কারণ ও তার বিভাগ | বৈশেষিক দর্শন

কারণ ও তার বিভাগ 

বৈশেষিক মতে এই জগৎ অনিত্য। জগতের সৃষ্টি আছে এবং লয় আছে। জগতের সৃষ্টি ও লয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় কার্য-কারণ তত্ত্বের সাহায্য নিয়েছেন। কারণ ও কার্য হলো যথাক্রমে স্রষ্টা ও সৃষ্ট। স্রষ্টা কোন কিছু সৃষ্টি করে। স্রষ্টার এই সৃষ্টি হলো কার্য। কারণ হলো কার্যের ঘটক। কারণ নিত্য হতে পারে, আবার অনিত্য হতে পারে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে কাল, দিক, আকাশ, ঈশ্বর, পরমাণু এইগুলি হলো নিত্য কারণ। এই কারণগুলি অন্য কারণের দ্বারা সৃষ্ট নয়। অপরদিকে ঘট, পট প্রভৃতি কারণ হলো অনিত্য কারণ। ঘট, ঘটরূপের কারণ। কিন্তু এই ঘট আবার কপালদ্বয় সংযোগের কার্য। এইজন্য ঘটকে অনিত্য কারণ বলি। অনিত্য কারণের উৎপত্তি ও বিনাশ থাকে।
 .
বিভিন্ন বৈশেষিক শাস্ত্রে নানাভাবে কারণের লক্ষণ দেয়া হয়েছে। এইসকল লক্ষণ প্রধানত কার্য ভিত্তিক। অর্থাৎ কার্যের ভিত্তিতেই কারণের লক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যোন্যাশ্রয় দোষ অর্থাৎ পারস্পরিক আশ্রয়দোষ পরিহারের অভিপ্রায়ে কারণের ভিত্তিতে কার্যের লক্ষণ দেয়া হয় নি। স্বতন্ত্রভাবেই কার্যের লক্ষণ দেয়া হয়েছে।
 .
কার্য (Effect) :
কার্যের লক্ষণ দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-
‘কার্যং প্রাগভাব প্রতিযোগী’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কার্য হলো প্রাগভাবের প্রতিযোগী।
 .
কোন পদার্থের উৎপত্তির পূর্বে যে অভাব থাকে তাকে বলা হয় প্রাগভাব। যেকোন প্রকার অভাবের ক্ষেত্রে যে পদার্থটির অভাব অনুভূত হয় সেই পদার্থটিকে বলা হয় অভাবের প্রতিযোগী। প্রাগভাবের প্রতিযোগী যতক্ষণ না উৎপন্ন হয় ততক্ষণই তার প্রাগভাব থাকে। যে ঘটটি এখনও উৎপন্ন হয়নি, জগতে তার প্রাগভাব বর্তমান। ন্যায়মতে, কার্যের উৎপত্তির পূর্বে তার প্রাগভাব থাকে। ঘটের উৎপত্তির পূর্বে ঘটের প্রাগভাব থাকে। যা উৎপন্ন হয় তাই কার্য। যে ক্ষণে ঘটটি উৎপন্ন হবে সেই ক্ষণেই ঐ ঘটের প্রাগভাব ধ্বংস হবে। বস্তুত প্রাগভাব ধ্বংস করেই কার্য উৎপন্ন হয়। যার প্রাগভাব নেই, তার উৎপত্তিরও প্রশ্ন নাই। এজন্য কোন কার্যের উৎপত্তির প্রতি ঐ কার্যের প্রাগভাব অন্যতম কারণরূপে বিবেচিত হয়। কার্য হলো তাই, উৎপত্তির পূর্বে যার অস্তিত্ব থাকে না, যা পরে আরম্ভ হয়। ফলে কার্য যেহেতু তার প্রাগভাবকে ধ্বংস করে উৎপন্ন হয়, সেহেতু কার্যকে প্রাগভাবের প্রতিযোগী বলা হয়েছে।
 .
কারণ (Cause) :
কারণের লক্ষণে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে বলেছেন-
‘কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি কারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, যা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ।
 .
তন্তু, তন্তুসংযোগ, তন্তুবায়, তুরী, বেমা বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি বলে বস্ত্রের কারণ। মৃত্তিকা, কুম্ভকার, জল ঘটের নিয়ত পূর্ববৃত্তি বলে ঘটের কারণ। এখানে ‘কার্য’ শব্দটি পূর্ববৃত্তির বিশেষণ এবং ‘নিয়ত’ শব্দটিও পূর্ববৃত্তির বিশেষণ। বৃত্তি মানে থাকা। ‘পূর্ববৃত্তি’ বলতে বোঝায় পূর্বে বৃত্তি বা পূর্বে থাকা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, কার পূর্বে বৃত্তি ? এর উত্তরে বলা হয়, কার্যের পূর্বে বৃত্তি। আর যদি প্রশ্ন উঠে, কিরূপ পূর্ববৃত্তি ? এর উত্তর হবে কার্যের নিয়ত পূর্বে বৃত্তি। পুনরায় যদি প্রশ্ন উঠে, কত পূর্বে বৃত্তি ? এর উত্তর হবে, অব্যবহিত পূর্বে বৃত্তি। যদিও অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে স্পষ্টত অব্যবহিত পূর্বে বৃত্তি বলেননি, তবু পরবর্তী টীকাকারেরা অব্যবহিত পূর্বে বৃত্তি যে গ্রন্থকারের অভিপ্রায় তা ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মতে, পূর্ব শব্দের দ্বারা কার্যের দূরবর্তী পূর্বগামী পদার্থকে বুঝলে হবে না। পূর্ব শব্দের দ্বারা কার্যের দূরবর্তী পূর্বগামী পদার্থকে বুঝলে গতকাল উৎপন্ন বস্ত্রের কারণ তন্তু, বেমা, তুরী প্রভৃতি আজকে উৎপন্ন বন্ত্রের নিয়ত পূর্ববর্তী বলে ঐ বস্ত্রের প্রতি কারণ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না। গতকাল উপস্থিত তুরী, বেমা, তন্তু প্রভৃতি আজকে উৎপন্ন বস্ত্রের প্রতি তাদের কারণ বলা যাবে না। অতএব পূর্ববৃত্তি মানে কার্যের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বে থাকা। এরপরেও যদি প্রশ্ন উঠে, কোথায় বা কোন্ স্থলে পূর্ববৃত্তি ? তার উত্তরে বলা হয়, কার্যের অধিকরণে পূর্ববৃত্তি। অর্থাৎ, যা কার্যের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বক্ষণে কার্যের অধিকরণে নিয়ত থাকে, তাই কারণ। কোন স্থলে যখন কোন কার্য ঘটে তখন সেই স্থলে কার্য ঘটার অব্যবহিত পূর্বে ঘটক কারণ উপস্থিত থেকে কার্যকে ঘটায়। সর্বত্র এইরূপ নিয়ম। এই জন্য কারণকে কার্যনিয়তপূর্ববৃত্তি বলা হয়েছে।
 .
কারণের এই লক্ষণে ‘নিয়ত’ শব্দ ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ‘নিয়ত’ শব্দ না দিলে কারণের লক্ষণ হয়ে যাবে- ‘যা কার্যের পূর্বে থাকে তাই কারণ’। কিন্তু এটি কারণের লক্ষণ হলে তা অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হবে। ঘট-কার্যের উৎপত্তির পূর্বে মৃত্তিকা বহনকারী গর্দভ (রাসভ) কখনও কখনও উপস্থিত থাকতে পারে। ফলে গর্দভ ঘট-কার্যের পূর্ববৃত্তি হওয়ায় গর্দভকেও ঘট-কার্যের কারণ বলতে হবে। পূর্ববৃত্তি কারণের লক্ষণ গর্দভে সমন্বয় হয়ে যায় বলে লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্যেই কারণের লক্ষণে ‘নিয়ত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ কার্যের কেবল পূর্ববৃত্তি নয়, কারণ কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি। গর্দভ ঘটরূপ কার্যের উৎপত্তির পূর্বে কখনও থাকলেও ঘটরূপ কার্যের উৎপত্তির পূর্বে নিয়ত থাকে না। গর্দভ ঘটের উৎপত্তিতে অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়। অর্থাৎ কারণের লক্ষণে যদি ‘নিয়ত’ শব্দটি সন্নিবিষ্ট না হয় তাহলে কোন আকস্মিক পূর্ববর্তী ঘটনাও কার্যের কারণ বলে বিবেচিত হতে পারে। একটি ঘটের উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বক্ষণে কোন একটি কাক উড়ে যেতে পারে, কিন্তু তার জন্য ঐ ঘটনাকে ঘট-কার্যের কারণ বলা যায় না। যেখানে কার্য, সেখানে কারণ থাকে। তাই কারণ কার্যের ব্যাপক হয়। ‘নিয়ত’ শব্দের অর্থ নিয়মযুক্ত বা সর্বত্র বা ব্যাপক। গর্দভ বা কাক ঘট-কার্যের ব্যাপক হয় না বলে ঘটের কারণ হয় না। যখনই কোন কার্য ঘটে তখনই তার পূর্বে তার কারণ উপস্থিত হয়। একই জাতীয় কার্যের উৎপত্তিতে সর্বদা একই জাতীয় কারণের পূর্ববৃত্তিত্ব থাকে। অতএব যা কোন কার্যের নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী তাকেই ঐ কার্যের কারণ বলা হয়।
 .
আবার কারণের লক্ষণে ‘পূর্ববৃত্তি’ শব্দটিও অপরিহার্য। শুধু বৃত্তি বললে কারণের লক্ষণ হবে- ‘যা কার্যের সঙ্গে নিয়ত বৃত্তি তাই কারণ’। এবং এটি কারণের লক্ষণ হলে এক্ষেত্রেও তা অতিব্যাপ্তি দোষে দুষ্ট হবে। কেননা ঘটকার্য নিয়ত নিজের সঙ্গে থাকায় ঘট নিজেই নিজের প্রতি কারণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ কারণের লক্ষণ কার্যে সমন্বয় হয়ে যাবে। ফলে কারণের লক্ষণে অতিব্যাপ্তি দোষ হবে। যে কোন বস্তু তাদাত্ম্য সম্বন্ধে সর্বদা নিজের সঙ্গে থাকে। তাই যে কোন কার্যও তাদাত্ম্য সম্বন্ধে সর্বদা নিজের সঙ্গে থাকে। ফলে একটি কার্য নিজেই নিজের ব্যাপক হবে, যাকে বলে স্ব-ব্যাপক বা স্ব-নিয়ত। কিন্তু যা কার্যের বাপক তাই কারণ, এটা হতে পারে না। এই অতিব্যাপ্তি বারণের জন্যেই কারণের লক্ষণে ‘পূর্ববৃত্তি’ শব্দ সংযোজিত হয়েছে।
 .
কিন্তু এতোসব ব্যাখ্যার পরেও কারণের এই যে লক্ষণ- ‘কার্যনিয়ত পূর্ববৃত্তি কারণম্’ বা ‘যা কার্যের নিয়ত পূর্বে থাকে তাই কারণ’, তাতেও কারণের লক্ষণ নির্দোষ হয় না। একটি কার্য উৎপত্তির অব্যবহিত পূর্বে জগতে এতো বিচিত্র ঘটনা ঘটে যাদের সঙ্গে হয়তো ঐ কার্যের কোন সম্পর্ক নাই। যেমন- তন্তু বা সুতা যেমন বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি হওয়ায় বস্ত্রের কারণ হবে, তেমনি তন্তুরূপও বস্ত্রের কারণ হয়ে পড়বে। কেননা তন্তুর মতো তন্তুরূপও বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি। কিন্তু ন্যায়মতে তন্তু বস্ত্রের কারণ হলেও তন্তুরূপ বস্ত্রের প্রতি কারণ নয়। কার্যের সাথে এরূপ সম্বন্ধহীন ঘটনাকে কারণ থেকে বহির্ভূত করার জন্য নৈয়ায়িকরা অনন্যথাসিদ্ধ বা অন্যথাসিদ্ধিশূন্য ধারণার সাহায্য নিয়েছেন।
 .
যে ঘটনা কোন কার্যের নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী হয়েও কার্যের জনক হয় না, তাই অন্যথাসিদ্ধ। অন্যথাসিদ্ধির অভাব বা বিরহই হলো অনন্যথাসিদ্ধ বা অন্যথাসিদ্ধিশূন্য। অন্যথাসিদ্ধ কার্যের কারণ হয় না। অনন্যথাসিদ্ধই কার্যের কারণ হয়। যে তন্তু পট বা বস্ত্র উৎপন্ন করে সেই তন্তু পটের কারণ। কিন্তু ঐ তন্তুর রূপ পটরূপের কারণ হলেও ঐ পটের কারণ নয়। অথচ তন্তুর রূপ তন্তুর সঙ্গেই পটকার্যের নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী হয়। এই কারণে তন্তুর রূপকে পটকার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ বলা হয়। এইরূপ অন্যথাসিদ্ধিশূন্য নিয়ত অব্যবহিত পূর্ববর্তী ঘটনাকেই কোন কার্যের কারণ বলা যায়। এইজন্য অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় অবশেষে কারণের নির্দোষ লক্ষণ দিয়েছেন-
‘অনন্যথাসিদ্ধ নিয়ত পূর্ববৃত্তিত্বং কারণত্বম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যা অনন্যথাসিদ্ধ ও নিয়ত পূর্ববৃত্তি, তাই কারণ।
 .
অতএব, কারণের প্রকৃত লক্ষণ হলো, যা অন্যথাসিদ্ধ নয়, অর্থাৎ অনন্যথাসিদ্ধ- যা কার্যের উৎপত্তির জন্য অপ্রয়োজনীয় নয়, এবং যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি বা সর্বদা কার্যের পূর্বে থাকে, তাই কারণ।
 .
অন্যথাসিদ্ধি ও তার প্রকারভেদ :
অন্নংভট্ট অন্যথাসিদ্ধির কোন লক্ষণ দেননি। তিনি তর্কসংগ্রহদীপিকা টীকায় বলেছেন- যা কোন কার্যের কারণ, তা অন্যথাসিদ্ধ হবে না, অন্যথাসিদ্ধ থেকে ভিন্ন হবে (অনন্যথাসিদ্ধ)। অতএব বলা যায়, যা কার্যের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, অথচ কোন যুক্তিতে তা কার্যের উৎপত্তির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় নয়, তাই অন্যথাসিদ্ধ। যেমন, তন্তুরূপ বস্ত্রের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ। তন্তু রূপ ছাড়া হয় না, তন্তুর কোন না কোন রূপ থাকবেই। কিন্তু বস্ত্রের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যেহেতু তন্তুই, তা যে কোন রঙেরই হোক না কেন, বস্ত্রের উৎপত্তির জন্য অপরিহার্য, তাই তন্তুরূপ বস্ত্রের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ, কিন্তু তা বস্ত্ররূপের প্রতি কারণ।
 .
বিভিন্ন ন্যায়শাস্ত্রে অন্যথাসিদ্ধির বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। তর্কসংগ্রহদীপিকায় অন্নংভট্ট তিন প্রকার অন্যথাসিদ্ধির উদাহরণসহ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
 .
(ক) প্রথমপ্রকার অন্যথাসিদ্ধির ব্যাখ্যায় অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘যেন সহৈব যস্য যং প্রতি পূর্ববৃত্তিত্বং অবগম্যতে, তং প্রতি তেন তৎ অন্যথাসিদ্ধম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : কোন কার্যের প্রতি যে পদার্থের পূর্ববৃত্তিত্ব যে সব ধর্মের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে জ্ঞাত হয়, সেই কার্যের প্রতি সেই সব ধর্ম ঐ কার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ।
 .
যেমন পটকার্যের প্রতি তন্তুর রূপ, তন্তুত্ব প্রভৃতি ধর্ম। তন্তুর কোন না কোন রূপ থাকবেই। আবার তন্তুতে তন্তুত্ব বলে জাতি বা ধর্ম সর্বদাই থাকে। তন্তু পটের নিয়ত পূর্ববর্তী ও পটের কারণ। তন্তুর রূপ ও তন্তুত্ব তন্তু সহযোগেই পটের নিয়ত পূর্ববর্তী। স্বতন্ত্রভাবে তারা পটকার্যের প্রতি নিয়ত পূর্ববর্তী হয় না। তন্তু কারণ হওয়ায় তার দ্বারা তার রূপ ও জাতি পটকার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ হয়। বস্তুতঃ তন্তুই পটের কারণ। পট যেহেতু তার রূপ ও জাতির আশ্রয়, সেইহেতু তন্তুর সঙ্গে তাদের পটের প্রতি নিয়ত পূর্ববৃত্তিত্ব ঘটে থাকে।
 .
প্রশ্ন হতে পারে, তন্তুরূপ ও তন্তুত্ব যেহেতু তন্তুর মতোই পট বা বস্ত্রের নিয়ত পূর্ববৃত্তি, তবে তাদের তন্তুর মতোই বস্ত্রের প্রতি কারণ বলা হবে না কেন ? উত্তরে বলা হয়েছে, লাঘবের নীতি অনুযায়ী তন্তুরূপ ও তন্তুত্বকে বস্ত্রের কারণ বলা হয়নি। যদি অল্পসংখ্যক নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপারের দ্বারা কার্যের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে অধিকতর নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপার স্বীকার করলে গৌরব দোষ হয়। তন্তুরূপ তন্তু (দ্রব্য) ছাড়া থাকতে পারে না, তন্তুত্বের জ্ঞান তন্তুর পূর্বজ্ঞান ছাড়া হয় না। তাই পট বা বস্ত্রের উৎপত্তির ব্যাপারে তন্তু ছাড়া তন্তুর অপরিহার্য ধর্মকে কারণরূপে স্বীকার করা অপ্রয়োজনীয়।
 .
(খ) দ্বিতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির বর্ণনা দিতে গিয়ে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘অন্যং প্রতি পূর্ববৃত্তিত্বে জ্ঞাত এব যস্য যং প্রতি পূর্ববৃত্তিত্বং অবগম্যতে তং প্রতি তৎ অন্যথাসিদ্ধম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : অন্য কার্যের প্রতি কোন পদার্থের পূর্ববৃত্তিত্ব জানার পরই যদি আরেকটি কার্যের প্রতি সেই পদার্থের পূর্ববৃত্তিত্ব জানা যায়, তবে সেই দ্বিতীয় কার্যের প্রতি ঐ পদার্থ অন্যথাসিদ্ধ হয়।
 .
যেমন পটকার্যের প্রতি আকাশ নিয়ত পূর্ববৃত্তি হলেও অন্যথাসিদ্ধ। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, আকাশ নিত্য ও বিভু (সর্বব্যাপী) দ্রব্য। তাই আকাশ যে কোন কার্যেরই নিয়ত পূর্ববৃত্তি। তাই আকাশকে যে কোন কার্যের প্রতি কারণ বলতে হয়। কিন্তু নৈয়ায়িকরা তা বলেন না। আকাশের পরিচয় হলো শব্দসমবায়িকারণত্ব। শব্দের সমবায়িকারণরূপে আকাশ শব্দের নিয়ত পূর্ববর্তী। পটের প্রতি আকাশের পূর্ববৃত্তিত্বের জ্ঞানের পূর্বে শব্দের প্রতি তার পূর্ববৃত্তিত্বের জ্ঞান সর্বদা হওয়ায় আকাশকে শব্দেরই কারণ বলা হয়, তাই পটের প্রতি আকাশ অন্যথাসিদ্ধ। যদিও বৈশেষিকেরা একাধিক কার্যের প্রতি একটি পদার্থের কারণতা স্বীকার করেন, তবুও যেক্ষেত্রে একটি কার্যের কারণতা জানতে হলে সর্বদাই অন্য একটি কার্যের প্রতি কারণতা আগে জানতে হয় সেক্ষেত্রে দ্বিতীয়াদি কার্যের প্রতি তার কারণতা সিদ্ধ হয় না। দ্বিতীয়াদি কার্যের প্রতি তা অন্যথাসিদ্ধ হয়।
 .
প্রশ্ন হতে পারে, আকাশ পটের নিয়ত পূর্ববৃত্তি হলেও তা পটের কারণ নয় কেন ? উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিকেরা বলেন, লাঘবের নীতি অনুযায়ী আকাশকে পটের প্রতি কারণ বলা হয় নি। অল্পসংখ্যক নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপারের দ্বারা কার্যের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলে অধিকতর নিয়ত পূর্বগামী ব্যাপার স্বীকার করলে গৌরব দোষ হয়। পটের উৎপত্তির ক্ষেত্রে তন্তু প্রভৃতি অন্যান্য নিয়ত পূর্বগামী পদার্থের উল্লেখই যথেষ্ট ও প্রয়োজনীয়। তাই আকাশকে পটের কারণ বললে গৌরব দোষ হয়। আকাশ শব্দের জনক। শব্দজনকত্বই আকাশের পরিচায়ক। আকাশ আকাশরূপে শব্দ ভিন্ন কার্যের কারণ হয় না। তাই আকশ আকাশরূপে শব্দ ভিন্ন সব কার্যের প্রতি অন্যথাসিদ্ধ।
 .
(গ) তৃতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির ব্যাখ্যায় অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-
‘অন্যত্র ক্লিপ্ত নিয়তপূর্ববর্তিনা এব কার্যসম্ভবে তৎ সহভূতম্ অন্যথাসিদ্ধম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : যে সব নিয়তপূর্বগামী ব্যাপার কার্যের উৎপত্তির জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় তাই কার্যের কারণ, তার সঙ্গে যা যা থাকে তা তা অন্যথাসিদ্ধ।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, পাকের ফলে পাকজস্থলে একটি পার্থিব দ্রব্যে রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ এই চারটি গুণ যুগপৎ অর্থাৎ একসঙ্গেই উৎপন্ন হয়। পাকের ফলে উৎপন্ন রূপাদিকে পাকজ রূপ, পাকজ রস, পাকজ গন্ধ, পাকজ স্পর্শ বলা হয়। উৎপত্তির পূর্বে প্রতিটি গুণের প্রাগভাব তার উৎপত্তির অন্যতম কারণ। কিন্তু গন্ধের উৎপত্তিতে গন্ধের প্রাগভাবই কারণ হবে। গন্ধ প্রাগভাবের সঙ্গে রূপপ্রাগভাব গন্ধের নিয়ত পূর্ববর্তী হলেও গন্ধের প্রতি রূপপ্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ হবে, কারণ হবে না। একইভাবে পাকজ রূপের প্রতি রূপের প্রাগভাব কারণ, গন্ধের প্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ। কেননা পাকজ রূপের উৎপত্তির জন্য গন্ধের প্রাগভাব প্রয়োজনীয় নয়। অনুরূপ, পাকজ রসের প্রতি রসের প্রাগভাব কারণ, রূপাদির প্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ, এবং পাকজ স্পর্শের প্রতি স্পর্শের প্রাগভাব কারণ, গন্ধাদির প্রাগভাব অন্যথাসিদ্ধ।
 .
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় উপরিউক্ত তিনপ্রকার অন্যথাসিদ্ধির কথা বললেও বিশ্বনাথ ন্যায়পঞ্চানন তাঁর ভাষাপরিচ্ছেদ গ্রন্থে পাঁচ প্রকার অন্যথাসিদ্ধি স্বীকার করেছেন- (১) কারণতার অবচ্ছেদক ধর্ম (যেমন, ঘটের প্রতি দণ্ডত্ব), (২) কারণের গুণ (যেমন, ঘটের প্রতি দণ্ডরূপ), (৩) ঘটাদি কার্যের প্রতি আকাশ, (৪) ঘটের প্রতি কুলালপিতা বা কুম্ভকারপিতা, (৫) ঘটমাত্রের প্রতি রাসভ (গর্দভ)। এই পাঁচ প্রকার অন্যথাসিদ্ধি সর্বসম্মত। তবে উল্লিখিত পাঁচ প্রকার অন্যথাসিদ্ধি অন্নংভট্ট স্বীকৃত তিন প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত।
.
(ক) উল্লিখিত প্রথম প্রকার অন্যথাসিদ্ধি কারণতার অবচ্ছেদক ধর্ম ও দ্বিতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধি কারণের গুণ এই দুটিকে অন্নংভট্ট পৃথক পৃথক অন্যথাসিদ্ধি না বলে দুটিকে প্রথম প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত করেছেন।
(খ) উল্লিখিত তৃতীয় ও চতুর্থ প্রকার অন্যথাসিদ্ধিকে অন্নংভট্ট দ্বিতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত করেছেন।
(গ) উল্লিখিত পঞ্চম প্রকার অন্যথাসিদ্ধি রাসভাদিকে অন্নংভট্ট তৃতীয় প্রকার অন্যথাসিদ্ধির অন্তর্গত করেছেন।
.
টীকাকার নীলকণ্ঠের মতে, নব্য-নৈয়ায়িক গঙ্গেশকে অনুসরণ করে অন্নংভট্টের এই তিনপ্রকার শ্রেণীবিভাগই যুক্তিযুক্ত।
 .
কারণের শ্রেণীবিভাগ :
ন্যায়-বৈশেষিক মতে কারণ তিন প্রকার- (১) সমবায়িকারণ, (২) অসমবায়িকারণ ও (৩) নিমিত্তকারণ।
 .
ন্যায়মতে কার্য দুই প্রকার হতে পারে- ভাবকার্য ও অভাবকার্য। ঘট, পট প্রভৃতি উৎপন্ন বস্তু ভাবকার্য। লাঠির আঘাতে ঘট ভেঙে গেলে ঘটের যে ধ্বংস উৎপন্ন হয় সেই ঘটধ্বংস অভাবকার্য। ন্যায়মতে ভাবকার্য সমবায়ি, অসমবায়ি ও নিমিত্ত- এই তিনটি কারণ হতে উৎপন্ন হয়। ভাবকার্য মাত্রেরই সমবায়ি, অসমবায়ি ও নিমিত্তকারণ থাকে। যেমন, তন্তু থেকে উৎপন্ন বস্ত্র ভাবকার্য। বস্ত্রের সমবায়িকারণ তন্তু, অসমবায়িকারণ তন্তুসংযোগ, নিমিত্তকারণ তন্তুবায়, তুরী, বেমা ইত্যাদি। কিন্তু ঘটধ্বংস রূপ অভাবকার্য কেবল নিমিত্তকারণ থেকে উৎপন্ন হয়। অভাবকার্যের সমবায়ি ও অসমবায়িকারণ নাই। অভাব কোথাও সমবায় সম্বন্ধে থাকে না বলে অভাব কার্যের সমবায়ি, অসমবায়ি কারণ হয় না। ঘটধ্বংস রূপ অভাবকার্য লাঠি, লাঠি ও ঘটের সংযোগ প্রভৃতি নিমিত্তকারণ থেকে উৎপন্ন।
 .
(১) সমবায়িকারণ (Inherent cause) : অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে সমবায়িকারণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘যৎ সমবেতং কার্যমুৎপদ্যতে তৎ সমবায়িকারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যাতে অর্থাৎ যে দ্রব্যে সমবেত হয়ে বা সমবায় সম্বন্ধে থেকে কার্যের উৎপত্তি হয়, তাই কার্যের সমবায়িকারণ।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে দ্রব্যই গুণ-ক্রিয়াদির আশ্রয়। একমাত্র দ্রব্যেই সমবায় সম্বন্ধে কার্য উৎপন্ন হতে পারে। তাই কেবল দ্রব্যই এই মতে সমবায়িকারণ হতে পারে। যেমন, তন্তু পট বা বস্ত্রের সমবায়িকারণ এবং পট পটরূপের সমবায়িকারণ। তন্তু দ্রব্য। তন্তুতে সমবেত হয়ে পট উৎপন্ন হয়। তাই তন্তু অর্থাৎ দ্রব্যই সমবায়িকারণ হয়। গুণ বা কর্ম (ক্রিয়া) সমবায়িকারণ হয় না। পট হলো অবয়বী (whole) এবং তন্তুসমূহ হলো তার অবয়ব (part)। ন্যায়মতে অবয়বী ও অবয়বের সম্বন্ধ সমবায়। পট (কার্য) তন্তুসমূহে (অবয়ব) সমবায় সম্বন্ধে থেকে উৎপন্ন হয়। তাই তন্তুসমূহ পটের সমবায়িকারণ। ন্যায়মতে, কার্য ও কারণ সমানাধিকরণ হওয়া প্রয়োজন। পট তন্তুতে সমবায় সম্বন্ধে এবং তন্তু তন্তুতে তাদাত্ম্য সম্বন্ধে থাকায় তন্তু (কারণ) ও পট (কার্য) সমানাধিকরণ হয় বা একই অধিকরণে থাকে বলা যায়। তাই তন্তু পটের কারণ হয়।
 .
ন্যায়-বৈশেষিক মতে, জন্যদ্রব্য অর্থাৎ উৎপন্নদ্রব্য গুণ ও কর্মের সমবায়িকারণ হওয়ায় দ্রব্যকে গুণ ও কর্মের অন্তত একক্ষণ আগে উৎপন্ন হতে হয়। যে ক্ষণে দ্রব্য উৎপন্ন হয় সেইণে দ্রব্য নির্গুণ ও নিষ্ক্রিয় থাকে। দ্রব্য উৎপত্তির পরক্ষণে গুণ উৎপন্ন করে কিন্তু কর্ম উৎপন্ন হওয়ার জন্য আরো একটি ক্ষণ প্রয়োজন হয়। কর্ম উৎপন্ন হওয়ার জন্য সংযোগ-বিভাগের অপেক্ষা করে। সংযোগাদি গুণ হওয়ায় দ্রব্য উৎপত্তির পরক্ষণেই তা উৎপন্ন হতে পারে। কিন্তু সংযোগের উৎপত্তিক্ষণে কর্মের উৎপত্তি সম্ভব নয়। তাই কর্মকে উৎপত্তির জন্য আরো একক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সুতরাং বলতে হয় যে, প্রথমক্ষণে দ্রব্যের উৎপত্তি, দ্বিতীয়ক্ষণে গুণের উৎপত্তি এবং তৃতীয়ক্ষণে কর্মের উৎপত্তি স্বীকার্য।
 .
(২) অসমবায়িকারণ (Non-inherent cause) : তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট অসমবায়ি কারণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘কার্যেণ কারণেন বা সহ একস্মিন অর্থে সমবেতত্বে সতি যৎ কারণং তৎ অসমবায়িকারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : কার্যের সঙ্গে বা কারণের সঙ্গে একই অধিকরণে থেকে অর্থাৎ সমবায়িকারণে থেকে যা কার্যকে উৎপন্ন করে তাই কার্যের অসমবায়িকারণ।
 .
যেমন, তন্তুসংযোগ পটের (বস্ত্রের) অসমবায়িকারণ, তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ। তন্তুসংযোগের অধিকরণ তন্তুতে পট (কার্য) সমবায় সম্বন্ধে থাকে বলে তন্তুসংযোগ পটের অসমবায়িকারণ হয়। আবার তন্তুরূপের অধিকরণ তন্তুতে পটরূপের কারণ পট থাকে বলে তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ হয়।
.
অসমবায়িকারণ দুইভাবে কার্যের সঙ্গে সংবদ্ধ হয়- (ক) সাক্ষাৎ সম্বন্ধে অসমবায়িকারণ কার্যৈকার্থ। অথবা (খ) পরম্পরা সম্বন্ধে অসমবায়িকারণ কারণৈকার্থ।
 .
কার্যৈকার্থ অসমবায়িকারণ : কার্যের সঙ্গে একই অধিকরণে থেকে যা কার্য উৎপন্ন করে সেই কারণকে বলা হয় কার্যৈকার্থ অসমবায়িকারণ। অন্যকথায়, যখন কার্যের অসমবায়িকারণ কার্যের সমবায়িকারণে সাক্ষাৎ সমবায় সম্বন্ধে থেকে কার্য উৎপন্ন করে তখন ঐ অসমবায়িকারণকে কার্যৈকার্থ অসমবায়িকারণ বলা হয়।  যেমন, তন্তুসংযোগ পটের অসমবায়িকারণ। এক্ষেত্রে পট কার্য তার অসমবায়িকারণ তন্তুসংযোগে থাকে না। কিন্তু তন্তুসংযোগের অধিকরণ তন্তুতে পট (কার্য) সমবায় সম্বন্ধে থাকে। ফলে তন্তুসংযোগ (কারণ) ও পট (কার্য) সমানাধিকরণ হয়। তাই তন্তুসংযোগকে পটের অসমবায়িকারণ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, তন্তুসংযোগ কার্য পটের সঙ্গে পটের সমবায়িকারণ তন্তুতে সমবায় সম্বন্ধে সমবেত থেকে পট কার্য উৎপন্ন করে বলে পটের প্রতি তন্তুসংযোগ অসমবায়িকারণ।
 .
কারণৈকার্থ অসমবায়িকারণ : কারণের সঙ্গে একই অধিকরণে থেকে যা কার্য উৎপন্ন করে সেই কারণকে বলা হয় কারণৈকার্থ অসমবায়িকারণ। অন্যকথায়, যখন কার্যের অসমবায়িকারণ কার্যের সমবায়িকারণে স্বসমবায়িসমবায় সম্বন্ধে থেকে কার্য উৎপন্ন করে তখন ঐ অসমবায়িকারণকে কারণৈকার্থ অসমবায়িকারণ বলা হয়। যেমন, তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ। এখানে পটরূপ কার্য। কিন্তু তন্তুরূপ (কারণ) ও পটরূপ (কার্য)-এর সামানাধিকরণ্য (একই অধিকরণে থাকা) সাক্ষাৎভাবে দেখানো যায় না। তবে পরম্পরাভাবে এরা একই অধিকরণে থাকে, তা দেখানো যায়। তাই তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ।
তন্তুরূপ সমবায় সম্বন্ধে থাকে তন্তুতে। তন্তু তন্তুরূপে অধিকরণ। কিন্তু সেই তন্তুতে পটরূপ (কার্য) থাকে না। পটরূপ থাকে পটে। তাই তন্তুরূপ (কারণ) ও পটরূপ সমানাধিকরণ হয় না। কিন্তু তন্তুরূপের অধিকরণ তন্তুতে পটরূপের কারণ পট সমবায় সম্বন্ধে থাকে। অর্থাৎ তন্তুরূপ সমবায় সম্বন্ধে থাকে তন্তুতে এবং সেই তন্তুতে পটরূপের সমবায়িকারণ পট সমবায় সম্বন্ধে থাকে। এভাবে পরম্পরা সম্বন্ধে বা স্বসমবায়ি সমবায় সম্বন্ধে তন্তুরূপ পটরূপের সমবায়িকারণ পটে থাকে বলে তন্তুরূপ পটরূপের অসমবায়িকারণ হয়।
 .
(৩) নিমিত্তকারণ (Efficient cause) : অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে নিমিত্তকারণের লক্ষণ দিয়েছেন-
‘তৎ উভয়ভিন্নং কারণং নিমিত্তকারণম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : যে কারণ সমবায়ি ও অসমবায়ি এই উভয় কারণ থেকে ভিন্ন তাই নিমিত্তকারণ।
 .
যে কারণ কোন কার্যের সমবায়িকারণ ও অসমবায়িকারণ থেকে ভিন্ন তাই নিমিত্তকারণ। যেমন, পটকার্যের প্রতি তন্তু সমবায়িকারণ এবং তন্তু-সংযোগ অসমবায়িকারণ। কিন্তু এই দুই প্রকার কারণ ছাড়াও পটকার্যের বহুবিধ কারণ আছে, যথা- তুরী, বেমা, তন্তুবায় প্রভৃতি। এই কারণগুলিকে পটকার্যের নিমিত্ত কারণ বলা হয়। তুরী, বেমা, তন্তুবায় প্রভৃতিতে পট সমবায় বা স্বসমবায়িসমবায় সম্বন্ধে থাকে না। ফলে এগুলি পটের সমবায়ি বা অসমবায়ি কারণ হয় না। অথচ তুরী, বেমা, তন্তুবায় প্রভৃতি যে পটে প্রতি কারণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ধরনের কারণকেই ন্যায়-বৈশেষিকমতে নিমিত্ত কারণ বলা হয়।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال