বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব: বিশ্ব-রহস্য উন্মোচনে এক দার্শনিক দৃষ্টিকোণ
ভারতীয় দর্শনের বিশাল প্রাঙ্গণে বৈশেষিক দর্শন তার নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দেদীপ্যমান। যেখানে ন্যায় দর্শন প্রধানত প্রমাণের আলোচনায় গুরুত্ব আরোপ করে, সেখানে বৈশেষিক দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্ব। এই মহাবিশ্বের বৈচিত্র্যময় রূপ এবং পার্থিব জগতের নিগূঢ় রহস্য উন্মোচনে বৈশেষিক সম্প্রদায় এক অভিনব ও সুসংবদ্ধ দার্শনিক কাঠামো তৈরি করেছে। তাদের মতে, জগতের প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি ঘটনাকে সাতটি মৌলিক পদার্থের অন্তর্গত করা যায়। এই সাতটি পদার্থ হলো দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব। এই ধারণাই বৈশেষিক দর্শনকে অন্য সকল ভারতীয় দর্শন থেকে স্বতন্ত্র করেছে, কারণ তাদের মতে, এই জগতে এমন কিছুই নেই যা এই সাতটি পদার্থের কোনো না কোনোটির আওতাভুক্ত নয়। ফলস্বরূপ, এই সাতটি মৌলিক উপাদানই সমগ্র বিশ্বজগতের মূল ভিত্তি।
পদার্থের সংখ্যা: কণাদ থেকে উদয়ন পর্যন্ত বিবর্তন
বৈশেষিক দর্শনের আদি সূত্রকার মহর্ষি কণাদ কিন্তু তার 'বৈশেষিক সূত্র'-এ পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেননি। কণাদ তার সূত্রে বলেছেন:
'দ্রব্যগুণকর্ম্মসামান্যবিশেষসমবায়নাং পদার্থানাং সাধর্ম্ম্যবৈধর্ম্ম্যাভ্যাং তত্ত্বজ্ঞাননিঃশ্রেয়সম।' (বৈশেষিক সূত্র: ১/১/৪)
এর অর্থ হলো: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় নামক পদার্থসমূহের সাধর্ম্য (সাদৃশ্য) ও বৈধর্ম্যের (বৈসাদৃশ্য) তত্ত্বজ্ঞান থেকেই নিঃশ্রেয়স লাভ হয়। এখানে 'নিঃশ্রেয়স' বলতে ভারতীয় দর্শনে পরম মুক্তি বা মোক্ষকে বোঝানো হয়, যা সর্বোচ্চ শ্রেয়। সুতরাং, বৈশেষিক দর্শনে মোক্ষলাভের জন্য এই পদার্থগুলির তত্ত্বজ্ঞান অপরিহার্য।
যদিও কণাদ সরাসরি পদার্থের সংখ্যা উল্লেখ করেননি, পরবর্তীকালে বিশিষ্ট ভাষ্যকার প্রশস্তপাদ তার ভাষ্যে প্রথম ছয়টি পদার্থের (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়) উল্লেখ করেছেন মোক্ষলাভের হেতু হিসেবে, যার মধ্যে অভাব পদার্থের কোনো উল্লেখ নেই:
'দ্রব্যগুণকর্ম্মসামান্যবিশেষসমবায়ানাং ষণ্নাং পদার্থানাং সাধর্ম্ম্য-বৈধর্ম্ম্যতত্ত্বজ্ঞানং নিঃশ্রেয়সহেতুঃ। তচ্চেশ্বরচোদনানিভব্যক্তাদ্ধর্মাদেব।' (প্রশস্তপাদভাষ্য)
অর্থাৎ: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায় – এই ছয়টি পদার্থের সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যরূপ তত্ত্বের জ্ঞান নিঃশ্রেয়সের হেতু। এই নিঃশ্রেয়স কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছাবিশেষের দ্বারা অভিমুখীকৃত ধর্ম বা ঈশ্বর-উপদিষ্ট ধর্ম থেকেই হয়।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সূত্রকার ও ভাষ্যকার কেন অভাব পদার্থের উল্লেখ করেননি? কণাদ তার রচনায় অভাবের ইঙ্গিত দিলেও, তা স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত কিনা তা স্পষ্ট করেননি। বিভিন্ন বৈশেষিকাচার্য এ বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিরণাবলীকার আচার্য উদয়ন এই প্রশ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তর দেন:
'অভাবস্তু স্বরূপবানপি পৃথঙনোদ্দিষ্টঃ প্রতিযোগিনিরূপণাধীননিরূপণত্বাৎ।' (কিরণাবলী, পৃষ্ঠা-৫৭)
এর অর্থ: অভাব সৎ পদার্থ হলেও, অভাবের নিরূপণ যেহেতু প্রতিযোগীর নিরূপণের ওপর নির্ভরশীল, তাই এটি পৃথকভাবে উল্লিখিত হয়নি। এখানে 'প্রতিযোগী' বলতে অভাব পদার্থের মধ্যে যে পদার্থটির অভাব, সেটিকেই বোঝানো হয়েছে। উদয়নের মতে, কণাদের বৈশেষিক সূত্রের সৃষ্টি-সংহার প্রকরণে উৎপত্তি ও বিনাশের ব্যাখ্যায় প্রাগভাব (পূর্বাভাব) ও প্রধ্বংসাভাব (ধ্বংসাভাব) এবং বৈধর্ম্যের ব্যাখ্যায় অন্যোন্যাভাব (পারস্পরিক অভাব) ও অত্যন্তাভাব (সর্বতোভাবে অভাব) আলোচিত হয়েছে। সুতরাং, অভাব পদার্থ যে বৈশেষিক সম্মত তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে, যেহেতু অভাবের জ্ঞান প্রতিযোগীর জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল, তাই নিঃশ্রেয়সের হেতুর আলোচনায় পদার্থের তালিকায় অভাবের স্বতন্ত্র উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না।
আসলে, আচার্য উদয়নই প্রথম অভাব সহ সাতটি বৈশেষিক পদার্থের উল্লেখ করেন। শ্রীধর, শিবাদিত্য প্রমুখ পরবর্তী দার্শনিকরাও সপ্তম পদার্থরূপে অভাবের উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, বৈশেষিক দর্শনে বিশ্বের মৌলিক তত্ত্ব সাতটিই। তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্টও বৈশেষিকসম্মত পদার্থের বিভাগ দেখিয়েছেন:
'দ্রব্যগুণকর্মসামান্যবিশেষসমবায়াভাবাঃ সপ্ত পদার্থাঃ।' (তর্কসংগ্রহ)
অর্থাৎ: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব – এই সাতটি পদার্থ।
পদার্থ কী? বৈশেষিক ধারণার গভীরে
এই সাতটি মৌলিক তত্ত্বকেই বৈশেষিক দর্শনে 'পদার্থ' বলে অভিহিত করা হয়েছে। ন্যায়মতে পদার্থের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট না হলেও, বৈশেষিক মতে পদার্থের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট এবং তা সাতটিই। এই কারণে বৈশেষিক সম্প্রদায়কে 'নিয়ত পদার্থবাদী' বলা হয়। বল্লভাচার্য তাঁর 'ন্যায়লীলাবতী' গ্রন্থে এই পার্থক্যটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন:
'অনিয়তপদার্থবাদিনো নৈয়ায়িকাঃ
নিয়তপদার্থবাদিনশ্চ বৈশেষিকাঃ।' (ন্যায়লীলাবতী)
অর্থাৎ: নৈয়ায়িকরা অনিয়ত পদার্থবাদী, আর বৈশেষিকরা নিয়ত পদার্থবাদী।
সাধারণত, 'পদার্থ' বলতে যা বোঝায়, বৈশেষিক দর্শনে এর প্রয়োগ কিছুটা ভিন্ন। বৈশেষিক দর্শনে 'পদার্থ' কথাটিকে আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যুৎপত্তিগতভাবে, 'পদার্থ' হলো পদের অর্থ, অর্থাৎ পদের দ্বারা যে বস্তুকে বোঝানো হয়, তাই পদার্থ। নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তার তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন:
'পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ'। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)
অর্থাৎ: পদের অর্থকে (অভিধেয়) পদার্থ বলে।
জগতের যেকোনো বস্তুই পদের দ্বারা অভিহিত হতে পারে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে, যা জ্ঞেয়, তাই অভিধেয়। যাবতীয় অস্তিত্বশীল (কাল্পনিক নয়) বস্তুই জ্ঞেয়। যেহেতু জগতের যাবতীয় বস্তুই জ্ঞেয়, সেহেতু যাবতীয় বস্তুই অভিধেয় (পদের দ্বারা অভিহিত হতে পারে), অর্থাৎ পদার্থ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পদার্থ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাতা ও জ্ঞান নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। পদার্থ যখন জ্ঞানে প্রতিভাত হয়, তখন তাকে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে 'বিষয়' বলে।
সপ্তপদার্থের শ্রেণীকরণ: ভাব ও অভাব
বৈশেষিক দর্শনে দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব – এই সপ্তপদার্থের মাধ্যমে জগতের যাবতীয় পদার্থের সাতটি শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। এই সাতটি শ্রেণীকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়:
ভাবপদার্থ: প্রথম ছয়টি পদার্থ – দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় – কে ভাবপদার্থ বলা হয়, কারণ এগুলি অস্তিত্বশীল সত্তা বোঝায়।
অভাবপদার্থ: সপ্তম পদার্থ, অর্থাৎ অভাব, কে অভাবপদার্থ বলা হয়, কারণ এটি কোনো কিছুর অনুপস্থিতি বা অভাবকে নির্দেশ করে।
অন্যান্য ভারতীয় দর্শনে পদার্থের ধারণা
ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পদার্থের সংখ্যা বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। এটি দর্শনের বৈচিত্র্য এবং চিন্তার গভীরতারই প্রমাণ।
ন্যায়দর্শন: ন্যায়দর্শনে ষোলটি পদার্থ স্বীকার করা হয়: প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, প্রয়োজন, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান। যদিও এদের কিছু বৈশেষিকের পদার্থের সাথে আংশিকভাবে মিলে যায়, তবে এদের শ্রেণীকরণ ও উদ্দেশ্য ভিন্ন।
ভাট্ট মীমাংসক সম্প্রদায়: এই সম্প্রদায় পাঁচটি পদার্থ স্বীকার করে: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব।
প্রাভাকর মীমাংসক মতে: এদের মতে পদার্থ আটটি: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, সংখ্যা, সমবায়, সাদৃশ্য এবং শক্তি।
বেদান্ত মতে: বেদান্ত মতে ভাট্ট মীমাংসকদের অনুরূপ পদার্থ পাঁচটি: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব।
নৈয়ায়িকদের মধ্যেও মতভেদ: এমনকি নৈয়ায়িকদের মধ্যেও পদার্থের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ দেখা যায়। যেমন, নব্যনৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি বিশেষকে স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকার করেননি।
উপসংহার
বৈশেষিক দর্শনের এই সপ্তপদার্থের ধারণা কেবল একটি দার্শনিক তত্ত্ব নয়, এটি বিশ্বকে বিশ্লেষণ এবং বোঝার একটি সুসংবদ্ধ পদ্ধতি। এই সাতটি মৌলিক উপাদানের মাধ্যমেই বৈশেষিকরা জগতের প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এবং প্রতিটি ক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাদের এই বিশ্লেষণ শুধুমাত্র দার্শনিক বিতর্কেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তির ভিত্তি গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বৈশেষিক পদার্থের এই গভীর জ্ঞানই মানুষকে মোক্ষের পথে চালিত করে, এই বিশ্বাসই বৈশেষিক দর্শনের মূল লক্ষ্য। তাদের এই 'নিয়ত পদার্থবাদী' অবস্থান ভারতীয় চিন্তাধারায় এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে, যা আজও গবেষক ও দার্শনিকদের কাছে আলোচনার বিষয়।
বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব: আপনার জিজ্ঞাস্য
বৈশেষিক দর্শন এবং এর পদার্থতত্ত্ব নিয়ে আপনার মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। এখানে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত ২০টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা এই জটিল ধারণাকে সহজভাবে বুঝতে সাহায্য করবে:
১. বৈশেষিক দর্শন কীসের উপর গুরুত্ব দেয়?
বৈশেষিক দর্শন প্রধানত ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্বের আলোচনার উপর গুরুত্ব দেয়, যেখানে ন্যায় দর্শন প্রমাণের উপর জোর দেয়।
২. বৈশেষিক মতে ক'টি মৌলিক পদার্থ রয়েছে?
বৈশেষিক মতে সাতটি মৌলিক পদার্থ রয়েছে: দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব।
৩. মহর্ষি কণাদ কি পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেছেন?
না, মহর্ষি কণাদ তাঁর 'বৈশেষিক সূত্র'-এ পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করেননি। তিনি সাধর্ম্য ও বৈধর্ম্যের মাধ্যমে তত্ত্বজ্ঞানের কথা বলেছেন।
৪. 'নিঃশ্রেয়স' বলতে বৈশেষিক দর্শনে কী বোঝায়?
'নিঃশ্রেয়স' বলতে বৈশেষিক দর্শনে পরামুক্তি বা মোক্ষকে বোঝায়, যা সর্বোচ্চ শ্রেয়।
৫. প্রশস্তপাদ তাঁর ভাষ্যে ক'টি পদার্থের উল্লেখ করেছেন?
প্রশস্তপাদ তাঁর ভাষ্যে প্রথম ছয়টি পদার্থের (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়) উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে অভাবের উল্লেখ নেই।
৬. কেন কণাদ ও প্রশস্তপাদ অভাব পদার্থের সরাসরি উল্লেখ করেননি?
আচার্য উদয়নের মতে, অভাব পদার্থ সৎ হলেও, এর নিরূপণ প্রতিযোগীর নিরূপণের উপর নির্ভরশীল। তাই মোক্ষলাভের হেতুর আলোচনায় এর স্বতন্ত্র উল্লেখের প্রয়োজন হয়নি।
৭. অভাব পদার্থকে প্রথম কে স্পষ্টভাবে সপ্তম পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করেন?
আচার্য উদয়নই প্রথম অভাবকে স্পষ্টভাবে সপ্তম পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করেন।
৮. বৈশেষিক সম্প্রদায়কে কেন 'নিয়ত পদার্থবাদী' বলা হয়?
বৈশেষিক মতে পদার্থের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট (সাতটি), এর অতিরিক্ত কোনো পদার্থ নেই। তাই তাদের 'নিয়ত পদার্থবাদী' বলা হয়।
৯. 'পদার্থ' শব্দটির বৈশেষিক অর্থ কী?
বৈশেষিক দর্শনে 'পদার্থ' বলতে পদের অর্থকে বোঝানো হয়। নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্টের মতে, 'পদস্য অর্থঃ পদার্থঃ'।
১০. পদার্থ কি জ্ঞাতা-নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল?
হ্যাঁ, বৈশেষিক মতে পদার্থ সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাতা ও জ্ঞান নিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল।
১১. যখন পদার্থ জ্ঞানে প্রতিভাত হয়, তখন তাকে কী বলে?
যখন পদার্থ জ্ঞানে প্রতিভাত হয়, তখন তাকে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে 'বিষয়' বলে।
১২. বৈশেষিক সপ্তপদার্থকে কয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়?
বৈশেষিক সপ্তপদার্থকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়: ভাবপদার্থ (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়) এবং অভাবপদার্থ (অভাব)।
১৩. 'ভাবপদার্থ' বলতে কী বোঝায়?
'ভাবপদার্থ' বলতে সেই পদার্থগুলোকে বোঝায় যারা অস্তিত্বশীল সত্তা প্রকাশ করে।
১৪. ন্যায় দর্শনে ক'টি পদার্থের কথা বলা হয়েছে?
ন্যায় দর্শনে ষোলটি পদার্থের কথা বলা হয়েছে, যেমন - প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয় ইত্যাদি।
১৫. ভাট্ট মীমাংসক সম্প্রদায় ক'টি পদার্থ স্বীকার করে?
ভাট্ট মীমাংসক সম্প্রদায় পাঁচটি পদার্থ (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব) স্বীকার করে।
১৬. প্রাভাকর মীমাংসক মতে পদার্থের সংখ্যা কত?
প্রাভাকর মীমাংসক মতে পদার্থের সংখ্যা আটটি।
১৭. বেদান্ত মতে ক'টি পদার্থ স্বীকার করা হয়?
বেদান্ত মতেও ভাট্ট মীমাংসকদের মতো পাঁচটি পদার্থ স্বীকার করা হয়।
১৮. নব্যনৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি কোন পদার্থকে স্বীকার করেননি?
নব্যনৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণি বিশেষকে স্বতন্ত্র পদার্থরূপে স্বীকার করেননি।
১৯. 'সাধর্ম্য' ও 'বৈধর্ম্য' বলতে কী বোঝায়?
'সাধর্ম্য' বলতে সাদৃশ্য এবং 'বৈধর্ম্য' বলতে বৈসাদৃশ্যকে বোঝায়। এগুলির তত্ত্বজ্ঞান মোক্ষলাভে সহায়ক।
২০. বৈশেষিক দর্শনে অভাবের প্রকারভেদ কী কী?
বৈশেষিক দর্শনে সাধারণত চার প্রকার অভাবের কথা বলা হয়: প্রাগভাব, প্রধ্বংসাভাব, অন্যোন্যাভাব এবং অত্যন্তাভাব।
বৈশেষিক পদার্থতত্ত্ব: বহু-নির্বাচনী প্রশ্ন (MCQ)
এখানে বৈশেষিক পদার্থতত্ত্বের উপর কিছু বহু-নির্বাচনী প্রশ্ন দেওয়া হলো। প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর চিহ্নিত করা হয়েছে।
১. বৈশেষিক দর্শন প্রধানত কোন বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করে?
ক. প্রমাণের আলোচনা
খ. ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্ব
গ. আত্মার স্বরূপ
ঘ. কর্মফল
সঠিক উত্তর: খ. ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্ব
ব্যাখ্যা: বৈশেষিক দর্শনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো বিশ্ববৈচিত্র্য তথা পার্থিব জগতকে ব্যাখ্যা করা এবং এর ভৌততত্ত্ব বা বিশ্বতত্ত্বের আলোচনা করা।
২. বৈশেষিক সম্প্রদায় কয়টি পদার্থ স্বীকার করেছেন?
ক. ছয়টি
খ. সাতটি
গ. আটটি
ঘ. ষোলটি
স সঠিক উত্তর: খ. সাতটি
ব্যাখ্যা: বৈশেষিক সম্প্রদায় দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় ও অভাব – এই সাতটি পদার্থ স্বীকার করেছেন।
৩. নিম্নোক্ত কোন পদার্থটি মহর্ষি কণাদ বা প্রশস্তপাদ সরাসরি তাদের প্রাথমিক আলোচনায় উল্লেখ করেননি, কিন্তু পরে এটি স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়?
ক. দ্রব্য
খ. গুণ
গ. অভাব
ঘ. কর্ম
সঠিক উত্তর: গ. অভাব
ব্যাখ্যা: মহর্ষি কণাদ ও প্রশস্তপাদ সরাসরি অভাবের উল্লেখ না করলেও, পরে আচার্য উদয়নের মাধ্যমে এটি স্বতন্ত্র পদার্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়।
৪. 'নিঃশ্রেয়স' বলতে বৈশেষিক দর্শনে কী বোঝায়?
ক. সম্পদ লাভ
খ. সর্বোচ্চ জ্ঞান
গ. পরামুক্তি বা মোক্ষ
ঘ. শারীরিক সুস্থতা
সঠিক উত্তর: গ. পরামুক্তি বা মোক্ষ
ব্যাখ্যা: ভারতীয় দর্শনে এবং বিশেষত বৈশেষিক দর্শনে, নিঃশ্রেয়স বলতে সবথেকে শ্রেয় অর্থাৎ পরামুক্তি বা মোক্ষকেই বোঝানো হয়।
৫. আচার্য উদয়নের মতে, অভাব স্বতন্ত্র পদার্থ রূপে উল্লিখিত না হওয়ার কারণ কী?
ক. অভাবের অস্তিত্ব নেই
খ. অভাবের নিরূপণ প্রতিযোগীর নিরূপণাধীন
গ. অভাব পদার্থের গুরুত্ব নেই
ঘ. এটি একটি কাল্পনিক পদার্থ
সঠিক উত্তর: খ. অভাবের নিরূপণ প্রতিযোগীর নিরূপণাধীন
ব্যাখ্যা: উদয়নের মতে, যেহেতু অভাবের নিরূপণ তার প্রতিযোগীর নিরূপণের উপর নির্ভরশীল, তাই এর স্বতন্ত্র উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না।
৬. 'নিয়ত পদার্থবাদী' বলে কোন সম্প্রদায়কে অভিহিত করা হয়?
ক. নৈয়ায়িক
খ. মীমাংসক
গ. বেদান্তী
ঘ. বৈশেষিক
সঠিক উত্তর: ঘ. বৈশেষিক
ব্যাখ্যা: বৈশেষিকরা তাদের সাতটি পদার্থের নির্দিষ্ট সংখ্যার কারণে 'নিয়ত পদার্থবাদী' নামে পরিচিত।
৭. বৈশেষিক মতে, জগতের যাবতীয় বস্তু যেহেতু জ্ঞেয়, সেহেতু যাবতীয় বস্তুই __________।
ক. বিষয়
খ. অভিধেয়
গ. অজ্ঞেয়
ঘ. অনস্তিত্বশীল
সঠিক উত্তর: খ. অভিধেয়
ব্যাখ্যা: ন্যায়-বৈশেষিক মতে যা জ্ঞেয়, তাই অভিধেয় (পদের দ্বারা অভিহিত হতে পারে), অর্থাৎ পদার্থ।
৮. বৈশেষিক সপ্তপদার্থের মধ্যে 'ভাবপদার্থ' কোনগুলো?
ক. শুধুমাত্র অভাব
খ. দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়
গ. দ্রব্য ও গুণ
ঘ. শুধুমাত্র দ্রব্য
সঠিক উত্তর: খ. দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায়
ব্যাখ্যা: এই ছয়টি পদার্থকে 'ভাবপদার্থ' বলা হয় কারণ এগুলি অস্তিত্বশীল সত্তা প্রকাশ করে।
৯. কোন ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় পাঁচ প্রকার পদার্থ স্বীকার করে, যেমন ভাট্ট মীমাংসকরা?
ক. ন্যায় দর্শন
খ. প্রাভাকর মীমাংসক
গ. বেদান্ত
ঘ. চার্বাক দর্শন
সঠিক উত্তর: গ. বেদান্ত
ব্যাখ্যা: বেদান্ত মতে ভাট্ট মীমাংসকদের অনুরূপ পাঁচটি পদার্থ (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য এবং অভাব) স্বীকার করা হয়।
১০. 'প্রতিযোগী' অর্থ কী?
ক. যে পদার্থটির অভাব নেই
খ. অভাবপদার্থের মধ্যে যে পদার্থটির অভাব
গ. অভাবের অস্তিত্ব
ঘ. অভাবের কারণ
সঠিক উত্তর: খ. অভাবপদার্থের মধ্যে যে পদার্থটির অভাব
ব্যাখ্যা: আচার্য উদয়নের মতে, 'প্রতিযোগী' অর্থ হলো অভাবপদার্থের মধ্যে যে পদার্থটির অভাব, সেটিই অভাবপদার্থের প্রতিযোগী।
১১. বৈশেষিক দর্শনে 'পদার্থ' এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কী?
ক. পদের প্রকৃতি
খ. পদের অর্থ
গ. পদের উচ্চারণ
ঘ. পদের গঠন
সঠিক উত্তর: খ. পদের অর্থ
ব্যাখ্যা: ব্যুৎপত্তিগতভাবে, 'পদার্থ' হলো পদের অর্থ, অর্থাৎ পদের দ্বারা যে বস্তুকে বোঝানো হয়, তাই পদার্থ।
১২. বৈশেষিক মতে, পদার্থ যখন জ্ঞানে প্রতিভাত হয়, তখন তাকে কী বলে?
ক. জ্ঞেয়
খ. বিষয়
গ. অভিধেয়
ঘ. প্রমাণ
সঠিক উত্তর: খ. বিষয়
ব্যাখ্যা: পদার্থ যখন জ্ঞানে ভাসমান হয়, তখন তাকে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে 'বিষয়' বলে।
১৩. 'সাধর্ম্য' বলতে কী বোঝায়?
ক. বৈসাদৃশ্য
খ. সাদৃশ্য
গ. বৈশিষ্ট্য
ঘ. গুণ
সঠিক উত্তর: খ. সাদৃশ্য
ব্যাখ্যা: 'সাধর্ম্য' বলতে সাদৃশ্যকে বোঝায়, যা পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানের জন্য আবশ্যক।
১৪. 'বৈধর্ম্য' বলতে কী বোঝায়?
ক. সাদৃশ্য
খ. বৈসাদৃশ্য
গ. ধর্ম
ঘ. কর্ম
সঠিক উত্তর: খ. বৈসাদৃশ্য
ব্যাখ্যা: 'বৈধর্ম্য' বলতে বৈসাদৃশ্যকে বোঝায়, যা পদার্থের তত্ত্বজ্ঞানের জন্য আবশ্যক।
১৫. কোন গ্রন্থে অন্নংভট্ট বৈশেষিকসম্মত সাতটি পদার্থের বিভাগ দেখিয়েছেন?
ক. ন্যায়লীলাবতী
খ. কিরণাবলী
গ. তর্কসংগ্রহ
ঘ. বৈশেষিক সূত্র
সঠিক উত্তর: গ. তর্কসংগ্রহ
ব্যাখ্যা: তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে অন্নংভট্ট 'দ্রব্যগুণকর্মসামান্যবিশেষসমবায়াভাবাঃ সপ্ত পদার্থাঃ' বলে সাতটি পদার্থের উল্লেখ করেছেন।
১৬. বৈশেষিক মতে, অভাবের কয়টি প্রকারভেদ রয়েছে?
ক. দুইটি
খ. তিনটি
গ. চারটি
ঘ. পাঁচটি
সঠিক উত্তর: গ. চারটি
ব্যাখ্যা: বৈশেষিক দর্শনে সাধারণত চার প্রকার অভাবের কথা বলা হয়: প্রাগভাব, প্রধ্বংসাভাব, অন্যোন্যাভাব এবং অত্যন্তাভাব।
১৭. 'প্রাগভাব' বলতে কী বোঝায়?
ক. ধ্বংসের অভাব
খ. উৎপত্তির পূর্বের অভাব
গ. পারস্পরিক অভাব
ঘ. চিরন্তন অভাব
সঠিক উত্তর: খ. উৎপত্তির পূর্বের অভাব
ব্যাখ্যা: প্রাগভাব হলো কোনো কিছুর উৎপত্তির পূর্বের অভাব, যেমন ঘট তৈরির আগে ঘটের অভাব।
১৮. 'প্রধ্বংসাভাব' বলতে কী বোঝায়?
ক. উৎপত্তির পূর্বের অভাব
খ. ধ্বংসের পরের অভাব
গ. পারস্পরিক অভাব
ঘ. চিরন্তন অভাব
সঠিক উত্তর: খ. ধ্বংসের পরের অভাব
ব্যাখ্যা: প্রধ্বংসাভাব হলো কোনো কিছুর ধ্বংসের পরের অভাব, যেমন ঘট ভেঙে যাওয়ার পর ঘটের অভাব।
১৯. 'অন্যোন্যাভাব' বলতে কী বোঝায়?
ক. উৎপত্তির পূর্বের অভাব
খ. ধ্বংসের পরের অভাব
গ. পারস্পরিক অভাব
ঘ. চিরন্তন অভাব
সঠিক উত্তর: গ. পারস্পরিক অভাব
ব্যাখ্যা: অন্যোন্যাভাব হলো একটি বস্তুর অন্য বস্তু থেকে ভিন্নতা, যেমন ঘট পট নয়।
২০. 'অত্যন্তাভাব' বলতে কী বোঝায়?
ক. উৎপত্তির পূর্বের অভাব
খ. ধ্বংসের পরের অভাব
গ. পারস্পরিক অভাব
ঘ. চিরন্তন অভাব
সঠিক উত্তর: ঘ. চিরন্তন অভাব
ব্যাখ্যা: অত্যন্তাভাব হলো কোনো কিছুর চিরন্তন বা সর্বতোভাবে অভাব, যেমন আকাশে নীল পদ্মের অভাব।
