শঙ্করাচার্য-বর্ণিত চার্বাকী দেহাত্মবাদ।
অদ্বৈত-বেদান্তের প্রবর্তক শঙ্করাচার্যের নিজস্ব মতের সম্পূর্ণ বিপরীত বলতে ভারতীয় দর্শনে যদি কিছু থাকে তা হলো এই দেহাত্মবাদ। কেননা, চার্বাকমতে দেহই সত্য, আত্মা বলে কিছু নেই; অন্যদিকে শঙ্কর-মতে আত্মাই একমাত্র সত্য, তথাকথিত দেহ বলে বস্তুটি অজ্ঞানের ঘোরে সাময়িক কল্পনামাত্র। তবুও বিদ্বান গবেষকদের মতে শঙ্করের বর্ণনার আকর্ষণীয় দিকটি হলো, সামগ্রিকভাবে ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে শঙ্করের মতো সহজ-সরল গদ্য রচনার নমুনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আলঙ্কারিকদের ভাষায়, শঙ্করের লেখা প্রসাদগুণে অুুলনীয়। অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করলে শঙ্করের বর্ণনায় সে-তুলনায় কূটতর্কেল বিশেষ বালাই নেই, কেননা শঙ্কর যুক্তিতর্কেরই বড় একটা ধার ধারতেন না। তাঁর নিজের দাবি অনুসারে মায়াবাদ বা অদ্বৈত-বেদান্তের আসল খুঁটি হলো শাস্ত্র বা শ্রুতি-স্মৃতি। শ্রুতি-স্মৃতির উপর নির্ভর না করে স্বাধীন যুক্তিতর্কের প্রতি যে কোনো প্রবণতাই অজ্ঞানের কুহেলিকায় দিশেহারা হতে বাধ্য। তবে নেহাতই নিকৃষ্ট পরমত খণ্ডনের জন্য– বা পাঠক-সাধারণের মোহমুক্তির উদ্দেশ্যে– যুক্তি-তর্কের গৌণ মূল্য থাকতে পারে। এই কারণে তিনি তুলনায় সীমিত অর্থে তর্কবিতর্কেরও পরিচয় দিয়েছেন। ফলে তাঁর রচনায় দেহাত্মবাদের বর্ণনাও যেমন সহজ সরল, দেহাত্মবাদের খণ্ডনও তেমনি সাদামাটা।
শঙ্করাচার্য চার্বাকী দেহাত্মবাদ বর্ণনার ক্ষেত্রে অন্যান্য নানা অবান্তর প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে দেহাত্মবাদ নিয়ে যেটা প্রধান বিতর্ক সরাসরি তারই আলোচনা তুলেছেন। কিসের বিতর্ক? দেহাত্মবাদীর মতে দেহগঠনের মূল উপাদান বলতে আগুন, বাতাস, জল ও মাটি। ভূতপদার্থই। কিন্তু এই উপাদানগুলির মধ্যে কোথাও চেতনা বা চৈতন্যের পরিচয় নেই। এগুলির সবই নিছক অচেতন; জড়পদার্থ। অথচ, মানুষ প্রভৃতির দৃষ্টান্তে সুস্পষ্টভাবেই চেতনার পরিচয়। এবং এই চৈতন্যের সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণ হয় যে মানবাদির ক্ষেত্রে আত্মা বলে অতিরিক্ত কিছু মানা দরকার, কেননা আত্মাই চেতনপদার্থ বা চৈতন্যবিশিষ্ট। দেহাত্মবাদ নিয়ে অন্যান্য দার্শনিকেরাও যত তর্ক তুলুন না কেন, শেষ পর্যন্ত সবকিছুই এই চৈতন্য বা চেতনার নজিরটির উপর প্রতিষ্ঠিত। চার্বাকেরা এ বিষয়ে কী উত্তর দেবেন?
দেহাত্মবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় হিসেবে শঙ্কর বলছেন–
‘দেহমাত্রং চৈতন্যবিশিষ্টমাত্মেতি প্রাকৃতা জনা লোকায়তিকাশ্চ প্রতিপন্না’। (শাঙ্করভাষ্য-১/১/১)
অর্থাৎ : অশিক্ষিত বা ইতর জনগণ এবং লোকায়তিকেরা চৈতন্য-বিশিষ্ট দেহমাত্রকে আত্মা বলে মনে করে।
তার মানে লোকায়তমতে চৈতন্য দেহেরই গুণ বা দেহেরই ধর্ম। কিন্তু নিছক অচেতন বা জড় বস্তু দিয়ে গড়া এই দেহই কী করে চৈতন্যবিশিষ্ট বা চৈতন্যগুণযুক্ত হতে পারে? একই গ্রন্থের অন্যত্র শঙ্কর লোকায়তমতের বর্ণনায় এই প্রশ্নের তুলনায় বিশদ উত্তর দিয়েছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের স্বাধীন তর্জমায় তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। শঙ্কর বলছেন–
‘অত্রৈকে দেহমাত্রাত্মদর্শিনো লোকায়তিকা…… তেভ্যশ্চৈতন্যং মদশক্তিবৎ বিজ্ঞানং …।’- (শাঙ্করভাষ্য-৩/৩/৫৩)
দেবীপ্রসাদ-কৃত তর্জমা :
‘লোকায়তিকেরা বলে আত্মা বলে কিছুই নেই; নিছক দেহকেই তারা আত্মা বলে বোঝে। তাদের মতে পৃথিবী বাহ্য ভূতবস্তুগুলিতে স্বতন্ত্রভাবে এবং এমনকি মিলিতভাবেও চৈতন্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। কিন্তু এই পৃথিবী প্রভৃতি ভূতবস্তুগুলিই শরীরাকারে পরিণত হলে তাতে চৈতন্যের উদ্ভব হয়। অতএব জ্ঞান বা চৈতন্য (ভারতীয় পরিভাষায় ‘বিজ্ঞান’) মদশক্তির মতো। অর্থাৎ, মদ তৈরি করার জন্য কিণ্ব– খামির বা গাঁজ– প্রভৃতি বস্তু ব্যবহার করা হয়। এগুলির কোনটিতেই মদশক্তির পরিচয় নেই : সোজা কথায়, এগুলির কোনোটি খেলেই নেশা হয় না। কিন্তু এগুলি দিয়েই মদ তৈরি করলে– বা এগুলিই মদিরাকারে পরিণত হলে– তাতে মদশক্তির উদ্ভব হয় বা এগুলি দিয়ে তৈরি মদ গিললে নেশা হয়। এইভাবেই পৃথিবী প্রভৃতি বস্তুগুলিই দেহ আকারে পরিণত হলে– অর্থাৎ এগুলি থেকেই দেহ তৈরি হলে– সেই দেহে চৈতন্যের উদ্ভব হয়। তাই ওরা– লোকায়তিকেরা– বলে মানুষ বলতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব স্বর্গগমন বা মোক্ষলাভে সমর্থ আত্মা নেহাতই কাল্পনিক। এমনতর কথা বলা যাবে না যে দেহের মধ্যে আত্মা বলে আলাদা কিছু আছে বলেই দেহে চৈতন্যের পরিচয়। লোকায়তমতে দেহই সচেতন, বা– আত্মা বলে কোনো কিছুর কথা যদি বলতেই চাও, তাহলে– ওই দেহকেই আত্মা বলো। এই মতের সমর্থনে সূত্র আছে : ‘শরীরে ভাবাৎ’। অর্থাৎ, যা বর্তমান থাকলে অপরকিছু বর্তমান থাকে, এবং যার অবর্তমানতায় সেই অপরকিছুও অবর্তমান হয়, সেই অপরকিছুকে তাই ধর্ম বলতে হবে। যেমন অগ্নির ধর্ম উষ্ণতা ও প্রকাশ : আগুন থাকলে তাপ ও আলো থাকে, আগুন না-থাকলে তাপ ও আলো থাকে না; অতএব তাপ ও আলো আগুনেরই ধর্ম। আত্মবাদীরা– অর্থাৎ যাঁরা দেহ ছাড়াও আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু মানতে চান, তাঁরা– প্রাণ, চৈতন্য, স্মৃতি প্রভৃতিকে ওই আত্মার ধর্ম বা গুণ বলে কল্পনা করেন। কিন্তু এসবই দেহতেই উপলব্ধ হয়, দেহ ছাড়া আর কোথাওই উপলব্ধ হয় না। তাই দেহ ছাড়া– বা দেহ-আত্মা বলে এমন কিছু মানা যায় না যার ধর্ম বা গুণ বলতে প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি প্রভৃতিকে স্বীকার করার সুযোগ আছে। দেহের বর্তমানতায় বর্তমান এবং অবর্তমানতায় অবর্তমান বলে এগুলিকে দেহধর্ম বলেই মানতে হবে। এই অর্থে দেহই আত্মা।’ (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৬-৭৭)
সত্যি বলতে কি, দেহাত্মবাদের এরকম সাদামাটা প্রাঞ্জল বর্ণনা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে সত্যিই দুর্লভ। যদিও, এই প্রসঙ্গে লোকায়তিক সূত্র হিসেবে শঙ্কর ‘শরীরে ভাবাৎ’ বলে যে কথা উদ্ধৃত করেছেন তা তিনি কোথা থেকে পেলেন জানা নেই। তবে এটুকু বোঝা কঠিন নয় যে সূত্রটির তাৎপর্যের সঙ্গে দেহাত্মবাদের মিল হয়। চার্বাকদের লোকায়তসূত্র নামে প্রচলিত বার্হস্পত্যসূত্র, চার্বাকষষ্ঠি কিংবা প্রচলিত চার্বাকী লোকগাথাগুলিতে শঙ্কর-উদ্ধৃত সূত্রটি কোথাও দেখা যায় না। ‘যদি এমন হয় যে লোকায়তমতের প্রকৃত তাৎপর্য দার্শনিক পরিভাষায় বোঝাতে গিয়ে শঙ্কর এ-হেন একটি সূত্র নিজেই জুড়ে দিয়েছেন, তাহলে বলতেই হবে, শঙ্কর দেহাত্মবাদী চার্বাকদের হাতে কঠিন এক অন্ত্র তুলে দিয়েছে যা তাঁর নিজস্ব অদ্বৈতমতের জন্যেই নিজের বিপদ নিজে টেনে এনেছেন।‘
সে যাক্, শঙ্করের ভাষ্যে এখানে প্রধানত উল্লেখ্যযোগ্য বিষয়টি হচ্ছে, অচেতন জড় মহাভূতের উপাদানে গঠিত দেহকে চৈতন্যের আবির্ভাবের ক্ষেত্র হিসেবে স্বীকার করার সময় চার্বাকেরা স্বীয় ধারণার সম্ভাব্য অসঙ্গতি দূর করার প্রচেষ্টায় যে লোকায়তিক দৃষ্টান্তের আশ্রয় নিয়েছেন সেটি হলো– মদশক্তিবৎ।
সুরা বা মদের উপাদান হিসেবে যে বিশেষ ধরনের বৃক্ষনির্যাসের ব্যবহার, তা মূলতঃ মাদকতাবিহীন হলেও পরে তাতে মাদকশক্তির উদ্ভব হয় এবং সেটা সুরা বা মদে পরিণতি লাভ করে; অনুরূপভাবে স্থূল মহাভূত যদিও প্রকৃতিগতভাবে চৈতন্যবর্জিত, তাহলেও দেহরূপে পরিণত হবার পর এই স্থূলভূতে চৈতন্যের বিকাশ দেখা যায়। চার্বাকী দেহাত্মবাদ বর্ণনায় প্রায় সকল সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরাই এই মদশক্তির উপমা ব্যবহার করেছেন। জৈন দার্শনিক হরিভদ্রসূরি তাঁর ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ে’ বলেছেন–
‘মদশক্তিঃ সুরাঙ্গেভ্যো যদ্বৎ তদ্বৎ স্থিতম্ আত্মতা’। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮৪)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) মাদকতাবিহীন উপাদানের পরিণাম যেরূপ মদশক্তি, সেইরূপ স্থূলভূতের দেহরূপে পরিণত হবার পর চৈতন্যের বিকাশ হয়।
চার্বাকী দেহাত্মবাদে এই উপমা ব্যবহারের ইঙ্গিত বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থেও পাওয়া যায়–
‘তস্মাদ্ভূতবিশেষেভ্যো যথা শুক্তসুরাদিকম, তেভ্য এব তথা জ্ঞানং জায়তে ব্যজ্যতেহথবা’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৮৫৮)
অর্থাৎ : (লোকায়তিকমতে) শুক্তসুরাদির মতোই চৈতন্যবর্জিত স্থূল মহাভূত দেহরূপে পরিণত হবার পর স্থূলভূতে জ্ঞান বা চৈতন্যের জন্ম হয়।
‘ন্যায়মঞ্জরী’তে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টও বলেন–
‘উক্তং চ, মদশক্তিবৎ বিজ্ঞানমিতি’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) তারা বলেন জ্ঞান বা চৈতন্য মদশক্তির মতো।
জয়ন্তভট্ট অবশ্য আরেকটু বিশদ করেই বলেছেন। লতিকা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৯৪) বলছেন–
‘ন্যায়মঞ্জরী’-তে চার্বাক ব্যবহৃত এই দৃষ্টান্তের বিবরণ এইভাবে দেওয়া হয়েছে– গুড়, পিষ্ট ইত্যাদি পদার্থ প্রাথমিক অবস্থায় মদশক্তিবিহীন হলেও সুরার আকারে পরিণত এই বস্তুগুলিতে বিশেষ এই মদশক্তির যে ভাবে প্রকাশ, ঠিক সেইভাবে আদিতে চৈতন্যবর্জিত মৃত্তিকাদি চতুর্ভূত শরীরাকারে রূপান্তরিত অবস্থায় চৈতন্যরূপ বিশেষ শক্তির দ্বারা যুক্ত হয়। এই বিশেষ শক্তির প্রকাশ ভূতাত্মক দেহে কিছুকাল থাকে, যে সময়ে স্মৃতি, অনুসন্ধান ইত্যাদি সচেতন ব্যবহারের অভিব্যক্তি এই দেহে দেখা যায়। কালবসানে ব্যাধি ইত্যাদির দ্বারা এই শক্তি বিনষ্ট হলে দেহ পুনরায় অচেতন রূপ পরিগ্রহ করে। (‘জ্ঞানাদি যোগস্তু ভূতানামেব পরিণাম বিশেষোপপাদিতশক্ত্যতিশয়জুষাং………ভবিষ্যন্তীতি’, ব্যাস, ২,৩)।’
তবে, নানা রকম উপকরণ মিশ্রিত তাম্বুল বা পানে যেমন উপকরণগুলির প্রত্যেকটির রঙ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রক্তবর্ণের উৎপত্তি, জড় মহাভূত থেকেও সেইভাবে ভিন্নধর্মী চৈতন্যের সৃষ্টি ব্যাখ্যা করা যায়– এধরনের উপমা-যুক্ত চার্বাকমতের প্রামাণিক একটি লোকায়তিক উদ্ধৃতি শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে রয়েছে–
‘জড়ভূতবিকারেষু চৈতন্যং যত্তু দৃশ্যতে।
তাম্বুলপূগচূর্ণানাং যোগাদ্রাগ ইবোত্থিতম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৭)।।
অর্থাৎ : (লোকায়তমতে) জড় ভূতের বিকাররূপ শরীরাদিতে যে চৈতন্য দৃষ্ট হয়, তা পান, সুপারি এবং চূণ সংযোগে রক্তিমার ন্যায়– সংযোগজন্য।
কিন্তু দৃষ্টান্ত হিসেবে চার্বাকী সাহিত্যে এই তাম্বুলপূগচূর্ণ-এর চেয়ে প্রথমটির অর্থাৎ মদশক্তিবৎ-এর প্রচলন বোধ হয় ব্যাপকতর, কারণ চার্বাক সিদ্ধান্তের আলোচনা বা সমালোচনা-সংক্রান্ত বিভিন্ন রচনার মধ্যে প্রচুর উল্লেখ রয়েছে– মদশক্তিবৎ। মদ্য প্রস্তুতের নানা উপকরণ। স্বতন্ত্র কিংবা মিলিত অবস্থায় (অর্থাৎ একসঙ্গে জড়ো করে দিলেও) এগুলির মধ্যে মদশক্তির বা নেশা ধরানোর সামর্থ্য থাকে না। অথচ, এগুলিই কোনো এক রকম ‘বিশেষ পরিণামে’র ফলে মদ তৈরি হলে সেই মদে নেশা হয়। এখানে উল্লেখ্য, ‘বিশেষ পরিণাম’ শব্দটি অবশ্য শঙ্কর ব্যবহার করেননি। কিন্তু জয়ন্তভট্ট করেছেন এবং তা করে শঙ্করের অভীষ্ট বক্তব্য আরো প্রাঞ্জল করেছেন। কেননা, মদ তৈরির উপকরণগুলি যে-কোনো ভাবে একজায়গায় জড়ো করলেই মদ পাওয়া যায় না; অথচ এগুলিকেই কোনো এক বিশেষ পদ্ধতিতে পরিবর্তন করলে মদ তৈরি হয়। এই ঘটনার নজির দেখিয়ে লোকায়তিকেরাও বলবেন, আগুন, বাতাস, জল আর মাটি যেমন তেমন করে একত্র জড়ো করলেই চৈতন্যবিশিষ্ট দেহের উৎপত্তি হয় না, কিন্তু এগুলিরই কোনো-এক-রকম বিশেষ পরিণামের ফলে প্রাণ-চেষ্টা-চৈতন্য-স্মৃতি বিশিষ্ট দেহের উৎপত্তি হয়। এটিই চার্বাকী দেহাত্মবাদের মূল কথা; চার্বাকমতের গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত প্রামাণিক লোকগাথাগুলি এই সাক্ষ্যই দেয়। এক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের সমর্থনে কয়েকটি প্রামাণিক লোকগাথার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের শুরুতেই– ‘চার্বাক-দর্শন’ নামে প্রথম পরিচ্ছেদেই– অনেকগুলি লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন, যা আমরা ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে উপস্থাপন করেছি। তার মধ্যে বর্তমান দেহাত্মবাদ আলোচনার পক্ষে বিশেষ প্রাসঙ্গিক কয়েকটি হলো–
‘অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমি-বারি-অনল-অনিলাঃ ।
চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যঃ চৈতন্যম্ উপজায়তে ।।
কিণ্ব-আদিভ্যঃ সমেতেভ্যঃ দ্রব্যেভ্যঃ মদশক্তিবৎ।
অহং স্থূলঃ কৃশঃ অস্মি ইতি সামানাধিকরণ্যতঃ।।
দেহঃ স্থৌল্য-আদি-যোগাৎ চ স এব আত্মা ন চ অপরঃ ।
মম দেহঃ অয়ম্ ইতি উক্তিঃ সম্ভবেৎ ঔপচারিকী ।।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ-চার্বাকপ্রস্থান)
অর্থাৎ :
(লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস– শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়।। যেমন কিণ্ব প্রভৃতি বস্তুগুলি থেকেই উৎপন্ন হয় মদশক্তি। ‘আমি মোটা’, ‘আমি রোগা’– এ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আসলে বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্কই বর্তমান।। ‘মোটা’ প্রভৃতি শব্দ দেহেরই বিশেষণ বলে স্বতন্ত্র কোনো আত্মার কথা অবান্তর। ‘আমার দেহ’ জাতীয় কথা নেহাতই কথার কথা– যাকে বলে উপচার।।
এই প্রাসঙ্গিক লোকগাথাগুলির সহজ সরল বক্তব্য থেকেই চার্বাকী দেহাত্মবাদের প্রয়োজনীয় বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু চার্বাকেতর আত্মবাদী দার্শনিকেরা এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবতারণা করে প্রকৃতপক্ষে স্বীয় পাণ্ডিত্য প্রদর্শনেরই অল্পবিস্তর প্রয়াস করেছেন বলে সন্দেহের অবকাশ আছে; কেননা এই প্রসঙ্গে তাঁরা এতরকম কূট বিচারের অবতারণা করেছেন যার তোয়াক্কা লোকায়তিকেরা সত্যিই করতেন বলে মনে হয় না। পক্ষান্তরে লোকায়তিকদের প্রামাণ্য লোকগাথাগুলি থেকে অনুমান হয়, তাঁরা সত্যিই অতশতর ধার ধারতেন না।
Tags
চার্বাক দর্শন