বস্তুবাদ বনাম ভাববাদ
সাধারণ অর্থে ‘বস্তু’ বলতে বোঝায় ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষগ্রাহ্য পদার্থ বিশেষ। এই যে প্রত্যক্ষগ্রাহ্যতা এটাই জ্ঞান। কোনকিছুকে আমরা এভাবেই জানি। প্রত্যক্ষগ্রাহ্যতার সাথে অস্তিত্বশীলতার প্রশ্ন জড়িত। এই অস্তিত্বশীল বস্তুকে ভারতীয় দার্শনিক পরিভাষায় বলা হয় ‘সৎ-বস্তু’। আর অস্তিত্বহীন কোন বিষয়কে বলা যায় ‘অসৎ’। সেক্ষেত্রে বস্তুবাদ বলতে বোঝায় ইন্দ্রিয়াতীত কোন বিষয়কে স্বীকার না করা। অন্যদিকে ভাববাদ তার বিপরীত অবস্থানে। বাস্তব জীবনে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তায় স্বীকার করেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নির্বাহ হয়। কিন্তু এই স্বাভাবিকতার বাইরে গিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যের অতীত কোন অতীন্দ্রিয় সত্তায় স্বীকার করার যে রহস্যময় ভাববাদী প্রবণতা, তা কী করে মানব-চেতনায় অনুপ্রবেশ করলো এটি একটি জটিল প্রশ্ন বৈকি। মানুষের সকল কর্মই উদ্দেশ্য বিধায়ক, কোন-না-কোন উদ্দেশ্য এতে থাকবেই। কবে কখন কোথায় কীভাবে কোন্ উদ্দেশ্যে মানব-সভ্যতায় প্রথম এমন ভাববাদী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো তা নিশ্চয় করে বলার উপায় নেই। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে তার একটি ব্যাখ্যা হাজির করা যেতে পারে।
‘ধর্ম’ শব্দটিকে ইংরেজিতে ‘রিলিজিওন’ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিন্তু ধর্ম শব্দটির অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। ‘রিলিজিওন’ এই ব্যাপক অর্থের একটি সংকীর্ণ খণ্ডিত ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। ‘রিলিজিওন’-এর অন্য কোনো উপযুক্ত প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না বলেই আমরা ধর্ম শব্দটি গ্রহণ করেছি। অথচ বস্তুর ধর্ম বললে বোঝা যায় বস্তুর স্বাভাবিক গুণাগুণ। যেমন তরলতা এবং নিম্নগতি জলের স্বাভাবিক ধর্ম। মননশক্তি মানুষের ধর্ম যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে। একে বলে ভেদক ধর্ম। সামাজিক রীতি নীতি, আচার ব্যবহার, ন্যায়ালয়ের বিচারের আইনকানুন সবই ধর্ম। এজন্য আদালতের নাম ধর্মাধিকরণ, বিচারকের নাম ধর্মাধিকারী। অর্থনীতি রাজনীতি, কর্তব্য অকর্তব্য, নৈতিক নিয়মশৃঙ্খলা সবই ধর্মের অন্তর্গত। সহজ কথায় যে নিয়ম নীতির দ্বারা সমাজ চলে তাই ধর্ম। আধ্যাত্মিক ভাবনার রীতিনীতিও এই সমাজধর্মেরই একটি অঙ্গ যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পূজা পার্বণ যাগযজ্ঞ ইত্যাদির মধ্যে। আরও ব্যাপক অর্থে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গ্রহ নক্ষত্র যে নিয়মশৃঙ্খলা অনুসারে চলে তাও ধর্ম। তবে আমাদের বর্তমান আলোচনায় ধর্ম শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে অধ্যাত্মবাদী শাস্ত্রসম্মত নীতি-নিয়মের প্রতিশব্দ হিসেবে। যার মধ্যে মুখ্যস্থান গ্রহণ করে আছে দেবতা ঈশ্বর পরলোক, স্বর্গসুখের আশ্বাস, সংসারচক্রের আবর্তনের শেষে পারলৌকিক মুক্তি ইত্যাদি অতীন্দ্রিয় ধারণার আবির্ভাব। নৈয়ায়িকেরা আবার ধর্মাধর্ম কথাটি পাপ-পুণ্য অর্থে ব্যবহার করেন, যার অর্থ দাঁড়ায় পূর্বজন্মের বা ইহজন্মের কর্মজনিত ‘অদৃষ্ট’। (দ্রষ্টব্য : হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৬২)
এগুলিই হলো ভাববাদী চিন্তা-চেতনার অস্ত্র ও মাল-মসলা। স্বাভাবিকভাবেই বস্তুবাদী চার্বাকেরা তাই এই ধর্মকে মানতেন না। আর প্রাকৃতিক-নিয়মের যে চিরায়ত বহমানতা তাকে চার্বাকেরা ‘স্বভাব-নিয়ম’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তা আমরা আগেই দেখেছি। এ-প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে–
‘Religion is the sigh of the oppressed creature, the feeling of a heartless world and the soul of soulless circumstances. It is the opium of the people.’
অর্থাৎ : ধর্ম নিপীড়িত মানুষের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন সংসারের বেদনা, নিশ্চেতন নিষ্ঠুর বাস্তবের চেতনা। ধর্ম মানুষের জন্য আফিম-স্বরূপ।
‘আদিম মানব সমাজে যখন রাজা ছিল না, রাজ্য ছিল না, রাষ্ট্র ছিল না, শাসক শাসিত শ্রেণীভেদ ছিল না তখন ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল জীবনসংগ্রামের প্রয়োজনে। মানুষ তখন প্রকৃতির দুই বিপরীত রূপ লক্ষ করেছে। প্রকৃতি মানুষের অনুকূল ও প্রতিকূল। প্রকৃতির এই দ্বৈত চরিত্র মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে। প্রাকৃতিক শক্তিকে বশীভূত করে জীবনধারণের প্রয়োজনে প্রযুক্ত করার কলাকৌশল মানুষ তখনো আয়ত্ত করে নি। প্রকৃতির কৃপণ আনুকূল্য পেলেও জীবিকা ছিল কঠোর কষ্টসাধ্য। তাই গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের সকল মানুষ মিলেমিশে একই সঙ্গে জীবনসংগ্রামে ব্যাপৃত না থাকলে বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না। পরস্পর পরস্পরকে বঞ্চনা করে অপরের ক্ষুধার অন্ন আত্মসাৎ করলে কারুর কপালেই অন্ন জুটত না। সুতরাং যা জুটত সবাই তাই ভাগ করে খেত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়াতে হলে সকলকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হত। এ অবস্থায় প্রকৃতির পরস্পর বিপরীত দ্বৈত রূপে মধ্যে প্রতিকূল রূপটাই ছিল মানুষের কাছে প্রধান সমস্যা।… সুতরাং মানুষ তখন স্বাভাবিকভাবেই পরস্পর পরস্পরকে রক্ষা করত। যৌথ জীবনযাত্রার সহযোগিতাই ছিল ধর্ম। এজন্য রাষ্ট্রের বা ধর্মশাস্ত্রের কোনো অনুশাসনের প্রয়োজন ছিল না।’…
‘এ অবস্থায় মানুষ তার কঠোর পরিশ্রমের সাফল্য অর্জন করার জন্য প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মধ্যে দৈবশক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করত, প্রকৃতির আনুকূল্য প্রার্থনার মধ্যে জীবনসংগ্রামে উৎসাহ সঞ্চয় করত। তখন পর্যন্ত মানুষের মনে পারলৌকিক সুখের আত্মবঞ্চনাময় আশ্বাসে বিশ্বাসস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে নি। মানুষের অধীশ্বর কোনো রাজা বা সম্রাটের তখনও জন্ম হয়নি। তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একচ্ছত্র অধীশ্বরের কল্পনাও তখন সম্ভব হয়নি। ইহলোকে বেঁচে থাকার সমস্যাই তাদের ধ্যান ধারণাকে পরিব্যাপ্ত করে রাখত। বঞ্চনাকারী শাসক শ্রেণীর আবির্ভাবের অভাবে পারলৌকিক সুখের আশ্বাসের মধ্যে ঐহিক সুখলাভের ব্যর্থতা-সঞ্জাত আত্মগ্লানিকে ডুবিয়ে রাখার করুণ কল্পনা তখনো মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করেনি। তাই ধর্ম তখন আফিমের কাজ করেনি। আদিম মানুষ জানত, বেঁচে থাকতে হলে কষ্ট করতে হবে। অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে সুখের মুখ দেখতে হবে। সুখ লাভের পথটি বড়ই দুর্গম… আদিম মানুষ প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করত, মৃত্যুর পরপারে আধ্যাত্মিক আনন্দের সান্ত্বনাময়ী কল্পনার মধ্য দিয়ে নয়।’ (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৬৪-৫)
বলা বাহুল্য, মানুষের সমাজে যখন ঐতিহাসিক নিয়মে শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটলো, সমাজের শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রদত্ত সুবিধাভোগী ধর্মগুরু ও ধর্মশাস্ত্রীর দল প্রাকৃতিক শক্তির মধ্যে দৈবশক্তির পুরাতন কল্পনায় রংদার কল্পনা বিস্তারে সবরকম মদত জোগাতে এগিয়ে এলো। ধর্ম যখন রাষ্ট্রশক্তির করায়ত্ত হয়, ধর্মপ্রচারের ভার যখন অনুগত ধর্মগুরুদের হাতে জমা পড়ে তখন এ সংসারে মানুষের দুর্গতির দায়িত্ব থেকে শাসক শ্রেণী অব্যাহতি লাভের চেষ্টা করে। জনসাধারণের ক্রোধ ও বিক্ষোভ যাতে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে চালিত না হয় সে জন্য সাংসারিক সুখলালসা থেকে মুক্ত হয়ে পরপারে মুক্তিসন্ধানের ব্রত উদযাপনে মানুষকে উৎসাহিত করে। ধর্মের সঙ্গে শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রশক্তির গাঁটবন্ধনের মর্মার্থ হলো, ধর্ম একটি লাভজনক ব্যবসায়ে রূপান্তরিত হয়। ধর্মবুদ্ধি আর ব্যবসায়িক বুদ্ধি এক হয়ে সেতুবন্ধন রচনা করলে যজ্ঞে বলিদানের পশু হয়ে সাধারণ মানুষ পরপারে সুখেই খোয়াব দেখতে থাকে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রশক্তি যখন ধর্মে অনুপ্রবেশ করে, তখন ধর্ম হয় প্রতারকের ছদ্মবেশ, চার্বাকের ভাষায় কঞ্চুক। কঞ্চুকের একটি অর্থ খোলস, আর একটি অর্থ বর্ম। সাধারণ মানুষ এই বর্মতুল্য খোলস ভেদ করে ছদ্মবেশীর আসল রূপটি চিনতে না পেরে সহজেই বিভ্রান্ত হয়। সহজ কথায় সভ্যযুগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম পণ্যে পরিণত হয়েছে। আর ব্যবসায়াত্মিকা ধর্মবুদ্ধি যখন আর একটু উর্ধ্বগামী হয় তখন শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মের নামে যুদ্ধ অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ ক্রুসেড বা জেহাদ।
‘মহাভারতে’ বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকেও ধর্মযুদ্ধ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পাণ্ডবপক্ষের বীরশ্রেষ্ঠ সেনাপতি অর্জুন এই যুদ্ধে বিপুল প্রাণনাশজনিত ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় আত্মীয় পরিজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে বিরাগ প্রকাশ করলে শ্রীকৃষ্ণরূপী ভগবান অর্জুনকে যুদ্ধে নিয়োজিত করতে ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’র আলেখ্যে যে উপদেশামৃত প্রদান করেছিলেন, তার মর্মার্থ কিন্তু এখানে–
‘অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্ ।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি।।
অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত।।
য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্ ।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।।
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ নায়ং ভূত্বাহভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।’ (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-২/১৭-২০)।
অর্থাৎ :
‘যিনি এই সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত করিয়া আছেন, তাঁহাকেই অবিনাশী আত্মা বা ব্রহ্ম বলিয়া জানিবে। কেহই এই অব্যয় আত্মার বিনাশ করিতে সমর্থ হয় না। (গীতা-২/১৭)।। প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অতীত, অবিনাশী ও নিত্য আত্মার এই সকল দেহ নশ্বর বলিয়া উক্ত হইয়াছে। অতএব হে অর্জুন, তোমার এই জড়দেহ কালে বিনষ্ট হইবেই; কিন্তু তুমি আত্মারূপে অবিনাশী। অতএব যুদ্ধ করিয়া স্বধর্ম পালন কর। (গীতা-২/১৮)।। যিনি ইঁহাকে হন্তা বলিয়া মনে করেন এবং যিনি ইঁহাকে নিহত বলিয়া ভাবেন, তাঁহারা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেন না। আত্মা কাহাকেও হত্যা করেন না এবং কাহারও দ্বারা নিহতও হন না। কারণ, আত্মা অবিনাশী। (গীতা-২/১৯)।। এই আত্মা কখনও জাত বা মৃত হন না। কারণ, পূর্বে না থাকিয়া পরে বিদ্যমান হওয়ার নাম জন্ম এবং পূর্বে থাকিয়া পরে না থাকার নাম মৃত্যু; আত্মাতে এই দুই অবস্থার কোনটিই নাই। অর্থাৎ আত্মা জন্ম-ও মৃত্যু-রহিত, অপক্ষয়হীন এবং বৃদ্ধিশূন্য; শরীর নষ্ট হইলেও আত্মা বিনষ্ট হন না।’ (গীতা-২/২০)।।
কী মারাত্মক কথা– ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ অর্থাৎ, ‘হত্যা করলেও তাকে সত্যি হত্যা করা হয় না’। কাকে? পরমাত্মাকে। কেননা, পরমাত্মা অজয় অমর শাশ্বত সত্য। তার জন্ম নেই। মৃত্যু নেই। তাই-ই পরব্রহ্ম। পারমার্থিক সত্য। যদিও বৈদান্তিকের ব্যাখ্যায় কথাটার ধার কমিয়ে কৌশলি তর্জমায় বলা হয়েছে– ‘শরীর নষ্ট হইলেও আত্মা বিনষ্ট হন না।’ কিন্তু এই কথাটার উৎস কিন্তু গীতাও নয়। গীতায় উদ্ধৃত হয়েছে কেবল। মূলত গীতার এই কথাগুলি ‘কঠ-উপনিষদ্’-এর শ্লোকেরই পুনরুক্তি–
‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।
হন্তা চেন্মন্যতে হন্তুং হতশ্চেন্মন্যতে হতম্ ।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।। (কঠ-১/২/১৮-৯)
অর্থাৎ :
আত্মা বা পরমাত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। তাই শরীর হত্যা করলেও তাকে হত্যা করা যায় না। (কঠ-১/২/১৮)।। হত্যাকারী যদি মনে করে সে হত্যা করছে, হত ব্যক্তি যদি মনে করে তাকে হত্যা করা হচ্ছে– উভয়ের পক্ষেই মনে রাখা দরকার, এই আত্মাকে হত্যা করাও যায় না, তার হত্যাও সম্ভব নয়। (কঠ-১/২/১৯)।।
প্রকৃতপক্ষে শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মাদ্বৈত-বেদান্ত দর্শনের তথা গোটা ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের সার-কথাও এটাই। এই গোটা ভাববাদী দর্শন বলতে ভারতীয় ইতিহাসে চরম ভাববাদ– নামান্তরে শূন্যবাদ, ব্রহ্মাদ্বৈতবাদ, মায়াবাদ, পরব্রহ্মবাদ। এই দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য প্রকাশ করতে গিয়ে আচার্য শঙ্কর বলেছেন–
‘শ্লোকার্ধেন প্রবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্রন্থকোটিভিঃ।
ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।।’ (বেদান্তভাষ্য)
অর্থাৎ : কোটি কোটি গ্রন্থ যে সত্য প্রতিপাদন করতে ব্যস্ত, আচার্য তা শ্লোকার্ধেই ব্যক্ত করেছেন। এই মূল সত্য হলো– ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ।’
তার মানে কী দাঁড়ালো? এই মিথ্যা মায়ার জগতে মিথ্যা শরীরে কে মরলো, কে মারলো এগুলি ধর্তব্যের বিষয় নয়। আসল যে সত্য ব্রহ্ম বা পরমাত্মা, তিনি তো অবিকারই আছেন। অতএব এই মিথ্যা সংসারে ক্ষুধা তৃষ্ণা বঞ্চনা দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এগুলি সবই মিথ্যে মায়া মাত্র। এসব মিথ্যে নিয়ে বিচলিত হওয়াই তো বোকামি। সকল সত্যই তো পরলোকে। কিংবা এসবই পূর্বকৃত কর্মের ফল-সমষ্টি, যা ভোগ করে কমাতে না পারলে পরের জন্মেও এসব জন্মরূপ যন্ত্রণা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই। তাই নিজের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্যই এগুলি ভোগ করে ফেলা সুবুদ্ধির পরিচায়ক। সাধে কি আর ধর্মকে আফিম বলা হয়েছে!
‘আদিম মানবসমাজে ধর্মের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেণীবিভক্ত সভ্য সমাজের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের ভেদরেখাটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। আদিম সমাজে মানুষের প্রতিকূল শক্তি ছিল প্রকৃতি। সুতরাং প্রকৃতিতে দেবত্ব আরোপ করে কল্পিত দেবতার কাছে মানুষ তার কঠোর পরিশ্রমের সাফল্য প্রার্থনা করেছে। কিন্তু সভ্য সমাজের আবির্ভাবের পর প্রকৃতিকে বশীভূত করার প্রযুক্তিবিদ্যা মানুষ যখন আংশিকভাবে আয়ত্ত করেছে তখন মানুষের প্রতিকূল শক্তি রূপে দাঁড়িয়েছে মানুষ, ধর্মকঞ্চুকী শাসক শ্রেণী। পূর্বজন্মের কর্মফল, পরকালের স্বর্গ, নতুন নতুন দেবতা ও ঈশ্বরের আবির্ভাব শাসক শ্রেণীর কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। একমাত্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সম্রাট এক ঈশ্বরের কল্পনা বাদ দিলে বাকি সব ছোট বড় পৌরাণিক দেবতার মধ্যে অনেক দেবতার আবির্ভাব যে ঘটানো হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। খ্রিস্টজন্মের কয়েক শতাব্দী আগে কৌটিল্য, রাজকোষে অর্থাভাব ঘটলে নতুন কোনো দেবতার আবির্ভাব ঘটাতে হবে, এই মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে গেছেন। রাত্রির অন্ধকারে বাবরি মসজিদে রামসীতার আবির্ভাব ঘটানো হয়েছিল, এ তথ্য এখন ঐতিহাসিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা হিসাবে সুবিদিত।’- (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৬৭)
এখানে উল্লেখ আবশ্যক যে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কৌটিল্য কর্তৃক রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’কে ‘মহাভারতে’র (মহাভারত-১২/২৯০/১০৪) শান্তিপর্বে ‘যচ্চার্থশাস্ত্রে নৃপশিষ্টজুষ্টে’ অর্থাৎ, ‘শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের দ্বারা সেবিত শাস্ত্র’ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। অসাধারণ প্রজ্ঞাবান পণ্ডিত কৌটিল্য ছিলেন মৌর্য-সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধান অমাত্য ও উপদেষ্টা। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণ ‘বিনয়াধিকারিকম্’-এর ‘রাজপ্রণিধিঃ’ অধ্যায়ে রাজার করণীয় হিসেবে একজায়গায় কৌটিল্যের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য হলো–
‘প্রজাসুখে সুখং রাজ্ঞঃ প্রজানাং চ হিতে হিতম্ ।
নাত্মপ্রিয়ং হিতং রাজ্ঞঃ প্রজানাং তু প্রিয়ং হিতম্ ।। (অর্থশাস্ত্র-১/১৯/৫)।
অর্থাৎ : প্রজাগণের সুখ হলেই রাজার সুখ, প্রজাগণের হিত হলেই রাজার হিত; রাজার নিজের প্রিয় যে বিষয় তাতে তাঁর হিত নয়, প্রজাগণের যেটা প্রিয় তাতেই রাজার হিত।।
কিন্তু রাজকোষে অর্থাভাব ঘটলে অর্থসংগ্রহের প্রক্রিয়া হিসেবে ‘অর্থশাস্ত্রে’ যদি নতুন দেবতার আবির্ভাব ঘটনোর চতুর পরামর্শ বস্তুতই দেয়া হয়ে থাকে তাহলে এটি যে শাসকদল-কর্তৃক ধর্মের শঠ-ব্যবহারের অতি-গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক নজির হবে তাতে সন্দেহ নেই। প্রকৃতই এমন নজির রয়েছেও। যেমন, ‘অর্থশাস্ত্রে’র পঞ্চম অধিকরণ ‘যোগবৃত্তম্’-এর ‘কোশাভিসংগ্রহণম্’ অধ্যায়ে প্রথমেই কৌটিল্য বলছেন–
‘কোশমকোশঃ প্রত্যুৎপন্নার্থকৃচ্ছঃ সঙগৃহ্নীয়াৎ।’ (অর্থশাস্ত্র-৫/২/১)
অর্থাৎ : রাজার কোশ ক্ষীণ হয়ে পড়লে, যদি তিনি অর্থকৃচ্ছ্রতা অনুভব করেন, তাহলে তিনি বিবিধ অর্থ-সংগ্রহের দ্বারা কোশবৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হবেন।
বলা বাহুল্য, রাজ্যের কোষাগারে দণ্ড, কর ইত্যাদি বহু বহু উপায়ে নিয়মিত অর্থসংগ্রহের স্বাভাবিক যে ব্যাপক-বিস্তৃত প্রক্রিয়া সেটি তো আছেই। কিন্তু সেটাও যদি (যুদ্ধাদি) বিশেষ কোন কারণে রাজার পক্ষে অপ্রতুল হয়ে যায় এবং অন্য কোন স্বাভাবিক ও বৈধ প্রক্রিয়া না থাকে, তবে বিভিন্ন চতুর প্রক্রিয়ায় প্রজা ঠকিয়ে রাজাকে অর্থসংগ্রহ করতে হবে। এটাই এই ‘কোশাভিসংগ্রহণম্’ অধ্যায়ের প্রতিপাদ্য। ফলে অতঃপর কৌটিল্য এই অর্থসংগ্রহের অনেকগুলি প্রজা-ঠকানো চতুর উপায়ের বিস্তারিত প্রস্তাব করেছেন, তার অন্যতম প্রতারণামূলক ধর্ম-ব্যবহারের উপায়টি হলো, যা আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে প্রাসঙ্গিক ও অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক–
‘দেবতাধ্যক্ষো দুর্গ-রাষ্ট্র-দেবতানাং যথাস্বমেকস্থং কোশং কুর্যাৎ। তথৈব চাহরেৎ। দৈবত-চৈত্যং সিদ্ধ-পুণ্যস্থান-ভৌমবাদিকং বা রাত্রাবুত্থাপ্য যাত্রাসমাজাভ্যামাজীবেৎ। চৈত্যোপবনবৃক্ষেণ বা দেবতাভিগমনম্ অনার্তবপুষ্পফলযুক্তেন খ্যাপয়েৎ। মনুষ্যকরং বা বৃক্ষে রক্ষোভয়ং প্ররূপয়িত্বা সিদ্ধব্যঞ্জনাঃ পৌরজনাপদানাং হিরণ্যেন প্রতিকুর্যুঃ। সুরুঙ্গাযুক্তে বা কূপে নাগম্ অনিয়তশিরস্কং হিরণ্যোপহারেণ দর্শয়েদ্ নাগপ্রতিমায়ামন্তশ্ছিদ্রায়াম্ । চৈত্যচ্ছিদ্রে বল্মীকচ্ছিদ্রে বা সর্পদর্শনমাহারেণ প্রতিবদ্ধসংজ্ঞং কৃত্বা শ্রদ্দধানাম্ আদর্শয়েৎ। অশ্রদ্দধানানাম্ আচমন-প্রোক্ষণেষু রসমবপায্য দেবতাভিশাপং ব্রূয়াৎ। অভিত্যক্তং বা দংশয়িত্বা। যোগদর্শনপ্রতীকারেণ বা কোশাভিসংহরণং কুর্যাৎ।’- (অর্থশাস্ত্র-৫/২/৭)।।
অর্থাৎ :
‘দেবতাধ্যক্ষ’ (রাজ্যের যাবতীয় মঠ-মন্দির-আরাধনালয় ইত্যাদির তত্ত্বাবধায়ক) দুর্গস্থিত দেবতাদের (অর্থাৎ দেবমন্দিরগুলির) এবং রাষ্ট্রগত দেবতাদের (রাষ্ট্রস্থিত সব দেবমন্দিরের) ধন যথাযথভাবে একস্থানে সংগ্রহ করবেন, অর্থাৎ দুর্গদেবতাদের সম্পত্তি এক জায়গায় এবং রাষ্ট্রদেবতাদের সম্পত্তি আর এক জায়গায় সংগ্রহ করবেন (প্রজাসাধারণের কাছে তাঁরা এমন ছল করবেন যে, শত্রুপক্ষের সৈন্যরা এই সম্পত্তি দেবমন্দির থেকে অপহরণ করতে পারে, তাই এগুলি অন্যত্র সরিয়ে রাখা হচ্ছে)। এবং সেই ভাবেই (আলাদা আলাদা ভাবেই) সেই উভয় সম্পত্তি রাজার কাছে সমর্পণ করবেন। কোনও ‘সিদ্ধ’ পুণ্যস্থানে (পূর্ব থেকেই প্রসিদ্ধ এমন পবিত্রস্থানে) ভূমি ভেদ করে শিবলিঙ্গ আবির্ভূত হয়েছে– এই রকম ঘোষণা করে সেখানে রাত্রিতে (অর্থাৎ বিজনে) একটি ‘দৈবতচৈত্য’ (দেবতার বেদি) নির্মাণ করে (এবং তার উপর শিবলিঙ্গ স্থাপন করে), উক্ত দেবতাধ্যক্ষ সেখানে ‘যাত্রা’ (উৎসব) ও ‘সমাজের’ (বহু লোকের সম্মেলন বা মেলার) আয়োজন করে, দেবতার পূজার জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তার দ্বারা জীবিকানির্বাহ করবেন, অর্থাৎ উসবাদিতে উপস্থিত পুণ্যার্থীদের দ্বারা (দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসবশতঃ) প্রদত্ত অর্থ গোপনে রাজার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। অথবা, (দেবতাধ্যক্ষ) চৈত্যসংলগ্ন উপবনে কোনও একটি বিশেষ গাছ অ-ঋতুতে অর্থাৎ স্ব-ঋতুর অতিরিক্ত সময়ে (অর্থাৎ অকালে) পুষ্প ও ফলদ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে তা (কৌশলের সাথে) দেখিয়ে খ্যাপিত করবেন যে, ঐ গাছে দেবতার আবির্ভাব হয়েছে। (এবং ভক্তি ভরে লোকেরা ঐ দেবতার উদ্দেশ্যে যে অর্থ দান করবে, দেবতাধ্যক্ষ তা গোপনে রাজার কাছে পাঠিয়ে দেবেন)। অথবা, সিদ্ধ পুরুষের বেশধারী গুপ্তচরেরা (শ্মশান ভূমির কাছাকাছি) কোনও গাছে রাক্ষসের বেশধারণ করে অবস্থান করে, ‘আমাকে প্রতিদিন এক একজন মানুষকে কররূপে (অর্থাৎ খাদ্যরূপে) দিতে হবে, তা না হলে আমি সকলকে একসাথে ভক্ষণ করব’– এইভাবে মিথ্যা-রাক্ষস-কৃত নির্দিষ্ট ‘মনুষ্যকর’– (মানুষ-বলি)-রূপ ভয় উৎপাদন করে পুরবাসী ও জনপদবাসীদের কাছ থেকে প্রভূত হিরণ্য (নগদ টাকা) নিয়ে সেই ভয়ের প্রতিকার করবে (অর্থাৎ প্রতীকার করার ছল করবে) এবং সেই টাকা রাজাকে গোপনে অর্পণ করবে। অথবা, কোনও সুরুঙ্গযুক্ত কূপে রক্ষিত একটি অন্তশ্ছিদ্রযুক্ত নাগপ্রতিমাতে (অর্থাৎ একটি কৃত্রিম নাগমূর্তি দেখানো হবে, কিন্তু যার ভিতর ফাঁকা) কৌশলে ‘অনিয়তশিরস্ক’ অর্থাৎ ত্রিশীর্ষ বা পঞ্চশীর্ষযুক্ত (বা অসংখ্য শীর্ষযুক্ত) অদ্ভূত নাগ (দর্শকবৃন্দকে) দেখিয়ে (দেবতাধ্যক্ষ) দর্শকদের কাছ থেকে হিরণ্য (টাকা) উপহার হিসাবে গ্রহণ করবেন (এবং তা গোপনে রাজার কাছে পাঠিয়ে দেবেন)। অথবা, কোনও দৈবতচৈত্যের (দেবতার বেদি) বা বল্মীকের ছিদ্রে দৈবাৎ কোনও সাপ দেখা গেলে, সেই সাপকে ‘আহার’ অর্থাৎ আয়ত্তীকরণের সাধনভূত মন্ত্র ও ওষধির প্রয়োগদ্বারা নিরুদ্ধগতি করে শ্রদ্ধাবান (বিশ্বাসকারী) লোকদের দেখাবেন (অর্থাৎ দেবতার সান্নিধ্যপ্রভাবে সাপটির সংজ্ঞা প্রতিবদ্ধ হয়েছে একথা বিশ্বাস করাবে)। যারা এ ব্যাপারে শ্রদ্ধাহীন হবে (অর্থাৎ বিশ্বাস করবে না) তাদের আচমন ও ‘প্রোক্ষণ’ অর্থাৎ স্নানের দ্রব্যে (জল প্রভৃতিতে) অল্পমাত্রায় বিষ মিশ্রিত করে (অর্থাৎ এমন পরিমাণ বিষ মেশাতে হবে যাতে তার কেবলমাত্র মোহগ্রস্ত হয়, তাদের যেন প্রাণসংশয় না হয়) তাদের মোহিত করে ‘এই ব্যক্তিরা নাগদেবতার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী হয়েছিল, তাই নাগদেবতার অভিশাপে অর্থাৎ কোপে এই মোহপ্রাপ্তি’ এই বলে প্রচার করবে। অথবা, এই সব দেবনিন্দকদের মধ্যে যদি কেউ ‘অভিত্যক্ত’ (শাস্তিরূপে পূর্ব থেকেই বধ্য হওয়ার সাজাপ্রাপ্ত) থাকে, তাহলে (রাত্রিতে গোপনে) সাপ দিয়ে তাকে দষ্ট করিয়ে (দেবতার অভিশাপ বলে প্রচার করবে)। অথবা, ‘যোগদর্শন’ প্রতীকারের দ্বারা অর্থাৎ ‘ঔপনিষদিক’ অধিকরণে প্রোক্ত বিষাদিযোগের প্রতীকার দ্বারা সাপ দ্বারা দষ্ট লোকদের কাছ থেকে ধন গ্রহণ করে রাজকোশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করবে। (অর্থশাস্ত্র-৫/২/৭)।। (মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়-কৃত তর্জমা)।
আজ থেকে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগেই রাজার কর্তব্যে কৌটিল্যের এই পরামর্শ কতোটা কার্যকর ও অনুসরণীয় ছিলো তা অনুধাবণ করতে খুব একটা কল্পনাপ্রবণ হওয়ারও দরকার আছে কি? পরবর্তীকাল থেকে এই কথিত বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের বর্তমান কালেও এর ভুরি ভুরি নজির আমাদের আশেপাশেই যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এইসব ঘটনাপুঞ্জে থাকে বা রয়েছে রাষ্ট্রের বা শাসকের তথা প্রভাবশালী সমাজপতিদের ইন্ধন ও অনুমোদন। কারণ, আগেই বলা হয়েছে, ধর্মের সঙ্গে শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রশক্তির গাঁটবন্ধনের মর্মার্থ হলো, ধর্ম একটি লাভজনক ব্যবসায়ে রূপান্তরিত হয়। এবং শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রশক্তি যখন ধর্মে অনুপ্রবেশ করে, তখন ধর্ম হয় প্রতারকের ছদ্মবেশ, চার্বাকের ভাষায় কঞ্চুক।
‘মানুষ যদি দেবতা বা ঈশ্বরে বিশ্বাসের মোহ ত্যাগ করতে পারতো তা হলে কিন্তু ধর্মের ব্যবসা সম্ভব হতো না। তাই ধর্মের ব্যাসায়ে জাঁকিয়ে বসার জন্য মানুষের বিশ্বাসকে দেবতার ঘরে বন্ধক রাখার প্রয়োজন আছে এবং এই পরবঞ্চক শ্রেণীর পক্ষে ধর্মবিশ্বাসে উৎসাহ বৃদ্ধির জন্য যত্র তত্র দেবতা সৃষ্টির প্রয়োজন আছে, নব জাগ্রত দেবতার অলৌকিক মহিমা প্রচারের জন্য ভাড়াটিয়া দালাল বাহিনীর প্রয়োজন আছে।’ -(হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাক-দর্শন, পৃষ্ঠা-১৮)
চার্বাক ‘সভ্যযুগীয়’ দেবতা ও ঈশ্বরের এই কল্পনাবৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছিলেন, সভ্যযুগের দেবতা ও ঈশ্বর এবং তার আনুষঙ্গিক কল্পনাজাল কীভাবে শাসক ও যাজক শ্রেণীর শঠতার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিলো সেই সত্য নির্মমভাবে উদ্ঘাটন করেছিলেন। অন্তত একথা চিন্তা করে লোকায়ত চার্বাক দর্শনের সামাজিক ও দার্শনিক তাৎপর্য অনুধাবনের চেষ্টা করা কর্তব্য বলে মনে হয়।
এই বর্ণবিভাজনকারী প্রতারণামূলক ভাববাদী দর্শনসঞ্জাত ধর্ম-ব্যবস্থাটাকে শাসকশ্রেণী যে তার নিজ স্বার্থেই টিকিয়ে রাখবে তাতে আর আশ্চর্যের কী ! আমরা ইতঃপূর্বে ধর্মীয় সমাজ-ব্যবস্থায় অনুশাসনমূলক বর্ণবাদী বিধানগুলির গুটিকয় বিষয় ‘মনুস্মৃতি’র আলোচনায় উল্লেখ করেছিলাম। এগুলি যে সেকালে রাষ্ট্রের জন্যেও আবশ্যকীয় নীতির অন্তর্ভুক্ত ছিলো তার প্রমাণও এই ‘অর্থশাস্ত্র’। বলা যায় রাষ্ট্রশাসন ও পরিচালনায় রাজার কর্তব্যের মধ্যে গোটা মনুস্মৃতির প্রায় সমস্ত অনুশাসনের প্রতিধ্বনি শোনা যায় কৌটিল্যের বয়ানেও। যেমন–
[বর্ণধর্মাঃ] : স্বধর্মো ব্রাহ্মণস্যাধ্যয়নমধ্যাপনং যজনং যাজনং দানং প্রতিগ্রহশ্চেতি। ক্ষত্রিয়স্যাধ্যয়নং যজনং দানং শস্ত্রাজীবো ভূতরক্ষণং চ। বৈশ্যস্যাধ্যয়নং যজনং দানং কৃষিপাশুপাল্যে বণিজ্যা চ। শূদ্রস্য দ্বিজাতিশুশ্রূষা বার্তা কারুকুশীলবকর্ম চ।’- (অর্থশাস্ত্র-১/৩/১)।।
[সর্বসাধারণাঃ ধর্মাঃ, সর্বেষাং স্ব-স্ব-ধর্মানুষ্ঠানাবশ্যকতা চ] : সর্বেষাম্ অহিংসা সত্যং শৌচম্ অনসূয়া আনৃশংস্যং ক্ষমা চ। স্বধর্মঃ স্বর্গায়ানন্ত্যায় চ। তস্যাতিক্রমে লোকঃ সঙ্করাদুচ্ছিদ্যেত।
[ধর্মানুষ্ঠানস্য রাজধর্মতা] :
তস্মাৎ স্বধর্মং ভূতানাং রাজা ন ব্যভিচারয়েত্ ।
স্বধর্মং সংদধানো হি প্রেত্য চেহ চ নন্দতি।।
ব্যবস্থিতার্যমর্যাদঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতিঃ।
ত্রয্যা হি রক্ষিতো লোকঃ প্রসীদতি ন সীদতি।।- (অর্থশাস্ত্র-১/৩/৩)।
অর্থাৎ :
[বর্ণধর্ম] : ব্রাহ্মণের স্বধর্ম হলো– অধ্যয়ন (বেদাদি পাঠ), অধ্যাপনা (অন্যকে পাঠদান), যজন (স্বহিতার্থে যজ্ঞসম্পাদন), যাজন (পরহিতার্থে যজ্ঞানুষ্ঠান), দান (অন্যকে দানকর্ম) ও প্রতিগ্রহ (অন্যের থেকে দানগ্রহণ)। ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম– অধ্যয়ন, যজন, দান শস্ত্রোপজীবিত্ব (শস্ত্র ব্যবহারের দ্বারা জীবিকার্জন) ও লোকরক্ষণ অর্থাৎ প্রাণীগণকে রক্ষা করা। বৈশ্যের ক্ষেত্রে অধ্যয়ন, যজন, দান, কৃষিকাজ, পশুপালন ও বাণিজ্যকর্ম– এগুলি স্বধর্ম। আর ব্রাহ্মণাদি তিন দ্বিজাতির সেবা, বার্তা অর্থাৎ কৃষিকার্য, পশুপালন ও বাণিজ্যকরণ এবং কারুকর্ম (শিল্পীর কাজ) ও কুশীলবকর্ম (চারণাদির কাজ)– এগুলি শূদ্রের স্বধর্ম। (অর্থশাস্ত্র-১/৩/১)।।
সকল বর্ণের ও সকল আশ্রমের পক্ষে আচরণীয় সাধারণ ধর্ম হলো– অহিংসাচরণ, সত্যনিষ্ঠা, (কায়, মন ও বাক্যে–) শুদ্ধি, অসূয়াহীনতা (অর্থাৎ গুণপক্ষপাত), আনৃশংস্য অর্থাৎ অনিষ্ঠুরতা বা দয়ার্দ্ররূপ হৃদয়তা এবং ক্ষমা। স্বধর্মপালন স্বর্গপ্রাপ্তিজনিত সুখের এবং অনন্তসুখপ্রদ মোক্ষপ্রাপ্তির সাধন। স্বধর্মের লঙ্ঘন হলে লোকসমাজ (কর্মসঙ্কর, বর্ণসঙ্কর– ইত্যাদি) সংমিশ্রণহেতু উচ্ছেদপ্রাপ্ত হবে।
অতএব প্রাণিবর্গ যাতে স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত না হয়, সেজন্য রাজার প্রয়াস করা কর্তব্য। যে রাজা তাঁর প্রজাদের মধ্যে স্বধর্মানুষ্ঠান সম্যগ্ভাবে ব্যবস্থাপিত করতে পারেন, তিনি ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হন।
যে লোকসমাজে আর্যমর্যাদা অর্থাৎ সদাচারের নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠিত থাকে, যে যে লোকসমাজে বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম পরিপালিত হয় এবং ত্রয়ী-ধর্মের দ্বারা অর্থাৎ বেদ অধ্যয়নের দ্বারা সংরক্ষিত হয় যে লোকসমাজ, সেই সমাজে প্রজালোক (সুখসমৃদ্ধিহেতু) প্রসন্ন থাকে এবং (কখনোই) বিনাশপ্রাপ্ত হয় না। (অর্থশাস্ত্র-১/৩/৩)।।
এতোসব কথার সার-কথাটা কিন্তু এটাই যে, মানুষরূপী প্রাণীদের স্বধর্ম-স্বরূপ বর্ণধর্মটা হলো সবার উপরে। রাজা কাউকে এর অন্যথা করার সুযোগ দিতে পারেন না প্রজালোকের স্বার্থে তথা তাঁর শাসনের স্বার্থেই। এটাই রাজার উপর অর্পিত ধর্ম। অতএব রাজার শাসন-প্রক্রিয়ায় বিচারকার্যে দণ্ডবিধানের নিয়মে ‘ব্রাহ্মণদণ্ডক্রমঃ’-তে এমন বিধান থাকা আশ্চর্যের নয়–
‘সর্বাপরাধেষু অদণ্ডনীয়ো ব্রাহ্মণঃ।’ (অর্থশাস্ত্র-৪/৮/৯)
অর্থাৎ : সকল রকম অপরাধের ক্ষেত্রেই অপরাধী ব্রাহ্মণকে বধ-তাড়নাদির দ্বারা দণ্ড দেওয়া যাবে না।
তবে গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে অভিশপ্ত কোনো চিহ্ন দ্বারা চিহ্নিত করে রাজ্য থেকে তাকে নির্বাসিত করা যেতে পারে, কিংবা তাকে আকর প্রদেশে বা খনিময় প্রদেশে বাস করানো যায়। এছাড়া অর্থদণ্ডের স্থলেও ব্রাহ্মণ কতকগুলি বিশেষ সুবিধা ভোগ করতেন। শ্রোত্রিয় বা বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণকে কোনো প্রকার কর দিতে হতো না। বহু দিন ভোগ দখল করলেও শ্রোত্রিয়ের সম্পত্তিতে অন্য কারুর অধিকার জন্মাতো না। যুদ্ধে জয়লাভ করেও বিজয়ী রাজা শ্রোত্রিয়ের সম্পত্তি দখল করতে পারতেন না, তাঁকে ফিরিয়ে দিতে হতো। এসব সুবিধা পাবেন-নাই-বা-কেন, এই ব্রাহ্মণ যাজক-সম্প্রদায়ই তো ধর্মকে ধারণ করে শাসকশ্রেণীর শাসনের সহায়ক ভিত্তি রূপে প্রতিষ্ঠিত!
বস্তুবাদী চার্বাকেরা এটা ভালো করেই জানতেন, বুঝতেন এবং এইসব প্রবঞ্চনাময় অপবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বাস্তববাদী যুক্তির অস্ত্র নিয়ে প্রতিবাদী বিদ্রোহী হয়ে তাদের গোমড় ফাঁস করতে উদ্যত হয়েছিলেন বলেই বাকি সব ভাববাদে পরিপূর্ণ অধ্যাত্মবাদী গোষ্ঠি তথা ধর্ম-ব্যবসায়ীরা চার্বাকদের উপর সোজাকথায় মারমুখী হয়ে উঠেছিলেন।