জৈন দর্শনের দার্শনিক সিদ্ধান্ত

জৈনমতের দার্শনিক সিদ্ধান্ত (Philosophy of Jainism)

মহাবীরের সময়ে জৈনধর্ম ছিলো ব্রত উপবাস ও তপস্যার পথ। তখনো দর্শনের ছোঁয়া তাতে লাগে নি বলেই পণ্ডিতদের অভিমত। পরে সঞ্জয় বেলট্বিপুত্তের অনেকান্তবাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জৈনগণ তাঁদের অনেকান্তবাদী স্যাদবাদ দর্শন প্রবর্তন করেন বলে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে গ্রীক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে সংস্পর্শ ও দার্শনিক মত-সংঘর্ষের ফলে ভারতীয় ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজ নিজ দার্শনিক মত সুব্যবস্থিত করার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিলো জৈনরা তা থেকে দূরে সরে থাকতে পারেন নি। এরই পরিণতি জৈনদের স্যাদবাদ।

এই নব্যব্যবস্থিত জৈনদর্শনের প্রাচীন গ্রন্থকারদের মধ্যে প্রথমেই আসে প্রথম শতাব্দির ‘বাচক শ্রবণ’ নামে খ্যাত উমাস্বাতির নাম। তাঁর রচিত ‘তত্ত্বার্ধাধিগম’ কে ভারতীয় নব্য-দর্শন যুগের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন জৈন গ্রন্থ বলা হয়। জৈনদর্শনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি হলো, আমরা জগতকে যেভাবে জানি সেভাবে তা সত্য বা যথার্থ। তাই কোন এক বা অদ্বিতীয় পরমসত্তার কল্পনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু মনুষ্য-জ্ঞান খণ্ডিত, সীমিত বা একদেশদর্শি বলে স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ বস্তুর পূর্ণ স্বরূপ জানা সাধারণ দৃষ্টিতে কখনো সম্ভব নয়। আপেক্ষিক দৃষ্টিতে যেটুকু জানা সম্ভব তা অসত্য না হলেও আংশিক। এটাকে একান্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলে। জৈনমতে সৎ বস্তুর স্বরূপ অতি জটিল। তাকে সম্যকরূপে বুঝতে হলে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এটা হলো অনেকান্তবাদী দৃষ্টি। আর এই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে জৈনদের দার্শনিক পরিভাষায় বলে ‘নয়’। তা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে জৈনদের অনেকান্তবাদের ধারণা এবং এই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরীক্ষালব্ধ বস্তুর স্বরূপ-উপলব্ধির সম্ভাব্যতার মাধ্যমে জৈনদের স্যাদ্বাদের জন্ম।
.
সবকিছুর মধ্যেই সবকিছু হওয়ার সম্ভাবনাকে জৈন স্যাদবাদে স্বীকার করা হয়। উপনিষদীয় দর্শনে নিত্যতার উপর জোর দেয়া হয়েছে, বৌদ্ধদর্শনে জোর দেয়া হয়েছে অনিত্যতার ওপর, আর জৈনদর্শনে উভয় মতকেই সম্ভব বলে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। স্যাৎ-বাদের মূল কথা হলো- বস্তু বা সত্তা বহুমুখী, অতএব বিবিধভাবে তা বর্ণিত হতে পারে। তার মধ্যে কোন বর্ণনাই মিথ্যা নয়, আবার কোন বর্ণনাই একমাত্র সত্য নয়। সত্তার বহুমুখী দিক সম্বন্ধে সামগ্রিক উক্তি একমাত্র পূর্ণজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব। আমরা পূর্ণজ্ঞানী নই, অতএব প্রত্যেক বিষয়ে আমাদের প্রতিটি উক্তিই শেষপর্যন্ত সম্ভাবনামূলক। এই সম্ভাবনার নির্দেশক হলো স্যাৎ। স্যাৎ মানে কোনোভাবে সম্ভব। অতএব আমাদের প্রত্যেক উক্তির সঙ্গে স্যাৎ শব্দ যোগ করা প্রয়োজন।
.
সমস্ত জীবের প্রতি ঐকান্তিক অহিংসা জৈনদের জন্য অবশ্য পালনীয় নীতি। নিজেদের জীবনাচারে তার অন্যথা করে না বলে দার্শনিক তত্ত্ব এমনকি যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রেও জৈনদের এই অহিংস নীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। দার্শনিক তত্ত্ব বিচারে জৈনরা বিপক্ষমতের প্রতি এক অদ্ভুত সহিষ্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। যার অন্যতম প্রমাণ জৈনদের অনেকান্তবাদ।

২.১ : জৈনমতে ‘নয়’

জৈনরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জ্ঞানের বিভাগ করেছেন, যা ‘জৈন প্রমাণশাস্ত্রে জ্ঞান ও তার ভেদ’ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও অন্য আরেক দিক থেকে জৈনমতে জ্ঞানকে ‘প্রমাণ’ ও ‘নয়’ ভেদে দুইপ্রকার বলা হয়েছে।
জৈনমতে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম ভেদে প্রমাণ তিন প্রকার। প্রমাণের দ্বারা আমরা অনেক বিশিষ্ট বস্তুকে জানতে পারি। তবে প্রমাণ হলো কোন একটি বস্তুর নিছক জ্ঞান, কিন্তু ‘নয়’ হলো পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বস্তুর জ্ঞান। অর্থাৎ নয়-এর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে চিন্তার বিশ্লেষণ পরিলক্ষিত হয়। বলা হয়ে থাকে- 

‘যস্যাং নীতৌ স্যাদ্বাদস্যানুকূলতয়া বস্তুনির্ণয়ো ভবতি স নয় ইত্যুচ্যতে’।
অর্থাৎ : যে নীতিতে স্যাদ্বাদের অনুকূলরূপে বস্তুনির্ণয় হয় তাকে ‘নয়’ বলে। (সূত্র: ড. বিশ্বরূপ সাহা/ নাস্তিকদর্শনপরিচয়ঃ) 

‘নয়’ শব্দের সাধারণ অর্থ হলো মত বা সিদ্ধান্ত, কিন্তু জৈনদর্শনে ‘নয়’ শব্দটি পারিভাষিক অথচ অন্বর্থক। ‘নয়’ শব্দের অর্থ কোন বস্তুর সাপেক্ষ নিরূপণ। জৈনাচার্য দেবসূরি নয়ের ব্যাখ্যায় বলেছেন- 

‘যেন শ্রুতাখ্যপ্রমাণবিষয়ীকৃত স্যার্থস্যাংশতস্তদিতরাংশ ঔদাসীন্যতঃ স প্রতিপত্তুরভিপ্রায়বিশেষো নয় ইতি।’
অর্থাৎ : যার দ্বারা শ্রুত নামক প্রমাণের বিষয়ীকৃত অর্থের অংশবিশেষের জ্ঞান হয় এবং অন্য অংশের ঔদাসীন্যবশত হয় না, জ্ঞাতার সেই অভিপ্রায় বিশেষকে ‘নয়’ বলে। 

জৈনদার্শনিক প্রভাচন্দ্রও তাঁর ‘প্রমেয়কমলমার্ত্তন্ডে’র ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে অনুরূপভাবে বলেছেন যে- 

‘অনিরাকৃতপ্রতিপক্ষো বস্ত্বংশগ্রাহী জ্ঞাতুরভিপ্রায়ো নয়ঃ।’
অর্থাৎ : অনিরাকৃত প্রতিপক্ষ বস্তু-অংশের গ্রাহী ও জ্ঞাতার অভিপ্রায় হচ্ছে ‘নয়’। 

সারকথা হলো, আমাদের চিন্তা যখন কোন বস্তুকে বিশ্লেষণাত্মক রীতিতে গ্রহণ করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই বস্তু সম্পর্কে বিবৃতি দেয়, তখন তাকে আমরা বলি ‘নয়’। ‘নয়’-এর ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আপেক্ষিতা পরিস্ফুট। জৈনমতে কোন একটি বস্তু অসংখ্য বৈশিষ্ট্যবিশিষ্ট। এই অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আমরা কোন একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যকেই জানতে পারি, বস্তুর এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জ্ঞান হলো আংশিক জ্ঞান। এইরূপ আংশিক জ্ঞানকে বলা হয় ‘নয়’। আবার এই আংশিক জ্ঞানকে যে অবধারণ প্রকাশ করে, তাকেও ‘নয়’ বলা হয়। জৈনমতে নয় সাতপ্রকার, যথা- নৈগম, সংগ্রহ, ব্যবহার, ঋজুসূত্র, শব্দ, সম্বিরুদ্ধ বা সমভিরূঢ় এবং এবম্ভূত।
এই সাতটি নয়ের মধ্যে নৈগম, সংগ্রহ, ব্যবহার ও ঋজুসূত্র এই প্রথম চারটি নয় হচ্ছে অর্থপ্রধান এবং অবশিষ্ট তিনটি অর্থাৎ শব্দ, সমভিরূঢ় ও এবম্ভূত নয় হচ্ছে শব্দপ্রধান। জৈনমতে প্রত্যেকটি নয় হচ্ছে একেকটি দৃষ্টিকোণ। এই সকল দৃষ্টিকোণ হচ্ছে আংশিক। তাদের কোনটিকে সত্য বললে নয়াভাস বা ভ্রান্তি হয়। উক্ত প্রকার নয়ের দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান হচ্ছে নয়নিশ্চয়। অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞানকে নয়নিশ্চয় বলে। এই নয়নিশ্চয় দুইপ্রকার- শুদ্ধ ও অশুদ্ধ। উপাধিশূন্য বস্তুর যথার্থ জ্ঞান হচ্ছে শুদ্ধ নয়নিশ্চয় এবং সোপাধি বা উপাধিযুক্ত বস্তুর জ্ঞান হচ্ছে অশুদ্ধ নয়নিশ্চয়।
উপরিউক্ত সাতটি নয়ের নিম্নাভিক্রম, অর্থাৎ পূর্ববর্তী নয় থেকে পরবর্তী নয়টি সঙ্কুচিত। সুতরাং নৈগম নয় সর্বব্যাপক এবং এবম্ভূত নয় সর্বব্যাপ্য (=সবচেয়ে সঙ্কুচিত)। জৈনমতে বিভিন্ন প্রকারের নয়গুলির সংশ্লেষে পূর্ণ যথার্থ জ্ঞান হয়। এই যথার্থ জ্ঞানকে নয়নিশ্চয় বলা হয়েছে। 
জৈনদর্শনের নয়সিদ্ধান্তে অত্যধিক গুরুত্ব রয়েছে। এই নয় জৈনের প্রমাণজ্ঞানে মহত্ত্বপূর্ণ অঙ্গ। জৈনের স্যাদ্বাদ এই সিদ্ধান্তে আশ্রিত হয়েছে। এই স্যাদ্বাদ সপ্তভঙ্গি নয় নামে খ্যাত।

জৈনদের এই ‘নয়’-সম্পর্কিত মতবাদে তাঁদের যৌক্তিক ও তাত্ত্বিক চিন্তাধারা উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁদের যৌক্তিক মতবাদ ‘স্যাদ্বাদ’ এবং তাত্ত্বিক মতবাদ ‘অনেকান্তবাদ’ নামে পরিচিত। দুটি মতবাদই পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা ও পরমতসহিষ্ণুতার অপূর্ব দৃষ্টান্ত।
.
(ক) : অনেকান্তবাদ
.
জৈনদর্শনে সবচেয়ে মহত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে অনেকান্তবাদ (manyness of reality)। অনেকান্তবাদ জৈন দর্শনের একটি তাত্ত্বিক মতবাদ বলে সাধারণভাবে পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে অনেকান্তবাদ জগৎ ও জীবনের প্রতি একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি। জৈন দর্শনের কি যৌক্তিক, কি তাত্ত্বিক সমস্ত প্রকার চিন্তাধারায় এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। এই মতে অন্যান্য সকল দর্শন একান্তবাদী, কিন্তু জৈন দর্শন অনেকান্তবাদী।
‘একান্ত’ শব্দের অর্থ নিশ্চিত বা নির্ণীতরূপে এক প্রকার। আর তাদের মতে ‘অনেকান্ত’ অর্থ হলো বস্তুর অনেক প্রকার। অর্থাৎ কোন বস্তু একই রূপ বা একই প্রকার নয়। কোন বস্তুকে একান্ত বা নিশ্চিতভাবে অস্তি বা নাস্তি ইত্যাদিরূপে বর্ণনা করা যায় না। দৃষ্টিভেদে একই বস্তু ভিন্ন আকারে প্রতীত হয়। জৈনদর্শন বস্তুর সৎ ও অসৎ এই দুই প্রকার বিভাগ স্বীকার করে না। জৈনরা বলেন-  

‘সদেব দ্রব্যস্য লক্ষণম্, অসৎ অভাবো বা তত্র ন কিঞ্চিৎ স্বতন্ত্রং তত্ত্বম্ ইতি।’
অর্থাৎ : ‘সৎ’ই দ্রব্যের লক্ষণ, ‘অসৎ’ বা ‘অভাব’ কোন স্বতন্ত্র তত্ত্ব নয়। 

জৈনমতে সৎ বস্তুর স্বরূপ অতি জটিল। সৎ বস্তু সম্যকরূপে বুঝতে হলে তাকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরীক্ষা করা আবশ্যক। কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে চরম সত্তার অন্যান্য দিক পরিত্যাগ করে একটি বিশেষ দিকের প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব। কিন্তু কোন্ অবস্থায় এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে তা বিবেচনায় না রেখে ঐরূপ বিচারকে দার্শনিক মর্যাদা দেয়া হলে সেটি দার্শনিক ভ্রান্তিতে পরিণত হয়। এতে করে ঐ সৎ বস্তু সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা জন্মায় তা আংশিক ও অসম্পূর্ণ। এই জাতীয় আংশিক দৃষ্টিভঙ্গিকে একান্তবাদ বলা হয়, যা একভাবে থাকে।
.
এক্ষেত্রে যদি বলা হয় ‘ঘটোহস্তি’ (ঘটটি আছে) একান্তভাবে সত্য, তবে ঘটাদি উৎপত্তির জন্য কুম্ভকার প্রভৃতির প্রয়োজন হতো না। আবার যদি ঘট একান্তভাবে নাস্তি বা অসত্য হতো তবে কোনভাবেই ঘটের উৎপত্তি হতে পারে না, যেমন অলীক শশশৃঙ্গের কখনো উৎপত্তি হয় না। যে বস্তু কোন দৃষ্টিতে সৎ সেই বস্তুকে দৃষ্টিভেদে অসৎও বলা যায়। অর্থাৎ স্বরূপের (=নিজ রূপের) সাপেক্ষে যে বস্তুকে সৎ বলা হয়, সেই বস্তুকে অন্য রূপের সাপেক্ষে অসৎও বলা যায়। তাই বলা যায়, প্রত্যেক বস্তুর স্বভাব ভিন্ন ভিন্ন এবং এই স্বভাব সেই বস্তুতেই থাকে, অন্য বস্তুতে থাকে না। যেমন ঘট ঘটত্বের দৃষ্টিতে সৎ, কিন্তু পটত্বের দৃষ্টিতে অসৎ।

জৈনমতে প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই কতকগুলি অংশ স্থায়ী এবং কতকগুলি অস্থায়ী। আবার প্রত্যেক কার্যের মধ্যে কতকগুলি ধর্ম নতুন সংক্রামিত হয় এবং কতকগুলি ধর্ম ধ্বংস হয়। প্রত্যেক বস্তুর কতকগুলি গুণ থাকে ধ্রুব বা স্থায়ী, কতকগুলি গুণ হয় উৎপন্ন এবং কতকগুলি ধ্বংস হয়। সুতরাং সকল বস্তুই দ্রব্য, উৎপাদ এবং ব্যয়যুক্ত। এর থেকেই জৈনদের অনেকান্তবাদের সৃষ্টি। এই মতে চরম সৎ উৎপত্তি, ধ্বংস ও স্থায়িত্ববিশিষ্ট। প্রাণিজগতে এই বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। যেমন একটি চারাগাছের প্রথম পত্তন শুরু হয় বীজের মধ্যে। বীজটি যদি কেবলমাত্র বীজ হিসেবে স্থায়ী থাকতো এবং এর কোন প্রকার ধ্বংস না হতো, তাহলে চারাগাছটি তার বর্ধিষ্ণু জীবনীশক্তি হারিয়ে ফেলতো এবং শীঘ্রই মরে যেতো।  কিন্তু গাছটির বৃদ্ধি পাওয়ার প্রতিটি স্তরে থাকে অন্তর্নিহিত অভিন্নতা। আবার একটি নিমের বীজের চারা বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যাবস্থায় আমের চারায় পরিবর্তিত হতে পারে না। অর্থাৎ বর্ধিষ্ণু প্রাণীর পক্ষে অন্তর্নিহিত অভিন্নতা প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য। এই অভিন্নতা ছাড়া বৃদ্ধি শব্দ অর্থহীন। সুতরাং চরম সৎ-এর বর্ণনায় অবশ্যই উৎপত্তি, ধ্বংস ও অন্তর্নিহিত অভিন্নতা বা স্থায়িত্বরূপ তিন প্রকার বৈশিষ্ট্য স্বীকার করতে হবে।

জৈনমত অনুসারে প্রত্যেক বস্তুতে অনেক গুণ থাকে। মানুষ বস্তুর একই গুণের জ্ঞান এক সময়ে পেতে পারে। কিন্তু বস্তুর অনন্ত গুণের জ্ঞান মুক্ত (=কেবলী) ব্যক্তির দ্বারাই সম্ভব। সাধারণ মানুষের জ্ঞান অপূর্ণ ও আংশিক। সাধারণ মানুষ এক কালে একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বস্তুর কেবলমাত্র একটি গুণ দেখতে পায়। বস্তুর এই আংশিক জ্ঞানকে জৈনমতে ‘নয়’ বলা হয়। নয় হচ্ছে কোন বস্তুকে বুঝবার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ। একে সত্যের আংশিক রূপ বলা হয়। এর দ্বারা সাপেক্ষ সত্যের উপলব্ধি হয়, নিরপেক্ষ সত্যের নয়। প্রত্যেক নয়ে বস্তুর একদেশবিশিষ্ট অর্থই বিষয় হয়।

যখন আমরা একটা বস্তুকে কেবলমাত্র তার দিক থেকে দেখি তখন সেইরকম দেখাকে বলে সংগ্রহ নয়। অদ্বৈত বেদান্তীরা এই দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। তাঁরা বলেন, সকল বস্তুই সৎরূপে এক। আবার যখন আমরা কোন বস্তুকে আমাদের ব্যবহারিক দৃষ্টিতে দেখি, অর্থাৎ তার সমস্ত গুণের সঙ্গে তাকে একত্র করে দেখি অথবা গুণগুলিকে বস্তুরই একটা স্বরূপ বলে মনে করি, তখন তাকে বলে ব্যবহার নয়। আবার যখন কোন বস্তুকে বর্তমান বা ভবিষ্যতের হিসাব না করে কেবলমাত্র কোন মুহূর্তের গুণসমষ্টিরূপে দেখি এবং মনে করি যে প্রতি মুহূর্তেই কতকগুলি নতুন গুণ একত্র সমাবিষ্ট হয়ে রয়েছে এবং প্রতি মুহূর্তেই তা পরিবর্তিত হচ্ছে, তখন সেই দৃষ্টিকে বলা যায় পর্যাপ্ত নয় বা ঋজুসূত্র নয়। বৌদ্ধরা এই দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। এভাবে বেদান্ত, সাংখ্য, বৌদ্ধ প্রভৃতি দার্শনিকরা এক একটি দৃষ্টিভঙ্গিকেই চরম দৃষ্টিভঙ্গি বলে মনে করেন। সেজন্য তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত বলে জৈনরা মনে করেন। এরূপ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিকে নয়াভাস বলে। বস্তুত প্রত্যেকটি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারাই বস্তুর এক একটি যথার্থ রূপ প্রকাশ পায়। এদের কোনটিকে একান্তভাবে সত্য মেনে অপরগুলিকে উপেক্ষা করলে আমাদের জ্ঞান ভ্রান্ত হয়।

সাংখ্য সৎবাদী, বৌদ্ধ অসৎবাদী, নৈয়ায়িক সদসৎ-বাদী ও মায়াবেদান্তী অনির্বচনীয়ত্ববাদী এভাবে সৎ, অসৎ, সদসৎ ও অনির্বচনীয়বাদ ভেদে একান্তবাদী চার প্রকার। এই চারটির সঙ্গে অনির্বচনীয়ত্বের আরো তিনটি বাদ যুক্ত করে মোট সাতটি মতাবলম্বী পাওয়া যায়। তাঁদের প্রতি ‘বস্তু কি আছে?’ এরূপ প্রশ্ন করলে ‘কোনভাবে আছে’ এই উত্তর দেওয়া যায়। এভাবে সকল একান্তবাদী ক্ষান্ত হয়ে মৌন থেকে সম্পূর্ণ অর্থনিশ্চয়কারীর স্যাদ্বাদকেই যথার্থ মনে হয়। তাই ‘স্যাদ্বাদমঞ্জরী’তে বলা হয়েছে-

‘অনেকান্তাত্মকং বস্তু গোচরঃ সর্বসংবিদাম্ ।
একদেশবিশিষ্টোহর্থো নয়স্য বিষয়ো মতঃ।।’- (স্যাদ্বাদমঞ্জরী)
অর্থাৎ : ঘটাদি বস্তু অস্তি (আছে), নাস্তি (নাই) ইত্যাদি সকল প্রকার জ্ঞানের বিষয় হয় বলে তা অনৈকান্তিক বা অনিশ্চয়াত্মক; প্রত্যেকটি নয়ে বস্তুর একদেশবিশিষ্ট অর্থই বিষয় হয়। 

জৈনব্যতিরিক্ত সকল দার্শনিকই হচ্ছেন একান্তবাদী। জৈনগণ মনে করেন যে, কোন বস্তু বিষয়ে তাঁদের যে নির্ণয় তা সকল দৃষ্টিতে সত্য নয়। তার সত্যতা বিশেষ পরিস্থিতিতে ও বিশেষ দৃষ্টিতেই মানা যেতে পারে। তাঁরা নিজ বিচারকে নিতান্ত সত্য বলে মানেন এবং অন্যের বিচারকে উপেক্ষা করেন বলে মতভেদের সৃষ্টি হয়। এই বিষয়টিকে বোঝাতেই জৈনরা হাতি ও ছয় অন্ধের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।
জৈনরা বলেন, চরম সৎ-এর বিভিন্ন রূপকে অগ্রাহ্য করে কেবলমাত্র বিশেষ রূপকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হলে দৃষ্টান্তস্বরূপ তা ছয় অন্ধ ব্যক্তির হাতি দেখার মতোই হবে। একজন অন্ধ হাতির কর্ণ স্পর্শ করে জন্তুটিকে কুলোর মতো বলে, আরেকজন পা স্পর্শ করে তাকে স্তম্ভের মতো বলে, তৃতীয় জন তার শূড় স্পর্শ করে সাপের মতে বলে, চতুর্থজন লেজ স্পর্শ করে তাকে দড়ির মতো বলে, পঞ্চমজন পেট স্পর্শ করে তাকে দেয়ালের মতো বলে এবং ষষ্ঠজন মাথা ছুঁয়ে তাকে ছাতার মতো বলে। প্রত্যেকে তার জ্ঞানকে সঠিক মনে করলেও সার্বিকভাবে কোন একজন অন্ধের জ্ঞান সত্য নয়, তা অংশত সত্য হতে পারে। অনুরূপভাবে দার্শনিকদের বিচার ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে সত্য হলেও পূর্ণত সত্য নয়, তা হচ্ছে আংশিক সত্য। সুতরাং চরম সৎ-এর জটিল স্বরূপ স্বীকার করতে হবে এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে পরিপূর্ণ সৎ-এর স্বরূপ বর্ণনা করার চেষ্টা করতে হবে। এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গিই অনেকান্তবাদ নামে পরিচিত।
.
অনেকান্তবাদ অনুসারে প্রত্যেকটি দৃষ্টিভঙ্গির সাথেই ‘হতে পারে’ অর্থাৎ ‘স্যাৎ’ শব্দটি যোগ করে বুঝিয়ে দিতে হয় যে, এই প্রকার নিশ্চয় যেমন সত্য হতে পারে তেমনি অপর রকমের নিশ্চয়ও সত্য হতে পারে। অর্থাৎ প্রত্যেকটি নিশ্চয় আপেক্ষিক। কোন বস্তু সম্পর্কে এরূপ কোন নিশ্চয় করা যায় না যে এটি অন্যরূপ নয়। এভাবে দেখার নাম নয়বাদ। এ থেকেই জৈনদের প্রসিদ্ধ স্যাৎবাদের উৎপত্তি। ‘স্যাৎ’ শব্দটি এসেছে ‘অস্’ ধাতু থেকে। অস্ ধাতুর অর্থ হওয়া। সুতরাং ‘স্যাৎ’ শব্দের অর্থ ‘হতে পারে’। এভাবেই জৈনদের অনেকান্তবাদ ও স্যাদ্বাদ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই বলা হয়-

‘স্যাদ্বাদঃ সর্বথৈকান্তত্যাগাৎ কিংবৃত্তচিদ্বিধেঃ।
সপ্তভঙ্গীনয়াপেক্ষো হেয়াদেয়বিষেষকৃৎ।।’
অর্থাৎ : স্যাদ্বাদ কথঞ্চিৎ এই বিশেষ প্রয়োগের দ্বারা সর্বত্র একান্ত বা নিশ্চয়কে পরিত্যাগ করে ও সপ্তভঙ্গি নয়ের অপেক্ষা রাখে। তা হেয় (=নাস্তি) ও আদেয় (=অস্তি) ভেদে বিকল্পের বিধান করে। 
.
অনেক সময় স্যাদবাদকে সম্ভাব্যতার মতবাদ বলে মনে করা হয় এবং সম্ভাব্যতা যেহেতু সংশয় বোঝায়, তাই জৈন দার্শনিকদের সংশয়বাদী বলা হয়। যেহেতু জৈনদের মতে একটি ‘নয়’ একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং একটি বিশেষ ধর্মসাপেক্ষ, তাই একথা সত্য যে জৈনদের স্যাদ্বাদ একপ্রকার সম্ভাব্যতার মতবাদ বা সাপেক্ষবাদ। কিন্তু এই সাপেক্ষবাদ কোনভাবেই সংশয়বাদ নয়। জৈনরা যখন কোন নয়ে বস্তুর একটি ধর্ম প্রকাশ করেন, তখন ‘স্যাৎ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। তার অর্থ হলো বস্তুর আরো ধর্ম আছে। কিন্তু সেই ধর্ম সম্বন্ধে কখনোই কোন সংশয়ের অবকাশ নেই। জৈনদের প্রত্যেকটি নয়ই নিশ্চিত। সুতরাং স্যাদ্বাদ কখনোই সংশয়বাদ নয়।

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال