কার্য–কারণ তত্ত্ব | সাংখ্য দর্শন,

কার্যকারণ তত্ত্ব


কার্য–কারণ তত্ত্ব | সাংখ্য দর্শন,



কার্যের সঙ্গে কারণের সম্বন্ধ অর্থাৎ কার্যকারণতত্ত্ব দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। আমরা কার্য প্রত্যক্ষ করিকিন্তু সেই কার্যের কারণ কী এবং সেই কারণের সঙ্গে ঐ কার্যের সম্বন্ধ কী ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করতে পারি না। তা জানার জন্য মানুষ যা ভেবেছেসেই ভাবনার সমষ্টিই দর্শন। কার্যকারণভাবকে অবলম্বন করে জগতের মূলতত্ত্বে উপনীত হওয়াই দর্শনের লক্ষ্য। ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়গুলি দৃশ্যমান বস্তুর কার্যকারণভাবের দ্বারাই তাদের স্বরূপ অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি সম্প্রদায়ই স্বীকৃত তত্ত্ব ও স্বীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাগতিক কার্যকারণভাবকে ব্যাখ্যা করেছেন। ফলে স্বভাবতই ভারতীয় দর্শনসমূহে নানা ধরনের কার্যকারণভাব পরিলক্ষিত হয়।
 .
উৎপত্তিঘটিত কার্যকারণ বিষয়ে ভারতীয় দর্শনে অনেকগুলি মত প্রচলিত আছে। বেদান্ত ও সাংখ্যসম্প্রদায়স্বীকৃত কার্যকারণভাব ‘সৎকার্যবাদ’ নামে পরিচিত। সাংখ্যসম্মত সৎকার্যবাদকে ‘পরিণামবাদ’ এবং অদ্বৈতবেদান্তসম্মত সৎকার্যবাদকে ‘বিবর্তবাদ’ বলা হয়। অন্যদিকে ন্যায়বৈশেষিক ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়স্বীকৃত কার্যকারণভাব ‘অসৎকার্যবাদ’ বা ‘আরম্ভবাদ’ নামে পরিচিত। তবে সম্প্রদায়ভেদে তারও প্রকারভেদ রয়েছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কার্যকারণবাদগুলির মধ্যে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য
(সাংখ্যদর্শনের সৎকার্যবাদ বা পরিণামবাদ
(নৈয়ায়িক ও বৈশেষিকদের পরমাণুবাদ বা আরম্ভবাদ
(বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের বিবর্তবাদ
(বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সংঘাতবাদ বা পরমাণুপুঞ্জবাদ
(কাশ্মীরীয় পণ্ডিতদের আভাসবাদ।
 .
সাধারণত যে কোন উৎপন্ন বস্তুকে বলা হয় কার্য এবং যা থেকে ঐ কার্য উৎপন্ন হয় তাকে বলা হয় ঐ কার্যের কারণ। বস্তুর কার্যকারণভাব আপেক্ষিক। জগতের প্রায় সকল বস্তুই দেশকাল ও নিমিত্তভেদে কখনো কারণআবার কখনো কার্য হয়ে থাকেএকান্ত কারণ বা একান্ত কার্য হয় না। আবার কারণ থেকে যে সকল কার্য উৎপন্ন হয় তারাও সকলে একরূপ নয়ফলে কারণও নানাবিধ। সাংখ্য সম্প্রদায় উপাদান ও নিমিত্তভেদে দুই প্রকার কারণ স্বীকার করেন।
 .
কার্যের যা উপাদান অর্থাৎ যা থেকে কার্য উৎপন্ন হয়তাই তার উপাদান কারণ। উপাদানই কার্যের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়। ন্যায়মতে কার্যের উপাদান যেহেতু কার্যের সঙ্গে সমবায় সম্বন্ধে সংবদ্ধ হয়ে তার আশ্রয় হয়সেহেতু কার্যের উপাদান কার্যের সমবায়ী কারণ। অপরদিকে যে ক্রিয়াশক্তির দ্বারা উপাদান থেকে কার্য উৎপন্ন হয়সেই ক্রিয়াশক্তি হলো কার্যের নিমিত্ত কারণ। উপাদান আপনাআপনি কার্যে পরিণত হয় নাএর জন্য প্রয়োজন উপাদানে ক্রিয়াশক্তির প্রয়োগ। এই ক্রিয়াশক্তি কার্যের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নাকার্যের বাইরে থেকে কার্যকে ঘটায় মাত্র। একটি মৃত্তিকানির্মিত ঘটের ক্ষেত্রে মৃত্তিকা হলো উপাদান কারণ এবং দণ্ডচক্রাদি হলো তার নিমিত্ত কারণ।
 .
কারণ ও কার্য যে ভিন্ন এবং উভয়ই যে সৎসে বিষয়ে ন্যায় ও সাংখ্য সম্প্রদায় একমত। কিন্তু প্রশ্ন হলোউৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে বর্তমান থাকে কি না এই প্রশ্নের যাঁরা সদর্থক উত্তরে বিশ্বাসীতাঁদের বলা হয় সৎকার্যবাদী। অপরদিকে যাঁরা এই প্রশ্নের নঞর্থক উত্তরে বিশ্বাসীতাঁদের বলা হয় অসৎকার্যবাদী
 .
সৎকার্যবাদী সাংখ্য সম্প্রদায় মনে করেনকার্য আবির্ভূত হবার পূর্বে অব্যক্তাবস্থায় কারণে বর্তমান থাকে। অন্যদিকে অসৎকার্যবাদী ন্যায়বৈশেষিক ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় মনে করেনউৎপন্ন হবার পূর্বে কার্যের কোন অস্তিত্বই থাকে নাকার্য সম্পূর্ণভাবে নতুন সৃষ্টি বা আরম্ভ। ক্ষণিকবাদী বৌদ্ধমতেবস্তু উৎপত্তির পরমুহূর্তেই যেহেতু বিনষ্ট হয়সেহেতু অসৎ কারণ থেকে সৎকার্যের উৎপত্তি হয়। আবার সৎকার্যবাদী অদ্বৈতবেদান্তমতে কার্য উৎপত্তির পূর্বে কারণে বর্তমান থাকলেও কারণ ও কার্য সমসত্তাক নয়। কারণের সত্তা কার্যের সত্তার অপেক্ষা অধিক এবং কার্যের সত্তা কারণের সত্তার অপেক্ষা ন্যূন। অদ্বৈতবেদান্তীদের এই কার্যকারণতত্ত্ব বিবর্তবাদ নামে পরিচিত।
 .
সাংখ্যমতে কারণ ও কার্য উভয়ই সৎ। কার্য উৎপত্তির পূর্বে শুধু যে কারণের মধ্যে বর্তমান থাকে তাই নয়কারণ ও কার্য সমসত্তাক বা সমপ্রকৃতিক। কার্যের মধ্যে কারণের যথার্থ ও বাস্তব পরিণাম ঘটে থাকে। অর্থাৎ সৃষ্টিকালে সৎ কারণ সৎ কার্যে পরিণাম প্রাপ্ত হয় এবং প্রলয়কালে সৎ কার্য সৎ কারণে পরিণাম প্রাপ্ত হয়। তাই সাংখ্য দর্শনের সৎকার্যবাদ পরিণামবাদ নামে পরিচিত।
 .
সাংখ্যদর্শনে সৎকার্যবাদ
যে মতবাদ অনুসারে উৎপত্তির পরের মতো উৎপত্তির পূর্বেও কার্য তার উপাদান কারণে সৎতাকে বলে সৎকার্যবাদ। আর যে মতবাদ অনুসারে উৎপত্তির পূর্বে কার্য তার উপাদান কারণে অসৎতাকে বলে অসৎকার্যবাদ। সাংখ্য সম্প্রদায় সৎকার্যবাদী। সাংখ্য দার্শনিকদের সিদ্ধান্ত হলো
সতঃ সজ্জায়ত’। অর্থাৎসৎ বস্তু থেকে সৎ বস্তু উৎপন্ন হয়।
 .
সাংখ্যমতে কারণ কার্যেরই অব্যক্ত অবস্থা। অর্থাৎউৎপত্তির পূর্বে কার্যকারণের মধ্যে অব্যক্তভাবে বা সূক্ষ্মভাবে থাকে বলে তাকে কেউ দেখতে পায় না। তাছাড়া কারণে কার্য কখনও অসৎ নয়। কার্য কারণেরই পরিণাম। কার্য নতুন আরম্ভ বা নতুন সৃষ্টি নয়। দুধ থেকে যখন দই উৎপন্ন হয়তখন দুধ দইরূপে পরিণত হয়দই নতুন সৃষ্টি নয়। দই উৎপন্ন হওয়ার আগে দুধের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় থাকেপরে সেটি দইরূপে অভিব্যক্ত হয়। সাংখ্য দার্শনিকদের মতেপরিদৃশ্যমান শব্দ প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ সুখদুঃখমোহস্বভাব। তাঁদের মতে ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতিও সুখদুঃখমোহস্বভাব। সুতরাং কার্য ও কারণ সমসত্তাক বা সমপ্রকৃতিক। এটি স্বীকৃত হলে কার্যের প্রতি প্রকৃতির কারণতা যুক্তিসিদ্ধ হয়।
 .
কার্য যে উৎপত্তির পূর্বে কারণে বর্তমান থাকেকার্য যে কারণের বাস্তব পরিণাম এবং কারণ ও কার্য যে সমসত্তাক– সৎকার্যবাদী এই সিদ্ধান্তের পক্ষে সাংখ্যাচার্যগণ প্রধানত পাঁচটি যুক্তির অবতারণা করেছেন। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ তাঁর সাংখ্যকারিকার নবম কারিকায় এই পাঁচটি যুক্তি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন
অসৎ অকরণাৎ উপাদানগ্রহণাৎ সর্বসম্ভবাভাবাৎ।
শক্তস্য শক্যকরণাৎ কারণভাবাৎ চ সৎ কার্যম্’ ।। (সাংখ্যকারিকা)
অর্থাৎ যা নেই তাকে উৎপন্ন করা যায় নাকার্য উৎপাদনে সমর্থ বস্তু থেকেই উৎপাদনযোগ্য বস্তু উৎপন্ন হতে পারেযে কোন কিছু থেকে যে কোন কিছু উৎপন্ন হয় নাএকটি বস্তু যে কার্য উৎপাদনে সমর্থ সেই বস্তুটি কেবলমাত্র সেই কার্যই উৎপাদন করে এবং কার্য স্বরূপত কারণ থেকে অভিন্ন বলে একটি কার্য উৎপত্তির পূর্বে তার উপাদান কারণে অস্তিত্বশীল থাকে।
 .
মোটকথাএই কারিকায় কার্যমাত্রে সত্ত্ব প্রতিপাদনের উদ্দেশ্যে যে পাঁচটি হেতু প্রদর্শন করা হয়েছেতা হলো– (অসৎঅকরণাৎঅসৎ বস্তুর অনুৎপত্তিহেতুঅর্থাৎ যা নেই বা অসৎ তা উৎপন্ন হয় না, (উপাদানগ্রহণাৎকার্যমাত্রই উপাদানজন্য হেতুঅর্থাৎ কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ স্বীকার্য, (সর্বসম্ভবাভাবাৎযে কোন বস্তু থেকে যে কোন বস্তুর অনুৎপত্তিহেত,ু অর্থাৎ বিশেষ কারণ থেকে বিশেষ কার্যই উৎপন্ন হয়, (শক্তস্যশক্যকরণাৎশক্য কারণ থেকে কার্যের উৎপত্তিহেতুঅর্থাৎ শক্য কারণের মধ্যেই কার্যশক্তি নিহিত থাকে এবং (কারণভাবাৎকার্যকারণভাবঅর্থাৎ উপাদান কারণ ও কার্য অভিন্ন।
 .
সৎকার্যবাদের সমর্থনে এবং বিভিন্ন পূর্বপক্ষ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে সাংখ্য দার্শনিকদের পক্ষ থেকে এই হেতুগুলি প্রদর্শন করা হয়েছে। যেসব প্রেক্ষিতে এসব যুক্তির উত্থাপন হয়েছে তা দেখা যেতে পারে।
 .
প্রথমহেতু: (অসদকরণাৎ)– সংকার্যবাদের পক্ষে সাংখ্য সম্প্রদায়ের প্রথম যুক্তি হলোকার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হয়তাহলে কার্যের উৎপত্তি আদৌ সম্ভব হয় না। যা অসৎ তাকে কোনভাবেই উৎপন্ন করা যায় নাযেমন– গগনকুসুম। সহস্র শিল্পীও গগনকুসুমকে সৃষ্টি করতে বা নীলবর্ণকে পীতবর্ণ করতে পারে না।
এরূপ যুক্তির উত্তরে অসৎকার্যবাদীরা বলতে পারেন নাযা সর্বকালেই অসৎ তাকে কেউ উৎপন্ন করতে পারে না– একথা ঠিক। কিন্তু উৎপত্তির পূর্বে কার্য গগনকুসুমাদির ন্যায় সর্বকালে থাকে না। কার্য উৎপত্তির পূর্বে অসৎকিন্তু উৎপত্তির পরে সৎ হয়। সত্তা ও অসত্তা উভয়ই কার্যের ধর্ম। তার মধ্যে উৎপত্তির পূর্বকালে কার্যে অসত্তাধর্ম থাকেআর উৎপত্তিকাল থেকে স্থিতিকাল পর্যন্ত কার্যে সত্তাধর্ম থাকে।
এরূপ আপত্তির উত্তরে সাংখ্য সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলোউৎপত্তির পূর্বে কার্যে অসত্তাধর্ম থাকতেই পারে না। কেননাকার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হয়তাহলে অসত্তাধর্ম উৎপত্তিপূর্বকালীন কার্যে বর্তমান থাকেএকথা বলতে হয়। কিন্তু একথাও বলা যায় না। অসৎধর্মীতে কোন ধর্ম থাকা সম্ভব নয়। আর উৎপত্তির পূর্বে কার্য যদি সৎ হয়তাহলে তাতে অসত্তাধর্ম থাকার প্রশ্নই ওঠে না। সুতরাং অসত্তা কোনভাবেই কার্যবস্তুর ধর্ম হতে পারে না।
 .
সৎকার্যবাদের বিপক্ষে অসৎকার্যবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকরা বলেন যেঅসৎ কারণ থেকে সৎ কার্যের উৎপত্তি হয়। উক্ত বক্তব্যের সমর্থনে দৃষ্টান্তস্বরূপ তাঁরা বলেন যেবীজের বিনাশ থেকে অঙ্কুরের উৎপত্তি হয় অথবা মৃৎপিণ্ড বিনষ্ট হলে তবে ঘট উৎপন্ন হয়।
উক্ত পূর্বপক্ষের উত্তরে সাংখ্য দার্শনিকদের বক্তব্য হলোবিনাশের কোন কার্যোৎপাদন ক্ষমতা থাকতে পারে না। বীজমৃৎপিণ্ড ইত্যাদি ভাববস্তুরই কার্যোৎপাদন সামর্থ্য আছে। কিন্তু বিনাশ অভাবঅবস্তু। বিনাশ থেকে যদি বস্তু উৎপন্ন হতোতাহলে অসংখ্য বিনাশ বা অভাব জগতের সর্বত্র থাকায় জগতে সর্বত্রই সব কার্য উৎপন্ন হতে পারতো। কিন্তু তা হয় না। সুতরাংঅসৎ থেকে সৎ উৎপন্ন হয়এই মত গ্রাহ্য নয়।
 .
অন্যদিকে বৈদান্তিকরা যে জগৎকার্যকে মায়িক বলেনসাংখ্য দার্শনিকরা তা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন যেজগৎ যে সৎ বস্তু নয়– একথা স্বীকারের পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি নেই। অতএব সৎ কারণ থেকে অনির্বচনীয় কার্য উৎপন্ন হয়এই মতও গ্রাহ্য নয়।
 .
সৎকার্যবাদের অন্যতম প্রতিপক্ষ হলো ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়। এই মতে উৎপত্তির পূর্বে কারণে কার্যের প্রাগভাব থাকে। কার্য যদি কারণে আগে থেকেই থাকেতাহলে কার্য উৎপন্ন হলোএকথা বলা নিরর্থক হয়ে যায়। ‘অবয়বী’ একটি নতুন আরম্ভএটি অবয়বের অতিরিক্ত। তাছাড়া ঘটপটইত্যাদি যদি মাটিসুতো ইত্যাদিতে আগে থেকেই থাকে তাহলে কুম্ভকারতন্তুবায় ইত্যাদির প্রযত্ন নিরর্থক হয়ে যায।
উক্ত পূর্বপক্ষ খণ্ডন প্রসঙ্গে ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে বাচস্পতি মিশ্র বলেন
অসৎ চেৎ কারণব্যাপারাৎ পূর্ব্বং কার্য্যম্নাস্য সত্ত্বং কর্ত্তুং কেনাপি শক্যম্ । ন হি নীলং শিল্পিসহস্রেণাপি শক্যং পীতং কর্ত্তুম শক্যতে।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ যদি কারণব্যাপারের পূর্বে কার্য (উপাদান কারণেঅসৎ হয়তবে কেউ তাকে উৎপন্ন করতে পারে না। সহস্র শিল্পীও নীলকে পীত (বা হলুদকরতে পারে না।
 .
সুতরাংকারণে কার্য উৎপত্তির আগে থেকেই অব্যক্ত অবস্থায় থাকে। কুম্ভকারতন্তুবায় প্রভৃতি সেই অব্যক্ত কার্যকে ব্যক্ত করেন মাত্র। আমাদের অভিজ্ঞতায় এরকম অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়ার একাধিক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে বাচস্পতি মিশ্র তাঁর তত্ত্বকৌমুদী গ্রন্থে আরো বলেন
কারণাচ্চাস্য সতোহভিব্যক্তিরেবাশিষ্যতে সতশ্চাভিব্যক্তিরুপপন্নাযথা– পীড়নেন তিলেষু তৈলস্যঅবঘাতেন ধান্যেষু তণ্ডলানাংদোহনেন সৌরভেয়ীষু পয়সঃ। অসতঃ করণে তু ন নিদর্শনং কিঞ্চিদস্তি। ন খল্বভিব্যজমানং চোৎপদ্যমানং বা ক্কচিদসদ্ দৃষ্টম্ ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ কারণব্যাপারের ফলে এই সৎ কার্যেরই অভিব্যক্তি উৎপন্ন হয়। যেমনপীড়ন বা পেষণের দ্বারা তিল থেকে তেল উৎপন্ন হয়আঘাতের দ্বারা ধান থেকে চাল উৎপন্ন হয়দোহনের দ্বারা গাভী থেকে দুধ পাওয়া যায়। কিন্তু অসদ্বস্তু উৎপন্ন হচ্ছেএমন কোথাও দেখা যায় না।
 .
তাঁর মতেকেউ বলবে না যে ঐ তেলচাল বা দুধ আগে থেকে তিলেধানে বা গাভীতে ছিলো না। কারণ তা যদি না থাকতোতাহলে তেলচালদুধ আমরা ঐভাবে পেতাম না। সুতরাং যা অসৎ তা কখনো উৎপন্ন হয় না।
 .
এ প্রেক্ষিতে পূর্বপক্ষী বলতে পারেন যে কার্য উৎপত্তির পূর্বে অসৎই। যেখানে ঘটসংযোগ ছিলো সেখান থেকে ঘটকে অপসারিত করার পর সেখানে যেমন ঘটাভাব থাকেঅনুরূপভাবে ঘট উৎপত্তির পূর্বেও কপালে ঘটাভাব থাকে। যেখানে ঘটাভাব থাকেসেখানে ঘট থাকতে পারে না। সুতরাংউৎপত্তির পূর্বে কপালে ঘট থাকতে পারে না।
উক্ত বক্তব্যের প্রতিবাদে স্বমতস্থাপনের উদ্দেশ্যে সাংখ্যকারিকায় দ্বিতীয় হেতুটি উপস্থাপন করা হয়।
 .
দ্বিতীয়হেতু: (উপাদানগ্রহণাৎ)– সৎকার্যবাদ সমর্থনে সাংখ্য সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় যুক্তি হলোকারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ অবশ্যস্বীকার্য। উপাদান অর্থ কারণগ্রহণ অর্থ সম্বন্ধ। কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ থাকার জন্য কার্যকে উৎপত্তির পূর্বে সৎ বলতে হবে। যে কারণ যে কার্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্তসেই কারণই সেই কার্যের জনক হতে পারে। অন্যথা মৃত্তিকা হতে পট বা বস্ত্রের উৎপত্তি এবং তন্তু হতে ঘটের উৎপত্তি হয় না কেন উৎপত্তির পূর্ব থেকে কার্যের সঙ্গে কারণের সম্বন্ধ স্বীকার করলে আর ঐ আপত্তি ওঠে না। কপাল প্রভৃতির সঙ্গে ঘট প্রভৃতির কার্যকারণ সম্বন্ধ অনস্বীকার্য। সম্বন্ধ সর্বদা উভয়বৃত্তি। কার্যটি উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হলে কিন্তু ঐ সম্বন্ধ সম্ভব হয় না। আবার উক্ত কার্যকারণ সম্বন্ধ স্বীকার না করলে নির্দিষ্ট কারণ থেকে নির্দিষ্ট কার্যের উৎপত্তি উপপন্ন হবে না।
 .
বস্তুতপক্ষে যে কারণের সঙ্গে যে কার্যের সম্বন্ধ আছে সেই কারণ থেকেই সেই কার্য উৎপন্ন হতে পারে। ঘটের সঙ্গে মৃত্তিকার সম্বন্ধ আছেকিন্তু বস্ত্রের সঙ্গে নেই। তাই মৃত্তিকা থেকে ঘটেরই উৎপত্তি হয়বস্ত্রের হয় না। কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ যেহেতু অবশ্যস্বীকার্যসেহেতু উৎপত্তির পূর্বেও কার্যের সত্তা স্বীকার করতে হয়। উৎপত্তির পূর্বে ঘট অসৎ হলে তার সঙ্গে সৎ মৃত্তিকার সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে নাকারণ সৎ ও অসতের মধ্যে কোন সম্বন্ধ সম্ভব নয়। অতএব উৎপত্তির পূর্বেও কার্য কারণে সৎ থাকে একথা স্বীকার করতে হয়।
 .
আপত্তি হতে পারে যেকারণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না হয়েই কার্য উৎপন্ন হোক। তা খণ্ডনকল্পেই সাংখ্যকারিকায় তৃতীয় হেতুর উপস্থাপন।
 .
তৃতীয়হেতু: (সর্বসম্ভবাভাবাৎ)– স্বীয় সিদ্ধান্ত সৎকার্যবাদের পক্ষে সাংখ্য সম্প্রদায়ের তৃতীয় যুক্তিটি হলোএকমাত্র বিশেষ কারণ থেকেই বিশেষ কার্য উৎপন্ন হয়। পশমতন্তু থেকে পশমবস্ত্র হয়তিল থেকে তেল হয়। তিল থেকে পশমবস্ত্র বা ধূলিকণা থেকে তেল হয় না। এ থেকে মনে হয়কার্য নিশ্চয়ই উপাদান কারণে কোন না কোন ভাবে বিদ্যমান থাকে। যদি তা না থাকতোতাহলে যে কোন কারণ থেকেই যে কোন কার্য উৎপন্ন হতে পারতো। অর্থাৎউপাদানের সঙ্গে সম্বন্ধহীন কার্যের উৎপত্তি স্বীকার করলে সকল কার্যের সঙ্গে সকল কারণের থেকে উৎপত্তির আপত্তি হবে। কিন্তু সংসারে এরূপ অব্যবস্থা দেখা যায় না। কোন্ কারণ থেকে কোন্ কার্য হবে নির্দিষ্টভাবে সে ব্যবস্থা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কার্য উৎপত্তির পূর্বে কারণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে থাকেকার্য উৎপত্তির পর কারণের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয় না। সাংখ্যমতে কারণ ও কার্যের এই সম্বন্ধ হলো তাদাত্ম্য সম্বন্ধ। অতএবউৎপত্তির পূর্বেই কারণে কার্যের উপস্থিতি স্বীকার করতে হয়।
 .
এ যুক্তির বিপক্ষে পূর্বপক্ষী বলতে পারেন যেউৎপত্তির পূর্বে কার্য সৎ নয়। সুতরাংতখন কারণে কার্যের সম্বন্ধ থাকে না। কিন্তু কার্য নিজের উপাদানকারণে সম্বন্ধযুক্ত না হলেও কারণব্যাপারের দ্বারা ঐ অসৎ কার্যেরই উৎপত্তি হয়যেহেতু ঐ কারণে ঐ কার্য উৎপাদনের শক্তি আছে। অর্থাৎকারণত্ব সম্বন্ধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়তার শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন মাটিতে ঘট জনন শক্তি থাকায় মাটি ঘটের প্রতি কারণ।
পূর্বপক্ষকে নিরাস করার লক্ষ্যে সাংখ্যকারিকাকার পরবর্তী চতুর্থ হেতুটি উপস্থাপন করেন।
 .
চতুর্থহেতু: (শক্তস্যশক্যকরণাৎ)– সৎকার্যবাদের পক্ষে সাংখ্য সম্প্রদায়ের চতুর্থ যুক্তি হলোশক্য কারণের মধ্যেই কার্যশক্তি নিহিত থাকে। একটি কার্যের কার্যশক্তি যে কোন কারণের মধ্যে নিহিত থাকতে পারে না। এটা অবাস্তব। যে কোন কারণে যে কোন কার্যশক্তি নিহিত থাকলে কার্যের উৎপত্তির অব্যবস্থা দেখা দেয়। এজন্য স্বীকার করতে হয় যেমৃত্তিকাই ঘটের শক্য কারণ এবং এই শক্য কারণেই ঘটকার্যের ঘটজননশক্তি নিহিত। ঐ ঘটকার্যের সঙ্গে ঘটজননশক্তির যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছেতা অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে। এই সম্বন্ধ উপপাদনের জন্য একথা স্বীকার করতে হবে যেউপাদান কারণ মৃত্তিকাতে ঘট তথা ঘটজননশক্তি উৎপত্তির পূর্বেই বর্তমান থাকে এবং তা মৃত্তিকারই ধর্মবিশেষ। বস্তুত ঘটজননশক্তি ঘটকার্যের সম্ভাবনা ও সুপ্তাবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই শক্তিই কালক্রমে ঘটকার্যরূপে অভিব্যক্ত হয় মাত্র।
অর্থাৎশক্তি কোন নির্দিষ্ট কারণে থাকে। যে কারণটির যে কার্যটি উৎপন্ন করার শক্তি আছেসেই কারণটি কেবল সেই কার্যটিই উৎপন্ন করতে পারেঅন্য কোন কার্য সে উৎপন্ন করতে পারে না। কারণে নিহিত শক্তি যদি এইভাবে কেবল তার শক্য কার্যের উপরই ক্রিয়া করতে সমর্থ হয়তাহলে স্বীকার করতে হবে যে শক্তিবিশেষ শক্যবিশেষের সঙ্গেই সম্বন্ধযুক্ত।
 .
এক্ষেত্রে প্রতিবাদী পূর্বপক্ষীয় বলতে পারেন যেমৃত্তিকা বা মাটি থাকলে এবং মাটির অতিরিক্ত অন্যান্য কারণ থাকলে ঘট হয়আবার মাটি না থাকলে এবং মাটির অতিরিক্ত অন্যান্য কারণ থাকলেও ঘট হয় না। এরূপ অন্বয়ব্যাতিরেকের দ্বারাই মাটির কারণত্ব ও ঘটের কার্যত্ব সিদ্ধ হয়। এর জন্য কার্যকারণের তাদাত্ম্যসম্বন্ধ এবং তার অনুরোধে উৎপত্তির পূর্বে কার্যের সত্ত্বস্বীকার অনাবশ্যক।
উক্ত আক্ষেপের সমাধানে ও সৎকার্যবাদের সমর্থনে সাংখ্যকারিকাকার এ বিষয়ক সর্বশেষ পঞ্চম হেতুটির উপস্থাপন করেন।
 .
পঞ্চমহেতু: (কারণভাবাৎ)– সৎকার্যবাদের সমর্থনে সাংখ্যাচার্যগণের পঞ্চম ও চরম যুক্তি হলোউপাদান কারণ ও কার্য বস্তুত অভিন্ন। এখানে ‘ভাব’ অর্থ হলো তাদাত্ম্য বা স্বরূপ। যেহেতু কার্য সর্বদা নিজের উপাদানকারণের সঙ্গে তাদাত্ম্য বা অভেদ সম্বন্ধে থাকেসেহেতু কার্য সকল সময়েই কারণাত্মক। সৎ কারণের সঙ্গে অভিন্ন কার্য অসৎ হতে পারে না। সুতরাং কার্য সৎ।
 .
সুবর্ণনির্মিত বলয় যেমন তার উপাদান সুবর্ণ থেকে অভিন্নতেমনি সকল ক্ষেত্রেই উপাদান ও তার কার্য অভিন্ন। উপাদান কারণ ও কার্য যে অভিন্নসাংখ্যাচার্যগণ তা একাধিক যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যে বস্তু যা থেকে ভিন্নসে বস্তু তার ধর্ম হয় না। অপরদিকে যে বস্তু যার ধর্মসে বস্তু ঐ ধর্মের সঙ্গে অভিন্ন। পট বা বস্ত্র তন্তুর ধর্ম হওয়ায় পটকে তন্তুর সঙ্গে অভিন্ন বলতে হয়। এখানে পটকে তন্তুর ধর্ম বলতে তন্তুতে পটের বৃত্তিকে বোঝানো হয়েছে। বৃত্তি হেতু তন্তু ও পট অভিন্ন।
অনুরূপভাবে সাংখ্যাচার্যরা উপাদানউপাদেয়ভাবসংযোগপ্রাপ্তাভাব ও গুরুত্বান্তরকার্যাগ্রহণ হেতুর দ্বারাও কারণ ও কার্য যে অভিন্নতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কার্য ও কারণের মধ্যে উপাদানউপাদেয়ভাব থাকে বলে তারা অভিন্ন হয়। আবার যাদের মধ্যে সংযোগ ও বিভাগের অভাব থাকেতারাও অভিন্ন বলে বিবেচিত হয়। সর্বশেষে যাদের মধ্যে গুরুত্বের ভেদ থাকে নাতারা ভিন্ন হতে পারে না। কারণ ও কার্যের মধ্যে উপাদানউপাদেয়ভাববশত কারণ ও কার্যকে অভিন্ন বলতে হয়। আবার কারণ ও কার্যের মধ্যে সংযোগ বা বিভাগ কখনো দেখা যায় না। উভয়ই তাই অভিন্ন বলে বিবেচিত। পরিশেষে কারণ ও কার্যের গুরুত্ব বা পরিমাণগত অভিন্নতাবশত উভয়কে অভিন্ন বলে স্বীকার করতে হয়।
 .
সাংখ্যকারিকা ও সাংখ্যসূত্রে এসব যুক্তির সাহায্যে সৎকার্যবাদে কারণ ও কার্য অভিন্ন প্রমাণিত করে কার্য যে উৎপত্তির পূর্বে কারণে বিদ্যমান থাকে তা প্রতিপাদন করা হয়েছে।
 .
অসৎকার্যবাদ :
ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায় সাংখ্য সম্প্রদায়ের সৎকার্যবাদী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কার্য ও কারণকে অত্যন্ত ভিন্ন বলে দাবি করেছেন। তাঁদের মতে ক্রিয়া (উৎপত্তি), নিরোধ (ধ্বংস), ব্যপদেশ (ব্যবহার), অর্থক্রিয়াভেদ (প্রয়োজন সাধনের ভিন্নতাএবং ক্রিয়াব্যবস্থা (প্রয়োজন সাধনের নিয়ম)- এই পঞ্চহেতুর দ্বারা কারণ ও কার্যের মধ্যে ভেদ সিদ্ধ হয়।
 .
ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলোউৎপত্তির পূর্বেও কার্য কারণে বিদ্যমান থাকেএকথা যদি স্বীকার করা হয়তাহলে কার্যোৎপত্তির কোন অর্থ থাকে না। কারণ ও কার্য দুটি ভিন্ন কালে উৎপন্ন ও ভিন্ন কালে ধ্বংস হয়। সুতরাং তাদের অভিন্ন বলার পক্ষে কোন যুক্তি থাকতে পারে না। যদি বস্তুতই উৎপত্তির পূর্বে ঘট মৃত্তিকাতে থাকেতাহলে ঘটের কার্যকরি শক্তি মৃত্তিকাতে থাকে না কেন ঘটের দ্বারা যে জল আনয়নাদি ক্রিয়া সম্পাদিত হয়মৃত্তিকার দ্বারা তা হয় নাপটের দ্বারা যে গাত্রনিবারণাদি ক্রিয়া সম্পাদিত হয়তন্তুর দ্বারা তা হয় না।
 .
বস্তুত প্রতিটি কার্যেরই এক একটি নির্দিষ্ট আকৃতি থাকে। কোন কার্যের নির্দিষ্ট আকৃতিহীন উপাদান কখনোই ঐ কার্যরূপে বিবেচিত হতে পারে না। ঘটাকারবিশিষ্ট মৃত্তিকাকেই ঘট বলা হয়ঘটাকৃতিহীন মৃৎপিণ্ড কখনোই ঘট বলে বিবেচিত হয় না। কার্যবস্তুমাত্রই কতকগুলি অংশ বা অবয়বের দ্বারা নির্মিত। কারণ ও কার্য ভিন্ন না হলে অবয়ব ও অবয়বীর ভেদ উপপন্ন হয় না। বস্তুত আরম্ভক অবয়ব ও উৎপন্ন অবয়বীর ভেদ প্রত্যক্ষঅভিজ্ঞতাসিদ্ধ। আরম্ভক অবয়বের সংখ্যার দ্বারাই অবয়বীর পরিমাণ নির্ধারিত হয়। সৎকার্যবাদ স্বীকার করলে সিদ্ধ এই অভিজ্ঞতা বাধিত অর্থাৎ বাধাপ্রাপ্ত হয়। অতএব স্বীকার করতে হয় যেউৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে থাকে না এবং কার্য সম্পূর্ণ নতুন সৃষ্টি।
 .
সাংখ্য সম্প্রদায় ন্যায়াচার্যদের প্রদত্ত উপরিউক্ত যুক্তিগুলি ত্র“টিপূর্ণ বলে মনে করেন। তাঁদের মতেবস্তুর উৎপত্তি ও ধ্বংস প্রকৃতপক্ষে বস্তুর বিনাশ ও সংকোচন বা ব্যক্ত ও অব্যক্ত অবস্থান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়। কুর্ম্মশরীরে মস্তকাদি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কখনো বিকশিত বা আবির্ভূতআবার কখনো সংকুচিত বা তিরোহিত হয়তেমনি ঘটপটাদি কার্য কখনো আবির্ভূত ও কখনো তিরোহিত হয়। কার্যের এই আবির্ভাব ও তিরোভাবকেই উৎপত্তি ও বিনাশ বলা হয়। নতুন উৎপত্তি ও চিরকালীন বিনাশ বলে কিছু নেই। অসতের কখনো উৎপত্তি হয় নাআবার সৎএর কখনো বিনাশ হয় না। অর্থক্রিয়াভেদাদির দ্বারাও কারণ ও কার্যের একান্তভেদ সিদ্ধ হয় না। একই বস্তুর বহুবিধ ব্যবহার দেখা যায়আবার একক ও সম্মিলিত শক্তিভেদে ক্রিয়াব্যবস্থারও ব্যতিক্রম দেখা যায়। সুতরাং নৈয়ায়িকগণ যে সকল যুক্তিতে কারণ ও কার্যের অত্যন্ত ভেদ সিদ্ধ করেছেনতা গ্রহণযোগ্য নয়।
 .
ন্যায়বৈশেষিক দার্শনিকরা কিন্তু মনে করেন যেসাংখ্য দার্শনিকের যুক্তিগুলির দ্বারা সৎকার্যবাদ প্রমাণিত হয় না। যা প্রমাণিত হয় তা হচ্ছেকার্য উৎপত্তির পূর্বে অসৎ হলেও সেটি আকাশকুসুম বা বন্ধ্যাপুত্রের মতো অলীক নয়। সাংখ্যদার্শনিকরা বলেছেন অসৎএর উৎপত্তি হয় না। অসৎ বলতে যদি অলীক বোঝানো হয় তাহলে কথাটি ঠিক। আকাশকুসুমবন্ধ্যাপুত্রশশশৃঙ্গ ইত্যাদি অলীক পদার্থের উৎপত্তি কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু ঘটপট ইত্যাদি কার্য কখনোই অলীক নয়। এই পদার্থগুলি উৎপত্তির পূর্বে অসৎকিন্তু উৎপত্তির পরে সৎ। উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে কার্যের যে অভাব তাকে বলা হয় প্রাগভাব। যার প্রাগভাব আছে তাকে আমরা অলীক বলতে পারি না। কারণ যে সমবায়িকারণে কার্যের প্রাগভাব আছেসেই সমবায়ী বা উপাদান কারণ যখন আমরা প্রত্যক্ষ করিতখন প্রাগভাবের যে বোধ আমাদের হয় তা হলো, ‘এখানে কার্যটি হবে’ বা ‘এখানে কার্যটি এখনও হয়নি’। জ্ঞানের এই আকার থেকেই বোঝা যায়যার অভাব উপলব্ধ হচ্ছে তা অলীক নয়। অতএব বন্ধ্যাপুত্রের মতো অলীকের উৎপত্তি অসম্ভব বলেযা উৎপত্তির পূর্বে থাকে নাতার উৎপত্তিই হতে পারে নাএকথা বলা যায় না। সাংখ্যদার্শনিকরাও বলেন যেউৎপত্তি অর্থ হলো যা অনভিব্যক্ত ছিলো তাই অভিব্যক্ত হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলোএই অভিব্যক্তিটি কি পূর্বে ছিলো অভিব্যক্তিটি যদি পূর্ব থেকেই না থেকে থাকেতাহলে বলতে হবে পূর্বে অসৎ যে অভিব্যক্তিতাই পরে সৎ হলো। অর্থাৎযা ছিলো না তাই হতে পারে। কিন্তু এটা অসম্ভব।
 .
অপরপক্ষে অসৎ অভিব্যক্তি যদি কারকব্যাপারের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারেতাহলে অসৎ কার্যের উৎপত্তিতেও বাধা নেই। কারণ ঘটের অভিব্যক্তিটি অসৎ হওয়া সত্ত্বেও কুম্ভকার তাকে উৎপন্ন করতে পারলেঅসৎ ঘটও কুম্ভকারের দ্বারা উৎপন্ন হতে পারবে। কিন্তু এই কল্পও অসম্ভব হওয়ায় স্বীকার করা যায় না।
 .
আর যদি বলা হয় যেকার্যটির মতো তার অভিব্যক্তিও পূর্ব থেকেই সৎতাহলে প্রশ্ন হবেঐ অভিব্যক্তির জন্য কারকব্যাপারের প্রয়োজন কী অথচ কারকব্যাপারের প্রয়োজন সর্বত্রই দেখা যায়। সুতরাংএই কল্পও গ্রহণযোগ্য নয়।
যদি বলা হয় ঐ অভিব্যক্তিটি আছে বটেতবে কার্যের মতো তাও প্রচ্ছন্ন অবস্থায় আছেতাহলে ঐ প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তির আবার অভিব্যক্তি হয়একথা স্বীকার করতে হবে। আবার এই দ্বিতীয় অভিব্যক্তি সম্বন্ধেও প্রশ্ন করা যাবেসেটি পূর্ব থেকে সৎ কিনা এক্ষেত্রে বলতে হবে যেতাও পূর্বেই প্রচ্ছন্ন ছিলো। সেক্ষেত্রে ঐ প্রচ্ছন্ন অভিব্যক্তিরও আবার অভিব্যক্তি ঘটতে হবে। এইভাবে অনাবস্থা দোষ ঘটবে।
 .
দ্বিতীয়তবিশেষ বিশেষ উপাদান থেকে বিশেষ বিশেষ কার্যের উৎপত্তিও ঐ উপাদানে পূর্ব থেকেই কার্যের সত্তা প্রমাণ করে না। আপত্তি হয়েছিলো যে যদি তিলে তেলের অভাব থাকেমাটিতেও তেলের অভাব থাকে। তাহলে তিল থেকে তেল হয় কেন মাটি থেকে হয় না কেন এর উত্তর হলোতিলে তেলের যে অভাবতা হলো প্রাগভাব। অপরপক্ষে মাটিতে তেলের অভাব হলো তেলের অত্যন্তাভাব। ন্যায়বৈশেষিক মতে যেখানে কার্যের প্রাগভাব থাকেসেখানেই কার্য উৎপন্ন হয়। কার্যের প্রাগভাব ঐ কার্যের একটি কারণ। সুতরাংবিশেষ উপাদান থেকে বিশেষ কার্যের উৎপত্তিকে ব্যাখ্যা করার জন্য উপাদান বা সমবায়িকারণে উৎপত্তির পূর্বে কার্যের সত্তা স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই।
 .
তৃতীয়তসাংখ্যদার্শনিকরা বলেন যেউৎপত্তির পূর্বে কার্যের সত্তা স্বীকার না করলে উপাদান কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ স্বীকার করা যাবে না। কারণবিশেষ বিশেষ উপাদান বিশেষ বিশেষ কার্য উৎপাদনে সমর্থ একথা আমরা সকলেই স্বীকার করি। এই সামর্থই প্রমাণ করে যেউপাদান কারণের সঙ্গে কার্যের সম্বন্ধ আছে।
এই বক্তব্যের উত্তরে ন্যায়বৈশেষিকরা বলেনদুটি পদার্থের মধ্যে সম্বন্ধ হতে গেলে ঐ দুটিকে বিদ্যমান হতে হবে এমন কোন কথা নেই। যেমনআমরা সকলেই জানি যে ভবিষ্যতে আমাদের মৃত্যু হবে। সুতরাংভবিষ্যৎ মৃত্যু আমাদের জ্ঞানের বিষয়। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণ হয় না যে ভবিষ্যৎ মৃত্যুও সৎ। সম্বন্ধ নানারকম হতে পারে। দুটি বিদ্যমান পদার্থের মধ্যে যেমন সম্বন্ধ হয়তেমনি বিদ্যমান ও অবিদ্যমান পদার্থদ্বয়েরও সম্বন্ধ হয়।
 .
চতুর্থতউৎপত্তির পূর্বে কার্যের উপাদানরূপে সত্তা স্বীকারের অর্থ হলো উপাদান কারণ ও কার্যকে অভিন্ন বলে মানা। কিন্তু তারা কখনোই অভিন্ন নয়ভিন্ন। যেমন সুতোর জ্ঞান এবং কাপড়ের জ্ঞান ভিন্ন। একথা ঠিক যে গরু যেমন ঘোড়া থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারেকাপড় তেমন সুতো থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারে না। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে কাপড় ও সুতো অভিন্ন। সুতো ও কাপড়ের সম্বন্ধ যেহেতু সমবায়সেহেতু সুতোকে ছেড়ে কাপড় থাকতে পারে না। কিন্তু এই কারণে সমবায়ের সম্বন্ধী দুটিকে অভিন্ন বলা যায় না।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال