ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। গিওর্দানো ব্রুনো কেবল দার্শনিক ছিলেন না। তিনি ইতালির বিখ্যাত কবি এবং নাট্যকার বলেও পরিচিত। স্বাধীন প্রবক্তা ব্রুনো খ্রিষ্টধর্মের ডমিনিকান মত পরিত্যাগ করায় গোঁড়া সাধক সম্প্রদায় তাঁকে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় আদালতে বিচার করে প্রথমে কারাগারে নিক্ষেপ করে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে নির্মম নির্যাতনের পরে ব্রুনোকে রোম শহরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
গিওর্দানো ব্রুনো মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। তিনি রোমান ক্যাথলিক মতকে সমালোচনা করেন। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল বিস্ময়কররূপে বস্তুবাদী। এই বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি তিনি প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের নিকট থেকেই প্রধানত লাভ করেন। তাঁর বস্তুবাদ প্যানথিজম বা সর্বপ্রাণবাদ বলে আখ্যায়িত হয়। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, একটা বিশ্বপ্রাণের অস্তিত্ব আছে। এই প্রাণ সর্ববস্তুতেই প্রকাশমান। ব্রুনোর মতে প্রকৃতি বা জগৎ হচ্ছে অসীম। তিনি পৃথিবী সম্পর্কে কপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকার করেন। কিন্তু ব্রুনোর অভিমতে আমরা কেবলমাত্র কপারনিকাসের তত্ত্বের স্বীকৃতি পাইনে, তাঁর অভিমতে কপারনিকাসের তত্ত্বের অধিকতর বৈজ্ঞানিক বিকাশও লক্ষ করা যায়। কারণ কপারনিকাস যেখানে সূর্যকে স্থির এবং সৌরমণ্ডলকে একমাত্র মণ্ডল বলে মনে করতেন, সেখানে গিওর্দানো ব্রুনো এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সূর্য স্থির নয় এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং পৃথিবী ছাড়া অপর জগতেও জীবন থাকা সম্ভব। ব্রুনোর পূর্বে পৃথিবী গ্রহের গঠন সম্পর্কে কোনো সুসমঞ্জস ধারণা ছিল না। ব্রুনোই বলেন যে, পৃথিবরি সর্বাঞ্চলের গঠনের মধ্যেই মাটি, পানি, বাতাস, তেজ এবং ইথারের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের ন্যায় ব্রুনোও বস্তুকে গতিময় মনে করতেন। মানুষের চেতনাও বস্তু বা প্রকৃতিরই ভেদ। এ সমস্ত অভিমত ছাড়া সমগ্র প্রকৃতির গতি, মহাজগতের ঐক্য এবং অস্তিত্বের পারস্পরিক নির্ভরতা প্রভৃতি প্রশ্নেও ব্রুনোর চিন্তা ছিল বৈজ্ঞানিক।
Buddhism: বৌদ্ধবাদ
প্রাচীন ধর্মসমূহের অন্যতম ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। বুদ্ধের জীবনকাল ছিল ৫৬৩-৪৮৩ খ্রি. পূ.। প্রাচীন ভারতে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিপত্তি ছিল। বুদ্ধের অভিমত এই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহস্বরূপ। এ কারণে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সম্রাটগণ বুদ্ধের ধর্মের প্রচারকে রুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের অনুসারীদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামি, আচার-অনুষ্ঠান, ব্যাপক পশুবলি এবং অনমনীয় বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিধ্বনিস্বরূপ ছিল বলে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু ভারতে নয় –ভারতের বাইরে সিংহল, নেপাল, বার্মা, চীন এবং জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়। প্রথমে বিরোধাত্মক সম্পর্ক থাকলেও কালক্রমে ব্যাপক হিন্দুধর্ম বুদ্ধকে তার অন্যান্য অবতারের সঙ্গে নবম অবতার বলে স্বীকৃতিদান করে।
বাংলাদেশের একজন প্রাচীন বৌদ্ধ কবি রামচন্দ্র বুদ্ধকে লক্ষ্য করে যে উক্তি করেন, তাতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধের ভাবটি সুন্দররূপে প্রকাশ পেয়েছে। উক্ত কবির মতে “ব্রহ্মা অবিদ্যা দ্বারা অভিভূত; বিষ্ণু মহামায়ার আলিঙ্গন বিমুগ্ধ; শঙ্কর আশক্তিবশত পার্বতীকে নিজ দেহে ধারণ করিয়াছিলেন; কিন্তু মুনিপুঙ্গর বুদ্ধ অবিদ্যা, মায়া, আসক্তি এই সমূহ হইতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত”।–(বিশ্বকোষ) প্রাচীন ভারতীয় সমাজের একদিকে যখন আদিম গোত্রতান্ত্রিক যৌথ সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল এবং অপরদিকে সমাজের একটা অংশ তার অনড় আচার-অনুষ্ঠান এবং বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে নিজের স্বার্থকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল, বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে সেইকালে। বুদ্ধ ভগবানের অস্তিত্ব, বেদের নির্ভূলতা এবং বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করেন।
কিন্তু বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসার অনুষ্ঠান এবং নির্যাতনমূলক বর্ণ প্রথার শৃঙ্খল থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলেন নি। জনসাধারণকে তিনি আত্মার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে কুক্তি অর্জন করতে বলেছেন। হিন্দু ধর্মের জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে বুদ্ধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাঁর মতে আত্মা জন্মান্তর গ্রহণ করে। কিন্তু সে জন্মান্তরের ভালো-মন্দ বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ নয়। মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে ভালো কিংবা মন্দ জন্মগ্রহণ করে। জীবনের ভোগ বাসনা পরিত্যাগের সাধনা দ্বারাই জীবন জন্মান্তরের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
বৌদ্ধধর্মে দুটি ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হীনযান ধারা, অপরটি মহাযান ধারা। হীনযান ধারাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম এবং বুদ্ধের শিক্ষা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত ধারা। হীনযান মতে বিশ্ব এবং জীবকে এক ধারায় গ্রথিত করা হত। সৃষ্টি হচ্ছে বস্তু এবং চেতনার বিবর্তন। বিবর্তিত সৃষ্টিমাত্রেরই বিশেষ বিশেষ স্বভাব আছে। এই স্বভাবই হচ্ছে সৃষ্টির ধর্ম। কোনো অস্তিত্ব বা সত্তার নির্বাণের জন্য আবশ্যক হচ্ছে তার নিজের ধর্মের বর্জন। স্বভাবের বর্জনে সত্তার সমস্ত প্রকার স্বভাব বা ধর্মরূপ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। এই মতের মধ্যে প্রকৃতি ও বস্তু জগতের একটা স্বীকৃতি আছে। পরবর্তীকালে মহাযান মতবাদ বুদ্ধের জীবনের নৈকট্যমূলক অভিমত বর্জন করে। মহাযান পন্থীরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিবিধ অনুষ্ঠান মারফত বুদ্ধের দয়া উদ্রেকের মধ্যে মানুষের মুক্তি নিহিত বলে প্রচার করে। মহাযানপন্থীদের মতে বস্তু বা বস্তুর ধর্ম হচ্ছে অলীক বা মায়া। জগৎও মায়া। খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের বিখ্যাত বৌদ্ধ যুক্তিবিদ নাগার্জুন যুক্তির পারম্পর্যে জগৎকে মায়া বা শূন্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬;