জৈনমতে অজীবতত্ত্ব (Theory of Non-living)
জৈনমতে (Jainism) অস্তিকায় ও অনস্তিকায় এই দুই প্রকার দ্রব্যের মধ্যে অস্তিকায়কে দুই ভাগ করে জীব ও অজীব দেখানো হলেও কোন কোন জৈন দার্শনিকের মতে তত্ত্ব দুটি- জীব ও অজীব। জীব হচ্ছে বোধস্বরূপ এবং অজীব হচ্ছে চৈতন্যহীন অবোধস্বরূপ।
অস্তিকায় অজীব চার প্রকার- পুদ্গল, আকাশ, ধর্ম, অধর্ম। আর অনস্তিকায় অজীব একটিই, কাল। অতএব অজীব তত্ত্ব মোট পাঁচটি। এই অজীব হচ্ছে জীবনহীন ও জ্ঞানহীন।
.
(১) পুদ্গল (matter) : জৈনমতে ভৌতিক দ্রব্য হচ্ছে পুদ্গল। ‘যার সংযোজন বা সংশ্লেষ ও বিভাজন বা বিশ্লেষ হতে পারে’, জৈন মতানুসারে তাকেই পুদ্গল বলা হয়েছে। জৈনগ্রন্থে পুদ্গল শব্দের বুৎপত্তি করা হয়েছে-
‘পূরয়ন্তি গলন্তি চ’।
অর্থাৎ : যা পূর্ণ হয় ও গলে যায়। অর্থাৎ, যা সংযোগ ও বিভাগযোগ্য তাই পুদ্গল।
এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যার প্রচয়ের দ্বারা শরীরের নিষ্পাদন ও যার প্রচয়নাশের দ্বারা শরীরের নাশ হয় সেই দ্রব্যই হচ্ছে পুদ্গল। সাধারণতঃ পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু এই চারটি ভূত দ্রব্যে পুদ্গল শব্দের প্রয়োগ হয়ে থাকে। যা কিছু আমরা দেখি, ছুঁই, শুনি, খাই, পান করি অর্থাৎ যাতে রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ এই চারটি গুণ উপলব্ধ হয় তাই পুদ্গল। তাই জৈনাচার্য উমাস্বাতি বলেছেন-
‘স্পর্শরসগন্ধবর্ণবন্তঃ পুদ্গলাঃ।’- (তত্ত্বার্থাধিগমসূত্র-৫/২৩)
অর্থাৎ : যাতে রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ এই চারটি গুণ উপলব্ধ হয় তাকে পুদ্গল বলে।
পুদ্গল হচ্ছে মূর্ত দ্রব্য, অবশিষ্ট দ্রব্য হচ্ছে অমূর্ত। বৌদ্ধরা আত্মা বুঝাতে পুদ্গল শব্দের ব্যবহার করলেও জৈনগণ জড় পদার্থকে বুঝাতে পুদ্গলের ব্যবহার করেছেন।
.
জৈনদের পুদ্গল-কল্পনা ন্যায়দর্শনের পরমাণু-কল্পনা হতে ভিন্ন। ন্যায়মতে পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু এই চারটি দ্রব্য ভিন্ন ভিন্ন, তাদের উৎপাদক পরমাণু ভিন্ন এবং চার প্রকার। এ বিষয়ে জৈনদের মান্যতায় সকল পরমাণু একজাতীয় এবং সর্বত্র উক্ত রূপাদি চারটি গুণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাদের দ্বারা নিষ্পন্ন (=নির্মিত) দ্রব্যে সকল গুণের অভিব্যক্তি হয় না। পুদ্গল-পরমাণুতে পরস্পর ভেদ হয় না বলে পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ুর পরমাণু হতে চারটি দ্রব্য হয় না, বরং একটি দ্রব্যই হয়, যার নাম পুদ্গল।
.
পুদ্গল দুই প্রকার- অণু বা পরমাণু (atom) ও সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ (compound)। উপনিষদে ‘অণু’ শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখা গেলেও জৈনদর্শনেই প্রথম অণুতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে, বেদান্তে হয় নি। জৈনদর্শনে অণু ও পরমাণু শব্দ দু’টির কোন ভিন্ন অর্থ নেই, বরং একই অর্থে বা পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। যা স্বয়ং আদি, মধ্য ও অন্তরূপ এবং যা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহীত হয় না এবং যার বিভাগ হয় না তাকে পরমাণু বলে। পুদ্গলের সর্বক্ষুদ্র অবিভাজ্য অংশ পরমাণু। একই প্রদেশকে ব্যাপ্ত করে থাকায় পরমাণুর অন্য কোন ভাগ থাকে না।
অনেক অণু বা পরমাণুর পরস্পর মিলনে যে দ্রব্য তৈরি হয় তাকে সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ বলে। জৈনদের এই স্কন্ধের ধারণা বৌদ্ধদর্শনের জীবনের পঞ্চ তত্ত্বরূপ স্কন্ধ হতে ভিন্ন।
.
দু’টি অণুর (=পরমাণুর) সংযোগে দ্ব্যণুক (dyad), তিনটি দ্ব্যণুকের মিলনে ত্র্যণুক (triad), চারটি ত্র্যণুকের মিলনে চতুরণুক ইত্যাদি ক্রমে বিশাল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো বিশ্লেষ ও সংশ্লেষ উভয়ের মিলিত প্রক্রিয়ার সাহায্যে সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ এই রূপের (=আকৃতির) উৎপত্তি হয়। ঘটপটাদির ন্যায় সকল স্থূল দ্রব্য হলো সংঘাত।
অণু ও সঙ্ঘাত উভয় প্রকার দ্রব্যেরই আকর্ষণী ও বিকর্ষণী শক্তি আছে। আকর্ষণ ও বিকর্ষণের দ্বারা একাধিক অণু সংযুক্ত হয়ে যেমন স্কন্ধ দ্রব্য উৎপন্ন হয়, তেমনি একাধিক স্কন্ধ দ্রব্য মিলে বৃহত্তর স্কন্ধ দ্রব্য উৎপন্ন হয়। জৈনমতে আমাদের দেহ, মন, বাক্, প্রাণ ও শ্বাস-প্রশ্বাস জড়ের দ্বারাই সৃষ্ট। অণুদ্রব্য অমূর্ত, অংশবিহীন, নিত্য ও অসংখ্য। সাধারণ জীবের প্রত্যক্ষের অগোচর হলেও অণু কেবলজ্ঞানীর প্রত্যক্ষের গোচর। এ কারণে জৈনরা অণুদ্রব্যের রূপ স্বীকার করেন।
.
পৌদ্গলিক অণুতে ও স্কন্ধে স্পর্শ, রস, গন্ধ ও বর্ণ (=রূপ) এই চারটি গুণ থাকে। জৈনমতে ‘শব্দ’ কোন মৌলিক ভূতগুণ নয়। এটা স্থূলত্ব, সূক্ষ্মত্ব প্রভৃতির মতো পুদ্গলের অবান্তর পরিণাম মাত্র। এই মতানুসারে শব্দকে স্কন্ধের আগন্তুক গুণ বলা হয়। তাঁদের মতে কর্মও পুদ্গলের সূক্ষ্মরূপ। শুভাশুভ কর্মরূপ অণুপুদ্গল জীবের স্বরূপ আচ্ছাদন করে থাকে। এই কর্মপুদ্গল হতে মুক্তিলাভই জীবের উদ্দেশ্য।
.
(২) ধর্ম (motion) : সাধারণত ধর্ম ও অধর্মের অর্থ পুণ্য ও পাপরূপ দু’টি গুণবিশেষ। কিন্তু জৈনদর্শনে বিশেষ পারিভাষিক অর্থে তাদের প্রয়োগ করা হয়েছে। জৈনমতে ধর্ম ও অধর্ম হচ্ছে দ্রব্য। ধর্ম হলো গতির অনুকূল এবং অধর্ম হলো গতির প্রতিকূল বা স্থিতির অনুকূল। ধর্ম ও অধর্ম যথাক্রমে গতি ও স্থিতির সহায়ক হলেও এরা গতি ও স্থিতির উৎপাদক নয়, এমন কি ধর্ম ও অধর্ম গতি ও স্থিতির মুখ্য কারণও নয়, সহকারি কারণমাত্র। কাল ও আকাশের ন্যায় এই ধর্ম ও অধর্মও প্রত্যক্ষের অযোগ্য। অনুমানের সাহায্যেই এদের অস্তিত্ব জানা সম্ভব।
.
জৈনদের পুদ্গল-কল্পনা ন্যায়দর্শনের পরমাণু-কল্পনা হতে ভিন্ন। ন্যায়মতে পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু এই চারটি দ্রব্য ভিন্ন ভিন্ন, তাদের উৎপাদক পরমাণু ভিন্ন এবং চার প্রকার। এ বিষয়ে জৈনদের মান্যতায় সকল পরমাণু একজাতীয় এবং সর্বত্র উক্ত রূপাদি চারটি গুণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাদের দ্বারা নিষ্পন্ন (=নির্মিত) দ্রব্যে সকল গুণের অভিব্যক্তি হয় না। পুদ্গল-পরমাণুতে পরস্পর ভেদ হয় না বলে পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ুর পরমাণু হতে চারটি দ্রব্য হয় না, বরং একটি দ্রব্যই হয়, যার নাম পুদ্গল।
.
পুদ্গল দুই প্রকার- অণু বা পরমাণু (atom) ও সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ (compound)। উপনিষদে ‘অণু’ শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখা গেলেও জৈনদর্শনেই প্রথম অণুতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে, বেদান্তে হয় নি। জৈনদর্শনে অণু ও পরমাণু শব্দ দু’টির কোন ভিন্ন অর্থ নেই, বরং একই অর্থে বা পরিভাষায় ব্যবহৃত হয়েছে। যা স্বয়ং আদি, মধ্য ও অন্তরূপ এবং যা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গৃহীত হয় না এবং যার বিভাগ হয় না তাকে পরমাণু বলে। পুদ্গলের সর্বক্ষুদ্র অবিভাজ্য অংশ পরমাণু। একই প্রদেশকে ব্যাপ্ত করে থাকায় পরমাণুর অন্য কোন ভাগ থাকে না।
অনেক অণু বা পরমাণুর পরস্পর মিলনে যে দ্রব্য তৈরি হয় তাকে সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ বলে। জৈনদের এই স্কন্ধের ধারণা বৌদ্ধদর্শনের জীবনের পঞ্চ তত্ত্বরূপ স্কন্ধ হতে ভিন্ন।
.
দু’টি অণুর (=পরমাণুর) সংযোগে দ্ব্যণুক (dyad), তিনটি দ্ব্যণুকের মিলনে ত্র্যণুক (triad), চারটি ত্র্যণুকের মিলনে চতুরণুক ইত্যাদি ক্রমে বিশাল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো বিশ্লেষ ও সংশ্লেষ উভয়ের মিলিত প্রক্রিয়ার সাহায্যে সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ এই রূপের (=আকৃতির) উৎপত্তি হয়। ঘটপটাদির ন্যায় সকল স্থূল দ্রব্য হলো সংঘাত।
অণু ও সঙ্ঘাত উভয় প্রকার দ্রব্যেরই আকর্ষণী ও বিকর্ষণী শক্তি আছে। আকর্ষণ ও বিকর্ষণের দ্বারা একাধিক অণু সংযুক্ত হয়ে যেমন স্কন্ধ দ্রব্য উৎপন্ন হয়, তেমনি একাধিক স্কন্ধ দ্রব্য মিলে বৃহত্তর স্কন্ধ দ্রব্য উৎপন্ন হয়। জৈনমতে আমাদের দেহ, মন, বাক্, প্রাণ ও শ্বাস-প্রশ্বাস জড়ের দ্বারাই সৃষ্ট। অণুদ্রব্য অমূর্ত, অংশবিহীন, নিত্য ও অসংখ্য। সাধারণ জীবের প্রত্যক্ষের অগোচর হলেও অণু কেবলজ্ঞানীর প্রত্যক্ষের গোচর। এ কারণে জৈনরা অণুদ্রব্যের রূপ স্বীকার করেন।
.
পৌদ্গলিক অণুতে ও স্কন্ধে স্পর্শ, রস, গন্ধ ও বর্ণ (=রূপ) এই চারটি গুণ থাকে। জৈনমতে ‘শব্দ’ কোন মৌলিক ভূতগুণ নয়। এটা স্থূলত্ব, সূক্ষ্মত্ব প্রভৃতির মতো পুদ্গলের অবান্তর পরিণাম মাত্র। এই মতানুসারে শব্দকে স্কন্ধের আগন্তুক গুণ বলা হয়। তাঁদের মতে কর্মও পুদ্গলের সূক্ষ্মরূপ। শুভাশুভ কর্মরূপ অণুপুদ্গল জীবের স্বরূপ আচ্ছাদন করে থাকে। এই কর্মপুদ্গল হতে মুক্তিলাভই জীবের উদ্দেশ্য।
.
(২) ধর্ম (motion) : সাধারণত ধর্ম ও অধর্মের অর্থ পুণ্য ও পাপরূপ দু’টি গুণবিশেষ। কিন্তু জৈনদর্শনে বিশেষ পারিভাষিক অর্থে তাদের প্রয়োগ করা হয়েছে। জৈনমতে ধর্ম ও অধর্ম হচ্ছে দ্রব্য। ধর্ম হলো গতির অনুকূল এবং অধর্ম হলো গতির প্রতিকূল বা স্থিতির অনুকূল। ধর্ম ও অধর্ম যথাক্রমে গতি ও স্থিতির সহায়ক হলেও এরা গতি ও স্থিতির উৎপাদক নয়, এমন কি ধর্ম ও অধর্ম গতি ও স্থিতির মুখ্য কারণও নয়, সহকারি কারণমাত্র। কাল ও আকাশের ন্যায় এই ধর্ম ও অধর্মও প্রত্যক্ষের অযোগ্য। অনুমানের সাহায্যেই এদের অস্তিত্ব জানা সম্ভব।
.
জৈনমতে ষড় দ্রব্যের অন্তর্গত গতিশীল জীব ও পুদ্গলের গতি ও উন্নতির সহকারি কারণ হচ্ছে ধর্ম। ধর্মের স্বরূপ বুঝানোর জন্য জৈনগ্রন্থে জলের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। মৎস্য গতিশীল জীব হলেও জল বিনা যেমন তার গতি সিদ্ধ হয় না, তেমনি জীব ও পুদ্গলের গতি ও উন্নতি ধর্ম ব্যতিরেকে সিদ্ধ হয় না। ধর্ম হচ্ছে রূপরসাদি রহিত অমূর্ত গতিশীল দ্রব্য। গতি ও উন্নতির জন্য যে সহায়ক বস্তুর আবশ্যক হয় তাকে ধর্ম বলে। উপরোক্ত উদাহরণে জল হচ্ছে ধর্ম। জলে মাছ সাঁতার কেটে বড় হয়। জল না থাকলে মাছে গতি সম্ভব হতো না। এভাবে জীবের গতিতে ধর্ম হচ্ছে সহায়ক বা উপকারক।
.
(৩) অধর্ম (rest) : অধর্ম হচ্ছে ধর্মের বিপরীত। জীব ও পুদ্গলের স্থিতির সহকারি কারণ হচ্ছে অধর্ম। ধর্মের মতো অধর্মও প্রেরক দ্রব্য নয়। অধর্ম কিছুকে থামতে বলপূর্বক প্রেরণা দেয় না। জীব ও পুদ্গল তো স্বয়ংই থামতে পারে, অধর্ম তাতে কেবল সহায়তা করে। কোন বস্তুকে স্থির রাখতে যা উপকার বা সহায়তা করে তাকে অধর্ম বলে। উদাহরণস্বরূপ, কোন ক্লান্ত ব্যক্তি বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়াতে আশ্রয় নিলে গাছের ছায়া তাকে বিশ্রামে সহায়তা করে। যা দ্রব্যের বিশ্রাম ও স্থিতিতে সহায়ক তা হচ্ছে অধর্ম। অধর্মের অবয়ব নেই, তা অমূর্ত।
ধর্মের মতো অধর্মও নিত্য দ্রব্য। তিলে তৈলের মতো লোকাকাশে সর্বত্র ধর্ম ও অধর্মের অবস্থান, যা সূত্রকার উমাস্বাতি ‘তত্ত্বার্থাধিগমসূত্রে’-(৫/১৩) বলেছেন। গতি ও স্থিতি হচ্ছে জীবের পরিণাম বিশেষ। ধর্ম প্রবৃত্তির দ্বারা অনুমেয় এবং অধর্ম স্থিতির দ্বারা অনুমেয়। এই উভয়ের প্রত্যক্ষ হয় না। তাই ধর্ম ও অধর্ম প্রত্যক্ষ না হলেও গতি ও স্থিতির দ্বারা অনুমান হয়।
.
(৪) আকাশ (space) : আকাশ হচ্ছে নিত্য দ্রব্য। জৈনাচার্য উমাস্বাতি বলেছেন-
.
(৩) অধর্ম (rest) : অধর্ম হচ্ছে ধর্মের বিপরীত। জীব ও পুদ্গলের স্থিতির সহকারি কারণ হচ্ছে অধর্ম। ধর্মের মতো অধর্মও প্রেরক দ্রব্য নয়। অধর্ম কিছুকে থামতে বলপূর্বক প্রেরণা দেয় না। জীব ও পুদ্গল তো স্বয়ংই থামতে পারে, অধর্ম তাতে কেবল সহায়তা করে। কোন বস্তুকে স্থির রাখতে যা উপকার বা সহায়তা করে তাকে অধর্ম বলে। উদাহরণস্বরূপ, কোন ক্লান্ত ব্যক্তি বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়াতে আশ্রয় নিলে গাছের ছায়া তাকে বিশ্রামে সহায়তা করে। যা দ্রব্যের বিশ্রাম ও স্থিতিতে সহায়ক তা হচ্ছে অধর্ম। অধর্মের অবয়ব নেই, তা অমূর্ত।
ধর্মের মতো অধর্মও নিত্য দ্রব্য। তিলে তৈলের মতো লোকাকাশে সর্বত্র ধর্ম ও অধর্মের অবস্থান, যা সূত্রকার উমাস্বাতি ‘তত্ত্বার্থাধিগমসূত্রে’-(৫/১৩) বলেছেন। গতি ও স্থিতি হচ্ছে জীবের পরিণাম বিশেষ। ধর্ম প্রবৃত্তির দ্বারা অনুমেয় এবং অধর্ম স্থিতির দ্বারা অনুমেয়। এই উভয়ের প্রত্যক্ষ হয় না। তাই ধর্ম ও অধর্ম প্রত্যক্ষ না হলেও গতি ও স্থিতির দ্বারা অনুমান হয়।
.
(৪) আকাশ (space) : আকাশ হচ্ছে নিত্য দ্রব্য। জৈনাচার্য উমাস্বাতি বলেছেন-
‘আ আকাশাদেকদ্রব্যাণি’।- (তত্ত্বার্থাধিগমসূত্র-৫/৬)
‘নিষ্ক্রিয়াণি চ’।- (তত্ত্বার্থাধিগমসূত্র-৫/৭)
অর্থাৎ : আকাশ এক ও ক্রিয়াহীন দ্রব্য, নিশ্চল।
জৈনমতে কাল ব্যতীত সকল দ্রব্যই বিস্তৃতিযুক্ত হওয়ায় আকাশ কাল ব্যতীত সর্বদ্রব্যেরই আশ্রয়। তাই এই মতানুসারে যা ধর্ম, অধর্ম, জীব ও পুদ্গল এই সকল বিস্তারযুক্ত অস্তিকায় দ্রব্যকে স্থান বা অবকাশ দেয় তাকে আকাশ বলা হয়। আকাশের কোন মূর্তি নেই এবং তা সর্বব্যাপি। এই আকাশকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় না। সুতরাং আকাশ অদৃশ্য। আকাশ অমূর্ত বলে বস্তুর বিস্তৃতি থেকে তার জ্ঞান অনুমানের দ্বারা পাওয়া যায়। আকাশের গুণ অবগাহ। এক বস্তুপ্রদেশের মধ্যে অন্য বস্তুর প্রবেশ হচ্ছে অবগাহ। এই অবগাহ হচ্ছে আকাশের কাজ।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ভারতীয় কোন দর্শনসম্প্রদায়ই ‘আকাশ’ বলতে শুধু শূন্যাকাশকে বোঝাননি, বিস্তৃতির ধারণার সঙ্গে আকাশকে যুক্ত করে (দেশ) বুঝিয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় দর্শনে দেশ ও কালের উপর বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
.
জৈনমতে আকাশ দুই প্রকার- লোকাকাশ (বিস্তৃতি) ও অলোকাকাশ (শূন্যাকাশ)। লোকাকাশ বিস্তৃতিযুক্ত দ্রব্যের অধিষ্ঠান, কিন্তু অলোকাকাশ বস্তুশূন্য, শুদ্ধ, নিত্য ও অমূর্ত। লোকাকাশ প্রসঙ্গে উমাস্বাতি বলেছেন-
‘ধর্মধর্ময়োঃ কৃৎস্নে’।- (তত্ত্বার্থাধিগমসূত্র-৫/১৩)
অর্থাৎ : লোকাকাশে জীব, পুদ্গল, ধর্ম ও অধর্ম নিবাস করে।
এই আকাশে ছয়টি দ্রব্য থাকে। অলোকাকাশ হচ্ছে জগতের বাইরে। এখানে কেবল আকাশ দ্রব্যই পাওয়া যায়, আকাশের চারদিকে সর্বব্যাপি অলোকাকাশ। লোকাকাশের উর্ধ্বে সিদ্ধশিলায় মুক্ত জীব নিবাস করে বলে জৈনরা বলে থাকেন।
.
(৫) কাল (time) : জৈনমতে বস্তু মাত্রেই প্রতিক্ষণে পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সহায়ক হচ্ছে কাল। পরিবর্তনের অনুকূলে যে পৌদ্গলিক দ্রব্য কারণ হয় তাকে কাল বলা হয়। যদিও পরিবর্তনকারী শক্তি সকল পদার্থেই থাকে, কিন্তু এই শক্তি কালের সহায়তা ছাড়া প্রকাশ হতে পারে না। জগতে নিয়ত পরিবর্তনশীল পদার্থের পরিবর্তনে কাল সহায়তা করে, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য বস্তুকে প্রেরিত করে না। কালের সাহায্যে গতির ব্যাখ্যাও করা যায়। একটি খেলার বলকে একস্থানে দেখার কিছুক্ষণ পর অন্য স্থানে দেখা যায়। সুতরাং দ্রব্যের পরিণাম (modification) ও ক্রিয়াশীলতার (action) ব্যাখ্যা কালের দ্বারা সম্ভব।
.
(৫) কাল (time) : জৈনমতে বস্তু মাত্রেই প্রতিক্ষণে পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের সহায়ক হচ্ছে কাল। পরিবর্তনের অনুকূলে যে পৌদ্গলিক দ্রব্য কারণ হয় তাকে কাল বলা হয়। যদিও পরিবর্তনকারী শক্তি সকল পদার্থেই থাকে, কিন্তু এই শক্তি কালের সহায়তা ছাড়া প্রকাশ হতে পারে না। জগতে নিয়ত পরিবর্তনশীল পদার্থের পরিবর্তনে কাল সহায়তা করে, কিন্তু পরিবর্তনের জন্য বস্তুকে প্রেরিত করে না। কালের সাহায্যে গতির ব্যাখ্যাও করা যায়। একটি খেলার বলকে একস্থানে দেখার কিছুক্ষণ পর অন্য স্থানে দেখা যায়। সুতরাং দ্রব্যের পরিণাম (modification) ও ক্রিয়াশীলতার (action) ব্যাখ্যা কালের দ্বারা সম্ভব।
.
কালের প্রত্যক্ষ হয় না। বর্তনা (continuity), পরিণাম (modification), ক্রিয়া (activity), পরত্ব (now, new), অপরত্ব (then, old) এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের দ্বারা কালের অনুমান হয়। কাল অণুলোকাকাশে সর্বত্র বিদ্যমান থাকে।
.
কাল এক ও অবিভাজ্য। কিন্তু কোন কোন জৈনমতে কাল দুই প্রকার- পারমার্থিক (real) ও ব্যবহারিক (empirical)। পারমার্থিক কাল অনন্ত, অবিভাজ্য, নিত্য, নিরবয়ব ও এক। অন্যদিকে ক্ষণ, মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন, মাস, বৎসর ইত্যাদি ভেদে ব্যবহারিক কালের অবয়ব কল্পিত হয়। কিন্তু পারমার্থিক কালের অবয়ব নেই, তা হচ্ছে অমূর্ত।
.
জৈনদর্শনে ছয়টি দ্রব্য স্বীকার করা হয়। এর মধ্যে কাল বাদে অন্য পাঁচটি দ্রব্য হলো অস্তিকায়। ‘অস্তি’ শব্দের অর্থ বিদ্যমান, ‘কায়’ শব্দের অর্থ দেহ, শরীর। ‘অস্তিকায়’ শব্দের তাৎপর্য হলো দেহ বা প্রদেশে বিদ্যমান পদার্থ। জীব, পুদ্গল, আকাশ, ধর্ম ও অধর্ম বহুপ্রদেশী। সেকারণে এই পাঁচটি তত্ত্ব হচ্ছে অস্তিকায়। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান তিন কালের সাথে সম্মন্ধযুক্ত বলে তাদের স্থিতি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং অনেক স্থান ব্যাপ্ত করে থাকে বলে কায়ের মত হওয়ায় ব্যাপ্তিবোধক ‘কায়’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। কালে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং স্থানে বা দেশে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘কায়’ শব্দ। ‘অস্তিকায়ে’র বিপরীত হচ্ছে ‘অনস্তিকায়’। একমাত্র কাল-ই (time) হলো অনস্তিকায় বা একদেশব্যাপি দ্রব্য।
.
৩.৩ : জৈনমতে জীবতত্ত্ব (Theory of Self / Soul)
কালের প্রত্যক্ষ হয় না। বর্তনা (continuity), পরিণাম (modification), ক্রিয়া (activity), পরত্ব (now, new), অপরত্ব (then, old) এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের দ্বারা কালের অনুমান হয়। কাল অণুলোকাকাশে সর্বত্র বিদ্যমান থাকে।
.
কাল এক ও অবিভাজ্য। কিন্তু কোন কোন জৈনমতে কাল দুই প্রকার- পারমার্থিক (real) ও ব্যবহারিক (empirical)। পারমার্থিক কাল অনন্ত, অবিভাজ্য, নিত্য, নিরবয়ব ও এক। অন্যদিকে ক্ষণ, মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন, মাস, বৎসর ইত্যাদি ভেদে ব্যবহারিক কালের অবয়ব কল্পিত হয়। কিন্তু পারমার্থিক কালের অবয়ব নেই, তা হচ্ছে অমূর্ত।
.
জৈনদর্শনে ছয়টি দ্রব্য স্বীকার করা হয়। এর মধ্যে কাল বাদে অন্য পাঁচটি দ্রব্য হলো অস্তিকায়। ‘অস্তি’ শব্দের অর্থ বিদ্যমান, ‘কায়’ শব্দের অর্থ দেহ, শরীর। ‘অস্তিকায়’ শব্দের তাৎপর্য হলো দেহ বা প্রদেশে বিদ্যমান পদার্থ। জীব, পুদ্গল, আকাশ, ধর্ম ও অধর্ম বহুপ্রদেশী। সেকারণে এই পাঁচটি তত্ত্ব হচ্ছে অস্তিকায়। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান তিন কালের সাথে সম্মন্ধযুক্ত বলে তাদের স্থিতি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং অনেক স্থান ব্যাপ্ত করে থাকে বলে কায়ের মত হওয়ায় ব্যাপ্তিবোধক ‘কায়’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। কালে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং স্থানে বা দেশে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘কায়’ শব্দ। ‘অস্তিকায়ে’র বিপরীত হচ্ছে ‘অনস্তিকায়’। একমাত্র কাল-ই (time) হলো অনস্তিকায় বা একদেশব্যাপি দ্রব্য।
.
৩.৩ : জৈনমতে জীবতত্ত্ব (Theory of Self / Soul)
.
জৈনদর্শনে দ্রব্যকে প্রধানত দু’টি বর্গে বিভক্ত করা হয়েছে- জীব ও অজীব। জীব হচ্ছে প্রথম বর্গ। তবে অন্যান্য ভারতীয় দর্শনে যে সত্তাকে আত্মা কল্পনা করা হয়েছে জৈনদর্শনে তাকে জীব বলা হয়েছে। অর্থাৎ জীব ও আত্মা একই সত্তার ভিন্ন দু’টি নাম।
জৈনমতে চেতনদ্রব্যকে জীব বলা হয়। জৈন সূত্রকার উমাস্বাতি বলেছেন-
জৈনদর্শনে দ্রব্যকে প্রধানত দু’টি বর্গে বিভক্ত করা হয়েছে- জীব ও অজীব। জীব হচ্ছে প্রথম বর্গ। তবে অন্যান্য ভারতীয় দর্শনে যে সত্তাকে আত্মা কল্পনা করা হয়েছে জৈনদর্শনে তাকে জীব বলা হয়েছে। অর্থাৎ জীব ও আত্মা একই সত্তার ভিন্ন দু’টি নাম।
জৈনমতে চেতনদ্রব্যকে জীব বলা হয়। জৈন সূত্রকার উমাস্বাতি বলেছেন-
‘চেতনালক্ষণো জীবঃ’। (তত্ত্বার্থাধিগমসূত্র)
অর্থাৎ : চৈতন্যই হচ্ছে জীবের মূল লক্ষণ।
তাতে কোন গন্ধ বা রূপ থাকে না। তা শব্দরূপও নয়, কোন ভৌতিক চিহ্ন নয় কিংবা কোন আকারযুক্ত নয়। চৈতন্য গুণবিশিষ্ট দ্রব্যই হচ্ছে জীব। এই চৈতন্য সর্বদা জীবে বর্তমান থাকে। চৈতন্যের অভাবে জীবের কল্পনা করা সম্ভব নয়। সেকারণে সকল অবস্থায় জীবের স্বরূপধর্ম চৈতন্য হওয়ায় চেতনালক্ষণকে জীব বলা হয়েছে।
.
এই চেতনালক্ষণ হচ্ছে জ্ঞান। চৈতন্যকে আত্মার গুণ ও স্বরূপ বলা হয়েছে। অতএব যে আত্মার জ্ঞান আছে তাকে জীব বলে। কিন্তু শুধু চেতনাযুক্ত বা জ্ঞানী বলে মেনে নিলেই তা জৈনদের অনেকান্তবাদ সম্মত হয় না। সেকারণে বলা হয়, গুণ দ্রব্যের সাথে ভিন্নভাবে থাকতে পারে, কিন্তু স্বরূপকে সেভাবে দ্রব্য হতে ভিন্ন ভাবা যায় না। এ প্রসঙ্গে তাই জৈন গ্রন্থ ‘স্বরূপসম্বোধনে’ বলা হয়েছে-
.
এই চেতনালক্ষণ হচ্ছে জ্ঞান। চৈতন্যকে আত্মার গুণ ও স্বরূপ বলা হয়েছে। অতএব যে আত্মার জ্ঞান আছে তাকে জীব বলে। কিন্তু শুধু চেতনাযুক্ত বা জ্ঞানী বলে মেনে নিলেই তা জৈনদের অনেকান্তবাদ সম্মত হয় না। সেকারণে বলা হয়, গুণ দ্রব্যের সাথে ভিন্নভাবে থাকতে পারে, কিন্তু স্বরূপকে সেভাবে দ্রব্য হতে ভিন্ন ভাবা যায় না। এ প্রসঙ্গে তাই জৈন গ্রন্থ ‘স্বরূপসম্বোধনে’ বলা হয়েছে-
‘জ্ঞানাদ্ ভিন্নো ন চাভিন্নো ভিন্নাভিন্নোঃ কথাশ্চন।জ্ঞানম্ পূর্বপরিভূতম্ সোত্যমাত্মেতি কীর্ত্তিতঃ।।’অর্থাৎ : যা জ্ঞান থেকে ভিন্ন, আবার অভিন্ন নয়, কোনো মতেই ভিন্ন-এবং-অভিন্ন নয়, যে জ্ঞান পূর্বাপর (=সর্বাবস্থায়) তাই আত্মা।
.
তার ব্যাখ্যায় জৈনরা আরো বলেন, চৈতন্য হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক অবস্থা। তাই জীবের অবস্থাবিশেষ হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানই জীবের অবস্থাবিশেষ বলে জীব জ্ঞান হতে অত্যন্ত ভিন্ন নয়। আবার আত্মা বা জীবের জ্ঞান- এরূপ সম্বন্ধের প্রয়োগ হয় বলে জীবকে জ্ঞান থেকে অত্যন্ত অভিন্ন বলা চলে না। অত্যন্ত অভিন্ন হলে আত্মা বা জীবই জ্ঞান বলা হতো। সুতরাং জৈন-স্যাদবাদ অনুসারে কোনভাবে আত্মা বা জ্ঞান হচ্ছে ভিন্নাভিন্ন। আত্মার প্রথম অবস্থা ও পরবর্তী অবস্থা- সকল অবস্থাতেই জ্ঞান বা চৈতন্য থাকে, এই হচ্ছে আত্মার স্বরূপ।
.
এখানে প্রশ্ন আসে, ভেদ ও অভেদ এই উভয়ের একটি যেখানে থাকে সেখানে অন্যটি থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং জীবের জ্ঞান হতে ভিন্ন ও অভিন্নরূপ উভায়াত্মকভাব সিদ্ধ হয় না।
উত্তরে জৈনরা বলেন, একটি থাকলে অন্য একটি থাকবে না, এরূপ কোন বাধক প্রমাণ নেই। একত্র ভেদ ও অভেদের অনুপলব্ধি হচ্ছে বাধক প্রমাণ, তা বলা সমীচীন নয়। কেননা সমস্ত বস্তু অনেকান্তরূপ হয় বলে স্যাদবাদী জৈনমতে তা স্বীকৃত। অতএব আত্মা কোনভাবে জ্ঞানের সাথে অভিন্ন ও ভিন্ন বলে সিদ্ধ হয়।
.
জৈনদের এই জীবসম্পর্কিত বিচার ন্যায়বৈশেষিকদের আত্মার বিচার হতে ভিন্ন। ন্যায়বৈশেষিকরা চৈতন্যকে আত্মার আগন্তুক গুণ (accidental property) বলেন। তাঁদের মতে আত্মা স্বভাবত অচেতন। কিন্তু শরীর, ইন্দ্রিয়, প্রাণ প্রভৃতি যুক্ত হলে আত্মায় চেতনার (=চৈতন্যের) সঞ্চার হয়।
অন্যদিকে জৈনমতে চৈতন্যকে জীবের আবশ্যক গুণ (essential property) বা স্বভাব মনে করা হয়। চৈতন্যকে জীবের গুণ বলা হয়েছে, আবার স্বরূপও বলা হয়েছে। গুণকে যেমন দ্রব্যভিন্ন বলে মনে করা হয়, স্বরূপকে তা ভাবা যায় না। তাই জীব চৈতন্য (=জ্ঞান) হতে ভিন্নও নয়, অভিন্নও নয়- অর্থাৎ কোনরূপে ভিন্ন এবং অন্যরূপে অভিন্ন। এই জ্ঞান পূর্বাপরভাবে (=সর্বাবস্থায়) অবস্থিত এবং তা-ই হচ্ছে জীব।
.
জ্ঞানে ও দর্শনে চৈতন্য উপলব্ধ হয় বলে, যে জানে ও দেখে সে হচ্ছে জীব। চৈতন্য জীবে সর্বদা অনুভূত হয় বলে জীবকে প্রকাশমান বলা হয়েছে। জৈনরা জীবকে প্রদীপের সাথে তুলনা করে বলেন, জীব প্রদীপের প্রকাশের মতো নিজেকে ও অন্য বস্তুকে প্রকাশিত করে। প্রকাশের কোন আকার থাকে না, কিন্তু যে কক্ষকে সে আলোকিত করে সেই কক্ষের আকার ধারণ করে। জীব প্রকাশের মতো অমূর্ত হলেও মূর্তি (=আকার) গ্রহণ করতে পারে। জৈনমতে জীব (=আত্মা) সর্বব্যাপি নয়, আবার বৈশেষিক মতের ‘মন’ এর মতো অণু পরিমাণও নয়, মধ্য সমপরিমাণী। অর্থাৎ শরীর যত বড় আত্মাও তত বড়। এই মতে শরীরকে জীবের অধিকরণ (=আধার) বলা হয়। তাই জীব যে শরীরে নিবাস করে তার আকার অনুসারে আকার গ্রহণ করে। হস্তির দেহে তার সমপরিমাণ জীব বা আত্মাই থাকে, পিপীলিকার দেহে হয় ক্ষুদ্রায়তন। হস্তির মৃতদেহ থেকে জীব বা আত্মা বহির্গমন করে যদি পিপীলিকার শরীরে প্রবেশ করে তবে সে ঠিক ঐটুকু আকৃতিই গ্রহণ করবে।
তার ব্যাখ্যায় জৈনরা আরো বলেন, চৈতন্য হচ্ছে আত্মার স্বাভাবিক অবস্থা। তাই জীবের অবস্থাবিশেষ হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানই জীবের অবস্থাবিশেষ বলে জীব জ্ঞান হতে অত্যন্ত ভিন্ন নয়। আবার আত্মা বা জীবের জ্ঞান- এরূপ সম্বন্ধের প্রয়োগ হয় বলে জীবকে জ্ঞান থেকে অত্যন্ত অভিন্ন বলা চলে না। অত্যন্ত অভিন্ন হলে আত্মা বা জীবই জ্ঞান বলা হতো। সুতরাং জৈন-স্যাদবাদ অনুসারে কোনভাবে আত্মা বা জ্ঞান হচ্ছে ভিন্নাভিন্ন। আত্মার প্রথম অবস্থা ও পরবর্তী অবস্থা- সকল অবস্থাতেই জ্ঞান বা চৈতন্য থাকে, এই হচ্ছে আত্মার স্বরূপ।
.
এখানে প্রশ্ন আসে, ভেদ ও অভেদ এই উভয়ের একটি যেখানে থাকে সেখানে অন্যটি থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং জীবের জ্ঞান হতে ভিন্ন ও অভিন্নরূপ উভায়াত্মকভাব সিদ্ধ হয় না।
উত্তরে জৈনরা বলেন, একটি থাকলে অন্য একটি থাকবে না, এরূপ কোন বাধক প্রমাণ নেই। একত্র ভেদ ও অভেদের অনুপলব্ধি হচ্ছে বাধক প্রমাণ, তা বলা সমীচীন নয়। কেননা সমস্ত বস্তু অনেকান্তরূপ হয় বলে স্যাদবাদী জৈনমতে তা স্বীকৃত। অতএব আত্মা কোনভাবে জ্ঞানের সাথে অভিন্ন ও ভিন্ন বলে সিদ্ধ হয়।
.
জৈনদের এই জীবসম্পর্কিত বিচার ন্যায়বৈশেষিকদের আত্মার বিচার হতে ভিন্ন। ন্যায়বৈশেষিকরা চৈতন্যকে আত্মার আগন্তুক গুণ (accidental property) বলেন। তাঁদের মতে আত্মা স্বভাবত অচেতন। কিন্তু শরীর, ইন্দ্রিয়, প্রাণ প্রভৃতি যুক্ত হলে আত্মায় চেতনার (=চৈতন্যের) সঞ্চার হয়।
অন্যদিকে জৈনমতে চৈতন্যকে জীবের আবশ্যক গুণ (essential property) বা স্বভাব মনে করা হয়। চৈতন্যকে জীবের গুণ বলা হয়েছে, আবার স্বরূপও বলা হয়েছে। গুণকে যেমন দ্রব্যভিন্ন বলে মনে করা হয়, স্বরূপকে তা ভাবা যায় না। তাই জীব চৈতন্য (=জ্ঞান) হতে ভিন্নও নয়, অভিন্নও নয়- অর্থাৎ কোনরূপে ভিন্ন এবং অন্যরূপে অভিন্ন। এই জ্ঞান পূর্বাপরভাবে (=সর্বাবস্থায়) অবস্থিত এবং তা-ই হচ্ছে জীব।
.
জ্ঞানে ও দর্শনে চৈতন্য উপলব্ধ হয় বলে, যে জানে ও দেখে সে হচ্ছে জীব। চৈতন্য জীবে সর্বদা অনুভূত হয় বলে জীবকে প্রকাশমান বলা হয়েছে। জৈনরা জীবকে প্রদীপের সাথে তুলনা করে বলেন, জীব প্রদীপের প্রকাশের মতো নিজেকে ও অন্য বস্তুকে প্রকাশিত করে। প্রকাশের কোন আকার থাকে না, কিন্তু যে কক্ষকে সে আলোকিত করে সেই কক্ষের আকার ধারণ করে। জীব প্রকাশের মতো অমূর্ত হলেও মূর্তি (=আকার) গ্রহণ করতে পারে। জৈনমতে জীব (=আত্মা) সর্বব্যাপি নয়, আবার বৈশেষিক মতের ‘মন’ এর মতো অণু পরিমাণও নয়, মধ্য সমপরিমাণী। অর্থাৎ শরীর যত বড় আত্মাও তত বড়। এই মতে শরীরকে জীবের অধিকরণ (=আধার) বলা হয়। তাই জীব যে শরীরে নিবাস করে তার আকার অনুসারে আকার গ্রহণ করে। হস্তির দেহে তার সমপরিমাণ জীব বা আত্মাই থাকে, পিপীলিকার দেহে হয় ক্ষুদ্রায়তন। হস্তির মৃতদেহ থেকে জীব বা আত্মা বহির্গমন করে যদি পিপীলিকার শরীরে প্রবেশ করে তবে সে ঠিক ঐটুকু আকৃতিই গ্রহণ করবে।
.
জৈনমতে আত্মা স্বরূপত নিত্য ও সর্বজ্ঞ হলেও আত্মার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন আত্মার বিভিন্ন দেহধারণের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। আত্মা যে দেহে অবস্থান করে, সেই দেহের ভিন্নতা অনুযায়ী চেতনার পরিমাণ কম বা বেশি হলেও তা দেহের সর্বাংশে পরিব্যাপ্ত থাকে। অর্থাৎ আত্মা দেহের কোন একটি বিশেষ অংশে অবস্থান করে না, দেহের সর্বাংশেই বিরাজ করে। ফলে একটি হাতির দেহে আত্মা যতো বিস্তৃত, একটি মশার দেহে ততো বিস্তৃত নয়। এইদিক থেকে দেহধারী জীবের আত্মা সসীম দেহের বিস্তৃতির দ্বারা সীমিত বলেই জৈনমতে জীব অস্তিকায় দ্রব্য। জীব বা আত্মার বিস্তৃতির কথা অন্য কোন ভারতীয় দর্শনসম্প্রদায় স্বীকার করেন না।
তবে জৈনমতে আত্মার বিস্তৃতি বা আকারের সঙ্গে জড়বস্তুর বিস্তৃতি বা আকারের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। জড়দ্রব্য স্থানকে ঘিরে থাকে। একটি জড়বস্তু যে দেশে বা স্থানে থাকে, সেই দেশে বা স্থানে অন্য একটি জড়বস্তু থাকতে পারে না; কিন্তু দুটি আলোর মতো একই স্থানে দুটি আত্মার অবস্থান সম্ভব হতে পারে। তবে বিভিন্ন আত্মার ইন্দ্রিয়ের সংখ্যার মধ্যে তারতম্য থাকে। তা জীবভেদে একেন্দ্রিয় থেকে ষড়েন্দ্রিয় পর্যন্ত যেকোন সংখ্যার হয়ে থাকে। জৈনমতে যদিও আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয়ের জ্ঞান লাভ করে, তবুও দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় আত্মার অপরোক্ষ জ্ঞানের বাহক।
.
এখানে উল্লেখ্য যে, আত্মার পরিমাণ বিষয়ে ভারতীয় দর্শনে তিনটি ভিন্ন মত আছে। ন্যায়মতে আত্মা বিভূ পরিমাণ, বিশিষ্টাদ্বৈত-বেদান্তী রামানুজ-মতে আত্মা অণুপরিমাণ এবং জৈনমতে আত্মা মধ্যমপরিমাণ। আবার জৈনমতে আত্মা সগুণ। আত্মা স্বরূপত অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত সুখ ও অনন্ত বীর্যের অধিকারী। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্তমতে আত্মা নির্গুণ। সাংখ্যমতে আত্মা ভোক্তা হলেও কর্তা নয়। ন্যায়মতে জ্ঞান আত্মার গুণবিশেষ। জৈনমতে আত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা, তবে জ্ঞান আত্মার কোন গুণ নয়, জ্ঞান আত্মার স্বরূপগত ধর্ম। সাংখ্যাচার্যদের ন্যায় জৈনরা বহু আত্মায় বিশ্বাসী।
.
জীবতত্ত্ব বিচারে খুব স্বাভাবিকভাবেই চার্বাকদের সাথে জৈনদের ভিন্নতা রয়েছে। চার্বাকদর্শনে আত্মাকে শরীর হতে অভিন্ন মানা হয়েছে এবং তাঁরা চৈতন্যকে শরীরের গুণ বলে স্বীকার করেন। কিন্তু জৈনমতে জীব বা আত্মা ভৌতিক (= ভূতপরিমাণ বা বস্তুর উপজাত) নয়, জীব নিত্য। জীবের এ বৈশিষ্ট্য শরীরে উপলব্ধ হয় না, কেননা শরীর নশ্বর। জীব আকারবিহীন, কিন্তু শরীর আকারযুক্ত। সুতরাং জৈনরা চার্বাকসম্মত দেহাত্মবাদ স্বীকার করেন না।
.
জৈনদের মতে জীব হচ্ছে জ্ঞাতা (knower)। জীব নানা বিষয়ে জ্ঞানবান। কিন্তু জীব কখনো স্বয়ং জ্ঞানের বিষয় হয় না।
জীব হচ্ছে কর্তা। সে সাংসারিক কর্মের ভাগিদার। কর্ম অনুষ্ঠানে সে পূর্ণত স্বাধীন। শুভ ও অশুভ কর্ম করে স্বয়ং নিজের ভাগ্য নির্মাণ করতে পারে। জৈনদের এই বিচার সাংখ্যবিচারের বিরোধী। সাংখ্যদর্শন মতে পুরুষ হচ্ছে অকর্তা (non-doer) অর্থাৎ কোন কার্য করে না। সাংখ্যমতে অচেতন সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই গুণত্রয়ের কর্তৃত্ব আছে, চেতন পুরুষের কর্তৃত্ব নেই।
জৈনমতে আবার জীব (=আত্মা) হচ্ছে ভোক্তা। জীব নিজের কর্মের ফল স্বয়ং ভোগ করে বলে সুখ ও দুঃখ প্রাপ্ত হয়। জীব কর্মের সাথে সংযুক্ত হয়। এই কর্মবন্ধন অনাদি কাল হতে বিদ্যমান। খনি থেকে নির্গত হওয়ার সময়ে স্বর্ণ যেমন অশুদ্ধ থাকে তেমনি জীব অনাদিকাল হতে কর্মের বন্ধনে শক্তভাবে বদ্ধ।
.
জৈনমতানুসারে জীব স্বভাবত অনন্ত। জীবে চার প্রকার পূর্ণতা পাওয়া যায়, তাকে অনন্ত চতুষ্টয় (fourfold perfection) বলে। এগুলো হচ্ছে- অনন্ত জ্ঞান (infinite knowledge), অনন্ত দর্শন (infinite faith), অনন্ত বীর্য (infinite power) ও অনন্ত সুখ (infinite bliss)। জীব বন্ধনগ্রস্ত হলে তার এই গুণগুলি অভিভূত হয়। পাপকর্মের বিরামে উক্ত অনন্ত চতুষ্ক লাভ করলে দর্শনাবরণীয়, জ্ঞানাবরণীয় ইত্যাদি অষ্টবিধ কর্ম বিনষ্ট হলে সংসারে অসম্বন্ধ ব্যক্তি জিনকথিত পুনরাগমহীন মুক্তি লাভ করে।
.
জৈনমতে সকল প্রকার জীবই চেতন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কোটির জীবে চৈতন্যের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। কোন জীবে চেতনা অধিক বিকশিত হয়, কোন জীবে অপেক্ষাকৃত কম। তবে মুক্ত জীবে সবচেয়ে অধিক চেতনার বিকাশ হয় এবং স্থাবর জীবে সবচেয়ে কম চেতনা বিকশিত হয়।
.
জৈনমতে চার্বাকের দেহাত্মবাদ খণ্ডন
চার্বাকদর্শনে আত্মাকে শরীর হতে অভিন্ন মানা হয়েছে এবং চৈতন্যকে শরীরের গুণ বলে স্বীকার করা হয়েছে। যেহেতু জৈনরা চার্বাকসম্মত দেহাত্মবাদ স্বীকার করেন না, তাই এই মত খণ্ডন করতে জৈনগণ কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছেন-
.
(১) চার্বাকরা বলেন, শরীর হতে চৈতন্য উৎপন্ন হয়। যদি শরীর নিজেই চৈতন্য হতো তবে শরীরের সাথে সাথে চৈতন্যও থাকতো। কিন্তু মূচর্ছা, মৃত্যু নিদ্রা ইত্যাদিতে শরীর থাকলেও চৈতন্য থাকে না। অতএব শরীরকে চৈতন্যের কারণ স্বীকার করা সঙ্গত নয়।
.
(২) যদি চৈতন্য শরীরের গুণ হতো তবে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে চৈতন্যেও পরিবর্তন হতো। লম্বা ও মোটা হলে চৈতন্যের মাত্রা অধিক হতো এবং বামন ও দুর্বল শরীরে চেতনার মাত্রা কম হতো। কিন্তু তা হয় না। এতে প্রমাণিত হয় যে, শরীরের গুণ চৈতন্য নয়।
.
(৩) চার্বাকরা আমি মোটা, আমি ক্ষীণ, আমি অন্ধ ইত্যাদি যুক্তির দ্বারা শরীর ও আত্মার ঐক্য স্থাপন করেন। এই যুক্তি আত্মা ও শরীরের ঘনিষ্ঠ সম্মন্ধ স্থাপন করে। কিন্তু তা শরীর ও আত্মার মধ্যে অভেদ স্থাপনে সমর্থ নয়।
তবে জৈনমতে আত্মার বিস্তৃতি বা আকারের সঙ্গে জড়বস্তুর বিস্তৃতি বা আকারের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। জড়দ্রব্য স্থানকে ঘিরে থাকে। একটি জড়বস্তু যে দেশে বা স্থানে থাকে, সেই দেশে বা স্থানে অন্য একটি জড়বস্তু থাকতে পারে না; কিন্তু দুটি আলোর মতো একই স্থানে দুটি আত্মার অবস্থান সম্ভব হতে পারে। তবে বিভিন্ন আত্মার ইন্দ্রিয়ের সংখ্যার মধ্যে তারতম্য থাকে। তা জীবভেদে একেন্দ্রিয় থেকে ষড়েন্দ্রিয় পর্যন্ত যেকোন সংখ্যার হয়ে থাকে। জৈনমতে যদিও আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিষয়ের জ্ঞান লাভ করে, তবুও দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় আত্মার অপরোক্ষ জ্ঞানের বাহক।
.
এখানে উল্লেখ্য যে, আত্মার পরিমাণ বিষয়ে ভারতীয় দর্শনে তিনটি ভিন্ন মত আছে। ন্যায়মতে আত্মা বিভূ পরিমাণ, বিশিষ্টাদ্বৈত-বেদান্তী রামানুজ-মতে আত্মা অণুপরিমাণ এবং জৈনমতে আত্মা মধ্যমপরিমাণ। আবার জৈনমতে আত্মা সগুণ। আত্মা স্বরূপত অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত সুখ ও অনন্ত বীর্যের অধিকারী। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্তমতে আত্মা নির্গুণ। সাংখ্যমতে আত্মা ভোক্তা হলেও কর্তা নয়। ন্যায়মতে জ্ঞান আত্মার গুণবিশেষ। জৈনমতে আত্মা জ্ঞাতা, কর্তা ও ভোক্তা, তবে জ্ঞান আত্মার কোন গুণ নয়, জ্ঞান আত্মার স্বরূপগত ধর্ম। সাংখ্যাচার্যদের ন্যায় জৈনরা বহু আত্মায় বিশ্বাসী।
.
জীবতত্ত্ব বিচারে খুব স্বাভাবিকভাবেই চার্বাকদের সাথে জৈনদের ভিন্নতা রয়েছে। চার্বাকদর্শনে আত্মাকে শরীর হতে অভিন্ন মানা হয়েছে এবং তাঁরা চৈতন্যকে শরীরের গুণ বলে স্বীকার করেন। কিন্তু জৈনমতে জীব বা আত্মা ভৌতিক (= ভূতপরিমাণ বা বস্তুর উপজাত) নয়, জীব নিত্য। জীবের এ বৈশিষ্ট্য শরীরে উপলব্ধ হয় না, কেননা শরীর নশ্বর। জীব আকারবিহীন, কিন্তু শরীর আকারযুক্ত। সুতরাং জৈনরা চার্বাকসম্মত দেহাত্মবাদ স্বীকার করেন না।
.
জৈনদের মতে জীব হচ্ছে জ্ঞাতা (knower)। জীব নানা বিষয়ে জ্ঞানবান। কিন্তু জীব কখনো স্বয়ং জ্ঞানের বিষয় হয় না।
জীব হচ্ছে কর্তা। সে সাংসারিক কর্মের ভাগিদার। কর্ম অনুষ্ঠানে সে পূর্ণত স্বাধীন। শুভ ও অশুভ কর্ম করে স্বয়ং নিজের ভাগ্য নির্মাণ করতে পারে। জৈনদের এই বিচার সাংখ্যবিচারের বিরোধী। সাংখ্যদর্শন মতে পুরুষ হচ্ছে অকর্তা (non-doer) অর্থাৎ কোন কার্য করে না। সাংখ্যমতে অচেতন সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই গুণত্রয়ের কর্তৃত্ব আছে, চেতন পুরুষের কর্তৃত্ব নেই।
জৈনমতে আবার জীব (=আত্মা) হচ্ছে ভোক্তা। জীব নিজের কর্মের ফল স্বয়ং ভোগ করে বলে সুখ ও দুঃখ প্রাপ্ত হয়। জীব কর্মের সাথে সংযুক্ত হয়। এই কর্মবন্ধন অনাদি কাল হতে বিদ্যমান। খনি থেকে নির্গত হওয়ার সময়ে স্বর্ণ যেমন অশুদ্ধ থাকে তেমনি জীব অনাদিকাল হতে কর্মের বন্ধনে শক্তভাবে বদ্ধ।
.
জৈনমতানুসারে জীব স্বভাবত অনন্ত। জীবে চার প্রকার পূর্ণতা পাওয়া যায়, তাকে অনন্ত চতুষ্টয় (fourfold perfection) বলে। এগুলো হচ্ছে- অনন্ত জ্ঞান (infinite knowledge), অনন্ত দর্শন (infinite faith), অনন্ত বীর্য (infinite power) ও অনন্ত সুখ (infinite bliss)। জীব বন্ধনগ্রস্ত হলে তার এই গুণগুলি অভিভূত হয়। পাপকর্মের বিরামে উক্ত অনন্ত চতুষ্ক লাভ করলে দর্শনাবরণীয়, জ্ঞানাবরণীয় ইত্যাদি অষ্টবিধ কর্ম বিনষ্ট হলে সংসারে অসম্বন্ধ ব্যক্তি জিনকথিত পুনরাগমহীন মুক্তি লাভ করে।
.
জৈনমতে সকল প্রকার জীবই চেতন। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কোটির জীবে চৈতন্যের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। কোন জীবে চেতনা অধিক বিকশিত হয়, কোন জীবে অপেক্ষাকৃত কম। তবে মুক্ত জীবে সবচেয়ে অধিক চেতনার বিকাশ হয় এবং স্থাবর জীবে সবচেয়ে কম চেতনা বিকশিত হয়।
.
জৈনমতে চার্বাকের দেহাত্মবাদ খণ্ডন
চার্বাকদর্শনে আত্মাকে শরীর হতে অভিন্ন মানা হয়েছে এবং চৈতন্যকে শরীরের গুণ বলে স্বীকার করা হয়েছে। যেহেতু জৈনরা চার্বাকসম্মত দেহাত্মবাদ স্বীকার করেন না, তাই এই মত খণ্ডন করতে জৈনগণ কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছেন-
.
(১) চার্বাকরা বলেন, শরীর হতে চৈতন্য উৎপন্ন হয়। যদি শরীর নিজেই চৈতন্য হতো তবে শরীরের সাথে সাথে চৈতন্যও থাকতো। কিন্তু মূচর্ছা, মৃত্যু নিদ্রা ইত্যাদিতে শরীর থাকলেও চৈতন্য থাকে না। অতএব শরীরকে চৈতন্যের কারণ স্বীকার করা সঙ্গত নয়।
.
(২) যদি চৈতন্য শরীরের গুণ হতো তবে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে চৈতন্যেও পরিবর্তন হতো। লম্বা ও মোটা হলে চৈতন্যের মাত্রা অধিক হতো এবং বামন ও দুর্বল শরীরে চেতনার মাত্রা কম হতো। কিন্তু তা হয় না। এতে প্রমাণিত হয় যে, শরীরের গুণ চৈতন্য নয়।
.
(৩) চার্বাকরা আমি মোটা, আমি ক্ষীণ, আমি অন্ধ ইত্যাদি যুক্তির দ্বারা শরীর ও আত্মার ঐক্য স্থাপন করেন। এই যুক্তি আত্মা ও শরীরের ঘনিষ্ঠ সম্মন্ধ স্থাপন করে। কিন্তু তা শরীর ও আত্মার মধ্যে অভেদ স্থাপনে সমর্থ নয়।
এভাবে জৈনরা চার্বাকের দেহাত্মবাদ খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন।
.
.
জৈনমতে জীবের অস্তিত্ব প্রমাণ
জৈনদর্শনে জীবকে অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের আত্মার সমার্থক সত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই জীব বা আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ করতে এই দর্শনে নিম্নোক্ত যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে।
.
(১) কোন বস্তুর জ্ঞান সেই বস্তুর গুণকে দেখে হয়। চেতনা, সুখ, দুঃখ, সন্দেহ, স্মৃতি ইত্যাদি গুণের প্রত্যানুভূতি হয়। তাতে এসকল গুণের আধার জীবের প্রত্যক্ষ অনুভব হয়। এভাবে জীবের গুণ প্রত্যক্ষ করে জীবের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ হয়।
এই যুক্তি জীবের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। জীবের অস্তিত্ব প্রমাণিত করতে কিছু যুক্তি পরোক্ষ ঢঙে করা হয়। যেমন-
.
(২) শরীরকে ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত করা হয়। শরীর হচ্ছে এক প্রকার মেশিন। মেশিনকে চালু করার জন্য এক চালকের প্রয়োজন হয়। তাতে সিদ্ধ হয় যে, শরীরের কোন-না-কোন চালক অবশ্য থাকবে। সে হচ্ছে জীব।
.
(৩) চোখ, কান, নাক ইত্যাদি ইন্দ্রিয় হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন সাধন। ইন্দ্রিয়গুলি জ্ঞানের সাধন (=করণ) হবার ফলে স্বয়ং জ্ঞান উৎপন্ন করতে পারে না। সেকারণে প্রমাণিত হয় যে, কোন-না-কোন এমন সত্তা অবশ্য থাকবে, যে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞান উৎপন্ন করে। সেই সত্তা হচ্ছে জীব।
.
(৪) প্রত্যেক জড় দ্রব্যের নির্মাণের জন্য উপাদান কারণের অতিরিক্ত নিমিত্ত কারণেরও দরকার হয়। শরীরও জড় দ্রব্যের সমূহের দ্বারা নির্মিত। প্রত্যেক শরীরের জন্য বিশেষ প্রকারের পুদ্গলকণার প্রয়োজন। এই পুদ্গলকণা শরীর নির্মাণে পর্যাপ্ত নয়। তার রূপ ও আকার দেবার জন্য নিমিত্ত কারণের (efficient cause) দরকার। এই নিমিত্ত কারণ হচ্ছে জীব। এতে প্রমাণিত হয় যে, জীবের অভাবে শরীরের নির্মাণ অসম্ভব। অতএব শরীরের উৎপত্তিতে জীবের সত্তা স্বীকার করা দরকার।
জৈনদর্শনে জীবকে অন্যান্য ভারতীয় দর্শনের আত্মার সমার্থক সত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই জীব বা আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ করতে এই দর্শনে নিম্নোক্ত যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে।
.
(১) কোন বস্তুর জ্ঞান সেই বস্তুর গুণকে দেখে হয়। চেতনা, সুখ, দুঃখ, সন্দেহ, স্মৃতি ইত্যাদি গুণের প্রত্যানুভূতি হয়। তাতে এসকল গুণের আধার জীবের প্রত্যক্ষ অনুভব হয়। এভাবে জীবের গুণ প্রত্যক্ষ করে জীবের অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ হয়।
এই যুক্তি জীবের অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ। জীবের অস্তিত্ব প্রমাণিত করতে কিছু যুক্তি পরোক্ষ ঢঙে করা হয়। যেমন-
.
(২) শরীরকে ইচ্ছা অনুসারে পরিচালিত করা হয়। শরীর হচ্ছে এক প্রকার মেশিন। মেশিনকে চালু করার জন্য এক চালকের প্রয়োজন হয়। তাতে সিদ্ধ হয় যে, শরীরের কোন-না-কোন চালক অবশ্য থাকবে। সে হচ্ছে জীব।
.
(৩) চোখ, কান, নাক ইত্যাদি ইন্দ্রিয় হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন সাধন। ইন্দ্রিয়গুলি জ্ঞানের সাধন (=করণ) হবার ফলে স্বয়ং জ্ঞান উৎপন্ন করতে পারে না। সেকারণে প্রমাণিত হয় যে, কোন-না-কোন এমন সত্তা অবশ্য থাকবে, যে বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জ্ঞান উৎপন্ন করে। সেই সত্তা হচ্ছে জীব।
.
(৪) প্রত্যেক জড় দ্রব্যের নির্মাণের জন্য উপাদান কারণের অতিরিক্ত নিমিত্ত কারণেরও দরকার হয়। শরীরও জড় দ্রব্যের সমূহের দ্বারা নির্মিত। প্রত্যেক শরীরের জন্য বিশেষ প্রকারের পুদ্গলকণার প্রয়োজন। এই পুদ্গলকণা শরীর নির্মাণে পর্যাপ্ত নয়। তার রূপ ও আকার দেবার জন্য নিমিত্ত কারণের (efficient cause) দরকার। এই নিমিত্ত কারণ হচ্ছে জীব। এতে প্রমাণিত হয় যে, জীবের অভাবে শরীরের নির্মাণ অসম্ভব। অতএব শরীরের উৎপত্তিতে জীবের সত্তা স্বীকার করা দরকার।