চার্বাক ও বৃহস্পতি
চার্বাক দর্শন সম্পর্কে যেটুকু নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় তা থেকে এই মতবাদের সূচনার কাল বা ‘চার্বাক’ নামের সঙ্গে এর সংযুক্তির কাহিনী কিছুই সঠিকভাবে নির্ণয় করা এখনো সম্ভব নয়। তাছাড়া এই চিন্তাধারা চার্বাক দর্শন নামে পরিচিতি লাভ করলেও চার্বাক নামে কোন ব্যক্তিকে এর প্রবর্তক বলে স্বীকার করার কোন প্রমাণও এযাবৎ পাওয়া যায়নি। তবে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ প্রভৃতি গ্রন্থে এই মতবাদের আদি প্রচারক হিসেবে বৃহস্পতির নাম উল্লেখ করা আছে। ব্যক্তিরূপী চার্বাক এসব গ্রন্থে স্বীকৃতি পেলেও তা উদ্ধৃত হয়েছে বৃহস্পতিশিষ্য হিসেবে।
যেমন চতুর্দশ শতকের মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদ ‘চার্বাক-দর্শনম’-এর শুরুর দিকে বলছেন-
‘অথ কথং পরমেশ্বরস্য নিঃশ্রেয়স-প্রদত্বমভিধীয়তে ? বৃহস্পতি-মতানুসারিণা নাস্তিক-শিরোমণিনা চার্বাকেণ তস্য দুয়োৎসারিতত্বাৎ।’ -(সর্বদর্শনসংগ্রহ, পৃষ্ঠা ০২)।
অর্থাৎ : আপনি কিভাবে পরমেশ্বরকে নিঃশ্রেয়সপ্রদ বলছেন ? বৃহস্পতির মতানুসারী নাস্তিক শিরোমণি চার্বাক কর্তৃক তিনি দূরোৎসারিত- দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অর্থাৎ তাঁদের মতে ঈশ্বর নামক কোন পদার্থ নাই।
.
আর কৃষ্ণমিশ্র রচিত একাদশ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হচ্ছে-
‘লোকায়েতামেব শাস্ত্রং… …বাচস্পতিনা প্রণীয় চার্বাকায় সমর্পিতম্ ।
তেন চ শিষ্যপ্রশিষ্যদ্বারেনাস্মিল্লোকে বহুলীকৃতং তন্ত্রম্ । -(প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)।
অর্থাৎ : বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন। (মুক্ত তর্জমা)।
.
অন্যদিকে অষ্টম শতকের জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা হিসেবে চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে রচিত আরেক জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় ‘যদুবাচ বাচস্পতিঃ’ অর্থাৎ ‘বাচস্পতি যা বলেন’ উল্লেখ করে বাচস্পতি বা বৃহস্পতির উক্তি হিসেবে তিনটি সূত্র উদ্ধৃত করেন। সেগুলো হচ্ছে-
‘অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি তত্ত্বানি।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী (মাটি), জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব।‘তৎসমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়সংজ্ঞা।’ – (বৃহস্পতি সূত্র)
অর্থাৎ : এর (তত্ত্ব চতুষ্টয়) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
.
লক্ষ্য করার বিষয় যে, সম্ভাব্য অষ্টম শতকের প্রথমদিকে রচিত জয়রাশি ভট্টের ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে রচয়িতার নাম উল্লেখ না করে এই তিনটি সূত্রই উদ্ধৃত হয়েছে বস্তুবাদী নিদর্শন হিসেবে। আবার বৌদ্ধ পণ্ডিত কমলশীলের (অষ্টম শতক) ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় লোকায়তসূত্র হিসেবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সূত্রেরই উদ্ধতি রয়েছে। যদিও সূত্র দুটি কমলশীলের উদ্ধৃতিতে সামান্য পরিবর্তিত আকারে দেখা যায়, যেমন- ‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি তেভ্যশ্চৈতন্যম্’ এবং ‘তৎসমুদায়ে’। এতে অবশ্য ভাবগত অর্থে শ্লোকগুলির মধ্যে খুব একটা পার্থক্য হয় না। যেমন বাংলা তর্জমায় সূত্র দুটির সমন্বিত অর্থ দাঁড়ায়- ‘পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটি তত্ত্বের সমন্বয়ে চৈতন্যের জন্ম ও অভিব্যক্তি হয়।’
.
অন্যদিকে উল্লেখিত প্রথম সূত্রটি (অথাতস্তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ)-কে জয়ন্ত ভট্টের (নবম শতক) ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে চার্বাক দর্শনের আদি সূত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। (ন্যায়মঞ্জরী ১, পৃঃ-৫৯)। অথচ সংকলিত বার্হস্পত্যসূত্রে এই সূত্রটির অন্তর্ভুক্তিই পাওয়া যায় না কোথাও। এসব দেখেশুনে মনে হয় যে চার্বাক গ্রন্থকাররা প্রত্যেকে তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির অনুকরণে এই আদি সূত্রে অন্তর্ভুক্ত তত্ত্বের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, যদিও প্রত্যেকেরই ধারণায় তাঁদের নিজ নিজ ব্যাখ্যাটি প্রকৃত সূত্রকারেরই অনুমোদন-সাপেক্ষ। সপ্তম থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যে বিভিন্ন দার্শনিক গ্রন্থের ভাষ্যকারদের রচনায় এরকম প্রচুর সূত্রের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। এগুলির প্রচারক কখনও চার্বাক, কখনও লোকায়ত, আবার কখনও বা বার্হস্পত্য বিশেষণে বিশেষিত হয়েছে।
.
সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায়ও এরকম কিছু শ্লোকের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। মাধবাচার্যের মতে এগুলি চার্বাক সিদ্ধান্তের প্রবর্তক বৃহস্পতির উক্তি।
‘অর্থ-কামৌ এব পুরুষার্থৌ’- (অর্থাৎ : অর্থ ও কামই পুরুষার্থ)।
‘তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি।’- (অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু- এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।)
‘কিণ্বাদিভ্যো মদশক্তিবৎ চৈতন্যমুপজায়তে।’- (অর্থাৎ : কিণ্ব বা বৃক্ষবিশেষ হতে মদশক্তির ন্যায় চৈতন্য জন্মে।)
‘ত্রয্যা ধূর্ত্তপ্রলাপমাত্রত্বেন’- (অর্থাৎ : বেদত্রয়ী ধূর্তের প্রলাপমাত্র।)
‘অগ্নিহোত্রাদের্জীবিকামাত্রপ্রয়োজনত্বাৎ।’- (অর্থাৎ : অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ কর্মের প্রয়োজন জীবিকামাত্র, অন্য কিছু নয়।)
‘লোক-সিদ্ধো রাজা পরমেশ্বরঃ।’- (অর্থাৎ : লোকপ্রসিদ্ধ রাজাই পরমেশ্বর।)
‘দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ।’- (অর্থাৎ : দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ।)
ইত্যাদি।
.
এসব শ্লোকেরই অনুরূপ কিছু শ্লোক ভারতীয় সাহিত্যের বিভিন্ন পাতায় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে, কোথাও বা চার্বাক দর্শনের সাথে যুক্ত হয়ে, কোথাও অন্যভাবে দেখা যায়। শ্লোকগুলির রচয়িতা প্রকৃতই বৃহস্পতি নামে কোন ব্যক্তি কিনা তা বলা কঠিন। তবে যথার্থ ইতিহাসের পর্যায়ে ফেলা না গেলেও চার্বাক মতবাদের সাথে বৃহস্পতির নামে যোগ বহন করে ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে কয়েকটি উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
.
দেবতাদের গুরুর নাম বৃহস্পতি। কথিত চার্বাক আচার্য বৃহস্পতির প্রকৃত পরিচয় যা-ই হোক না কেন, তিনি যে ক্রমে এই দেবগুরু বৃহস্পতির সঙ্গে একাত্মতা লাভ করেছেন তা ওই উপাখ্যানগুলোর কাহিনী থেকে প্রতীয়মান হয়। ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকে চার্বাক মতের প্রচারক বৃহস্পতি যে এই দেবগুরুর সঙ্গে অভিন্ন এবং বাচস্পতি আখ্যায় অভিহিত, তা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট শ্লোক উদ্ধৃত করে দেখানো হয়েছে। বাচস্পতি শব্দের অর্থ বাক্যের অধিপতি এবং দেবগুরু বৃহস্পতি সাধারণত এই নামের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে বৃহদারণ্যক উপনিষদ স্মর্তব্য-
এষ উ এব বৃহস্পতি। বাগ্ বৈ বৃহতি, তস্যা এষ পতিঃ, তস্মাদ্ উ বৃহস্পতি।। ১/৩/২০।। (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)।
অর্থাৎ : প্রাণের আর-এক নাম বৃহস্পতি। বাক্যকে বলে বৃহতী। যেহেতু তিনি বাক্যের গতি, তাই বৃহস্পতি।
.
প্রচলিত বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যে ধারণা এই চার্বাক মতবাদের মাধ্যমে প্রচারিত, দেবতাদের গুরুর সঙ্গে সে ধারণার মিল বা সংগতি খুঁজে পাওয়া কঠিন বৈকি। তাই হয়তো এ ক্ষেত্রে উভয়ের যোগের সামঞ্জস্য বজায় রাখার চেষ্টা হয়েছে কিছু কল্পনার মাধ্যমে। আর এই কল্পনা বিভ্রান্তি বা মায়ামোহের রূপ নিয়ে বিভিন্ন প্রাচীন উপাখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
.
বিষ্ণুপুরাণে (৩/১৭/১৪-২৬) বলা হয়েছে, অসুরদের মোহগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই মায়ামোহ তাঁদের মধ্যে এই মারাত্মক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। মায়ামোহের ওই উপদেশগল্পে বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে নর্মদা নদীর তীরে কিছু দৈত্য শ্রুতিপ্রতিপাদিত পথে একাগ্র অন্তঃকরণে তপস্যা করছিলো। তাতে ভীত দেবগণ নারায়ণের শরণাপন্ন হন। তারপর নারায়ণ তাঁদেরকে সেমত অবস্থায় দেখে তাঁদের মনোব্যাথা দুর করার জন্য নিজ শরীর হতে মায়ামোহ নামে একজন পুরুষকে উৎপন্ন করে ‘এই ব্যক্তি আপনাদের কার্য সম্পাদন করবে’ বললেন। মায়ামোহ নিজের নাম অনুসারে নিজ প্রবৃত্তি প্রদর্শন করে নিজ মায়ায় দৈত্যদের মোহিত করে সন্মার্গ হতে ভ্রষ্ট করেছিলো। বৃহস্পতির প্রণীত সূত্রানুসারে মায়ামোহ উপদেশ শুনাতে শুনাতে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মিয়ে তপস্যা হতে নিবৃত্ত করেছিলো।
নাস্তিক মতের প্রচার করে মায়ামোহ যে উপদেশ দিয়েছিলো তা অনেক প্রকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সর্বসাধারণ। যেমন যজ্ঞাদি কর্ম ধর্ম নয়, একথা স্বীকার করতে হয়। কেননা সেখানে পশু সকল হত্যা করা হয়। আর অহিংসা হচ্ছে পরম ধর্ম। বেদ হচ্ছে ধূর্ত ব্যক্তিদের প্রলাপ। এরই মোহে পড়ে অসুরেরা বৈদিক জ্ঞানকে উপহাস করতে শিখলেন; অতএব তাঁদের দারুণ অধঃপতন ঘটলো। সেই অবকাশে দেবতারা শক্তি সঞ্চয় করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন এবং সহজেই অসুরদের পরাজিত করলেন।
নাস্তিক মতের প্রচার করে মায়ামোহ যে উপদেশ দিয়েছিলো তা অনেক প্রকার। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সর্বসাধারণ। যেমন যজ্ঞাদি কর্ম ধর্ম নয়, একথা স্বীকার করতে হয়। কেননা সেখানে পশু সকল হত্যা করা হয়। আর অহিংসা হচ্ছে পরম ধর্ম। বেদ হচ্ছে ধূর্ত ব্যক্তিদের প্রলাপ। এরই মোহে পড়ে অসুরেরা বৈদিক জ্ঞানকে উপহাস করতে শিখলেন; অতএব তাঁদের দারুণ অধঃপতন ঘটলো। সেই অবকাশে দেবতারা শক্তি সঞ্চয় করে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান করলেন এবং সহজেই অসুরদের পরাজিত করলেন।
.
এই মায়ামোহ যে মূলত দেবগুরু বৃহস্পতি তা স্পষ্ট হয় সম্ভাব্য বুদ্ধ-পরবর্তী কালে সৃষ্ট মৈত্রায়ণীয় উপনিষদের (৭,৮,৯) অন্তর্ভুক্ত অনুরূপ একটি পৌরাণিক উপাখ্যানের মধ্যে। এই উপাখ্যান অনুযায়ী- দেবগুরু বৃহস্পতি অসুরগুরু শুক্রের ছদ্মবেশ ধারণ করে ইন্দ্রের নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই অসুরদের মধ্যে এই মারাত্মক অবিদ্যা-মূলক মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। সেই অবিদ্যার প্রভাবেই অসুরেরা অধর্মকে ধর্ম এবং ধর্মকে অধর্ম মনে করতে শুরু করে।
.
বেদ বিরোধী এই মতাদর্শ যে আসলে চার্বাক দর্শনেরই অন্তর্ভুক্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যা বৃহস্পতির বচন হিসেবেই বিভিন্ন স্থানে পরিদৃষ্ট হয়। এই উপাখ্যানের মাধ্যমে দেবগুরু বৃহস্পতির কুল রক্ষা করা গেলো বটে, তবে একই সাথে এই চার্বাক মতকে অমঙ্গলের প্রতীক অসুর মত হিসেবেও প্রচার করার প্রয়াসও দেখতে পাই আমরা। এই অসুর বলতে যাঁদেরকেই বোঝাক না কেন, তাঁদের সংস্কৃতি যে বেদবিরোধী ছিলো এ নিয়ে সন্দেহ নেই। ফলে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরা তাঁদেরকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখেই দেখার চেষ্টা করেছিলেন। বৈদিক সংস্কৃতিতে এই অসুর মত যে একান্তই পরিত্যাজ্য সে সম্পর্কে যথোপযুক্ত প্রচারণার লক্ষ্যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন-
দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।। ১৬/৬।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : হে পার্থ, এই জগতে দেবস্বভাব ও অসুরস্বভাব- এই দুই প্রকার মানুষ সৃষ্ট হয়েছে। দেবস্বভাবসম্পন্ন মানুষের কথা বিস্তৃতভাবে বলেছি। এখন অসুরস্বভাববিশিষ্ট মানুষের কথা আমার নিকট শ্রবণ কর।.প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।
ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।। ১৬/৭।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : অসুরস্বভাব ব্যক্তিগণ ধর্মবিষয়ে প্রবৃত্ত এবং অধর্মবিষয় হতে নিবৃত্ত হতে জানে না; তাদের শৌচ নাই, সদাচার নাই এবং সত্যও নাই।.অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্ ।
অপরস্পরসম্ভূতং কিমন্যৎ কামহৈতুকম্ ।। ১৬/৮।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : আসুরভাববিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বলে, এই জগৎ সত্যশূন্য; ইহা ধর্মাধর্মের ব্যবস্থাহীন। ইহার কর্মফলদাতা ঈশ্বর নাই এবং কামবশতঃ স্ত্রী-পুরুষের সংযোগেই ইহা উৎপন্ন; ইহার উৎপত্তির অদৃষ্ট ধর্মাধর্মাদি অন্য কারণ নাই।.এতাং দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবোদ্ধয়ঃ।
প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মাণঃ ক্ষয়ায় জগতোহহিতাঃ।। ১৬/৯।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : এই লোকায়তিক মত আশ্রয়পূর্বক পারলৌকিক-সাধনচ্যুত ক্রূরকর্মা, অনিষ্টকারী ও অল্পবুদ্ধি আসুরপ্রকৃতি ব্যক্তিগণ জগতের বিনাশের জন্য জন্মগ্রহণ করে।
.
উল্লেখ্য, বেদের সারাংশকে উপনিষদ এবং ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’কে উপনিষদের সার বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ হচ্ছে মহাভারতের (আনুমানিক ৪০০খ্রীস্টপূর্ব-৪০০খ্রীস্টাব্দ) ভীষ্মপর্বের এক বিশিষ্ট অংশও। তাই গীতায় এ অসুর-মত বিষয়ক আরো শ্লোক উদ্ধৃত থাকলেও উল্লেখকৃত শ্লোক-ক’টি থেকেই কথিত অসুর মত সম্পর্কে একটা আপাত ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বর্ণিত শ্লোক অনুযায়ী এই মতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার পাশাপাশি তথাকথিত ঈশ্বর প্রদত্ত কর্মফল তথা এতদসংশ্লিষ্ট জন্মান্তরবাদও অসার বলে ঘোষিত হয়েছে। অসুর মতের সৃষ্টিতত্ত্বে এই জগৎ যে স্ত্রী-পুরুষের মিলনজাত ও কামোদ্ভূত এবং এর পেছনে অদৃষ্ট নামের কোন ধর্ম-অধর্ম পাপ-পুণ্য বা স্বর্গ-নরক ও আত্মা এসব অলৌকিক অবাস্তব কোন কারণ নেই তাও এই শ্লোক থেকে ধারণা করতে পারি আমরা। এবং এ শ্লোক থেকে আরেকটি যে কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য পেয়ে যাই তা হলো, গীতায় এই অসুর মতকে লোকায়তিক মত হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি। ফলে চার্বাক মতের আদি উৎস খুঁজতে গিয়ে বৃহস্পতির সম্পর্কসূত্রে শেষপর্যন্ত পৌঁছে যাই লোকায়ত মত নামের এক প্রাচীন ধারণার কাছাকাছি। তবে কি চার্বাক দর্শনের আদি রূপটি লুকিয়ে আছে প্রাচীন লোকায়ত মতের গভীরে কোথাও ? নিশ্চয়ই তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। কিন্তু সে পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি-আকর্ষণ করা যেতে পারে।
.
বামাচার :
লোকায়ত-মত পর্যালোচনার আগে চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে জৈন দর্শনকার গুণরত্নের ভাষ্যগ্রন্থ ‘তর্করহস্যদীপিকা’য় বর্ণিত উদ্ধৃতাংশটি প্রণিধানযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে-
।। অথ লোকায়তমতম্।।
প্রথমম্ নাস্তিক স্বরূপমুচ্যতে। কাপালিকাঃ ভস্মোদ্ধুলনপরাঃ যোগিনঃ ব্রাহ্মণাদ্যস্ত্যজাতাশ্চ কেচন নাস্তিকা ভবন্তি। তে চ জীবপুণ্যপাপাদিকং ন মন্যন্তে। চতুর্ভূতাত্মকং জগদাচক্ষতে। কেচিত্তু চার্ব্বাকৈকদেশীয়া আকাশং পঞ্চমং ভূতমভিমন্যমানাঃ পঞ্চভূতাত্মকং জগদিতি নিগদন্তি। তন্মতে ভূতেভ্যো মদশক্তিবচ্চৈতন্যমুতূদ্যতে। জলবুদ্বুদবজ্জীবাঃ। চৈতন্যবিশিষ্টঃ কায়ঃ পুরুষঃ ইতি। তে চ মদ্যমাংসে ভুঞ্জতে মাত্রাদ্যগম্যাগমনমপিকুর্বতে। বর্ষে বর্ষে কস্মিন্নপি দিবসে সর্বে সংভূয় যথানামনির্গমং স্ত্রীভিরভিরমন্তে। ধর্মং কামাদপরং ন মন্যতে। তন্নামানি চার্ব্বাকাঃ লোকায়তাঃ ইত্যাদীনি। গলচর্ব অদনে। চর্ব্বয়ন্তি ভক্ষয়ন্তি তত্ত্বতঃ ন মন্যন্তে পুণ্যপাপাদিকং পরোক্ষং বস্তুজাতমিতি চার্ব্বাকাঃ। …লোকাঃ নির্ব্বিচারাঃ সামান্যাঃ লোকাস্তদ্বদাচরন্তি স্মেতি লোকায়তা লোকায়তিকা ইত্যপি। বৃহস্পতিপ্রণীতমতত্বেন বার্হস্পত্যাশ্চ ইতি।
অর্থাৎ :
অনন্তর লোকায়ত। প্রথমে নাস্তিকদের কথা। কাপালিক :- ভস্ম আচ্ছাদিত যোগীগণ এবং অন্ত্যজ ব্রাহ্মণাদি কেহ কেহ নাস্তিক। তাহারা জীবগণের পুণ্য পাপ প্রভৃতির বিচার করে না। তাহারা জগতকে চতুর্ভূতাত্মক বলিয়া মনে করে। চার্বাক প্রভৃতি মতাবলম্বীদিগের কেহ কেহ আকাশকে পঞ্চম ভূত রূপে ধরিয়া জগতকে পঞ্চভূতাত্মক বলিয়া থাকে। তাহাদের মতে চৈতন্য মদশক্তির ন্যায় আবির্ভূত হয়। জীবগণ জলবুদবুদ্ তুল্য। পুরুষ চৈতন্যবিশিষ্ট শরীরমাত্র। তাহারা মদ্যপান ও মাংস ভোজন করিয়া থাকে এবং মাতা প্রভৃতি অগম্য নারী প্রভৃতিতেও গমন করিয়া থাকে। প্রতি বৎসর কোনো একদিনে সকলে একত্র হইয়া যথাভিপ্রেত স্ত্রীগণের সহিত রমন করিয়া থাকে। কাম ব্যতীত ধর্ম নাই। এই জন্যই চার্বাকদিগকে লোকায়ত বলা হইয়া থাকে। পরোক্ষ বস্তুসমূহ হইতে জাত গলাধঃকরণ ও চর্বণ হেতুই চার্বাক বলা হইয়া থাকে। …নির্বিচারে সাধারণ লোকের ন্যায় আচরণ করে বলিয়াই তাহাদিগকে লোকায়ত বা লোকায়তিকও বলা হইয়া থাকে। তাহাদের মত বৃহস্পতি প্রণীত বলিয়াই তাহাদের বার্হস্পত্যও বলে।
.
উদ্ধৃতিটিতে প্রাচীন তান্ত্রিক মত বামাচারের সাথে চার্বাক মতকে মিশিয়ে ফেলে তথ্য বিচ্যুতি ঘটানোর প্রবণতা অনুমান করা অস্বাভাবিক হবে না। তবে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীন কৃষিভিত্তিক ধ্যানধারণায় প্রকৃতিস্বরূপা নারীযোনির আদিম জাদুবিশ্বাস সংশ্লিষ্ট প্রাচীন তান্ত্রিক আচারের সাথে চার্বাকী লোকায়ত মতাদর্শকে এক করে দেখানোর অন্যতম কারণ হয়তো উভয়ই বেদবহির্ভূত লোকায়তিক চিন্তা-চেতনা থেকে উদ্ভূত বলেই। কিন্তু এই তন্ত্র-সাধনার সাথে চার্বাক মতের সরাসরি পার্থক্যটাই হলো তান্ত্রিক আচার সুস্পষ্টভাবেই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যনিষ্ট কিন্তু দেহাচারী স্বতন্ত্র সাধন-পদ্ধতি, অন্যদিকে চার্বাক মতাদর্শ সম্পূর্ণই দেহাত্মবাদী বস্তুতান্ত্রিক দর্শন। যার সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনই সম্পর্ক নেই। তাই আধুনিক রুচি ও নীতিবোধের কাছে পঞ্চমকারপূর্ণ অর্থহীন তান্ত্রিক সাধনার বীভৎসতায় এর আদি-তাৎপর্য না খুঁজে কেবল লোকায়তিক আচারের দোহাই দিয়ে নির্দিষ্ট দর্শনদৃষ্টির সাথে মিশিয়ে ফেলাটা যথাযথ উপস্থাপন নয় বলেই মনে হয়। বিষয়টির কিঞ্চিৎ অনুধাবনের নিমিত্তে প্রাচীন তন্ত্র-সাধনার গূঢ়তত্ত্ব উদ্ঘাটন না-হলেও রহস্য-চিহ্নায়ক তন্ত্র-নির্দেশনার কিছু উদ্ধৃতি টানা যেতে পারে।
.
এক্ষেত্রে প্রাচীন ‘কুলার্ণব-তন্ত্র’-এ (সূত্র: লোকায়ত দর্শন / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) বলা হচ্ছে-
এক্ষেত্রে প্রাচীন ‘কুলার্ণব-তন্ত্র’-এ (সূত্র: লোকায়ত দর্শন / দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়) বলা হচ্ছে-
মদ্যং মাংসঞ্চ মৎস্যঞ্চ মুদ্রামৈথুনমেবচ।
মকারপঞ্চকং দেবি দেবতাপ্রীতিকারকম্ ।। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন- এই পাঁচটি বস্তুর নামের আদিতে ‘ম’ অক্ষরটি থাকায় ইহাদের সংক্ষিপ্ত নাম মকার। এই পঞ্চমকার দেবতাদিগের জন্যও প্রীতিকারক।
.
মকারপঞ্চকং দেবি দেবানামপি দুর্লভং।
মদ্যৈর্মাংসৈন্তথা মৎসৈর্মুদ্রাভির্মৈথুনৈরপি।।
স্ত্রীভিঃ সার্দ্ধং মহাসাধুরর্চ্চয়েৎ জগদম্বিকা।
অন্যথা চ মহানিন্দা গীয়তে খণ্ডিতৈঃ সুরৈঃ।। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : পঞ্চমকার তন্ত্রের প্রাণস্বরূপ। পঞ্চমকার ব্যতীত তান্ত্রিকের কোনো কার্যেই অধিকার নাই। পঞ্চমকার দেবতাদিগেরও দুর্লভ ; মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন এই পঞ্চমকার দ্বারা জগদম্বিকাকে পূজা করিতে হয়।
.
পঞ্চমেন বিনা দেবি চণ্ডিমন্ত্রং কথং জপেৎ। (কুলার্ণব-তন্ত্র)।
অর্থাৎ : পঞ্চমকার ব্যতীত চণ্ডিমন্ত্র কেমন করিয়া জপ হইতে পারে ?
.
যদিও তান্ত্রিক রিচ্যুয়াল বা আধ্যাত্মিক তন্ত্রবিশ্বাস মতে বলা হয়ে থাকে, পঞ্চমকারের তাৎপর্য অতি গূঢ়, সাধারণের পক্ষে তা বোঝা সম্ভব নয়, তবু একই প্রাকৃত উৎস থেকে উদ্ভূত এই আদিম তান্ত্রিক বিশ্বাস আর বার্হস্পত্য মতাদর্শের মধ্যে যে মাত্রাগত পার্থক্য তা বোধ করি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
তন্ত্রসাধনায় যত গূঢ় রহস্যই থাকুক না কেন, এটা যে কামপ্রধান আচারই তা বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। যেমন-
কামেন মায়য়া চৈব পুটিতং কামবীজকম্ ।
তদা কামেশ্বরো মন্ত্রঃ সর্ব্বকামফলপ্রদঃ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৩৫)
অর্থাৎ : কামবীজ (কীং) এবং মায়াবীজ (হ্রীং) দ্বারা কামবীজকে পুটিত করিলে, তাহা সর্ব্বকাম ফলপ্রদ কামেশ্বর মন্ত্র হয়। (কীং হ্রীং কীং হ্রীং কীং)।
.
শ্রীপার্ব্বত্যুবাচ-
মন্ত্রার্থং মন্ত্রচৈতন্যং যোনিমুদ্রাং নবেত্তি যঃ।
শতকোটিজপেনাপি তস্য বিদ্যা ন সিধ্যতি।। (সরস্বতীতন্ত্র : ১/১)
মহাদেব মহাদেব ইতি যৎ পূর্ব্বসূচিতম্ ।
এতত্তত্ত্বং মহাদেব কৃপয়া বদ শঙ্কর।। (সরস্বতীতন্ত্র : ১/২)।
অর্থাৎ :
পার্ব্বতী বলিলেন- হে মহাদেব ! যে জন মন্ত্রার্থ মন্ত্রচৈতন্য এবং যোনিমূদ্রা জানে না, শতকোটি যপের দ্বারাও তাঁহার বিদ্যা (ইষ্টমন্ত্র) সিদ্ধ হয় না। আপনি পূর্বে এইরূপ যে সূচনা করিয়াছিলেন, হে শঙ্কর ! এই তত্ত্ব কৃপাপূর্ব্বক বলুন। ১-২।
.
তবে চার্বাকরা বেদকে প্রামাণিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তন্ত্রসাধকদের ধ্যান-ধারণায় ব্রাহ্মণ্যবাদী বিশ্বাসের ছাপ পুরোদমেই বিদ্যমান দেখা যায়। যেমন-
অস্যাঃ স্মরণমাত্রেণ জীবন্মুক্তশ্চ সাধকঃ।
একোচ্চারণমাত্রেণ অশ্বমেধাযুতং ফলম্ ।। (কুব্জিকাতন্ত্রম্ : ২/৪৯)
অর্থাৎ : কালিকামন্ত্র স্মরণমাত্রই সাধক জীবন্মুক্তি লাভ করে এবং একবার মাত্র উচ্চারিত হইলে অযুত অশ্বমেধযজ্ঞ সম্পাদনের ফল লাভ হয়।
.
এই যাগযজ্ঞ বা বৈদিক বিশ্বাসের সাথে অবাধ কামাচারের মণি-কাঞ্চণ যোগের বৈধ সংকলকের ভূমিকায় তান্ত্রিকদের কালিকামন্ত্রের কার্যকর শক্তি যে কী বিপুল, তা তন্ত্রসাধনায় কুমারীতন্ত্রের ষষ্ঠ পটলের ‘কুলাচার-কথন’ উপাখ্যানের মাধ্যমে অনুধাবন করা যায়-
শ্রীদেব্যুবাচ-
দেবদেব মহাদেব জগৎপ্রলয়কারকঃ।।
কুলাচারে তু মদ্যাদ্যৈঃ কথং সিদ্ধির্ভবেৎ প্রভো।
অর্ধমকারণং হ্যেতৎ সংশয়ং ছিন্দি মে প্রভো।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১)
শ্রীভৈরব উবাচ-
সাধু পৃষ্ঠো হি দেবেশি কথয়ামি শৃণুম্ব মে।
পুরা দারুবনে রম্যে মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মদ্যং পিবন্তি নিত্যশঃ।
তদ্দষ্টানুচিতং কর্ম্ম বির্ষ্ণুমাং সমুপস্থিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৩)
দেবদেব মহাদেব সৃষ্টিস্থিতিলয়াত্মকঃ।
প্রভো দারুবনে পাপা মদ্যপানরতাস্তথা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৪)
পরস্ত্রিয়ং ধর্ষয়ন্তি মুনয়ো রাগমোহিতাঃ।
দিগম্বরাশ্চ মত্তাশ্চ কিং গতিশ্চ ভবিষ্যতি।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৫)
ইতি বিষ্ণুবচঃ শ্রুত্বা তমবাদমহং প্রিয়ে।
কালিকায়া মহাবিদ্যা অনিরুদ্ধঃ সরস্বতী।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৬)
বিদ্যারাজ্ঞীতি সা প্রোক্তা এতন্মন্ত্রপ্রজপকাঃ।
পরং মুক্তা ভবিষ্যন্তি তদ্গায়ত্রীং জপন্তি চ।। (কুমারীতন্ত্র¿ : ৬/৭)
কালিকায়াঃ প্রভাবেন সর্ব্বে দেবা বিমোহিতাঃ।
ভ্রুণহত্যা-মাতৃবধাৎ পরশুরামো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৮)
দত্তাত্রেয়শ্চ ত্রিপুরঃ সুরাপানাদ্বিমোচিতঃ।
ব্রহ্মহত্যা-শিরচ্ছেদাদহং রুদ্রোহপি মোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/৯)
গৌতমস্ত্রীধর্ষণাচ্চ দেবেন্দ্রোহপি বিমোচিতঃ।
কন্যায়া ধর্ষণাদ্বাপি ব্রহ্মাবাচং বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/১০)
চাণ্ডালীগমনাদ্বাপি বশিষ্ঠোহপি বিমোচিতঃ।
রাবণস্য বধাচ্চাপি রামচন্দ্রো বিমোচিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র¿ : ৬/১১)
.
অর্থাৎ :
দেবী কহিলেন- হে দেবদেব মহাদেব। আপনি জগৎ প্রলয়কারক। হে প্রভু ! কুলাচারবিধি-নির্দ্দিষ্ট মদ্যাদি পঞ্চমকার অধর্ম্ম অর্থাৎ পাপ সৃষ্টির কারণ। সুতরাং তৎসমুদয় কিরূপে মন্ত্রসিদ্ধি-প্রদায়ক হইতে পারে প্রকাশ করিয়া আপনি আমার সন্দেহ দূর করুন। ১।
ভৈরব কহিলেন- দেবেশি ! তুমি অতি উত্তম প্রশ্ন করিয়াছ। আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতেছি, শ্রবণ কর। পুরাকালে মুনিগণ কামমোহিত চিত্তে রম্য দারুবনে নিয়ত মদ্যপান এবং পরস্ত্রী ধর্ষণকার্য্যে ব্যাপৃত ছিল। মুনিগণের এই সকল অন্যায় কার্য্য দর্শন করিয়া, বিষ্ণু আমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হন। ২-৩।
তখন বিষ্ণু আমাকে বলিতে লাগিলেন, হে দেবদেব মহাদেব ! আপনি সৃষ্টি স্থিতি এবং লয়ের কর্ত্তা। হে প্রভো ! দারুবনে কামমোহিত মদ্যপায়ী পাপাত্মা দিগম্বর ও পানমত্ত মুনিগণ পরস্ত্রী ধর্ষণ করিতেছে। ইহাদের কি গতি হইবে। ৪-৫।
হে প্রিয়ে ! তৎকালে বিষ্ণুর এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, কালিকা-নামক যে মহামন্ত্র এবং অনিরুদ্ধ যাহার সরস্বতী, যাহা মন্ত্রসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ- এই সকল মুনিগণ সেই মহামন্ত্র জপ করে। সেই কালিকা গায়ত্রী জপ করিয়া ইহারা সকলেই শ্রেষ্ঠ মুক্তি লাভ করিবে। ৬-৭।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দেবতারাও বিমোহিত হইয়া থাকেন। কালিকাদেবীর প্রভাবে পরশুরাম ভ্রুণহত্যা ও মাতৃবধ পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। ৮।
কালিকাদেবীর প্রভাবে দত্তাত্রেয় এবং ত্রিপুর সুরাপানের পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন। আমি রুদ্রও স্বয়ং ব্রহ্মহত্যা বা ব্রহ্মার শিরচ্ছেদরূপ পাতক হইতে কালিকাদেবীর প্রভাবেই মুক্তিলাভ করিয়াছিলাম। ৯।
সুরপতি ইন্দ্রও কালিকাদেবীর প্রভাবে গুরুপত্নী গৌতমীতে ধর্ষণজনিত পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছিলেন এবং ব্রহ্মাও কন্যাধর্ষণহেতু পাপ হইতে, বশিষ্ঠ চাণ্ডালীগমন পাপ হইতে এবং রামচন্দ্র রাবণবধজনিত পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়াছিলেন। ১০-১১।
.
এবং কালিকামন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়ে কিভাবে কুলাচার পালন করতে হবে তারও বর্ণনা রয়েছে কুমারীতন্ত্রে-
ব্রাহ্মণস্তাম্রপাত্রে তু মধুমদ্যং প্রকল্পয়েৎ।
নটী কাপালিকা বেশ্যা রজকী-নাপিতাঙ্গনা।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২১)
ব্রাহ্মণী শূদ্রকন্যা চ তথা গোপালকন্যকা।
মালাকারস্য কন্যা চ নবকন্যা প্রকীর্ত্তিতাঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২২)
এতাসু কাঞ্চিদানীয় ততস্তু যোনিমণ্ডলে।
পূজয়িত্বা মহাদেবীং ততো মৈথুনমাচরেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৬/২৩).অর্থাৎ :
ব্রাহ্মণ তাম্রপাত্রস্থিত মধুকেই মদ্যরূপে কল্পনা করিবে।
নটী, কাপালিকা, বেশ্যা, রজকী, নাপিতাঙ্গনা, ব্রাহ্মণী, শূদ্রকন্যা, গোপকন্যা এবং মালাকার কন্যা- ইহারা নবকন্যা বা গ্রহণীয়া কুলযুবতী বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। ২১-২২।
এই সকল কুলযুবতী মধ্যে অন্যতমা কুলযুবতী গ্রহণ করিয়া তাহার শক্তিমণ্ডলে কালিকা দেবীর পূজা করিবে। তৎপর কুলযুবতীর মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। ২৩।
.
বামাচারী তান্ত্রিক সাধনায় দেহজ কামের সাথে আধ্যাত্মিকতা মেশানো এই প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই শুদ্ধ বৈদিক আচার বা সামাজিক রুচি ও সদাচারের পরিপন্থী ছিলো। তাই হয়তো ব্রহ্মবাদীরা একে কদাচারের তুল্য হিসেবে বিবেচনা করতে কার্পণ্য করেননি। অন্যদিকে স্রেফ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত চার্বাক মতাদর্শকেও এই ব্রহ্মবাদীরা নিন্দনীয় দেহজ কামনা-বাসনার দর্শন হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে গেছে সবসময়ই। ফলে এ দুটোকে এক করে দেখানোর প্রবণতা বোধ করি অস্বাভাবিক নয়। তার উপর এই বামাচারী তান্ত্রিক সাধনার নিমিত্তে যখন অতি সম্মান ও জ্ঞানীর আসনে বৃহষ্পতির নাম উদ্ধৃত হয়, তখন আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। কেননা বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এই তান্ত্রিক সাধনায় উক্ত হয়েছে, তা রীতিমতো লোমহর্ষক-
বৃহস্পতিসমো যন্তু ভবিতুং কাময়েন্নরঃ।
সর্ব্বো বৃহস্পতিসমো ভবেচ্চৈব ন সংশয়ঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/১৯)
সুন্দরীং যৌবনোন্মত্তাং নারীমানীয় নিত্যশঃ।
অষ্টোত্তরশতং জপ্তা কুলমামন্ত্র্য মন্ত্রবিৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২০)
মৈথুনং যঃ করোত্যেব স তু সর্ব্বং ফলং লভেৎ।
তন্মুখে চ মুখং চ দত্ত্বা সহস্রং মানসং জপেৎ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২১)
স ভবেৎ সর্ব্বসিদ্ধিদো নাত্র কার্য্যবিচারণা।
সর্ব্বেষাং সাধনাং মধ্যে শ্রেষ্ঠঃ স্যাৎ কুলসাধনম্ ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২২)
তস্মাৎ সর্ব্বপ্রযতেœন সাধয়েৎ সুসমাহিতঃ।। (কুমারীতন্ত্র : ৫/২৩)।.অর্থাৎ :
যে ব্যক্তি বৃহস্পতি তুল্য জ্ঞানবান হইতে ইচ্ছা করে সে ব্যক্তি এই সাধনাপ্রভাবে বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানবান হইয়া থাকে, এতদ্বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। ১৯।
প্রত্যহ সুন্দরী যৌবনোন্মতা কুলযুবতী আনয়নপূর্ব্বক প্রথমে কুলাগার অভিমন্ত্রিত করিবে। তৎপর মন্ত্রজ্ঞ সাধাক অষ্টোত্তর শতবার কালিকামন্ত্র জপ করিয়া ঐ কুলস্ত্রীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হইবে। এইরূপে কুলস্ত্রীর সহিত রতিক্রিয়া সম্পন্ন করিলে সাধক পূর্ণফল লাভ করিয়া থাকে।
রতিকালে কুলযুবতীর মুখে মুখ প্রদান করিয়া এক-সহস্র সংখ্যক মানস জপ করিবে। ২০-২১।
যে ব্যক্তি এইরূপে কার্য্য করে সে সর্ব্বসিদ্ধিদাতা হইয়া থাকে। এতদ্বিষয়ে বিচার বিতর্ক অনাবশ্যক। সর্ব্বপ্রকার সাধন পদ্ধতির মধ্যে কুলাচারমতে সাধনই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। সুতরাং সর্ব্বপ্রযত্নে অত্যন্ত একাগ্রতার সহিত কুলাচার পদ্ধতিতে সাধন করিবে। ২২-২৩।
.
বৃহস্পতির তুল্য জ্ঞানী হওয়ার এই দেহাচারী তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতির নমুনা থেকে প্রতীয়মান হয়, পরবর্তীকালের ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক দর্শনের আদিতে বৃহস্পতির নামেই এই দর্শনটিকে হয়তো নিচু ভোগবাদী মতাদর্শ হিসেবে প্রচারের প্রবণতা কার্যকর ছিলো। এবং তা হয়তো সফলও হয়েছিলো।
.
উল্লেখ্য, সহজ কথায় তান্ত্রিক মতের মূল চেতনা হলো- ‘যা আছে ব্রহ্মাণ্ডে, তাই আছে দেহভাণ্ডে।’ তান্ত্রিক সাধনার এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুরণন আমরা নির্ব্বাণতন্ত্রে দেখতে পাই এভাবে-
মহাব্রহ্মাণ্ডকে যদ্ যদ্ প্রকারং পরমেশ্বরি।
তত্তৎ সর্ব্বং হি দেবেশি বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ডমধ্যতঃ।। (নির্ব্বাণতন্ত্র : ১০/১৯)
তদ্রূপঞ্চ দেহমধ্যে ভুবনানি চতুর্দ্দশ।
সৃষ্টিপ্রকারব্রহ্মাণ্ডে ভেদো নাস্তি সুনিশ্চিতম্ ।। (নির্ব্বাণতন্ত্র : ১০/২০)।
অর্থাৎ :
হে দেবাধীশ্বরি ! পরমেশ্বরি ! মহাব্রহ্মাণ্ড মধ্যে যাহা যে প্রকারে রহিয়াছে বৃহদ্ ব্রহ্মাণ্ড মধ্যেও সেই সকল সেইভাবে রহিয়াছে। ১৯।
সেইরূপ দেহমধ্যে চতুর্দ্দশ ভূবন বর্ত্তমান। সৃষ্টিপ্রকার ব্রহ্মাণ্ডে কোন ভেদ নাই ইহা সুনিশ্চয়রূপে জানিবে। ২০।
.
ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিরূপ সংস্করণ এই দেহভাণ্ডকে উপলক্ষ করে সাধনমার্গের মাধ্যমেই ব্রহ্মাণ্ডের যে সাধনা বিস্তার তান্ত্রিক বিশ্বাস-সম্মত, এর সাথে ইন্দ্রিয়াতীত কোন সত্তায় অবিশ্বাসী ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাক মতের বিরাট দার্শনিক প্রভেদ বর্তমান। তবু হয়তো তাদের মধ্যকার অন্তর্গত সাদৃশ্য কেবল এখানেই যে, দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় উভয়ের লক্ষ্যই দেহপ্রত্যক্ষতা। ভাববাদী বা ব্রহ্মবাদীদের দৃষ্টিতে একটি অনাচারী, অন্যটি বেদবিদ্বেষী। ফলে প্রতিপক্ষ কর্তৃক বিরুদ্ধতার সমান্তরাল অবস্থানে উভয় মত হয়তো তাঁদের কাছে একই রেখায় মিশে গেছে একসময়। আর তাই প্রাচীন জড়বাদী লোকায়ত দর্শনের প্রতি অন্যান্য মতাবলম্বীদের দিক থেকে গুণরত্নের উপরিউক্ত বক্তব্যটি হয়তো এই সাধারণ প্রবণতারই লক্ষণ। চার্বাক মতের আদিরূপ সন্ধানে এই লক্ষণ নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে রাখা আবশ্যক যে, জৈন দার্শনিক গুণরত্ন চার্বাক-বৃহস্পতি-লোকায়তের সাথে তান্ত্রিক সাধন-পদ্ধতিকে মিশিয়ে দিলেও আধুনিককালের অতি-প্রসিদ্ধ বিদ্বান-গবেষক মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কিন্তু এই লোকায়তের সাথে বৌদ্ধ-তান্ত্রিকদের একাত্ম করে উত্তরকালের সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধ-সহজযান হিসেবে উল্লেখ করে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল বলে চিহ্নিত করেছেন। তিনি তাঁর ‘বৌদ্ধধর্ম’ গ্রন্থে বলেছেন যে, নামান্তরের আড়ালে লোকায়তিক সম্প্রদায় আজো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি সহজিয়া-সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তাহলে প্রশ্ন, সহজিয়া বলতে ঠিক কী বোঝায়? কোত্থেকেই বা এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হলো? হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলছেন, এই সহজিয়া সম্প্রদায় বা সহজযান আসলে হলো বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের ফল-
‘যে পঞ্চকামোপভোগ নিবারণের জন্য বুদ্ধদেব প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলেন, যে চরিত্র-বিশুদ্ধি বৌদ্ধধর্মের প্রাণ, যে চরিত্রবিশুদ্ধির জন্য হীনযান হইতেও মহাযানের মহত্ত্ব, যে চরিত্র বিশুদ্ধির জন্য আর্যদেব ‘চরিত্র বিশুদ্ধি প্রকরণ’ নামে গ্রন্থই রচনা করিয়া গিয়াছেন, সহজযান সেই চরিত্রবিশুদ্ধি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া দিল। বৌদ্ধধর্ম সহজ করিতে গিয়া, সহজযানীরা যে মত প্রচার করিলেন তাহাতে ব্যভিচারের স্রোত ভয়ানক বাড়িয়া উঠিল। ক্রমে বৌদ্ধধর্ম নেড়ানেড়ীর দলে গিয়া দাঁড়াইল। সহজযানীরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ আলো-আঁধারী ভাষা। কানে শুনিবামাত্র একরকম অর্থ বোধ হয়, কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলে তাহার গূঢ় অর্থ অতি ভয়ানক। তাঁহারা দেহতত্ত্বের গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন।… যে বোধিচিত্ত মহাযানমতে নির্বাণ পাইবার আশায় ক্রমেই আপনার উন্নতি করিতেছিলেন, দেহতত্ত্বের মধ্যে আসিয়া তাহার যে কী দশা হইল তাহা আর লিখিয়া জানাইব না। জানাইতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৩)
‘যে পঞ্চকামোপভোগ নিবারণের জন্য বুদ্ধদেব প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলেন, যে চরিত্র-বিশুদ্ধি বৌদ্ধধর্মের প্রাণ, যে চরিত্রবিশুদ্ধির জন্য হীনযান হইতেও মহাযানের মহত্ত্ব, যে চরিত্র বিশুদ্ধির জন্য আর্যদেব ‘চরিত্র বিশুদ্ধি প্রকরণ’ নামে গ্রন্থই রচনা করিয়া গিয়াছেন, সহজযান সেই চরিত্রবিশুদ্ধি একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া দিল। বৌদ্ধধর্ম সহজ করিতে গিয়া, সহজযানীরা যে মত প্রচার করিলেন তাহাতে ব্যভিচারের স্রোত ভয়ানক বাড়িয়া উঠিল। ক্রমে বৌদ্ধধর্ম নেড়ানেড়ীর দলে গিয়া দাঁড়াইল। সহজযানীরা সন্ধ্যাভাষায় গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন। সন্ধ্যাভাষার অর্থ আলো-আঁধারী ভাষা। কানে শুনিবামাত্র একরকম অর্থ বোধ হয়, কিন্তু একটু ভাবিয়া দেখিলে তাহার গূঢ় অর্থ অতি ভয়ানক। তাঁহারা দেহতত্ত্বের গান লিখিতে আরম্ভ করিলেন।… যে বোধিচিত্ত মহাযানমতে নির্বাণ পাইবার আশায় ক্রমেই আপনার উন্নতি করিতেছিলেন, দেহতত্ত্বের মধ্যে আসিয়া তাহার যে কী দশা হইল তাহা আর লিখিয়া জানাইব না। জানাইতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৩)
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বৌদ্ধধর্মের এই ভয়াবহ অধঃপতনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরো বলছেন-
‘বৌদ্ধধর্মে অনেকদিন হইতেই ঘুণ ধরিয়াছিল। বুদ্ধদেব নিজে যেদিন স্ত্রীলোকদিগকে দীক্ষা দিয়া ভিক্ষুণী করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন- সেইদিন হইতেই তাঁহাকে সঙ্ঘের বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য অনেক কঠোর নিয়ম করিতে হইয়াছিল। তিনি ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের এক বিহারে থাকিতে দিতেন না। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পাঁচ ছয় শত বৎসর পর হইতে ভিক্ষুরা ক্রমে বিবাহ করিতে লাগিল- ক্রমে একদল গৃহস্থ ভিক্ষু হইল। এইখান হইতেই ঘুণ ধরা আরম্ভ হইল।… ভিক্ষুর ছেলে- সে একেবারেই ভিক্ষু হইত।… আমাদের দেশে যেমন ‘জাত বৈষ্ণব’ বলিয়া একটা জাতি হইয়াছে- সেকালেও তেমনি ‘জাত ভিক্ষু’ বলিয়া একটা জাতির মত হইয়াছিল। উহাদের যত দলপুষ্টি হইতে লাগিল, আসল ভিক্ষুদের অবস্থা তত হীন হইতে লাগিল। গৃহস্থ ভিক্ষুরা কারিগরি করিয়া জীবন নির্বাহ করিত- ভিক্ষাও করিত- কেন বা রাজমজুর হইত, কেন বা স্যাকরা হইত, কেন বা ছুতার হইত- অথচ ভিক্ষাও করিত, ধর্মও করিত, পুজাপাঠও করিত। বৌদ্ধধর্মের পৌরহিত্যটা ক্রমে নামিয়া আসিয়া কারিগরদের হাতে পড়িল।… লেখাপড়া, বিদ্যাবুদ্ধির নামগন্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে লোপ পাইল।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৯)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহামহোপাধ্যয়ের এই অনুমান যদি নির্ভুল হয় তাহলে এ-থেকে ঠিক কী সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব? ওই তথাকথিত অধঃপতনের স্বরূপটিকে বিশ্লেষণ করে দেবীপ্রসাদ বলছেন-
‘ওই ‘অধঃপতিত’ বৌদ্ধধর্মের রূপটিকে বিশ্লেষণ করে কি তার মধ্যে শুধুমাত্র স্থূলবুদ্ধি, নির্বুদ্ধি এবং নিরক্ষরতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে? না, এমন কিছু কিছু নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যার সঙ্গে ইতিপূর্বেই আমাদের পরিচয় ঘটেছে?
যদি প্রথম সম্ভাবনাটি ঠিক হয় তাহলে মানতে হবে, প্রাকৃতজনের সংস্পর্শে এসে বৌদ্ধধর্মের মহত্তর ও বৃহত্তর আদর্শগুলির স্থূল-ব্যাখ্যা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ঠিক হয়- যদি দেখা যায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং জাত-আলাদা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কতকগুলি আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান এই তথাকথিত অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের প্রাণবস্তু হয়ে দাঁড়ালো- তাহলে স্বীকার করতে হবে, সমাজের নিচের মহলের মানুষদের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়া সত্ত্বেও তাদের চিন্তাচেতনায় এই বৌদ্ধধর্ম কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অর্থাৎ, সমাজের নিচের মহলের ওই মানুষদের বিশ্বাসাদির উপর যদিও কৃত্রিমভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রলেপ এসে পড়লো তবুও তারা আসলে তাদের আদিম বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই মেতে রইলো। এই সম্ভাবনা অনুসারে সহজিয়া-সম্প্রদায়কে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে মনে না করে কৃত্রিম বৌদ্ধপ্রভাবের পরিচায়ক মনে করাই সঙ্গত হবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪৬০)
বস্তুত এটাই যৌক্তিক যে, সহজিয়া সম্প্রদায়ের উপর বৌদ্ধতত্ত্বের ওই প্রলেপটাই কৃত্রিম এবং অর্বাচীন। তাই একে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের পরিচায়ক না বলে বরং আদিম জাদুবিশ্বাসের কৃত্রিম বৌদ্ধসংস্করণ মনে করাই ন্যায়সঙ্গত। এবং এই প্রভেদটা এইজন্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, দেবীপ্রসাদের মতে, কেননা, বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করলে এ-সম্প্রদায়ের মূল কথাগুলিকে বোঝবার সময় বৌদ্ধধর্মের মৌলিক তত্ত্বের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেখতে হবে একদা-মহৎ কতকগুলি ধ্যানধারণা কীভাবে অশিক্ষিত ও মূর্খ মানুষদের চেতনায় স্থূল ও বিকৃত অর্থে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ-পরিভাষায় কৃত্রিমভাবে সজ্জিত এক আদিম বিশ্বাসের পরিচায়ক বলে গ্রহণ করলে এই সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ওই বৌদ্ধ-পরিভাষাগুলিই অপ্রাসঙ্গিক বলে স্বীকৃত হবে এবং সে-ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের স্বরূপ উপলব্ধির উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ করবার প্রয়োজন হবে।
এখানে স্মর্তব্য যে, আমরা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট অন্য অধ্যায়ে সিন্ধু-ধর্ম প্রসঙ্গে কৃষিকেন্দ্রিক উর্বরতামূলক আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানে শক্তি-উপাসনার যে সুপ্রাচীন উপাদানগুলির পরিচয় পেয়েছি তার সাথে সহজিয়া-সম্প্রদায়ের মূল তত্ত্বগুলির বিচার করলেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, সমাজ-বিকাশের পিছনদিককার পর্যায়ে আটকে পড়ে থাকা মানুষদের মধ্যেই সেই বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের স্পষ্টতর স্বাক্ষর রয়েছে। তাছাড়া শাস্ত্রী মহাশয়ের রচনাতেও এমন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন (বৌদ্ধধর্ম ১০৬), বৌদ্ধধর্ম কোথায় গেল? উত্তরে তিনিই বলছেন, প্রধানত মুসলমান আক্রমণের দরুনই বাংলা দেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। উড়িষ্যার জঙ্গলে, চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে আজো ওই (অধঃপতিত) বৌদ্ধধর্মের জীবন্ত নিদর্শন পাওয়া যায়।
এই অঞ্চলগুলি যে প্রধানতই দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের অঞ্চল সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে দেবীপ্রসাদ প্রশ্ন রাখেন, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে-সব ধ্যানধারণাকে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে অনুমান করছেন সেগুলি টিকে থাকবার মতো স্বাভাবিক জমি কেন এই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের মানুষদের মধ্যেই পেলো? এইদিক থেকেও, ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের সঙ্গে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক অনুমান করা সঙ্গত নয় কি?
এ-প্রেক্ষিতে আরো বলা বাহুল্য হবে না যে, ওই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে গবেষক অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, এ-জাতীয় সম্প্রদায় একটি নয়, বহু। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নানান নামের অন্তরালে মূলত ওই একই সম্প্রদায়কে টিকে থাকতে দেখা যায় : কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব এবং আরো অনেক নাম। এবং শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এই জাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে তত্ত্বগত সাদৃশ্যের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী-২/৩২৫)- ‘সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া-সাধনা- সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।’
আর নৃতাত্ত্বিক যুক্তি অনুসারে এই জাতীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াই স্বাভাবিক বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কেননা, উক্ত ধ্যানধারণার উৎসে যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানই বর্তমান থাকে এবং যদি বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদন-পদ্ধতিতে খুব বড়ো রকমের মৌলিক উন্নতি দেখা না দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নানান দলের চেতনায় উক্ত ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব নানান নামে প্রতিভাত হওয়াই সম্ভব এবং স্বাভাবিক।
যদিও অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও এই সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধধর্মেরই স্মারক বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, তবুও তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, আধুনিক বিদ্বানদের এই সিদ্ধান্তটি সহজিয়াদের নিজেদের কাছেই অজ্ঞাত-
‘The Sahajias would by no means confess that they were Buddhists, nor refer to any Buddhist texts whick would make it far easier to trace the doctrines to their genuine origin…. It is the duty of a historian and scholar to thrash out grains from the chaff and find out the true Buddhist elements in their views and practices.’
অর্থাৎ : সহজিয়ারা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে তারা আসলে বৌদ্ধ। তারা কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থেরও উল্লেখ করবে না- তাহলে তাদের মতের প্রকৃত উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হতো।… ঐতিহাসিক ও বিদ্বানের কর্তব্য হলো, ধানকুটে চাল বের করবার মতো করেই সহজিয়াদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান থেকে প্রকৃত বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিকে খুঁজে বের করা। (তর্জমা- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৬৩)
ধান কুটে চাল বের করার দৃষ্টান্তটি জুতসই বলা চলে। কেবল কোনটি চাল আর কোনটি তুষ- এখানেই বিভেদ। দেবীপ্রসাদ বলেন, ওই বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিই তুষের মতো- সহজিয়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে এই তুষই বাদ দিতে হবে। বাদ দিলে কী পড়ে থাকে? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান। আর এর সূত্রের মাথাটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সেই সুপ্রাচীন সিন্ধু-যুগের উর্বরতাকেন্দ্রিক আদিম জাদু-বিশ্বাসের মধ্যেই হয়তো। তাহলে আমাদের আলোচ্য লোকায়তিক দর্শনের সাথে ওই সহজিয়া-সম্প্রদায়গুলির সাদৃশ্য কোথায়? মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকে হয়তো বা লোকায়তিকদের সঙ্গে এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের কোনভাবে সাদৃশ্য রয়েছে যা গভীর পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। তবে মোটাদাগে অন্তত একটা সাদৃশ্য খুবই দৃশ্যমান যে, সনাতন বেদপন্থীরা মূলত উভয় সম্প্রদায়কেই ঘৃণার চোখে দেখেছেন। আর তার ফলেই তাঁদের মধ্যে এই দুটিকে এক করে দেখা কিংবা উপস্থাপনের উৎসাহ ব্যাপক বলে মনে হয়।
কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠা উচিৎ যে, তথাকথিত অধঃপাত নির্ণয়ে বেদপন্থীদের এই উৎসাহ আসলে কতোটা প্রাসঙ্গিক? কেননা লোকায়তিক বা সহজিয়াদের ওই বামাচার বা কামাচার যদি তাঁদের কাছে অবৈদিক ও অধঃপাত হিসেবেই বিবেচিত হয় তাহলে বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত বামাচার বা কামাচার-সদৃশ উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্যগুলিকে বেদপন্থীরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
বৈদিক সাহিত্যে বামাচার :
বৈদিক সাহিত্যে বেদ-ত্রয়ীর অন্যতম যজুর্বেদের নিদর্শন দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। শুক্ল-যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার ২৩/২১ থেকে ২৩/৩১ বেদমন্ত্রগুলিতে কিছু দৃশ্য ও সংলাপের বর্ণনা রয়েছে। কিসের সংলাপ? মৈথুনের। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মৈথুন-দৃশ্যে ও মৈথুন-সংলাপে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা কেউই আজকালকার লম্পটের মতো লোক নন। বরং এরা হচ্ছেন পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিক- অধ্বয্যু, ব্রহ্মা, উদ্গাতা প্রমুখ। তার মধ্যে ২৩/২২-২৩ : অধ্বয্যু কুমারীকে অভিমেথন করছেন- দুটি মন্ত্রে অধ্বয্যু ও কুমারীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩/২৪-২৫ : ব্রহ্মা মহিষীকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে ব্রহ্মা ও মহিষীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩/২৬-২৭ : উদ্গাথা কুমারী বাবাতাকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে অনুরূপ সংলাপ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে বলা আবশ্যক, হরফ প্রকাশনী কলকাতা থেকে প্রকাশিত শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার অনুবাদক ২৩/২০ মন্ত্রের পর আগেভাগেই টীকায় বলেছেন-
‘বৌদ্ধধর্মে অনেকদিন হইতেই ঘুণ ধরিয়াছিল। বুদ্ধদেব নিজে যেদিন স্ত্রীলোকদিগকে দীক্ষা দিয়া ভিক্ষুণী করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন- সেইদিন হইতেই তাঁহাকে সঙ্ঘের বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য অনেক কঠোর নিয়ম করিতে হইয়াছিল। তিনি ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের এক বিহারে থাকিতে দিতেন না। কিন্তু তাঁহার মৃত্যুর পাঁচ ছয় শত বৎসর পর হইতে ভিক্ষুরা ক্রমে বিবাহ করিতে লাগিল- ক্রমে একদল গৃহস্থ ভিক্ষু হইল। এইখান হইতেই ঘুণ ধরা আরম্ভ হইল।… ভিক্ষুর ছেলে- সে একেবারেই ভিক্ষু হইত।… আমাদের দেশে যেমন ‘জাত বৈষ্ণব’ বলিয়া একটা জাতি হইয়াছে- সেকালেও তেমনি ‘জাত ভিক্ষু’ বলিয়া একটা জাতির মত হইয়াছিল। উহাদের যত দলপুষ্টি হইতে লাগিল, আসল ভিক্ষুদের অবস্থা তত হীন হইতে লাগিল। গৃহস্থ ভিক্ষুরা কারিগরি করিয়া জীবন নির্বাহ করিত- ভিক্ষাও করিত- কেন বা রাজমজুর হইত, কেন বা স্যাকরা হইত, কেন বা ছুতার হইত- অথচ ভিক্ষাও করিত, ধর্মও করিত, পুজাপাঠও করিত। বৌদ্ধধর্মের পৌরহিত্যটা ক্রমে নামিয়া আসিয়া কারিগরদের হাতে পড়িল।… লেখাপড়া, বিদ্যাবুদ্ধির নামগন্ধ পর্যন্ত বৌদ্ধদের মধ্যে লোপ পাইল।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা-সংগ্রহ তৃতীয় খণ্ড/ বৌদ্ধধর্ম ৮/ পৃষ্ঠা-৩৭৯)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মহামহোপাধ্যয়ের এই অনুমান যদি নির্ভুল হয় তাহলে এ-থেকে ঠিক কী সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব? ওই তথাকথিত অধঃপতনের স্বরূপটিকে বিশ্লেষণ করে দেবীপ্রসাদ বলছেন-
‘ওই ‘অধঃপতিত’ বৌদ্ধধর্মের রূপটিকে বিশ্লেষণ করে কি তার মধ্যে শুধুমাত্র স্থূলবুদ্ধি, নির্বুদ্ধি এবং নিরক্ষরতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে? না, এমন কিছু কিছু নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে যার সঙ্গে ইতিপূর্বেই আমাদের পরিচয় ঘটেছে?
যদি প্রথম সম্ভাবনাটি ঠিক হয় তাহলে মানতে হবে, প্রাকৃতজনের সংস্পর্শে এসে বৌদ্ধধর্মের মহত্তর ও বৃহত্তর আদর্শগুলির স্থূল-ব্যাখ্যা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু যদি দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ঠিক হয়- যদি দেখা যায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং জাত-আলাদা কিন্তু সুনির্দিষ্ট কতকগুলি আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান এই তথাকথিত অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের প্রাণবস্তু হয়ে দাঁড়ালো- তাহলে স্বীকার করতে হবে, সমাজের নিচের মহলের মানুষদের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এসে পড়া সত্ত্বেও তাদের চিন্তাচেতনায় এই বৌদ্ধধর্ম কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। অর্থাৎ, সমাজের নিচের মহলের ওই মানুষদের বিশ্বাসাদির উপর যদিও কৃত্রিমভাবে বৌদ্ধধর্মের প্রলেপ এসে পড়লো তবুও তারা আসলে তাদের আদিম বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান নিয়েই মেতে রইলো। এই সম্ভাবনা অনুসারে সহজিয়া-সম্প্রদায়কে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে মনে না করে কৃত্রিম বৌদ্ধপ্রভাবের পরিচায়ক মনে করাই সঙ্গত হবে।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৪৬০)
বস্তুত এটাই যৌক্তিক যে, সহজিয়া সম্প্রদায়ের উপর বৌদ্ধতত্ত্বের ওই প্রলেপটাই কৃত্রিম এবং অর্বাচীন। তাই একে বৌদ্ধধর্মের অধঃপাতের পরিচায়ক না বলে বরং আদিম জাদুবিশ্বাসের কৃত্রিম বৌদ্ধসংস্করণ মনে করাই ন্যায়সঙ্গত। এবং এই প্রভেদটা এইজন্যই তাৎপর্যপূর্ণ যে, দেবীপ্রসাদের মতে, কেননা, বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক হিসেবে গ্রহণ করলে এ-সম্প্রদায়ের মূল কথাগুলিকে বোঝবার সময় বৌদ্ধধর্মের মৌলিক তত্ত্বের উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখতে হবে এবং দেখতে হবে একদা-মহৎ কতকগুলি ধ্যানধারণা কীভাবে অশিক্ষিত ও মূর্খ মানুষদের চেতনায় স্থূল ও বিকৃত অর্থে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ-পরিভাষায় কৃত্রিমভাবে সজ্জিত এক আদিম বিশ্বাসের পরিচায়ক বলে গ্রহণ করলে এই সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে ওই বৌদ্ধ-পরিভাষাগুলিই অপ্রাসঙ্গিক বলে স্বীকৃত হবে এবং সে-ক্ষেত্রে এই সম্প্রদায়ের স্বরূপ উপলব্ধির উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র পদ্ধতি গ্রহণ করবার প্রয়োজন হবে।
এখানে স্মর্তব্য যে, আমরা ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট অন্য অধ্যায়ে সিন্ধু-ধর্ম প্রসঙ্গে কৃষিকেন্দ্রিক উর্বরতামূলক আদিম বিশ্বাস ও অনুষ্ঠানে শক্তি-উপাসনার যে সুপ্রাচীন উপাদানগুলির পরিচয় পেয়েছি তার সাথে সহজিয়া-সম্প্রদায়ের মূল তত্ত্বগুলির বিচার করলেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিৎ যে, সমাজ-বিকাশের পিছনদিককার পর্যায়ে আটকে পড়ে থাকা মানুষদের মধ্যেই সেই বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের স্পষ্টতর স্বাক্ষর রয়েছে। তাছাড়া শাস্ত্রী মহাশয়ের রচনাতেও এমন ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন (বৌদ্ধধর্ম ১০৬), বৌদ্ধধর্ম কোথায় গেল? উত্তরে তিনিই বলছেন, প্রধানত মুসলমান আক্রমণের দরুনই বাংলা দেশ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্ত হয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। উড়িষ্যার জঙ্গলে, চট্টগ্রামের রাঙামাটিতে আজো ওই (অধঃপতিত) বৌদ্ধধর্মের জীবন্ত নিদর্শন পাওয়া যায়।
এই অঞ্চলগুলি যে প্রধানতই দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষদের অঞ্চল সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে দেবীপ্রসাদ প্রশ্ন রাখেন, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে-সব ধ্যানধারণাকে অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মের পরিচায়ক বলে অনুমান করছেন সেগুলি টিকে থাকবার মতো স্বাভাবিক জমি কেন এই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের মানুষদের মধ্যেই পেলো? এইদিক থেকেও, ওই পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ের সঙ্গে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক অনুমান করা সঙ্গত নয় কি?
এ-প্রেক্ষিতে আরো বলা বাহুল্য হবে না যে, ওই সহজিয়া সম্প্রদায়ের আলোচনা প্রসঙ্গে গবেষক অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, এ-জাতীয় সম্প্রদায় একটি নয়, বহু। পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে নানান নামের অন্তরালে মূলত ওই একই সম্প্রদায়কে টিকে থাকতে দেখা যায় : কর্তাভজা, বাউল, বৈষ্ণব এবং আরো অনেক নাম। এবং শ্রীযুক্ত পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় এই জাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে তত্ত্বগত সাদৃশ্যের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন (পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী-২/৩২৫)- ‘সহজিয়া, বৈষ্ণব, শৈব, কিশোরীভজা, কর্তাভজা, পরকীয়া-সাধনা- সবই রিরংসার উপর প্রতিষ্ঠাপিত।’
আর নৃতাত্ত্বিক যুক্তি অনুসারে এই জাতীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াই স্বাভাবিক বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কেননা, উক্ত ধ্যানধারণার উৎসে যদি কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানই বর্তমান থাকে এবং যদি বাংলাদেশের কৃষকদের উৎপাদন-পদ্ধতিতে খুব বড়ো রকমের মৌলিক উন্নতি দেখা না দিয়ে থাকে, তাহলে তাদের নানান দলের চেতনায় উক্ত ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব নানান নামে প্রতিভাত হওয়াই সম্ভব এবং স্বাভাবিক।
যদিও অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন নিজেও এই সহজিয়া সম্প্রদায়কে বৌদ্ধধর্মেরই স্মারক বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, তবুও তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছে যে, আধুনিক বিদ্বানদের এই সিদ্ধান্তটি সহজিয়াদের নিজেদের কাছেই অজ্ঞাত-
‘The Sahajias would by no means confess that they were Buddhists, nor refer to any Buddhist texts whick would make it far easier to trace the doctrines to their genuine origin…. It is the duty of a historian and scholar to thrash out grains from the chaff and find out the true Buddhist elements in their views and practices.’
অর্থাৎ : সহজিয়ারা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে তারা আসলে বৌদ্ধ। তারা কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থেরও উল্লেখ করবে না- তাহলে তাদের মতের প্রকৃত উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হতো।… ঐতিহাসিক ও বিদ্বানের কর্তব্য হলো, ধানকুটে চাল বের করবার মতো করেই সহজিয়াদের মতবাদ ও আচার-অনুষ্ঠান থেকে প্রকৃত বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিকে খুঁজে বের করা। (তর্জমা- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-৩৬৩)
ধান কুটে চাল বের করার দৃষ্টান্তটি জুতসই বলা চলে। কেবল কোনটি চাল আর কোনটি তুষ- এখানেই বিভেদ। দেবীপ্রসাদ বলেন, ওই বৌদ্ধধর্মের অঙ্গগুলিই তুষের মতো- সহজিয়ার স্বরূপ নির্ণয় করতে হলে এই তুষই বাদ দিতে হবে। বাদ দিলে কী পড়ে থাকে? কৃষিকেন্দ্রিক জাদুঅনুষ্ঠান। আর এর সূত্রের মাথাটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সেই সুপ্রাচীন সিন্ধু-যুগের উর্বরতাকেন্দ্রিক আদিম জাদু-বিশ্বাসের মধ্যেই হয়তো। তাহলে আমাদের আলোচ্য লোকায়তিক দর্শনের সাথে ওই সহজিয়া-সম্প্রদায়গুলির সাদৃশ্য কোথায়? মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকে হয়তো বা লোকায়তিকদের সঙ্গে এই সহজিয়া সম্প্রদায়ের কোনভাবে সাদৃশ্য রয়েছে যা গভীর পর্যবেক্ষণের দাবী রাখে। তবে মোটাদাগে অন্তত একটা সাদৃশ্য খুবই দৃশ্যমান যে, সনাতন বেদপন্থীরা মূলত উভয় সম্প্রদায়কেই ঘৃণার চোখে দেখেছেন। আর তার ফলেই তাঁদের মধ্যে এই দুটিকে এক করে দেখা কিংবা উপস্থাপনের উৎসাহ ব্যাপক বলে মনে হয়।
কিন্তু এখানেও প্রশ্ন ওঠা উচিৎ যে, তথাকথিত অধঃপাত নির্ণয়ে বেদপন্থীদের এই উৎসাহ আসলে কতোটা প্রাসঙ্গিক? কেননা লোকায়তিক বা সহজিয়াদের ওই বামাচার বা কামাচার যদি তাঁদের কাছে অবৈদিক ও অধঃপাত হিসেবেই বিবেচিত হয় তাহলে বৈদিক সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত বামাচার বা কামাচার-সদৃশ উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্যগুলিকে বেদপন্থীরা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
বৈদিক সাহিত্যে বামাচার :
বৈদিক সাহিত্যে বেদ-ত্রয়ীর অন্যতম যজুর্বেদের নিদর্শন দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। শুক্ল-যজুর্বেদ বা বাজসনেয়ী-সংহিতার ২৩/২১ থেকে ২৩/৩১ বেদমন্ত্রগুলিতে কিছু দৃশ্য ও সংলাপের বর্ণনা রয়েছে। কিসের সংলাপ? মৈথুনের। তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মৈথুন-দৃশ্যে ও মৈথুন-সংলাপে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা কেউই আজকালকার লম্পটের মতো লোক নন। বরং এরা হচ্ছেন পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিক- অধ্বয্যু, ব্রহ্মা, উদ্গাতা প্রমুখ। তার মধ্যে ২৩/২২-২৩ : অধ্বয্যু কুমারীকে অভিমেথন করছেন- দুটি মন্ত্রে অধ্বয্যু ও কুমারীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩/২৪-২৫ : ব্রহ্মা মহিষীকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে ব্রহ্মা ও মহিষীর মধ্যে মৈথুন-সংলাপ। ২৩/২৬-২৭ : উদ্গাথা কুমারী বাবাতাকে অভিমেথন করছেন- মন্ত্র দুটিতে অনুরূপ সংলাপ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক্ষেত্রে বলা আবশ্যক, হরফ প্রকাশনী কলকাতা থেকে প্রকাশিত শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার অনুবাদক ২৩/২০ মন্ত্রের পর আগেভাগেই টীকায় বলেছেন-
‘এখান থেকে ৩১ কণ্ডিকা পর্যন্ত মহীধর ভাষ্যে অশ্লীল অর্থ করা হয়েছে। আধ্যাত্মিক পবিত্র বৈদিক মন্ত্রে এ অশ্লীল অর্থ কেন, তা আমাদের বোধগম্য হয় না। ভাষ্যকার কারণ বলেছেন অশ্বমেধ যজ্ঞে অশ্বের সংস্কারের জন্য তা করা হয়েছে। যাজ্ঞিক অর্থ সম্বন্ধে আমাদের বলবার কিছু নেই, তবে মন্ত্রসকলের অন্য অর্থও সম্ভব। আমরা এখানে ভাষ্য অনুযায়ী সাধারণ একটা অর্থ দিয়েছি।’
তার মানে, মন্ত্রের অশ্লীলতাটুকু বাদ দিয়ে ভাষ্যবিহীন সাধারণ একটা অর্থসহ শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার আলোচ্য অংশটুকু (শুক্লযজুর্বেদ-২৩/২১-৩০) হলো-
তার মানে, মন্ত্রের অশ্লীলতাটুকু বাদ দিয়ে ভাষ্যবিহীন সাধারণ একটা অর্থসহ শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার আলোচ্য অংশটুকু (শুক্লযজুর্বেদ-২৩/২১-৩০) হলো-
উৎসক্থ্যা অবস্তদং ধেহি সমঞ্জিং চারয়া বৃষন্ । য স্ত্রীণাং জীবভোজনঃ।। ২১।। যকাহসকৌ শকুন্তিকাহহহলগিতি বঞ্চতি। আহন্তি গভে পস্যে নিগল্গলীতি ধারকা।। ২২।। যকোহসকৌ শকুন্তক আহলগিতি বঞ্চতি। বিবক্ষত ইব তে মুখমধ্বর্ষো মা নস্ত¡মভিভাষথাঃ।। ২৩।। মাতা চ তে পিতা চ তেহগ্রং বৃক্ষস্য রোহতঃ। প্রতিলামীতি তে পিতা গভে মুষ্টিমতংসয়ৎ।। ২৪।। মাতা চ তে পিতা চ তেহগ্রে বৃক্ষস্য ক্রীড়তঃ। বিবক্ষত ইব তে মুখং ব্রহ্মন্মা ত্বং বদো বহু।। ২৫।।
ঊর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব। অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৬।। ঊর্ধ্বমেনমুচ্ছ্রয়তাদ্গিরৌ ভারং হরন্নিব। অথাস্য মধ্যমেজতু শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৭।। যদস্যা অংহুভেদ্যাঃ কৃধু স্থূলমুপাতসৎ। মুষ্কাবিদস্যা এজতো গোশফে শকুলাবিব।। ২৮।। যদ্দেবাসো ললামগুং প্রবিষ্টীমিনমাবিষুঃ। সক্থ্না দেদিশ্যতে নারী সত্যস্যাক্ষিভুবো যথা।। ২৯।। যদ্ধরিণো ববমত্তি ন পুষ্টং পশূ মন্যতে। শূদ্রা যদর্যজারা ন পোষায় ধনায়তি।। ৩০।।
অর্থাৎ :
হে বর্ষণকারী অশ্ব, তুমি বীর্য ধারণ কর, যা রমণীগণের জীবন ও ভোজন স্বরূপ। ২১/১।। ক্ষুদ্র পক্ষীর মত কুমারী হলে হলে শব্দ করে যাচ্ছে। ২২/১।। হে অধ্বর্যুগণ, পক্ষীর মত তোমাদের মুখই শব্দ করছে, আমাদের প্রতি এরূপ বলো না। ২৩/১।। তোমার মাতা ও পিতা কাষ্ঠময় মঞ্চকের অগ্রভাগ রোহন করেছিলেন। ২৪/১।। তোমার মাতা ও পিতা পূর্বে মঞ্চকের আগে ক্রীড়া করেছিল। তোমার মুখ যেন আরও বলতে চায়, হে ব্রাহ্মণ, আর বহু কথা বলো না। ২৫/১।।
পর্বতে ভারবাহী ব্যক্তি যেমন পর্বতের উপর ভার রেখে উপরে উঠে, সেরূপ একে উপরে তোল। ঠান্ডা বাতাসে কৃষক যেমন ধান ঝেরে ধান্যপাত্র উপরে রাখে, সেরূপ একে উপরে রাখ। ২৬/১।। পর্বতে ভারবাহী ব্যক্তি যেমন পর্বতের উপর ভার রেখে উপরে উঠে, সেরূপ হে নর, উদ্গাতাকে উর্ধ্বে রাখ। শীতল বায়ুতে কম্পমান লোকের মত একে কাঁপাও। ২৭/১।। জলপূর্ণ গাভীর খুরে মৎস্য যেমন কাঁপে, সেরূপে হ্রস্ব ও স্থূল শিশ্ন যোনি প্রাপ্ত হয়ে কাঁপে। ২৮/১।। যখন দেবগণ ক্রীড়া করে, তখন চোখে দেখা প্রত্যক্ষের মত নারীর উরু দেখা যায়। ২৯/১।। হরিণ ক্ষেত্রস্থ ধান্য ভক্ষণ করলে ক্ষেত্রপতি যেমন সুখী হয় না, সেরূপ শূদ্রা স্ত্রী বৈশ্যগামিনী হলে তার পতি সুখী হয় না। ৩০/১।।
বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় জোর করে এই সাধারণ অর্থ আরোপ থেকে বৈদিক-ভাষায় অনভিজ্ঞ সাধারণ পাঠক এতে কতটুকু কী বুঝবেন জানি না। বোঝার সুবিধার্থে মন্ত্রগুলির প্রকৃত অর্থ ও ব্যাখ্যা-ভাষ্য জরুরি বৈকি। তাই আলোচনার প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বোঝবার সুবিধার্থে শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার ২৩/২৬-২৭ মন্ত্র দুটির অর্থের সঙ্গে উবটভাষ্যও উদ্ধৃত করেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়, যেমন-
ঊর্ধ্বামেনামুচ্ছ্রাপয় গিরৌ ভারং হরন্নিব।
অথাস্যৈ মধ্যমেধতাং শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৩/২৬।।
উবটভাষ্য :- উদ্গাতা বাবাতাম্ অভিমেথয়তি ঊর্ধ্বাম্ এনাম্ কম্ চিৎ পুরুষম্ আহ। ঊর্ধ্বম্ এনাম্ বাবাতাম্ উচ্ছ্রিতাম্ কুরু। কথম্ ইব। গিরৌ ভারম্ মধ্যে নিগৃহ্য হরেৎ এবম্ এনাম্ মধ্যে নৃগৃহ্য ঊর্ধ্বাম্ উচ্ছ্রাপয়। অথ যথা ইতি এতস্য স্থানে। তথাচ উচ্ছ্রাপয় যথা অস্যা বাবাতায়া মধ্যম্ যোনিপ্রদেশঃ এধতাম্ । ‘এধ্ বৃদ্ধৌ’ বৃদ্ধিম্ যায়াৎ অথ এনাম্ গৃন্থীয়াঃ। শীতে বাতে পুনন্ ইব। যথা কৃষীবলঃ ধ্যান্যম্ বাতে শুদ্ধম্ কুর্বন্ গ্রহনমোক্ষৌ ঝটিতি করোতি।
ঊর্ধ্বমেনমুচ্ছ্রয়তাদ্গিরৌ ভারং হরন্নিব।
অথাস্য মধ্যমেজতু শীতে বাতে পুনন্নিব।। ২৭।।
উবটভাষ্য :- বাবাতা প্রত্যাহ উদ্গাতারম্ । ভবতঃ অপি এতৎ এবম্ । ঊর্ধ্বম্ এনম্ । উদ্গাতারম্ উচ্ছ্রয়তাম্ উচ্ছ্রাপয়। অত্র স্ত্রী পুরুষায়তে। গিরৌ ভারম্ হরন্ ইব। অথ এবম্ ক্রিয়মাণস্য অস্য মধ্যম প্রজননম্ এজতু চলতু। অথ এনম্ নিগৃহীষ¦ শীতে বাতে পুনন্ ইব যবান্ ।
তর্জমা-
২৩/২৬ : এই স্ত্রীকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। পর্বতে যেমন করিয়া ভার উত্তোলন করে। অনন্তর ইহার মধ্যদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হউক। বায়ুতে শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবটভাষ্য : উদ্গাতা বাবাতাকে অভিমেথন করিলেন। কোনো পুরুষকে বলিলেন, এই বাবাতাকে উর্ধ্বে তুলিয়া উষ্প্রিত করো। কেমন করিয়া? পর্বতে ভারবস্তুকে মধ্যস্থানে ধরিয়া যেমন ভাবে উত্তোলন করা হয় তেমনি ইহাকে মধ্যে ধরিয়া উত্তোলন করো। অনন্তর যাহাতে এই বাবাতার যোনিপ্রদেশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় সেইভাবে ইহাকে ধরো। যেমন কৃষক বায়ুতে ধান্য শুদ্ধ করিতে করিতে গ্রহণ করে ও বপন করে…
২৩/২৭ : ঊর্ধ্বে এই পুরুষকে তুলিয়া ধরো। যেমন করিয়া পর্বতে ভারবস্তুকে উত্তোলন করা হয়। অনন্তর ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক। শীতল বায়ুতে যব শস্য শুদ্ধ করিতে করিতে…
উবটভাষ্য : প্রত্যুত্তরে বাবাতা উদ্গাতাকে বলিল, তোমা কর্তৃকও এই রকমই করা হউক। এই পুরুষকে, অর্থাৎ উদ্গাতাকে, উর্ধ্বে তুলিয়া ধরো। এইখানে স্ত্রীলোক পুরুষের ন্যায় আচরণ করিতেছে। পর্বতে যেমন করিয়া ভার তোলে। অনন্তর এইরূপ ক্রিয়মান ইহার মধ্যপ্রদেশ চলিতে থাকুক, অর্থাৎ মৈথুন চলিতে থাকুক। অনন্তর ইহাকে চাপিয়া ধরো। যেমন কৃষক শীতল বায়ুতে যব শুদ্ধ করিতে করিতে ঝটিতে গ্রহণ এবং বপন করে…
সাধারণ পাঠক নিশ্চয়ই এই দুটি বেদমন্ত্রের আভাসিত অর্থ যাচাইয়ের মাধ্যমে পূর্ব-উদ্ধৃত অন্য মন্ত্রগুলির অন্তর্গত বিশেষ অর্থও অনুধাবনে সমর্থ হবেন আশা করি। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মৈথুন-সংলাপের মধ্যে ক্ষেত্রে বীজ বপনের দৃষ্টান্তের ব্যবহার। তার মানে বামাচারের সঙ্গে বার্ত্তা-বিদ্যার সংযোগ শুধুমাত্র কাপালিক-লোকায়তিক সম্প্রদায়ের মধ্যেই নয়, খোদ বৈদিক ঐতিহ্যেও একই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বেদপন্থীদের জন্য এখানে সমস্যা হলো রচনাটি খোদ বৈদিক ঋষিদেরই।
‘অবশ্যই, পরের যুগের বেদপন্থীরা এই মন্ত্রগুলি নিয়ে খুবই বিপদে পড়েছেন। তার কারণ, তাঁদের উত্তরযুগের রুচির সঙ্গে এগুলি কিছুতেই খাপ খায় না। তাই পরের যুগে এমনকি বিধান দেওয়া হয়েছে, এই বৈদিক মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করবার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত-বিধানের মূলে নিশ্চয়ই পাপ-বোধ। অথচ, পুরাকালে বৈদিক ঋষিরা যদি সত্যিই একে পাপাচরণ মনে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই তার জন্য পাঁচ-পাঁচজন যজ্ঞীয় ঋত্বিককে নিয়োগ করতে চাইতেন না। তাই তাঁদের কাছে পুরো ব্যাপারটাই যে একটি বৈদিক যজ্ঞ-বিশেষ সে-বিষয়ে কোনো রকম সন্দেহেরই অবকাশ নেই। বস্তুত, বেদের ছাত্রমাত্রই জানেন এই মন্ত্রগুলির সঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞের কী রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়/ লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৫)
কিন্তু প্রশ্ন হলো, মৈথুনের সঙ্গে বৈদিক যজ্ঞের কী সম্পর্ক? বিষয়টা নিশ্চয়ই কৌতুহলজনক। তবে যজ্ঞ মানে যাই হোক না কেন, অনেক জায়গায় দেখা যায় প্রাচীনেরা মৈথুনকেও সরাসরি যজ্ঞের মতোই মনে করেছিলেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের শেষের দিকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়-
‘এষাং বৈ ভূতানাং পৃথিবী রসঃ, পৃথিব্যা আপোহপাম্ ওষধয়, ওষধীনাং পুষ্পাণি, পুষ্পাণাং ফলানি, ফলানাং পুরুষঃ, পুরুষস্য রেত। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১)।। সহ প্রজাপতিরীক্ষাঞ্চক্রে হন্তাস্মৈ প্রতিষ্ঠাং কল্পয়ানীতি। স স্ত্রীয়ং সসৃজে। তাং সৃষ্টবাধ উপাস্ত; তস্মাৎ স্ত্রিয়মধ উপাসীত। স এতং প্রাঞ্চং গ্রাবাণমাত্মন এব সমুদপারয়ৎ। তেন এনাম অভ্যসৃজৎ। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/২)।। তস্যা বেদিরুপস্থো, লোমানি বহিশ্চর্মাধিষবণে, সমিদ্ধ্যো মধ্যতস্তৌ মুস্কৌ। স যাবান্ হ বৈ বাজপেয়ন যজমানস্য লোকে ভবতি, তাবানস্য লোকো ভবতি, য এবং বিদ্বান্ অধোপহাসং চরত্যাসাং স্ত্রিয়ঃ সুকৃতং বৃঞ্জতে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৩)।।
অর্থাৎ :
যাবতীয় ভূতের রস এই পৃথিবী। জল পৃথিবীর রস। ওষধি লতা-পাতা জলের রস। ফুল ওষধির রস। ফল ফুলের রস। ফলের সার পুরুষ। রেতঃ বা জীববীজ পুরুষের রস বা নির্যাস। এইভাবে ক্রমানুসারে পুরুষদেহে এলো সৃষ্টির বীজ- বীর্য। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/১)।। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি সেই জীববীজকে দেখে চিন্তিত হলেন- এর উপযুক্ত আধার (পাত্র) কোথায়? অনেক ভেবে তিনি এর পাত্ররূপে সৃষ্টি করলেন নারীকে, স্ত্রীকে। সৃষ্টি করে, তিনি তাকে নিচে রেখে তার অধোদেশে মিলিত হয়ে মৈথুনকর্মের উপাসনা করেছিলেন। সেই কারণে, আজও পুরুষ স্ত্রীকে নিচে রেখেই তার অধোদেশে মৈথুনের উপাসনা করে আসছে। প্রজাপতি তাঁর সোমলতা পেষার পাষাণদণ্ড বা নোড়ার মতো সুকঠিন জননেন্দ্রিয় বা পুরুষাঙ্গ দিয়ে সেই স্ত্রী সংসর্গ করে তাকে গর্ভবতী করেছিলেন। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/২)।। তার (স্ত্রীলোকটির) উপস্থ অর্থাৎ নিম্নাঙ্গ বা নিতম্ব হলো যজ্ঞের বেদী, তার লোমরাজি কুশ বা যজ্ঞ-তৃণ, তার চর্মাবরণ আশ্রয় বা অধিযবন (=সোমরস নিষ্কাশনের যন্ত্র), তার মধ্যস্থল প্রদীপ্ত অগ্নি, মুষ্কদ্বয় অর্থাৎ দুদিকের দুটি স্থূল মাংসপিণ্ড হোমকুণ্ডের দুদিকের দুই ফলক বা পাথরের আড়াল। বাজপেয় যজ্ঞ যারা করে তারা যে সুফল পায়, স্ত্রীর নিম্নাঙ্গকে যারা এইভাবে দেখে, তারাও সেই সুফল পায়। এটি জেনে যে ‘অধোপহাস’ অর্থাৎ মৈথুন কর্ম করে, সে স্ত্রী দ্বারা নিজে শক্তিমান হয়। আর যে এ তত্ত্ব না জেনে মৈথুন করে সে তার সুকৃতি স্ত্রীকে দেয়। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৩)।।
এ-রকম প্রকট বামাচারী চিন্তা কিন্তু উপনিষদে মাত্র একবারই উঁকি দেয়নি, ছান্দোগ্য উপনিষদেও দেখা যায় ছান্দোগ্যের ঋষি বলছেন-
যোষা বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যা উপস্থ এব সমিদ্ যদুপমন্ত্রয়তে স ধূমো যোনিরর্চির্যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ। (ছান্দোগ্য-৫/৮/১)।। তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা আহুতের্গর্ভঃ সম্ভবতি। (ছান্দোগ্য-৫/৮/২)।।
অর্থাৎ :
হে গৌতম, স্ত্রীলোকই হলো যজ্ঞীয় অগ্নি। তার উপস্থই হলো সমিধ। ওই আহ্বানই হলো ধূম। যোনিই হলো অগ্নিশিখা। প্রবেশ-ক্রিয়াই হলো অঙ্গার। রতিসম্ভোগই হলো বিস্ফুলিঙ্গ। (ছান্দোগ্য-৫/৮/১)।। দেবতারা এই অগ্নিতে রেত বা শুক্র আহুতি দেন। সেই আহুতি থেকেই গর্ভ সম্ভব হয়। (ছান্দোগ্য-৫/৮/২)।।
এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদেও হুবহু এ-কথারই প্রতিধ্বনি দেখা যায়-
‘যোষা বা অগ্নির্গৌতম। তস্যা উপস্থ এব সমিৎ, লোমানি ধূমো। যোনিরর্চিঃ। যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা, অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ। তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবা রেতো জুহ্বতি। তস্যা আহুত্যৈ পুরুষঃ সংভবতি। স জীবতি যাবজ্জীবত। অথ যদা ম্রিয়তে। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।
অর্থাৎ :
গৌতম, যোষা অর্থাৎ স্ত্রী যজ্ঞের অগ্নি। তার উপস্থদেশ হলো সেই অগ্নির সমিধ বা ইন্ধন। (উপস্থদেশের) লোমরাজি হলো সেই ইন্ধনের ধোঁয়া। যোনিদেশ হলো সেই অগ্নির শিখা। মৈথুন হলো অঙ্গার। আর শীৎকারাদি যে ক্ষণিক পুলক শিহরণ, তা হচ্ছে সেই যজ্ঞাগ্নির স্ফুলিঙ্গ। এই যজ্ঞাগ্নিতে দেবতারা সেই রেতঃ বা জীববীজ আহুতি দেন। তা থেকে উৎপন্ন হয় পুরুষ (প্রজাতি)। যতদিন প্রাণ থাকে, সেই সন্তান বেঁচে থাকে। তারপর মারা যায়। (বৃহদারণ্যক-৬/২/১৩)।।
অতএব বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপনিষদের অতি প্রসিদ্ধ ঋষিরাই মৈথুন-ক্রিয়াকে খোলাখুলিভাবেই যজ্ঞ বলে উল্লেখ করেছেন। এবং কথায় কথায় সোমযাগ থেকে উপমা নেয়ার চেষ্টাটাও লক্ষ্য করবার মতো বলে দেবীপ্রসাদ তাঁর লোকায়ত দর্শন গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন। আমাদের আধুনিক রুচিতে এ-সব কথাবার্তা যতোই কদর্য লাগুক না কেন (যেমন আধুনিককালের স্বামী লোকেশ্বরানন্দও তাঁর উপনিষদ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের ৫/৮/১-২ শ্রুতির বাংলা তর্জমা প্রায় গোটাটাই ফাঁকা রেখে এড়িয়ে গেছেন), উপনিষদের ঋষিরা এই তত্ত্বটির প্রতিই যে কতোখানি গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন তার পরিচয় পাওয়া যায় নানান দিক থেকে। যেমন বৃহদারণ্যকের ঋষি এই তত্ত্ব বলবার পরই তিনজন প্রাচীন জ্ঞানীর নজির দেখিয়ে বলেছেন, বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, বিদ্বান নাক মৌদ্গল্য ও বিদ্বান কুমারহারিত- এই তিনজনই নাকি এই তত্ত্ব জানতেন এবং সেই মর্মে উপদেশ দিয়েছেন। এবং এই তত্ত্বের অসাধারণ গুরুত্ব বিবেচনায় বৃহদারণ্যকের ঋষি আরো এগিয়ে উপদেশ প্রদান করতে করতে বলছেন-
এতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ উদ্দালক আরুণিয়াহ, এতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ নাকো মৌদ্গল্য আহৈতদ্ধ স্ম বৈ তৎ বিদ্বান্ কুমারহারিত আহ-বহবো মর্যা ব্রহ্মণায়না নিরিন্দ্রিয়া বিসুকৃৎতোহস্মাল্লোকাৎ প্রষন্তি য ইদম্ অবিদ্বাংসোহধোপহাসং চরন্তীতি বহু বা ইদং সুপ্তস্য বা জাগ্রতো বা রেতঃ স্কন্দতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪)।। অথ যদ্ উদক আত্মানং পণ্যেৎ তদভিমন্ত্রয়েত-মরি তেজ ইন্দ্রিয়ং যশো দ্রবিণং সৃকৃতমিতি শ্রীর্হ বা এষা স্ত্রীণাং যন্মলোৎবাসাঃ তস্মাৎ মলোৎবাসসং যশস্বিনীম্ অভিক্রম্য উপমন্ত্রয়েতে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৬)।। সা চেদস্মৈ ন দদ্যাৎ কামমেনাম্ অবক্রীণীয়াৎ। সা চেদস্মৈ নৈব দদ্যাৎ কামমেনাং যষ্ট্যা বা পামিনা বোপহত্যা অতিক্রামেৎ ইন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদদ ইতি। যশা এব ভবতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৭)।। সা চেদস্মৈ দদ্যাৎ ইন্দ্রিয়েণ তে যশসা যশ আদধামীতি যশাস্বিনৌ এব ভবতঃ। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৮)।। স যামিচ্ছেৎ কাময়েত মেতি তস্যাং অর্থং নিষ্ঠাং, মুখেন মুখং সন্ধ্যায় উপস্থমস্যা অভিমৃশ্য জপেৎ অঙ্গাদঙ্গাৎ সংভবসি, হৃদয়াৎ অধিজায়সে, স ত্বং অঙ্গকষায়োহসি দিগ্ধবিদ্ধামিব মাদয় ইমাম্ অমূং ময়ীতি। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৯)।।
অর্থাৎ :
(বাজপেয় যজ্ঞানুষ্ঠানের মতোই এই অধোপহাস অর্থাৎ মৈথুনকর্ম জেনে) বিদ্বান উদ্দালক আরুণি, মুদ্গল-তনয় নাক ঋষি, কুমারহারিত বলেছিলেন- নামেমাত্র ব্রাহ্মণ, এমন অনেকে আছে যারা এই বিষয়ের তত্ত্বজ্ঞান না জেনে স্ত্রীসংসর্গ এবং মৈথুনকর্ম করার ফলে বিকলেন্দ্রিয় হয়ে এবং সুকৃতি হারিয়ে মারা যায়। জাগ্রত কিংবা ঘুমন্ত, যে কোন অবস্থাতেই তাদের অনেক-অনেক বীর্যস্খলন ঘটে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৪)।। যদি কেউ জলে স্খলিত বীর্য হয়ে নিজের ছায়া দেখে তবে সে নিজের মঙ্গলের জন্য এই মন্ত্রে প্রার্থনা জানাবে-‘ময়ি তেজ…সুকৃতম্’ অর্থাৎ আমার তেজ, ইন্দ্রিয়শক্তি, যশ, ধন, সৌভাগ্য দেবতারা আমায় দান করুন। যে নারী মলোদ্বাসা অর্থাৎ ঋতুকালীন মলিন-বসন পরিত্যাগ করেছে সে নারীদের মধ্যে শ্রীযুক্তা বা লক্ষ্মীস্বরূপা। অতএব মলোদ্বাসা সেই সৌভাগ্যবতী নারীতে গর্ভাধান করার জন্য পুরুষ তাকে আমন্ত্রণ জানাবে, আহ্বান করবে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৬)।। যদি সেই নারী পুরুষকে কাম দিতে রাজী না হয়, তবে প্রথমে উপহার সামগ্রি দিয়ে তাকে নিজের বশে আনার চেষ্টা করবে। যদি তাতেও সে সাড়া না দেয় তবে সেই স্ত্রীকে হাত বা লাঠি দিয়ে প্রহার করে অভিভূত করে বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ তে…আদদ’ অর্থাৎ আমার ইন্দ্রিয়শক্তিরূপ যশ দিয়ে আমি তোমার যশ কেড়ে নিচ্ছি। এই বলে তাতে উপগত হবে। তখন সেই নারী বশে আসতে বাধ্য হবে। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৭)।। আর আহ্বান-মাত্রেই যদি সে স্ত্রী পুরুষের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য নিজেকে দান করতে চায়, বলবে ‘ইন্দ্রিয়েণ…আদধাম’- অর্থাৎ, আমার ইন্দ্রিয়রূপ যশ দিয়ে তোমাকে যশস্বী করছি। এতে নারী-পুরুষ, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যশস্বী হয়, সুখী হয়। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৮)।। পুরুষ যদি নারীটিকে কামনাপরায়ণা করে তুলতে চায়, তবে সে স্ত্রী-অঙ্গে নিজের অর্থ অর্থাৎ পুরুষাঙ্গ সংযোগ করে, মুখে মুখ রেখে বা মুখচুম্বন করে স্ত্রীর উপস্থ অর্থাৎ নিতম্ব ছুঁয়ে এই মন্ত্র জপ করবে-‘অঙ্গাদঙ্গাৎ…ময়ীতি’- অর্থাৎ, হে রেতঃ, তুমি উৎপন্ন হয়েছো আমার প্রতিটি অঙ্গ হতে, তোমার জন্ম আমার হৃদয়ে। তুমি আমার সর্বাঙ্গের রস। বাণবিদ্ধা হরিণীর-মতো তুমি এই নারীকে বিদ্ধ করো। রসসিক্তা করে একে আনন্দে অধীরা করে তোলো। (বৃহদারণ্যক-৬/৪/৯)।।
বলাই বাহুল্য, আজকের দিনে এ-ধরনের উপদেশ দিতে গেলে ঋষির গৌরব পাবার বদলে কপালে কী ঘটবে ! কিন্তু বৃহদারণ্যক উপনিষদের ঋষি মেয়েদের লাঠি-পিটে, কিলচড় লাগিয়ে কামভাব চরিতার্থ করতে দিতে বাধ্য করবার উপদেশ দিয়েও নাজেহাল হয়েছিলেন বলে কোথাও লেখা নেই। বরং তাঁর রচিত গ্রন্থকে প্রাচীনেরা জ্ঞানের আকর বলেই মনে করেছেন। আর তাতেই প্রমাণ হয় মৈথুন ও কাম সম্বন্ধে আজকের দিনের ধারণার সঙ্গে সেকালের মানুষদের ধারণার একেবারে আকাশ-পাতাল তফাত। এবং এ-বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যখন দেখা যায় মহাভারতের যুগে এসেই এ-বিষয়ে পুরনো কালের ধ্যানধারণার সঙ্গে নতুন কালের ধ্যনধারণাগুলি আর মিল খাচ্ছে না। যেমন, মহাভারতের আদিপর্বের ১১৬ অধ্যায়ে বর্ণিত হচ্ছে (মহাভারত-আদিপর্ব-১১৬/৩-২১)-
অথ ত্বিদং প্রবক্ষ্যামি ধর্ম্মতত্ত্বং নিবোধ মে।
পুরাণমৃষিভির্দৃষ্টং ধর্ম্মবিদ্ভির্মহাত্মভিঃ।। ৩।।
অনাবৃতাঃ কিল পুরা স্ত্রিয় আসন্ বরাননে!।
কামচারবিহারিণ্যঃ স্বতন্ত্রাশ্চারুহাসিনি!।। ৪।।
তাসাং ব্যুচ্চরমাণানাং কৌমারাৎ সুভগে! পতীন্ ।
নাধর্ম্মোহভূদ্বরারোহে! স হি ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।। ৫।।
তঞ্চৈব ধর্ম্মং পৌরাণং তির্য্যগ্-যোনিগতাঃ প্রজাঃ।
অদ্যাপ্যনুবিধীয়ন্তে কামদ্বেষবিবর্জিতাঃ।। ৬।।
প্রমাণদৃষ্টো ধর্ম্মোহয়ং পূজ্যতে চ মহর্ষিভিঃ।
উত্তরেষু চ রম্ভোরু! কুরুষ্বদ্যাপি পূজ্যতে।
স্ত্রীণামনুগ্রহকরঃ স হি ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।। ৭।।
অস্মিংস্তু লোকে নচিরান্মর্য্যাদেয়ং শুচিস্মিতে!।
স্থাপিতা যেন যস্মাচ্চ তন্মে বিস্তরতঃ শৃণু।। ৮।।
বভূবোদ্দালকো নাম মহর্ষিরিতি নঃ শ্রুতম্ ।
শ্বেতকেতুরিতি খ্যাতঃ পুত্রস্তস্যাভবন্মুনিঃ।। ৯।।
মর্য্যাদেয়ং কৃতা তেন ধর্ম্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা।
কোপাৎ কমলপত্রাক্ষি! যদর্থং তন্নিবোধ মে।। ১০।।
শ্বেতকেতোঃ কিল পুরা সমক্ষং মাতরং পিতুঃ।
জগ্রাহ ব্রাহ্মণঃ পাণৌ গচ্ছাব ইতি চাব্রবীৎ।। ১১।।
ঋষিপুত্রস্ততঃ কোপং চকারামর্ষচোদিতঃ।
মাতরং তাং তথা দৃষ্ট্বা নীয়মানাং বলাদিব।। ১২।।
ক্রুদ্ধন্তু তং পিতা দৃষ্ট্বা বেপমানমুবাচ হ।
মা তাত! কোপং কার্ষীস্ত্বম্ এষ ধর্ম্মঃ সনাতনঃ।। ১৩।।
অনাবৃতা হি সর্ব্বেষাং বর্ণানামঙ্গনা ভুবি।
যথা গাবঃ স্থিতাস্তাত! স্বে স্বে বর্ণে তথা প্রজাঃ।। ১৪।।
তথৈব চ কুটুম্বেষু ন প্রমাদ্যন্তি কর্হিচিৎ।
ঋতুকালে তু সম্প্রাপ্তে ভর্ত্তারং ন জহুস্তদা।। ১৫।।
ঋষিপুত্রস্তু তং ধর্ম্মং শ্বেতকেতুর্ন চক্ষমে।
চকার চৈব মর্য্যাদামিমাং স্ত্রীপুংসয়োর্ভুবি।। ১৬।।
মানুষেষু মহাভাগে! ন ত্বেবান্যেষু জন্তুষু।
ততঃ প্রভৃতি মর্য্যাদা স্থিতেয়মিতি নঃ শ্রুতম্ ।। ১৭।।
ব্যুচ্চরন্ত্যাঃ পতিং নার্য্যা অদ্যপ্রভৃতি পাতকম্ ।
ভ্রূণহত্যাসমং ঘোরং ভবিষ্যত্যসুখাবহম্ ।। ১৮।।
ভার্য্যাং তথা ব্যুচ্চরতঃ কৌমারব্রহ্মচারিণীম্ ।
পতিব্রতামেতদেব ভবিতা পাতকং ভুবি।। ১৯।।
পত্যা নিযুক্তা যা চৈব পত্নী পুত্রার্থমেব চ।
ন করোতি বচস্তস্যা ভবিষ্যত্যেতদেব হি।। ২০।।
ইতি তেন পুরা ভীরু! মর্য্যাদা স্থাপিতা বলাৎ।
উদ্দালকস্য পুত্রেণ ধর্ম্ম্যা বৈ শ্বেতকেতুনা।। ২১।।
অর্থাৎ :
তার পর, ধর্ম্মজ্ঞ মহাত্মা ঋষিরা যাহা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, আমি সেই প্রাচীন ধর্ম্মতত্ত্ব তোমার নিকট বলিব; শ্রবণ কর। ৩।। চারুহাসিনি! পূর্ব্বকালে সকল স্ত্রীলোকই অনবরুদ্ধ ছিল এবং তাহারা ইচ্ছা অনুসারে বিহার করিয়া বেড়াইত এবং স্বাধীন ছিল। ৪।। সুন্দরি! তাহারা বিবাহের পর হইতে পতিকে ছাড়িয়া ইচ্ছানুসারে অন্য পুরুষের সহিত বিচরণ করিত; তাহাতে তাহাদের অধর্ম্ম হইত না। কেন না, তাহাই প্রাণিগণের চিরন্তন স্বভাব। ৫।। মনুষ্যভিন্ন প্রাণীরা আসক্তি ও বিদ্বেষশূন্য হইয়া এখনও সেই প্রাচীন ধর্ম্মেরই অনুসরণ করিয়া থাকে। ৬।। মহর্ষিরাও প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন বলিয়া এই ব্যবহারের আদর করেন এবং উত্তর কুরুদেশে এখনও এই ব্যবহার আদৃত হইয়া থাকে; আর, এই আচার স্ত্রীলোকদিগের প্রতি অনুগ্রহসূচক এবং চিরকালই চলিয়া আসিতেছে। ৭।। সুন্দরি! অধিক কাল হয় নাই; যে কারণে যিনি এই দেশে এই নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি বিস্তরক্রমে আমার নিকট শ্রবণ কর। ৮।।
আমাদের শুনা আছে- উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন; শ্বেতকেতু নামে তাঁহার এক পুত্র ছিলেন, তিনিও মুনি ছিলেন। ৯।। পদ্মনয়নে! সেই শ্বেতকেতু যে কারণে ক্রোধবশতঃ এই ন্যায়সঙ্গত নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তুমি আমার নিকট শোন। ১০।। একদা এক ব্রাহ্মণ সেই উদ্দালকের সমক্ষে শ্বেতকেতুর মাতার হস্ত ধারণ করিয়াছিলেন এবং বলিয়াছিলেন যে, ‘চল, আমরা যাই’। ১১।। তাহার পর, বলপূর্ব্বকই যেন মাতাকে সেইভাবে লইয়া চলিয়াছে- ইহা দেখিয়া শ্বেতকেতু অসহিষ্ণুতাবশতঃ ক্রোধ প্রকাশ করিলেন। ১২।। কিন্তু তখন পিতা উদ্দালক, পুত্র শ্বেতকেতুকে ক্রোধকম্পিত দেখিয়া বলিলেন- ‘বৎস! তুমি ক্রোধ করিও না; ইহাই স্ত্রীলোকদিগের চিরাচরিত নিত্যধর্ম্ম। ১৩।। জগতে সকল বর্ণের স্ত্রীলোকেরাই অনবরুদ্ধ; সুতরাং গরুগুলি যেমন স্বেচ্ছাচারিণী, মনুষ্যরমণীরাও তেমন আপন আপন বর্ণে স্বেচ্ছাচারিণীই হইয়া থাকে। ১৪।। তবে তাহারা কখনও রন্ধনাদি গৃহকার্য্যে অনবধানতা করিত না, কিংবা ঋতুকালে ভর্ত্তাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করিত না’। ১৫।। ঋষিপুত্র শ্বেতকেতু সে প্রাচীন আচার সহ্য করিলেন না; কিন্তু জগতে সকল স্ত্রী-পুরুষের জন্যই এই নিয়ম স্থাপন করিলেন। ১৬।। কুন্তি! আমাদের শুনা আছে যে, তদবধি এই নিয়ম কেবল মনুষ্যসমাজেই চলিয়াছে; কিন্তু অন্য প্রাণীর মধ্যে নহে। ১৭।। ‘আজ হইতে যে রমণী পতিকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করিবে, তাহার ভ্রূণহত্যা তুল্য ঘোরতর দুঃখজনক পাপ হইবে। ১৮।। আবার, কন্যাকালে ব্রহ্মচারিণী এবং বিবাহের পর পতিব্রতা- এহেন ভার্য্যাকে পরিত্যাগ করিয়া যে পুরুষ অন্য স্ত্রীর সংসর্গ করিবে, তাহারও এই পাপই হইবে। ১৯।। আর, যে রমণী ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করিবার জন্য পতির আদেশ পাইয়াও সে আদেশ পালন করিবে না, তাহারও এইরূপ পাপই হইবে’। ২০।। কুন্তি! পূর্ব্বকালে উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতু তপোবলে এই ধর্ম্মসঙ্গত নিয়ম স্থাপন করিয়াছিলেন। ২১।।
যৌনজীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটা যে একটি বিশেষ যুগেই বদলেছে- আগে একরকম ছিলো, পরে অন্যরকম হলো- উদ্ধৃত শ্বেতকেতুর কাহিনীটাই এ-কথার স্পষ্ট প্রমাণ হতে পারে। যদিও সেই যুগ বলতে ঠিক কোন যুগ,- কোন যুগ থেকে কামজীবন সম্বন্ধে আধুনিক ধ্যানধারণার শুরু,- এ-প্রশ্ন অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু সেকালের ধারণাটা ঠিক কী রকম বা কীরকম ধারণার বশবর্তী হলে বৈদিক ঋষিদের পক্ষে কামজীবনকে এতাটা গুরুত্বপূর্ণ ও উদ্দেশ্যমূলক মনে করা সম্ভবপর?
এর-জবাবে দেবীপ্রসাদ বলেন, ‘এ-প্রশ্নের পুরো জবাবটা অবশ্যই শুধুমাত্র বৈদিক সাহিত্যের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না।… কিন্তু, যেটা খুবই বিস্ময়ের কথা, এ-বিষয়ে বৈদিক সাহিত্য আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করে না। উপনিষদ এবং বিশেষ করে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলির কাছ থেকেই প্রশ্নটার অন্তত আংশিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৯)
কী উত্তর? এ-প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ হিসেবে ছান্দোগ্য-উপনিষদের বামদেব্য-ব্রতের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘বামদেব্য’ নামটা এখানে উল্লেখযোগ্য। কেননা তাঁর মতে, বৈদিক সাহিত্যেও যে বামাচারের স্মারক রয়েছে তার একটি স্পষ্ট নিদর্শন ওই নামেই মধ্যেই পরিদৃষ্ট হয়। এই বামদেব্য-ব্রত সম্পর্কে ছান্দোগ্য উপনিষদে (ছান্দোগ্য-২/১৩) বলা হয়েছে-
‘উপমন্ত্রয়তে স হিঙ্কারো জ্ঞপয়তে স প্রস্তাবঃ স্ত্রিয়া সহ শেতে সঃ উদ্গীথঃ প্রতি স্ত্রীং সহ শেতে স প্রতিহারঃ কালং গচ্ছতি তন্নিধনং পারং গচ্ছতি তন্নিধনমেতদ্-বামদেব্যং মিথুনে প্রোতম্’। (ছান্দোগ্য-২/১৩/১)।।
‘স য এবমেতদ্বামদেব্যং মিথুনে প্রোতং বেদ মিথুনীভবতি মিথুনান্মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বমায়ুরেতি জ্যোগ্-জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’। (ছান্দোগ্য-২/১৩/২)।।
অর্থাৎ :
মৈথুনে লিপ্ত হওয়ার আগে যে পুরুষ স্ত্রীলোককে আহ্বান করে সেই হলো পঞ্চবিধ সামের প্রথম সাম ‘হিঙ্কার’। স্ত্রীর মনোরঞ্জন করা বা তাকে সন্তুষ্ট করা হলো দ্বিতীয় সাম ‘প্রস্তাব’। স্ত্রীর সঙ্গে শয্যায় শয়ন হলো ‘উদ্গীথ’। সঙ্গমের প্রাক-মুহূর্তে স্ত্রীর অভিমুখ হয়ে শয়ন করা ‘প্রতিহার’। মিথুন-অবস্থায় থাকা হলো ‘নিধন’। আবার চরিতার্থতাও ‘নিধন’। এই বামদেব্য নামক সাম মিথুনে প্রতিষ্ঠিত। (ছান্দোগ্য-২/১৩/১)।।
যে এইভাবে বামদেব্য সামকে মিথুনে প্রতিষ্ঠিত বলে জানে সে নিয়ত মিথুনে মিলিত হয়। (তার) প্রত্যেক মিথুন থেকেই প্রজার (সন্তানের) উৎপত্তি হয়। সে পূর্ণজীবী হয়। সন্তান, পশু ও কীর্তিতে মহান হয়। কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না- এই-ই ব্রত। (ছান্দোগ্য-২/১৩/২)।।
অতএব, বামদেব্য ব্রতে- ‘মিথুনাৎ মিথুনাৎ প্রজায়তে সর্ব্বম্ আয়ুঃ এতি জ্যোক্ জীবতি মহান্ প্রজয়া পশুভির্ভবতি মহান্ কীর্ত্ত্যা’- এই হলো আসল কথা। মিথুন থেকে কী কী পাওয়া যাবে? তালিকা হলো-
সন্তান পাওয়া যাবে।
পূর্ণ জীবন পাওয়া যাবে।
পশু পাওয়া যাবে।
মহান কীর্তির নামডাক পাওয়া যাবে।
এখানে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়টি হলো, উপনিষদের ঋষি মৈথুনকে শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনেরই উপায় মনে করছেন না, সেই সঙ্গেই ধন-উৎপাদনের উপায় বলেও বর্ণনা করছেন। উপনিষদের যুগেও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকখানিই পশুপালনমূলক বলে আমরা জানি, তাই ধনউৎপাদন বলতে প্রধানতই পশুবৃদ্ধি। আর এই ধারণার দরুনই মিথুনকে এতোটা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে যে, উপনিষদের ঋষি মিথুনের বিভিন্ন স্তরকে যজ্ঞের হিঙ্কার, প্রস্তাব, উদ্গীথ, প্রতিহার প্রভৃতি পঞ্চবিধ সামগানের সঙ্গে এক বলে বর্ণনা করছেন। শুধু তাই নয়, উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’- কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না, এই-ই ব্রত।
তাহলে, বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রাচীনদের মনে মিথুন সম্বন্ধে ধারণাটা ঠিক একালের আমাদের মতো নয়। আমাদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? উত্তর হলো, সন্তান। কিন্তু প্রাচীন ঋষিদের ধারণায় মিথুন থেকে কী পাওয়া যায়? শুধু সন্তান নয়, ধনসম্পদও। আমাদের ধারণায় সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে ধনসম্পদ উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাঁদের ধারণায়, ধনসম্পদ উৎপাদন ও সন্তান উৎপাদন- দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক বড়ো গভীর। কিন্তু কোন্ ধারণা সঠিক এ-নিয়ে কি তর্ক তোলার আদৌ দরকার আছে? এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলেন-
‘এখন, আমাদের ধারণাটা ঠিক না তাঁদের ধারণাটা ঠিক, এ-নিয়ে তর্ক তোলবার দরকার নেই। অবশ্যই, এ-বিষয়ে আমাদের ধারণা তাঁদের চেয়ে অনেক স্পষ্ট, অনেক নির্ভুল। তার তুলনায়, তাঁদের ধারণাটার প্রায় পরেরো আনাই কল্পনা। কিন্তু যেটা আসলে ঢের বড়ো কথা, তাঁদের যুগে তাঁদের মনে এই রকমের একটা কল্পনা সত্যিই ছিলো, ছিলো ওই রকমের একটা ভুল ধারণা। তাই তাঁদের লেখা পুঁথিপত্র আমরা যদি বুঝতে চাই তাহলে আমাদের একালের ধ্যান-ধারণাগুলিকে তাঁদের লেখার উপর আরোপ করে বসলে প্রকাণ্ড ভুল হবে- ঠিক কী ভেবে তাঁরা কী লিখেছিলেন সে-কথা আমরা বুঝতেই পারবো না।’- (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১১০)
দেবীপ্রসাদ আরো বলেন (লোকায়ত দর্শন, পৃষ্ঠা-১১১), ‘তাঁদের মনে যে সত্যিই ওই রকমের একটা ধারণা ছিলো এ-কথার প্রমাণ শুধুই উপনিষদ নয়, ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিও। বরং ব্রাহ্মণগ্রন্থগুলিতে এই কথা এতোবার এবং এতো স্পষ্টভাবে তাঁরা লিখে রেখেছেন যে সেদিকে চোখ না পড়াটাই বিস্ময়কর। স্থানসংকুলানের খাতিরে আমরা এখানে মাত্র একটি নমুনার উল্লেখ করতে পারবো; উৎসাহী পাঠক…অন্যান্য বহু দৃষ্টান্তের উল্লেখ পাবেন। আমাদের এই দৃষ্টান্তটি ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রথম পঞ্চিকা প্রথম অধ্যায় থেকে সংগৃহিত, তর্জমা শ্রদ্ধেয় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর’ (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ/৬-৭) :
‘যে যজমান আপনাকে অপ্রতিষ্ঠিত মনে করে সে ঘৃতপক্ক চরু নির্বাপন করিবে। (অপ্রতিষ্ঠিত অর্থে, পুত্রাদিরহিত ও গবাদিরহিত)।
হে বৎস, যে এইরূপ প্রতিষ্ঠারহিত সে ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত (শ্লাঘ্য) হয় না। (ঘৃতচরুর দ্বারা সেই অপ্রতিষ্ঠার পরিহার হয়)।
তাহাতে (সেই ঘৃতপক্ক চরুতে) যে ঘৃত আছে তাহা স্ত্রীর পয়ঃ (শোনিতস্বরূপ) আর যে তণ্ডুল আছে তাহা পুরুষের (রেতঃ স্বরূপ); সেই ঘৃততন্ডুল মিথুন সদৃশ; সেই জন্য এই মিথুনদ্বারাই (ঘৃততন্ডুলময় চরুপ্রদানদ্বারা) ইহাকে (যজমানকে) সন্ততিদ্বারা ও পশুদ্বারা বর্ধিত করা হয়। (সেই হেতু এই চরু) প্রতিষ্ঠারই হেতু।’
এখানেও সেই একই ধারণার প্রতিচ্ছবি- মিথুন থেকে শুধুই যে সন্তান পাওয়া যাবে তাই নয়, পশু অর্থাৎ ধনসম্পদও। তার মানে, সে-যুগের যাঁরা জ্ঞানী তাঁদের ধারণায় ধনউৎপাদন আর প্রজনন এমন কিছু আলাদা ব্যাপার নয়। মিথুন থেকে শুধু সন্তান পাবার আশা নয়, পশুদ্বারা বর্ধিত হবার আশাও। আর এই বিশ্বাস যদি অটুট হয় তাহলে তাঁরা স্বভাবতই উপদেশ দেবেন : ‘ন কাঞ্চন পরিহরেৎ তদ্ ব্রতম্’, কোনো স্ত্রীলোককেই পরিহার করবে না- এই-ই ব্রত।
এখানে আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। এই ব্রাহ্মণমন্ত্রে ঋষি-কর্তৃক মিথুন-সদৃশ ঘৃততণ্ডুলের মধ্যে স্ত্রীর স্বরূপে যে ঘৃতের উপমা ব্যবহার করা হয়েছে এদিকে বেদপন্থী পণ্ডিত-দার্শনিকদের শ্যেন-দৃষ্টি যে-কোনো অদৃশ্য কারণে পিছলে গেলেও লোকায়ত চার্বাক-মতগোষ্ঠির নামে প্রচলিত প্রবাদ- ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋনং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো সুখেই বাঁচো, প্রয়োজন হলে ঋণ করেও ঘি খাও- উদ্ধৃত করে ভোগবাদিতার পরাকাষ্ঠায় নিন্দামুখর হয়ে তাঁরা লোকায়তিকদের উপর সম্মিলিতভাবে হামলে পড়তে কোন দ্বিধাবোধ করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আধুনিক কালের বেদপন্থী পণ্ডিতেরা বেদ-উপনিষদে এ-ধরনের লেখা আছে দেখে কী-ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেন? হয়তো বা এ-কারণে বিলক্ষণ বিরক্তিবোধ করতে পারেন। কেননা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জাতিগোষ্ঠির মধ্যে আদিম বিশ্বাসজনিত কামাচার বা বামাচারের স্বাক্ষর দেখে যেভাবে তাঁরা আধুনিক রুচি-বিগর্হিত অধঃপাতের নমুনা আবিষ্কার করেন, যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে বেদ-উপনিষদের রচয়িতাদের মধ্যে অত্যন্ত স্থূল আর কদর্য মনোবৃত্তি কল্পনা না করে উপায় থাকে কি? কিন্তু তাই বা কী করে বলা যায়? হাজার হোক, তাঁরা ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ঋষি ! ফলে আধুনিক বেদপন্থী পণ্ডিতদের পক্ষে হয়তো একমাত্র উপায় হলো ঋষিদের এই জাতীয় কথাবার্তাগুলিকে চেপে যাওয়া। এই প্রবণতার নমুনা খুঁজলে তার কমতি হবে না বলেই মনে হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিতজনেরা তাঁদের কথিত অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মে বামাচারের কদর্যতা প্রকাশ করতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করতে হয় বললেও অন্যদিকে বৈদিক সাহিত্যে প্রকটিত বামাচারের জ্বলজ্যান্ত স্মারকগুলি নিয়ে কোথাও কিছু বলেছেন কিনা জানা নেই। আর খুব একটা গুরুত্ববহ না হলেও অতি-সাম্প্রতিক একটা ভিন্নধরনের উদাহরণ এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে হয়। যেমন, ইতঃপূর্বে আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের ত্রয়োদশ খণ্ডে বর্ণিত বামদেব্য-ব্রতের (ছান্দোগ্য-২/১৩/১-২) শ্রুতিদ্বয় প্রয়োজনীয় তর্জমাসহ উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ কৃত ‘উপনিষদ’ দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের শঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যায় মূল সংস্কৃতে বামাদেব্য ব্রতের এই শ্রুতিদুটির উল্লেখ থাকলেও তার বাংলা তর্জমা দেয়া হয়েছে এভাবে-
‘উপরোক্ত মন্ত্র দুটির অন্তনির্হিত অর্থ হল, জাগতিক বলতে আমাদের কিছুই নেই। আমাদের সবকিছুই আধ্যাত্মিক, এমনকি দৈহিক অভিজ্ঞতাগুলিও।’- (উপনিষদ দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮২)
বাস্তবে কি তাই? প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের বক্তব্যগুলিকে এভাবে চেপে যাওয়া বা ভণিতার মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতিটাই যে ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, দেবীপ্রসাদের মতে, প্রাচীনেরা কী ভেবে কী লিখেছেন তা ঠিকমতো বুঝতে হলে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার যে প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন- তাই একালের ধ্যানধারণাগুলি তাঁদের মধ্যে কল্পনা করাটাই অসঙ্গত ও যুক্তিহীন।
বৈদিক সাহিত্যের মূল গ্রন্থাবলি অনেকটা দুষ্প্রাপ্য হলেও তবুও এখনো বিরল নয়, বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, প্রাচীন জড়বাদী চার্বাক-মতের নিজস্ব গ্রন্থাবলির বিলুপ্তিজনিত কারণে তাঁদের বিবৃতি ও বক্তব্য খুঁজে পেতে আমাদেরকে যখন বিরোধীপক্ষের গ্রন্থের উপরই নির্ভর করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে চার্বাক-মত নির্ধারণে সুনিশ্চিতভাবেই অদ্ভূত এক জটিলতার সম্মুখীন হতেই হয়, কোনটা তাঁদের প্রকৃত মত কিংবা কোনটা বিরোধীপক্ষের বিকৃত-উপস্থাপনের ভণিতা তা নির্ধারণের অসহায়তা।
তাই সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, আধুনিক কালের বেদপন্থী পণ্ডিতেরা বেদ-উপনিষদে এ-ধরনের লেখা আছে দেখে কী-ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেন? হয়তো বা এ-কারণে বিলক্ষণ বিরক্তিবোধ করতে পারেন। কেননা, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও জাতিগোষ্ঠির মধ্যে আদিম বিশ্বাসজনিত কামাচার বা বামাচারের স্বাক্ষর দেখে যেভাবে তাঁরা আধুনিক রুচি-বিগর্হিত অধঃপাতের নমুনা আবিষ্কার করেন, যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে বেদ-উপনিষদের রচয়িতাদের মধ্যে অত্যন্ত স্থূল আর কদর্য মনোবৃত্তি কল্পনা না করে উপায় থাকে কি? কিন্তু তাই বা কী করে বলা যায়? হাজার হোক, তাঁরা ছিলেন সত্যদ্রষ্টা ঋষি ! ফলে আধুনিক বেদপন্থী পণ্ডিতদের পক্ষে হয়তো একমাত্র উপায় হলো ঋষিদের এই জাতীয় কথাবার্তাগুলিকে চেপে যাওয়া। এই প্রবণতার নমুনা খুঁজলে তার কমতি হবে না বলেই মনে হয়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ পণ্ডিতজনেরা তাঁদের কথিত অধঃপতিত বৌদ্ধধর্মে বামাচারের কদর্যতা প্রকাশ করতে গেলে সভ্যতার সীমা অতিক্রম করতে হয় বললেও অন্যদিকে বৈদিক সাহিত্যে প্রকটিত বামাচারের জ্বলজ্যান্ত স্মারকগুলি নিয়ে কোথাও কিছু বলেছেন কিনা জানা নেই। আর খুব একটা গুরুত্ববহ না হলেও অতি-সাম্প্রতিক একটা ভিন্নধরনের উদাহরণ এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলে মনে হয়। যেমন, ইতঃপূর্বে আমরা ছান্দোগ্য উপনিষদের ত্রয়োদশ খণ্ডে বর্ণিত বামদেব্য-ব্রতের (ছান্দোগ্য-২/১৩/১-২) শ্রুতিদ্বয় প্রয়োজনীয় তর্জমাসহ উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ কৃত ‘উপনিষদ’ দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থে ছান্দোগ্য উপনিষদের শঙ্করভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যায় মূল সংস্কৃতে বামাদেব্য ব্রতের এই শ্রুতিদুটির উল্লেখ থাকলেও তার বাংলা তর্জমা দেয়া হয়েছে এভাবে-
‘উপরোক্ত মন্ত্র দুটির অন্তনির্হিত অর্থ হল, জাগতিক বলতে আমাদের কিছুই নেই। আমাদের সবকিছুই আধ্যাত্মিক, এমনকি দৈহিক অভিজ্ঞতাগুলিও।’- (উপনিষদ দ্বিতীয় ভাগ, পৃষ্ঠা-৮২)
বাস্তবে কি তাই? প্রাচীন বৈদিক ঋষিদের বক্তব্যগুলিকে এভাবে চেপে যাওয়া বা ভণিতার মাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতিটাই যে ভুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, দেবীপ্রসাদের মতে, প্রাচীনেরা কী ভেবে কী লিখেছেন তা ঠিকমতো বুঝতে হলে সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার যে প্রাচীনেরা ছিলেন প্রাচীন- তাই একালের ধ্যানধারণাগুলি তাঁদের মধ্যে কল্পনা করাটাই অসঙ্গত ও যুক্তিহীন।
বৈদিক সাহিত্যের মূল গ্রন্থাবলি অনেকটা দুষ্প্রাপ্য হলেও তবুও এখনো বিরল নয়, বহাল তবিয়তে বর্তমান আছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো, প্রাচীন জড়বাদী চার্বাক-মতের নিজস্ব গ্রন্থাবলির বিলুপ্তিজনিত কারণে তাঁদের বিবৃতি ও বক্তব্য খুঁজে পেতে আমাদেরকে যখন বিরোধীপক্ষের গ্রন্থের উপরই নির্ভর করতে হয়, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে চার্বাক-মত নির্ধারণে সুনিশ্চিতভাবেই অদ্ভূত এক জটিলতার সম্মুখীন হতেই হয়, কোনটা তাঁদের প্রকৃত মত কিংবা কোনটা বিরোধীপক্ষের বিকৃত-উপস্থাপনের ভণিতা তা নির্ধারণের অসহায়তা।
.
সে যাক, আমাদের মনোযোগের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো একই জড়বাদী দর্শনের বিভিন্ন নামকরণের প্রবনতা পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ চার্বাকই বার্হস্পত্য এবং বার্হস্পত্যই যে লোকায়ত, এ বিষয়টি ভারতীয় দর্শন ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সবসময়ই একে অন্যের সাথে যুক্ত হয়েই উপস্থাপিত হয়ে এসেছে। ফলে সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন থেকেই লোকায়ত মতের গভীরে চার্বাক দর্শনের আদি রূপটিকে খুঁজে দেখা যৌক্তিকভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে। হয়তো সেখানেই লুকিয়ে আছে চার্বাক দর্শনের মূল স্পন্দনটুকু। তবে লোকায়তিক আলোচনায় প্রবেশের আগে বৃহস্পতির সূত্র তথা বার্হস্পত্য-দর্শনের সাথে আরেকটু নিবিড় পরিচয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়।
Tags
চার্বাক দর্শন