অনুপলব্ধি প্রমাণ | মীমাংসা দর্শন,

অনুপলব্ধি প্রমাণ 


অভাবকে অতিরিক্ত পদার্থের স্বীকৃতি দিলেও ন্যায়-বৈশেষিক ও ভাট্ট-মীমাংসক সম্প্রদায় অভাব পদার্থের জ্ঞান বা উপলব্ধির ব্যাপারে একমত নন। ভাট্ট-মীমাংসক ও অদ্বৈতবেদান্ত দর্শনের মতে অনুপলব্ধি হলো স্বতন্ত্র প্রমাণ। এই মতে অনুপলব্ধি প্রমাণ স্বীকার না করলে অভাবের জ্ঞান ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ অভাব পদার্থের গ্রাহক প্রমাণরূপে অনুপলব্ধি প্রমাণ অবশ্যই স্বীকার করা প্রয়োজন। মানমেয়োদয় গ্রন্থে নারায়ণ ভট্ট বলেন-  

‘অথোপলম্ভযোগ্যত্বে সত্যপ্যনুপলম্ভনম্ ।
অভাবাখ্যং প্রমাণং স্যাদভাবস্যাববোধকম্ ।।’- (মানমেয়োদয়)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষযোগ্য বস্তুকেও যদি প্রত্যক্ষ করা না যায়, তবে সেই অপ্রত্যক্ষের দ্বারা বস্তুটির অভাব অবধারিত হয়। এইপ্রকার অভাবের অববোধক প্রমাণ হচ্ছে অনুপলব্ধি বা অভাব।

গৃহের মধ্যে প্রবেশ করে যখন আমরা বলি ‘গৃহে কোন ঘট নেই’ তখন গৃহের মধ্যে ঘটের অভাব অনুপলব্ধি প্রমাণের সাহায্যে জানা যায়। ‘গৃহে ঘট’ থাকা রূপ একটি ধারণার অনুপলব্ধি হেতু গৃহে ঘট নেই বলে জ্ঞান হয়। ‘অনুপলব্ধি’ নামক প্রমাণই এরূপ জ্ঞানের কারণ। এ জ্ঞান প্রত্যক্ষের সাহায্যে লাভ করা যায় না কারণ এক্ষেত্রে ঘট অসদ্ বস্তু এবং অসদ্ বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষ হতে পারে না। এই জ্ঞান অনুমানলব্ধ জ্ঞান নয়, কারণ ঘটের অপ্রত্যক্ষ এবং অভাবের মধ্যে কোনো ব্যাপ্তি সম্পর্ক জানা নেই। এই জ্ঞান উপমানলব্ধও নয় কারণ কোনো সাদৃশ্যের ভিত্তিতে এই জ্ঞান সম্ভব নয়। এই জ্ঞান শব্দজ্ঞানও নয় কারণ কোনো বিশ্বাসযোগ্য আপ্তব্যক্তি ঘটের অভাবের কথা বলেননি। এজন্য ঘটের অনস্তিত্বের বা অভাবের জ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্য অনুপলব্ধি নামক একটি স্বতন্ত্র প্রমাণের প্রয়োজন।
কিন্তু মীমাংসা দর্শনেরই অপর শাখা প্রাভাকর-মীমাংসকদের মতে অনুপলব্ধি স্বতন্ত্র প্রমাণ নয়। কারণ এই মতে অভাব অধিকরণ স্বরূপ অর্থাৎ , অভাব অধিকরণের অতিরিক্ত পদার্থ নয়। সুতরাং অভাব পদার্থের গ্রাহকরূপে অনুপলব্ধি প্রমাণ স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। প্রাভাকর-মীমাংসকদের মতে অনুপলব্ধি একটি অনুমান।
অদ্বৈতবেদান্তী ধর্মরাজাব্বরীন্দ্রও তাঁর ‘বেদান্তপরিভাষায়’ কুমারিলের মতো অনুপলব্ধিকে প্রমাণের বিভাগে দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, আমাদের যেমন ‘গৃহে ঘট (আছে)’ বলে জ্ঞান জন্মায় তেমন অন্য কোন সময়ে গৃহে ‘ঘট নেই’ বলেও জ্ঞান জন্মাতে পারে-
‘নাস্তি, নাস্তি ইতি প্রত্যয়ঃ (জ্ঞানম্) নাস্তি-প্রত্যয়ঃ’।
অর্থাৎ : ‘নেই’ আকারে যে জ্ঞান তাকে এক কথায় বলা চলে ‘নাস্তি-প্রত্যয়’।
আলোকসংযোগ, চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়- ঘটের উপলব্ধির জন্য অপেক্ষিত এই ‘কারণ’-সামগ্রি ঠিক থাকা সত্ত্বেও ঘটের অনুপলব্ধি জানিয়ে দেয় যে ঘটটি নেই অর্থাৎ ঘটটির অভাব আছে। বস্তুবাদী মীমাংসক ও নৈয়ায়িক প্রভৃতির মতে নির্বিষয়ক জ্ঞান হতে পারে না। জ্ঞানমাত্রই কোন বিষয়কে অবলম্বন করে উৎপন্ন হয়। ‘ঘট নেই’ এই জ্ঞানের অবলম্বন বা আলম্বন বিষয় ঘট হতে পারে না। অতএব ওই ‘নাস্তিপ্রত্যয়ের’ আলম্বনরূপে স্বীকার করতে হয় অভাব নামক কোন স্বতন্ত্র পদার্থকে। অনুপলব্ধি হলো ‘উপলব্ধির অভাব’। অভাবজ্ঞানাত্মক প্রমার জনক বলে অনুপলব্ধির অন্য নাম ‘অভাবপ্রমাণ’।
তবে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায় অভাব পদার্থের জ্ঞান ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষজন্য বলে মনে করেন। স্বাভাবিকভাবেই এই দর্শনে অভাব পদার্থের প্রমাণ হলো প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই মতে অভাবের গ্রাহক প্রমাণ হলো প্রত্যক্ষ, যেহেতু এই জ্ঞান ইন্দ্রিয়-সন্নিকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন হয়। এখানে অভাব প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে সন্নিকর্ষ হলো বিশেষণ-বিশেষ্যভাব। অর্থাৎ, জ্ঞানে অভাব যদি বিশেষণ হয়, তাহলে অভাব প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষকে বলা হয় বিশেষণতা। আবার জ্ঞানে অভাব যদি বিশেষ্য হয়, তাহলে অভাব প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষটিকে বলা হয় বিশেষ্যতা। যেমন, ‘ভূতল ঘটাভাববিশিষ্ট’- এরূপ অভাবের জ্ঞানে ভূতল হলো বিশেষ্য এবং ঘটাভাব হলো বিশেষণ। সুতরাং, এক্ষেত্রে সন্নিকর্ষ হলো সংযুক্ত বিশেষণতা। আবার ‘ভূতলে ঘটাভাব’ এই জ্ঞানে ঘটাভাব হলো বিশেষ্য এবং ভূতল হলো বিশেষণ। ফলে, এক্ষেত্রে সন্নিকর্ষ হলো বিশেষ্যতা। এই মতে অভাব পদার্থের প্রত্যক্ষে বিশেষণতা সন্নিকর্ষ করণ এবং প্রতিযোগীর অনুপলব্ধি সহকারি কারণ।
ভাট্ট-মীমাংসকরা উপরিউক্ত ন্যায়-বৈশেষিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেন, ভাব পদার্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ সম্ভব, কিন্তু কোন অভাব পদার্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ সর্বদাই সন্নিকর্ষের থেকে উৎপন্ন। কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক স্বীকৃত বিশেষ্য-বিশেষণভাবকে সন্নিকর্ষ বলে স্বীকার করা যায় না, যেহেতু বিশেষ্য-বিশেষণভাব সম্বন্ধই নয়। কারণ সম্বন্ধের তিনটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত, সম্বন্ধ এক হবে। দ্বিতীয়ত, সম্বন্ধ দ্বিনিষ্ট হবে, অর্থাৎ সম্বন্ধ দুটি সম্বন্ধীতে থাকবে। তৃতীয়ত, সম্বন্ধ সম্বন্ধী ভিন্ন হবে।
কিন্তু সম্বন্ধের এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের কোনোটিই বিশেষ্য-বিশেষণভাবে থাকে না। প্রথমত, বিশেষ্য-বিশেষণভাব শব্দের দ্বারা একটা সম্বন্ধ বোধিত হতে পারে না। কারণ ভাবশব্দটি বিশেষ্য শব্দের সঙ্গে এবং বিশেষণ শব্দের সঙ্গে অন্বিত হয় বলে এক্ষেত্রে বিশেষ্যভাব এবং বিশেষণভাব- এই দুটি সম্বন্ধ বোধিত হতে পারে। বিশেষ্যভাব অর্থ বিশেষ্যতা এবং বিশেষণভাব অর্থ বিশেষণতা। বিশেষ্যতা এবং বিশেষণতা ভিন্ন, কারণ বিশেষ্যতা বিশেষ্যে থাকে এবং বিশেষণতা বিশেষণে থাকে। ভিন্ন আশ্রয়ে থাকায় বিশেষণতা এবং বিশেষ্যতাকে কখনোই এক বলা যায় না। দ্বিতীয়ত, যেহেতু বিশেষ্যতা কেবল বিশেষ্যে থাকে এবং বিশেষণতা কেবল বিশেষণে থাকে, সেহেতু বিশেষ্যতা এবং বিশেষণতাকে দ্বিনিষ্ট বলা যায় না। তৃতীয়ত, বিশেষ্যতা বিশেষ্যস্বরূপ এবং বিশেষণতা বিশেষণস্বরূপ। ফলে বিশেষ্যতা এবং বিশেষণতাকে সম্বন্ধী দুটি থেকে ভিন্ন বলা যাবে না।
সুতরাং, সম্বন্ধের কোন বৈশিষ্ট্য না থাকায় বিশেষ্য-বিশেষণভাব সম্বন্ধ নয়। বিশেষ্য-বিশেষণভাব যদি সম্বন্ধ না হয় তাহলে সেটি অভাবের গ্রাহক প্রত্যক্ষে সন্নিকর্ষরূপে কাজ করতে পারে না। ফলে অভাবের গ্রাহক অন্য প্রমাণ অনুপলব্ধি অবশ্যস্বীকার্য।
ভাট্টমতে, কোন পদার্থের অনুপস্থিতিতে আমাদের সেই পদার্থের অভাব অনুপলব্ধি হয়। এই অনুপলব্ধিই ঐ পদার্থের অভাবজ্ঞানের করণ এবং ঐ পদার্থের উপলব্ধির যোগ্যতা তার সহকারি কারণ। প্রমার করণকেই প্রমাণ বলা হয়। অনুপলব্ধি যেহেতু অভাবজ্ঞানের করণ, সেহেতু ভাট্টমীমাংসকরা অনুপলব্ধিকেই অভাব প্রমাণ বলেছেন।
মীমাংসকরা উপলব্ধির যোগ্যতারও ব্যাখ্যা করেছেন। কেননা অনুপলব্ধি সব সময়ই বস্তুর অভাবের প্রমাণ নয়। অন্ধকারে আমরা গৃহের ভিতর ঘট না দেখতেও পারি। এজন্য ঘটের অনস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না। পরমাণু, আকাশ প্রভৃতি দ্রব্যের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু অতীন্দ্রিয় বলে প্রত্যক্ষ করা যায় না। বিষয় এবং বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ ব্যতীত যে সকল ঘটনার উপস্থিতিতে একটি পদার্থ প্রত্যক্ষ হতে পারে, সেই ঘটনাগুলিকেই ঐ পদার্থ প্রত্যক্ষের পক্ষে যোগ্য বলে মনে করা হয়। যেমন, ঘট প্রভৃতি বস্তুর চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের প্রতি ঘট, চক্ষুরিন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ এবং প্রয়োজনীয় আলোক ইত্যাদি কারণ। এইগুলির উপস্থিতিতে ঘটের চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ হয়। অর্থাৎ কোন বিষয়ের প্রত্যক্ষ-যোগ্যতা বলতে আমরা বিষয় এবং বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ ব্যতীত অন্যান্য যাবতীয় কারণের উপস্থিতিকেই বুঝি। এইরূপ যোগ্যতার উপস্থিতিতে যদি বিষয়টির প্রত্যক্ষ না হয় তাহলে ঐ বিষয়ের অনুপলব্ধিকে যোগ্যানুপলব্ধি বলা যেতে পারে। যোগ্যানুপলব্ধি মানে যোগ্য-অনুপলব্ধি। এরূপ যোগ্যানুপলব্ধি বিষয়ের অভাবকে প্রতিপাদন করে। উপলব্ধির যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি বিষয়ের উপলব্ধি না হয়, তাহলে বিষয়ের অবিদ্যমানতাই বা বিষয়ের অভাবই প্রতিপাদিত হয়।
আবার অন্ধকারে গৃহে ঘটের উপলব্ধি হয় না অর্থাৎ, অনুপলব্ধি হয়। কিন্তু তাকে যোগ্য-অনুপলব্ধি বলা যায় না। কারণ সেখানে ‘যদি গৃহে ঘট থাকতো, তাহলে ঘটের উপলব্ধি হতো’ এরূপ উপলব্ধির আরোপ অন্ধকারে সম্ভব নয়। কারণ অন্ধকারে ঘট থাকলেও তার উপলব্ধি হয় না। এই কারণে এই অনুপলব্ধি অযোগ্য অনুপলব্ধি। সুতরাং, অন্ধকারে ঘটের অনুপলব্ধির দ্বারা ঘটাভাবের জ্ঞান হয় না। এই কারণে প্রতিযোগীর প্রত্যক্ষ-যোগ্যতাসহকৃত পদার্থের অনুপলব্ধিকে সেই পদার্থের অভাব প্রমাণ বা অনুপলব্ধি প্রমাণ বলা হয়।

অনুপলব্ধির যোগ্যতার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ‘বেদান্তপরিভাষা’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
‘তর্কিত প্রতিযোগিসত্ত্ব প্রসঞ্জিত প্রতিযোগিকত্ব।’
অর্থাৎ : প্রতিযোগী ও প্রতিযোগীর ব্যাপ্য ব্যতীত উপলব্ধির যাবতীয় কারণ উপস্থিত থাকলে যদি কোন স্থলে অভাবের প্রতিযোগীর সত্ত্বের আরোপের দ্বারা সেই প্রতিযোগীর উপলব্ধি আরোপিত হয়, তাহলে সেই অভাবের প্রতি সেই অনুপলব্ধিই হবে যোগ্যানুপলব্ধি।
যেমন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষের কারণ উজ্জ্বল আলো প্রভৃতি থাকাকালে, ‘যদি ভূতলে ঘটাভাবের প্রতিযোগী ঘট থাকতো, তাহলে অবশ্যই ঘটের উপলব্ধি হতো’ এরূপ আরোপ সম্ভব বলে ঐরূপ ভূতলে ঘটের যে অনুপলব্ধি, তাই যোগ্য অনুপলব্ধি। এই অনুপলব্ধির দ্বারাই ভূতলে ঘটাভাবের জ্ঞান হয়।
মীমাংসামতে অভাবপ্রমাণ দ্বিবিধ- প্রমাণাভাব ও স্মরণাভাব
প্রমাণের মাধ্যমে যখন কোন প্রত্যক্ষযোগ্য পদার্থের অভাব অনুপলব্ধ হয়, তখন সেই অভাব প্রমাণকে বলা হয় প্রমাণাভাব। যেমন, ভূতলে একটি ঘটের অনুপস্থিতিতে ঐ ঘটের অনুপলব্ধি প্রমাণাভাবের দৃষ্টান্ত।
অপরদিকে কোন পদার্থের অভাব যখন স্মৃতির সাহায্যে অনুপলব্ধ হয়, তখন সেই অভাব প্রমাণকে বলা হয় স্মরণাভাব। সকালে গৃহে অতিথি বা মৈত্রের অভাব সকালে প্রমাণাভাবের মাধ্যমে অনুপলব্ধ হতে পারে, কিন্তু অতিবাহিত সকালে গৃহে মৈত্রের অভাব যখন সায়াহ্নে স্মরণ করা হয়, তখন ঐ মৈত্রের অভাব প্রমাণাভাবের দ্বারা লাভ করা যায় না, স্মরণাভাবের দ্বারাই ঐ অভাবের জ্ঞান হতে পারে। সকালে গৃহে মৈত্রের উপস্থিতির উপলব্ধিযোগ্যতা সায়াহ্নে কেবলমাত্র স্মরণেই থাকতে পারে। তাই এরূপ অভাবের প্রমাণরূপে স্মরণাভাবকে স্বীকার করা হয়।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال