উদ্দালক আরুণি সংবাদ: উপনিষদে বস্তুবাদের অনন্য নজির
আমরা জানি, যা বেদ-এর অন্ত, তাই বেদান্ত। চলতি কথায়, বেদের শেষভাগ। নামান্তরে তাই উপনিষদ বলে খ্যাত, কেননা বৈদিক ঐতিহ্যের দাবি অনুসারে উপনিষদ্-সাহিত্য বেদের শেষভাগ। বেদের মর্যাদায় অধিষ্ঠানের কারণে এই উপনিষদের বাণীও বেদসম্মত দর্শন সম্প্রদায়ের নিকট বেদের মতোই ‘শ্রুতি’র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তবে এযাবৎ ১১২টি উপনিষদ নামক গ্রন্থের কথা জানা গেলেও সবগুলিকে ‘শ্রুতি’র মর্যাদা দেয়া হয়নি। স্বভাবতই ‘উপনিষদ’ নাম ব্যবহৃত হলেও এ-জাতীয় সকল গ্রন্থাবলীকে প্রকৃত বৈদিক ‘উপনিষদ’ মনে করবার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগেও বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি প্রাচীন (আরণ্যক’ও) ‘উপনিষদ’ই কোনো-না-কোনো ‘বেদ’ বা বেদের শাখার সঙ্গে সংযোজিত। তাই যেগুলি বেদের অঙ্গীভূত বা ঐতিহ্য অনুসারে বেদের সাথে সংযুক্ত নয় সেগুলিকে বৈদিক সাহিত্যের অংশ বলে স্বীকার করা হয় না। অর্থাৎ সেগুলি অনেক পরে রচিত হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বেদবিদ পণ্ডিতেরা প্রকৃত বৈদিক উপনিষদ হিসেবে একটি তালিকা প্রস্তুত করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপনিষদগুলি হলো,– ঈশ, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, প্রশ্ন, কেন, কঠ, মুণ্ডক, মাণ্ডূক্য, কৌষীতকি, মৈত্রী ও শ্বেতাশ্বতর এই তেরোটি উপনিষদ। তার মধ্যে ছান্দোগ্য উপনিষদ একেবারে প্রথমকালের উপনিষদ।
এই উপনিষদ্-সাহিত্যেরই এখানে ওখানে বস্তুবাদের উল্লেখ যে আছে সেকথা অনেক আধুনিক বিদ্বানই আলোচনা করেছেন। কিন্তু প্রায় সকলের মতেই উল্লেখগুলো পূর্বপক্ষ মাত্র। অর্থাৎ, প্রচলিত মতে উপনিষদ্-এর দার্শনিক সারাংশ বলতে ভাববাদই, যদিও ঠিক কোন্ ধরনের ভাববাদ তা নিয়ে পরবর্তীকালের উপনিষদ্-অনুগামী বা বৈদান্তিকদের মধ্যেই অনেক তর্কবিতর্ক আছে। এবং এ-প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে বিভিন্ন বৈদান্তিক সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু যে-অর্থেই ভাববাদ হোক-না-কে, তার সমর্থনে বস্তুবাদ খণ্ডন ও বর্জনের প্রয়োজন। অর্থাৎ উপনিষদে বস্তুবাদের উল্লেখ আসলে পূর্বপক্ষই।
কিন্তু এই প্রচলিত মতের বাইরেও তার বদলে দেখানো সম্ভব যে– ‘উপনিষদেরই জনৈক প্রখ্যাত ঋষির মতকে সংস্কারমুক্ত মনে বিচার করলে বোঝা যায় যে তাঁর মতের সারাংশ বস্তুবাদ বলে স্বীকৃত হতে বাধ্য।
ঋষিটির নাম উদ্দালক আরুণি। ‘ছান্দোগ্য-উপনিষদ্’-এর একটি পুরো অধ্যায়ে তাঁর মত বর্ণিত হয়েছে। সে-মতের সারমর্ম যে আসলে বস্তুবাদই– এই দাবি খুব একটা অভিনব নয়। ইতিপূর্বে জ্যাকবি (H. Jacobi)– এবং তাঁর প্রিয় শিষ্য ওয়ালটার রুবেন (Walter Ruben)– বিচারমূলকভাবেও বিষয়টি প্রদর্শন করেছেন। কিন্তু আমাদের আধুনিক বিদ্বানেরা উপনিষদ্-এর প্রথাগত ব্যাখ্যায় এমনই অভ্যস্ত যে জ্যাকবি ও রুবেন-এর মতো দিক্পাল ভারততত্ত্ববিদদের বিচারকে একান্ত অনাদরের কুক্ষিতে গোপন রাখা ছাড়া তাঁদের যেন গত্যন্তর নেই। মোটের উপর তাই জ্যাকবি ও রুবেন-এর বিচার বিশেষ সুবিদিত নয়।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১০২)
এই কুক্ষি থেকে তাঁদের বিচার বের করে আনা সময়ের প্রয়োজনেই আবশ্যক মনে হয়। তবে তা করার আগে আরেকটি সহায়ক সাক্ষ্য স্মরণ করা যেতে পারে। প্রখ্যাত নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টর কথা ইতঃপূর্বে একাধিকবার উল্লিখিত হয়েছে। তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে চার্বাকদের ভূতচৈতন্যবাদ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে তিনি পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকমতের একটা যুক্তির উল্লেখ করেছিলেন–
‘ভূতেষ্বন্নপানাদ্যুপযোগপুষ্টেষু পাট্বী চেতনা ভবতি তদ্বিপর্যয়ে বিপর্যয়ঃ, ব্রাহ্মীঘৃতাদ্যুপযোগসংস্কৃতে চ কুমার শরীরে পটুপ্রজ্ঞতা জায়তে।’- (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ :
(চার্বাকমতে) বুদ্ধি বা চৈতন্যের বিকাশ শরীরের সম্যক পরিপুষ্টির উপর নির্ভরশীল। ভোজন, পান ইত্যাদির দ্বারা দেহ পুষ্ট থাকলেই চৈতন্যের সতেজ স্ফূর্তি দৃষ্ট হয়। ব্রাহ্মীঘৃত অথবা অন্য ঔষধাদি সেবনের ফলে বালকের মধ্যেও যথেষ্ট প্রজ্ঞার সঞ্চার হতে দেখা যায়।
যুক্তিটির সংক্ষিপ্ত সারাংশ হলো,– অন্নপানাদি দ্বারা শরীর পুষ্ট হলে চেতনার উৎকর্ষ দেখা যায়; কিন্তু শরীরে পুষ্টির অভাব হলে চেতনাও ক্ষুণ্ন হয়। তাছাড়া ব্রাহ্মীঘৃত খেলে চেতনা বা জ্ঞান বাড়ে। কিন্তু অন্নাদিই বলুন বা ব্রাহ্মীঘৃতই বলুন– এগুলি তো নেহাতই ভূতবস্তু। তাহলে মানতেই হবে, ভূতবস্তুর আধিক্য থাকলে চৈতন্য বাড়ে, ভূতবস্তুর অভাব ঘটলে চৈতন্য কমে। অতএব চৈতন্য ও ভূতবস্তুর মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ স্বীকার করতে হবে। জয়ন্তভট্টর বিচারে এই কথা নিছক ভূতচৈতন্যবাদীর কথা, চার্বাকের কথা।
কী যুক্তি দিয়ে জয়ন্তভট্ট এই যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেছেন তা ইতঃপূর্বে আলোচিত হয়েছে, বর্তমান আলোচনায় তা প্রধান প্রশ্ন নয়। বড়ো প্রশ্ন হলো, চার্বাকের ভূতচৈতন্যবাদের সমর্থনে এরকম যুক্তি জয়ন্তভট্ট কোথা থেকে পেলেন? ব্রাহ্মীঘৃতর কথাটা যে আয়ুর্বেদ থেকে পাওয়া এ-বিষয়ে হয়তো মতান্তর হবে না। কিন্তু গোটা যুক্তিটার কাঠামোর মধ্যে তা তো একটা দৃষ্টান্তমাত্র। আসল প্রশ্ন হলো ওই গোটা যুক্তিটার কাঠামো নিয়ে। অন্ন প্রভৃতি নিছক ভূতবস্তুর বর্তমানতায় চৈতন্য বাড়ে, অবর্তমানতায় চৈতন্য কমে। অতএব ভূতবস্তুই চৈতন্যের আসল কারণ।
‘এ-হেন কোনো যুক্তি জয়ন্তভট্ট অধুনালুপ্ত চার্বাকদেরই কোনো রচনা থেকে সংকলন করেছিলেন, তা দাবি করতে যাওয়া কল্পনা-প্রাবল্যেরই পরিচায়ক হবে। যুক্তিটা কি তাহলে তিনি নিছক নিজের মাথা খাটিয়ে উদ্ভাবন করেছিলেন? এমনতর দাবি করারও সত্যিই কোনো কারণ নেই। কেননা, উপনিষদ্-সাহিত্যেই উদ্দালক আরুণির মত প্রসঙ্গে যুক্তিটার অন্তত সারাংশ বর্তমান। আরো বড় কথা হলো, উদ্দালক পরীক্ষামূলকভাবে যুক্তিটা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে পরীক্ষামূলকভাবে কোনো বিষয় প্রমাণ করার এর চেয়ে প্রাচীন কোনো নিদর্শন আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। সেদিক থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনায় প্রচলিত পাশ্চাত্য-কেন্দ্রিকতা অবশ্যই তার একটা কারণ। কিন্তু সেই সঙ্গে ভারতীয় বিদ্বানদের পক্ষে উদ্দালককে নিছক আত্মাবাদী বা ভাববাদী বলে ধরে নেবার সুদীর্ঘ প্রথাও নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ দায়মুক্ত নয়।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১০৩)
সে যাক, উদ্দালকের আলোচনায় ফেরা যাক। বর্তমান আলোচনায় উদ্দালকের দার্শনিক মত পুরোটা উদ্ধৃত করার দরকার নেই বা সেই বিস্তৃত উদ্ধৃতির সুযোগও নেই। যেটুকু প্রাসঙ্গিক শুধু সেটুকুরই সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া যাবে। তবু তার আগে উপনিষদীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে কিছু নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে। ‘ছান্দোগ্য-উপনিদ্’-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ষোলটি খণ্ডে এই উদ্দালক আরুণি ও শ্বেতকেতু সংবাদ বিস্তৃতভাবে বর্ণিত আছে। উদ্দালকের বক্তব্যটি একটা আখ্যানের রূপে প্রকাশিত। তা থেকে খুঁটে খুঁটে প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিগুলি তর্জমাসহ উপস্থাপন করা হলো, আশা করি আগ্রহী পাঠকের খুব বেশি ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে না–
‘ওঁ। শ্বেতকেতুর্হারুণেয় আস তং হ পিতোবাচ শ্বেতকেতো বস ব্রহ্মচর্যং ন বৈ সোম্যাস্মৎকুলীনোহননূচ্য ব্রহ্মবন্ধুরিব ভবতীতি। (ছান্দোগ্য-৬/১/১)।। স হা দ্বাদশবর্ষ উপেত্য চতুর্বিংশতিবর্ষঃ সর্বান্ বেদানধীত্য মহামনা অনূচানমানী স্তব্ধ এয়ায় তং হ পিতোবাচ শ্বেতকেতো যন্নু সোম্যেদং মহামনা অনূচানমানী স্তব্ধোহস্যুত তমাদেশমপ্রাক্ষ্যঃ–। (ছান্দোগ্য-৬/১/২)।। যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতমিতি কথং নু ভগবঃ স আদেশো ভবতীতি। (ছান্দোগ্য-৬/১/৩)।। যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্ বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্ । (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)।। যথা সৌম্যৈকেন লোহমণিনা সর্বং লোহময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং লোহমিত্যেব সত্যম্ । (ছান্দোগ্য-৬/১/৫)।। ন বৈ নূনং ভগবন্তস্ত এতদবেদিষুর্যদ্ধ্যেতদবেদিষ্যন্ কথং মে নাবক্ষ্যন্নিতি ভগবাংস্ত্বেব মে তদ্ ব্রবীত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ। (ছান্দোগ্য-৬/১/৭)।।
অর্থাৎ :
শ্বেতকেতু নামে উদ্দালক আরুণির এক পুত্র ছিলেন। একবার আরুণি তাঁর পুত্রকে বললেন, ‘শ্বেতকেতু, তুমি ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে গুরুগৃহে বাস করো। আমাদের বংশে বেদ অধ্যয়ন না করে শুধু নামে মাত্র ব্রাহ্মণ হয়েছেন এমন কেউ নেই। (ছান্দোগ্য-৬/১/১)।। বারো বছর বয়সে শ্বেতকেতু গুরুগৃহে গেলেন। চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানে থেকে সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করে গম্ভীরচিত্ত, অবিনয়ী ও পাণ্ডিত্যের অহংকারে পূর্ণ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাঁর পিতা তাঁকে বললেন, ‘শ্বেতকেতু, তুমি দেখছি গম্ভীর, পাণ্ডিত্যাভিমানী ও অবিনীতস্বভাব হয়ে ফিরে এসেছো। কিন্তু তুমি কি সেই উপদেশের কথা গুরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলে–। (ছান্দোগ্য-৬/১/২)।। –যে উপদেশের সাহায্যে অশ্রুতবিষয় শোনা যায়, অচিন্তনীয় বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়।’ (শ্বেতকেতু জিজ্ঞাসা করলেন) ‘ভগবন্, কী সেই উপদেশ?’ (ছান্দোগ্য-৬/১/৩)।। হে সোম্য, যেমন একখণ্ড মাটিকে জানলেই মাটির তৈরি সব জিনিসকে জানা যায়। জিনিসগুলি নামে আলাদা বা নামের বিকার, কেবলমাত্র মাটিই সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/১/৪)।। হে সোম্য, একতাল সোনাকে জানলে যেমন সোনার তৈরি সব জিনিসকেই জানা যায়। সোনার অলঙ্কারগুলি কেবল নামের বিকার, কতগুলি শব্দ মাত্র। সোনাই একমাত্র সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/১/৫)।। (শ্বেতকেতু বললেন)– ‘আমার পূজনীয় আচার্যগণ নিশ্চয়ই এ সত্য জানতেন না। যদি জানতেন তবে বললেন না কেন? অতএব ভগবন্, আপনি আমাকে তা বলুন।’ পিতা বললেন, ‘সোম্য, তাই হোক।’ (ছান্দোগ্য-৬/১/৭)।।
..
সদেব সোম্যেদমগ্র আসীৎ একমেবাদ্বিতীয়ম্ । তদ্ধৈক আহুরসদেবেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ং তস্মাদসতঃ সজ্জায়ত। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।। কুতস্তু খলু সোম্যৈবং স্যাদিতি হোবাচ কথমসতঃ সজ্জায়েতেতি। সদেব সোম্যেদমগ্র আসীৎ একমেবাদ্বিতীয়ম্ । (ছান্দোগ্য-৬/২/২)।। তদৈক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোহসৃজত তত্তেজ ঐক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি তদপোহসৃজত তস্মাদ্ যত্র ক্ব চ শোচতি স্বেদতে বা পুরুষস্তেজস এব তদধ্যাপো জায়ন্তে। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)।। তা আপ ঐক্ষন্ত বহ্ব্যঃ স্যাম প্রজায়েমহীতি তা অন্নমসৃজন্ত তস্মাদ্যত্র ক্ব চ বর্ষতি তদেব ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবত্যদ্ভ্য এব তদধ্যন্নাদ্যং জায়তে। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।।
অর্থাৎ :
হে সোম্য, এই দৃশ্যমান জগৎ প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় সৎরূপে বিদ্যমান ছিলো। এই বিষয়ে কেউ কেউ বলেন, ‘এই জগৎ প্রকাশের আগে এক ও অদ্বিতীয় অসৎরূপে বিদ্যমান ছিলো’ অর্থাৎ তখন কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিলো না। সেই অসৎ থেকেই সৎ হয়েছে। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।। পিতা বললেন, ‘কিন্তু সোম্য, তা কী করে হতে পারে? অসৎ (অর্থাৎ শূন্য) থেকে কী করে সৎ (অস্তিত্ব) উৎপন্ন হতে পারে? প্রকৃতপক্ষে, হে সোম্য, এই জগৎ প্রকাশিত হওয়ার আগে এক ও অদ্বিতীয় সৎরূপেই বর্তমান ছিলো।’ (ছান্দোগ্য-৬/২/২)।। সেই সৎ-বস্তু সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ তারপর তেজ অর্থাৎ অগ্নি সৃষ্টি হলো। সেই তেজও সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি বহু হবো, উৎকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ সেই তেজ থেকে জল উৎপন্ন হলো। তাই যখনই মানুষ শোক করে বা ঘর্মাক্ত হয়, তখনই তেজ থেকে জল উৎপন্ন হয়। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)।। সেই জল সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি বহু হবো, প্রকৃষ্টরূপে উৎপন্ন হবো।’ সেই জল থেকে অন্ন (পৃথিবী) সৃষ্টি হলো। এইজন্য যেখানে যখন বৃষ্টি পড়ে, সেখানেই প্রভূত অন্ন উৎপন্ন হয়। এই অন্নই পৃথিবী। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।।
..
তেষাং খল্বেষাং ভূতানাং ত্রীণ্যৈব বীজাণি ভবন্ত্যান্ডজং জীবজমুদ্ভিজ্জম্ ইতি। (ছান্দোগ্য-৬/৩/১)।। সেয়ং দেবতৈক্ষত হন্তাহম্ ইমাঃ তিস্র দেবতা অনেন জীবেন আত্মনাহনুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরবাণীতি। (ছান্দোগ্য-৬/৩/২)।। তাসাং ত্রিবৃতং ত্রিবৃতমেকৈকাং করবাণীতি সেয়ং দেবতা ইমাস্তিস্রো দেবতা অনেনৈব জীবেন আত্মন অনুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরোৎ। (ছান্দোগ্য-৬/৩/৩)।।
অর্থাৎ :
এই জগতে যত ভূত আছে, বিষয় আছে, জীবন আছে, সবই এই ত্রিবিৎকরণ বা তিনের (তেজ, জল, অন্ন) মধ্যে। যেমন– অণ্ডজ (ডিম থেকে জাত), জীবজ (জীব বা পিতামাতার থেকে জাত) এবং উদ্ভিজ্জ (উদ্ভিদ থেকে জাত)। এই তিনের বাইরে কিছু নেই। (ছান্দোগ্য-৬/৩/১)।। পূর্বোক্ত সেই সৎবস্তুস্বরূপ দেবতা আবার সঙ্কল্প করলেন, ‘আমি এই তিন দেবতার (অর্থাৎ তেজ, জল ও অন্ন বা পৃথিবীর) মধ্যে আত্মরূপে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে নামে রূপে প্রকাশ করি না কেন?’ (ছান্দোগ্য-৬/৩/২)।। ‘উক্ত তিন দেবতার প্রত্যেককে আগে ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ (তিন তিন ভাগে বিভক্ত) করে দিই। প্রত্যেকের মধ্যেই প্রত্যেকের কিছু কিছু অংশ ঢুকিয়ে দিই।’ এই ভেবে তিনি এঁদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে নিজেকে নানা নামে-রূপে প্রকাশ করলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৩/৩)।।
..
যদগ্নে রোহিতং রূপং তেজসঃ তদ্রূপং, যৎ শুক্লং তদপাং, যৎ কৃষ্ণং তদন্নস্য; অপাগাৎ অগ্নেরগ্নিত্বং; বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং; ত্রীণিং রূপাণীত্যেব সত্যম্ । (ছান্দোগ্য-৬/৪/১)।। এতদ্ধ স্ম বৈ তদ্বিদ্বাংস আহুঃ পূর্বে মহাশালা মহাশ্রেত্রিয়া ন নোহদ্য কশ্চন অশ্রুতম্ অমতম্ অবিজ্ঞাতম্ উদাহরিষ্যতীতি, হি এভ্যো বিদ্যাঞ্চক্রুঃ। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৫)।। যদু রোহিতমিবাভূদিতি তেজসঃ তদ্ রূপমিতি, তৎ বিদ্যাঞ্চক্রুঃ; যদু শুক্লমিবাভূদিতি অপাং রূপমিতি, তৎ বিদ্যাঞ্চক্রুুঃ; যদু কৃষ্ণমিবাভূদিতি অন্নস্য রূপমিতি, তৎ বিদ্যাঞ্চক্রুঃ। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৬)।। যদু অবিজ্ঞাতম্ ইব অভূৎ ইত্যেতাসামৈব দেবতানাং সমাস ইতি, তদ্বিদ্যাঞ্চক্রুঃ; যথা নু খলু সোম্য, ইমাস্তিস্রো দেবতাঃ পুরুষং প্রাপ্য ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ একৈকা ভবতি, তস্মে বিজানীহীতি। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৭)।।
অর্থাৎ :
স্থূল অগ্নির যে লাল বা রক্তবর্ণ তা সূক্ষ্ম অগ্নির রূপ, যা সাদা বা শুক্লবর্ণ তা সূক্ষ্ম জলের রূপ, আর যা কালো বা কৃষ্ণবর্ণ তা সূক্ষ্ম অন্ন বা পৃথিবীর রূপ। এইভাবে অগ্নির অগ্নিত্ব দূর হলো। কারণ সব পরিবর্তন বা বিকারই শব্দাত্মক, নামমাত্র (অর্থাৎ অগ্নি একটি নাম মাত্র। এর দ্বারা একটি বিশেষ অবস্থাকে বোঝাচ্ছে)। এই তিনটি বর্ণই (অর্থাৎ তিনটি সূক্ষ্ম মহাভূতই) কেবলমাত্র সত্য। (ছান্দোগ্য-৬/৪/১)।। একথা জেনেই প্রাচীনকালে আদর্শ গৃহী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেছিলেন– ‘আজ থেকে কোন ব্যক্তি আমাদের এমন কিছু বলতে পারবেন না যা আমরা শুনিনি, চিন্তা করিনি বা আমাদের জানা নেই।’ কারণ লোহিতাদি এই তিন রূপের কথা তাঁরা জেনেছিলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৫)।। তাঁরা জেনেছিলেন যে, যা কিছু লাল বলে মনে হয় তা তেজের (অগ্নির) রূপ, যা কিছু সাদা বলে মনে হয় তা জলের রূপ, এবং যা কিছু কালো বলে মনে হয় তা অন্ন বা পৃথিবীর রূপ। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৬)।। অন্য যা কিছু অজানা ছিলো, তাও যে এই তিন দেবতারই (অর্থাৎ তেজ, জল ও অন্ন বা পৃথিবীর) সমষ্টি বা সংযোগ তা তাঁরা বুঝেছিলেন। হে সোম্য জেনে নাও, এই তিন দেবতা কিভাবে ত্রিবৃৎ হয়ে শরীর, মন, প্রাণ, বাক্য উৎপন্ন করছে। (ছান্দোগ্য-৬/৪/৭)।।
..
অন্নম্ অশিতং ত্রেধা বিধীয়তে; তস্য যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুঃ তৎ পুরীষং ভবতি, যো মধ্যমঃ তন্মাংসং, যোহণিষ্ঠঃ তন্মনঃ। (ছান্দোগ্য-৬/৫/১)।। আপঃ পীতাঃ ত্রেধা বিধীয়ন্তে; তাসাং যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুঃ তন্মূত্রং ভবতি, যো মধ্যমস্তৎ লোহিতং, যোহণিষ্ঠঃ স প্রাণঃ। (ছান্দোগ্য-৬/৫/২)।। তেজোহশিতং ত্রেধা বিধীয়তে; তস্য যঃ স্থবিষ্ঠোধাতুঃ তদস্থি ভবতি, যো মধ্যমঃ স মজ্জা, যোহণিষ্ঠঃ সা বাক্ । (ছান্দোগ্য-৬/৫/৩)।। অন্নময়ং হি সোম্য মন আপোময়ঃ প্রাণঃ তেজোময়ী বাগিতি। ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি, তথা সোম্যেতি হোবাচ। (ছান্দোগ্য-৬/৫/৪)।।
অর্থাৎ :
আমরা যে অন্ন বা খাবার খাই তা শরীরের ভিতরে গিয়ে তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ মলে, মধ্যম অংশ মাংসে এবং সূক্ষ্মতম অংশ মনে পরিণত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/১)।। আমরা যে জল পান করি তা তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ মূত্রে, মধ্যম অংশ রক্তে এবং সূক্ষ্মতম অংশ প্রাণে রূপান্তরিত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/২)।। (ঘি, মাখন প্রভৃতি শক্তি-উৎপাদনকারী) তেজস্কর পদার্থ খেলে তা তিনভাগে বিভক্ত হয়। তার স্থূলতম অংশ অস্থি, মধ্যম অংশ মজ্জা এবং সূক্ষ্মতম অংশ বাক্-এ পরিণত হয়। (ছান্দোগ্য-৬/৫/৩)।। ‘অতএব, হে সোম্য, মন অন্নের দ্বারা পুষ্ট হয় এবং প্রাণ জলের দ্বারা। আর বাক্ পরিপুষ্টি লাভ করে তেজের দ্বারা।’ (শ্বেতকেতু বললেন)– ‘আপনি আমাকে আবার বুঝিয়ে বলুন।’ পিতা বললেন, ‘হে সোম্য, তাই হোক।’ (ছান্দোগ্য-৬/৫/৪)।।
..
ষোড়শকলঃ সোম্য পুরুষঃ পঞ্চদশাহানি মাহশীঃ। কামম্ অপঃ পিব। অপোময় প্রাণো ন পিবতো বিচ্ছেৎস্যত ইতি। (ছান্দোগ্য-৬/৭/১)।। স হ পঞ্চদশাহানি নাশাথ হৈনমুপসসাদ। কিং ব্রবীমি ভো ইতি। ঋছঃ সোম্য যজুংষি সামানীতি। স হোবাচ–ন বৈ মা প্রতিভান্তি ভো ইতি। (ছান্দোগ্য-৬/৭/২)।। তং হোবাচ যথা সোম্য মহতোহভ্যাহিতস্যৈকঃ অঙ্গারঃ খদ্যোতমাত্রঃ পরিশিষ্টঃ স্যাৎ, তেন ততোহপি ন বহু দহেদেবং সোম্য তে ষোড়শানাং কলানামেকা কলাহতিশিষ্টা স্যাৎ, তয়া এতর্হি বেদান্নানুভবসি। অশান। অথ মে বিজ্ঞাস্যসীতি। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৩)।। স হ আশ; অথ হৈনমুপসসাদ। তং হ যৎ কিঞ্চ পপ্রচ্ছ সর্বং হ প্রতিপেদে। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৪)।। তং হোবাচ যথা সোম্য মহতোহভ্যাহিতস্যৈকম্ অঙ্গারং খদ্যোতমাত্রং পরিশিষ্টং তং তৃণৈঃ উপসমাধায় প্রাজ্বলয়েৎ, তেন ততোহপি বহু দহেৎ। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৫)।। এবং সোম্য তে ষোড়শানাং কলানামেকা কলাতিশিষ্টা অভূৎ, সা অন্নেন উপসমাহিতা প্রাজ্বালী, তয়ৈতর্হি বেদান্ অনুভবসি। অন্নময়ং হি সোম্য মন, আপোময়ঃ প্রাণঃ, তেজোময়ী বাগিতি। তং হ অস্য বিজজ্ঞৌ ইতি, বিজজ্ঞাবিতি। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৬)।।
অর্থাৎ :
হে সোম্য, মানুষের ষোলটি কলা বা অংশ আছে। তুমি পনেরো দিন কিছু আহার কোরো না। তবে যত ইচ্ছে জল পান কোরো। কারণ প্রাণ জলের ওপর নির্ভরশীল। জল পান করলে প্রাণ বিয়োগ হয় না। (ছান্দোগ্য-৬/৭/১)।। শ্বেতকেতু পনের দিন কিছু খেলেন না। তারপর পিতার নিকট উপস্থিত হতেই পিতা বললেন, ‘সোম্য, তুমি তো সব বেদই অধ্যয়ন করেছো। আমাকে ঋক, যজুঃ, সাম বেদ থেকে কিছু মন্ত্র শোনাও তো।’ শ্বেতকেতু বললেন, ‘ওসব আমার কিছুই মনে পড়ছে না।’ (ছান্দোগ্য-৬/৭/২)।। পিতা আরুণি শ্বেতকেতুকে বললেন, ‘হে সোম্য, যদি বিশাল প্রজ্বলিত অগ্নির থেকে জোনাকি পোকার মতো ছোট একখণ্ড অঙ্গারমাত্র অবশিষ্ট থাকে তবে তার দ্বারা তার চেয়ে বড় কোন বস্তু দগ্ধ করা যায় না। তেমনি তোমার ষোল কলার এক কলা মাত্র অবিশিষ্ট আছে। তার দ্বারা বেদসমূহ বুঝতে পারছো না। ভয় নেই। তুমি নিত্য অন্নভোজন শুরু করো। আহার করো, পরে আমার কথা বুঝতে পারবে। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৩)।। শ্বেতকেতু এবার নিয়মিত অন্নাহার করে একদিন পিতার কাছে এলেন। পিতা তাঁকে যা কিছু জিজ্ঞাসা করলেন, সে সবই তিনি অনায়াসে বুঝতে ও বলতে পারলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৪)।। পিতা তাঁকে বললেন, ‘হে সোম্য, প্রায় নিভে যাওয়া বিশাল অগ্নিকুণ্ডের সেই জোনাকি পোকার মতো ছোট অঙ্গারটিকে যদি খড়কুটো দিয়ে আবার দাউ দাউ বাড়িয়ে তোলা যায় তবে তার দ্বারা আগের চেয়েও বেশি পরিমাণ বস্তু দগ্ধ করা যায়।’ (ছান্দোগ্য-৬/৭/৫)।। ‘তেমনি হে সোম্য, তোমার ষোলটি কলার এক কলা মাত্র অবশিষ্ট ছিলো। সেই কলাটি অন্নের দ্বারা বর্ধিত হয়ে প্রজ্বলিত হয়েছে। এখন তার দ্বারাই তুমি বেদ বুঝতে পারছো, সহজে বলে যেতে পারছো। অতএব হে সোম্য, এখন বুঝতে পারছো কেন আমি বলেছি মন অন্নময়, প্রাণ জলময় এবং বাক্ তেজোময় !’ তখন শ্বেতকেতু পিতা আরুণির উপদেশ বুঝতে পারলেন। (ছান্দোগ্য-৬/৭/৬)।।
এই আখ্যানের মাধ্যমে বর্ণিত উপদেশের মূল কথা হলো, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আদি কারণকে ‘নিছক সৎ’ বলেই উল্লেখ করতে হবে। এই ‘সৎ’ থেকে পর্যায়ক্রমে আগুন, জল এবং অন্নর উৎপত্তি। আগুনের সূক্ষ্মতম অংশ থেকে ‘বাক্’, জলের সূক্ষ্মতম অংশ থেকে প্রাণ এবং অন্নের সূক্ষমত অংশ থেকে মন উৎপন্ন হয়। শেষ কথাটা– অর্থাৎ নিছক অন্ন থেকে কীভাবে ‘মন’ উৎপন্ন হতে পারে– সে-বিষয়ে পুত্র পিতা উদ্দালককে একটু বিস্তৃত ব্যাখ্যার অনুরোধ জানালে ব্যাখ্যা হিসেবে উদ্দালক একটা পরীক্ষা করে কথাটার প্রমাণ দিলেন। পুত্রকে তিনি বললেন, পনেরো দিন অন্নভক্ষণ বন্ধ রাখো, কিন্তু জল পান কোরো, কেননা জল থেকেই প্রাণের উৎপত্তি বলে এই পনেরো দিন জল পান করলে প্রাণসংশয় হবে না। ছেলে পনেরো দিন অন্নভক্ষণ বন্ধ রাখলেন, কিন্তু জল পান করে প্রাণরক্ষা করলেন। তারপর উদ্দালক বললেন, বারো বছর ধরে গুরুর কাছে যে-বেদ মুখস্থ করেছো তা আবৃত্তি করে শোনাও। শ্বেতকেতু চেষ্টা করেও বিফল হলেন; বললেন, কিছুই মনে পড়ছে না। পিতা বললেন, অন্ন থেকেই মনের উৎপত্তি; পনেরো দিন কিছু খাওনি বলে তোমার মনের এই অবস্থা– উপনিষদের ভাষায় ‘মন’ অন্নাভাবে (সাময়িকভাবে) লুপ্ত হয়েছে। এবার ফিরে গিয়ে পনেরো দিন ধরে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে আবার এসো। শ্বেতকেতু তা-ই করলেন। উদ্দালক বললেন, এবার বেদ আবৃত্তি করে শোনাও। এবার দেখা গেলো, ছেলের বেদ মনে পড়ছে; আবৃত্তি করতে কোনো অসুবিধে হলো না। উদ্দালক বললেন, তাহলে তো দেখতেই পাচ্ছো, অন্ন থেকেই মনের উৎপত্তি!
একেবারে যাকে বলে হাতে-নাতে প্রমাণের আয়োজন। অন্ন-র বর্তমানতায় মনও বর্তমান, অন্ন-র অবর্তমানতায় মন বিলুপ্ত হয়। তাহলে ‘মন’ বলে যা উল্লেখ করা হয় তা অন্ন থেকেই উৎপন্ন!
এখানে মনে রাখা আবশ্যক যে, উপনিষদ্-সাহিত্যের রচনাকাল আজ থেকে অন্তত আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগেকার ব্যাপার। তখন সবে দার্শনিক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে; দার্শনিক পরিভাষা মার্জিত হতে তখনো বাকি। তাই পরের যুগে ‘চৈতন্য’, ‘মন’, ‘স্মৃতি’ প্রভৃতি বিভিন্ন শব্দের যে-পার্থক্য করার আয়োজন, উপনিষদের যুগে তা প্রত্যাশা করা ইতিহাস-বোধের পরিচায়ক হবে না বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। তখন ‘মন’ শব্দ দিয়েই সাধারণভাবে চেতনা প্রভৃতি সবকিছুই বোঝা হতো। অতএব, জয়ন্তভট্টর লেখার সঙ্গে এদিক থেকে অনেকটাই তফাৎ থাকবার কথা। তাই পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকদের ভূতচৈতন্যবাদ বর্ণনার সঙ্গে উদ্দালকের প্রকাশ-ভঙ্গি হুবহু একই হবার কথা নয়। কিন্তু মূল যুক্তিটা যে একই– এবিষয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই।
প্রখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ জ্যাকবি ও রুবেন যে-মূল যুক্তি দেখিয়ে উদ্দালককে বস্তুবাদী বলে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন তার মূল কথাটিও এই প্রসঙ্গে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের নাতিদীর্ঘ বক্তব্য থেকেই বিষয়টা খোলাশা হয়ে যায়–
‘উপনিষদ্-এর অন্যান্য প্রখ্যাত দার্শনিকেরা পরম সত্য বা জগতের আদিকারণ হিসেবে ‘ব্রহ্ম’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সমগ্র উপনিষদ্-সাহিত্যের কোথাওই উদ্দালকের মুখে ‘ব্রহ্ম’ শব্দ নেই। তার বদলে তিনি ‘সৎ এব’ বা ‘নিছক সৎ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। জ্যাকবি, রুবেন প্রমুখের দাবি হলো, এই ‘সৎ’-কে সাংখ্য-দর্শনের ‘প্রকৃতি’ বা ‘প্রধান’-এর মতোই স্বয়ং-অচেতন বস্তু অর্থে গ্রহণ করতে হবে। ফলে উদ্দালকের মতে স্বয়ং-অচেতন বস্তুই জগৎকারণ; তা থেকেই চৈতন্য প্রভৃতির উৎপত্তি। অর্থাৎ বস্তুবাদই।
বলাই বাহুল্য, বেদান্ত বা উপনিষদ্-এর কোনো ব্যাখ্যাকারই একথা মানেন নি এবং তাঁদের কারুর পক্ষেই কথাটা মানা সম্ভব নয়। বেদান্তমতের ব্যাখ্যাকার শঙ্কর এবং রামানুজ পারস্পরিক মতপার্থক্য ভুলে জোর গলায় এবং একই যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, উদ্দালকের ‘সৎ’-কে কিছুতেই অচেতন পদার্থ বলে মানা যায় না। তাঁদের প্রতিটি যুক্তির মূল্য সমান নয় এবং এখানে তা উল্লেখ করার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু চরম যুক্তি হিসেবে উভয়েই যা বলেছেন সে-বিষয়ে অন্তত একটা মন্তব্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যুক্তিটা হলো : পুত্র শ্বেতকেতু মোক্ষলাভের আশায় উদ্দালকের কাছে জ্ঞান ভিক্ষা করেছিলেন; কিন্তু অধ্যাত্মজ্ঞান ছাড়া মোক্ষলাভের কোনো পথ অসম্ভব বলেই পিতার পক্ষে পুত্রকে অচেতন কোনো পদার্থের উপদেশ দিয়ে বিভ্রান্ত করা তো বঞ্চনারই সামিল হবে। নিজের ছেলেকে কেউ এইভাবে ঠকাতে পারে নাকি?
আধুনিক বৈদান্তিক মহলে এ-হেন যুক্তি কম-বেশি বাহবা পেলেও যুক্তিটা নিয়ে কিছুটা মুস্কিল আছে। সমগ্র উপনিষদ্-সাহিত্যে কোথাও বলা হয়নি যে মোক্ষলাভের আশায় শ্বেতকেতু উদ্দালকের উপদেশ চেয়েছিলেন। ‘ছান্দোগ্য-উপনিষদ্’-এর উপাখ্যানটা থেকে বরং উল্টো কথাই অনুমান হয় : গুরুগৃহে বারো বছর বেদ পড়ে বিদ্যার অভিমান নিয়ে ছেলে বাড়ি ফিরলে উদ্দালক তাকে দেখাতে চান সে-অভিমান আসলে অন্তঃসারশূন্য, কেননা অতদিন ধরে বেদ পড়া সত্ত্বেও প্রকৃত দার্শনিক তত্ত্ব ছেলের মাথায় ঢোকেনি এবং ‘ছান্দোগ্য-উপনিষদ্’-এ কোথাও এমন ইংগিতমাত্রও নেই যে উদ্দালক-বর্ণিত দার্শনিক তত্ত্বর সম্যক উপলব্ধি থেকেই মোক্ষ বা মুক্তিলাভ সম্ভব। অন্য কোনো উপনিষদ্-এও উদ্দালকের নামের সঙ্গে মোক্ষ বা মুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্যই, উদ্দালকের মতে যেহেতু আদিম বা পরম সত্য ‘নিছক সৎ’ এবং এই সৎ থেকেই যেহেতু দেহ-বাক্-প্রাণ-মন– মানুষের সবকিছুরই উদ্ভব, সেইহেতু শেষ পর্যন্ত মানষ ওই সৎ ছাড়া আর কিছুই নয়। কথাটা ছেলের মাথায় ভালো করে ঢোকাবার জন্যে উদ্দালক শ্বেতকেতুকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন : তুমি আসলে ওই সৎ-ই ‘তৎ ত্বম্ অসি’। চলতি কথায় আজকাল যাকে বলি একটা ফর্মুলার মতোই। পরবর্তীকালের বৈদান্তিকেরা এই ফর্মুলার ‘তৎ’ বলতে পরব্রহ্ম মাত্র– এ-জাতীয় ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করে ফর্মুলাটাকে ব্রহ্ম ও আত্মার অভেদসূচক একটা মস্ত নজির (মহাবাক্য) হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। কিন্তু তা কষ্টকল্পনার প্রকৃষ্ট নিদর্শন বলে গ্রহণ করলেও উপনিষদ্-এর বাস্তব সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই। ‘ছান্দোগ্য উপনিষদ্’-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ে উদ্দালকের মত বিস্তৃতভাবে আলোচিত; তার মধ্যে আত্মার কথা কোথাও নেই। উপনিষদ্-সাহিত্যের অন্যত্র বরং উল্টো কথাই চোখে পড়ে। উদ্দালককে প্রশ্ন করা হলো : আত্মা বলতে আপনি কী বোঝেন? উদ্দালক সবিনয়ে উত্তর দিলেন, ‘আজ্ঞে, আমার কাছে এই পৃথিবীই আত্মা’ (ছান্দোগ্য-৫/১৭/১)। এ-হেন পৃথিবী-সর্বস্ব দার্শনিকটিকে যেন তেন প্রকারে ভাববাদীদের দলে ভেড়াবার জন্যে শঙ্কর-রামানুজ অনেক প্রয়াস করেছেন; কিন্তু অন্তত উপনিষদ্-এর কোনো সাক্ষ্য থেকেই তা স্বীকার করার সম্ভাবনা নেই।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১০৫-৬)
এমনকি উপনিষদ্-বহির্ভূত কোনো সাক্ষ্য থেকেও উদ্দালক আরুণিকে ভাববাদীর দলে ভেড়ানোর সুযোগ নেই। পরবর্তীকালের বৈদান্তিকেরা উদ্দালক আরুণির পুত্র শ্বেতকেতুকে মূলতই মোক্ষ-অভিলাষী বলে বর্ণনা করলেও, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত ঐতিহ্যের সঙ্গে তার কোনো মিল হয় না। কেননা, ‘কামসূত্র’-র দাবি অনুসারে এই শ্বেতকেতুই কামশাস্ত্রের আদি প্রবক্তা বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন।
এই মন্তব্য যে অহেতুক না তা বোঝা যায় ‘কামসূত্র’-এ বাৎস্যায়নের স্বীকৃতি বক্তব্য থেকেই–
ধর্ম্মার্থকামেত্যো নমঃ।। (কামসূত্র-১/১/১)।
শাস্ত্রে প্রকৃতত্বাৎ।। (কামসূত্র-১/১/২)।
তৎসময়াববোধকেভ্যশ্চাচার্যেভ্যঃ।। ইতি।। (কামসূত্র-১/১/৩)।
তৎসম্বন্ধাৎ।। ইতি।। (কামসূত্র-১/১/৪)।
প্রজাপতির্হি প্রজাঃ সৃষ্ট্বা তাসাং স্থিতিনিবন্ধনং ত্রিবর্গস্য
সাধনমধ্যায়ানাং শত সহস্রেনাগ্রে প্রোবাচ।। (কামসূত্র-১/১/৫)।
তস্যৈকদেশিকং মনুঃ স্বায়ম্ভুবো ধর্ম্মাধিকারিকং পৃথক্ চকার।। (কামসূত্র-১/১/৬)।
বৃহস্পতিরর্থাধিকারিকম্ ।। (কামসূত্র-১/১/৭)।
মহাদেবানুচরশ্চ নন্দী সহস্রেণাধ্যায়ানাং পৃথক্ কামসূত্রং প্রোবাচ।। (কামসূত্র-১/১/৮)।
তদেব তু পঞ্চভি-রধ্যায়শতৈ রৌদলিকিঃ শ্বেতকেতুঃ সঞ্চিক্ষেপ।। (কামসূত্র-১/১/৯)।
অর্থাৎ :
(গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর-এর তর্জমা)
ধর্ম্ম,অর্থ ও কামের উদ্দেশে নমস্কার। (কামসূত্র-১/১/১)।। সেই সকল দেবতার অধিকারেই এই শাস্ত্রের প্রবৃত্তি হইতেছে। (কামসূত্র-১/১/২)।। যে সকল আচার্য্য ধর্ম্মাদির আচার নিজে করিয়াছেন, পরকে ব্যবহার করাইয়াছেন এবং তাহার সঞ্চয় করিয়া গ্রন্থাকারে আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন, সেই সকল আচার্য্যকেও নমস্কার। (কামসূত্র-১/১/৩)।। এই শাস্ত্রে তাঁহাদিগের সম্বন্ধ আছে,– এইজন্য। (কামসূত্র-১/১/৪)।। আগম প্রসিদ্ধি এইরূপ যে, প্রজাপতি আদিকবি ব্রহ্মা প্রজাসকল সৃষ্টি করিয়া তাহাদিগের স্থিতির (সম্যক পালনের) জন্য প্রথমে লক্ষ অধ্যায়াত্মক ত্রিবর্গ সাধন বিশদভাবে বলিয়াছিলেন। (কামসূত্র-১/১/৫)।। তাহার ঐকদেশিক ধর্ম্মাধিকারিক স্বায়ম্ভুব মনু পৃথক করিয়াছিলেন। (কামসূত্র-১/১/৬)।। বৃহস্পতি অর্থাধিকারিক শাস্ত্রকে পৃথক করিয়াছিলেন। (কামসূত্র-১/১/৭)।। মহাদেবের অনুচর নন্দী সহস্র অধ্যায়াত্মক কামসূত্রকে পৃথক করিয়া বিশদভাবে বলিয়াছিলেন। (কামসূত্র-১/১/৮)।। ঔদ্দালিকি শ্বেতকেতু তাহাই পাঁচশত অধ্যায় দ্বারা সংক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন। (সংগ্রহ করিয়াছিলেন)। (কামসূত্র-১/১/৯)।।
কামশাস্ত্র আর যাই হোক মোক্ষশাস্ত্র নয়। তাই পরবর্তীকালের বৈদান্তিকদের দাবি মানতে গেলে আরো মানতে হবে যে পিতার কাছে মোক্ষধর্মের উপদেশ পেয়েও পুত্র কিন্তু নেহাতই বিপথগামী হয়েছিলেন। এমনতর কথা হজম করা সোজা নয়। কিন্তু দেবীপ্রসাদ বলেন, এমন কথা হজমের চেষ্টা করার দরকার নেই। ‘কেননা, উদ্দালক শ্বেতকেতুকে সত্যিই মোক্ষধর্মের উপদেশ দিয়েছিলেন– এ-হেন দাবিটাই কাল্পনিক। বরং বেণীমাধব বড়ুয়া দেখাবার চেষ্টা করেছেন, ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ্’-এর সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ হয়, স্বয়ং উদ্দালকেরও কামশাস্ত্রে আগ্রহ ছিল। কেননা ‘বৃহদারণ্যক’-এর এই অংশে উদ্দালক প্রজনন-সমর্থ কোনো একরকম মণ্ড প্রস্তুতের বিষয়ে আলোচনা করেছেন।’
কিন্তু বর্তমান আলোচনায় আমাদের পক্ষে সে-আলোচনায় প্রবেশ করার সুযোগ নেই, দরকারও নেই। তার চেয়ে বরং অন্য উপনিষদ্-সাহিত্যেও একটু দৃষ্টি ফেলা যাক।