বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায় (Schools of Buddhism)
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দিতে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধের উপদেশকে ভিত্তি করে উত্তরপূর্ব ভারতে বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়। শিষ্যদের মধ্যে বুদ্ধ মৌখিকভাবে উপদেশ দিতেন। জীবদ্দশায় তিনি বৌদ্ধসঙ্ঘ স্থাপন করেন। তবে বুদ্ধ নিজে কোন অধিবিদ্যা বা দার্শনিক আলোচনা পছন্দ করতেন না বলে দার্শনিক প্রশ্নের উত্তরে তিনি নীরব থাকতেন। তাঁর এই নীরবতা পরবর্তীকালের বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে অনেক মতভেদের সৃষ্টি করেছিলো। ফলে বৌদ্ধদর্শনে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিলো। ধারণা করা হয় বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁর অনুগামীদের মধ্যে দার্শনিক প্রশ্নে মতভেদ দেখা দিলেও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বুদ্ধের পরিনির্বাণের (৪৮৭ খ্রিষ্টপূর্ব) পর।
.
বুদ্ধ তাঁর প্রচারিত ধর্মের কোন গ্রন্থ রচনা করেন নি। তাঁর পরিনির্বাণের পর মেধাবী শিষ্যগণ কর্তৃক বৌদ্ধদের ক্রমাগত তিনটি মহাসভায় তাঁর বাণী, মত, আচার ব্যবহার ও দর্শন সংগৃহীত হয়। বুদ্ধের পরিনির্বণের পর তাঁর প্রধান শিষ্যত্রয় (সারিপুত্র ও মৌদ্গলায়ন বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই মারা যান) মহাকাশ্যপ, আনন্দ এবং উপালি প্রথম বর্ষায় রাজগৃহে (রাজগীরে) উপস্থিত হয়ে বুদ্ধের বাণীগুলি সঙ্কলনের জন্য এক মহাসভার (council) আহ্বান করেন। এটাই প্রথম ধর্ম-সঙ্গীতি নামে বিখ্যাত। এ সভায় বিদ্যাবয়োবৃদ্ধ পাঁচশত বুদ্ধশ্রাবক উপস্থিত ছিলেন। মগধরাজ অজাতশত্রু (৪৯৩-৪৬২ খ্রিস্টপূর্ব) এই সভার পৃষ্ঠপোষক এবং মহাকাশ্যপ প্রধান নেতা ছিলেন। বুদ্ধের নিত্যসহচর আনন্দ ধর্মাংশের সংগ্রহে প্রধান নেতা এবং বিনয়াংশের সংগ্রহে প্রধান নেতা ছিলেন উপালি। দুই শিষ্যের এই সংগ্রহ গ্রন্থ সূত্রপিটক ও বিনয়পিটক নামে প্রসিদ্ধ। অভিধর্ম সূত্রপিটকেরই অন্তর্গত ছিলো। পরে পৃথককৃত হয়ে অভিধর্মপিটক নামে প্রসিদ্ধ হয়। এই তিন পিটককে বলা হয় ত্রিপিটক। ত্রিপিটক থেরাবাদীর শাস্ত্র। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের প্রায় ৫০০ বছর পরে এই ত্রিপিটক লিখিত হয়, এর পূর্বে তা সঙ্ঘের দ্বারা মৌখিকভাবে উপদিষ্ট হতো। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের এই মূল পিটকগুলি বুদ্ধকথিত মগধের পালিভাষায় রচিত হয়। পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্ম প্রাদেশিক হতে ক্রমশঃ সার্বভৌমিক হলে সংস্কৃতেও শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচিত হয়।
.
বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর তাঁর অনুসারি আচার্যদের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসার ঘটতে থাকলেও এর পরিণাম হিসেবে অনুসারিদের মধ্যে বিভিন্ন আচার-বিচার ও মন্তব্যে ভেদও উৎপন্ন হতে থাকে। কেননা বিভিন্ন মানুষ, জাতি বা সমাজের বদ্ধমূল আচার-বিচার, বিশ্বাস বা সংস্কারগুলি নতুন ধর্মে দীক্ষিত ব্যক্তির কাছ থেকে একেবারে চলে যায় না। ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায়গত মতের উদ্ভব ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই কোন নতুন ধর্ম স্বীকার করা মাত্রই মানুষের জীবন বা বিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে না, বরং নিজের বিশ্বাস বা পরম্পরাগত অভ্যাস নতুন ধর্মেও প্রভাব ফেলে। এ কারণেই বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণকারী নানা প্রকৃতির মানুষ একে নানাভাবে দেখে এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করে। এতে করে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক মতভেদও বাড়তে থাকে।
.
প্রথম সঙ্গীতির একশ’ বছরের মধ্যেই অনুসারীদের মধ্যে মতভেদ তীব্র হয়ে ওঠলে এ সময় স্থবির যশ বা যজ্ঞ নামক একজন আচার্য (ভিক্ষু শোণবাসী এবং রেবত নামক অন্য কয়েক প্রখ্যাত ভিক্ষুকে সম্মত করে) ৩৮০ মতান্তরে ৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৈশালীতে দ্বিতীয় মহাসভার (সঙ্গীতি) আহ্বান করেন। এই সভার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো সে সময়ে অনেকগুলো বিকশিত সম্প্রদায়ের বিচারপূর্বক সত্য সিদ্ধান্ত প্রতিপাদন করে বিনয় পরিশোধন করা। কিন্তু পারস্পরিক মতভেদের দরুন সেই সভার উদ্দেশ্য সফল হয় নি। মতভেদের তীব্রতার কারণে বৌদ্ধগণ স্থবিরবাদী ও মহাসাঙ্ঘিক নামে দু’টি সম্প্রদায়ে (নিকায়ে) বিভক্ত হয়ে যায়। স্থবিরবাদ হচ্ছে থেরবাদ। স্থবিরবাদীরা বুদ্ধের মানবতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু মহাসাঙ্ঘিকরা বুদ্ধকে অলৌকিক বা অমানব রূপ দিতে তৎপর ছিলেন। ফলে ভিন্নমতাবলম্বী ভিক্ষুগণ এই সঙ্গীতি বর্জন করে কৌশাম্বীতে পৃথক সভার আহ্বান করেন। এভাবে ভিক্ষুসঙ্ঘে এই প্রথম দুই নিকায় বা পক্ষের সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে বৈশালীতে সংগৃহিত সূত্র ও বিনয়ের অনুসরণকারিগণ স্থবিরবাদী এবং কৌশাম্বীর সভায় অনুগামিগণ মহাসাঙ্ঘিক নামে অভিহিত হন। মহাসাঙ্ঘিক সম্প্রদায়ের প্রবর্তকরূপে মহাকাশ্যপকে মানা হয়। বুদ্ধ সম্বন্ধীয় বিচারে মহাসাঙ্ঘিকদের চিন্তাধারাই ছিলো মহাযান ধর্মের প্রধান ভিত্তি। পরবর্তীকালে মহাসাঙ্ঘিক সম্প্রদায় হতে মহাযান বৌদ্ধের উদ্ভব হয়। এই সংস্কারমনা মহাযানীরাই রক্ষণশীল স্থবিরবাদীদের হীনযান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। স্থবিরবাদের প্রবর্তক ছিলেন উজ্জয়িনীর নিবাসী মহাকচ্ছপায়ন। এই হচ্ছে দ্বিতীয় ধর্ম সঙ্গীতি।
.
কিন্তু বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মতভেদ ও বিবাদ নিরন্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই ভেদ দূর করতে কালক্রমে পুনরায় ধর্ম ও বিনয়ের সংস্কার প্রয়োজন হলে মহারাজ অশোকের (২৬৯-২৩২ খ্রিস্টপূর্ব) পৃষ্ঠপোষকতায় পাটলিপুত্রের ‘অশোকারামে’ তৃতীয় সভার অধিবেশন আহুত হয়। কিন্তু বিভেদ নিরসনে সফল না হতে পারায় তিনি স্থবিরবাদকে বুদ্ধের মূলশিক্ষার অনুরূপ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই তৃতীয় সভার অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁর গুরু ৭২ বছরের বৃদ্ধ আচার্য মোগ্গলিপুত্ত তিস্স (মৌদ্গলিপুত্র তিষ্য)। বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মতভেদ দূর করে সত্য সিদ্ধান্ত নির্ণয় করার উদ্দেশ্যে আচার্য তিষ্য এক হাজার ভিক্ষুকে নির্বাচন করেছিলেন বলে জানা যায়। এই সভায় তিষ্যের অধ্যক্ষতায় বিবাদগ্রস্ত বিষয়ের উপর নয় মাস ধরে আলোচনা চলে। পরিশেষে তিষ্যের রচিত ‘কথাবত্থু’ গ্রন্থটি প্রমাণস্বরূপ সকলে স্বীকার করেন। এটি হচ্ছে তৃতীয় সঙ্গীতি। এই সঙ্গীতিতে সর্বাস্তিবাদী প্রভৃতি এগারোটি নিকায় স্থবির নিকায় হতে পৃথক হয়। অর্থাৎ বুদ্ধের নির্বাণের একশত বছর পরে (৩৮০ খ্রিস্টপূর্ব) বৌদ্ধসঙ্ঘ স্থবিরবাদ এবং মহাসাঙ্ঘিক নামে যে দুটি নিকায়ে বিভাগ হয়েছিলো, পরবর্তী সোয়াশো বছরে তা বিভক্ত হয়ে মহাসাঙ্ঘিকের ছয়টি এবং স্থবিরবাদের বারোটি, মোট আঠারোটি নিকায় হয়। এই বিভাগগুলি এরকম-
.
প্রথম ধাপ:
বৌদ্ধসঙ্ঘ => (১) মহাসাঙ্ঘিক + (২) স্থবিরবাদ
.
দ্বিতীয় ধাপ:
(১) মহাসাঙ্ঘিক => (৩) গোকুলিক + (৪) এক ব্যবহারিক
(২) স্থবিরবাদ => (৫) বৃজিপুত্রক (বাৎসীপুত্রীয়) + (৬) মহীশাসক
.
তৃতীয় ধাপ:
(৩) গোকুলিক => (৭) প্রজ্ঞপ্তিবাদ + (৮) বাহুলিক (বাহুশ্রুতিক) > (৯) চৈত্যবাদী
(৫) বৃজিপুত্রক => (১০) সম্মিতীয় + (১১) ভদ্রয়াণিক + (১২) ধর্মোত্তরী + (১৩) ছন্নাগারিক
(৬) মহীশাসক => (১৪) ধর্মগুপ্তিক + (১৫) সর্বাস্তিবাদ
.
চতুর্থ ধাপ:
(১৫) সর্বাস্তিবাদ > (১৬) কাশ্যপীয় > (১৭) সাংক্রান্তিক > (১৮) সূত্রবাদী (সৌত্রান্তিক)
.
আঠারোটি নিকায়ের পিটকও (সূত্র, বিনয়, অভিধর্ম) ছিলো, যাদের মধ্যে সূত্র ও বিনয় অনেকটা একরকম ছিলো। অভিধর্ম পিটকে শুধু মতভেদই নয়, এমনকি তাদের গ্রন্থও ছিলো ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্ন ভিন্ন অভিধর্ম পিটক গ্রন্থগুলোতে একে অন্যের মতবাদকে খণ্ডন করেছেন। সম্রাট অশোক নিজে স্থবিরবাদী হওয়ায় তাঁর সময়কাল পর্যন্ত এই নিকায় রাজপৃষ্টপোষকতা পেলেও অশোকের পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ হতে ক্রমশ অন্য বৌদ্ধশাখা কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে স্থবিরবাদী ভিক্ষুগণ শ্রীলঙ্কায় আশ্রয় নেয়। ২৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অশোকের পুত্র মহেন্দ্রর চেষ্টায় শ্রীলঙ্কায় স্থবিরবাদ প্রচারিত হয়। সেখান হতে ব্রহ্ম, শ্যাম প্রভৃতি দেশে তা বিস্তৃত হয়।
.
স্থবিরবাদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সর্বাস্তিবাদ হচ্ছে সর্বপ্রধান। এই সম্প্রদায় তত্ত্বের অনিত্যতায় অবিশ্বাস করে সকল কিছুকে নিত্য বলে স্বীকার করেন। অশোক প্রভৃতি কর্তৃক সর্বাস্তিবাদিরা অনাদৃত হলেও একসময় উত্তর ভারতে সর্বাস্তিবাদেরই প্রাধান্য সৃষ্টি হয়। এই সর্বাস্তিবাদীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন কুষাণবংশীয় রাজা কণিষ্ক (৭৮-১৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর সময়ে এই সম্প্রদায় মধ্য এশিয়া ও চীনদেশে প্রসারিত হয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বসুমিত্রের নেতৃত্বে এবং পার্শ্ব, অশ্বঘোষ প্রমুখ বৌদ্ধ আচার্যের সহায়তায় জলন্ধরে কুণ্ডলবন বিহারে পাঁচশত ভিক্ষুর সমন্বয়ে চতুর্থ সঙ্গীতি অনুষ্ঠিত হয়। এটাই ছিলো বৌদ্ধধর্মের অন্তিম সঙ্গীতি। এ সভায় বসুমিত্র ছিলেন সভাপতি এবং অশ্বঘোষকে পাটলিপুত্র থেকে এনে উপসভাপতি করা হয়েছিলো। এই মহাসভায় একত্রিত আচার্যগণ বৌদ্ধধর্মের সিদ্ধান্তগুলিকে স্পষ্ট করতে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতভেদ দূর করতে বৌদ্ধ ত্রিপিটকের ভাষ্যরূপে ‘মহাবিভাষা’ নামে বিশাল গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়। সর্বাস্তিবাদীর অভিধর্ম পিটকের অন্তর্গত জ্ঞানপ্রস্থানের অভিধর্মের এই ব্যাখ্যাগ্রন্থ মহাবিভাষা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হয়। পূর্বে যে আঠারোটি নিকায়ে সঙ্ঘ বিভক্ত হয়েছিলো, তা লুপ্ত হয়ে এ সময়ে মোটামুটি চারটি মাত্র সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলো। আর্যসর্বাস্তিবাদী, আর্যসম্মিতীয়, আর্যমহাসাঙ্ঘিক এবং আর্যস্থবির। পূর্বোক্ত আর্যসর্বাস্তিবাদী ও আর্যসম্মিতীয় সম্প্রদায় তত্ত্বনির্ণয়ে ভগবান্ বুদ্ধের বচন এবং এর বিবরণভূত অভিধর্মবিভাষাকে প্রমাণরূপে অবলম্বন করতেন বলে তাদেরকে একত্রে বৈভাষিক এবং পরবর্তী দুই সম্প্রদায় আর্যমহাসাঙ্ঘিক ও আর্যস্থবিরগণ কেবল সূত্রান্ত অর্থাৎ বুদ্ধের বচনকেই মাত্র প্রমাণরূপে অবলম্বন করায় তাদেরকে একত্রে সৌত্রান্তিক বলা হয়। বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক এই দুই দার্শনিক সম্প্রদায় হীনযান বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত।
.
রাজা কণিষ্কের সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বৌদ্ধগ্রন্থে সংস্কৃত ভাষা সমাদৃত হয় এবং মহাযান নামক ধর্মসম্প্রদায়ের আবির্ভাব হয়। পরবর্তীতে চীন, কোরিয়া, জাপান ও তিব্বতে এর ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই মহাযান সম্প্রদায়ের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রধানত মহাযান ও হীনযান এই দুটি সম্প্রদায়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায়। সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী উদার মহাযানী বৌদ্ধগণই পূর্ববর্তী রক্ষণশীল বৌদ্ধগণকে হীনযান আখ্যা দেয়। হীনযানীদের থেরবাদীও (স্থবিরবাদী) বলা হয়। হীনযানীরা বুদ্ধের মূল অনুশাসনকে অনুসরণ করার পক্ষপাতী। এই অনুশাসনে ভোগবিরতি, ইন্দ্রিয় সংযম ও চিত্তশুদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এর তাৎপর্য হচ্ছে নৈতিক জীবনে কঠোরতা বা কৃচ্ছ্রতাসাধন। হীনযানীরা পুরুষকারের পক্ষপাতী। তাদের মতে নির্বাণ বা অর্হৎ-এর অবস্থালাভ নিজের চেষ্টাতেই সম্ভব। ভিক্ষুজীবন বা সন্ন্যাস নির্বাণলাভের উপযোগী। বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক শাখায় বিভক্ত এই হীনযানীদেরকে সর্বাস্তিবাদীও বলা হয়। দার্শনিক বিবেচনায় এরা বস্তুবাদী।
.
অন্যদিকে মহাযানীরা সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী। এই মতে কেবল নিজের মুক্তিকামনা স্বার্থপরতা মাত্র। সর্বমুক্তি হলো ধর্মসাধনার উদ্দেশ্য। নির্বাণ লাভের জন্য ভিক্ষু-জীবন অপরিহার্য নয়। কারণ গৃহস্থরাও নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম। তাঁদের মতে বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে মনে করা হয়েছে যে, শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করার বহু পূর্ব থেকে জন্ম জন্মান্তর ধরে পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করে পুণ্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর সেই অবস্থাগুলিকে বোধিসত্ত্ব অবস্থা বলা হয়। এই অবস্থায় বোধিমার্গে একবার আরূঢ় হতে পারলে ভিক্ষু ধীরে ধীরে বুদ্ধত্বের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাই মহাযানপন্থীরা এই বোধিসত্ত্ব অবস্থাকে কাম্য মনে করেন। যে অবস্থায় মানুষ পরোপকারে আত্মোৎসর্গ করতে পারে সেই অবস্থা হলো মহাযানীদের আদর্শ। এই অবস্থা দু’ভাবে স্থায়ী করা সম্ভব। পূর্ববর্তী মহাযানী আচার্যরা মনে করেন, করুণ, মৈত্রী প্রভৃতি বিশেষ গুণরূপ পারমিতার (বদান্যতা, ধার্মিক আচরণ, সহনশীলতা, আত্মিক শক্তি, ধ্যান ও স্বজ্ঞা- এই ছয়প্রকার পারমিতাকে ‘পরম জ্ঞান’ বা প্রজ্ঞা অর্জনের পথে একেকটি পদক্ষেপ বলে গণ্য করা হয়।) চর্চা করে এই অবস্থা স্থায়ী করা যায়। দার্শনিক দৃষ্টির তারতম্য অনুসারে মহাযানীরা দুটি শাখায় বিভক্ত- মাধ্যমিক বা শূন্যবাদী ও যোগাচার বা বিজ্ঞানবাদী। দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দের আচার্য নাগার্জুন ও আর্যদেব মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের আচার্য এবং চতুর্থ খ্রীষ্টাব্দের আচার্য অসঙ্গ ও বসুবন্ধু হচ্ছেন যোগাচার সম্প্রদায়ের প্রবক্তা। তবে মহাযানীদের দর্শন হচ্ছে ভাববাদী দর্শন।
.
পরবর্তী কোন কোন আচার্যরা মনে করেন যে, মন্ত্রশক্তি নিয়োগেও এই কাম্য অবস্থানকে স্থায়ী করা যায়। অষ্টম-নবম শতকে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতাবলম্বীদের উদ্ভব হয়। এই মতকে মন্ত্রযান বা তন্ত্রযান বলা হয়। আধ্যাত্মিক দৃষ্টির তারতম্য অনুসারে এর তিনটি শাখা হচ্ছে- বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান। তান্ত্রিক বৌদ্ধ হতে দশম শতাব্দীতে আবির্ভূত বজ্রযান সম্প্রদায়টি দার্শনিক দিক দিয়ে যোগাচার ও মাধ্যমিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মিশ্রিত রূপ। নেপালের বর্তমান বৌদ্ধধর্ম প্রধানত বজ্রযান। এই ধর্মে একটি বিরাট পূজাপদ্ধতিকে স্থান দেয়া হয়েছে। দেবদেবীর সংখ্যাও অনেক। বোধিচিত্তকে বজ্র নামে আখ্যায়িত করা হয়। লৌকিক অর্থে বোধিচিত্ত হচ্ছে শুক্র এবং পারমার্থিক অর্থে চিত্তের সেই অবস্থা যা হতে বুদ্ধত্ব লাভ করা যায়।
.
যাঁরা দশভূমিক সিদ্ধির জন্য যোগাভ্যাসকে একান্ত আবশ্যক মনে করেন তাঁদেরকে যোগাচারী বলা হয়। যোগাচারীদের মতে শিষ্যগণ যোগ এবং আচার অবলম্বন করবেন। অপ্রাপ্ত ও অজ্ঞাত বিষয়কে জানার জন্য যে প্রশ্ন (অনুসন্ধান) তা হচ্ছে যোগ এবং গুরুর উপদিষ্ট তত্ত্বকে গ্রহণ ও স্বীকার করে নেয়া হচ্ছে আচার। যোগ ও আচার এই দু’টি গ্রহণ করায় যোগাচার নামে খ্যাত। তাঁরা স্বয়ং বেদ্য জ্ঞানকে স্বীকার করায় বিজ্ঞানবাদী নামেও পরিচিত হয়েছেন।
.
অন্যদিকে মাধ্যমিক বা শূন্যবাদীরা আর কিছু জানার নেই বলে যোগকে গ্রহণ করেন না। এই মতে সর্ব ক্ষণিক, সর্ব দুঃখ, সর্ব স্বলক্ষণ ও সর্ব শূন্য- এই চারটি বুদ্ধোপদিষ্ট তত্ত্বের ভাবনা দ্বারা সর্বশূন্যত্বরূপ পরিনির্বাণ লাভ হয়। তাতে মাধ্যমিকগণ কৃতার্থ, তাঁদের আর কিছু করণীয় বা কোন উপদেশ গ্রহণীয় থাকতে পারে না, এরূপ মনে করেন। তাঁরা বৌদ্ধ গন্ধ স্পর্শ প্রভৃতি বাহ্যবস্তু এবং রূপবিজ্ঞান প্রভৃতি চৈত্তবস্তু থাকা সত্ত্বেও ঐগুলিকে অস্বীকার করতে সচেষ্ট হয়ে সর্বশূন্য এরূপ প্রচার করায় শূন্যবাদী নামে পরিচিত। তাঁদের দর্শনে ভাব ও অভাব এই অন্ত (কোটি) রহিত বলে সর্ব স্বভাবের অনুৎপত্তিরূপ শূন্যতা হচ্ছে মধ্যমপ্রতিপৎ। সেই মধ্যম মার্গকে অবলম্বন করে নিজের মত প্রচার করায় তাঁদেরকে মাধ্যমিক বা শূন্যবাদী বলা হয়।
.
তবে বৌদ্ধধর্মের মূলসূত্রগুলির বা বুদ্ধের বাণীর তত্ত্বনির্দেশ করতে গিয়ে কালক্রমে যেসব নানান দার্শনিক মতের সৃষ্টি হয়েছিলো, সেসব বিভিন্ন মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে শেষপর্যন্ত চারটি সম্প্রদায় তাঁদের নিজেদের বিশিষ্ট আধ্যাত্মদৃষ্টি বা দর্শনের জন্য বৌদ্ধসঙ্ঘে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো এবং বহুদিন ধরে তাঁরা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এই চারটি সম্প্রদায় হচ্ছে শূন্যবাদ বা মাধ্যমিক সম্প্রদায়, বিজ্ঞানবাদ বা যোগাচার সম্প্রদায়, বাহ্যানুমেয়বাদ বা সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় এবং বাহ্যপ্রত্যবাদ বা বৈভাষিক সম্প্রদায়। ব্যবহারিক সংজ্ঞায় মাধ্যমিক ও যোগাচারকে মহাযান এবং সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিককে হীনযান বলা যায়। দার্শনিক ভিন্নতা মেনেও প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধসঙ্ঘের ভিতরে এই মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়কে পরস্পর বিরোধী দল বলা সঙ্গত হবে না এজন্যে যে, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভেদ থাকলেও তা অতি সূক্ষ্ম এবং এরা পরস্পর নিকট সম্পর্কযুক্ত। শেষপর্যন্ত উভয়ই বৌদ্ধদর্শনেরই অনুসারী।
অন্যদিকে মাধ্যমিক বা শূন্যবাদীরা আর কিছু জানার নেই বলে যোগকে গ্রহণ করেন না। এই মতে সর্ব ক্ষণিক, সর্ব দুঃখ, সর্ব স্বলক্ষণ ও সর্ব শূন্য- এই চারটি বুদ্ধোপদিষ্ট তত্ত্বের ভাবনা দ্বারা সর্বশূন্যত্বরূপ পরিনির্বাণ লাভ হয়। তাতে মাধ্যমিকগণ কৃতার্থ, তাঁদের আর কিছু করণীয় বা কোন উপদেশ গ্রহণীয় থাকতে পারে না, এরূপ মনে করেন। তাঁরা বৌদ্ধ গন্ধ স্পর্শ প্রভৃতি বাহ্যবস্তু এবং রূপবিজ্ঞান প্রভৃতি চৈত্তবস্তু থাকা সত্ত্বেও ঐগুলিকে অস্বীকার করতে সচেষ্ট হয়ে সর্বশূন্য এরূপ প্রচার করায় শূন্যবাদী নামে পরিচিত। তাঁদের দর্শনে ভাব ও অভাব এই অন্ত (কোটি) রহিত বলে সর্ব স্বভাবের অনুৎপত্তিরূপ শূন্যতা হচ্ছে মধ্যমপ্রতিপৎ। সেই মধ্যম মার্গকে অবলম্বন করে নিজের মত প্রচার করায় তাঁদেরকে মাধ্যমিক বা শূন্যবাদী বলা হয়।
.
তবে বৌদ্ধধর্মের মূলসূত্রগুলির বা বুদ্ধের বাণীর তত্ত্বনির্দেশ করতে গিয়ে কালক্রমে যেসব নানান দার্শনিক মতের সৃষ্টি হয়েছিলো, সেসব বিভিন্ন মতাবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে শেষপর্যন্ত চারটি সম্প্রদায় তাঁদের নিজেদের বিশিষ্ট আধ্যাত্মদৃষ্টি বা দর্শনের জন্য বৌদ্ধসঙ্ঘে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলো এবং বহুদিন ধরে তাঁরা প্রভাব বিস্তার করেছিলো। এই চারটি সম্প্রদায় হচ্ছে শূন্যবাদ বা মাধ্যমিক সম্প্রদায়, বিজ্ঞানবাদ বা যোগাচার সম্প্রদায়, বাহ্যানুমেয়বাদ বা সৌত্রান্তিক সম্প্রদায় এবং বাহ্যপ্রত্যবাদ বা বৈভাষিক সম্প্রদায়। ব্যবহারিক সংজ্ঞায় মাধ্যমিক ও যোগাচারকে মহাযান এবং সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিককে হীনযান বলা যায়। দার্শনিক ভিন্নতা মেনেও প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধসঙ্ঘের ভিতরে এই মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়কে পরস্পর বিরোধী দল বলা সঙ্গত হবে না এজন্যে যে, উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভেদ থাকলেও তা অতি সূক্ষ্ম এবং এরা পরস্পর নিকট সম্পর্কযুক্ত। শেষপর্যন্ত উভয়ই বৌদ্ধদর্শনেরই অনুসারী।
.
তবু যেহেতু বৌদ্ধ সম্প্রদায় হীনযান ও মহাযানে স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত, তাই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যসূচক কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
.
হীনযান ও মহাযানের ভেদ :
প্রথমেই জেনে রাখা আবশ্যক যে, বৌদ্ধসম্প্রদায়ের এই দুটি বিভাগ বৌদ্ধধর্মের প্রসার অনুসারে হয় নি। মূলত বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ক্রমোন্নতির পর্যায় অনুসারে তা উন্নীত হয়েছে। বুদ্ধের নির্বাণের চার-পাঁচশত বছর পর তাঁর অনুসারি খ্যতনামা আচার্যগণই তা সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মতে, প্রাচীন বৌদ্ধগণ বুদ্ধোপদিষ্ট ধর্মমতের গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে না পেরে কেবল বাহ্য আচারের পরিশীলন করেন। সেজন্যে তাঁরা এই প্রাচীন বৌদ্ধদের হীনযান আখ্যা দেন। এবং নতুন বৌদ্ধরা সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী উদার বলে তাদেরকে মহাযান আখ্যা দেন। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হীনযানীদের সঙ্গে মহাযানীদের প্রধান মত-পার্থক্য চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। এই চারটি বিষয় হলো- (ক) অধিবিদ্যা-সংক্রান্ত, (খ) নৈতিক নীতি-সংক্রান্ত, (গ) নির্বাণ-সংক্রান্ত ও (ঘ) বুদ্ধের পদমর্যাদা-সংক্রান্ত।
.
(ক) অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে হীনযান সম্প্রদায় মনে করেন যে, এ জগৎ বহুবিধ ধর্ম বা উপাদানে গঠিত, এই ধর্মগুলিকে তাঁরা সংস্কৃত ও অসংস্কৃত এই দুইভাগে ভাগ করেছেন। মহাযান সম্প্রদায় হীনযানীদের এই বহুবিধ ধর্মের ভিন্নতাকে পরিহার করে অখণ্ডতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এই সকল ধর্মের মধ্যে একটা ঐক্য বর্তমান। এই ঐক্যই হলো পরমার্থসৎ। তাঁরা এই ঐক্যকে বলেছেন ‘শূন্যতা’ বা ‘তথতা’।
.
(খ) নৈতিকনীতি বিষয়ে হীনযান সম্প্রদায় অর্হত্বকে মানুষের চরম আদর্শ বলে মনে করেন। অর্হত্ব লাভ হলে ক্লেশসমূহ বিনষ্ট হয় এবং নির্বাণলাভ হয়। সুতরাং হীনযানীদের মতে নির্বাণ হলো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টালভ্য। মহাযান সম্প্রদায় অর্হত্বের এই আদর্শকে গ্রহণ করেননি। তাঁরা এই আদর্শকে স্বার্থবাদী আদর্শ বলে মনে করে বোধিসত্ত্বের আদর্শকে পরম আদর্শ বলে গ্রহণ করেছেন। বোধিসত্ত্বের আদর্শ হলো সামগ্রিক নির্বাণের আদর্শ। অপরের সঙ্গে পাপ-পুণ্যের অংশীদার হয়ে ‘মহাপ্রজ্ঞা’ ও ‘মহাকরুণা’র দ্বারা নির্বাণ লাভই হলো যথার্থ নির্বাণলাভ।
.
(গ) নির্বাণ বিষয়ে হীনযানী সম্প্রদায় সংসার এবং নির্বাণকে দুটি স্বতন্ত্র জগৎ রূপে বর্ণনা করেছেন। এই মতে সংসার ত্যাগ করে নির্বাণলাভ করতে হয়। সংসার ও নির্বাণ দুটি ভিন্ন সত্তা। জগৎ এক স্তরের সত্তা, নির্বাণ অপর এক স্তরের সত্তা। মহাযান সম্প্রদায় এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে সংসার এবং নির্বাণ অভিন্ন। এঁদের মধ্যে যে পার্থক্য তা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, যা সংসার, তাই নির্বাণ। জগৎ প্রপঞ্চের দৃষ্টিভঙ্গিতে যাকে সংসার বলা হয় প্রপঞ্চশূন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকেই নির্বাণ বলা হয়।
.
(ঘ) বুদ্ধের পদমর্যাদা বিষয়ে হীনযান সম্প্রদায় বুদ্ধকে ব্যক্তিমানুষ রূপে গ্রহণ করেছেন। এর ফলে বৌদ্ধধর্মে অতিবর্তিবাদ বর্জিত হয়েছে। কিন্তু অতিবর্তিতা ধর্মজীবনের ভিত্তি। তাই হীনযানীদের বৌদ্ধধর্মে ধর্মের যথার্থ মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। মহাযান সম্প্রদায় মনে করেন, বুদ্ধ একজন ব্যক্তিমানুষ নন, তিনি একটি তত্ত্ববিশেষ। বেদান্তের ব্রহ্মতত্ত্বের সঙ্গে বুদ্ধতত্ত্ব তুলনীয়। এই সম্প্রদায় বুদ্ধের ত্রিকায়ে (Trinity) বিশ্বাসী। এই ত্রিকায় হলো- ধর্মকায়, সম্ভোগকায় ও নির্মাণকায়। ধর্মকায় বুদ্ধ হলেন জগতের সারবত্তা। সম্ভোগকায় বুদ্ধ হলেন জ্যোতির্ময়দেহধারী বুদ্ধ। নির্মাণকায় বুদ্ধ হলেন মর্ত্যের বুদ্ধ। মর্ত্যলোকবাসীদের উপদেশ দেওয়ার জন্য তিনি যখন মর্ত্যের দেহ ধারণ করেন, তখন তাঁকে নির্মাণকায় বুদ্ধ বলা হয়।
.
এ প্রেক্ষিতে ‘বৌদ্ধধর্ম : হীনযান ও মহাযান’ শীর্ষক নিবন্ধে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র বক্তব্যটিকে প্রণিধানযোগ্য মনে হতে পারে। তিনি বলছেন-
‘হীনযান ও মহাযানে প্রভেদ কী? হীনযান বলে কোন যান নেই। মহাযানেরা আগেকার বৌদ্ধদের হীনযান বলত। যেহেতু তার ‘মহা’, সুতরাং তাদের আগেকার যারা, তার ‘হীন’ অর্থাৎ ছোট। আগে কিন্তু দুটি যান ছিল,- ১. প্রত্যকবুদ্ধযান বা প্রত্যেযান আর ২. শ্রাবকযান। বুদ্ধদেবও প্রত্যকবুদ্ধযান স্বীকার করে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যখন পৃথিবীতে কোন বুদ্ধ উপস্থিত নেই, তাঁর মুখ হতে ধর্মকথা শুনিবার কোন সুবিধা নেই, তখনও লোকে আপনার চেষ্টায়, জন্মজ্বরামরণাদির হাত হতে অব্যাহতি পেতে পারে। হিন্দুদের ঋষিরা এইরূপে মুক্তিলাভ করেছেন। এইরূপে যারা নিজের যত্নে, বুদ্ধের সাহায্য না পেয়ে, উদ্ধার হয়, তাদেরকে প্রত্যকবুদ্ধ বলে। তাদের যান প্রত্যকবুদ্ধযান। এই প্রত্যকবুদ্ধেরা আপনিই উদ্ধার হতে পারে, আর কাউকেই উদ্ধার করবার শক্তি তাদের নেই।’
‘বুদ্ধের মুখে ধর্মকথা শুনে যারা ধর্মজ্ঞান লাভ করে, তাদের নাম ‘শ্রাবক’। তাঁরা প্রথমে ‘শ্রাবক’ হন, তার পর ‘ভিক্ষু’ হন, বিহারে বাস করেন। অনেকদিন বিহারে থাকতে ‘স্রোতাপন্ন’ হন, ‘সকৃতাগামী’ হন, ‘অনাগামী’ হন, পরে ‘অর্হৎ’ হয়ে যান। এরাও জন্মজ্বরামরণাদি হতে অব্যাহতি পান, কিন্তু এরাও কাউকেই উদ্ধার করতে পারেন না। তাদের যান, ‘শ্রাবকযান’। বুদ্ধ নির্বাণ পেলে তাঁর শিষ্য প্রশিষ্য হতে যাঁরা ধর্মকথা শোনেন, তাঁরা পর পর পরজন্মে ধার্মিক বৌদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু আবার না যতদিন বুদ্ধদেবের প্রাদুর্ভাব হয় ততদিন তাঁদের মুক্তি পাবার উপায় নেই। একজন বুদ্ধের শ্রাবক অনেক জন্মের পর আর-একজন বুদ্ধের কাছে উদ্ধার হতে পারেন।’
‘মহাযানের লোকেরা বলত ‘প্রত্যক’ ও ‘শ্রাবক’ এই দুই যানই হীন, কারণ এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত স্বার্থপর, তাদের কাছে যেন জগৎ নেই। তারা আপনাদেরকে মহাযান বলে, যেহেতু তারা আপনার উদ্ধারের জন্য তত ভাবে না, জগৎ উদ্ধারই তাদের মহাব্রত। ‘অবলোকিতেশ্বর’ উদ্ধার হন,- মহাশূন্যে বিলীন হন, এমন সময়ে জগতের সমস্ত প্রাণী তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, আপনি নির্বাণ প্রাপ্ত হলে কে আমাদের উদ্ধার করবে? তাই শুনে ‘অবলোকিতেশ্বর’ প্রতিজ্ঞা করলেন, একটিও প্রাণী যতক্ষণ বদ্ধ থাকবে, ততক্ষণ আমি নির্বাণে প্রবেশ করব না। এই যে করুণা, সর্বভূতে দায় তাই মহাযানকে ‘মহা’ করে তুলেছে, আর এরই তুলনায় অপর দুই যানই হীন হয়ে গিয়েছে।’
‘হীনযান অর্হত্ব পেলেই খুশি, মহাযান বুদ্ধত্ব চায়। অর্হৎও নির্বাণ পেলেন, বুদ্ধও নির্বাণ পেলেন। উভয়েই জন্মজ্বরামরণের হাত থেকে উদ্ধার পেলেন। উভয়েরই বোধিজ্ঞান লাভ হল এবং অর্হতেরা হীনযান হলেন, আর বুদ্ধ মহাযান হলেন কেন? বুদ্ধ পরের উদ্ধারের জন্য চেষ্টা পেয়েছিলেন- তাই তিনি ‘বুদ্ধ’, আর তাঁর শিষ্যেরা নিজেরাই উদ্ধার হতেন- তাই তাঁরা ‘অর্হৎ’।’…
‘শ্রাবকযানে সর্বপ্রথম ‘ত্রিশরণ’গমন, তার পর ‘পঞ্চশীল’ গ্রহণ। এদুটি জিনিস গৃহস্থরাও করত, ভিক্ষুরাও করত। এর পর ‘অষ্টশীল’-গ্রহণ অর্থাৎ ওই ‘পাঁচের উপর আরও তিন, -স্রক্চন্দনাদি ত্যাগ, রূঢ়বাক্যপ্রয়োগ ত্যাগ, গীতাদি ত্যাগ। এই যে তিনটি শীল, তা খুব উচ্চ ভক্ত গৃহস্থের জন্য। গৃহস্থ এর উপর আর যেতে পারবে না। এর উপর আর দুটি শীল শুধু ভিক্ষুদের জন্য, গৃহস্থের এতে অধিকার নেই। এ দশ শীল ছাড়া ‘শ্রাবকযানের আর একটা বড় জিনিস ‘পোষধ’ব্রত, অর্থাৎ উপোষ করা। দুই অষ্টমীতে, দুই চতুর্দশীতে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় উপোষ করে কেবল ধর্মকথা শুনবে। সেইদিন গৃহস্থ ও ভিক্ষু সবাই বিহারে এসে ধর্মচর্চা করবে।’
‘মহাযানে আমরা ত্রিশরণগমনের কথা খুব পাই। শীলরক্ষার কথাও পাই। কিন্তু ‘পোষধ’ব্রতের কথা বড় একটা পাই না। শীলরক্ষাটা শ্রাবকেরা যত বড় বলে মনে করেন, বোধিসত্ত্বেরা তত বড় বলে মনে করেন না। তাঁদের ধর্ম আর-একরূপ; তাঁরা ‘শরণ’-গমনের পরই কীসে বোধিলাভের জন্য একান্ত আগ্রহ জন্মে, তারই চেষ্টা করেন, এরই নাম ‘চিত্তোৎপাদ’ বা ‘বোধিচিত্তোৎপাদ’। ‘বোধিচিত্তোৎপাদের’ পর আর দুটি কথা শুনতে পাই,- ‘পাপদেশনা’ ও ‘পুণ্যানুমোদনা’, অর্থাৎ পাপ কাকে বলে তার উপদেশ ও পুণ্যের প্রতি আসক্তি। এর পর তাঁদের ‘ষট্পারমিতা’।’…
‘…স্রোতাপন্ন, সকৃতাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ এসকল শব্দ মহাযানে পাওয়া যায় না। এর পরিবর্তে পাওয়া যায় ‘দশবোধি সত্ত্বভূমি’ অর্থাৎ বোধিসত্ত্ব যেমন ধ্যান, ধারণা, দান, শীল, ক্ষান্তি ইত্যাদিতে ক্রমে দক্ষ হতে থাকেন, তাঁর মনোবৃত্তি-সকলও সেইরূপ ক্রমে উচ্চে উঠতে থাকে। মানুষের মনোবৃত্তি অনন্ত। প্রথম ভূমিতে কতকগুলো থাকে, কতকগুলো ত্যাগ করা হয় এবং কতকগুলো প্রবল হয়ে উঠে। দ্বিতীয় ভূমিতে আবার কতকগুলো আসে; প্রথমের কতকগুলো, হয় একেবারে চলে যায়, নয় তো হীনবীর্য হয়ে পড়ে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে বোধিসত্ত্ব দশটি ভূমি অতিক্রম করলে তবে তিনি নির্বাণপথের যথার্থ পথিক হতে পারেন। সে করুণার নাম পর্যন্ত শ্রাবকযানে দেখা যায় না, সেটি বোধিসত্ত্বের চিরসহচর, যতই উচ্চ ভূমিতে উঠবেন ততই করুণা প্রবল হতে থাকবে।’
‘পাঁচটি পারমিতায় দক্ষতালাভ করলে তার পর ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। ‘প্রজ্ঞাপারমিতাই’ আসল পারমিতা। কিন্তু শুধু প্রজ্ঞাপারমিতাও ঠিক নয়। অপর পাঁচের সাথে প্রজ্ঞাপারমিতা মিলিত হলে পূর্ণ পারমিতা হয়। প্রজ্ঞাপারমিতার মোট কথা এই যে সত্য দুই প্রকার- সাংবৃত সত্য ও পরমার্থ সত্য। সাংবৃত সত্য, ব্যবহারিক সত্য। আমরা চারদিকে যে-সকল জিনিস দেখতে পাই সেগুলোকে সত্য বলে ধরে না নিলে ব্যবহার চলে না; তাই সেগুলোকে সত্য বলে ধরে নিতে হয়। কিন্তু বিশেষরূপ পরীক্ষা করে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, তার একটিও সত্য নয়। পরমার্থ সত্য কখনই অন্যথা হয় না, সে চিরকালই সত্য থাকে, সেটিকে মহাযানেরা শূন্য বলেন।’…
‘…এইরূপে আমরা হীনযান ও মহাযান যতই তুলনা করি, ততই দেখতে পাই যে, হীনযান ধর্মনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, আর মহাযান দার্শনিক মত ও পারমিতা নিয়ে ব্যস্ত। স্বভাবচরিত্র বিশুদ্ধ হলে, মানুষ পৃথিবীর বস্তু ছেড়ে কোন উচ্চতর বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করলে নিশ্চয়ই বড় হয়। হীনযান মানুষকে সেইরূপ বড় করবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মহাযান তাতে তৃপ্ত হতেন না। তাঁরা মানুষকে সর্বময় সর্বনিয়ন্তা করবার চেষ্টা করতেন বলে দর্শনে তাঁরা শূন্যবাদী, নীতিতে তাঁরা করুণাবাদী। তাই তাঁরা আপনাদেরকে বড় বা ‘মহা’ মনে করতেন ও শ্রাবক ও প্রত্যকযানকে ‘হীন’ বা ছোট মনে করতেন।’- (শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী/ বৌদ্ধধর্ম: হীনযান ও মহাযান)।
.
অর্থাৎ হীনযানী ও মহাযানী মতবাদগুলির মধ্যকার মুখ্য ও গৌণ ভিন্নতাগুলিকে যদি চিহ্নিত করা যায় তাহলে এই দুই সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য যে পার্থক্যগুলি দেখা যায় তা হলো-
.
০১. প্রথমতঃ হীনযান ও মহাযান এই দুই সম্প্রদায়ের চরম লক্ষ্যেই বিরোধ রয়েছে। হীনযানের চরম লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাণের মাধ্যমে অর্হৎপদ লাভ। অন্যদিকে মহাযানের চরম লক্ষ্য হচ্ছে বোধিসত্ত্ব প্রাপ্তি। হীনযান মতানুযায়ী অর্হন্মুনি কেবল নিজ মুক্তির জন্য যত্নশীল হন, আর মহাযান সম্প্রদায় সকল জীবের মুক্তির জন্য যত্নশীল হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য মনে করেন। অর্থাৎ সংসারের সকল দুঃখভারাক্রান্ত প্রাণীর মুক্তি না হওয়াতক মহাযানীরা সচেষ্ট হন। সুতরাং বলা যায়, হীনযানীরা অন্তর্মূখী অর্থাৎ তাদের চরম লক্ষ্য হলো ব্যক্তিক বা বৈয়ক্তিক মুক্তি (individual liberation), আর মহাযানীরা বহির্মুখী অর্থাৎ সার্বভৌম মুক্তিকে (universal liberation) স্বীকার করেন।
.
০২. হীনযানে নিরীশ্বরবাদ স্বীকৃত। বুদ্ধের ‘আত্মদীপো ভব’ এই বচনে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তির জন্য জীবকেই স্বয়ং যত্নশীল হতে হয়। কিন্তু মহাযানে ঈশ্বর স্বীকৃত এবং বুদ্ধকে ঈশ্বর মনে করে ‘দশভূমি’র উপর বুদ্ধের মূর্তি স্থাপন করে তাঁর পূজার্চনা করা হয়। তাঁদের মতে বুদ্ধ হচ্ছেন স্বয়ং কল্যাণময়, সমস্ত সংসার তাঁর কল্যাণপাত্র। অর্থাৎ হীনযানে বুদ্ধকে মানুষ হিসেবে ভাবা হয়েছে, আর মহাযানে তাঁকে ঈশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করে তাঁর উপাসনা স্বীকৃত হয়েছে।
.
০৩. হীনযানে ভিক্ষুজীবন ও সন্ন্যাসের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এবং এই মতানুযায়ী মানুষ সংসার পরিত্যাগ করে নির্বাণের জন্য যত্নশীল হবে। কিন্তু মহাযানমতে নির্বাণলাভের জন্য সংসার ত্যাগের আবশ্যকতা নেই, সংসারে থেকেই মানুষ নির্বাণ লাভে সমর্থ হতে পারে।
.
০৪. হীনযানে নির্বাণ হচ্ছে অভাবাত্মক, অর্থাৎ নির্বাণের মাধ্যমে ভবতৃষ্ণা লুপ্ত হয় বলে দুঃখেরও নিবৃত্তি ঘটে। কিন্তু মহাযানে নির্বাণ হচ্ছে ভাবাত্মক। তাঁদের মতে নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির দুঃখ নাশ হয় না, কিন্তু আনন্দ লাভ হয়।
.
০৫. হীনযানে ‘তন্হা’ বা তৃষ্ণা নিবারণকে নির্বাণের সেতু বলা হয়েছে। এই তৃষ্ণানিবারণের দ্বারা যে ভাব লাভ করা যায় তা হলো তৃষ্ণাশূন্যভাব বা শূন্যতা। কিন্তু মহাযানে এই নিবৃত্তি মার্গ অপেক্ষা কার্য মার্গকে প্রবল মনে করা হয়। এই মতে জ্ঞানই মূলশক্তি এবং তা অর্জনের উপায়স্বরূপ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছালে বোধিলাভ ঘটে।
.
০৬. হীনযানমতে অর্হৎপদ প্রাপ্তির লক্ষ্যে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘ এই ত্রিরত্ন বা ত্রিশরণ এবং শীলতাকে মূল অবলম্বন হিসেবে স্বীকার করা হয়। বোধিসত্ত্বোৎপাদ, পাপদেশন, পুণ্যানুমোদনা, ষট্পারমিতা (বিশুদ্ধতা) এগুলি অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায়। অন্যদিকে মহাযানমতে সার্বভৌম মুক্তির লক্ষ্যে বোধিসত্ত্বকেই মুখ্য উপায় বলে সমাদর করা হয়। আর এই বোধিসত্ত্বের প্রধান গুণ বা ধর্ম হচ্ছে করুণা যাকে প্রজ্ঞার মতো স্বীকার করা হয়েছে।
.
০৭. হীনযানে আত্মা স্বীকৃত নয়। কিন্তু মহাযানে ভিন্নভাবে আত্মর সত্তা স্বীকার করা হয়। মহাযান মতে ব্যক্তিক বা বৈয়ক্তিক আত্মা মিথ্যা হলেও পারমার্থিক আত্মা (মহাত্মা) মিথ্যা নয় এবং মহাত্মা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
.
০৮. হীনযানে স্বাবলম্বন সন্ন্যাসের আদর্শ অত্যন্ত কঠিন পথ। অন্যদিকে মহাযানে ঈশ্বরাত্মা বোধিসত্ত্বকে আদর্শরূপে স্বীকার করে নির্বাণলাভের পথ সুগম করা হয়েছে। এজন্যেই হীনযানকে সঙ্কীর্ণপথ এবং মহাযানকে প্রশস্ত পথ বলা হয়েছে।
.
০৯. হীনযানে বিশ্বতত্ত্বের কোন দার্শনিক বিচার করা হয় নি, যা মহাযানে বহুল পরিমাণে রয়েছে। হীনযানে ভূমিচতুষ্টয়, কিন্তু মহাযানে দশভূমি আলোচিত হয়েছে।
.
১০. সর্বোপরি সম্প্রদায় হিসেবে পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী হীনযানীরা প্রকৃতপক্ষে গোড়া বৌদ্ধ। অন্যদিকে মহাযানীরা উদার ও প্রগতিশীল বলে অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, অসঙ্গ প্রমুখ মহাযানী পণ্ডিতগণ নানান দার্শনিকতাপ্রসূত গভীর প্রশ্নের সমাধান করেছেন।
.
হীনযান ও মহাযানের ভেদ :
প্রথমেই জেনে রাখা আবশ্যক যে, বৌদ্ধসম্প্রদায়ের এই দুটি বিভাগ বৌদ্ধধর্মের প্রসার অনুসারে হয় নি। মূলত বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের ক্রমোন্নতির পর্যায় অনুসারে তা উন্নীত হয়েছে। বুদ্ধের নির্বাণের চার-পাঁচশত বছর পর তাঁর অনুসারি খ্যতনামা আচার্যগণই তা সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মতে, প্রাচীন বৌদ্ধগণ বুদ্ধোপদিষ্ট ধর্মমতের গূঢ় তাৎপর্য বুঝতে না পেরে কেবল বাহ্য আচারের পরিশীলন করেন। সেজন্যে তাঁরা এই প্রাচীন বৌদ্ধদের হীনযান আখ্যা দেন। এবং নতুন বৌদ্ধরা সংস্কারপন্থী এবং কৃচ্ছ্রতাসাধনের বিরোধী উদার বলে তাদেরকে মহাযান আখ্যা দেন। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। হীনযানীদের সঙ্গে মহাযানীদের প্রধান মত-পার্থক্য চারটি বিষয়কে কেন্দ্র করে। এই চারটি বিষয় হলো- (ক) অধিবিদ্যা-সংক্রান্ত, (খ) নৈতিক নীতি-সংক্রান্ত, (গ) নির্বাণ-সংক্রান্ত ও (ঘ) বুদ্ধের পদমর্যাদা-সংক্রান্ত।
.
(ক) অধিবিদ্যার ক্ষেত্রে হীনযান সম্প্রদায় মনে করেন যে, এ জগৎ বহুবিধ ধর্ম বা উপাদানে গঠিত, এই ধর্মগুলিকে তাঁরা সংস্কৃত ও অসংস্কৃত এই দুইভাগে ভাগ করেছেন। মহাযান সম্প্রদায় হীনযানীদের এই বহুবিধ ধর্মের ভিন্নতাকে পরিহার করে অখণ্ডতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এই সকল ধর্মের মধ্যে একটা ঐক্য বর্তমান। এই ঐক্যই হলো পরমার্থসৎ। তাঁরা এই ঐক্যকে বলেছেন ‘শূন্যতা’ বা ‘তথতা’।
.
(খ) নৈতিকনীতি বিষয়ে হীনযান সম্প্রদায় অর্হত্বকে মানুষের চরম আদর্শ বলে মনে করেন। অর্হত্ব লাভ হলে ক্লেশসমূহ বিনষ্ট হয় এবং নির্বাণলাভ হয়। সুতরাং হীনযানীদের মতে নির্বাণ হলো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টালভ্য। মহাযান সম্প্রদায় অর্হত্বের এই আদর্শকে গ্রহণ করেননি। তাঁরা এই আদর্শকে স্বার্থবাদী আদর্শ বলে মনে করে বোধিসত্ত্বের আদর্শকে পরম আদর্শ বলে গ্রহণ করেছেন। বোধিসত্ত্বের আদর্শ হলো সামগ্রিক নির্বাণের আদর্শ। অপরের সঙ্গে পাপ-পুণ্যের অংশীদার হয়ে ‘মহাপ্রজ্ঞা’ ও ‘মহাকরুণা’র দ্বারা নির্বাণ লাভই হলো যথার্থ নির্বাণলাভ।
.
(গ) নির্বাণ বিষয়ে হীনযানী সম্প্রদায় সংসার এবং নির্বাণকে দুটি স্বতন্ত্র জগৎ রূপে বর্ণনা করেছেন। এই মতে সংসার ত্যাগ করে নির্বাণলাভ করতে হয়। সংসার ও নির্বাণ দুটি ভিন্ন সত্তা। জগৎ এক স্তরের সত্তা, নির্বাণ অপর এক স্তরের সত্তা। মহাযান সম্প্রদায় এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মতে সংসার এবং নির্বাণ অভিন্ন। এঁদের মধ্যে যে পার্থক্য তা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, যা সংসার, তাই নির্বাণ। জগৎ প্রপঞ্চের দৃষ্টিভঙ্গিতে যাকে সংসার বলা হয় প্রপঞ্চশূন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকেই নির্বাণ বলা হয়।
.
(ঘ) বুদ্ধের পদমর্যাদা বিষয়ে হীনযান সম্প্রদায় বুদ্ধকে ব্যক্তিমানুষ রূপে গ্রহণ করেছেন। এর ফলে বৌদ্ধধর্মে অতিবর্তিবাদ বর্জিত হয়েছে। কিন্তু অতিবর্তিতা ধর্মজীবনের ভিত্তি। তাই হীনযানীদের বৌদ্ধধর্মে ধর্মের যথার্থ মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে। মহাযান সম্প্রদায় মনে করেন, বুদ্ধ একজন ব্যক্তিমানুষ নন, তিনি একটি তত্ত্ববিশেষ। বেদান্তের ব্রহ্মতত্ত্বের সঙ্গে বুদ্ধতত্ত্ব তুলনীয়। এই সম্প্রদায় বুদ্ধের ত্রিকায়ে (Trinity) বিশ্বাসী। এই ত্রিকায় হলো- ধর্মকায়, সম্ভোগকায় ও নির্মাণকায়। ধর্মকায় বুদ্ধ হলেন জগতের সারবত্তা। সম্ভোগকায় বুদ্ধ হলেন জ্যোতির্ময়দেহধারী বুদ্ধ। নির্মাণকায় বুদ্ধ হলেন মর্ত্যের বুদ্ধ। মর্ত্যলোকবাসীদের উপদেশ দেওয়ার জন্য তিনি যখন মর্ত্যের দেহ ধারণ করেন, তখন তাঁকে নির্মাণকায় বুদ্ধ বলা হয়।
.
এ প্রেক্ষিতে ‘বৌদ্ধধর্ম : হীনযান ও মহাযান’ শীর্ষক নিবন্ধে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র বক্তব্যটিকে প্রণিধানযোগ্য মনে হতে পারে। তিনি বলছেন-
‘হীনযান ও মহাযানে প্রভেদ কী? হীনযান বলে কোন যান নেই। মহাযানেরা আগেকার বৌদ্ধদের হীনযান বলত। যেহেতু তার ‘মহা’, সুতরাং তাদের আগেকার যারা, তার ‘হীন’ অর্থাৎ ছোট। আগে কিন্তু দুটি যান ছিল,- ১. প্রত্যকবুদ্ধযান বা প্রত্যেযান আর ২. শ্রাবকযান। বুদ্ধদেবও প্রত্যকবুদ্ধযান স্বীকার করে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যখন পৃথিবীতে কোন বুদ্ধ উপস্থিত নেই, তাঁর মুখ হতে ধর্মকথা শুনিবার কোন সুবিধা নেই, তখনও লোকে আপনার চেষ্টায়, জন্মজ্বরামরণাদির হাত হতে অব্যাহতি পেতে পারে। হিন্দুদের ঋষিরা এইরূপে মুক্তিলাভ করেছেন। এইরূপে যারা নিজের যত্নে, বুদ্ধের সাহায্য না পেয়ে, উদ্ধার হয়, তাদেরকে প্রত্যকবুদ্ধ বলে। তাদের যান প্রত্যকবুদ্ধযান। এই প্রত্যকবুদ্ধেরা আপনিই উদ্ধার হতে পারে, আর কাউকেই উদ্ধার করবার শক্তি তাদের নেই।’
‘বুদ্ধের মুখে ধর্মকথা শুনে যারা ধর্মজ্ঞান লাভ করে, তাদের নাম ‘শ্রাবক’। তাঁরা প্রথমে ‘শ্রাবক’ হন, তার পর ‘ভিক্ষু’ হন, বিহারে বাস করেন। অনেকদিন বিহারে থাকতে ‘স্রোতাপন্ন’ হন, ‘সকৃতাগামী’ হন, ‘অনাগামী’ হন, পরে ‘অর্হৎ’ হয়ে যান। এরাও জন্মজ্বরামরণাদি হতে অব্যাহতি পান, কিন্তু এরাও কাউকেই উদ্ধার করতে পারেন না। তাদের যান, ‘শ্রাবকযান’। বুদ্ধ নির্বাণ পেলে তাঁর শিষ্য প্রশিষ্য হতে যাঁরা ধর্মকথা শোনেন, তাঁরা পর পর পরজন্মে ধার্মিক বৌদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু আবার না যতদিন বুদ্ধদেবের প্রাদুর্ভাব হয় ততদিন তাঁদের মুক্তি পাবার উপায় নেই। একজন বুদ্ধের শ্রাবক অনেক জন্মের পর আর-একজন বুদ্ধের কাছে উদ্ধার হতে পারেন।’
‘মহাযানের লোকেরা বলত ‘প্রত্যক’ ও ‘শ্রাবক’ এই দুই যানই হীন, কারণ এরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত স্বার্থপর, তাদের কাছে যেন জগৎ নেই। তারা আপনাদেরকে মহাযান বলে, যেহেতু তারা আপনার উদ্ধারের জন্য তত ভাবে না, জগৎ উদ্ধারই তাদের মহাব্রত। ‘অবলোকিতেশ্বর’ উদ্ধার হন,- মহাশূন্যে বিলীন হন, এমন সময়ে জগতের সমস্ত প্রাণী তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, আপনি নির্বাণ প্রাপ্ত হলে কে আমাদের উদ্ধার করবে? তাই শুনে ‘অবলোকিতেশ্বর’ প্রতিজ্ঞা করলেন, একটিও প্রাণী যতক্ষণ বদ্ধ থাকবে, ততক্ষণ আমি নির্বাণে প্রবেশ করব না। এই যে করুণা, সর্বভূতে দায় তাই মহাযানকে ‘মহা’ করে তুলেছে, আর এরই তুলনায় অপর দুই যানই হীন হয়ে গিয়েছে।’
‘হীনযান অর্হত্ব পেলেই খুশি, মহাযান বুদ্ধত্ব চায়। অর্হৎও নির্বাণ পেলেন, বুদ্ধও নির্বাণ পেলেন। উভয়েই জন্মজ্বরামরণের হাত থেকে উদ্ধার পেলেন। উভয়েরই বোধিজ্ঞান লাভ হল এবং অর্হতেরা হীনযান হলেন, আর বুদ্ধ মহাযান হলেন কেন? বুদ্ধ পরের উদ্ধারের জন্য চেষ্টা পেয়েছিলেন- তাই তিনি ‘বুদ্ধ’, আর তাঁর শিষ্যেরা নিজেরাই উদ্ধার হতেন- তাই তাঁরা ‘অর্হৎ’।’…
‘শ্রাবকযানে সর্বপ্রথম ‘ত্রিশরণ’গমন, তার পর ‘পঞ্চশীল’ গ্রহণ। এদুটি জিনিস গৃহস্থরাও করত, ভিক্ষুরাও করত। এর পর ‘অষ্টশীল’-গ্রহণ অর্থাৎ ওই ‘পাঁচের উপর আরও তিন, -স্রক্চন্দনাদি ত্যাগ, রূঢ়বাক্যপ্রয়োগ ত্যাগ, গীতাদি ত্যাগ। এই যে তিনটি শীল, তা খুব উচ্চ ভক্ত গৃহস্থের জন্য। গৃহস্থ এর উপর আর যেতে পারবে না। এর উপর আর দুটি শীল শুধু ভিক্ষুদের জন্য, গৃহস্থের এতে অধিকার নেই। এ দশ শীল ছাড়া ‘শ্রাবকযানের আর একটা বড় জিনিস ‘পোষধ’ব্রত, অর্থাৎ উপোষ করা। দুই অষ্টমীতে, দুই চতুর্দশীতে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় উপোষ করে কেবল ধর্মকথা শুনবে। সেইদিন গৃহস্থ ও ভিক্ষু সবাই বিহারে এসে ধর্মচর্চা করবে।’
‘মহাযানে আমরা ত্রিশরণগমনের কথা খুব পাই। শীলরক্ষার কথাও পাই। কিন্তু ‘পোষধ’ব্রতের কথা বড় একটা পাই না। শীলরক্ষাটা শ্রাবকেরা যত বড় বলে মনে করেন, বোধিসত্ত্বেরা তত বড় বলে মনে করেন না। তাঁদের ধর্ম আর-একরূপ; তাঁরা ‘শরণ’-গমনের পরই কীসে বোধিলাভের জন্য একান্ত আগ্রহ জন্মে, তারই চেষ্টা করেন, এরই নাম ‘চিত্তোৎপাদ’ বা ‘বোধিচিত্তোৎপাদ’। ‘বোধিচিত্তোৎপাদের’ পর আর দুটি কথা শুনতে পাই,- ‘পাপদেশনা’ ও ‘পুণ্যানুমোদনা’, অর্থাৎ পাপ কাকে বলে তার উপদেশ ও পুণ্যের প্রতি আসক্তি। এর পর তাঁদের ‘ষট্পারমিতা’।’…
‘…স্রোতাপন্ন, সকৃতাগামী, অনাগামী ও অর্হৎ এসকল শব্দ মহাযানে পাওয়া যায় না। এর পরিবর্তে পাওয়া যায় ‘দশবোধি সত্ত্বভূমি’ অর্থাৎ বোধিসত্ত্ব যেমন ধ্যান, ধারণা, দান, শীল, ক্ষান্তি ইত্যাদিতে ক্রমে দক্ষ হতে থাকেন, তাঁর মনোবৃত্তি-সকলও সেইরূপ ক্রমে উচ্চে উঠতে থাকে। মানুষের মনোবৃত্তি অনন্ত। প্রথম ভূমিতে কতকগুলো থাকে, কতকগুলো ত্যাগ করা হয় এবং কতকগুলো প্রবল হয়ে উঠে। দ্বিতীয় ভূমিতে আবার কতকগুলো আসে; প্রথমের কতকগুলো, হয় একেবারে চলে যায়, নয় তো হীনবীর্য হয়ে পড়ে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে বোধিসত্ত্ব দশটি ভূমি অতিক্রম করলে তবে তিনি নির্বাণপথের যথার্থ পথিক হতে পারেন। সে করুণার নাম পর্যন্ত শ্রাবকযানে দেখা যায় না, সেটি বোধিসত্ত্বের চিরসহচর, যতই উচ্চ ভূমিতে উঠবেন ততই করুণা প্রবল হতে থাকবে।’
‘পাঁচটি পারমিতায় দক্ষতালাভ করলে তার পর ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’। ‘প্রজ্ঞাপারমিতাই’ আসল পারমিতা। কিন্তু শুধু প্রজ্ঞাপারমিতাও ঠিক নয়। অপর পাঁচের সাথে প্রজ্ঞাপারমিতা মিলিত হলে পূর্ণ পারমিতা হয়। প্রজ্ঞাপারমিতার মোট কথা এই যে সত্য দুই প্রকার- সাংবৃত সত্য ও পরমার্থ সত্য। সাংবৃত সত্য, ব্যবহারিক সত্য। আমরা চারদিকে যে-সকল জিনিস দেখতে পাই সেগুলোকে সত্য বলে ধরে না নিলে ব্যবহার চলে না; তাই সেগুলোকে সত্য বলে ধরে নিতে হয়। কিন্তু বিশেষরূপ পরীক্ষা করে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, তার একটিও সত্য নয়। পরমার্থ সত্য কখনই অন্যথা হয় না, সে চিরকালই সত্য থাকে, সেটিকে মহাযানেরা শূন্য বলেন।’…
‘…এইরূপে আমরা হীনযান ও মহাযান যতই তুলনা করি, ততই দেখতে পাই যে, হীনযান ধর্মনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, আর মহাযান দার্শনিক মত ও পারমিতা নিয়ে ব্যস্ত। স্বভাবচরিত্র বিশুদ্ধ হলে, মানুষ পৃথিবীর বস্তু ছেড়ে কোন উচ্চতর বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করলে নিশ্চয়ই বড় হয়। হীনযান মানুষকে সেইরূপ বড় করবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু মহাযান তাতে তৃপ্ত হতেন না। তাঁরা মানুষকে সর্বময় সর্বনিয়ন্তা করবার চেষ্টা করতেন বলে দর্শনে তাঁরা শূন্যবাদী, নীতিতে তাঁরা করুণাবাদী। তাই তাঁরা আপনাদেরকে বড় বা ‘মহা’ মনে করতেন ও শ্রাবক ও প্রত্যকযানকে ‘হীন’ বা ছোট মনে করতেন।’- (শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী/ বৌদ্ধধর্ম: হীনযান ও মহাযান)।
.
অর্থাৎ হীনযানী ও মহাযানী মতবাদগুলির মধ্যকার মুখ্য ও গৌণ ভিন্নতাগুলিকে যদি চিহ্নিত করা যায় তাহলে এই দুই সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখযোগ্য যে পার্থক্যগুলি দেখা যায় তা হলো-
.
০১. প্রথমতঃ হীনযান ও মহাযান এই দুই সম্প্রদায়ের চরম লক্ষ্যেই বিরোধ রয়েছে। হীনযানের চরম লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাণের মাধ্যমে অর্হৎপদ লাভ। অন্যদিকে মহাযানের চরম লক্ষ্য হচ্ছে বোধিসত্ত্ব প্রাপ্তি। হীনযান মতানুযায়ী অর্হন্মুনি কেবল নিজ মুক্তির জন্য যত্নশীল হন, আর মহাযান সম্প্রদায় সকল জীবের মুক্তির জন্য যত্নশীল হওয়াকে জীবনের লক্ষ্য মনে করেন। অর্থাৎ সংসারের সকল দুঃখভারাক্রান্ত প্রাণীর মুক্তি না হওয়াতক মহাযানীরা সচেষ্ট হন। সুতরাং বলা যায়, হীনযানীরা অন্তর্মূখী অর্থাৎ তাদের চরম লক্ষ্য হলো ব্যক্তিক বা বৈয়ক্তিক মুক্তি (individual liberation), আর মহাযানীরা বহির্মুখী অর্থাৎ সার্বভৌম মুক্তিকে (universal liberation) স্বীকার করেন।
.
০২. হীনযানে নিরীশ্বরবাদ স্বীকৃত। বুদ্ধের ‘আত্মদীপো ভব’ এই বচনে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তির জন্য জীবকেই স্বয়ং যত্নশীল হতে হয়। কিন্তু মহাযানে ঈশ্বর স্বীকৃত এবং বুদ্ধকে ঈশ্বর মনে করে ‘দশভূমি’র উপর বুদ্ধের মূর্তি স্থাপন করে তাঁর পূজার্চনা করা হয়। তাঁদের মতে বুদ্ধ হচ্ছেন স্বয়ং কল্যাণময়, সমস্ত সংসার তাঁর কল্যাণপাত্র। অর্থাৎ হীনযানে বুদ্ধকে মানুষ হিসেবে ভাবা হয়েছে, আর মহাযানে তাঁকে ঈশ্বররূপে প্রতিষ্ঠিত করে তাঁর উপাসনা স্বীকৃত হয়েছে।
.
০৩. হীনযানে ভিক্ষুজীবন ও সন্ন্যাসের উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এবং এই মতানুযায়ী মানুষ সংসার পরিত্যাগ করে নির্বাণের জন্য যত্নশীল হবে। কিন্তু মহাযানমতে নির্বাণলাভের জন্য সংসার ত্যাগের আবশ্যকতা নেই, সংসারে থেকেই মানুষ নির্বাণ লাভে সমর্থ হতে পারে।
.
০৪. হীনযানে নির্বাণ হচ্ছে অভাবাত্মক, অর্থাৎ নির্বাণের মাধ্যমে ভবতৃষ্ণা লুপ্ত হয় বলে দুঃখেরও নিবৃত্তি ঘটে। কিন্তু মহাযানে নির্বাণ হচ্ছে ভাবাত্মক। তাঁদের মতে নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির দুঃখ নাশ হয় না, কিন্তু আনন্দ লাভ হয়।
.
০৫. হীনযানে ‘তন্হা’ বা তৃষ্ণা নিবারণকে নির্বাণের সেতু বলা হয়েছে। এই তৃষ্ণানিবারণের দ্বারা যে ভাব লাভ করা যায় তা হলো তৃষ্ণাশূন্যভাব বা শূন্যতা। কিন্তু মহাযানে এই নিবৃত্তি মার্গ অপেক্ষা কার্য মার্গকে প্রবল মনে করা হয়। এই মতে জ্ঞানই মূলশক্তি এবং তা অর্জনের উপায়স্বরূপ ‘প্রজ্ঞাপারমিতা’ উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছালে বোধিলাভ ঘটে।
.
০৬. হীনযানমতে অর্হৎপদ প্রাপ্তির লক্ষ্যে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘ এই ত্রিরত্ন বা ত্রিশরণ এবং শীলতাকে মূল অবলম্বন হিসেবে স্বীকার করা হয়। বোধিসত্ত্বোৎপাদ, পাপদেশন, পুণ্যানুমোদনা, ষট্পারমিতা (বিশুদ্ধতা) এগুলি অবলম্বনের মাধ্যমে নির্বাণ লাভ করা যায়। অন্যদিকে মহাযানমতে সার্বভৌম মুক্তির লক্ষ্যে বোধিসত্ত্বকেই মুখ্য উপায় বলে সমাদর করা হয়। আর এই বোধিসত্ত্বের প্রধান গুণ বা ধর্ম হচ্ছে করুণা যাকে প্রজ্ঞার মতো স্বীকার করা হয়েছে।
.
০৭. হীনযানে আত্মা স্বীকৃত নয়। কিন্তু মহাযানে ভিন্নভাবে আত্মর সত্তা স্বীকার করা হয়। মহাযান মতে ব্যক্তিক বা বৈয়ক্তিক আত্মা মিথ্যা হলেও পারমার্থিক আত্মা (মহাত্মা) মিথ্যা নয় এবং মহাত্মা মানুষের মধ্যে বিদ্যমান থাকে।
.
০৮. হীনযানে স্বাবলম্বন সন্ন্যাসের আদর্শ অত্যন্ত কঠিন পথ। অন্যদিকে মহাযানে ঈশ্বরাত্মা বোধিসত্ত্বকে আদর্শরূপে স্বীকার করে নির্বাণলাভের পথ সুগম করা হয়েছে। এজন্যেই হীনযানকে সঙ্কীর্ণপথ এবং মহাযানকে প্রশস্ত পথ বলা হয়েছে।
.
০৯. হীনযানে বিশ্বতত্ত্বের কোন দার্শনিক বিচার করা হয় নি, যা মহাযানে বহুল পরিমাণে রয়েছে। হীনযানে ভূমিচতুষ্টয়, কিন্তু মহাযানে দশভূমি আলোচিত হয়েছে।
.
১০. সর্বোপরি সম্প্রদায় হিসেবে পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী হীনযানীরা প্রকৃতপক্ষে গোড়া বৌদ্ধ। অন্যদিকে মহাযানীরা উদার ও প্রগতিশীল বলে অশ্বঘোষ, নাগার্জুন, অসঙ্গ প্রমুখ মহাযানী পণ্ডিতগণ নানান দার্শনিকতাপ্রসূত গভীর প্রশ্নের সমাধান করেছেন।
Tags
বৌদ্ধ দর্শন