ভেদ বা পৃথক অস্তিত্ব না থাকায় জ্ঞান স্বয়ং-ই প্রকাশিত হয়।
.
যেটি যার জ্ঞান তা সেই বিষয়েই হয়ে থাকে। নীল রং নীল রঙের জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞেয়, সুতরাং ওই জ্ঞান অভিন্ন। জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের মধ্যে এই নিয়ত সম্বন্ধটিকে তাদাত্ম্য সম্বন্ধও বলে। বিদ্যার দ্বারা যখন অবিদ্যা তথা অনাদি বাসনা বিনষ্ট হয়, তখন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের অভিন্ন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উদয় হয়। এই বিশুদ্ধ জ্ঞানকে বলা হয় ‘মহোদয়’।
.
প্রশ্ন হলো, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যে জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়কে ভিন্নরূপে প্রত্যক্ষ করি তা কেন হয় ?
উত্তরে যোগাচার দার্শনিকরা বলেন, ভ্রমবশত আমরা এরূপ প্রত্যক্ষ করি। যেমন, প্রকৃতপক্ষে চন্দ্র এক হওয়া সত্ত্বেও ভ্রমবশত আমরা দ্বিচন্দ্র প্রত্যক্ষ করি। জাগ্রত অবস্থায়ও জ্ঞান ও বিষয়ের যে ভেদ আমরা অনুভব করি, তা মিথ্যা। জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয় নিত্যসম্বন্ধযুক্ত বলে তারা অভিন্ন। সুতরাং জ্ঞানের অতিরিক্ত বস্তুর বাহ্যিক সত্তা নেই। তাই বলা হয়েছে-
.
প্রশ্ন হলো, জাগ্রত অবস্থায় আমরা যে জ্ঞান ও জ্ঞানের বিষয়কে ভিন্নরূপে প্রত্যক্ষ করি তা কেন হয় ?
উত্তরে যোগাচার দার্শনিকরা বলেন, ভ্রমবশত আমরা এরূপ প্রত্যক্ষ করি। যেমন, প্রকৃতপক্ষে চন্দ্র এক হওয়া সত্ত্বেও ভ্রমবশত আমরা দ্বিচন্দ্র প্রত্যক্ষ করি। জাগ্রত অবস্থায়ও জ্ঞান ও বিষয়ের যে ভেদ আমরা অনুভব করি, তা মিথ্যা। জ্ঞান এবং জ্ঞানের বিষয় নিত্যসম্বন্ধযুক্ত বলে তারা অভিন্ন। সুতরাং জ্ঞানের অতিরিক্ত বস্তুর বাহ্যিক সত্তা নেই। তাই বলা হয়েছে-
‘অবেদ্যবেদকাকারা যথা ভ্রান্তৈর্নিরীক্ষ্যতে।
বিভক্তলক্ষণগ্রাহ্যগ্রাহকাকারবিপ্লবা।।’
অর্থাৎ : জ্ঞান হচ্ছে বেদ্য ও বেদক এরূপ আকাররহিত, কিন্তু ভ্রমের দরুন লোকে তার স্বরূপকে গ্রাহ্য গ্রাহক অবস্থাপন্নরূপ ভিন্ন ভিন্ন বলে প্রত্যক্ষ করে।
.
এখানে আপত্তি হতে পারে, যা জ্ঞান থেকে ভিন্ন নয় সেটি কিভাবে জ্ঞানের বিষয় হবে ?
উত্তরে বলা হয়, জ্ঞানের বিষয় যে জ্ঞানের অতিরিক্ত বা জ্ঞানের থেকে ভিন্ন হবেই একথা বলা যায় না। কারণ যেখানে আমাদের স্বসংবেদন হয় সেখানে জ্ঞান নিজেকেই জানে। এখানে জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানভিন্ন হতেই হবে এমন কোন নিয়ম করা যায় না।
.
আপত্তি হতে পারে, সমস্ত জ্ঞান বিষয়শূন্য হতে পারে না। কারণ কোন কোন জ্ঞান থেকে সফল প্রবৃত্তি হয়, আবার কোন কোন জ্ঞান থেকে বিফল প্রবৃত্তি হয়। আসল সোনা দেখে আমরা তাকে নিতে যাই এবং এই প্রবৃত্তি বা নিতে যাওয়া সফল হয়। সোনার মতো চকচকে বস্তুকে সোনা মনে করে নিতে গেলে সেই প্রবৃত্তি বিফল হয়। এই প্রভেদ যে হয় তার কারণ একটি ক্ষেত্রে বাহ্যবস্তু আছে, অপর ক্ষেত্রটিতে বাহ্যবস্তু নেই। অতএব বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব মানতে হবে।
এই আপত্তির উত্তরে বিজ্ঞানবাদীরা বলেন, স্বপ্নে আমরা বাঘ বা সাপের মতো অবাস্তব হিংস্র জন্তু দেখি, তখন বাস্তব হৃদকম্প হয়। অতএব প্রবৃত্তির সফলতা একথা প্রমাণ করে না যে বাহ্যবস্তু আছে।
.
যোগাচার বিজ্ঞানবাদীরা আরো বলেন যে, যদি বা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, বাহ্যবস্তু কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। বৌদ্ধ দর্শনের সাধারণ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী (প্রতীত্য-সমুৎপাদ) বাহ্যবস্তু স্বরূপত ক্ষণিক, অর্থাৎ এক ক্ষণ স্থায়ী। সুতরাং কোন বস্তু সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হয় তখন জ্ঞানের উৎপাদক সেই বস্তুটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে বস্তু ছাড়াই জ্ঞানের অস্তিত্ব থাকে।
.
আবার অন্যভাবে বললে, প্রথমত, যদি বা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, বাহ্যবস্তু কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। যদি জ্ঞানভিন্ন বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে তাহলে প্রশ্ন উঠে এই বস্তু কি উৎপন্ন হয়ে জ্ঞানের বিষয় হয়, অথবা উৎপন্ন না হয়ে জ্ঞানের বিষয় হয়? বাহ্যবস্তু উৎপন্ন হয়ে জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, কারণ ক্ষণিকবস্তু উৎপত্তির পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়। উৎপন্ন হবার পর তাই বিষয়ের জ্ঞান হবার আর অবকাশ থাকে না। আবার বাহ্যবস্তু উৎপন্ন না হয়েও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। যা উৎপন্ন হয়নি তা অসৎ। অসৎ কখনো জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। আবার যদি বলা হয় বাহ্যবস্তু জ্ঞানের কারণ সামগ্রী, তাই ক্ষণকাল পরে বাহ্যবস্তু বিনষ্ট হলেও বিনষ্ট হবার পর তা জ্ঞানের বিষয় হয়, তাহলে সে যুক্তিও গ্রহণযোগ্য হয় না। জ্ঞানের কারণ বলে যদি অতীত বস্তুকে জ্ঞানের বিষয় বলতে হয় তাহলে ইন্দ্রিয়াদিকেও একই কারণে জ্ঞানের বিষয় বলতে হবে। কিন্তু ইন্দ্রিয় যে জ্ঞানের কারণ হয়, সে-ই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না।
.
দ্বিতীয়ত, বাহ্যবস্তু যদি জ্ঞানের বিষয় হয তাহলে তা হয় পরমাণুরূপে কিংবা অবয়বীরূপে জ্ঞানের বিষয় হবে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় ও অপ্রত্যক্ষযোগ্য এবং কল্পিত নিরংশ পরমাণু কিংবা সর্ব অংশ বা সর্ব অবয়ব একই সঙ্গে কোন জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। আর কোন একটি অংশ যদি জ্ঞানের বিষয় হয়, তাহলে সেই অংশমাত্রকে অবয়বী রূপে গ্রহণ করাও উচিত নয়। এ বিষয়ে বসুবন্ধু তাঁর ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ গ্রন্থে বলেছেন-
এখানে আপত্তি হতে পারে, যা জ্ঞান থেকে ভিন্ন নয় সেটি কিভাবে জ্ঞানের বিষয় হবে ?
উত্তরে বলা হয়, জ্ঞানের বিষয় যে জ্ঞানের অতিরিক্ত বা জ্ঞানের থেকে ভিন্ন হবেই একথা বলা যায় না। কারণ যেখানে আমাদের স্বসংবেদন হয় সেখানে জ্ঞান নিজেকেই জানে। এখানে জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানভিন্ন হতেই হবে এমন কোন নিয়ম করা যায় না।
.
আপত্তি হতে পারে, সমস্ত জ্ঞান বিষয়শূন্য হতে পারে না। কারণ কোন কোন জ্ঞান থেকে সফল প্রবৃত্তি হয়, আবার কোন কোন জ্ঞান থেকে বিফল প্রবৃত্তি হয়। আসল সোনা দেখে আমরা তাকে নিতে যাই এবং এই প্রবৃত্তি বা নিতে যাওয়া সফল হয়। সোনার মতো চকচকে বস্তুকে সোনা মনে করে নিতে গেলে সেই প্রবৃত্তি বিফল হয়। এই প্রভেদ যে হয় তার কারণ একটি ক্ষেত্রে বাহ্যবস্তু আছে, অপর ক্ষেত্রটিতে বাহ্যবস্তু নেই। অতএব বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব মানতে হবে।
এই আপত্তির উত্তরে বিজ্ঞানবাদীরা বলেন, স্বপ্নে আমরা বাঘ বা সাপের মতো অবাস্তব হিংস্র জন্তু দেখি, তখন বাস্তব হৃদকম্প হয়। অতএব প্রবৃত্তির সফলতা একথা প্রমাণ করে না যে বাহ্যবস্তু আছে।
.
যোগাচার বিজ্ঞানবাদীরা আরো বলেন যে, যদি বা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, বাহ্যবস্তু কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। বৌদ্ধ দর্শনের সাধারণ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী (প্রতীত্য-সমুৎপাদ) বাহ্যবস্তু স্বরূপত ক্ষণিক, অর্থাৎ এক ক্ষণ স্থায়ী। সুতরাং কোন বস্তু সম্পর্কে যখন আমাদের জ্ঞান হয় তখন জ্ঞানের উৎপাদক সেই বস্তুটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণ হয় যে বস্তু ছাড়াই জ্ঞানের অস্তিত্ব থাকে।
.
আবার অন্যভাবে বললে, প্রথমত, যদি বা বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, বাহ্যবস্তু কখনও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। যদি জ্ঞানভিন্ন বাহ্যবস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে তাহলে প্রশ্ন উঠে এই বস্তু কি উৎপন্ন হয়ে জ্ঞানের বিষয় হয়, অথবা উৎপন্ন না হয়ে জ্ঞানের বিষয় হয়? বাহ্যবস্তু উৎপন্ন হয়ে জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, কারণ ক্ষণিকবস্তু উৎপত্তির পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়। উৎপন্ন হবার পর তাই বিষয়ের জ্ঞান হবার আর অবকাশ থাকে না। আবার বাহ্যবস্তু উৎপন্ন না হয়েও জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। যা উৎপন্ন হয়নি তা অসৎ। অসৎ কখনো জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। আবার যদি বলা হয় বাহ্যবস্তু জ্ঞানের কারণ সামগ্রী, তাই ক্ষণকাল পরে বাহ্যবস্তু বিনষ্ট হলেও বিনষ্ট হবার পর তা জ্ঞানের বিষয় হয়, তাহলে সে যুক্তিও গ্রহণযোগ্য হয় না। জ্ঞানের কারণ বলে যদি অতীত বস্তুকে জ্ঞানের বিষয় বলতে হয় তাহলে ইন্দ্রিয়াদিকেও একই কারণে জ্ঞানের বিষয় বলতে হবে। কিন্তু ইন্দ্রিয় যে জ্ঞানের কারণ হয়, সে-ই জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না।
.
দ্বিতীয়ত, বাহ্যবস্তু যদি জ্ঞানের বিষয় হয তাহলে তা হয় পরমাণুরূপে কিংবা অবয়বীরূপে জ্ঞানের বিষয় হবে। কিন্তু অতীন্দ্রিয় ও অপ্রত্যক্ষযোগ্য এবং কল্পিত নিরংশ পরমাণু কিংবা সর্ব অংশ বা সর্ব অবয়ব একই সঙ্গে কোন জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। আর কোন একটি অংশ যদি জ্ঞানের বিষয় হয়, তাহলে সেই অংশমাত্রকে অবয়বী রূপে গ্রহণ করাও উচিত নয়। এ বিষয়ে বসুবন্ধু তাঁর ‘বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘ষটকেন যুগপদ্ যোগাৎ পরমাণোঃ ষড়ংশতা।
তেষামপ্যেকদেশত্বে পিন্ডঃ স্যাদণুমাত্রকঃ।।’ (বিজ্ঞপ্তিমাত্রতাসিদ্ধি-১২)
অর্থাৎ : ছয়টি দিকের সাথে একসঙ্গে যুক্ত হলে পরমাণু ষড়ংশবিশিষ্ট হবে। ছয়টি অংশ যদি সমান (=অভিন্ন) দেশ বা স্থান হয় তবে ঘটাদি বস্তুও অণুপরিমাণক হবে, তার মহৎ পরিমাণ স্বীকার করা যাবে না।
.
অতএব, উপরিউক্ত এসব যুক্তির ভিত্তিতে যোগাচার বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা সিদ্ধান্ত করেন যে, মননিরপেক্ষ বাহ্যবস্তুর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। দৃশ্যমান বাহ্যজগৎ চেতনার মধ্যে প্রতিভাত হয় এবং চেতনার মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং বিজ্ঞান বা চেতনাই একমাত্র সত্তা।
.
বিজ্ঞানবাদ মতে, আলয় বিজ্ঞানে সুপ্ত ও পরিবর্তনশীল সংস্কারসমূহের মধ্যে কোন একটি মুহূর্তে যে সংস্কারটি উদ্বুদ্ধ হয়, সেই সংস্কারটিরই জ্ঞান হয়। জ্ঞান-জনক এই সংস্কারই বাহ্যবস্তুরূপে প্রতীত হয়। ‘আলয় বিজ্ঞান’ অর্থ হচ্ছে পরিবর্তনশীল চেতনার প্রবাহ। ‘আলয় বিজ্ঞান’ ছাড়াও বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকেরা বিজ্ঞানের আরো দুটি স্তর স্বীকার করেন। এই দুটি স্তরের একটি হলো ‘মনোবিজ্ঞান’ এবং অপরটি হলো ‘প্রবৃত্তিবিজ্ঞান’। আলয় বিজ্ঞানে সকল প্রকার সংস্কার বা ধারণা বীজাবস্থায় থাকে। মনোবিজ্ঞানের স্তরে এই সকল ধারণা নামরূপ সমন্বিত বস্তুর আকার গ্রহণ করে। প্রবৃত্তিবিজ্ঞানের স্তরে বিজ্ঞানের দ্বারা সৃষ্ট বাহ্যবস্তু জ্ঞানের বিষয় হয়।
.
বিজ্ঞানের পরিণাম :
বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদার্শনিক বসুবন্ধু বলেন যে, আত্মা, ধর্ম প্রভৃতি সমস্তই বিজ্ঞানের পরিণাম। এই পরিণাম তিন প্রকারের- (১) আলয়বিজ্ঞান, (২) আলম্বন, (৩) বিষয়বিজ্ঞপ্তি।
.
আলয়বিজ্ঞান হচ্ছে সমস্ত ধর্মের বীজস্বরূপ। সমস্ত সাংক্লেশিক ধর্ম যা হতে জগতের উৎপত্তি, তার বীজ এখানে নিহিত থাকে বলে একে আলয় বলা হয়। ‘আলয়’ শব্দের অর্থ গৃহ। প্রবৃত্তিবিজ্ঞান আলয়বিজ্ঞানের উপর অবলম্বিত। সকল জ্ঞান বীজরূপে এখানে একত্রিত থাকে।
এই আলয়বিজ্ঞানের পরিণতি দু’রকমের- অধ্যাত্ম এবং বহির্ধা। অধ্যাত্মকে উপাদানবিজ্ঞপ্তিও বলা হয়, কেননা সমস্ত বস্তুর গ্রহণ করার শক্তি এই অধ্যাত্মবিজ্ঞানে নিহিত থাকে। এ ছাড়া যা কিছু সমস্তই বহির্ধা বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।
.
অধ্যাত্ম বা উপাদানবিজ্ঞানের পরিণতি তিন প্রকারের- (১) পরিকল্পিত স্বভাবাভিনিবেশ বাসনা অর্থাৎ যে বাসনাবীজ হতে জগতের পরিকল্পিত স্বভাব উদ্ভূত হয়, (২) ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়স্থান যা হতে রূপাদির জ্ঞান উদ্ভূত হয় এবং (৩) নাম অর্থাৎ যে জ্ঞানের দ্বারা সংজ্ঞা স্থির করা হয়। এ কারণে স্পর্শ, মনস্কার, বেদনা, সংজ্ঞা ও চেতনা প্রভৃতি আলয়বিজ্ঞানেরই পরিণতি। এই পাঁচটি হতে সমস্ত ধর্মের জ্ঞান উদ্ভূত হয়।
.
ইন্দ্রিয়, বিষয় ও বিজ্ঞান এই ত্রিকের সন্নিপাতে (=সঙ্ঘটনে) স্পর্শের উৎপত্তি হয়। সুতরাং স্পর্শ হচ্ছে ইন্দ্রিয়বিকার মাত্র। মনস্কার হচ্ছে ‘চেতস আভোগ’ বা বিষয়ের প্রতি চিত্তের অভিমুখী ক্রিয়া। বেদনা হচ্ছে অনুভব। এই অনুভব তিন প্রকারের- সুখ, দুঃখ ও অদুঃখ-অসুখ। সংজ্ঞা হচ্ছে বিষয়নিমিত্তের নিরূপণ এবং চেতনা হচ্ছে মনের চেষ্টা।
আলয়বিজ্ঞানের এই পরিণতি হতে যে ধর্মসমূহের উৎপত্তি হয় তাদের কোন স্থায়িত্ব নেই। বসুবন্ধু তাদের নদীস্রোতের সাথে তুলনা করেছেন।
.
বিজ্ঞানের দ্বিতীয় পরিণতি হচ্ছে আলম্বন। বসুবন্ধুর ‘ত্রিংশিকাকারিকা’তে এই আলম্বনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আলম্বন আলয়বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে উদ্ভূত হয়। এই আলম্বন হচ্ছে মননাত্মক। সুতরাং এই আলম্বনকে মনোবিজ্ঞান বলা চলে। এই আলম্বনের পরিণতিতেই চার প্রকার ক্লেশের উৎপত্তি হয়। এই চার প্রকার ক্লেশ হচ্ছে- আত্মদৃষ্টি, আত্মমোহ, আত্মমান এবং আত্মস্নেহ।
বিজ্ঞানের তৃতীয় পরিণতি হচ্ছে বিষয়বিজ্ঞপ্তি। বিষয় হচ্ছে ছয় প্রকার- রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শনীয় এবং ধর্মাত্মক। এই বিষয়বিজ্ঞপ্তির পরিণতিতে যে ধর্মসমূহের উদ্ভব হয় সেগুলি হচ্ছে সৌত্রান্তিকের ছয় প্রকার চৈত্তধর্ম- চিত্তমহাভূমিক, কুশল, ক্লেশ, অকুশল, উপক্লেশ ও অনিয়তভূমিক।
.
বিজ্ঞানবাদে বিজ্ঞানের দুটি ভেদ স্বীকার করা হয়। একটি আলয়বিজ্ঞান এবং অন্যটি প্রবৃত্তিবিজ্ঞান। প্রবৃত্তিবিজ্ঞানের আবার সাতটি ভেদ। তারা হচ্ছে- চক্ষুর্বিজ্ঞান, শ্রোত্রবিজ্ঞান, ধারণবিজ্ঞান, রসনাবিজ্ঞান, কায়বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞান। প্রথম পাঁচটি বিজ্ঞান হতে বস্তুর জ্ঞান হয়, মনোবিজ্ঞান তাদের বিচার (=মনন) করে এবং বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানের দ্বারা তাদের প্রত্যক্ষ হয়। এই সকলকে সংযোজনকারী হচ্ছে চিত্ত যাকে আলয়বিজ্ঞান বলা হয়।
সুতরাং বিজ্ঞানবাদ অনুসারে সমস্তই বিজ্ঞানমাত্র। বিজ্ঞানের পরিণামেই ত্রিজগতের উদ্ভব। এই কারণে ত্রিজগৎকে অলীক বলা হয়েছে।
.
‘মহাযানসম্পরিগ্রহশাস্ত্র’-এ অসঙ্গ যোগাচার মতের প্রধান দশটি বিষয়ে উল্লেখ করেছেন এভাবে-
(১) আলয়বিজ্ঞান সমস্ত জীবে ব্যাপ্ত।
(২) জ্ঞান তিন প্রকার- ভ্রম, সাপেক্ষ ও নিরপেক্ষ।
(৩) বাহ্যজগৎ এবং আভ্যন্তজগৎ আলয়বিজ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ বা অভিব্যক্তি।
(৪) ছয়টি পূর্ণতা আবশ্যক।
(৫) বুদ্ধত্ব লাভের জন্য বোধিসত্ত্বের দশটি অবস্থা অতিক্রম করতে হয়।
(৬) মহাযান হীনযান অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ। হীনযান হচ্ছে ব্যক্তিবাদী, স্বার্থপর ও সঙ্গীর্ণ। তাঁরা বুদ্ধ-উপদেশের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।
(৭) বোধির (=প্রজ্ঞার) দ্বারা বুদ্ধের ধর্মকায়ের সাথে এক (=অভিন্ন) হওয়া হচ্ছে লক্ষ্য।
(৮) বিষয়-বিষয়ী দ্বৈতকে অতিক্রম করে শুদ্ধ চেতনার দ্বারা একত্ব স্থাপন করা বাঞ্ছনীয়।
(৯) পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ হতে সংসার ও নির্বাণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
(১০) ধর্মকায় হচ্ছে বুদ্ধের শরীরতত্ত্ব। তা হচ্ছে পূর্ণ শুদ্ধ চেতনা। এর অভিব্যক্তি সাংসারিক দৃষ্টিতে নির্মাণকায় এবং নির্বাণের দৃষ্টিতে সম্ভোগকায় বলে অভিহিত হয়।
.
সর্বাস্তিবাদী সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় কর্তৃক বিজ্ঞানবাদ খণ্ডন :
বৌদ্ধধর্মের অন্য একটি সম্প্রদায় সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়, যাদের দর্শনকে সর্বাস্তিবাদী দর্শনও বলা হয়। এই হীনযানী সম্প্রদায় তাঁদের যুক্তি উত্থাপন করে মহাযানী বিজ্ঞানবাদের কঠোর সমালোচনা করেন। সৌত্রান্তিকদের সর্বাস্তিবাদী দর্শন অনুযায়ী বাহ্যজগৎ ও মনোজগৎ উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। যোগাচার বিজ্ঞানবাদীরা যেহেতু জ্ঞানের অতিরিক্ত বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, তাই বিজ্ঞানবাদ খণ্ডিত না হলে সৌত্রান্তিক মত প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিজ্ঞানবাদ খণ্ডনে তাঁদের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ-
.
(০১) যোগাচার দর্শনের সহোপলম্ভ নিয়মে বলা হয়, জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয় এক ও অভিন্ন অর্থাৎ অভেদ। সৌত্রান্তিকরা বলেন, সংবেদন এবং তার বিষয়ের অনুভব এক সাথে হয় বলে ওই নিয়মটি সর্বদাই যে দুটি বস্তুর অভেদ প্রমাণ করে তা স্বীকার করা যায় না। যেমন যে জন্তু রোমন্থন করে তাঁরই পায়ের খুর দ্বিখণ্ডিত দেখা যায়। কিন্তু তা বলে এই দুটিকে কখনোই এক বলা যায় না। অর্থাৎ দ্বিখণ্ডিত খুর থাকা ও রোমন্থন করা এক জিনিস নয়।
.
(০২) সৌত্রান্তিক দার্শনিকদের মতে, বস্তু জ্ঞান হতে ভিন্ন। জ্ঞান আভ্যন্তর বা আত্মনিষ্ঠ, কিন্তু বস্তু বাহ্য বা বিষয়গত। বস্তু তার জ্ঞান হতে ভিন্ন। তাই ঘট ও ঘটের চেতনা অভিন্ন নয়। কারণ ঘট ও ঘটের চেতনা যদি স্বতন্ত্র না হয়ে অভিন্ন হতো তাহলে ‘আমি ঘট প্রত্যক্ষ করছি’ একথা না বলে আমরা বলতাম ‘আমিই ঘট’। কিন্তু একথা আমরা বলি না। সুতরাং জ্ঞেয় বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে।
.
(০৩) যোগাচার বিজ্ঞানবাদ অনুসারে ‘চেতনা বা জ্ঞানই ভ্রমবশতঃ বাহ্যবস্তুরূপে প্রতিভাত হয়’। এই বক্তব্য খণ্ডন প্রসঙ্গে সৌত্রান্তিকরা বলেন, বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করলে ঐরূপ উপমামূলক বাক্য প্রযুক্ত হতে পারে না। কারণ যার অস্তিত্ব নেই, তা কখনোই কোন উপমার ভিত্তি হতে পারে না। যেমন ‘বসুমিত্র বন্ধ্যাপুত্রের মতো’- একথা আমরা কখনো বলি না, যেহেতু বন্ধ্যাপুত্রের কোন অস্তিত্ব নেই। সুতরাং, চেতনা বাহ্যবস্তুরূপে প্রতিভাত হয়- এই উপমা বোধগম্য হওয়ার জন্য যোগাচার দার্শনিকদের অবশ্যই বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।
.
(০৪) জ্ঞানের মধ্যে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এই বিভাগ রয়েছে। জ্ঞানের বিষয় যদি জ্ঞানেরই আকারবিশেষ হতো তাহলে তা কখনো জ্ঞেয় বস্তুরূপে প্রকাশিত হতো না। কিন্তু জ্ঞানের বিষয় বাহ্যবস্তুরূপে প্রকাশিত হয়। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানের বাইরে আছে, তা জ্ঞানের আকারমাত্র নয়।
.
(০৫) যদি বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব না থাকে তবে সকল জ্ঞান এক প্রকার হবে। ঘটজ্ঞান ও পটজ্ঞানে কোন ভেদ থাকবে না। কিন্তু ঘটজ্ঞান ও পটজ্ঞান এক ও অভিন্ন স্বীকার করা যায় না। আমাদের সব জ্ঞান একপ্রকার নয়। আমাদের জ্ঞান বা চেতনা কখনো নীলাকার, কখনো পীতাকার, কখনো ঘটাকার ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, প্রতিটি জ্ঞানই স্বরূপত জ্ঞান হলেও তাদের মধ্যে আকারগত বা বিষয়গত ভিন্নতা হয় কেন ? নীল আকার যদি জ্ঞানের স্বরূপ হতো তাহলে জ্ঞানে সর্বদাই নীলরূপের উপলব্ধি হতো, কিন্তু তা হয় না। অর্থাৎ এই নীলাকার চেতনার উপর নির্ভর করে না। এই কারণে সৌত্রান্তিক দার্শনিকরা বলেন, চেতনা বহির্ভূত বাহ্য বিষয় আছে বলেই জ্ঞানের আকারগত ভেদ হয়। পুষ্টি দ্বারা যেমন ভোজন অনুমান করা হয়, ভাষার দ্বারা যেমন দেশকে অনুমান করা হয়, তেমনি জ্ঞানাকারের দ্বারা বাহ্যবস্তুর অনুমান হয়।
.
(০৬) আমাদের জ্ঞানে যে আকার থাকে তা আমাদের দ্বারা আরোপিত হলে নীলাকার বা ঘটাকার জ্ঞানসৃষ্টি আমাদের ইচ্ছার অধীন হতো। কিন্তু জ্ঞানসৃষ্টি আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। সুতরাং, বাহ্যবস্তুই আমাদের জ্ঞানে বিভিন্ন আকার আরোপ করে একথাই বলতে হবে।
.
(০৭) কোন ধারণা সত্য হয়, আবার কোন ধারণা মিথ্যা হয়। একটি ধারণা যদি বস্তু অনুযায়ী হয় তাহলে সেটি সত্য। অপরপক্ষে বস্তুর সঙ্গে মিল না থাকলে ধারণাটি হয় মিথ্যা। কিন্তু যোগাচার বিজ্ঞানবাদ মতে ধারণার সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ বাহ্যবস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ অস্তিত্ব না থাকলে, বস্তুর ধারণা বস্তু অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা বোঝা যাবে না। সুতরাং যোগাচার মতানুসারে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করলে কোন ধারণার সত্যতা বা মিথ্যাত্ব বোঝা যাবে না।
.
(০৮) যোগাচার মতে বাহ্যবস্তু বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। তবুও আমাদের বাহ্যবস্তুর যে জ্ঞান হয় তা মিথ্যা। অর্থাৎ ওই জ্ঞান ভ্রান্তজ্ঞান। কিন্তু প্রমাজ্ঞান আগে না থাকলে ভ্রমজ্ঞান হয় না। যেমন দড়িকে যখন সাপ বলে ভ্রম হয়, তার আগে সাপের সঠিক জ্ঞান কোথাও না কোথাও হওয়া চাই। নইলে দড়িকে সাপ বলে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষও হবে না। অতএব বিজ্ঞানবাদী যদি বলেন যে বাহ্যবস্তুর জ্ঞান হলো ভ্রমজ্ঞান, তাহলে কোন না কোন বাহ্যবস্তুর যথার্থ জ্ঞান তাঁকে স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ বাহ্যবস্তু যদি বন্ধ্যাপুত্র বা শশশৃঙ্গের মতো অসৎ হয়, তাহলে বাহ্যবস্তু সম্বন্ধে ভ্রমজ্ঞানও হবে না।
.
(০৯) সর্বোপরি সৌত্রান্তিক দার্শনিকরা বলেন, প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য মন-বহির্ভূত বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। যেমন, খাদ্য সম্বন্ধে নিছক ধারণা কখনোই কোন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারে না। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য আমরা খাদ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। সুতরাং বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে।
.
এভাবে যোগাচার বিজ্ঞানবাদের যুক্তি খণ্ডন করে সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় মূলত তাঁদের মত প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন।
অতএব, উপরিউক্ত এসব যুক্তির ভিত্তিতে যোগাচার বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকরা সিদ্ধান্ত করেন যে, মননিরপেক্ষ বাহ্যবস্তুর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। দৃশ্যমান বাহ্যজগৎ চেতনার মধ্যে প্রতিভাত হয় এবং চেতনার মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং বিজ্ঞান বা চেতনাই একমাত্র সত্তা।
.
বিজ্ঞানবাদ মতে, আলয় বিজ্ঞানে সুপ্ত ও পরিবর্তনশীল সংস্কারসমূহের মধ্যে কোন একটি মুহূর্তে যে সংস্কারটি উদ্বুদ্ধ হয়, সেই সংস্কারটিরই জ্ঞান হয়। জ্ঞান-জনক এই সংস্কারই বাহ্যবস্তুরূপে প্রতীত হয়। ‘আলয় বিজ্ঞান’ অর্থ হচ্ছে পরিবর্তনশীল চেতনার প্রবাহ। ‘আলয় বিজ্ঞান’ ছাড়াও বিজ্ঞানবাদী দার্শনিকেরা বিজ্ঞানের আরো দুটি স্তর স্বীকার করেন। এই দুটি স্তরের একটি হলো ‘মনোবিজ্ঞান’ এবং অপরটি হলো ‘প্রবৃত্তিবিজ্ঞান’। আলয় বিজ্ঞানে সকল প্রকার সংস্কার বা ধারণা বীজাবস্থায় থাকে। মনোবিজ্ঞানের স্তরে এই সকল ধারণা নামরূপ সমন্বিত বস্তুর আকার গ্রহণ করে। প্রবৃত্তিবিজ্ঞানের স্তরে বিজ্ঞানের দ্বারা সৃষ্ট বাহ্যবস্তু জ্ঞানের বিষয় হয়।
.
বিজ্ঞানের পরিণাম :
বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদার্শনিক বসুবন্ধু বলেন যে, আত্মা, ধর্ম প্রভৃতি সমস্তই বিজ্ঞানের পরিণাম। এই পরিণাম তিন প্রকারের- (১) আলয়বিজ্ঞান, (২) আলম্বন, (৩) বিষয়বিজ্ঞপ্তি।
.
আলয়বিজ্ঞান হচ্ছে সমস্ত ধর্মের বীজস্বরূপ। সমস্ত সাংক্লেশিক ধর্ম যা হতে জগতের উৎপত্তি, তার বীজ এখানে নিহিত থাকে বলে একে আলয় বলা হয়। ‘আলয়’ শব্দের অর্থ গৃহ। প্রবৃত্তিবিজ্ঞান আলয়বিজ্ঞানের উপর অবলম্বিত। সকল জ্ঞান বীজরূপে এখানে একত্রিত থাকে।
এই আলয়বিজ্ঞানের পরিণতি দু’রকমের- অধ্যাত্ম এবং বহির্ধা। অধ্যাত্মকে উপাদানবিজ্ঞপ্তিও বলা হয়, কেননা সমস্ত বস্তুর গ্রহণ করার শক্তি এই অধ্যাত্মবিজ্ঞানে নিহিত থাকে। এ ছাড়া যা কিছু সমস্তই বহির্ধা বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।
.
অধ্যাত্ম বা উপাদানবিজ্ঞানের পরিণতি তিন প্রকারের- (১) পরিকল্পিত স্বভাবাভিনিবেশ বাসনা অর্থাৎ যে বাসনাবীজ হতে জগতের পরিকল্পিত স্বভাব উদ্ভূত হয়, (২) ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়স্থান যা হতে রূপাদির জ্ঞান উদ্ভূত হয় এবং (৩) নাম অর্থাৎ যে জ্ঞানের দ্বারা সংজ্ঞা স্থির করা হয়। এ কারণে স্পর্শ, মনস্কার, বেদনা, সংজ্ঞা ও চেতনা প্রভৃতি আলয়বিজ্ঞানেরই পরিণতি। এই পাঁচটি হতে সমস্ত ধর্মের জ্ঞান উদ্ভূত হয়।
.
ইন্দ্রিয়, বিষয় ও বিজ্ঞান এই ত্রিকের সন্নিপাতে (=সঙ্ঘটনে) স্পর্শের উৎপত্তি হয়। সুতরাং স্পর্শ হচ্ছে ইন্দ্রিয়বিকার মাত্র। মনস্কার হচ্ছে ‘চেতস আভোগ’ বা বিষয়ের প্রতি চিত্তের অভিমুখী ক্রিয়া। বেদনা হচ্ছে অনুভব। এই অনুভব তিন প্রকারের- সুখ, দুঃখ ও অদুঃখ-অসুখ। সংজ্ঞা হচ্ছে বিষয়নিমিত্তের নিরূপণ এবং চেতনা হচ্ছে মনের চেষ্টা।
আলয়বিজ্ঞানের এই পরিণতি হতে যে ধর্মসমূহের উৎপত্তি হয় তাদের কোন স্থায়িত্ব নেই। বসুবন্ধু তাদের নদীস্রোতের সাথে তুলনা করেছেন।
.
বিজ্ঞানের দ্বিতীয় পরিণতি হচ্ছে আলম্বন। বসুবন্ধুর ‘ত্রিংশিকাকারিকা’তে এই আলম্বনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আলম্বন আলয়বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে উদ্ভূত হয়। এই আলম্বন হচ্ছে মননাত্মক। সুতরাং এই আলম্বনকে মনোবিজ্ঞান বলা চলে। এই আলম্বনের পরিণতিতেই চার প্রকার ক্লেশের উৎপত্তি হয়। এই চার প্রকার ক্লেশ হচ্ছে- আত্মদৃষ্টি, আত্মমোহ, আত্মমান এবং আত্মস্নেহ।
বিজ্ঞানের তৃতীয় পরিণতি হচ্ছে বিষয়বিজ্ঞপ্তি। বিষয় হচ্ছে ছয় প্রকার- রূপ, রস, শব্দ, গন্ধ, স্পর্শনীয় এবং ধর্মাত্মক। এই বিষয়বিজ্ঞপ্তির পরিণতিতে যে ধর্মসমূহের উদ্ভব হয় সেগুলি হচ্ছে সৌত্রান্তিকের ছয় প্রকার চৈত্তধর্ম- চিত্তমহাভূমিক, কুশল, ক্লেশ, অকুশল, উপক্লেশ ও অনিয়তভূমিক।
.
বিজ্ঞানবাদে বিজ্ঞানের দুটি ভেদ স্বীকার করা হয়। একটি আলয়বিজ্ঞান এবং অন্যটি প্রবৃত্তিবিজ্ঞান। প্রবৃত্তিবিজ্ঞানের আবার সাতটি ভেদ। তারা হচ্ছে- চক্ষুর্বিজ্ঞান, শ্রোত্রবিজ্ঞান, ধারণবিজ্ঞান, রসনাবিজ্ঞান, কায়বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞান। প্রথম পাঁচটি বিজ্ঞান হতে বস্তুর জ্ঞান হয়, মনোবিজ্ঞান তাদের বিচার (=মনন) করে এবং বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানের দ্বারা তাদের প্রত্যক্ষ হয়। এই সকলকে সংযোজনকারী হচ্ছে চিত্ত যাকে আলয়বিজ্ঞান বলা হয়।
সুতরাং বিজ্ঞানবাদ অনুসারে সমস্তই বিজ্ঞানমাত্র। বিজ্ঞানের পরিণামেই ত্রিজগতের উদ্ভব। এই কারণে ত্রিজগৎকে অলীক বলা হয়েছে।
.
‘মহাযানসম্পরিগ্রহশাস্ত্র’-এ অসঙ্গ যোগাচার মতের প্রধান দশটি বিষয়ে উল্লেখ করেছেন এভাবে-
(১) আলয়বিজ্ঞান সমস্ত জীবে ব্যাপ্ত।
(২) জ্ঞান তিন প্রকার- ভ্রম, সাপেক্ষ ও নিরপেক্ষ।
(৩) বাহ্যজগৎ এবং আভ্যন্তজগৎ আলয়বিজ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ বা অভিব্যক্তি।
(৪) ছয়টি পূর্ণতা আবশ্যক।
(৫) বুদ্ধত্ব লাভের জন্য বোধিসত্ত্বের দশটি অবস্থা অতিক্রম করতে হয়।
(৬) মহাযান হীনযান অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ। হীনযান হচ্ছে ব্যক্তিবাদী, স্বার্থপর ও সঙ্গীর্ণ। তাঁরা বুদ্ধ-উপদেশের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন।
(৭) বোধির (=প্রজ্ঞার) দ্বারা বুদ্ধের ধর্মকায়ের সাথে এক (=অভিন্ন) হওয়া হচ্ছে লক্ষ্য।
(৮) বিষয়-বিষয়ী দ্বৈতকে অতিক্রম করে শুদ্ধ চেতনার দ্বারা একত্ব স্থাপন করা বাঞ্ছনীয়।
(৯) পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ হতে সংসার ও নির্বাণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
(১০) ধর্মকায় হচ্ছে বুদ্ধের শরীরতত্ত্ব। তা হচ্ছে পূর্ণ শুদ্ধ চেতনা। এর অভিব্যক্তি সাংসারিক দৃষ্টিতে নির্মাণকায় এবং নির্বাণের দৃষ্টিতে সম্ভোগকায় বলে অভিহিত হয়।
.
সর্বাস্তিবাদী সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় কর্তৃক বিজ্ঞানবাদ খণ্ডন :
বৌদ্ধধর্মের অন্য একটি সম্প্রদায় সৌত্রান্তিক সম্প্রদায়, যাদের দর্শনকে সর্বাস্তিবাদী দর্শনও বলা হয়। এই হীনযানী সম্প্রদায় তাঁদের যুক্তি উত্থাপন করে মহাযানী বিজ্ঞানবাদের কঠোর সমালোচনা করেন। সৌত্রান্তিকদের সর্বাস্তিবাদী দর্শন অনুযায়ী বাহ্যজগৎ ও মনোজগৎ উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। যোগাচার বিজ্ঞানবাদীরা যেহেতু জ্ঞানের অতিরিক্ত বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, তাই বিজ্ঞানবাদ খণ্ডিত না হলে সৌত্রান্তিক মত প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিজ্ঞানবাদ খণ্ডনে তাঁদের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ-
.
(০১) যোগাচার দর্শনের সহোপলম্ভ নিয়মে বলা হয়, জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয় এক ও অভিন্ন অর্থাৎ অভেদ। সৌত্রান্তিকরা বলেন, সংবেদন এবং তার বিষয়ের অনুভব এক সাথে হয় বলে ওই নিয়মটি সর্বদাই যে দুটি বস্তুর অভেদ প্রমাণ করে তা স্বীকার করা যায় না। যেমন যে জন্তু রোমন্থন করে তাঁরই পায়ের খুর দ্বিখণ্ডিত দেখা যায়। কিন্তু তা বলে এই দুটিকে কখনোই এক বলা যায় না। অর্থাৎ দ্বিখণ্ডিত খুর থাকা ও রোমন্থন করা এক জিনিস নয়।
.
(০২) সৌত্রান্তিক দার্শনিকদের মতে, বস্তু জ্ঞান হতে ভিন্ন। জ্ঞান আভ্যন্তর বা আত্মনিষ্ঠ, কিন্তু বস্তু বাহ্য বা বিষয়গত। বস্তু তার জ্ঞান হতে ভিন্ন। তাই ঘট ও ঘটের চেতনা অভিন্ন নয়। কারণ ঘট ও ঘটের চেতনা যদি স্বতন্ত্র না হয়ে অভিন্ন হতো তাহলে ‘আমি ঘট প্রত্যক্ষ করছি’ একথা না বলে আমরা বলতাম ‘আমিই ঘট’। কিন্তু একথা আমরা বলি না। সুতরাং জ্ঞেয় বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে।
.
(০৩) যোগাচার বিজ্ঞানবাদ অনুসারে ‘চেতনা বা জ্ঞানই ভ্রমবশতঃ বাহ্যবস্তুরূপে প্রতিভাত হয়’। এই বক্তব্য খণ্ডন প্রসঙ্গে সৌত্রান্তিকরা বলেন, বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করলে ঐরূপ উপমামূলক বাক্য প্রযুক্ত হতে পারে না। কারণ যার অস্তিত্ব নেই, তা কখনোই কোন উপমার ভিত্তি হতে পারে না। যেমন ‘বসুমিত্র বন্ধ্যাপুত্রের মতো’- একথা আমরা কখনো বলি না, যেহেতু বন্ধ্যাপুত্রের কোন অস্তিত্ব নেই। সুতরাং, চেতনা বাহ্যবস্তুরূপে প্রতিভাত হয়- এই উপমা বোধগম্য হওয়ার জন্য যোগাচার দার্শনিকদের অবশ্যই বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।
.
(০৪) জ্ঞানের মধ্যে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এই বিভাগ রয়েছে। জ্ঞানের বিষয় যদি জ্ঞানেরই আকারবিশেষ হতো তাহলে তা কখনো জ্ঞেয় বস্তুরূপে প্রকাশিত হতো না। কিন্তু জ্ঞানের বিষয় বাহ্যবস্তুরূপে প্রকাশিত হয়। সুতরাং জ্ঞানের বিষয় জ্ঞানের বাইরে আছে, তা জ্ঞানের আকারমাত্র নয়।
.
(০৫) যদি বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব না থাকে তবে সকল জ্ঞান এক প্রকার হবে। ঘটজ্ঞান ও পটজ্ঞানে কোন ভেদ থাকবে না। কিন্তু ঘটজ্ঞান ও পটজ্ঞান এক ও অভিন্ন স্বীকার করা যায় না। আমাদের সব জ্ঞান একপ্রকার নয়। আমাদের জ্ঞান বা চেতনা কখনো নীলাকার, কখনো পীতাকার, কখনো ঘটাকার ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, প্রতিটি জ্ঞানই স্বরূপত জ্ঞান হলেও তাদের মধ্যে আকারগত বা বিষয়গত ভিন্নতা হয় কেন ? নীল আকার যদি জ্ঞানের স্বরূপ হতো তাহলে জ্ঞানে সর্বদাই নীলরূপের উপলব্ধি হতো, কিন্তু তা হয় না। অর্থাৎ এই নীলাকার চেতনার উপর নির্ভর করে না। এই কারণে সৌত্রান্তিক দার্শনিকরা বলেন, চেতনা বহির্ভূত বাহ্য বিষয় আছে বলেই জ্ঞানের আকারগত ভেদ হয়। পুষ্টি দ্বারা যেমন ভোজন অনুমান করা হয়, ভাষার দ্বারা যেমন দেশকে অনুমান করা হয়, তেমনি জ্ঞানাকারের দ্বারা বাহ্যবস্তুর অনুমান হয়।
.
(০৬) আমাদের জ্ঞানে যে আকার থাকে তা আমাদের দ্বারা আরোপিত হলে নীলাকার বা ঘটাকার জ্ঞানসৃষ্টি আমাদের ইচ্ছার অধীন হতো। কিন্তু জ্ঞানসৃষ্টি আমাদের ইচ্ছাধীন নয়। সুতরাং, বাহ্যবস্তুই আমাদের জ্ঞানে বিভিন্ন আকার আরোপ করে একথাই বলতে হবে।
.
(০৭) কোন ধারণা সত্য হয়, আবার কোন ধারণা মিথ্যা হয়। একটি ধারণা যদি বস্তু অনুযায়ী হয় তাহলে সেটি সত্য। অপরপক্ষে বস্তুর সঙ্গে মিল না থাকলে ধারণাটি হয় মিথ্যা। কিন্তু যোগাচার বিজ্ঞানবাদ মতে ধারণার সত্যতা বা মিথ্যাত্ব নির্ণয় করা সম্ভব নয়। কারণ বাহ্যবস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ অস্তিত্ব না থাকলে, বস্তুর ধারণা বস্তু অনুযায়ী হয়েছে কিনা তা বোঝা যাবে না। সুতরাং যোগাচার মতানুসারে বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার না করলে কোন ধারণার সত্যতা বা মিথ্যাত্ব বোঝা যাবে না।
.
(০৮) যোগাচার মতে বাহ্যবস্তু বলে প্রকৃতপক্ষে কিছু নেই। তবুও আমাদের বাহ্যবস্তুর যে জ্ঞান হয় তা মিথ্যা। অর্থাৎ ওই জ্ঞান ভ্রান্তজ্ঞান। কিন্তু প্রমাজ্ঞান আগে না থাকলে ভ্রমজ্ঞান হয় না। যেমন দড়িকে যখন সাপ বলে ভ্রম হয়, তার আগে সাপের সঠিক জ্ঞান কোথাও না কোথাও হওয়া চাই। নইলে দড়িকে সাপ বলে ভ্রান্ত প্রত্যক্ষও হবে না। অতএব বিজ্ঞানবাদী যদি বলেন যে বাহ্যবস্তুর জ্ঞান হলো ভ্রমজ্ঞান, তাহলে কোন না কোন বাহ্যবস্তুর যথার্থ জ্ঞান তাঁকে স্বীকার করতে হবে। অর্থাৎ বাহ্যবস্তু যদি বন্ধ্যাপুত্র বা শশশৃঙ্গের মতো অসৎ হয়, তাহলে বাহ্যবস্তু সম্বন্ধে ভ্রমজ্ঞানও হবে না।
.
(০৯) সর্বোপরি সৌত্রান্তিক দার্শনিকরা বলেন, প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য মন-বহির্ভূত বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে। যেমন, খাদ্য সম্বন্ধে নিছক ধারণা কখনোই কোন ক্ষুধার্ত ব্যক্তির ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারে না। ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য আমরা খাদ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করতে বাধ্য। সুতরাং বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব আছে।
.
এভাবে যোগাচার বিজ্ঞানবাদের যুক্তি খণ্ডন করে সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় মূলত তাঁদের মত প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়েছেন।
Tags
বৌদ্ধ দর্শন