বস্তুবাদী চার্বাক
অলৌকিকতাকে সরিয়ে রেখে জড়বস্তুর সাপেক্ষে যে মতবাদ যাবতীয় প্রাকৃতিক নিয়ম বা বিষয়ের যৌক্তিক ব্যাখ্যা উপস্থিত করে মোটাদাগে তাকেই বস্তুবাদী দর্শনমত বলা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে চার্বাক-মত কি সফল? এই প্রশ্নের বিপরীতে এক্ষেত্রে হয়তো উল্টো প্রশ্ন রাখা যেতে পারে, কেন নয়?
চার্বাক মতবাদ আলোচনার সময় আমরা লক্ষ্য করেছি যে চার্বাক দর্শন প্রধানত যুক্তিনির্ভর। কিন্তু এ-প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হয়তো একধরনের একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলতে পারেন– ‘যুক্তির আশ্রয় নিয়ে প্রতিপক্ষকে নানাভাবে পর্যুদস্ত করাকেই সাধারণভাবে চার্বাকী নীতি হিসাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। চার্বাক সর্বক্ষেত্রে বিরোধীপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ। চার্বাকের নীতি নূতন সৃষ্টির সম্ভাবনায় উজ্জ্বল নয়; চার্বাকী প্রচেষ্টা প্রধানতঃ নূতন দৃষ্টির আলোক নিয়ে প্রাচীনের বিশ্লেষণ এবং এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে নানাভাবে তার ত্রুটি প্রদর্শন।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৩৯)
এধরনের বক্তব্যকে একদিকে তেমন দোষের বলা যাবে না এজন্যেই যে, কোন অজ্ঞাত কারণে বিলুপ্ত চার্বাকী নিজস্ব গ্রন্থের অভাবে চার্বাকেতর সম্প্রদায়ের দার্শনিক সাহিত্যে চার্বাকের অবস্থান তো বিরোধীপক্ষ হিসেবেই উপস্থাপিত, যার উপর ভিত্তি করেই আমাদেরকে চার্বাকমতের রূপরেখা আঁকতে হচ্ছে। আর চার্বাক-বিরোধী দার্শনিক গ্রন্থে, আগেও বলা হয়েছে, চার্বাকের উপস্থিতি সেটুকুই যেটুকুর যুক্তিকে তাঁরা খণ্ডনের প্রয়োজন উপযোগী মনে করেছেন স্ব-স্ব মতকে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠা দানের লক্ষ্যে। চার্বাক-বিরোধী দার্শনিকরা এটা করেছেন তাঁরা তাঁদের নিজস্ব দায় থেকেই। চার্বাক-মতকে করুণা দেখিয়ে প্রচারের উদ্দেশ্য থেকে তাঁরা তাঁদের দার্শনিক সাহিত্যে পূর্বপক্ষীয় চার্বাকমত উপস্থাপন করেছেন– এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। তবু তাঁদের এই কৃত উদ্যোগ থেকেই আজ যেকোনভাবেই চার্বাকমত সম্পর্কিত ধারণাটুকু পাওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে তাঁদের এই উদ্যোগকেই আমরা নিশ্চয়ই গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি।
কিন্তু চার্বাকেরা কেবল বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা অর্থাৎ বিতণ্ডা করেছেন, এ-পর্যায়ে এসে এমনটা বলা নিশ্চয়ই সুবিবেচনা প্রসূত মন্তব্য হবে না। চার্বাক নীতির মাধ্যমে যে বিরোধিতার মনোভাব সুপরিস্ফূট, যে কোন জাতির রাজনীতি, সমাজনীতি বা দর্শননীতি– প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই বিরোধিতার প্রয়োজন আছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধিতা না থাকলে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগতভাবে শাসকের যে যথেচ্ছচারিতার সুযোগ আসে, তার পরিচয় কারও কাছেই অবিদিত নয়। ভারতীয় সামাজিক আচরণ পদ্ধতি তার দর্শননীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি যে যাজকদের যথেচ্ছচারিতাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সমাজজীবনে যে আতিশয্যের সূত্রপাত হয়েছিলো তার প্রতিবাদের মাধ্যমেই চার্বাকী বিদ্রোহাত্মক নীতির সূচনা। প্রকৃতপক্ষে সামাজিক অনাচারের প্রতিরোধের ভূমিকাতেই চার্বাক প্রাথমিক পর্যায়ে অবতীর্ণ বলে মনে হয়, কিন্তু ভারতীয় সমাজনীতির সঙ্গে দর্শননীতির এই অচ্ছেদ্য যোগের জন্যই দার্শনিক মতবাদের ক্ষেত্রেও চার্বাকের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় কার্যকর।
উপরের মন্তব্য প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে যে, চার্বাকের নীতি নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনায় উজ্জ্বল নয়। এই মন্তব্যের ভিত্তি যদি হয় চার্বাকদের মধ্যে আত্মা, অদৃষ্ট, কর্মফল, পরলোক, জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম এ-জাতীয় নতুন কোন অবাস্তব অলৌকিক কল্পনার অনুপস্থিতি, তাহলে যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে হয় যে চার্বাকের এই কথিত অনুজ্জ্বলতাই তাঁদের বিজ্ঞান-চেতনায় অগ্রণী হয়ে থাকার সবচাইতে বড়ো দার্শনিক উজ্জ্বলতার দৃষ্টান্ত। বলতে বাধা নেই, আধুনিক বিজ্ঞানের আজকের এই কল্পনাতীত সাফল্যের আঁতুর-ঘর যে প্রকৃতি-বিজ্ঞান, সেই বিজ্ঞান-চিন্তায়ও ছিলো অলৌকিক অবাস্তবতাকে একপাশে সরিয়ে রেখে চিরায়ত প্রাকৃতিক নিয়মের যথাযথ ব্যাখ্যা হাজির করা। এই প্রাকৃতিক নিয়মই প্রকৃতির অধিভুক্ত বিভিন্ন বস্তুপুঞ্জের নিজ নিজ ও বিভিন্ন সমবায়ের বৈশিষ্ট্যিকৃত স্বভাব-নিয়ম নয় কি?
চার্বাক দর্শননীতিতে বহু ক্ষেত্রে অসঙ্গতি আছে বলে চার্বাক-সমালোচকরা আরেকটি যে অভিযোগ তোলেন সেটাও কতোটা বস্তুনিষ্ঠ– চার্বাকী নিজস্ব গ্রন্থের অভাব-প্রসূত কারণে বিরোধীপক্ষের স্বেচ্ছাকৃত আরোপিত কৌশল কিনা– পর্যালোচনার দাবি রাখে। চার্বাক সমালোচকরা হয়তো এই বিষয়টা খুব সযতনে এড়িয়ে যান যে, বিরোধী যুক্তির বিরোধিতায় যে প্রতিযুক্তি উপস্থাপিত হয় সেখানেও উপস্থাপিত যুক্তির সমর্থনে একটা দার্শনিক অবস্থান স্পষ্ট হতে হয়। নইলে তা কোন বিচারেই দার্শনিক তত্ত্ব বলে গৃহীত হয় না। চার্বাকরা আত্মার স্বীকৃতির বিপক্ষে যখন যুক্তি স্থাপন করেন সেখানে দার্শনিক সমর্থন হিসেবে দেহকেই আত্মা বলে স্বীকার করার সপক্ষেও প্রয়োজনীয় যুক্তি তুলে ধরেন। কিংবা প্রাকৃতিক ঘটনাপুঞ্জের ব্যাখ্যায় অপ্রমাণিত ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে গিয়ে তার যুক্তির সমর্থনে স্বভাব-নিয়ম বলে একটা তত্ত্বেরও স্বীকৃতি দেন। তার মানে চার্বাকী যুক্তি কেবল হাওয়াই বিরোধিতাই নয়, বরং তার সমর্থনে যে যুক্তির আয়োজন চোখে পড়ে তাকে কোনভাবেই তত্ত্বহীন বলার যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। চক্ষু বন্ধ রাখলেই যে প্রলয় বন্ধ থাকে না– আধুনিক চার্বাক-সমালোচকরা তা না-মানলেও সেকালের প্রাচীন চার্বাক-বিরোধীরা যে খুব ভালো করেই বুঝতেন তার নিদর্শনই হলো সবগুলি চার্বাকেতর দার্শনিক সাহিত্যে সমস্ত সাধ্য ও সামর্থ দিয়ে চার্বাকমত খণ্ডনের ব্যাপক আয়োজন প্রচেষ্টা। অতএব এক্ষেত্রে সন্দেহের অবকাশ রাখা অনুচিত যে, চার্বাকমত একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শন এবং শুধু তাই নয়, সমকালীন অন্যান্য দর্শনগুলির তুলনায় বিজ্ঞানমনস্ক ভূমিকায় আবির্ভূত একটি অগ্রগামী দর্শন। এবং লোকায়তিক বলে যে যেভাবেই তাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চান-না-কেন, অবশ্যই তা বস্তুবাদী বা জড়বাদী দর্শন। যা ভারতীয় বস্তুবাদের প্রকৃষ্ট নির্দেশকও।
১। শাস্ত্রশাসনের শৃঙ্খলমুক্তি।
২। ভূতচৈতন্যবাদ। অতএব আত্মা প্রসঙ্গে ঔদাসীন্য।
৩। প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ।
৪। স্বভাববাদ।
৫। প্রমাণ প্রসঙ্গে প্রবৃত্তিসামর্থ্যবাদ।
চার্বাক সিদ্ধান্তের সামগ্রিক আলোচনার প্রেক্ষিতে নির্ণীত বস্তুবাদের এই নির্দেশনাগুলি নিয়ে নতুন করে আর আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। বরং এখন মন্তব্য করা চলে যে, ভারতীয় চিন্তাজগতে চার্বাকের আবির্ভাব যে নিঃসন্দেহে একটা নতুন যুগের সূচনা করেছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বাসের বেদীমূলে যুক্তিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেবার ফলে ভারতীয় জনমানসে যে আবিলতা ক্রমশ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছিলো, শাস্ত্রশাসনের শৃঙ্খলমুক্তির মধ্য দিয়ে তার অপসারণের প্রচেষ্টার মধ্যে চার্বাকী চিন্তার প্রথম আত্মপ্রকাশ। চিরাচরিত সব কিছুই গ্রহণযোগ্য নয় এবং আপ্তবাক্য নামে যা প্রচলিত, তা সর্বক্ষেত্রে পথের নির্দেশ-প্রদানে অসমর্থ– ভারতীয় জনচিত্তে এই বোধের সূচনা চার্বাক দর্শনের প্রধান অবদান। চার্বাকের যুক্তিবাদী প্রবণতা আমাদের প্রতিদিনের ধারণার বিষয়গুলিকে যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখার প্রেরণা দিয়ে বহুকালে মজ্জাগত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
কিন্তু শাস্ত্রশাসনের শৃঙ্খলমুক্তির প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই চার্বাকের প্রথম আবির্ভাব বললে কথাটা পূর্ণাঙ্গ সত্যকথন হয় কিনা তাও ভাবার বিষয়। কেননা চার্বাক নামের আত্মপ্রকাশজনিত জটিলতা যাই থাকুক না কেন, চার্বাকী ভূতবাদী চিন্তার সূচনা যে আরো প্রাচীন লোকায়তিক দেহভিত্তিক প্রাকৃতিক ভাবনার গর্ভে সঞ্চিত ছিলো তা বোধকরি এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। আর এই লোকায়ত প্রাকৃত-ভাবনার মূলটুকু রয়ে গেছে আমাদের সুপ্রাচীন সিন্ধু-সভ্যতার কৃষিভিত্তিক সমাজ-সংগঠনের আদিম প্রজ্ঞাজাত লোক-অনুষ্ঠানগুলির দ্রষ্টব্যের মধ্যে। বস্তুতান্ত্রিকতার এই ধারাক্রমকে অস্বীকার করে হঠাৎ করে চার্বাকী চিন্তার উদ্ভব হওয়া যে ঐতিহাসিকভাবে সম্ভব নয়, তা স্বীকার করা বোধকরি অমূলক হবে না। তারও অনেককাল পরের বৈদিক সংস্কৃতির প্রাচীনতর নিদর্শন হিসেবে ঋগ্বেদ-সংহিতার যুগের সমাজ-সভ্যতার চিন্তাধারা বিশ্লেষণ করলেও এই ধারণা মোটেও অযৌক্তিক নয় যে, যতোই অলৌকিক মহিমা আরোপ করা হোক-না-কেন, ঋগ্বেদের প্রথমকালের পার্থিব কামনাভিত্তিক চাওয়া-পাওয়াগুলিও একান্তই বস্তুতান্ত্রিক জনমানসেরই সাক্ষ্য বহন করে। বৈদিক যুগের শেষ লগ্নে উপনিষদ্-যুগের আত্মগত জ্ঞানচিন্তার উন্মেষকালেও সকল উপনিষদকাররা বহমান বস্তুতান্ত্রিক বাস্তবতা থেকে যে সমূলে বেরিয়ে আসতে পারেননি তার নজির দেখানোও অসম্ভব হবে না মনে হয়। যদি তাই হয়, ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে দার্শনিক বিচারের দিক থেকে বস্তুনিষ্ঠাহীনতার পরিচায়ক হিসেবে চার্বাকদের একেবারে একঘরে করে রাখার প্রচলিত প্রথায় তাঁদের বিরুদ্ধে যতো গালমন্দই বর্ষিত হোক না কেন, বস্তুবাদের প্রতিনিধি হিসেবে আসলে তাঁরা একান্তই নিঃসঙ্গ ছিলেন না বলা চলে। বেদান্তের মূল উপপাদ্য যেখানে ‘একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, এ জগৎ মিথ্যা’, সেই বৈদান্তিক মহলেই এই বস্তুবাদের নজির আকর্ষণীয় বৈকি। এ-প্রসঙ্গে একটু আলোকপাত করা যেতেই পারে।
Tags
চার্বাক দর্শন