কর্ম পদার্থ | বৈশেষিক দর্শন

কর্ম পদার্থ (Action) 

বৈশেষিক স্বীকৃত সপ্তপদার্থের মধ্যে তৃতীয় পদার্থ হলো কর্ম। তবে গুণ দ্রব্যের নিষ্ক্রিয় ও স্থিতিবোধক বিশেষণ, কিন্তু কর্ম দ্রব্যের সক্রিয় ও গতিবোধক বিশেষণ। মহর্ষি কণাদ বৈশেষিকসূত্রে কর্ম-এর লক্ষণে বলেছেন-
‘সংযোগবিভাগেষ্বনপেক্ষকারণমিতি কর্মলক্ষণম্’। (বৈশেষিকসূত্র: ১/১/১৭)।
অর্থাৎ : সংযোগ, বিভাগ ও বেগের সাধারণ কারণস্বরূপ পদার্থই হলো কর্ম।
 .
বৈশেষিকসূত্র অনুসারে, যা একমাত্র দ্রব্যে থাকে, যা গুণশূন্য এবং কোন ভাবপদার্থকে অপেক্ষা না করেই যা সংযোগ এবং বিভাগের কারণ হয় তাই কর্ম। গুণ কিন্তু সংযোগ এবং বিভাগের প্রতি নিরপেক্ষ কারণ হয় না। কর্মই এক বস্তুর সঙ্গে অপর বস্তুর সংযোগ এবং এক বস্তু থেকে অপর বস্তুর বিভাগ করে থাকে। যেমন, হাতের সঙ্গে বই-এর সংযোগস্থলে সংযোগটি হাতের ক্রিয়া থেকেই উৎপন্ন। গুণ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় বেগের কারণ হতে পারে না। কর্মই বেগের কারণ। তর্কসংগ্রহে তাই অন্নংভট্ট কর্মের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘চলনাত্মকং কর্ম’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কর্ম হলো চলন বা গতি স্বরূপ।
 .
গুণের সঙ্গে কর্মের সাদৃশ্য হলো উভয়েই দ্রব্যে সমবায় সম্বন্ধে আশ্রিত। কিন্তু দ্রব্যে আশ্রিত হলেও কর্মকে স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যেহেতু কর্ম স্বতন্ত্রভাবে জ্ঞানের বিষয় হয়। এজন্যেই বলা হয় ‘কর্মত্বই কর্মের লক্ষণ’। কর্ম দ্রব্যে আশ্রিত হলেও সকল দ্রব্যে কর্ম থাকে না, কেবলমাত্র ক্ষিতি, অপ্, তেজ প্রভৃতি মূর্ত ও সীমিত দ্রব্যেই কর্ম থাকে। আকাশ, দিক, কাল ও আত্মা অমূর্ত ও সর্বব্যাপী বলে ইত্যাদি অমূর্ত দ্রব্যে কর্ম থাকে না।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কর্ম পাঁচ প্রকার- (১) উৎক্ষেপণ, (২) অবক্ষেপণ, (৩) আকুঞ্চন, (৪) প্রসারণ ও (৫) গমন।
 .
(১) উৎক্ষেপণ : পদার্থের উর্ধ্বমুখী গতিসঞ্চারক ক্রিয়া হলো উৎক্ষেপণ। উপরের দিকে যখন ঢিল ছোঁড়া হয়, ঢিলটি তখন উপরের দিকে উঠতে থাকে। এরূপ ক্রিয়াই হলো উৎক্ষেপণ। উৎক্ষেপণ কর্মের দ্বারা উর্ধ্বস্থিত কোন দ্রব্যের সঙ্গে অন্য একটি দ্রব্যের সংযোগ করা হয়। উৎক্ষেপণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘উর্ধ্বদেশসংযোগ হেতুঃ উৎক্ষেপণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : উৎক্ষেপণ হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা ঐ ক্রিয়ার আশ্রয় দ্রব্যের উর্ধ্বদেশের সঙ্গে সংযোগ হয়।
 .
(২) অবক্ষেপণ : অবক্ষেপণ হলো বস্তুর নিম্নমুখী গতি সঞ্চারক ক্রিয়া। একটি ফল যখন ডাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে, তখন ঐ ফলের নিম্নমুখী ক্রিয়াকে বলে অবক্ষেপণ। অবক্ষেপণ কর্মের দ্বারা নিম্নস্থিত কোন দ্রব্যের সঙ্গে অন্য একটি দ্রব্যের সংযোগ হয়। অবক্ষেপণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘অধোদেশসংযোগ হেতুঃ অপক্ষেপণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অপক্ষেপণ হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা ঐ ক্রিয়ার আশ্রয় দ্রব্যের অধোদেশের সঙ্গে সংযোগ হয়।
 .
(৩) আকুঞ্চন : আকুঞ্চন হলো সংকোচন ক্রিয়া। একটি বায়ুপূর্ণ বেলুন থেকে যখন বায়ু নির্গত হয়, তখন বেলুনটি সংকুচিত হয়। বিস্তৃত দ্রব্যের অংশগুলিকে সংকুচিত করাই হলো আকুঞ্চন। বস্তুর সঙ্গে বস্তুর সংযোগের জন্য আকুঞ্চন ক্রিয়া প্রয়োজন। তর্কসংগ্রহে আকুঞ্চন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘শরীরস্য সন্নিকৃষ্ট সংযোগ হেতুঃ আকুঞ্চনম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আকুঞ্চন হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা শরীরের সন্নিকৃষ্ট দেশের সঙ্গে শরীরের অবয়বের সংযোগ হয়।
 .
(৪) প্রসারণ : আকুঞ্চনের বিপরীত কর্ম হলো প্রসারণ। প্রসারণ বস্তু থেকে বস্তুকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রিয়া। একটি বায়ুশূন্য বেলুনকে যখন বায়ুপূর্ণ করা হয় তখন বেলুনটি প্রসারিত হয়। বেলুনের এই প্রসারিত হওয়ারূপ ক্রিয়াকে বলে প্রসারণ। প্রসারণ প্রসঙ্গে তর্কসংগ্রহে বলা হয়েছে-
‘শরীর বিপ্রকৃষ্ট সংযোগ হেতুঃ প্রসারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : প্রসারণ হলো সেই ক্রিয়া যার দ্বারা শরীরের দূরবর্তী দেশের সঙ্গে শরীরের অবয়বের সংযোগ হয়।
 .
(৫) গমন : উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণ, আকুঞ্চন ও প্রসারণ এই চারটি কর্ম ছাড়া বাকি সব গতিবিশেষ কর্মই গমনের অন্তর্ভুক্ত। বৈশেষিকমতে গমন শব্দটি ব্যাপক অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে। গমন ক্রিয়ার দ্বারা ক্রিয়ার আশ্রয় দ্রব্যটি অনিয়ত দেশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ভ্রমণ, রেচন, স্যন্দন, উর্ধ্বজ্বলন, বক্রগমন, উন্নমন, নমন প্রভৃতি গমনেরই প্রকারভেদমাত্র। ভ্রমণের দৃষ্টান্ত হলো কুম্ভকারের চক্রের ঘূর্ণন। রেচন হলো অন্তঃস্থিত তরল বস্তুর নিঃসরণ, যেমন পিচকারি থেকে জলের বহির্গমন। স্যন্দন হলো তরল দ্রব্যের প্রবহন। উর্ধ্বজ্বলন হলো উপরের দিকে শিখাবিস্তার, যেমন প্রদীপের শিখার উর্ধ্বগতি। বক্র বা তির্যগ্গমনের দৃষ্টান্ত হলো সাপের গতি।
গমনক্রিয়ার সঙ্গে উৎক্ষেপণ, অবক্ষেপণ, আকুঞ্চন ও প্রসারণ ক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো, এই চতুর্বিধ ক্রিয়া গতিবিশেষ নয়, গতির অনুকূল ব্যাপারবিশেষ, কিন্তু গমনক্রিয়া স্বয়ং গতিবিশেষ।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال