বুদ্ধের মতবাদ (Buddhism)
গৌতম বুদ্ধ কোন চরমপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সর্বাবস্থায় তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বনকেই সঠিক মনে করতেন। বোধিপ্রাপ্তির লক্ষ্যে কঠোর তপস্যাকালীন সময়েই এ জ্ঞান তিনি প্রাপ্ত হন এবং মধ্যম মার্গ অনুসরণ করেই বোধিলাভ করেন। তাই বোধিলাভের পরপরই সর্বপ্রথম তিনি ঋষিপত্তন মৃগদাবে (সারনাথ, বেনারস) সেই পাঁচজন ভিক্ষুর অন্বেষণে গিয়েছিলেন তাঁদের শঙ্কা দূর করার লক্ষ্যে, যাঁরা তপস্যাকালীন সময়ে অনশন ভঙ্গকারী গৌতমকে ছেড়ে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে চলে গিয়েছিলেন।
.
বুদ্ধের প্রথম শিষ্যত্ব গ্রহণকারী সেই পঞ্চভিক্ষুকে ধর্মোপদেশ দানকালে বুদ্ধ বললেন-
“ভিক্ষুগণ! এই দুই চরম পন্থাকে …লালন করতে নেই- (১) ভোগ বাসনায় লিপ্ত হওয়া …(২) শরীরকে ক্লেশ দেওয়া। -এই দুই অতিকে ছেড়ে …আমি মধ্যমপন্থা সন্ধান করেছি, যা দৃষ্টিদানকারী, জ্ঞানদাতা …শান্তিময়। …এই মধ্যম মার্গই শ্রেষ্ঠ অষ্টাঙ্গিক মার্গ; যথা, ঠিক দর্শন, ঠিক কর্ম, ঠিক সংকল্প, ঠিক বচন, ঠিক জীবিকা, ঠিক প্রযত্ন, ঠিক স্মৃতি এবং ঠিক সমাধি। …” (‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্ত’, সংযুক্তনিকায়: ৫৫/২/১)
“ভিক্ষুগণ! এই দুই চরম পন্থাকে …লালন করতে নেই- (১) ভোগ বাসনায় লিপ্ত হওয়া …(২) শরীরকে ক্লেশ দেওয়া। -এই দুই অতিকে ছেড়ে …আমি মধ্যমপন্থা সন্ধান করেছি, যা দৃষ্টিদানকারী, জ্ঞানদাতা …শান্তিময়। …এই মধ্যম মার্গই শ্রেষ্ঠ অষ্টাঙ্গিক মার্গ; যথা, ঠিক দর্শন, ঠিক কর্ম, ঠিক সংকল্প, ঠিক বচন, ঠিক জীবিকা, ঠিক প্রযত্ন, ঠিক স্মৃতি এবং ঠিক সমাধি। …” (‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন সূত্ত’, সংযুক্তনিকায়: ৫৫/২/১)
.
তর্কের সাহায্যে অধিবিদ্যা বা অধ্যাত্মবাদের (metaphysical) সমস্যার দার্শনিক সমাধান খোঁজা বুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং কেশবহুল প্রপঞ্চ থেকে রেহাই পাবার জন্যে তিনি নৈতিক আচারমার্গের নির্দেশের মাধ্যমে মূলত ধর্মপ্রচার করেছেন। বুদ্ধ কথিত চারটি আর্যসত্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বৌদ্ধধর্মের আচারমার্গিক রহস্য, এমনকি দার্শনিক মাহাত্ম্যও।
চার আর্যসত্য (The Four Noble Truths)
.
বলা হয়ে থাকে, চারটি আর্য বা শ্রেষ্ঠ সত্যের উদ্ঘাটন করায় শাক্যমুনি গৌতম বোধিলাভ করে ‘বুদ্ধ’ নামে অভিহিত হন। এই রহস্যের প্রকটিকরণই তাঁর আধ্যাত্মিক জাগরণের (বুদ্ধত্বের) সঙ্কেত দেয়। তাই বৌদ্ধধর্মের রহস্য জানার জন্য এই চার আর্য সত্যের জ্ঞান নিতান্ত আবশ্যক। বৌদ্ধদর্শনে যাকে বলা হয় চত্বারি আর্য সত্যানি বা চার আর্যসত্য। বুদ্ধের সমস্ত উপদেশের মূলে এই চারটি আর্যসত্য নিহিত রয়েছে। অধ্যাত্মবাদের গ্রন্থিমোচন না-করা হলেও কেশবহুল প্রপঞ্চ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তথাগত বুদ্ধের আচারমার্গিক নির্দেশনা হলো এই চারটি আর্যসত্য। এগুলো হচ্ছে-
(১) জগত দুঃখময়- সর্বং দুঃখম্ ।
(২) দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের হেতু আছে- দুঃখসমুদয়ঃ।
(৩) দুঃখের নিরোধ বা নির্বাণ সম্ভব- দুঃখনিরোধঃ। এবং
(৪) দুঃনিরোধের উপায় বা মার্গ আছে- দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপৎ।
অর্থাৎ চার আর্যসত্য হলো- দুঃখের বিদ্যমানতা, তার কারণের বিদ্যমানতা, তার নিরোধের সম্ভাব্যতা এবং তাতে সাফল্য লাভের পথ বা উপায়। এই চার আর্যসত্যকে বুদ্ধের চতুঃসূত্রীও বলা হয়।
বলা হয়ে থাকে, চারটি আর্য বা শ্রেষ্ঠ সত্যের উদ্ঘাটন করায় শাক্যমুনি গৌতম বোধিলাভ করে ‘বুদ্ধ’ নামে অভিহিত হন। এই রহস্যের প্রকটিকরণই তাঁর আধ্যাত্মিক জাগরণের (বুদ্ধত্বের) সঙ্কেত দেয়। তাই বৌদ্ধধর্মের রহস্য জানার জন্য এই চার আর্য সত্যের জ্ঞান নিতান্ত আবশ্যক। বৌদ্ধদর্শনে যাকে বলা হয় চত্বারি আর্য সত্যানি বা চার আর্যসত্য। বুদ্ধের সমস্ত উপদেশের মূলে এই চারটি আর্যসত্য নিহিত রয়েছে। অধ্যাত্মবাদের গ্রন্থিমোচন না-করা হলেও কেশবহুল প্রপঞ্চ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তথাগত বুদ্ধের আচারমার্গিক নির্দেশনা হলো এই চারটি আর্যসত্য। এগুলো হচ্ছে-
(১) জগত দুঃখময়- সর্বং দুঃখম্ ।
(২) দুঃখ সমুদয় বা দুঃখের হেতু আছে- দুঃখসমুদয়ঃ।
(৩) দুঃখের নিরোধ বা নির্বাণ সম্ভব- দুঃখনিরোধঃ। এবং
(৪) দুঃনিরোধের উপায় বা মার্গ আছে- দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপৎ।
অর্থাৎ চার আর্যসত্য হলো- দুঃখের বিদ্যমানতা, তার কারণের বিদ্যমানতা, তার নিরোধের সম্ভাব্যতা এবং তাতে সাফল্য লাভের পথ বা উপায়। এই চার আর্যসত্যকে বুদ্ধের চতুঃসূত্রীও বলা হয়।
.
প্রথম আর্যসত্য : দুঃখ (Suffering)
বুদ্ধের বোধিলব্ধ প্রথম আর্যসত্য হলো- ‘সর্বম্ দুঃখম্ দুঃখম্’। এই সংসারের সকল কিছই দুঃখময়। জীবজীবন নিরবচ্ছিন্ন দুঃখে পূর্ণ। জন্ম, জরা, বিচ্ছেদ এবং মৃত্যু অর্থাৎ যা কিছু আসক্তিপ্রসূত তাই দুঃখময়। দুঃখ হলো মানব অস্তিত্বের নিত্যসাথী। জীবনে সুখ যে নেই তা নয়, তবে সেই সুখ ক্ষণস্থায়ী এবং পরিণামে দুঃখই আনে। কেননা, বুদ্ধের মতে জীবজীবনে যে আপাত সুখের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় তা দুঃখেরই নামান্তর। অবিদ্যাগ্রস্ত জীব যথার্থ সুখের পরিচয় জানে না। অজ্ঞতাবশত শিশু যেমন নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হয়ে আপাত সুখ বোধ করে, অবিদ্যাগ্রস্ত জীবও সেইরূপ ইন্দ্রিয়সম্ভোগ এবং ভোগলালসার পরিতৃপ্তিকে সুখ বলে মনে করে। কিন্তু শিশুর এ আপাত সুখ অসুখকেই আহ্বান করে। অনুরূপভাবে ইন্দ্রিয়সম্ভোগ ভোগলালসাকে পরিতৃপ্ত করে না, বরং তাকে তীব্রতর করে। ভোগলালসা অন্তহীন তাই ইন্দ্রিয়সম্ভোগেরও পরিতৃপ্তি নেই। বিদ্যার দ্বারা যখন অবিদ্যা বিনষ্ট হয় তখন জীব এই জগৎসংসারকে একান্ত দুঃখময় বলে বুঝতে পারে। বুদ্ধমতে এই সংসার অনিত্য এবং যা অনিত্য তাই দুঃখময়। সুতরাং সবই দুঃখময়।
মজ্ঝিমনিকায় (১/৫/৪) বুদ্ধ বলেছেন- “জন্মে দুঃখ, বার্ধক্যে বা নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখময়, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়ের বিয়োগ দুঃখময়। সংক্ষেপে রোগ হতে উৎপন্ন পঞ্চ-উপাদান স্কন্ধ দুঃখময়।”
মজ্ঝিমনিকায় (১/৫/৪) বুদ্ধ বলেছেন- “জন্মে দুঃখ, বার্ধক্যে বা নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখময়, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়ের বিয়োগ দুঃখময়। সংক্ষেপে রোগ হতে উৎপন্ন পঞ্চ-উপাদান স্কন্ধ দুঃখময়।”
.
বৌদ্ধনয়ে বস্তু বা ভূতব্যতিরিক্ত অমূর্ত তত্ত্বকে স্কন্ধ বলা হয়। তা পাঁচ প্রকার। এই পঞ্চ-উপাদান স্কন্ধ হলো- রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান।
.
(ক) রূপ– পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, এই চতুর্মহাভূত হলো রূপ উপাদান-স্কন্ধ।
(খ) বেদনা– বিষয়ের স্পর্শ (সম্বন্ধ) হতে অর্থাৎ বস্তু ও তার বিচার সম্বন্ধে এসে আমরা যে সুখ-দুঃখ অনুভব করি তাকেই বলে বেদনা স্কন্ধ।
(গ) সংজ্ঞা– বেদনার পর আমাদের মস্তিষ্কে পূর্ব থেকেই অঙ্কিত যে সংস্কার দ্বারা আমরা ব্যক্তি বা বস্তুকে চিনতে পারি তাকেই বলে সংজ্ঞা স্কন্ধ।
(ঘ) সংস্কার– রূপের যে বেদনা এবং সংজ্ঞার যে সংস্কার আমাদের চিন্তায় ছাপ ফেলে প্রকৃত ব্যক্তি বা বস্তুকে চিনতে সাহায্য করে তা-ই সংস্কার স্কন্ধ। বিতর্ক, বিচার, লোভ, দ্বেষ, করুণা ইত্যাদি মানসিক প্রবৃত্তিকে একসাথে সংস্কার স্কন্ধ বলে।
(ঙ) বিজ্ঞান– চেতনা বা মনকে বলে বিজ্ঞান স্কন্ধ।
(ক) রূপ– পৃথিবী, জল, বায়ু, অগ্নি, এই চতুর্মহাভূত হলো রূপ উপাদান-স্কন্ধ।
(খ) বেদনা– বিষয়ের স্পর্শ (সম্বন্ধ) হতে অর্থাৎ বস্তু ও তার বিচার সম্বন্ধে এসে আমরা যে সুখ-দুঃখ অনুভব করি তাকেই বলে বেদনা স্কন্ধ।
(গ) সংজ্ঞা– বেদনার পর আমাদের মস্তিষ্কে পূর্ব থেকেই অঙ্কিত যে সংস্কার দ্বারা আমরা ব্যক্তি বা বস্তুকে চিনতে পারি তাকেই বলে সংজ্ঞা স্কন্ধ।
(ঘ) সংস্কার– রূপের যে বেদনা এবং সংজ্ঞার যে সংস্কার আমাদের চিন্তায় ছাপ ফেলে প্রকৃত ব্যক্তি বা বস্তুকে চিনতে সাহায্য করে তা-ই সংস্কার স্কন্ধ। বিতর্ক, বিচার, লোভ, দ্বেষ, করুণা ইত্যাদি মানসিক প্রবৃত্তিকে একসাথে সংস্কার স্কন্ধ বলে।
(ঙ) বিজ্ঞান– চেতনা বা মনকে বলে বিজ্ঞান স্কন্ধ।
.
বুদ্ধমতে মনুষ্যে কোন শুদ্ধ এক সত্তা থাকে না, সে মানসিক (mental) ও ভৌতিক (material) অনেক অবস্থার সমুদায় মাত্র, যা অবিচ্ছিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। সমস্ত ভৌতিক অবস্থাকে সমষ্টিগতভাবে ‘রূপ’ এবং মানসিক অবস্থাসমূহকে ‘নাম’ বলা হয়। নামের তিনটি অবস্থা- বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার। আর পাপ-পুণ্য ইত্যাদি যত প্রকার চিত্ত আছে সকলকে একসাথে ‘বিজ্ঞান’ বলে। এভাবে মানুষ হচ্ছে পাঁচ অবস্থার সমুদায়। এদেরকে ‘পঞ্চ স্কন্ধ’ বলা হয়।
এই পঞ্চ স্কন্ধ যখন ব্যক্তির তৃষ্ণার বিষয় হয়ে তার নিকট আসে তখনই তাকে বলে উপাদান স্কন্ধ। বুদ্ধ এই পঞ্চ উপাদান স্কন্ধকেই বলেছেন দুঃখ।
.
এই প্রথম আর্যসত্যের প্রামাণ্য হিসেবে দুঃখকে ভারতীয় সমস্ত দার্শনিক-সম্প্রদায় স্বীকার করলেও চার্বাক-সম্প্রদায় তা স্বীকার করেন নি। চার্বাকরা জগৎকে সুখময় বলে মনে করেন।
এই পঞ্চ স্কন্ধ যখন ব্যক্তির তৃষ্ণার বিষয় হয়ে তার নিকট আসে তখনই তাকে বলে উপাদান স্কন্ধ। বুদ্ধ এই পঞ্চ উপাদান স্কন্ধকেই বলেছেন দুঃখ।
.
এই প্রথম আর্যসত্যের প্রামাণ্য হিসেবে দুঃখকে ভারতীয় সমস্ত দার্শনিক-সম্প্রদায় স্বীকার করলেও চার্বাক-সম্প্রদায় তা স্বীকার করেন নি। চার্বাকরা জগৎকে সুখময় বলে মনে করেন।
.
.
দ্বিতীয় আর্যসত্য : দুঃখের কারণ বা হেতু (The Origin of Suffering)
দ্বিতীয় আর্যসত্যে বুদ্ধ দুঃখের কারণ বা হেতু নির্দেশ করেছেন। বুদ্ধের লক্ষ্য ছিলো দুঃখ থেকে জীবের নিবৃত্তি। কিন্তু জগৎ দুঃখময় বললেই দুঃখের নিবৃত্তি হয় না। আবার কোন কিছুর নিবৃত্তি তার কারণের নিবৃত্তি-নির্ভর। রোগ-নিবৃত্তি যেমন রোগের কারণ বা হেতুকে নিবৃত্ত না করে সম্ভব নয়, তেমনি দুঃখ-নিবৃত্তিও দুঃখের কারণকে নিবৃত্ত না করে সম্ভব নয়। বস্তুত কারণের উপস্থিতিতেই কার্যের উপস্থিতি ঘটে। একইভাবে কারণের উচ্ছেদেই কার্যের উচ্ছেদ হয়। সুতরাং দুঃখ-নিবৃত্তির জন্য দুঃখের কারণ বা হেতু জানা প্রয়োজন এবং তার উচ্ছেদ কিভাবে সম্ভব তার উপায়ও অনুধাবন করা প্রয়োজন। এ কারণে বুদ্ধ দ্বিতীয় আর্যসত্যে দুঃখের কারণ নির্দেশ করেছেন।
.
দুঃখের কারণ কী ? তৃষ্ণা বা আসক্তি- সম্ভোগতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা, বৈভবতৃষ্ণা। জগতে যত ইন্দ্রিয়-প্রিয় বস্তু আছে, বিষয় আছে, সে সম্পর্কে চিন্তা ও সম্বন্ধ স্থাপনই তৃষ্ণার জন্ম দেয়। প্রথম আর্যসত্যের দুঃখরূপ পঞ্চ স্কন্ধ লক্ষণই হচ্ছে দুঃখের সমুদয় অর্থাৎ কারণ নামক দ্বিতীয় আর্যসত্য। মজ্ঝিমনিকায় বলা হচ্ছে-
“কাম্য বস্তুর ভোগলালসা থেকেই রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব লাগে, ক্ষত্রিয়ে ক্ষত্রিয়ে শত্রুতা, ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণে তর্ক, বৈশ্যে বৈশ্যে হানাহানি, মাতাপুত্রে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নী-বন্ধুর মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। তারা পারস্পরিক মৌখিক কলহ থেকে ক্রমশ হাতাহাতি এমনকি অস্ত্রধারণ করতেও কুণ্ঠিত হয় না, এতে তারা অনেক সময়ে মৃত্যুমুখেও পতিত হয়ে মৃত্যুতুল্য দুঃখ প্রাপ্ত হয়।”
দ্বিতীয় আর্যসত্যে বুদ্ধ দুঃখের কারণ বা হেতু নির্দেশ করেছেন। বুদ্ধের লক্ষ্য ছিলো দুঃখ থেকে জীবের নিবৃত্তি। কিন্তু জগৎ দুঃখময় বললেই দুঃখের নিবৃত্তি হয় না। আবার কোন কিছুর নিবৃত্তি তার কারণের নিবৃত্তি-নির্ভর। রোগ-নিবৃত্তি যেমন রোগের কারণ বা হেতুকে নিবৃত্ত না করে সম্ভব নয়, তেমনি দুঃখ-নিবৃত্তিও দুঃখের কারণকে নিবৃত্ত না করে সম্ভব নয়। বস্তুত কারণের উপস্থিতিতেই কার্যের উপস্থিতি ঘটে। একইভাবে কারণের উচ্ছেদেই কার্যের উচ্ছেদ হয়। সুতরাং দুঃখ-নিবৃত্তির জন্য দুঃখের কারণ বা হেতু জানা প্রয়োজন এবং তার উচ্ছেদ কিভাবে সম্ভব তার উপায়ও অনুধাবন করা প্রয়োজন। এ কারণে বুদ্ধ দ্বিতীয় আর্যসত্যে দুঃখের কারণ নির্দেশ করেছেন।
.
দুঃখের কারণ কী ? তৃষ্ণা বা আসক্তি- সম্ভোগতৃষ্ণা, ভবতৃষ্ণা, বৈভবতৃষ্ণা। জগতে যত ইন্দ্রিয়-প্রিয় বস্তু আছে, বিষয় আছে, সে সম্পর্কে চিন্তা ও সম্বন্ধ স্থাপনই তৃষ্ণার জন্ম দেয়। প্রথম আর্যসত্যের দুঃখরূপ পঞ্চ স্কন্ধ লক্ষণই হচ্ছে দুঃখের সমুদয় অর্থাৎ কারণ নামক দ্বিতীয় আর্যসত্য। মজ্ঝিমনিকায় বলা হচ্ছে-
“কাম্য বস্তুর ভোগলালসা থেকেই রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব লাগে, ক্ষত্রিয়ে ক্ষত্রিয়ে শত্রুতা, ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণে তর্ক, বৈশ্যে বৈশ্যে হানাহানি, মাতাপুত্রে মনোমালিন্য, ভ্রাতা-ভগ্নী-বন্ধুর মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। তারা পারস্পরিক মৌখিক কলহ থেকে ক্রমশ হাতাহাতি এমনকি অস্ত্রধারণ করতেও কুণ্ঠিত হয় না, এতে তারা অনেক সময়ে মৃত্যুমুখেও পতিত হয়ে মৃত্যুতুল্য দুঃখ প্রাপ্ত হয়।”
.
আমরা কেন দুঃখ ভোগ করি ? এ প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ বলেন, দুঃখের কারণ আছে। অর্থাৎ এ সত্যটি একটি কার্য-কারণ সম্বন্ধীয় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বুদ্ধ এর নাম দিয়েছেন প্রতীত্যসমুৎপাদ (The doctrine of Dependent Origination)। এই প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুসারেই দুঃখের কারণকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি। এতে বলা হয়েছে, সংসারে অকারণ কোন বস্তু নেই, প্রত্যেক বিষয়ের কারণ থাকে। প্রতিটি ঘটনাই পূর্ববর্তী কোন ঘটনা থেকে উদ্ভূত হয়। দুঃখ একটি ঘটনা। সুতরাং দুঃখেরও কারণ আছে। কারণের অভাবে দুঃখের উৎপত্তি সম্ভব নয়। দুঃখের কারণটি জানা হলে আমরা দুঃখ নিবৃত্তির পথে এগিয়ে যেতে পারবো। কেননা কারণটিকে দূর করতে পারলেই কার্যটি আর ঘটবে না। সংসারে জরা ও মরণ দুঃখ দু’টি প্রধান। শরীর ধারণ করার দরুন জরা-মরণের দুঃখভোগ করতে হয়, যদি শরীর ধারণ না করতে হয় তবে দুঃখ দু’টি হতে রেহাই পাওয়া যায়।
.
বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের কারণ সম্পর্কে একটি বিশেষ সূত্র আছে। যা বৌদ্ধ দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ‘প্রতিত্যসমুৎপাদ’ তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয়। এই সূত্র অনুসারে দুঃখ সৃষ্টির একই কারণ নয়। তাদের মধ্যে একটি ধারাবাহিক শৃঙ্খলা রয়েছে। এই কারণ-শৃঙ্খলে বারোটি নিদান বা সংযোগসূত্র আছে। এগুলো হচ্ছে অবিদ্যা, সংস্কার, চেতনা বা বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা বা অনুভূতি, তৃষ্ণা বা ভোগবাসনা, উপাদান বা বিষয়ানুরাগ, ভব, জাতি ও জরামরণ। একে ‘দ্বাদশ নিদান’ও (twelve sources) বলা হয়। এই বারোটি নিদানের কার্যকারণের যে ব্যবস্থিত নিয়ম বা শৃঙ্খলা তা অস্থিত্বের বৃত্ত ‘ভবচক্রে’র বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ জন্মের সাথে সম্বন্ধ। প্রথম নিদান থেকে আরম্ভ করে কারণ খুঁজতে খুঁজতে অন্তিম নিদানে পৌছানো যায়, যার নাম হচ্ছে ‘অবিদ্যা’, দুঃখের সামগ্রিক কারণ।
.
বুদ্ধমতে ভবচক্রের (wheel of existence) দ্বাদশ নিদান:
.
(১) অবিদ্যা (ignorance) : অবিদ্যা হলো সকল দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যা মানে অজ্ঞান। এখানে অবিদ্যা অভাব-বাচক নয়, বরং বিরোধ-বাচক অর্থে প্রতিপাদন হয়েছে। অর্থাৎ অবিদ্যা মানে জ্ঞানশূন্য নয়, জ্ঞানের বিপক্ষ। যেমন যে বস্তু অবাস্তবিক তাকে বাস্তবিক ভাবা, সে বস্তু দুঃখময় তাকে সুখময় ভাবা, যে বস্তু আত্মা নয় (অনাত্মা, non-self) তাকে আত্মা ভাবা হচ্ছে অবিদ্যার প্রতীক। অবিদ্যা হলো সত্যের সম্যক জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যার প্রভাবে আমরা অনিত্য সংসারকে নিত্য বলে মনে করি। বস্তুর যথার্থ স্বরূপকে না জানার কারণ অবিদ্যা প্রতিফলিত হয়ে সংস্কারকে উৎপন্ন করে। অর্থাৎ এই অবিদ্যাজনিত কামনা ও বাসনা থেকে উদ্ভূত হয় আমাদের সংস্কার।
(১) অবিদ্যা (ignorance) : অবিদ্যা হলো সকল দুঃখের মূল কারণ। অবিদ্যা মানে অজ্ঞান। এখানে অবিদ্যা অভাব-বাচক নয়, বরং বিরোধ-বাচক অর্থে প্রতিপাদন হয়েছে। অর্থাৎ অবিদ্যা মানে জ্ঞানশূন্য নয়, জ্ঞানের বিপক্ষ। যেমন যে বস্তু অবাস্তবিক তাকে বাস্তবিক ভাবা, সে বস্তু দুঃখময় তাকে সুখময় ভাবা, যে বস্তু আত্মা নয় (অনাত্মা, non-self) তাকে আত্মা ভাবা হচ্ছে অবিদ্যার প্রতীক। অবিদ্যা হলো সত্যের সম্যক জ্ঞানের অভাব। অবিদ্যার প্রভাবে আমরা অনিত্য সংসারকে নিত্য বলে মনে করি। বস্তুর যথার্থ স্বরূপকে না জানার কারণ অবিদ্যা প্রতিফলিত হয়ে সংস্কারকে উৎপন্ন করে। অর্থাৎ এই অবিদ্যাজনিত কামনা ও বাসনা থেকে উদ্ভূত হয় আমাদের সংস্কার।
.
(২) সংস্কার (impression) : সংস্কার হলো আমাদের অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ। অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মাবস্থাই সংস্কার। পূর্বজন্মের কর্ম ও অনুভবের দরুন উৎপন্ন সূক্ষ্ম ও বাসনাময় বস্তু হলো সংস্কার। সংস্কারের কারণ হচ্ছে অবিদ্যা। অবিদ্যাজনিত কর্ম একপ্রকার শক্তি উৎপন্ন করে। এই শক্তি আবার কর্মের ফল সৃষ্টি করে। এক জীবনের সংস্কার পরের জীবনের চিন্তা ও কর্মকে উৎপন্ন করে। ফলে পূর্বজন্মের সংস্কার থেকেই পরজন্মের বিজ্ঞান বা চেতনা উদ্ভূত হয়।
(২) সংস্কার (impression) : সংস্কার হলো আমাদের অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ। অর্থাৎ পূর্বজন্মের কর্মাবস্থাই সংস্কার। পূর্বজন্মের কর্ম ও অনুভবের দরুন উৎপন্ন সূক্ষ্ম ও বাসনাময় বস্তু হলো সংস্কার। সংস্কারের কারণ হচ্ছে অবিদ্যা। অবিদ্যাজনিত কর্ম একপ্রকার শক্তি উৎপন্ন করে। এই শক্তি আবার কর্মের ফল সৃষ্টি করে। এক জীবনের সংস্কার পরের জীবনের চিন্তা ও কর্মকে উৎপন্ন করে। ফলে পূর্বজন্মের সংস্কার থেকেই পরজন্মের বিজ্ঞান বা চেতনা উদ্ভূত হয়।
.
(৩) চেতনা বা বিজ্ঞান (consciousness) : আমাদের বিজ্ঞান বা চেতনার কারণ হলো অতীত জীবনের সংস্কার। চেতনা থাকে বলেই এই জীবদেহ মাতৃগর্ভে দিন দিন বাড়তে থাকে, এই বিজ্ঞানের দরুনই শিশুর শরীর ও মন বিকশিত হয়। অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার চৈতন্যরূপে মাতৃজঠরে আবির্ভূত হয় এবং জীবদেহ গঠন করে। কাজেই চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় জীবদেহ বা নামরূপ।
বৌদ্ধদর্শন মতে এই বিজ্ঞান হচ্ছে প্রতিসন্ধি (জন্ম) স্কন্ধ। প্রতিসন্ধি ক্ষণে বা উপপত্তি ক্ষণে গর্ভস্থ পাঁচটি স্কন্ধ (রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার) হচ্ছে বিজ্ঞান বা চেতনা। উল্লেখ্য, ভূতব্যতিরিক্ত অমূর্ত তত্ত্বকে বৌদ্ধগণ স্কন্ধ বলেন।
(৩) চেতনা বা বিজ্ঞান (consciousness) : আমাদের বিজ্ঞান বা চেতনার কারণ হলো অতীত জীবনের সংস্কার। চেতনা থাকে বলেই এই জীবদেহ মাতৃগর্ভে দিন দিন বাড়তে থাকে, এই বিজ্ঞানের দরুনই শিশুর শরীর ও মন বিকশিত হয়। অর্থাৎ পূর্বজন্মের সংস্কার চৈতন্যরূপে মাতৃজঠরে আবির্ভূত হয় এবং জীবদেহ গঠন করে। কাজেই চেতনা থেকে উদ্ভূত হয় জীবদেহ বা নামরূপ।
বৌদ্ধদর্শন মতে এই বিজ্ঞান হচ্ছে প্রতিসন্ধি (জন্ম) স্কন্ধ। প্রতিসন্ধি ক্ষণে বা উপপত্তি ক্ষণে গর্ভস্থ পাঁচটি স্কন্ধ (রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার) হচ্ছে বিজ্ঞান বা চেতনা। উল্লেখ্য, ভূতব্যতিরিক্ত অমূর্ত তত্ত্বকে বৌদ্ধগণ স্কন্ধ বলেন।
.
(৪) নামরূপ (mind body organism) : দৃশ্যমান শরীর ও মনের সংবলিত সংস্থানবিশেষ হচ্ছে নামরূপ। সোজা কথায় দেহ-মনের সংগঠন। নামরূপের কারণ হলো চেতনা বা বিজ্ঞান। এই নামরূপ থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের ষড়ায়তন বা ছয়টি ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়গুলোর নিবাস শরীরে ও মনে। পাঁচ বাহ্যেন্দ্রিয় শরীরে থাকে বলে মনে করা হয় এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মন হচ্ছে আন্তর। নামরূপের অস্তিত্ব না থাকলে এই ছয়টি ইন্দ্রিয় উদ্ভূত হতো না।
(৪) নামরূপ (mind body organism) : দৃশ্যমান শরীর ও মনের সংবলিত সংস্থানবিশেষ হচ্ছে নামরূপ। সোজা কথায় দেহ-মনের সংগঠন। নামরূপের কারণ হলো চেতনা বা বিজ্ঞান। এই নামরূপ থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের ষড়ায়তন বা ছয়টি ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়গুলোর নিবাস শরীরে ও মনে। পাঁচ বাহ্যেন্দ্রিয় শরীরে থাকে বলে মনে করা হয় এবং ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মন হচ্ছে আন্তর। নামরূপের অস্তিত্ব না থাকলে এই ছয়টি ইন্দ্রিয় উদ্ভূত হতো না।
.
(৫) ষড়ায়তন (six sense organs) : ষড়ায়তন হলো বিশেষ বিশেষ বিষয়যুক্ত পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনের সঙ্কলন। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক হচ্ছে বাহ্য পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন হচ্ছে আন্তর ইন্দ্রিয়। এই ছয়টি ইন্দ্রিয়ই বিষয়ের সাথে সম্পর্ক গ্রহণ করে। ইন্দ্রিয়ের প্রাদুর্ভাবকাল হতে ইন্দ্রিয়, বিষয় ও চেতনা বা বিজ্ঞানের সন্নিপাতকাল পর্যন্ত হচ্ছে ‘ষড়ায়তন’। এই ছয়টি ইন্দ্রিয় আছে বলেই স্পর্শ সম্ভব হয়। কাজেই ষড়ায়তন থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের স্পর্শ।
(৫) ষড়ায়তন (six sense organs) : ষড়ায়তন হলো বিশেষ বিশেষ বিষয়যুক্ত পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনের সঙ্কলন। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক হচ্ছে বাহ্য পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় এবং মন হচ্ছে আন্তর ইন্দ্রিয়। এই ছয়টি ইন্দ্রিয়ই বিষয়ের সাথে সম্পর্ক গ্রহণ করে। ইন্দ্রিয়ের প্রাদুর্ভাবকাল হতে ইন্দ্রিয়, বিষয় ও চেতনা বা বিজ্ঞানের সন্নিপাতকাল পর্যন্ত হচ্ছে ‘ষড়ায়তন’। এই ছয়টি ইন্দ্রিয় আছে বলেই স্পর্শ সম্ভব হয়। কাজেই ষড়ায়তন থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের স্পর্শ।
.
(৬) স্পর্শ (sense contact) : স্পর্শ হলো আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাথে তাদের বিষয়ের সংযোগ। যদি বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক না হতো তবে ইন্দ্রিয়ানুভূতি (বেদনা) উদ্ভূত হতো না। সুখ-দুঃখাদির কারণ জ্ঞানের শক্তি উৎপন্ন হবার পূর্ব অবস্থা হচ্ছে স্পর্শ। এই স্পর্শ থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের অনুভূতি বা বেদনা।
(৬) স্পর্শ (sense contact) : স্পর্শ হলো আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর সাথে তাদের বিষয়ের সংযোগ। যদি বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সম্পর্ক না হতো তবে ইন্দ্রিয়ানুভূতি (বেদনা) উদ্ভূত হতো না। সুখ-দুঃখাদির কারণ জ্ঞানের শক্তি উৎপন্ন হবার পূর্ব অবস্থা হচ্ছে স্পর্শ। এই স্পর্শ থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের অনুভূতি বা বেদনা।
.
(৭) বেদনা বা অনুভূতি (sense experience) : আমাদের বেদনা বা অনুভূতির কারণ হলো স্পর্শ। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন অনুভবই বেদনা। বুদ্ধমতে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জীবের সুখাত্মক অনুভূতি হয় (যা জীবের তৃষ্ণাকে মৈথুনের পূর্বে যে-যাবৎ মৈথুনরাগের সমুদাচার না হয় সে-যাবৎ অবস্থা), তাকে ‘বেদনা’ সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই বেদনা থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের তৃষ্ণা বা ভোগ-বাসনা।
(৭) বেদনা বা অনুভূতি (sense experience) : আমাদের বেদনা বা অনুভূতির কারণ হলো স্পর্শ। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন অনুভবই বেদনা। বুদ্ধমতে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা জীবের সুখাত্মক অনুভূতি হয় (যা জীবের তৃষ্ণাকে মৈথুনের পূর্বে যে-যাবৎ মৈথুনরাগের সমুদাচার না হয় সে-যাবৎ অবস্থা), তাকে ‘বেদনা’ সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এই বেদনা থেকেই উদ্ভূত হয় আমাদের তৃষ্ণা বা ভোগ-বাসনা।
.
(৮) তৃষ্ণা বা ভোগবাসনা (craving) : শব্দ, স্পর্শ, রূপ ইত্যাদি বিষয়ের বা ভোগ্যবস্তুকে ভোগ করার বাসনাই হলো তৃষ্ণা। অর্থাৎ তৃষ্ণা হচ্ছে বিষয়লাভের তীব্র ইচ্ছা। তৃষ্ণার কারণে জীব সাংসারিক বিষয়ের পশ্চাতে অন্ধের মতো দৌঁড়ায়। ভোগ ও মৈথুনের কামনাকারী জীবের অবস্থাই হচ্ছে তৃষ্ণা। রূপাদি কামগুণ ও মৈথুনের প্রতি রাগের সমুদাচার তৃষ্ণার অবস্থা। এর অন্ত হয় যখন এই রাগের প্রভাব থেকে জীব ভোগের পর্যেষ্টি আরম্ভ করে। এই তৃষ্ণা থেকেই উদ্ভূত হয় উপাদান বা বিষয়ের প্রতি অনুরাগ।
(৮) তৃষ্ণা বা ভোগবাসনা (craving) : শব্দ, স্পর্শ, রূপ ইত্যাদি বিষয়ের বা ভোগ্যবস্তুকে ভোগ করার বাসনাই হলো তৃষ্ণা। অর্থাৎ তৃষ্ণা হচ্ছে বিষয়লাভের তীব্র ইচ্ছা। তৃষ্ণার কারণে জীব সাংসারিক বিষয়ের পশ্চাতে অন্ধের মতো দৌঁড়ায়। ভোগ ও মৈথুনের কামনাকারী জীবের অবস্থাই হচ্ছে তৃষ্ণা। রূপাদি কামগুণ ও মৈথুনের প্রতি রাগের সমুদাচার তৃষ্ণার অবস্থা। এর অন্ত হয় যখন এই রাগের প্রভাব থেকে জীব ভোগের পর্যেষ্টি আরম্ভ করে। এই তৃষ্ণা থেকেই উদ্ভূত হয় উপাদান বা বিষয়ের প্রতি অনুরাগ।
.
(৯) উপাদান বা বিষয়ানুরাগ (mental clinging) : উপাদান হলো জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তি। যে জীব ভোগের পর্যেষ্টিতে দৌঁড়-ঝাঁপ করে তার সেই অবস্থা হচ্ছে উপাদান। এই উপাদানের কারণ হলো তৃষ্ণা এবং এই উপাদান থেকে উদ্ভূত হয় ভব বা পুনর্বার জন্মগ্রহণের প্রস্তুতি।
(৯) উপাদান বা বিষয়ানুরাগ (mental clinging) : উপাদান হলো জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তি। যে জীব ভোগের পর্যেষ্টিতে দৌঁড়-ঝাঁপ করে তার সেই অবস্থা হচ্ছে উপাদান। এই উপাদানের কারণ হলো তৃষ্ণা এবং এই উপাদান থেকে উদ্ভূত হয় ভব বা পুনর্বার জন্মগ্রহণের প্রস্তুতি।
.
(১০) ভব (tendency to be born) : ভব কথার অর্থ হলো পুনর্বার জন্মগ্রহণের প্রবৃত্তি বা ব্যাকুলতা। মানুষ বা জীবের মধ্যে জন্মগ্রহণের প্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকায় তাকে জন্ম গ্রহণ করতে হয়। এই প্রবৃত্তি জীবকে জন্ম নিতে প্রেরিত করে। উপাদানবশে জীব কর্ম করে, যার ফল হচ্ছে অনাগত ভব। ‘ভব’ হচ্ছে কর্ম যার দরুন জন্ম হয়। এ হচ্ছে কর্মভাব। যে অবস্থায় জীব কর্ম করে তা হচ্ছে ভব। যেহেতু ভব থেকে উদ্ভূত হয় জাতি বা জন্ম, কাজেই পুনর্জন্মের কারণ হলো ভব।
(১০) ভব (tendency to be born) : ভব কথার অর্থ হলো পুনর্বার জন্মগ্রহণের প্রবৃত্তি বা ব্যাকুলতা। মানুষ বা জীবের মধ্যে জন্মগ্রহণের প্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকায় তাকে জন্ম গ্রহণ করতে হয়। এই প্রবৃত্তি জীবকে জন্ম নিতে প্রেরিত করে। উপাদানবশে জীব কর্ম করে, যার ফল হচ্ছে অনাগত ভব। ‘ভব’ হচ্ছে কর্ম যার দরুন জন্ম হয়। এ হচ্ছে কর্মভাব। যে অবস্থায় জীব কর্ম করে তা হচ্ছে ভব। যেহেতু ভব থেকে উদ্ভূত হয় জাতি বা জন্ম, কাজেই পুনর্জন্মের কারণ হলো ভব।
.
(১১) জাতি (rebirth) : জাতি শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম। এ হচ্ছে পুনঃ প্রতিসন্ধি (জন্ম), অর্থাৎ পুনর্জন্ম। মরণান্তর প্রতিসন্ধি কালে পঞ্চস্কন্ধ হচ্ছে জাতি। প্রত্যুৎপন্নভবের আলোচনায় যে অঙ্গকে ‘বিজ্ঞান বা চেতনা’ নাম দেয়া হয় তাকে অনাগত ভবের সমীক্ষায় ‘জাতি’ বলা হয়। (সংশ্লিষ্ট দার্শনিক পরিভাষায় বিষয়টা অনুধাবনে যে জটিল আকার ধারণ করে বাস্তবে তা এতো জটিল নয়; প্রথম আর্যসত্য দ্রষ্টব্য)। সোজা কথায়, জীব যদি জন্মগ্রহণ না করতো বা শরীর ধারণ না করতো তাহলে তাকে জরামরণের অধীন হতে হতো না। কাজেই জীবের জরামরণের কারণ হলো জাতি বা জন্ম।
(১১) জাতি (rebirth) : জাতি শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম। এ হচ্ছে পুনঃ প্রতিসন্ধি (জন্ম), অর্থাৎ পুনর্জন্ম। মরণান্তর প্রতিসন্ধি কালে পঞ্চস্কন্ধ হচ্ছে জাতি। প্রত্যুৎপন্নভবের আলোচনায় যে অঙ্গকে ‘বিজ্ঞান বা চেতনা’ নাম দেয়া হয় তাকে অনাগত ভবের সমীক্ষায় ‘জাতি’ বলা হয়। (সংশ্লিষ্ট দার্শনিক পরিভাষায় বিষয়টা অনুধাবনে যে জটিল আকার ধারণ করে বাস্তবে তা এতো জটিল নয়; প্রথম আর্যসত্য দ্রষ্টব্য)। সোজা কথায়, জীব যদি জন্মগ্রহণ না করতো বা শরীর ধারণ না করতো তাহলে তাকে জরামরণের অধীন হতে হতো না। কাজেই জীবের জরামরণের কারণ হলো জাতি বা জন্ম।
.
(১২) জরামরণ (old age and death) : জরামরণ মানে জরা ও মরণ। আক্ষরিক অর্থে বার্ধক্য ও মৃত্যু। বৌদ্ধদর্শনে ‘জরামরণ’ বলতে রোগ, শোক, নিরাশা ইত্যাদি সাংসারিক সমস্ত দুঃখকেই বুঝানো হয়েছে। জীবের জরামরণ উদ্ভূত হয় তার জাতি বা জন্মের কারণে। তাই জরামরণাদি হলো সকল দুঃখের কারণ।
(১২) জরামরণ (old age and death) : জরামরণ মানে জরা ও মরণ। আক্ষরিক অর্থে বার্ধক্য ও মৃত্যু। বৌদ্ধদর্শনে ‘জরামরণ’ বলতে রোগ, শোক, নিরাশা ইত্যাদি সাংসারিক সমস্ত দুঃখকেই বুঝানো হয়েছে। জীবের জরামরণ উদ্ভূত হয় তার জাতি বা জন্মের কারণে। তাই জরামরণাদি হলো সকল দুঃখের কারণ।
.
এই বারোটি নিদানের মধ্যে প্রথম দুটি পূর্ববর্তী জীবনে, পরের আটটি বর্তমান জীবনে এবং শেষ দুটি ভবিষ্যৎ জীবনে কার্যকরী হয়। এখানে মূল কারণ অবিদ্যা। অবিদ্যার কারণে জীব বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না বলে তৃষ্ণা থেকে মুক্ত হতে পারে না এবং বার বার জন্মচক্রে পতিত হয়ে দুঃখ থেকেও মুক্ত হতে পারে না। এই অবিদ্যা থেকেই অন্য নিদানগুলি আবির্ভূত হয়ে ‘ভবচক্র’ অর্থাৎ অস্তিত্বের বৃত্তকে বারবার আবর্তিত করছে। তাই এই চক্রটির আবর্তনকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে-
.
[ অতীত জীবন বা পূর্বজন্ম ]
> ১.অবিদ্যা > ২.সংস্কার >
[ বর্তমান জীবন বা এ জন্ম ]
> ৩.চেতনা বা বিজ্ঞান > ৪.নামরূপ > ৫.ষড়ায়তন > ৬.স্পর্শ > ৭.বেদনা > ৮.তৃষ্ণা > ৯.উপাদান >
[ ভবিষ্যৎ জীবন বা পরজন্ম ]
> ১০.ভব > ১১.জাতি > ১২.জরামরণ > (১.অবিদ্যা)
.
উপরিউক্ত কারণ শৃঙ্খল থেকে বোঝা যায় যে, কার্যের দিক থেকে যেমন দুঃখ সর্বশেষ উৎপন্ন কার্য, তেমনি কারণের দিক থেকে অবিদ্যা সর্বপ্রথম কারণ।
> ১.অবিদ্যা > ২.সংস্কার >
[ বর্তমান জীবন বা এ জন্ম ]
> ৩.চেতনা বা বিজ্ঞান > ৪.নামরূপ > ৫.ষড়ায়তন > ৬.স্পর্শ > ৭.বেদনা > ৮.তৃষ্ণা > ৯.উপাদান >
[ ভবিষ্যৎ জীবন বা পরজন্ম ]
> ১০.ভব > ১১.জাতি > ১২.জরামরণ > (১.অবিদ্যা)
.
উপরিউক্ত কারণ শৃঙ্খল থেকে বোঝা যায় যে, কার্যের দিক থেকে যেমন দুঃখ সর্বশেষ উৎপন্ন কার্য, তেমনি কারণের দিক থেকে অবিদ্যা সর্বপ্রথম কারণ।
.
.
তৃতীয় আর্যসত্য : দুঃখ নিরোধ বা নির্বাণ (removal of suffering)
গৌতম বুদ্ধের মতে দুঃখ নিরোধ সম্ভব। যেহেতু প্রতিটি কার্যেরই কারণ আছে সেহেতু দুঃখেরও কারণ আছে এবং দুঃখের কারণগুলোকে রোধ করতে পারলেই দুঃখনিরোধ সম্ভব হবে। এই দুঃখনিরোধ অর্থাৎ বিনাশের সাধনকেই বুদ্ধ নির্বাণ বলেছেন, যার পালিরূপ হচ্ছে ‘নিব্বান’।
তৃতীয় আর্যসত্য : দুঃখ নিরোধ বা নির্বাণ (removal of suffering)
গৌতম বুদ্ধের মতে দুঃখ নিরোধ সম্ভব। যেহেতু প্রতিটি কার্যেরই কারণ আছে সেহেতু দুঃখেরও কারণ আছে এবং দুঃখের কারণগুলোকে রোধ করতে পারলেই দুঃখনিরোধ সম্ভব হবে। এই দুঃখনিরোধ অর্থাৎ বিনাশের সাধনকেই বুদ্ধ নির্বাণ বলেছেন, যার পালিরূপ হচ্ছে ‘নিব্বান’।
.
দুঃখের নিরোধ অর্থাৎ নাশই হচ্ছে নিরোধসত্য। বিনাশ ভেদে নিরোধ দুই প্রকার। প্রতিসংখ্যা অর্থাৎ বুদ্ধিপূর্বক বিনাশ এবং অপ্রতিসংখ্যা অর্থাৎ অবুদ্ধিপূর্বক বিনাশ। নির্বাণলক্ষণ নিরোধসত্য প্রতিসংখ্যানিরোধ কোটির (পর্যায়ের) অন্তর্গত। অতএব নির্বাণই দুঃখের নিরোধ এবং তা নিরোধসত্য।
দুঃখের কারণ যে তৃষ্ণা তাকে দৃঢ়ভাবে সংযত করে, ক্রমশ পরিত্যাগ করে বিনাশ করাকেই দুঃখবিনাশ বলে। প্রিয় বিষয় এবং সেই বিষয়ে তত্ত্ব-নির্ণয়ে সংশয় থেকে যখন তৃষ্ণা বিমুখ হয় তখনই তৃষ্ণার নিরোধ সম্ভব। তৃষ্ণানাশ হলেই উপাদানের (বিষয় সংগ্রহের) প্রবণতা নষ্ট হয়। উপাদানের নিরোধে ভবলোকের অর্থাৎ পুনর্জন্মগ্রহণ প্রবণতার নিরোধ হয় এবং তা থেকেই পুনর্জন্মের বিনাশ। জন্মের নিরোধ থেকেই বার্ধক্য, মৃত্যু, শোক, ক্রন্দন, দুঃখ, মানসিক কেশ এবং ঝঞ্ঝাট ও জটিলতা দূর হয়। এভাবেই হয় দুঃখের নিরোধ। এই দুঃখ নিরোধই বুদ্ধের সমুদয় দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু।
.
বুদ্ধের মতে নির্বাণের দ্বারা পুনর্জন্ম রুদ্ধ হয় এবং তার সাথে সাথে দুঃখ হতে মুক্তি লাভ হয়। নির্বাণের অবস্থা পূর্ণ শান্তি, স্থিরতা এবং তৃষ্ণাবিহীনতা। নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অর্হৎ বলা হয়।
.
নির্বাণের স্বরূপ :
আক্ষরিক অর্থে ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিভে যাওয়া’। তৃণ বা কাষ্ঠখণ্ড পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে আগুন যেমন নিভে যায় তেমনি জীব কামনা-বাসনার চিরবিলুপ্তিতে বা নিঃশেষে নির্বাণ লাভ করে। এ কারণে কেউ কেউ নির্বাণকে ‘শূন্যতা’ বলে অভিহিত করেন।
.
ভারতীয় অন্যান্য দর্শনে এই নির্বাণকে বলা হয় মোক্ষ (যদিও এর প্রকৃতি ভিন্ন)। তবে নির্বাণের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ তো আছেই, এমনকি নির্বাণের যথার্থ স্বরূপ নিয়ে বুদ্ধের অনুগামীদের মধ্যেও মতান্তর লক্ষ্য করা যায়। কয়েকটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই এসব মতান্তরের উদ্ভব। নির্বাণের স্বরূপ অনুধাবনের জন্য এই প্রশ্নগুলির কিঞ্চিৎ আলোকপাত প্রয়োজন রয়েছে। যেমন-
.
প্রথমত, প্রশ্ন হলো, নির্বাণ কি একটি শাশ্বত আনন্দপূর্ণ শান্ত অবস্থা ? যাঁরা নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা কি এক শাশ্বত দিব্য আনন্দের অধিকারী ? যেমন, ধম্মপদে বলা হয়েছে-
নির্বাণের স্বরূপ :
আক্ষরিক অর্থে ‘নির্বাণ’ শব্দের অর্থ হলো ‘নিভে যাওয়া’। তৃণ বা কাষ্ঠখণ্ড পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে আগুন যেমন নিভে যায় তেমনি জীব কামনা-বাসনার চিরবিলুপ্তিতে বা নিঃশেষে নির্বাণ লাভ করে। এ কারণে কেউ কেউ নির্বাণকে ‘শূন্যতা’ বলে অভিহিত করেন।
.
ভারতীয় অন্যান্য দর্শনে এই নির্বাণকে বলা হয় মোক্ষ (যদিও এর প্রকৃতি ভিন্ন)। তবে নির্বাণের প্রকৃত স্বরূপ নিয়ে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ তো আছেই, এমনকি নির্বাণের যথার্থ স্বরূপ নিয়ে বুদ্ধের অনুগামীদের মধ্যেও মতান্তর লক্ষ্য করা যায়। কয়েকটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই এসব মতান্তরের উদ্ভব। নির্বাণের স্বরূপ অনুধাবনের জন্য এই প্রশ্নগুলির কিঞ্চিৎ আলোকপাত প্রয়োজন রয়েছে। যেমন-
.
প্রথমত, প্রশ্ন হলো, নির্বাণ কি একটি শাশ্বত আনন্দপূর্ণ শান্ত অবস্থা ? যাঁরা নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা কি এক শাশ্বত দিব্য আনন্দের অধিকারী ? যেমন, ধম্মপদে বলা হয়েছে-
‘আরোগ্য পরমালাভা সন্তুটঠি পরমং ধনং।
বিস্সাস পরমাঞাতি নিব্বানং পরমং সুখং।।’ (ধম্মপদ-২০৩/সুখবর্গ-৮)
অর্থাৎ : আরোগ্য শ্রেষ্ঠ লাভ, সন্তোষ পরম ধন, বিশ্বস্ত মিত্র পরমাত্মীয়, নির্বাণই পরম সুখ।
.
কিন্তু নির্বাণকে সেভাবে বর্ণনা করা যায় না। সুখ, ভোগের ব্যাপার। কামনা-বাসনাশূন্য অবস্থায় ভোগের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। সংযুক্তনিকায়ের ‘মিলিন্দ প্রশ্নে’ বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেন মিলিন্দকে নির্বাণের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, কোন উপমা দিয়েই নির্বাণকে বোঝানো যায় না।
.
দ্বিতীয়ত, তাই প্রশ্ন উঠে, নির্বাণ কি এক অবর্ণনীয় অবস্থা ? নির্বাণ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির অবস্থা ঠিকই, কিন্তু এই অবস্থাটিকে ভাবাত্মক বা অভাবাত্মক কোন কিছুই কি বলা যায় না ?
তাঁদের মতে, নির্বাণের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে পর্বত, সমুদ্র প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভাবাত্মক কোন উপমাই নির্বাণকে বর্ণনা করার পক্ষে পর্যন্ত নয়। বরং অভাবাত্মক বর্ণনার মাধ্যমেই নির্বাণকে বোঝা সহজ হতে পারে। নির্বাণ জরা-মরণাদির অভাবরূপ এক স্বস্তির অবস্থা। এই অবস্থা সকলপ্রকার অনিত্য জাগতিক অবস্থা থেকে বিলক্ষণ।
.
তৃতীয়ত, তৃতীয় যে প্রশ্নটি আসে, নির্বাণ কি এক কর্মশূন্য বা কর্মহীন অপরিবর্তনীয় অবস্থা ? তাঁদের মতে, এই অবস্থার সৃষ্টি কখনো হয়নি। এটি হলো অজ্ঞাত ও অদ্ভুত অবস্থা। শুধু তাই নয়, নির্বাণ বিভিন্ন অবস্থার সমষ্টিও নয়। এটি হলো অসংস্কৃত। অর্থাৎ নির্বাণ হলো একটি চিরন্তন অবস্থা যার কোন পরিবর্তন নেই।
.
চতুর্থত, কারো কারো মতে নির্বাণ হলো অস্তিত্বের পূর্ণ বিলুপ্তি। এরা নির্বাণ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে তাকিয়ে নির্বাণকে সত্তার আত্যন্তিক বিনাশরূপে ব্যাখ্যা করেন। ‘নির্বাণ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘নিভে যাওয়া’ বা ‘শীতল হওয়া’। তার অর্থ হলো ধ্বংস হওয়া। এজন্য এই অবস্থাকে শূন্যতার স্বর্গ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে।
কিন্তু নির্বাণকে সেভাবে বর্ণনা করা যায় না। সুখ, ভোগের ব্যাপার। কামনা-বাসনাশূন্য অবস্থায় ভোগের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। সংযুক্তনিকায়ের ‘মিলিন্দ প্রশ্নে’ বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেন মিলিন্দকে নির্বাণের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, কোন উপমা দিয়েই নির্বাণকে বোঝানো যায় না।
.
দ্বিতীয়ত, তাই প্রশ্ন উঠে, নির্বাণ কি এক অবর্ণনীয় অবস্থা ? নির্বাণ দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তির অবস্থা ঠিকই, কিন্তু এই অবস্থাটিকে ভাবাত্মক বা অভাবাত্মক কোন কিছুই কি বলা যায় না ?
তাঁদের মতে, নির্বাণের স্বরূপ বোঝাতে গিয়ে পর্বত, সমুদ্র প্রভৃতি উপমা ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ভাবাত্মক কোন উপমাই নির্বাণকে বর্ণনা করার পক্ষে পর্যন্ত নয়। বরং অভাবাত্মক বর্ণনার মাধ্যমেই নির্বাণকে বোঝা সহজ হতে পারে। নির্বাণ জরা-মরণাদির অভাবরূপ এক স্বস্তির অবস্থা। এই অবস্থা সকলপ্রকার অনিত্য জাগতিক অবস্থা থেকে বিলক্ষণ।
.
তৃতীয়ত, তৃতীয় যে প্রশ্নটি আসে, নির্বাণ কি এক কর্মশূন্য বা কর্মহীন অপরিবর্তনীয় অবস্থা ? তাঁদের মতে, এই অবস্থার সৃষ্টি কখনো হয়নি। এটি হলো অজ্ঞাত ও অদ্ভুত অবস্থা। শুধু তাই নয়, নির্বাণ বিভিন্ন অবস্থার সমষ্টিও নয়। এটি হলো অসংস্কৃত। অর্থাৎ নির্বাণ হলো একটি চিরন্তন অবস্থা যার কোন পরিবর্তন নেই।
.
চতুর্থত, কারো কারো মতে নির্বাণ হলো অস্তিত্বের পূর্ণ বিলুপ্তি। এরা নির্বাণ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের দিকে তাকিয়ে নির্বাণকে সত্তার আত্যন্তিক বিনাশরূপে ব্যাখ্যা করেন। ‘নির্বাণ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে ‘নিভে যাওয়া’ বা ‘শীতল হওয়া’। তার অর্থ হলো ধ্বংস হওয়া। এজন্য এই অবস্থাকে শূন্যতার স্বর্গ বলেও বর্ণনা করা হয়েছে।
.
পঞ্চমত, নির্বাণের উক্ত নঞর্থক অর্থ অনেকেই স্বীকার করেন না। তাই তাঁদের মতে নির্বাণ অস্তিত্বের পূর্ণ বিলুপ্তি নয়। নির্বাণের প্রকৃত অর্থ বাসনার বিলোপ। নির্বাণ হলো কামনা, বাসনা, লোভ ও মোহের পাবক নির্বাপিত হওয়া। যাঁরা ভোগতৃষ্ণা দমন করে জ্ঞানী হয়েছেনে, তাঁরাই এ জীবনে নির্বাণ লাভ করেছেন।
পঞ্চমত, নির্বাণের উক্ত নঞর্থক অর্থ অনেকেই স্বীকার করেন না। তাই তাঁদের মতে নির্বাণ অস্তিত্বের পূর্ণ বিলুপ্তি নয়। নির্বাণের প্রকৃত অর্থ বাসনার বিলোপ। নির্বাণ হলো কামনা, বাসনা, লোভ ও মোহের পাবক নির্বাপিত হওয়া। যাঁরা ভোগতৃষ্ণা দমন করে জ্ঞানী হয়েছেনে, তাঁরাই এ জীবনে নির্বাণ লাভ করেছেন।
.
মূলত এই শেষোক্ত মতবাদটিই বুদ্ধমতের প্রচারিত বাণীর সাথে সমতা রক্ষা করে। বিলুপ্তি বুদ্ধের শিক্ষার প্রেরণা হতে পারে না। কেননা ‘নির্বাণ’ কথার অর্থ যদি অস্তিত্বের পূর্ণ বিলুপ্তি হয় তাহলে একথা স্বীকার করতে হয় যে গৌতম বুদ্ধ মৃত্যুর পূর্বে নির্বাণ লাভ করেননি। কাজেই নির্বাণের অর্থ নিষ্ক্রিয় অবস্থা নয়। তথাগত বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করার পর মানবজাতির মঙ্গলের জন্য সক্রিয় প্রচারকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ভগবান বুদ্ধ ৩৫ বৎসর বয়সে নির্বাণলাভ করেন এবং নির্বাণলাভের পর দীর্ঘদিত জীবিত থেকে ৮১ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। বুদ্ধের জীবন-ইতিহাস থেকে একথাই প্রতিফলিত হয় যে নির্বাণ হলো ‘জীবন্মুক্তি’। অর্থাৎ এ পৃথিবীতে এই জীবনেই নির্বাণ লাভ করা যায়। তবে একথা আংশিকভাবে সত্য। নির্বাণ যেমন ‘জীবনমুক্তি’ তেমনি আবার ‘বিদেহমুক্তি’। বৌদ্ধমতে নির্বাণ কখনোই সত্তার বিলোপ নয়। নির্বাণ হলো কামনার বিলোপ বা চিরবিলোপ। কামনা-বাসনাই জীবকে বন্ধনযুক্ত করে। কামনা-বাসনার চিরবিলুপ্তি ঘটলেই জীব মুক্ত হয়। মুক্তাবস্থায় জীবের দেহ থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। দেহ থাকলেও এই অবস্থায় সেই দেহ জীবের দুঃখের কারণ হয় না। দেহের শোক-দুঃখ, কামনা-বাসনা কোনটিই এই অবস্থায় জীবকে স্পর্শ করে না।
নির্বাণ হলো মনের একপ্রকার অভ্যাস। বস্তুত নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তি সকাম কর্ম করেন না। তাঁর তৃষ্ণা, কামনা-বাসনা ক্ষয় হওয়ায় তাঁর কর্ম হয় নিষ্কাম কর্ম। এ কারণে তাঁকে কর্মফল ভোগ করতে হয় না। ফলে নির্বাণ হলে পুনর্জন্ম হয় না। তাছাড়া নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির এই জীবনেই এক পরম শান্তির অনুভব হয় যা জাগতিক কামনা-বাসনার পরিতৃপ্তিজনিত সুখের মতো কখনোই নয়। এ কারণে সাধারণ অভিজ্ঞতার সাহায্যে নির্বাণকে বর্ণনা করা কখনোই সম্ভব নয় বলে মনে করা হয়।
.
.
চতুর্থ আর্যসত্য : দুঃখনিরোধ মার্গ বা পথ (The Way of the Removal of Suffering)
নির্বাণের দিকে নিয়ে যায় এ অর্থে দুঃখনিরোধের উপায়কে মার্গসত্য বলে। যে কারণের জন্য দুঃখ উৎপন্ন হয় সেই কারণের নাশ করার উপায় বা সাধনাই এই নির্বাণের মার্গ। অবিদ্যা যে জীবের যাবতীয় দুঃখভোগের মূল ও প্রধান কারণ তা চার্বাক ব্যতীত বাকি সব দার্শনিক প্রস্থানেরই সাধারণ স্বীকৃত সত্য। কিন্তু অবিদ্যা কিভাবে দূর হতে পারে সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্থান বিভিন্ন পথ নির্দেশ করেছেন। বুদ্ধ নির্দেশিত দুঃখ-নিরোধমার্গ কিন্তু জ্ঞানকে নির্বাণলাভের একমাত্র অবলম্বন বলে বর্ণনা করেনি। এই মার্গের মধ্যে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সূক্ষ্ম জীবনবোধ অতি সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে উপেক্ষা না করে সাধারণ মানুষ কিভাবে জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে নির্বাণের পথে অগ্রসর হতে পারে চতুর্থ আর্যসত্যে তার একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশিত হয়েছে। বুদ্ধের নির্দেশিত দুঃখ-নিরোধমার্গ অষ্ট অঙ্গ বিশিষ্ট।
নির্বাণের দিকে নিয়ে যায় এ অর্থে দুঃখনিরোধের উপায়কে মার্গসত্য বলে। যে কারণের জন্য দুঃখ উৎপন্ন হয় সেই কারণের নাশ করার উপায় বা সাধনাই এই নির্বাণের মার্গ। অবিদ্যা যে জীবের যাবতীয় দুঃখভোগের মূল ও প্রধান কারণ তা চার্বাক ব্যতীত বাকি সব দার্শনিক প্রস্থানেরই সাধারণ স্বীকৃত সত্য। কিন্তু অবিদ্যা কিভাবে দূর হতে পারে সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রস্থান বিভিন্ন পথ নির্দেশ করেছেন। বুদ্ধ নির্দেশিত দুঃখ-নিরোধমার্গ কিন্তু জ্ঞানকে নির্বাণলাভের একমাত্র অবলম্বন বলে বর্ণনা করেনি। এই মার্গের মধ্যে ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সূক্ষ্ম জীবনবোধ অতি সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে উপেক্ষা না করে সাধারণ মানুষ কিভাবে জ্ঞান ও কর্মের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে নির্বাণের পথে অগ্রসর হতে পারে চতুর্থ আর্যসত্যে তার একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশিত হয়েছে। বুদ্ধের নির্দেশিত দুঃখ-নিরোধমার্গ অষ্ট অঙ্গ বিশিষ্ট।
বুদ্ধের মতে ভোগবিলাসে জীবন যাপন করা অনুচিত ও দুঃখময়। তেমনি ব্রত উপবাস প্রভৃতির দ্বারা শরীরকে উৎপীড়ন করারও প্রয়োজন নেই। তিনি পুরোপুরি মধ্যম মার্গের সমর্থক। এই মধ্যম মার্গের আটটি অঙ্গ বা উপদেশ রয়েছে বলে তা ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ নামে প্রসিদ্ধ। এই অষ্ট অঙ্গ হলো- সম্যক্ দৃষ্টি, সম্যক্ সংকল্প, সম্যক্ বচন, সম্যক্ কর্মান্ত, সম্যক্ আজীব, সম্যক্ ব্যায়াম, সম্যক্ স্মৃতি ও সম্যক্ সমাধি।
বুদ্ধমতে এই অষ্টাঙ্গিক মার্গই আর্য বা শ্রেষ্ঠ। অষ্টাঙ্গিক মার্গের এই আটটি উপদেশকে জ্ঞান (প্রজ্ঞা), সদাচার (শীল) এবং যোগ (সমাধি) এই তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে।
.
‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ (Eightfold Noble Path)
.
(ক) সম্যক জ্ঞান বা প্রজ্ঞা (knowledge) :
(১) প্রথম অঙ্গ : সম্যক দৃষ্টি (Right Views) : ‘সম্যক্’ শব্দের অর্থ যথার্থ এবং ‘দৃষ্টি’ শব্দের অর্থ এখানে জ্ঞান। সুতরাং যথার্থ জ্ঞানই হলো সম্যক দৃষ্টি। আর্যসত্য সম্মন্ধে অর্থাৎ দুঃখ, দুঃখের হেতু এবং তার নিরোধ মার্গের যথার্থ জ্ঞান ও উপলব্ধিকে সম্যক দৃষ্টি বলা হয়েছে। অবিদ্যা যেমন ভবচক্রের মূল কারণ, সম্যক দৃষ্টিও তেমনি মুক্তিলাভের প্রধান কারণ।
বুদ্ধ দুঃখের মূল কারণকে অবিদ্যা বলেছেন। অবিদ্যার দরুন মিথ্যাদৃষ্টি (wrong views) উদ্ভূত হয়। মিথ্যাদৃষ্টির প্রাবল্যের কারণে অবাস্তবিক বস্তুকে বাস্তবিক ভাবা হয়। যেমন যা আত্মা নয় তাকে আত্মা ভাবা। মিথ্যাদৃষ্টির প্রভাবে মানুষ নশ্বর বিশ্বকে অবিনাশী এবং দুঃখময় অনুভূতিকে সুখময় ভাবে। মিথ্যাদৃষ্টির নাশ সম্যগ্দৃষ্টিতে সম্ভব। সেকারণে বুদ্ধ সম্যক দৃষ্টিকে অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথম সোপান বলেছেন। সম্যক দৃষ্টি হচ্ছে বস্তুর যথার্থ স্বরূপকে জানা। সম্যক দৃষ্টি হচ্ছে চারটি আর্যসত্যের যথার্থ জ্ঞান, যা মানুষকে নির্বাণের দিকে নিয়ে যায়। আত্মা ও বিশ্ব সম্মন্ধীয় দার্শনিক বিচার মানবকে নির্বাণপ্রাপ্তিতে বাধা দেয়। অতএব দার্শনিক বিচারের চিন্তা না করে নির্বাণহেতু চারটি আর্যসত্যের মনন হচ্ছে অত্যন্ত আবশ্যক।
(১) প্রথম অঙ্গ : সম্যক দৃষ্টি (Right Views) : ‘সম্যক্’ শব্দের অর্থ যথার্থ এবং ‘দৃষ্টি’ শব্দের অর্থ এখানে জ্ঞান। সুতরাং যথার্থ জ্ঞানই হলো সম্যক দৃষ্টি। আর্যসত্য সম্মন্ধে অর্থাৎ দুঃখ, দুঃখের হেতু এবং তার নিরোধ মার্গের যথার্থ জ্ঞান ও উপলব্ধিকে সম্যক দৃষ্টি বলা হয়েছে। অবিদ্যা যেমন ভবচক্রের মূল কারণ, সম্যক দৃষ্টিও তেমনি মুক্তিলাভের প্রধান কারণ।
বুদ্ধ দুঃখের মূল কারণকে অবিদ্যা বলেছেন। অবিদ্যার দরুন মিথ্যাদৃষ্টি (wrong views) উদ্ভূত হয়। মিথ্যাদৃষ্টির প্রাবল্যের কারণে অবাস্তবিক বস্তুকে বাস্তবিক ভাবা হয়। যেমন যা আত্মা নয় তাকে আত্মা ভাবা। মিথ্যাদৃষ্টির প্রভাবে মানুষ নশ্বর বিশ্বকে অবিনাশী এবং দুঃখময় অনুভূতিকে সুখময় ভাবে। মিথ্যাদৃষ্টির নাশ সম্যগ্দৃষ্টিতে সম্ভব। সেকারণে বুদ্ধ সম্যক দৃষ্টিকে অষ্টাঙ্গিক মার্গের প্রথম সোপান বলেছেন। সম্যক দৃষ্টি হচ্ছে বস্তুর যথার্থ স্বরূপকে জানা। সম্যক দৃষ্টি হচ্ছে চারটি আর্যসত্যের যথার্থ জ্ঞান, যা মানুষকে নির্বাণের দিকে নিয়ে যায়। আত্মা ও বিশ্ব সম্মন্ধীয় দার্শনিক বিচার মানবকে নির্বাণপ্রাপ্তিতে বাধা দেয়। অতএব দার্শনিক বিচারের চিন্তা না করে নির্বাণহেতু চারটি আর্যসত্যের মনন হচ্ছে অত্যন্ত আবশ্যক।
.
(২) দ্বিতীয় অঙ্গ : সম্যক সংকল্প (Right Resolve) : সম্যক্ দষ্টি বা জ্ঞানের দ্বারা উদ্ভূত হয় সম্যক্ সংকল্প। সংকল্প হলো মানসিক স্থিরতা, দৃঢ়তা ও নিশ্চয়তা। মুক্তিলাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প থাকা প্রয়োজন। সম্যক দৃষ্টি সর্বপ্রথম সংকল্পে রূপান্তরিত হয়। বুদ্ধের চারটি আর্যসত্যের নিজ জীবনে পালন করার দৃঢ় নিশ্চয়কে সম্যক সংকল্প বলে। আর্যসত্যের জ্ঞানে মানুষ নিজেকে সার্থক করতে পারে যদি সে অনুসারে জীবনযাপন করে। তাই নির্বাণের আদর্শকে ধারণ করতে সাধককে ঐন্দ্রিয় বিষয় থেকে দূরে থাকতে হয়, অন্যের প্রতি দ্বেষ ও হিংসার বিচারকে ত্যাগ করতে দৃঢ় সংকল্প হতে হয়। মোট কথা যা অশুভ তা না করার সংকল্প হচ্ছে সম্যক সংকল্প। এতে ত্যাগ ও পরোপকারের ভাবনা নিহিত থাকে। এই বৃত্তিগুলোর অনুশীলন করতে করতে ভোগতৃষ্ণা দূর হয় এবং মুক্তিলাভের সংকল্প দৃঢ় হয়।
.
(খ) সম্যক আচার বা শীল (conduct) :
(৩) তৃতীয় অঙ্গ : সম্যক বচন (Right Speech) : এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে সত্য বলা, মিথ্যা পরিত্যাগ এবং বাকসংযম। বৌদ্ধদর্শনে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সম্যক সংকল্পের বাহ্য রূপ হচ্ছে সম্যক বাক বা সম্যক বচন। কেননা দ্বেষ, হিংসা প্রভৃতি কু-প্রবৃত্তি থেকেই মিথ্যাভাষণ ও কপটতার সৃষ্টি হয়। নির্বাণলাভ করতে হলে মিথ্যা ও কটুভাষণ বর্জন করতে হবে। সত্য, হিতকর ও প্রীতিপ্রদ কথা বলতে হবে। কেবল সত্যভাষণই দুঃখ, দুঃখহেতু, দুঃখনিরোধ এবং দুঃখনিরোধের মার্গ সম্যক বচনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। যে বাক্যে অন্যের কষ্ট হয় সেরূপ পৌরুষ বা কটু বাক্যের পরিত্যাগও বাঞ্ছনীয়।
(৩) তৃতীয় অঙ্গ : সম্যক বচন (Right Speech) : এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে সত্য বলা, মিথ্যা পরিত্যাগ এবং বাকসংযম। বৌদ্ধদর্শনে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সম্যক সংকল্পের বাহ্য রূপ হচ্ছে সম্যক বাক বা সম্যক বচন। কেননা দ্বেষ, হিংসা প্রভৃতি কু-প্রবৃত্তি থেকেই মিথ্যাভাষণ ও কপটতার সৃষ্টি হয়। নির্বাণলাভ করতে হলে মিথ্যা ও কটুভাষণ বর্জন করতে হবে। সত্য, হিতকর ও প্রীতিপ্রদ কথা বলতে হবে। কেবল সত্যভাষণই দুঃখ, দুঃখহেতু, দুঃখনিরোধ এবং দুঃখনিরোধের মার্গ সম্যক বচনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। যে বাক্যে অন্যের কষ্ট হয় সেরূপ পৌরুষ বা কটু বাক্যের পরিত্যাগও বাঞ্ছনীয়।
.
(৪) চতুর্থ অঙ্গ : সম্যক কর্মান্ত (Right Actions) : পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফল বা সংস্কার এ জন্মে ভোগ করতেই হবে, এর ব্যতিক্রম কখনোই সম্ভব নয়। এ জন্মেও যদি তৃষ্ণা বা আসক্তিবাহিত ফলভোগের আকাঙ্ক্ষা থাকে তবে পরের জন্মে আবার দুঃখ ভোগ করতে হবে। এজন্যে দুঃখের সংসারে পুনর্বার জন্ম না-নিতে হলে লোভ, মোহ, বাসনা প্রভৃতি পরিত্যাগ করে কর্মান্ত পালন করতে হবে। সম্যক কর্মান্তের অর্থ খারাপ কর্মের পরিহার। হিংসা, দ্রোহ ও দুরাচার হতে রহিত কর্ম হচ্ছে সম্যক কর্ম।
বুদ্ধের মতে ত্রিতয় বা খারাপ কর্ম তিন প্রকার- হিংসা, স্তেয় (অন্যের সম্পদ অপহরণ) ও ইন্দ্রিয়ভোগ। তাঁর মতে এগুলো হচ্ছে সম্যক কর্মের প্রতিকূল। অতএব অহিংসা (প্রাণীহিংসা না করা), অস্তেয় (অন্যের সম্পদ অপহরণ না-করা) এবং ইন্দ্রিয়সংযম (ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ) হলো সম্যক কর্মান্তের তাৎপর্য।
বুদ্ধের মতে ত্রিতয় বা খারাপ কর্ম তিন প্রকার- হিংসা, স্তেয় (অন্যের সম্পদ অপহরণ) ও ইন্দ্রিয়ভোগ। তাঁর মতে এগুলো হচ্ছে সম্যক কর্মের প্রতিকূল। অতএব অহিংসা (প্রাণীহিংসা না করা), অস্তেয় (অন্যের সম্পদ অপহরণ না-করা) এবং ইন্দ্রিয়সংযম (ইন্দ্রিয়সুখ পরিত্যাগ) হলো সম্যক কর্মান্তের তাৎপর্য।
.
বুদ্ধ গৃহস্থ উপাসক, ভিক্ষু প্রভৃতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর্মের আদেশ দিয়েছেন। নির্বাণ প্রাপ্তি অত্যন্ত দুষ্কর। গৃহস্থের জন্য তা সম্ভব নয়। উপাসকের জন্য ত্রিশরণ গমনের বিধি রয়েছে। যে গৃহস্থ উপাসক হতে চায় তাকে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের শরণ নিতে হয়। বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি- এরা ত্রিরত্ন নামে প্রসিদ্ধ। বুদ্ধের শরণে বা আশ্রয়ে যাওয়ার অর্থ বুদ্ধকারক ধর্মের শরণে যাওয়া।
উপাসক যারা স্বর্গোপপত্তি চায় তাদের জন্য বুদ্ধ পাঁচটি বিরতি এবং ভিক্ষুদের জন্য দশটি বিরতির নির্দেশ করেছেন। এগুলোকে পঞ্চশীল ও দশশীল বলা হয়। এই শীলগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- (১) প্রাণাতিপাতের বিরতি, (২) অদত্তাদানের বিরতি, (৩) অব্রহ্মচর্য বা কর্মে মিথ্যাচারের বিরতি, (৪) মৃষাবদের বিরতি, (৫) সুরা মৈরেয় (মৈথুন) প্রমাদ স্থানের বিরতি, (৬) অকালভোজন বিরতি, (৭) নৃত্যগীতবাদিত্র বিরতি, (৮) মাল্যগন্ধবিলেপন বিরতি, (৯) উচ্চাসনশয়ন বিরতি ও (১০) জাতরূপ রজত প্রতিগ্রহ থেকে বিরতি । প্রথম পাঁচটি পঞ্চশীল এবং সবগুলো মিলে দশশীল।
উপাসক যারা স্বর্গোপপত্তি চায় তাদের জন্য বুদ্ধ পাঁচটি বিরতি এবং ভিক্ষুদের জন্য দশটি বিরতির নির্দেশ করেছেন। এগুলোকে পঞ্চশীল ও দশশীল বলা হয়। এই শীলগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- (১) প্রাণাতিপাতের বিরতি, (২) অদত্তাদানের বিরতি, (৩) অব্রহ্মচর্য বা কর্মে মিথ্যাচারের বিরতি, (৪) মৃষাবদের বিরতি, (৫) সুরা মৈরেয় (মৈথুন) প্রমাদ স্থানের বিরতি, (৬) অকালভোজন বিরতি, (৭) নৃত্যগীতবাদিত্র বিরতি, (৮) মাল্যগন্ধবিলেপন বিরতি, (৯) উচ্চাসনশয়ন বিরতি ও (১০) জাতরূপ রজত প্রতিগ্রহ থেকে বিরতি । প্রথম পাঁচটি পঞ্চশীল এবং সবগুলো মিলে দশশীল।
.
উপাসকের কাজ হচ্ছে ধর্ম শোনা, উপবাস ব্রত পালন করা, ভিক্ষুকে দান দেয়া। উপাসককে ভদ্রকশীল ও ভদ্রকদৃষ্টিতে সমন্বাগত হতে হয়। তাকে মানসিক, কায়িক ও বাচিক কুচরিত হতে দূরে থাকতে হয়। সুচরিত পালন করতে হয়। এভাবে সে অপায়গতি হতে রেহাই পায় এবং স্বর্গে উৎপন্ন হয়।
.
(৫) পঞ্চম অঙ্গ : সম্যক আজীব (Right Living) : ব্যবহারিক জীবনযাপন যে বুদ্ধ কখনোই অস্বীকার করেননি, সম্যক্ আজীবই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সম্যক আজীবের অর্থ ন্যায়পূর্ণ জীবিকা উপার্জন। ধম্মপদের অপ্রমাদ বর্গে বলা হয়েছে-
‘উট্ঠানবতো সতিমতো সূচিকম্মস্স নিসকম্মকারিনো,
সঞ্ঞস্স চ ধম্মজীবিনো অপ্পমত্তস্স যসোভিবড্ঢতি।’ (অপ্রমাদ বর্গ, ধম্মপদ-২৪)
অর্থাৎ : যিনি উদ্যমশীল, স্মৃতিমান, পবিত্রকর্মা, বিচার প্রসূত কার্য করেন, সংযত এবং ধর্মতঃ জীবিকা নির্বাহ করেন, সে অপ্রমত্ত ব্যক্তির যশ বৃদ্ধিলাভ করে।
.
পঞ্চশীলকে অনুসরণ করে ভোগবাসনা শূন্য হয়ে সৎপথে সৎকর্মের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনকে বলা হয়েছে সম্যক আজীব। গৃহী এবং সন্ন্যাসীভেদে সম্যক আজীব ভিন্ন। গৃহী ব্যক্তি তার সামর্থ ও স্বভাব অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু একমাত্র সন্ন্যাস গ্রহণের পরই নির্বাণ প্রাপ্তি হয়। পরের প্রতি দ্রোহবর্জিত জীবিকাই হচ্ছে সম্যক আজীব। তৎকালীন শাসক-শোষক সমাজোনুমোদিত সকল প্রকার জীবিকার মধ্যে প্রাণী-হিংসা-যুক্ত কয়েকটি জীবিকাকে বুদ্ধ মিথ্যা জীবিকা বলে উল্লেখ করেছেন- অস্ত্র ব্যবসা, প্রাণী ব্যবসা, মাংস বিক্রয়, মদ্য ও বিষের বাণিজ্য।
অনেকে মনে করেন, সম্যক আজীবে সম্যক কর্মান্তের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধ সম্যক আজীবকে পৃথক সোপান বলেছেন এজন্যে যে, মানুষ সম্যক কর্মান্তের পালন করেও কখনো কখনো জীবন নির্বাহের জন্য অনুচিত পথ আশ্রয় করে। অতএব সম্যক কর্মান্ত যাতে সার্থক হয় সেকারণে সম্যক আজীব পালন অপরিহার্য।
পঞ্চশীলকে অনুসরণ করে ভোগবাসনা শূন্য হয়ে সৎপথে সৎকর্মের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনকে বলা হয়েছে সম্যক আজীব। গৃহী এবং সন্ন্যাসীভেদে সম্যক আজীব ভিন্ন। গৃহী ব্যক্তি তার সামর্থ ও স্বভাব অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু একমাত্র সন্ন্যাস গ্রহণের পরই নির্বাণ প্রাপ্তি হয়। পরের প্রতি দ্রোহবর্জিত জীবিকাই হচ্ছে সম্যক আজীব। তৎকালীন শাসক-শোষক সমাজোনুমোদিত সকল প্রকার জীবিকার মধ্যে প্রাণী-হিংসা-যুক্ত কয়েকটি জীবিকাকে বুদ্ধ মিথ্যা জীবিকা বলে উল্লেখ করেছেন- অস্ত্র ব্যবসা, প্রাণী ব্যবসা, মাংস বিক্রয়, মদ্য ও বিষের বাণিজ্য।
অনেকে মনে করেন, সম্যক আজীবে সম্যক কর্মান্তের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধ সম্যক আজীবকে পৃথক সোপান বলেছেন এজন্যে যে, মানুষ সম্যক কর্মান্তের পালন করেও কখনো কখনো জীবন নির্বাহের জন্য অনুচিত পথ আশ্রয় করে। অতএব সম্যক কর্মান্ত যাতে সার্থক হয় সেকারণে সম্যক আজীব পালন অপরিহার্য।
.
(গ) সম্যক যোগ বা সমাধি (tranquility) :
(৬) ষষ্ঠ অঙ্গ : সম্যক ব্যায়াম (Right Efforts) : ‘ব্যায়াম’ শব্দের অর্থ চেষ্টা, শ্রম বা অনুশীলন। শারীরিক ব্যায়ামের দ্বারা শরীর যেমন সুস্থ থাকে, মানসিক ব্যায়ামে তেমনি মন বা চিন্তা সুস্থ থাকে। উপরিউক্ত পাঁচটি মার্গ পালন করলেও সাধক নির্বাণ লাভে সমর্থ হয় না। কেননা মানুষের মনে পুরাতন খারাপ বিচার ঘর বেধে আছে এবং নতুন খারাপ বিচার নিরন্তর মনে প্রবাহিত হতে থাকে। সেকারণে পুরাতন খারাপ বিচারকে মন থেকে নিরসন করা এবং নতুন খারাপ বিচারকে মনে আসা রোধ করা প্রয়োজন। মন কখনো শান্ত হয় না, তাই মনকে ভালো ভাবে পরিপূর্ণ রাখতে হয় এবং ভালো ভাব মনে বলবৎ রাখার জন্য যত্নশীল হতে হয়। সম্যক ব্যায়ামের অর্থ হচ্ছে ভালো উৎপন্ন করার জন্য সতত উদ্যোগ। এই ব্যায়াম চার প্রকার- (১) পুরাতন খারাপ বিচারকে বের করে দূর করা অর্থাৎ কু-চিন্তার বিনাশ সাধন করা, (২) নতুন খারাপ বিচারকে মনে প্রবেশ করতে না-দেয়া অর্থাৎ কু-চিন্তার উৎপত্তি দূর করা, (৩) মনকে সুচিন্তায় নিরত করা অর্থাৎ ভালো ভাব মনে পূর্ণ করা এবং (৪) এই ভাবকে মনে কার্যকর রাখতে সর্বদা ক্রিয়াশীল হওয়া অর্থাৎ সুচিন্তা উৎপাদনের জন্য সচেষ্ট হওয়া।
অর্থাৎ এই চতুর্বিধ প্রযত্নের মাধ্যমে বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানে এবং প্রতিষিদ্ধ কর্মের বর্জনে যে দৃঢ় অধ্যবসায় তা-ই হচ্ছে সম্যক ব্যবসায় বা ব্যায়াম।
(৬) ষষ্ঠ অঙ্গ : সম্যক ব্যায়াম (Right Efforts) : ‘ব্যায়াম’ শব্দের অর্থ চেষ্টা, শ্রম বা অনুশীলন। শারীরিক ব্যায়ামের দ্বারা শরীর যেমন সুস্থ থাকে, মানসিক ব্যায়ামে তেমনি মন বা চিন্তা সুস্থ থাকে। উপরিউক্ত পাঁচটি মার্গ পালন করলেও সাধক নির্বাণ লাভে সমর্থ হয় না। কেননা মানুষের মনে পুরাতন খারাপ বিচার ঘর বেধে আছে এবং নতুন খারাপ বিচার নিরন্তর মনে প্রবাহিত হতে থাকে। সেকারণে পুরাতন খারাপ বিচারকে মন থেকে নিরসন করা এবং নতুন খারাপ বিচারকে মনে আসা রোধ করা প্রয়োজন। মন কখনো শান্ত হয় না, তাই মনকে ভালো ভাবে পরিপূর্ণ রাখতে হয় এবং ভালো ভাব মনে বলবৎ রাখার জন্য যত্নশীল হতে হয়। সম্যক ব্যায়ামের অর্থ হচ্ছে ভালো উৎপন্ন করার জন্য সতত উদ্যোগ। এই ব্যায়াম চার প্রকার- (১) পুরাতন খারাপ বিচারকে বের করে দূর করা অর্থাৎ কু-চিন্তার বিনাশ সাধন করা, (২) নতুন খারাপ বিচারকে মনে প্রবেশ করতে না-দেয়া অর্থাৎ কু-চিন্তার উৎপত্তি দূর করা, (৩) মনকে সুচিন্তায় নিরত করা অর্থাৎ ভালো ভাব মনে পূর্ণ করা এবং (৪) এই ভাবকে মনে কার্যকর রাখতে সর্বদা ক্রিয়াশীল হওয়া অর্থাৎ সুচিন্তা উৎপাদনের জন্য সচেষ্ট হওয়া।
অর্থাৎ এই চতুর্বিধ প্রযত্নের মাধ্যমে বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানে এবং প্রতিষিদ্ধ কর্মের বর্জনে যে দৃঢ় অধ্যবসায় তা-ই হচ্ছে সম্যক ব্যবসায় বা ব্যায়াম।
.
(৭) সপ্তম অঙ্গ : সম্যক স্মৃতি (Right Thought) : সম্যক স্মৃতির অর্থ লোভ আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি চিত্তসন্তাপ থেকে পৃথক থাকা। যে স্মৃতিতে মনে অকুশলের চিন্তা উদিত হয় না এবং সর্বদা কুশলকর বুদ্ধি জাগ্রত থাকে তা-ই সম্যক স্মৃতি।
.
সম্যক স্মৃতি পালন করা খুবই সূক্ষ্মবোধের বিষয়। এ যাবৎ যে সকল বিষয়ের জ্ঞান হয়েছে তাদের সর্বদা স্মরণ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। সম্যক স্মৃতি হচ্ছে বস্তুর বাস্তবিক স্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত থাকা। নির্বাণেচ্ছু সাধককে সদাসর্বদা মনে রাখতে হয়, ‘আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সংবেদন নই, আমি কোন মানসিক অবস্থাও নই।’ শরীর, মন, সংবেদন সব কিছুই অনিত্য ও দুঃখকর। মানুষ অজ্ঞানের বশে শরীর, মন, সংবেদন ইত্যাদিকে স্থায়ী এবং সুখজনক বলে মনে করে। আর সে কারণেই বিষয়ে আসক্ত হলে বস্তুগুলির নাশে দুঃখ অনুভব হয়। তাই তাদের বাস্তবিক স্বরূপ স্মরণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। মোটকথা আর্যসত্যচতুষ্টয়, ভোগ, আয়তন এবং যাবতীয় শারীরিক ও মানসিক অবস্থার যথার্থ বোধ সর্বদা স্মরণীয়। যথার্থ বোধের স্মরণের অভাবে অর্জিত বোধ লুপ্ত হতে পারে এবং তার ফলে জীব পুনরায় অবিদ্যাগ্রস্ত হতে পারে। তাই বিদ্যালাভই নির্বাণলাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। অর্জিত বিদ্যার যাতে বিস্মৃতি না হয় এবং অবিদ্যা যাতে পুনরায় উদিত হতে না পারে তার জন্য যাবতীয় বস্তুস্বরূপের যথাযথ বা সম্যক্ স্মরণ প্রয়োজন। শরীরকে ক্ষণভঙ্গুর বলে উল্লেখ করে বুদ্ধ বলেছেন, শ্মশানে গিয়ে শরীরের নশ্বরতাকে দেখা যায়। এই অনিত্যতায় বিশ্বাস দৃঢ় হলে আসক্তি থাকবে না। ফলে নির্বাণ লাভের পথ সহজতর হয়। সম্যক স্মৃতির পালন নির্বাণেচ্ছু ব্যক্তিকে সমাধির যোগ্য বানায়।
সম্যক স্মৃতি পালন করা খুবই সূক্ষ্মবোধের বিষয়। এ যাবৎ যে সকল বিষয়ের জ্ঞান হয়েছে তাদের সর্বদা স্মরণ রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। সম্যক স্মৃতি হচ্ছে বস্তুর বাস্তবিক স্বরূপ সম্বন্ধে অবহিত থাকা। নির্বাণেচ্ছু সাধককে সদাসর্বদা মনে রাখতে হয়, ‘আমি দেহ নই, আমি মন নই, আমি সংবেদন নই, আমি কোন মানসিক অবস্থাও নই।’ শরীর, মন, সংবেদন সব কিছুই অনিত্য ও দুঃখকর। মানুষ অজ্ঞানের বশে শরীর, মন, সংবেদন ইত্যাদিকে স্থায়ী এবং সুখজনক বলে মনে করে। আর সে কারণেই বিষয়ে আসক্ত হলে বস্তুগুলির নাশে দুঃখ অনুভব হয়। তাই তাদের বাস্তবিক স্বরূপ স্মরণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। মোটকথা আর্যসত্যচতুষ্টয়, ভোগ, আয়তন এবং যাবতীয় শারীরিক ও মানসিক অবস্থার যথার্থ বোধ সর্বদা স্মরণীয়। যথার্থ বোধের স্মরণের অভাবে অর্জিত বোধ লুপ্ত হতে পারে এবং তার ফলে জীব পুনরায় অবিদ্যাগ্রস্ত হতে পারে। তাই বিদ্যালাভই নির্বাণলাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। অর্জিত বিদ্যার যাতে বিস্মৃতি না হয় এবং অবিদ্যা যাতে পুনরায় উদিত হতে না পারে তার জন্য যাবতীয় বস্তুস্বরূপের যথাযথ বা সম্যক্ স্মরণ প্রয়োজন। শরীরকে ক্ষণভঙ্গুর বলে উল্লেখ করে বুদ্ধ বলেছেন, শ্মশানে গিয়ে শরীরের নশ্বরতাকে দেখা যায়। এই অনিত্যতায় বিশ্বাস দৃঢ় হলে আসক্তি থাকবে না। ফলে নির্বাণ লাভের পথ সহজতর হয়। সম্যক স্মৃতির পালন নির্বাণেচ্ছু ব্যক্তিকে সমাধির যোগ্য বানায়।
.
(৮) অষ্টম অঙ্গ : সম্যক সমাধি (Right Tranquility) বা ধ্যান (Concentration) : বুদ্ধ-নির্দেশিত দুঃখ-নিরোধমার্গের সর্বশেষ স্তর হলো সম্যক্ সমাধি। অষ্টাঙ্গিক মার্গের বাকি সাতটি মার্গ সমাধির সহায়ক রূপেই বিবেচিত হয়। এ কারণে তাদের ‘সপ্ত-সমাধি-পরিষ্কার’ বলা হয়। বৌদ্ধমতে নির্বাণলাভের জন্য যদিও যথার্থ জ্ঞান এবং সংযত আচরণ প্রয়োজন, তবুও শুধুমাত্র তার দ্বারা নির্বাণলাভ সম্ভব নয়। নির্বাণের জন্য সমাধি বা ধ্যান প্রয়োজন। রাগদ্বেষ বর্জিত চিত্তের প্রচণ্ড একাগ্রতা, যার দ্বারা মানসিক চাঞ্চল্য সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় তাকেই সম্যক সমাধি বলে। সমাধিতে সাধক নির্বাণ লাভ করেন।
উপরিউক্ত সাতটি সোপানে চলার পর নির্বাণলাভের জন্য সাধক নিজের চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করে সমাধির অবস্থায় আসতে যোগ্য হয়। এই সমাধি বা ধ্যানকে চার্বাক ব্যতীত অন্য সকল ভারতীয় দার্শনিক কোন-না-কোনভাবে স্বীকার করেছেন। তবে বৌদ্ধ ও যোগদর্শনে সমাধির উপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে। সমাধিস্থ বা ধ্যানস্থ হলেই যে তৎক্ষণাৎ নির্বাণলাভ হয়ে যাবে তা নয়। সমাধির নানা স্তরভেদ রয়েছে এবং এই স্তরগুলির মাধ্যমে ধীরে ধীরে নির্বাণলাভ সম্ভব হয়। বুদ্ধ সমাধির চারটি স্তর বা অবস্থা স্বীকার করেছেন। এগুলো হলো-
উপরিউক্ত সাতটি সোপানে চলার পর নির্বাণলাভের জন্য সাধক নিজের চিত্তবৃত্তিকে নিরোধ করে সমাধির অবস্থায় আসতে যোগ্য হয়। এই সমাধি বা ধ্যানকে চার্বাক ব্যতীত অন্য সকল ভারতীয় দার্শনিক কোন-না-কোনভাবে স্বীকার করেছেন। তবে বৌদ্ধ ও যোগদর্শনে সমাধির উপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে। সমাধিস্থ বা ধ্যানস্থ হলেই যে তৎক্ষণাৎ নির্বাণলাভ হয়ে যাবে তা নয়। সমাধির নানা স্তরভেদ রয়েছে এবং এই স্তরগুলির মাধ্যমে ধীরে ধীরে নির্বাণলাভ সম্ভব হয়। বুদ্ধ সমাধির চারটি স্তর বা অবস্থা স্বীকার করেছেন। এগুলো হলো-
.
সমাধির প্রথম অবস্থায় সাধক চারটি আর্যসত্যের মনন ও চিন্তন করবে। এটি হচ্ছে তর্ক ও বিতর্ক অবস্থা। এ সময় সাধকের মনে অনেক প্রকার সংশয় উৎপন্ন হয়, সে স্বয়ং তাদের নিরাকরণ করবে।
প্রথম অবস্থার পর সকল সন্দেহ দূর হয়ে যায়। আর্যসত্যের প্রতি শ্রদ্ধাভাবনার বিকাশ হয়। ধ্যানের এই দ্বিতীয় অবস্থায় তর্ক ও বিতর্কের প্রয়োজন হয় না। এ স্তরে আনন্দ ও শান্তির অনুভূতি হয়। এবং এ অবস্থায় আনন্দ ও শান্তির অনুভূতির চেতনা বিদ্যমান থাকে।
আনন্দ ও শান্তির চেতনার প্রতি ঔদাসীন্য জন্মালে সমাধির তৃতীয় অবস্থা শুরু হয়। আনন্দ ও শান্তির চেতনা নির্বাণপ্রাপ্তিতে বাধক হয়। সেকারণে আনন্দ ও শান্তির চেতনাতে সাধক তটস্থ হতে প্রয়াসী হয়। এ স্তরে আনন্দ ও শান্তির চেতনা আর থাকে না। তবে শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের জ্ঞান বিদ্যমান থাকে।
সমাধির চতুর্থ অবস্থায় দৈহিক বিশ্রাম ও মনের ভাব নষ্ট হয়। এ স্তরে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, শান্তি- কোনকিছুরই অনুভূতি থাকে না এবং সর্বপ্রকার অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে নির্বাণার্থী একপ্রকার নির্লিপ্ত ও উদাসীন অবস্থা প্রাপ্ত হন। সাধকের এইরূপ অবস্থা জীবন্মুক্ত অবস্থার সদৃশ। এ অবস্থা প্রাপ্ত হলে সাধককে ‘অর্হৎ’ বলা হয়। এটিই হচ্ছে নির্বাণ অবস্থা। এখানে জীব সুদ-দুঃখকে অতিক্রম করে যায়।
প্রথম অবস্থার পর সকল সন্দেহ দূর হয়ে যায়। আর্যসত্যের প্রতি শ্রদ্ধাভাবনার বিকাশ হয়। ধ্যানের এই দ্বিতীয় অবস্থায় তর্ক ও বিতর্কের প্রয়োজন হয় না। এ স্তরে আনন্দ ও শান্তির অনুভূতি হয়। এবং এ অবস্থায় আনন্দ ও শান্তির অনুভূতির চেতনা বিদ্যমান থাকে।
আনন্দ ও শান্তির চেতনার প্রতি ঔদাসীন্য জন্মালে সমাধির তৃতীয় অবস্থা শুরু হয়। আনন্দ ও শান্তির চেতনা নির্বাণপ্রাপ্তিতে বাধক হয়। সেকারণে আনন্দ ও শান্তির চেতনাতে সাধক তটস্থ হতে প্রয়াসী হয়। এ স্তরে আনন্দ ও শান্তির চেতনা আর থাকে না। তবে শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের জ্ঞান বিদ্যমান থাকে।
সমাধির চতুর্থ অবস্থায় দৈহিক বিশ্রাম ও মনের ভাব নষ্ট হয়। এ স্তরে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, শান্তি- কোনকিছুরই অনুভূতি থাকে না এবং সর্বপ্রকার অনুভূতি বিলুপ্ত হয়ে নির্বাণার্থী একপ্রকার নির্লিপ্ত ও উদাসীন অবস্থা প্রাপ্ত হন। সাধকের এইরূপ অবস্থা জীবন্মুক্ত অবস্থার সদৃশ। এ অবস্থা প্রাপ্ত হলে সাধককে ‘অর্হৎ’ বলা হয়। এটিই হচ্ছে নির্বাণ অবস্থা। এখানে জীব সুদ-দুঃখকে অতিক্রম করে যায়।
.
বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গকে প্রজ্ঞা, শীল ও সমাধি নামক তিনটি বিশেষ অঙ্গে বিভাজন করেছেন। সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সংকল্প প্রজ্ঞায় অন্তর্গত হয়। সম্যক বাক্, সম্যক কর্মান্ত, সম্যক আজীব ও সম্যক ব্যায়াম শীলে অন্তর্ভূক্ত। সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি সমাধিতে অন্তর্গত হয়। আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের আচরণ দ্বারা কেবল শান্তি, দিব্যজ্ঞান, সম্বোধি বা নির্বাণ লাভই হয় না, জীবনে সুখ, কীর্তি, যশও লাভ হয়। প্রজ্ঞার দ্বারা সর্বভবকে, শীল দ্বারা পাপকে এবং সমাধির দ্বারা কামধাতুকে অতিক্রম করা যায়। বৌদ্ধসাধনায় একে ত্রিশিক্ষাও বলা হয়। এই ত্রিশিক্ষা সম্বন্ধে ধম্মপদের বুদ্ধ বর্গে বলা হয়েছে-
‘সব্বপাপস্সা অকরণং কুসলস্স উপসম্পদা,
সচিত্ত পরিয়োদপনং এতং বুদ্ধানুসাসনং।’ (ধম্মপদ-১৮৩)
অর্থাৎ : সকল প্রকার পাপ থেকে বিরতি (শীল), কুশল কর্মের পূর্ণতা সাধন (প্রজ্ঞা) এবং নিজ চিত্তকে বিশুদ্ধি সাধন (সমাধি), এটাই বুদ্ধগণের উপদেশ।
.
এবং এ বিষয়ে ধম্মপদের আত্ম বর্গে বলা হয়েছে-
এবং এ বিষয়ে ধম্মপদের আত্ম বর্গে বলা হয়েছে-
‘মগ্গানট্ঠঙ্গিকো সেট্ঠো সচ্চানং চতুরো পদা,
ডবরাগো সেটঠো ধম্মানং দ্বিপদানঞ্চ চক্খুমা।’- (মার্গবর্গ-ধম্মপদ-২৭৩)
অর্থাৎ : সব মার্গের মধ্যে অষ্টাঙ্গিক মার্গ শ্রেষ্ঠ, সত্যের মধ্যে চতুরার্যসত্য শ্রেষ্ঠ, ধর্মের মধ্যে বিরাগ শ্রেষ্ঠ এবং মানুষের মধ্যে চক্ষুষ্মানই শ্রেষ্ঠ।