চার্বাকদের প্রত্যক্ষ প্রমাণের সপক্ষে যুক্তি
প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্যতম চার্বাকদের প্রত্যক্ষ প্রমাণবাদী বলা হয়। তাঁরা বলেন, ‘প্রত্যক্ষম্ একৈব প্ৰমাণম্’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। এই প্রত্যক্ষ বলতে তাঁরা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকেই বুঝিয়েছেন। এখানে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বলতে বহিরিন্দ্রিয় প্রত্যক্ষকে বুঝতে হবে। এই প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসাবে স্বীকারের স্বপক্ষে চার্বাকগণ যে সকল যুক্তি উপস্থাপন করেন সে গুলি হল :
প্রথমতঃ প্রত্যক্ষ প্রমাণ সর্ববাদীসম্মত - অর্থাৎ সকল দার্শনিকই প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করেন। স্বীকারের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ কোন মতবিরোধ লক্ষ্য করা যায় না।
দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন দার্শনিক কর্তৃক স্বীকৃত বিভিন্ন প্রমাণগুলির মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণ সবচেয়ে শক্তশালী প্রমাণ। চার্বাকদের মতে, যারা অনুমানাদি প্রমাণ স্বীকার করেন, সেই সকল প্রমাণাদির মধ্যে যদি কোন সন্দেহ দেখা দেয়, তবে তা নিরসনের জন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণের সাহায্য নিতে হয়৷
তৃতীয়তঃ প্রত্যক্ষে জ্ঞাত বস্তুকে সৎ বলা হয় কারণ প্রত্যক্ষ হল বস্তুর অস্তিত্বের সূচক। যাকে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে, তাই কেবল সৎ হতে পারে। ‘আমি টেবিলটিকে প্রত্যক্ষ করছি তাই টেবিলটি সৎ অর্থাৎ টেবিলটির অস্তিত্ব আছে। টেবিলটিকে আর অন্য কোনভাবে জানার উপায়ও নাই।
চতুর্থতঃ প্রত্যক্ষপ্রমাণলব্ধ জ্ঞান স্পষ্ট - ইন্দ্রিয়ের সাথে বিষয়ের সরাসরি সম্বন্ধ হয়ে থাকে বলে প্রত্যক্ষ প্রমাণলব্ধ অনুভবকে অপরোক্ষ অনুভব বলা হয়। আর বিষয়েন্দ্রিয় সন্নিকর্ষ বা সম্বন্ধের ফলে প্রত্যক্ষ প্রমাণলব্ধ জ্ঞান যতখানি স্পষ্ট অতখানি স্পষ্টতা অন্য কোন প্রমাণের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না৷
পঞ্চমতঃ প্রতাক্ষ প্রমাণলব্ধ জ্ঞান অভ্রান্ত যথাযথভাবে বস্তুর জ্ঞাপক প্রত্যক্ষজ্ঞান জ্ঞাতাকে কখনো বিভ্রান্ত করে না। কারণ, যথাযথ প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে সংশয় ও বিপর্যয় ঘটে না।
ষষ্ঠতঃ প্রত্যক্ষ প্রমাণলব্ধ জ্ঞান লোক ব্যবহারে সফল সাধারণ লোক যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় বলতে প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই বুঝে থাকেন। কিন্তু অন্যান্য উপায়ে প্রাপ্ত জ্ঞানে ভুল ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে বলে ঐ সকল জ্ঞানের ওপর প্রত্যক্ষ প্রমাণলব্ধ জ্ঞানের মতো ভরসা করা যায় না৷
সপ্তমতঃ প্রত্যক্ষ প্রমাণ সকল প্রমাণের শ্রেষ্ঠ ও মূলীভূত প্রমাণ চার্বাকদের মতে, যাঁরা প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমানাদি প্রমাণ স্বীকার করেন, তাঁরাও প্রত্যক্ষকে সকল প্রমাণের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মনে করেন। সকল প্রমাণের প্রামাণ্যের জনক হল প্রত্যক্ষ প্রমাণ। যেমন
ক) অনুমান একটি প্রমাণ এক্ষেত্রে পক্ষে হেতুর প্রত্যক্ষজ্ঞান (পক্ষধর্মতাজ্ঞান), সপক্ষে হেতু ও সাধ্যের সহচারের প্রত্যক্ষ(ব্যাপ্তিজ্ঞান) ইত্যাদি অনুমিতির জনক। প্রত্যক্ষে ভ্রান্তি ঘটলে অনুমিতিতে দোষ ঘটে। অভ্রান্ত প্রত্যক্ষ অভ্রান্ত অনুমিতির জনক।
খ) উপমান একটি প্রমাণ উপমান প্রমাণলব্ধ জ্ঞান অর্থাৎ উপমিতিও প্রত্যক্ষজ্ঞান সাপেক্ষ। উপমান ও উপমেয়ের প্রত্যক্ষ হলেই তাদের সম্বন্ধ অনুমিত হতে পারে। উপমান ও উপমেয়ের সম্যক প্রত্যক্ষ হলেই সম্যক উপমিতি জ্ঞান হতে পারে।
গ) শব্দ একটি প্রমাণ - শাব্দজ্ঞানের প্রামাণ্যও প্রত্যক্ষজ্ঞান নির্ভর। শব্দের শ্রাবন প্রত্যক্ষ হলেই শব্দের অর্থ জানার প্রয়োজন হয়। অর্থ ও শব্দ উভয়ের প্রত্যক্ষ হলেই শব্দার্থের সম্বন্ধ জানা যেতে পারে অর্থাৎ শাব্দবোধ হতে পারে।
এককথায় চার্বাকদের মতে, অন্যান্য প্রমাণে বিশ্বাসীরাও প্রত্যক্ষকেই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলে মনে করেন। নিত্য অভ্রান্ত বলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ একমাত্র নির্ভরযোগ্য। তাই চার্বাকগণ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করেন। অবশ্য এক্ষেত্রে এক্ষেত্রে চার্বাকগণ বলেন, বলেন, ভ্রম প্রত্যক্ষ প্রত্যক্ষের প্রামাণ্যকে বাধিত করে না। তাঁরা বলেন, ভ্রম প্রত্যক্ষে প্রতিভাত বস্তুটি যে দেশে ও কালে প্রতীত হয়, বস্তুতঃ বস্তুটি সেই দেশে ও কালে থাকে না। অসৎ বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হতে পারে না। আসলে ভ্ৰম প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের ত্রুটি, দেশ-কালের অতিরিক্ত ব্যবধান, উপযুক্ত আলোকের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে প্রত্যক্ষে ভ্রান্তি ঘটে। বস্তুতঃ নির্দোষ ইন্দ্রিয়জন্য যথার্থ প্রত্যক্ষজ্ঞান অভ্রান্ত ও নির্ভরযোগ্য। প্রত্যক্ষের ভ্রান্তত্বের কারণ প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়। অসৎ বস্তুকে সৎ বলে মনে করার জন্যই ভ্রান্তি ঘটে থাকে। আবার অনেক সময় কল্পনার আরোপও তথাকথিত ভ্রম প্রত্যক্ষের কারণ।
সমালোচনা : চার্বাকদের প্রত্যক্ষ প্রমাণ সম্পর্কিত উক্ত যুক্তিগুলি স্বীকার করলে নানা ধরনের সমস্যা লক্ষ্য করা যায়, যা অন্যান্য দার্শনিকদের বক্তব্যের মাধ্যমে পরিস্ফুট হয়েছে। সমস্যাগুলি নিম্নরূপভাবে তুলে ধরা যেতে পারে।
১) জৈন দার্শনিকগণ চার্বাকদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত যুক্তির ত্রুটি দেখিয়ে বলেন, যদি অনুমানাদি প্রমাণ প্রত্যক্ষ নির্ভর হওয়ার জন্য পরোক্ষ বলে অস্পষ্ট ও অযথার্থ হয়, তাহলে প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেও অযথার্থ বলতে হবে, যেহেতু প্রত্যক্ষ জ্ঞানও ইন্দ্রিয় নির্ভর হওয়ায় পরোক্ষ
২) যা প্রত্যক্ষে নেই তার অস্তিত্ব নেই - চার্বাকদের এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আমাদের মৃত পূর্বপুরুষগণ প্রত্যক্ষের অতীত। কিন্তু তাই বলে তাদের অস্তিত্ব আমারা অস্বীকার করি না।
৩) চার্বাক স্বীকৃত ‘প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ এই উক্তটি একটি সার্বিক উক্তি অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রে (ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান) প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেই বোঝায়। কিন্তু এই জ্ঞান প্রত্যক্ষলব্ধ নয়। পরন্তু অনুমানলব্ধ। তাহলে স্বীকার করতেই হবে চার্বাকগণ প্রত্যক্ষ অতিরিক্ত অনুমানের প্রামাণ্য প্রকারান্তরে স্বীকার করেন।
৪) ‘প্রত্যক্ষম্ একৈব প্রমাণম্’ চার্বাকদের এই যুক্ত মানলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা রকমের সমস্যা সৃষ্টি হবে। দৈনন্দিন জীবন প্রায় অচল হয়ে যাবে। কারণ, প্রাত্যহিক জীবনের অধিকাংশ কার্যাবলী অনুমান নির্ভর। ধূম দেখে বহ্নির অনুমান না করলেই চলে না। লোকযাত্রা নির্বাহের জন্য প্রত্যক্ষ অতিরিক্ত অনুমানের প্রমাণ্য স্বীকার করতেই হয়।
পরিশেষে, একথা উল্লেখযোগ্য যে, চার্বাকদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত বক্তব্যের যতই ত্রুটি দেখানো হোক না কেন, তাঁদের বক্তব্যের যে একটা গুরুত্ব আছে, তা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কারণ, আমার যখন চার্বাক পরবর্তী দার্শনিকদের দর্শন নিয়ে আলোচনা করি, তখন দেখি তাঁরা চার্বাকদের এই সম্পর্কিত যুক্তিগুলি খণ্ডন না করে তাঁদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। আর এইজন্যই চার্বাকদের দর্শনের নেতিবাচক দিকের গুরুত্ব অনেক বেশী।