পুরুষের বন্ধন ও কৈবল্য

পুরুষের বন্ধন ও কৈবল্য


সাংখ্য-যোগমতে সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতি ও প্রকৃতিজাত সবকিছুই দুঃখদায়ক। সত্ত্বপ্রধান বুদ্ধি পুরুষের সন্নিধানে পুরুষকে প্রতিবিম্বিত করে। কিন্তু অবিদ্যাবশত পুরুষ তখন বুদ্ধির সঙ্গে নিজের অভেদ কল্পনা করে এবং এর ফলে বুদ্ধির দুঃখ পুরুষে আরোপিত হয়। তাই যোগমতে, তমোগুণ উদ্ভূত অজ্ঞানের প্রভাবে সত্ত্বপ্রধান প্রকৃতির পরিণাম বুদ্ধির সঙ্গে আত্মার অভেদজ্ঞানই হলো আত্মার বন্ধন। আত্মা বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হলে বুদ্ধিকে চৈতন্যযুক্ত এবং আত্মাকে বুদ্ধিযুক্ত বলে মনে হয়। একেই পুরুষ-প্রকৃতির অভেদজ্ঞান বলে। পাতঞ্জলসূত্রে বলা হয়েছে-
‘দ্রষ্টৃদৃশ্যোপরক্তং চিত্তং সর্ব্বার্থম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-৪/২২)
অর্থাৎ : দ্রষ্টা আত্মা দৃশ্য বুদ্ধিতত্ত্বে উপরক্ত বা প্রতিবিম্বিত হলে সেই বুদ্ধিতত্ত্ব বা চিত্ত সর্বপ্রকাশক হয় (পাতঞ্জল-৪/২২)।
এই অভেদজ্ঞান বস্তুত অবিদ্যাপ্রসূত অজ্ঞান। এর ফলেই পুরুষ বুদ্ধির বৃত্তিকে নিজবৃত্তি এবং বুদ্ধির পরিণামকে নিজ পরিণাম ভেবে তা অধিগ্রহণ করে। পুরুষের এই অবস্থাই হলো পুরুষের বদ্ধাবস্থা। এই অঘটনের ঘটক হলো অনাদি অবিদ্যা।
 .
পুরুষ বা আত্মা স্বভাবত নিত্য মুক্ত শুদ্ধ চৈতন্য সত্তা। পুরুষের বন্ধন নেই, মুক্তিও নেই। কিন্তু অবিদ্যার কারণে পুরুষের বন্ধন বা বদ্ধাবস্থা দেখা দেয়। এই অবিদ্যার কারণেই দ্রষ্টা পুরুষ এবং দৃশ্য প্রকৃতির সংযোগ ঘটে এবং সংযোগের ফলে পঞ্চক্লেশযুক্ত দুঃখের উদ্ভব হয়। যোগদর্শনে অবিদ্যাকে ত্রিতাপ অর্থাৎ পরিণাম-দুঃখ, তাপ-দুঃখ ও সংস্কার-দুঃখের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই অবিদ্যাকে দূর করতে না পারলে পুরুষ বা আত্মার মুক্তি সম্ভব হয় না। অবিদ্যাকে দূর করার উপায় হলো ভেদজ্ঞান বা বিবেকখ্যাতি। পাতঞ্জলসূত্রের কৈবল্যপাদে বলা হয়েছে-
‘প্রসংখ্যানেহপ্যকুসীদস্য সর্ব্বথা। বিবেকখাতেধর্ম্মমেঘঃ সমাধিঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৪/২৮)
‘ততঃ ক্লেশকর্ম্মনিবৃত্তিঃ’। (পাতঞ্জলসূত্র-৪/২৯)
‘তদা সর্ব্বাবরণাপেতস্য জ্ঞানস্যানন্ত্যাৎ জ্ঞেয়মল্পম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-৪/৩০)
‘কৃতার্থানাং পরিণামক্রমসমাপ্তির্গুণানাম্’। (পাতঞ্জলসূত্র-৪/৩১)
অর্থাৎ :
যাঁর পরম বৈরাগ্য প্রভাবে প্রসংখ্যান অথবা সর্ববিজ্ঞানশক্তির প্রতিও অনাসক্তি হয়, তিনিই প্রকৃতি পুরুষে যে প্রভেদ আছে তা বুঝতে পারেন, তিনিই বিবেকখ্যাতি নাম্নী অদ্ভূত শক্তির অধিকারী হন। তিনিই সেই অদ্ভূতশক্তি-বলে ধর্মমেঘ (শ্রেষ্ঠতম সমাধি) নামক অমৃতসাগরে নিমগ্ন হন (পাতঞ্জল-৪/২৮)।  ঐ ধর্মমেঘ-বলেই অবিদ্যা প্রভৃতি পঞ্চক্লেশের এবং সর্বকর্মের নিবৃত্তি হয় (পাতঞ্জল-৪/২৯)।  তখন জ্ঞানের (বুদ্ধিসত্ত্বের) সমস্ত আবরণ ক্ষয় হয়ে জ্ঞান অনন্ত হয়। অনন্ত-জ্ঞান হলেই জ্ঞেয় অল্পই থাকে। অনন্ত-জ্ঞান হলে সহজেই সর্বজ্ঞ হওয়া যায় (পাতঞ্জল-৪/৩০)।  পুরুষ ধর্মমেঘ নামক অপূর্ব সমাধিমগ্ন হলে, প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক গুণগুলি সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান লাভ করলে, তখন আর তিনি প্রাকৃতিক প্রলোভনে প্রলোভিত হন না। সুতরাং তখন প্রাকৃতিক গুণ পরিণামক্রম একেবারেই পরিসমাপ্ত হয় (পাতঞ্জলসূত্র-৪/৩১)।
 .
যোগমতে অষ্টাঙ্গিক যোগ বা যোগাঙ্গগুলির দীর্ঘকাল ধরে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাধির হানিকর ক্লেশসমূহ বিনষ্ট হয়, চিত্তের অশুদ্ধি ও মালিন্য দূর হয় এবং অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা জ্ঞানের দীপ্তি বৃদ্ধি পেতে পেতে ক্রমশ বিবেকখ্যাতির উদয় হয়। সম্প্রজ্ঞাত ও অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির মাধ্যমে সর্বপ্রকার ক্লেশবীজ ও বৃত্তিসংস্কার ধ্বংস হলে পুরুষ চরমবৈরাগ্য লাভ করে। ক্লেশবীজ ও বৃত্তিসংস্কার স্ব-স্ব কারণের মধ্যে বিলীন হলে প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদজ্ঞানরূপ বিবেকখ্যাতি পরিপক্কতা লাভ করে। এর ফলে কার্য-কারণরূপে অবস্থিত সকল পদার্থ আপন প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়। একে প্রকৃতির দিক থেকে কৈবল্য বলা হয়। পুরুষ থেকে প্রকৃতির বিযুক্তভাবে অবস্থানকেই প্রকৃতির কৈবল্য বলা হয়। এই অবস্থায় সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণসমূহের প্রয়োজন শেষ হয় তথা ভোগ-অপবর্গ নিষ্পন্ন হয় এবং মহৎ বা বুদ্ধি, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়, ভূতাদি কার্যসমূহের স্ব স্ব কারণপ্রকৃতিতে লয় হয়। আর পুরুষের দিক থেকে চিতিশক্তি, বুদ্ধি তথা প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। বুদ্ধির প্রলয়ে পুরুষের প্রতিবিম্বপাতের আর কোন সম্ভাবনাই থাকে না। পুরুষের এই যে কেবল অবস্থা তাকেই পুরুষের কৈবল্য বা মোক্ষ বলা হয়। কৈবল্যপ্রাপ্তির পর আত্মা পুরুষের দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে।
প্রকৃতি ও পুরুষের এই উভয়বিধ কৈবল্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর যোগসূত্রের কৈবল্যপাদে বলেছেন-
‘পুরুষার্থশূন্যানাং গুণানাং প্রতিপ্রসবঃ কৈবল্যং স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তিরিতি’- (যোগসূত্র : ৪/৩৪)
অর্থাৎ : কৈবল্যে পুরুষের কিছু অবস্থান্তর হয় না, স্বরূপে অবস্থান হয় মাত্র, কিন্তু বুদ্ধি তথা গুণত্রয়ের প্রলয় হয়।
 .
এভাবেই যোগদর্শনে পুরুষ বা আত্মার বন্ধন ও কৈবল্যের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال