বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মধ্যে চার্বাক দর্শনের মূল ধারার আবির্ভাবের যে ইঙ্গিত পণ্ডিতেরা দিয়েছেন তার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। এই বিদ্রোহের পটভূমিতে চার্বাক সিদ্ধান্তকে বিচার করতে গেলে বৈদিক চিন্তাধারার সমান্তরালে চার্বাকী মনোভাব মিলিয়ে দেখাটাই প্রাসঙ্গিক হবে। ইতঃপূর্বে আমরা প্রাচীন বৈদিক সাহিত্য ও তার চিন্তাধারার পরিচয় অধ্যায়ান্তরে আলোচনা করেছি। সেখানেই আমরা অবগত হয়েছি যে, বেদের সংখ্যা চার– ঋক্, সাম, যজুস্ ও অথর্ব। অবশ্য বহুক্ষেত্রে বেদ ‘ত্রয়ী’ নামের মাধ্যমে পরিচিত; কারণ, অথর্ব বা চতুর্থ বেদকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে অনেক দেরিতে। প্রত্যেক বেদের আবার তিনটি বিভাগ– মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ এবং উপনিষৎ। সংহিতা, ব্রাহ্মণ এবং উপনিষদে বিভক্ত বেদ এক বিপুল সাহিত্য সম্ভার। বৈদিক সাহিত্য হিসেবে এর পরিচিতি এবং যে যুগের পরিধির মধ্যে এই সাহিত্যের সৃষ্টি, বৈদিক যুগ বলতে সাধারণত তাকেই বোঝায়।
তবে সূক্ষ্ম বিচারের মাপকাঠিতে কিন্তু সংহিতা এবং ‘ব্রাহ্মণ’ই কেবল বৈদিক যুগের সাক্ষ্য বহন করে, কারণ, বৈদিক মন্ত্র এবং ‘ব্রাহ্মণে’র অনুসরণে উদ্ভূত হলেও বৈদিক সাহিত্যের অন্তিম অংশ উপনিষৎ এক ভিন্নধর্মী ভাবের পরিচায়ক, যার অনুবৃত্তি পরবর্তী চিন্তাধারায় সুপরিস্ফূট। এই বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদিক যুগ বলতে বিশিষ্ট অর্থে মন্ত্র এবং ‘ব্রাহ্মণে’র যুগকেই বোঝায়। এবং আমাদের খেয়াল রাখা আবশ্যক, চার্বাক দর্শনে বেদ প্রধানত মন্ত্র এবং ‘ব্রাহ্মণ’ পর্যায়ের বৈদিক সাহিত্যের অর্থে ব্যবহৃত।
(১)
আমরা আগেই দেখেছি, বৈদিক যুগের চিন্তাধারা মূলত পার্থিব কামনাভিত্তিক। সাধারণ মানুষ সুখ, সম্পদ, ঐশ্বর্য ইত্যাদির অধিকারী হতে চায়। কামনার লক্ষ্য সেই সব বিষয়। বৈদিক যুগের সমস্ত প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য প্রথমত এই কামনাগুলির পূর্তি এবং দ্বিতীয়ত এই কামনাপূর্তির পথের অন্তরায়গুলির দূরীকরণ। বৈদিক সংহিতায় এই প্রয়াসই রূপ পেয়েছে বিভিন্ন কল্পিত দেবদেবীর উদ্দেশ্যে রচিত প্রার্থনার মাধ্যমে। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপে দেবত্বের মহিমা আরোপ করে মানুষ তাঁর পূজা করেছে; দেবতার কাছে তাঁর প্রার্থনা, তিনি যেন তাঁর মঙ্গলময় প্রকাশের মধ্য দিয়ে সর্বদা আবির্ভূত হন এবং রুদ্ররূপকে সংবরণ করেন। আর এই প্রার্থনা ছাড়াও মানুষের কামনা পূর্তির উদ্দেশ্য সাধনের অঙ্গ হিসেবে যজ্ঞ ইত্যাদি নানা রকম ক্রিয়াকর্মের বিধান বা প্রচলনও স্থান পেয়েছে বৈদিক সংহিতাতে।
এই যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান সংহিতা-উত্তর ‘ব্রাহ্মণের’ যুগে অত্যন্ত প্রাধান্য পায় এবং প্রধানতঃ এই অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করেই ‘ব্রাহ্মণের’ যুগের রূপায়ণ।
‘ক্রিয়াকর্মের খুঁটিনাটিবহুল এই সব বৈদিক যজ্ঞের যথাযথ ফল প্রদানের ক্ষমতা বৈদিক নির্দেশনা অনুসারে মন্ত্রাদির বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং বিভিন্ন ক্রিয়ার অনুষ্ঠানের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল ছিল। এ ধরণের বিশুদ্ধতা পালন সাধারণ লোকের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়; ফলে, একটা দুর্বোধ্যতার আবরণ এই যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানগুলিকে সাধারণ লোকের বুদ্ধির জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখত। অনুষ্ঠানের জটিলতা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। অনভিজ্ঞ অথচ যাজ্ঞিক ক্রিয়ায় রত ব্যক্তির শোচনীয় অবস্থার এক বর্ণনা ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ (শঃব্রাঃ-১২/২) পাওয়া যায়। অন্তবর্তী পথগুলির বিবরণ সম্বন্ধে অজ্ঞ হয়েও যে ব্যক্তি গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে তার দশার সঙ্গে এই অবস্থা তুলনীয়। এইভাবে অরণ্যে প্রবেশকারীকে যেভাবে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দুর্জনের প্রতারণা ইত্যাদি প্রতিকূলতার কাছে পরাভব স্বীকার করতে বাধ্য হতে হয়, অনভিজ্ঞ যজ্ঞকারীরও সেইভাবে নানা ধরনের দুর্বিপাকের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অপর পক্ষে, যজ্ঞ সম্বন্ধে ‘বিস্তারিত জ্ঞান’ যাঁদের আছে, সেই ব্যক্তিদের দ্বারা যজ্ঞ পরিচালিত হলে যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে সব রকম বিপদ থেকে পরিত্রাণ এবং পরিশেষে সুখ, শান্তি এবং স্বর্গলাভ হয়।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১২০)
যজ্ঞের ব্যাপারে এই ‘বিস্তারিত জ্ঞানের’ যাঁরা অধিকারী, স্বাভাবিকভাবেই বৈদিক সমাজে তাঁদের সর্বাধিক প্রতিপত্তি ছিলো; কারণ, সাধারণ মানুষের সুখ, সমৃদ্ধি এবং স্বর্গের চাবিকাঠি ছিলো তাঁদের হাতে। এই অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায় নামে বিশেষ এক শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং যজ্ঞ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বিশেষ এই শ্রেণীর অধিকারে আসে। যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে সাধারণ ব্যক্তিদের এই পুরোহিত বা যাজকদের উপর নির্ভর করতে হতো, কারণ যজ্ঞের জটিল ক্রিয়াপদ্ধতির জ্ঞান একমাত্র এঁদেরই অধিগত ছিলো। যাঁর কামনাপূর্তি যজ্ঞানুষ্ঠানের লক্ষ্য, সেই যজমান বস্তুতপক্ষে যাজ্ঞিক অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন। এই পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা জাতিগতভাবে পৌরোহিত্যকেই বৃত্তি হিসেবে অবলম্বন করতেন।
কেবল পৌরোহিত্যকে বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করেই ক্রমান্বয়ে এই পরাশ্রিত পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায় যে সমাজের স্তরবিনাসে সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তার দৃষ্টান্ত হলো, বৈদিক সাহিত্যের বহু অংশে এই যাজক শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরা দেবতা হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। যেমন, ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ (শতপথ-ব্রাহ্মণ-২/২/২/৬, ৪/৩/৪/৪, ২/৪/৩/১৪) দেবতাকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে– স্বর্গের দেবতা আর মানুষ দেবতা বা পুরোহিত, যাঁরা বৈদিক শাস্ত্রে অভিজ্ঞ এবং যজ্ঞ পরিচালনার ভার যাঁদের উপর অর্পিত।
এই পুরোহিতেরা সমাজজীবনে যে বিশেষ ধরনের সুযোগ সুবিধার অধিকারী ছিলেন বৈদিক সাহিত্যের বিভিন্ন জায়গায় সে সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে ‘মনুস্মৃতি’ বা ‘মনুসংহিতা’র বিবরণে এ-বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে। পুরোহিতদের স্থান অপর ব্যক্তির তুলনায় উচ্চুর স্তরে নির্দেশিত ছিলো এবং এঁদের সঙ্গে ব্যবহারে এই বিশেষ ব্যবধানটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সকলেই সচেতন থাকতেন। এই যাজকদের সব সময়ে সম্মান দেখাতে হতো, উপহার বা দক্ষিণা দিতে হতো এবং এঁদের হত্যা বা উৎপীড়ন করার অধিকার কারও থাকতো না। এমনকি এঁদের সঙ্গে ব্যবহারের সময় দেশের রাজাকেও এই একই নিয়ম পালন করতে হতো। এই যাজকদের সম্পত্তিতে রাজা কোন পরিস্থিতিতেই হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। সাধারণ লোকের সঙ্গে বিরোধের ব্যাপারে বিচারক সব সময়ে যাজকদের পক্ষে রায় দিতেন; কারণ, এই যাজকদের কোন কাজে ত্রুটির সম্ভাবনা অকল্পনীয় ছিলো। কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতায়ও এর বিশদ আলোচনা রয়েছে। তবে সার-কথা বা মর্ম-উপদেশটা হলো–
এই যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান সংহিতা-উত্তর ‘ব্রাহ্মণের’ যুগে অত্যন্ত প্রাধান্য পায় এবং প্রধানতঃ এই অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করেই ‘ব্রাহ্মণের’ যুগের রূপায়ণ।
‘ক্রিয়াকর্মের খুঁটিনাটিবহুল এই সব বৈদিক যজ্ঞের যথাযথ ফল প্রদানের ক্ষমতা বৈদিক নির্দেশনা অনুসারে মন্ত্রাদির বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং বিভিন্ন ক্রিয়ার অনুষ্ঠানের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভরশীল ছিল। এ ধরণের বিশুদ্ধতা পালন সাধারণ লোকের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়; ফলে, একটা দুর্বোধ্যতার আবরণ এই যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানগুলিকে সাধারণ লোকের বুদ্ধির জগৎ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখত। অনুষ্ঠানের জটিলতা সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। অনভিজ্ঞ অথচ যাজ্ঞিক ক্রিয়ায় রত ব্যক্তির শোচনীয় অবস্থার এক বর্ণনা ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ (শঃব্রাঃ-১২/২) পাওয়া যায়। অন্তবর্তী পথগুলির বিবরণ সম্বন্ধে অজ্ঞ হয়েও যে ব্যক্তি গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে তার দশার সঙ্গে এই অবস্থা তুলনীয়। এইভাবে অরণ্যে প্রবেশকারীকে যেভাবে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, দুর্জনের প্রতারণা ইত্যাদি প্রতিকূলতার কাছে পরাভব স্বীকার করতে বাধ্য হতে হয়, অনভিজ্ঞ যজ্ঞকারীরও সেইভাবে নানা ধরনের দুর্বিপাকের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। অপর পক্ষে, যজ্ঞ সম্বন্ধে ‘বিস্তারিত জ্ঞান’ যাঁদের আছে, সেই ব্যক্তিদের দ্বারা যজ্ঞ পরিচালিত হলে যজ্ঞানুষ্ঠানের মাধ্যমে সব রকম বিপদ থেকে পরিত্রাণ এবং পরিশেষে সুখ, শান্তি এবং স্বর্গলাভ হয়।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১২০)
যজ্ঞের ব্যাপারে এই ‘বিস্তারিত জ্ঞানের’ যাঁরা অধিকারী, স্বাভাবিকভাবেই বৈদিক সমাজে তাঁদের সর্বাধিক প্রতিপত্তি ছিলো; কারণ, সাধারণ মানুষের সুখ, সমৃদ্ধি এবং স্বর্গের চাবিকাঠি ছিলো তাঁদের হাতে। এই অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায় নামে বিশেষ এক শ্রেণীর উদ্ভব হয় এবং যজ্ঞ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বিশেষ এই শ্রেণীর অধিকারে আসে। যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে সাধারণ ব্যক্তিদের এই পুরোহিত বা যাজকদের উপর নির্ভর করতে হতো, কারণ যজ্ঞের জটিল ক্রিয়াপদ্ধতির জ্ঞান একমাত্র এঁদেরই অধিগত ছিলো। যাঁর কামনাপূর্তি যজ্ঞানুষ্ঠানের লক্ষ্য, সেই যজমান বস্তুতপক্ষে যাজ্ঞিক অনুষ্ঠান থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন। এই পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা জাতিগতভাবে পৌরোহিত্যকেই বৃত্তি হিসেবে অবলম্বন করতেন।
কেবল পৌরোহিত্যকে বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করেই ক্রমান্বয়ে এই পরাশ্রিত পুরোহিত বা যাজক সম্প্রদায় যে সমাজের স্তরবিনাসে সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তার দৃষ্টান্ত হলো, বৈদিক সাহিত্যের বহু অংশে এই যাজক শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরা দেবতা হিসেবে বর্ণিত হয়েছেন। যেমন, ‘শতপথ ব্রাহ্মণে’ (শতপথ-ব্রাহ্মণ-২/২/২/৬, ৪/৩/৪/৪, ২/৪/৩/১৪) দেবতাকে দু’শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে– স্বর্গের দেবতা আর মানুষ দেবতা বা পুরোহিত, যাঁরা বৈদিক শাস্ত্রে অভিজ্ঞ এবং যজ্ঞ পরিচালনার ভার যাঁদের উপর অর্পিত।
এই পুরোহিতেরা সমাজজীবনে যে বিশেষ ধরনের সুযোগ সুবিধার অধিকারী ছিলেন বৈদিক সাহিত্যের বিভিন্ন জায়গায় সে সম্বন্ধে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে ‘মনুস্মৃতি’ বা ‘মনুসংহিতা’র বিবরণে এ-বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোকপাতের চেষ্টা করা হয়েছে। পুরোহিতদের স্থান অপর ব্যক্তির তুলনায় উচ্চুর স্তরে নির্দেশিত ছিলো এবং এঁদের সঙ্গে ব্যবহারে এই বিশেষ ব্যবধানটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সকলেই সচেতন থাকতেন। এই যাজকদের সব সময়ে সম্মান দেখাতে হতো, উপহার বা দক্ষিণা দিতে হতো এবং এঁদের হত্যা বা উৎপীড়ন করার অধিকার কারও থাকতো না। এমনকি এঁদের সঙ্গে ব্যবহারের সময় দেশের রাজাকেও এই একই নিয়ম পালন করতে হতো। এই যাজকদের সম্পত্তিতে রাজা কোন পরিস্থিতিতেই হস্তক্ষেপ করতে পারতেন না। সাধারণ লোকের সঙ্গে বিরোধের ব্যাপারে বিচারক সব সময়ে যাজকদের পক্ষে রায় দিতেন; কারণ, এই যাজকদের কোন কাজে ত্রুটির সম্ভাবনা অকল্পনীয় ছিলো। কৃষ্ণযজুর্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতায়ও এর বিশদ আলোচনা রয়েছে। তবে সার-কথা বা মর্ম-উপদেশটা হলো–
‘যৎ ব্রাহ্মণশ্চাব্রাহ্মণশ্চ প্রশ্নমেয়াতাং ব্রাহ্মনায়াধি ব্রূয়াদ্যৎ ব্রাহ্মণায়াধ্যাহাহত্মনেহধ্যাহ যৎ ব্রাহ্মণং পরাহাহত্মানং পরাহহ তস্মাৎ ব্রাহ্মণো ন পরোচ্যঃ।’- (তৈত্তিরীয়-সংহিতা-২/৫/১১)
অর্থাৎ :
এ জগতে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ এ নিয়ে বিবাদ করে কোন অভিজ্ঞ লোকের কাছে গেলে, সে অভিজ্ঞ ব্যক্তি যদি ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলে, তবে তার নিজের আধিক্য হয়। ব্রাহ্মণের পরাভব হলে, তারও পরাভব হয়। অতএব কখনও ব্রাহ্মণের পরাভব করা উচিত নয়।
কিন্তু ক্ষমতা ও অর্থের লোভ মানুষের মধ্যে চিরন্তন এবং এই যাজকসম্প্রদায়ের লোকেরাও তা থেকে অব্যাহতি পাননি।
‘জনসাধারণের অজ্ঞতার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে এঁরা সমাজে এঁদের বিশেষ সুযোগ সুবিধার অপব্যবহারে রত হলেন। কেবলমাত্র জাতিগত ব্রাহ্মণতার ভিত্তিতেই পৌরোহিত্যের মর্যাদা দাবী করে বহু লোক সাধারণের কাছে নিজেদের উপস্থাপিত করলেন এবং এইভাবে সমাজে তাঁদের প্রভুত্ব বিস্তারের প্রস্তুতি শুরু হল। পরলোকে প্রচুর সুখ ও সম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করা এঁদের মধ্যে অনেকের জীবিকার উপায় হয়ে দাঁড়াল। এই জাতীয় লোকের অন্তর্ভুক্তি স্বাভাবিকভাবেই যাজকসম্প্রদায়ের মধ্যে অধঃপতনের সূচনা করতে থাকে এবং এইভাবে সংহিতার যুগে যে বৈদিক সংস্কৃতির উদ্ভব, সংহিতোত্তর ‘ব্রাহ্মণে’র যুগে তা এ বিকৃত আকার ধারণ করে। বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব যে সময়ে সর্বাপেক্ষা প্রবল, সেই ‘ব্রাহ্মণের’ যুগেই বেদের যজ্ঞভিত্তিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি আরম্ভ হল। পরবর্তী ভাবনা বিভিন্নমুখী ধারায় নূতন খাতে প্রবাহিত হয়ে ভারতের চিন্তাজগতে পরিবর্তন সূচনা করল।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১২১-২)
(২)
বৈদিক সাহিত্যে উপনিষদের স্থান সংহিতা এবং ‘ব্রাহ্মণের’ পরবর্তী যুগে। ফলে উপনিষদীয় সাহিত্যে একে একে পূর্ববর্তী যুগের কামনাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতধর্মী সুরের পরিচয়ই পরিস্ফূট হতে দেখা যায়। যে বৈষয়িক সুখভোগ বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রধানতম লক্ষ্য তার অসারতা প্রতিপাদিত হতে থাকে উপনিষদীয় চিন্তায়। নিজেদের কামনাপূর্তির সহায়ক হিসেবে বৈদিক আর্যরা বিভিন্ন দেবদেবীর কল্পনা করেছিলেন। কিন্তু উপনিষদীয় ঋষি বহু দেবতার উৎসরূপে অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিপাদন করলেন। উপনিষদীয় সাহিত্যের বহু অংশে যজ্ঞীয় সংস্কৃতির নিন্দা বা নতুন ব্যাখ্যা লক্ষিত হয়। এ-প্রসঙ্গে বিভিন্ন উপনিষদে অজস্র দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়। নমুনা হিসেবে যেমন, প্রাচীনতম ছান্দোগ্য-উপনিষদে অদ্বৈততত্ত্ব প্রতিপাদনে বলা হয়েছে–
‘তেনোভৌ কুরুতো যশ্চৈতদেবং বেদ যশ্চ ন বেদ। নানা তু বিদ্যা চাবিদ্যা চ যদেব বিদ্যয়া করোতি শ্রদ্ধয়োপনিষদা তদেব বীর্যবত্তরং ভবতীতি খল্বেতস্যৈবাক্ষরস্যোপব্যাখ্যানং ভবতি।। (ছান্দোগ্য-১/১/১০)
অর্থাৎ :
ওঁকার বা অক্ষর-ব্রহ্মের মহিমা কেউ জানুন বা না জানুন উভয়েরই কর্মক্ষমতা ওঁকার থেকে আসে। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে কর্মের ফল হয় ভিন্ন ভিন্ন। ‘ওম্’-কে জেনে, শাস্ত্রবাক্য ও গুরুবাক্যে শ্রদ্ধাবান হয়ে এবং শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী কর্ম বা যাগযজ্ঞ করলে সেই কর্ম অধিকতর ফলপ্রসূ হয়। এ-ই হলো ওঁকারের যথার্থ ব্যাখ্যা।
অন্যদিকে ‘মুণ্ডক-উপনিষদ’-এ (মুণ্ডক-১/২/৭-১০)-তে বৈদিক কর্মকাণ্ডের প্রতি উপনিষদীয় ঋষির তীব্র বিরাগ সপরিস্ফুট। যেমন–
‘প্লবা হ্যেতে অদৃঢ়া যজ্ঞরূপা অষ্টাদশোক্তমবরং যেষু কর্ম।
এতচ্ছ্রেয়ো যেহভিনন্দন্তি মূঢ়া জরামৃত্যুং তে পুনরেবাপি যন্তি।।’ (মুণ্ডক-১/২/৭)।
‘অবিদ্যায়াং বহুধা বর্তমানা বয়ং কৃতার্থা ইত্যভিমন্যন্তি বালাঃ।
যৎ কর্মিণো ন প্রবেদয়ন্তি রাগাৎ তেনাতুরাঃ ক্ষীণলোকাশ্চ্যবন্তে।।’ (মুণ্ডক-১/২/৯)।
অর্থাৎ :
যজ্ঞে আঠারো জন ব্যক্তির প্রয়োজন– যজমান স্বয়ং, তাঁর পত্নী ও ষোলজন ঋত্বিক বা পুরোহিত। তাঁরা সকলেই মরণশীল, অতএব তাঁরা যা করেন তাও ক্ষণস্থায়ী ও বিনাশী। সেই অর্থে তাঁরা যে যজ্ঞ করেন তা নিকৃষ্ট কর্ম। ভেলার মতোই তাঁদের যজ্ঞকর্ম অনিত্য এবং (সংসার সমুদ্র পার করতে) অক্ষম। তবু কিছু নির্বোধ মানুষ আছেন যাঁরা এই কর্মকে শ্রেয়োলাভের উপায় বলে মনে করেন। বস্তুত এই কর্মের ফলে স্বর্গলাভ হতে পারে, কিন্তু এই স্বর্গসুখ নেহাতই সাময়িক। স্বর্গের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেই তাঁদের পুনর্জন্ম হয়, এবং আবার তাঁরা জন্মমৃত্যুর চক্রে প্রবেশ করেন। (মুণ্ডক-১/২/৭)।। কিছু নির্বোধ ব্যক্তি আছেন যাঁদের আচরণ শিশুসুলভ। বহু বিষয়েই তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তবু নিজেদের সর্বজ্ঞ এবং বুদ্ধিমান বলে জাহির করেন। তাঁরা নিজেদের বিশেষ কৃপাপ্রাপ্ত বলে দাবি করেন। আসলে কর্মফলে আসক্তিবশত তাঁরা যাগযজ্ঞ নিয়ে মত্ত থাকেন। সঠিক পথ তাঁদের অজানা। তাই তাঁরা কিছুকাল স্বর্গসুখ ভোগ করেন ঠিকই, কিন্তু অচিরেই মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তাঁরা স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হন এবং অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করেন। (মুণ্ডক-১/২/৯)।।
তাছাড়া, ছান্দোগ্য উপনিষদের এক স্থানে পরস্পরসংলগ্ন কুকুরবাহিনীকে বহিষ্পবমান স্তোত্রগায়কের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যেমন–
‘তে হ যথৈবেদং বহিস্পবমানেন স্তোষ্যমাণাঃ সংরব্ধাঃ সর্পন্তীত্যেবম আসসৃপুস্তে হ সমুপবিশ্য হিং চক্রুঃ।।’ (ছান্দোগ্য-১/১২/৪)।
‘ও৩ মদা৩ মোং৩ পিবা৩মোং৩ দেবো বরুণঃ প্রজাপতিঃ সবিতা২ হন্নমিহা২ হরৎ, অন্নপতে৩হন্নমিহা২ হরো৩মিতি।।’ (ছান্দোগ্য-১/১২/৫)।
অর্থাৎ :
‘বহিষ্পবমান’ স্তোত্র উচ্চারণ করতে করতে উদ্গীথ ঋষিরা যেমন পরস্পর হাত ধরাধরি করে সর্পগতিতে পরিক্রমা করেন, কুকুরগুলিও তেমনি পরস্পরের লেজ মুখে ধরে পরিভ্রমণ করতে লাগলো। তারপর কিছু পরে উপবেশন করে তাঁরা উচ্চারণ করে উঠলো ‘হিং’। (ছান্দোগ্য-১/১২/৪)।। তারা হিংকার করে গান গাইতে লাগলো– ‘ওম্ অদাম’, আমরা আহার করবো, ‘ওম্ পিবাম’, আমরা পান করবো। হে দেব বরুণ! হে প্রজাপতি! হে সবিতা! হে অন্নপতে! আমাদের জন্য এখানে অন্ন আহরণ করুন…অন্ন এনে দিন, এনে দিন– ওম্ । (ছান্দোগ্য-১/১২/৫)।।
‘প্রকৃতপক্ষে উপনিষদীয় চিন্তাধারার আবির্ভাবের সূচনা বৈদিক সংহিতার মধ্যেই পরিদৃশ্যমান। প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে দেবতার মর্যাদা দিলেও এদের মধ্যে একত্বের অনুসন্ধানে সংহিতার যুগেই আর্যমানস উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছিল। বহু দেবতার মধ্যে প্রাধান্যের অধিকারী কোন্ দেবতা– এ সম্বন্ধে দ্বন্দ্বের সূচনাও বৈদিক সংহিতার যুগেই লক্ষ্য করা যায়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের বিভিন্ন মন্ত্রে বহুর মধ্যে একত্বের অনুসন্ধানের যে প্রারম্ভিক রূপ প্রকাশমান তারই পূর্ণ পরিণতি উপনিষদীয় চিন্তায়। এই দিক দিয়ে বিচার করলে উপনিষদে বৈদিক কর্মকাণ্ডের নিন্দা থাকলেও উপনিষদকে বেদেরই অনুবৃত্তি বলা চলে।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১২২)
‘মুণ্ডক-উপনিষদে’ই দুই রকম বিদ্যার উল্লেখ আছে– পরা এবং অপরা। পরা বা শ্রেষ্ঠ বিদ্যা উপনিষদের ব্রহ্মজ্ঞান এবং অন্যান্য সব বিষয়ের জ্ঞান অপরা বা নিকৃষ্ট বিদ্যার অন্তর্গত। যেমন–
‘তস্মৈ স হোবাচ। দ্বে বিদ্যে বেদিতব্যে ইতি হ স্ম যৎ ব্রহ্মবিদো বদন্তি পরা চৈবাপরা চ।।’ (মুণ্ডক-১/১/৪)।
‘তত্রাপরা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোহথর্ববেদঃ শিক্ষা কল্পো ব্যাকরণং নিরুক্তং ছন্দো জ্যোতিষমিতি। অথ পরা যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।। (মুণ্ডক-১/১/৫)।
অর্থাৎ :
অঙ্গিরস শৌনককে বললেন, ‘ব্রহ্মজ্ঞানীরা বলেন জ্ঞান দুই প্রকার, ব্রহ্মজ্ঞান অর্থাৎ পরম-জ্ঞান; আর আপেক্ষিক জ্ঞান অর্থাৎ এই দৃশ্যমান জগৎ সম্পর্কীয় জ্ঞান।’ (মুণ্ডক-১/১/৪)।। এই দুই শ্রেণীর বিদ্যা হলো পরা বিদ্যা এবং অপরা বিদ্যা। অপরা বিদ্যা হলো– ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা (উচ্চারণ বিদ্যা), কল্প (অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিদ্যা), ব্যাকরণ, নিরুক্ত (শব্দার্থ বিদ্যা), ছন্দ, জ্যোতিষ– এই দশটি। আর পরা বিদ্যা দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়, যে ব্রহ্ম শাশ্বত ও নিত্য। (মুণ্ডক-১/১/৫)।।
স্বাভাবিকভাবেই উপনিষৎকার তাঁর নিজ শাস্ত্রের অন্তর্গত বিদ্যাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দিয়েছেন। কিন্তু বৈদিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অবহেলিত হয়নি, নিকৃষ্ট হলেও তা বিদ্যার স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ব্যাপারে উপনিষদের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে দ্বিমুখী মনোভাব লক্ষণীয় বলে বিদ্বানেরা মনে করেন। বৈদিক যাগযজ্ঞবহুল ক্রিয়াপদ্ধতি উপনিষদীয় চিন্তার দ্বারা সমর্থিত হয়নি বটে, কিন্তু উপেক্ষার দৃষ্টিতে সব সময় এগুলির বিচার করা হয়নি, বরং নূতন ব্যাখ্যার দ্বারা এগুলির তাৎপর্য বিবেচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে সূচিত হয় নূতন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পুরাতন ভাবধারার সমন্বয়ের প্রয়াস। তাই লতিকা চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেন, ‘উপনিষদের মধ্যে বৈদিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা থাকলেও একই ঐতিহ্যের ধারা যে উপনিষদীয় সংস্কৃতিকেও প্লাবিত করেছিল তা বোঝা যায়।’
বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনের আবির্ভাব কালকে কোন কোন উপনিষদীয় রচনার সমসাময়িক বলে মনে করা হয়। এই দর্শন দুটির মধ্যেও বৈদিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্তির এক প্রবল প্রচেষ্টা দেখা যায়। বৈষয়িক সুখের যে নশ্বরতার চিন্তা উপনিষদীয় সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন দর্শনেও তা পূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে বলে পণ্ডিতদের অভিমত। কিন্তু এই দর্শন দুটিকে উপনিষদের মতো বৈদিক সংস্কৃতির অনুবৃত্তি বলা চলে না। কারণ এগুলির মধ্যে বেদের প্রাধান্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের ঘোষণা আছে। তবে ভারতীয় ঐতিহ্যের সাধারণ ভাববাদী ধারা থেকে এই দর্শন দুটি বিচ্যুত নয়। কাজেই নাস্তিক পঙক্তিতে জৈন ও বৌদ্ধদের স্থান নির্দেশিত হলেও আস্তিকতার প্রভাবকে বোধকরি তাঁরা সম্পূর্ণ অতিক্রম করতে পারেননি।
‘বৈদিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার মূলতঃ এক অতীন্দ্রিয় এবং অলৌকিক জগৎকে কেন্দ্র করে। এ জগতের পরিচয় প্রত্যক্ষ বা ব্যবহারিক অনুমান, যা চার্বাক মতে একমাত্র প্রমাণ– তার মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব নয়। জাগতিক সুখ ও সমৃদ্ধির কামনার পরিপূর্তির লক্ষ্যে বৈদিক সংস্কৃতি তার নিজস্ব পথ ধরে অগ্রসর হয়েছিল। এই পথের প্রসার যে অলৌকিক রাজ্যকে ঘিরে সেই রাজ্যের রহস্য উন্মোচনে উপনিষদীয় এবং বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনও ব্রতী– যদিও তাদের লক্ষ্যের কেন্দ্রবিন্দু ভিন্ন। বৈদিক চিন্তাধারায় যে অতিজাগতিক রহস্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই দর্শনগুলি তাকে উপেক্ষা করেনি, বরং নিজেদের স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে এই রহস্যের সন্ধান করেছে।’
‘একমাত্র চার্বাকী চিন্তার উপরই বৈদিক সংস্কৃতি তার উত্তরাধিকারের কোন ছাপ রেখে যেতে পারেনি। আর বেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে চার্বাকের ভূমিকা বোধ হয় প্রধানতম। বস্তুবাদী চার্বাক কাম্য বস্তুর উপভোগকেই তার মুখ্য উপজীব্য করেছে। কাজেই লক্ষ্যের বিচারে বৈদিক দর্শনের সঙ্গে চার্বাক দর্শনের মৌল সাদৃশ্য সহজ সিদ্ধান্তের বিষয় হতে পারে, কিন্তু এ সাদৃশ্য নেহাতই গৌণ। কারণ কামনা পূর্তির উপায়ের নির্দেশনায় উভয় দর্শনের মূল ব্যবধানের ইঙ্গিত নিহিত আছে। কামনাকারীর চিত্তের তাৎক্ষণিক তুষ্টি বৈদিক বিধানের অনুসরণে সম্ভব নয়। বেদের মধ্যে আছে কেবল কামনার পরিপূর্তির প্রতিশ্রুতি, তাও বহু ক্ষেত্রে ব্যবহারিক জগতের অন্তরালে এবং লৌকিক অনুভূতির সীমার বহির্দেশে। বৈদিক বিধানের অনুসরণে কামনাকারী তখনকার মত যা লাভ করে তার মধ্যে সুখের স্বাদের সম্পূর্ণ অভাব, বরং অর্থব্যয় এবং সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে তা দুঃখের অনুভূতিই বহন করে। সুখলাভের এই উপায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চার্বাক দর্শনে বিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছে। লৌকিক সুখ লাভের জন্য দৈব সাহায্য প্রার্থনায় চার্বাকপন্থী সম্মত নন।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১২৪-৫)
বস্তুত যাজকগোষ্ঠির প্রভাবে বৈদিক যজ্ঞীয় চর্চা ক্রমশ জটিল রূপ পরিগ্রহ করে অনুষ্ঠানগত আড়ম্বর বৃদ্ধি পেতে থাকলে এরই প্রতিক্রিয়ায় ব্রাহ্মণোত্তর যুগে বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের যে সূচনা– তার পূর্ণ রূপায়ণ চার্বাক মতবাদেই সুস্পষ্ট লক্ষ্য করা যেতে পারে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আমরা এখন সেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারি।
(৩)
ভারতীয় অধ্যাত্ম বিশ্বাস অনুসারে বেদমন্ত্র ব্যক্তিবিশেষের রচনা নয়, বৈদিক ঋষির নিকট এই মন্ত্র প্রকটিত হয়েছে মাত্র। তাই বেদের অপর নাম ‘শ্রুতি’। ‘শ্রুতি’ শব্দের মধ্যে বৈদিক মন্ত্রের সঙ্গে অতীন্দ্রিয় এক জগতের যোগাযোগের ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু চার্বাকী দৃষ্টিভঙ্গি এই বিশ্বাসের বিরোধী এবং বেদের অপৌরুষেয়ত্ব চার্বাক মতে সমর্থনযোগ্য নয়। অন্যান্য বিভিন্ন গ্রন্থের মতো বেদও চার্বাকদের মতে ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা রচিত। চার্বাকেতর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের রচিত নানান গ্রন্থ যেমন ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’, ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’, ‘সর্বমতসংগ্রহ’, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’, ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’, ‘তর্কসংগ্রহদীপিকা’ ইত্যাদি গ্রন্থাবলিতে এবং অন্যত্র লোকায়তিক চার্বাক বা বৃহস্পতিবচনের যে উদ্ধৃতি আছে তাতে বেদের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে বেদমন্ত্রের রচয়িতারা চার্বাকী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। যেমন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে সায়ণভাষ্য অনুযায়ী দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের নিকট জরায়ু-জাতের অজরত্ব প্রার্থনার মন্ত্র হিসেবে উক্ত হয়েছে–
‘সৃণ্যেভ্য জর্ভরী তুর্ফরীতূ নৈতোশেব তুর্ফরী পর্ফরীকা।
উদন্ যজেব জেমনা মদেরূ তা মে জরায্বজরং মরায়ু।।’- (ঋগ্বেদ-১০/১০৬/৬)
(যদিও ঋগ্বেদ গ্রন্থে তার তর্জমাটি দেয়া হয়েছে)–
অঙ্কুশ তাড়িত মত্ত হস্তীর ন্যায় তোমরা শরীর অবনত করে শত্রু সংহার কর। শত্রুনিধনকারীর সন্তানের ন্যায় তোমরা শত্রুকে বিদীর্ণ ও বধ কর। তোমরা এমনি নির্মল, যেন জলমধ্যে জন্মেছ, তোমরা বলবান ও জয়শীল। সে তোমরা আমার মরণধর্মশীল দেহকে পুনর্বার যৌবনাবস্থা দান কর।
কিন্তু চার্বাকমতে, জর্ভরী তুর্ফরী ইত্যাদি অপ্রচলিত এবং আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন শব্দের অন্বয়ে গঠিত বেদমন্ত্রগুলি যে পণ্ডিতবাক্য হিসেবে বিবেচিত হবার সম্পূর্ণ অযোগ্য, বৃহস্পতিবচনে তা প্রমাণ করার প্রয়াস দেখা যায়। যেমন–
‘ত্রয়ো বেদস্য কর্ত্তারো ভণ্ডধূর্তনিশাচরাঃ ।
জর্ফরীতুর্ফরীত্যাদি পণ্ডিতানাং বচঃ স্মৃতম্।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : যারা তিন বেদ রচনা করেছেন তাঁরা নেহাতই ভণ্ড, ধূর্ত ও চোর (নিশাচর)। জর্ফরীতুর্ফরী (প্রভৃতি অর্থহীন বেদমন্ত্র) ধূর্ত পণ্ডিতদের বাক্যমাত্র।
চার্বাক গুরু বৃহস্পতির অভিমত অনুসারে এই মন্ত্রগুলিকে প্রলাপ বলা চলে এবং এগুলির প্রণেতারা পাণ্ডিত্যে না হলেও ভণ্ডামিতে অনেকের চেয়েই উন্নততর। ‘ভণ্ড’ ছাড়াও ‘ধূর্ত’, ‘নিশাচর’ অর্থাৎ রাক্ষস বা চোর ইত্যাদি নিন্দাসূচক নানা শব্দ চার্বাকপন্থীদের মতে এইসব ‘বেদস্য কর্তারঃ’ সম্বন্ধে প্রযোজ্য।–
‘ধূর্ত্ত-প্রলাপস্ত্রয়ী।’ (বার্হস্পত্যসূত্র-৫৯)
অর্থাৎ : বৃহস্পতির মতে, (বেদের কর্তা) ভণ্ড, ধূর্ত, নিশাচর ত্রয়ী।
যে যাজকশ্রেণীর লোকেরা ‘ব্রাহ্মণে’র যুগে দেবতার স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন, চার্বাক দর্শনে তাঁদের নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা দেখা যায়। চার্বাক মতে এই সব পুরোহিতেরা বুদ্ধি ও পৌরুষবিহীন। এ কারণে জীবিকার অন্য উপায় অবলম্বন করতে না পেরে এরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন।–
‘অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্ ।
বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১৪)।।
অর্থাৎ : অগ্নিহোত্র, তিন বেদ, ত্রিদণ্ডধারণ (সন্ন্যাস), ভস্মানুলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষহীন মানুষের জীবিকার্জনের উপায় বলে বৃহস্পতি মনে করেন।
কিংবা–
‘অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্।
বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকা ধাতৃনির্মিতা ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাক বলেন,) যাদের না-আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মুরোদ তাদের জীবিকা হিসাবেই বিধাতা যেন সৃষ্টি করেছেন অগ্নিহোত্র যজ্ঞ, তিন বেদ, সন্ন্যাসীদের ত্রিদণ্ড, গায়ে ভস্মলেপন প্রভৃতি ব্যবস্থা।
স্বর্গ ইত্যাদি যে সব সুখপ্রদ স্থানের বর্ণনা বেদে আছে এবং মানুষকে যার প্রলোভন দেখিয়ে পুরোহিতেরা বঞ্চনা করেন সেগুলিতে চার্বাকদের কোন অনুমোদন নেই। এমনকি স্বর্গের সঙ্গে স্বর্গের দেবতাদেরও চার্বাকী ধারণায় প্রবেশাধিকার নেই।
এছাড়া, বৈদিক মন্ত্রগুলির মধ্যে চার্বাকেরা বিভিন্ন ধরনের ত্রুটির সন্ধান পেয়েছেন। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ মতে চার্বাক প্রদর্শিত এই ত্রুটিগুলি তিন ভাগে বিভক্ত– অনৃত, ব্যাঘাত এবং পুনরুক্তি। যেমন–
‘অনৃত-ব্যাঘাত-পুনরুক্ত দোষৈর্দূষিততয়া’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাক মতে) বেদ অনৃত দোষ (মিথ্যা কথা), ব্যাঘাত দোষ (পরস্পর বিরুদ্ধ কথা) ও পুনরুক্ত দোষে দূষিত হওয়ায় অপ্রমাণ এবং তা কেবল প্রতারকদের জীবিকার উপায় হয়েছে।
বৈদিক প্রামাণ্যের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধবাদীদের ঠিক এই জাতীয় অভিযোগের (বার্হস্পত্যসূত্র-৫৮) উল্লেখ ন্যায়সূত্রের মধ্যেও দেখা যায়। যেমন–
‘তদপ্রামাণ্যমনৃত-ব্যাঘাত-পুনরুক্ত-দোষেভ্যঃ।’- (ন্যায়সূত্র-২/১/৫৭)
অর্থাৎ : (পূর্বপক্ষ বলেন,) অনৃতদোষ, ব্যাঘাতদোষ এবং পুনরুক্তদোষ-বশত অর্থাৎ বেদে মিথ্যা কথা আছে, পদদ্বয় বা বাক্যদ্বয়ের পরস্পর বিরোধ আছে এবং পুনরুক্তি-দোষ আছে, এজন্য তার (বেদরূপ শব্দবিশেষের) প্রামাণ্য নেই।
মন্ত্রগত অনৃত বা অসত্য দোষের উদাহরণ প্রসঙ্গে কতকগুলি উক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, পুত্রকামী ব্যক্তি তাঁর কামনা পূরণের জন্য ‘পুত্রেষ্টি’ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে রত হবেন, পশুকামীর কামনা পূর্তি হবে ‘চিত্রা’ যজ্ঞের মাধ্যমে– বেদের বিধান এই রকম। কিন্তু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নির্দেশিত যজ্ঞগুলির অনুষ্ঠানের পরেও পুত্রলাভ বা পশুলাভ অনেক সময় দেখা যায় না। চার্বাক মতে এই ধরনের ব্যাপার বৈদিক মন্ত্রের অসত্যতা প্রতিপাদন করে। বেদবিরোধী এই পূর্বপক্ষীয় যুক্তির বর্ণনা ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ‘ন্যায়ভাষ্যে’ উদ্ধৃত হয়েছে–
‘শব্দস্য প্রমাণত্বং ন সম্ভবতি। কস্মাৎ? অনৃতদোষাৎ পুত্রকামেষ্টৌ। পুত্রকামঃ পুত্রেষ্ট্যা যজেতেতি নেষ্টৌ সংস্থিতায়াং পুত্রজন্ম দৃশ্যতে। দৃষ্টার্থস্য বাক্যস্যানৃতত্বাৎ অদৃষ্টার্থমপি বাক্যং “অগ্নিহোত্রং জুহুয়াৎ স্বর্গকাম” ইত্যাদ্যনৃতমিতি জ্ঞায়তে।’- (ন্যায়ভাষ্য-২/১/৫৭)
অর্থাৎ :
বেদরূপ শব্দবিশেষের অর্থাৎ বেদের প্রামাণ্য নাই। কেন? যেহেতু পুত্রকাম ব্যক্তির যজ্ঞে অর্থাৎ পুত্রেষ্টি যজ্ঞবিধায়ক বেদবাক্যে অনৃতদোষ আছে। কারণ, “পুত্রকাম ব্যক্তি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করবে”– এই বেদবাক্যবিহিত যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হলে পুত্র জন্ম দেখা যায় না। (অর্থাৎ পূর্বোক্ত বেদবাক্যানুসারে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করলেও যখন অনেকের পুত্র লাভ হয় না, তখন ঐ বেদবাক্য অনৃতদোষযুক্ত অর্থাৎ তা মিথ্যা।) আর পূর্বোক্ত দৃষ্টার্থক বেদবাক্য মিথ্যা বলে “স্বর্গকাম ব্যক্তি অগ্নিহোত্র হোম করবে” ইত্যাদি অদৃষ্টার্থক বাক্যও মিথ্যা, তা বোঝা যায়।
বেদের অপর একটি নির্দেশ– স্বর্গলাভে অভিলাষী ব্যক্তির অগ্নিহোত্র ইত্যাদি যজ্ঞের অনুষ্ঠান। চার্বাকেরা এ জাতীয় বিধানের মধ্যে মানুষকে প্রতারণার উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত পান। অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠাতার স্বর্গপ্রাপ্তি সত্যই হয় কিনা, সে বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। অপর পক্ষে, পুত্রেষ্টি ইত্যাদি যজ্ঞ, যেগুলির ফল প্রত্যক্ষগ্রাহ্য এবং সকলের পক্ষেই যার সঠিকতা বিচার করা সম্ভব, সেগুলির সম্বন্ধে বেদমন্ত্র যে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সব সময়ে সক্ষম নয়, তা এই যজ্ঞগুলির অনুষ্ঠান এবং সেগুলির ফলপ্রাপ্তির বিষয়ে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। কাজেই বৈদিক মন্ত্রের সত্যতায় বিশ্বাস রাখা সম্ভব নয়। আর স্বর্গপ্রাপ্তি ইত্যাদি সম্পর্কীয় বেদের বিধান নিছক প্রতারণামূলক। চার্বাকমতে, যিনি বেদে ঐ কথা বলেছেন, তিনি মিথ্যাবাদী বলে আপ্ত নন। সুতরাং তাঁর অন্য বাক্যও মিথ্যা। যে বক্তা মিথ্যাবাদী বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন, তিনি আপ্ত না হওয়ায় তাঁর অন্যান্য বাক্যগুলিও আপ্তবাক্য নয়। সুতরাং তাও প্রমাণ হতে পারে না।
‘ব্যাঘাত’ শব্দ পরস্পর বিরোধিতার দ্যোতক এবং বেদের মধ্যে বহু স্থানে একটি মন্ত্রের সাহায্যে অপর একটি মন্ত্রে নির্দেশিত বিধানের বিরোধিতা করা হয়েছে। অগ্নিহোত্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে কোন ক্ষেত্রে সূর্যোদয়ের আগে আবার কোন ক্ষেত্রে সূর্যোদয়ের পরে আহুতি প্রদানের বিধান দেখা যায়। তাই চার্বাকমতে বেদ প্রমাণ হতে পারে না, এর দ্বিতীয় কারণ– বেদে ব্যাঘাত বা বিরোধ-দোষ আছে। ‘ন্যায়ভাষ্যে’ পূর্বপক্ষীয় চার্বাকী যুক্তি বর্ণনা দেয়া হয়েছে–
‘বিহিতব্যাঘাতদোষাচ্চ হবনে। “উদিতে হোতব্যং, অনুদিতে হোতব্যং, সময়াধ্যুষিতে হোতব্য”মিতি বিধায় বিহিতং ব্যাহন্তি, “শ্যাবোহহস্যাহুতিমভ্যবহরতি য উদিতে জুহোতি, শবলোহস্যাহুতিমভ্যবহরতি হেনুদিতে জুহোতি, শ্যাবশবলৌ বাহস্যাহুতিমভ্যবহরতো যঃ সময়াধ্যুষিতে জুহোতি”। ব্যাঘাতাচ্চান্যতরন্-মিথ্যেতি।’- (ন্যায়ভাষ্য-২/১/৫৭)
অর্থাৎ :
হবনে অর্থাৎ উদিতাদি কালত্রয়ে হোমবিধায়ক বেদবাক্যে বিহিত ব্যাঘাত দোষবশত বেদের প্রামাণ্য নাই। কিভাবে? “উদিত কালে হোম করবে, অনুদিত কালে হোম করবে, সময়াধ্যুষিত কালে (সূর্য ও নক্ষত্রশূন্য কালে) হোম করবে”– এই বাক্যের দ্বারা কালত্রয়ে হোম বিধান করে আবার অপর বাক্যের দ্বারা বিহিতকে অর্থাৎ পূর্বোক্ত বাক্যের দ্বারা কালত্রয়ে বিহিত হোমকে ব্যাহত করা হয়েছে। সেই ব্যাঘাতক বাক্য কী? “যে ব্যক্তি উদিতকালে হোম করে, শ্যাব নামক কুকুর তাঁর আহুতি ভোজন করে। যে ব্যক্তি অনুদিত কালে হোম করে, শবল নামক কুকুর তাঁর আহুতি ভোজন করে। যে ব্যক্তি সময়াধ্যুষিত কালে হোম করে, শ্যাব ও শবল তাঁর আহুতি ভোজন করে”। ব্যাঘাতপ্রযুক্ত অর্থাৎ শেষোক্ত বেদবাক্যের সাথে পূর্বোক্ত বেদবাক্যের বিরোধবশত অন্যতর অর্থাৎ ঐ বাক্যদ্বয়ের মধ্যে কোন একটি বাক্য মিথ্যা।
তার মানে, বেদে ‘উদিত’, ‘অনুদিত’ ও ‘সময়াধ্যুষিত’ নামক কালত্রয়ে হোমের বিধান করে পরে আবার ঐ কালত্রয়েই বিহিত হোমের নিন্দা করা হয়েছে; ফলত সেই নিন্দা দ্বারা পূর্বোক্ত কালত্রয়ে হোম অকর্তব্য, তাই বলা হয়েছে। সুতরাং পূর্বে যে বিধিবাক্যের দ্বারা কালত্রয়ে হোম কর্তব্য বলা হয়েছে, সেই বিধিবাক্যের সাথে শেষোক্ত অর্থবাদ-বাক্যের বিরোধ হওয়ায় তা প্রমাণ হতে পারে না। ঐ বিরোধবশত তার মধ্যে যে-কোনও একটিকে মিথ্য বলতেই হবে। কালত্রয়ে হোমের কর্তব্যতাবোধক বাক্য মিথ্যা অথবা কালত্রয়ে হোমের নিন্দাবোধক শেষোক্ত বাক্য মিথ্যা। তাছাড়া যিনি ঐরূপ বিরুদ্ধার্থক বাক্যবাদী, তিনি আপ্ত হতে পারেন না। প্রমত্ত ব্যক্তিকে আপ্ত বলা যায় না। সুতরাং তাঁর কোনও বাক্যই আপ্তবাক্য না হওয়ায় তা প্রমাণ হতে পারে না।
এছাড়াও পুনরুক্তি বা একই শব্দের পুনঃ পুনঃ উল্লেখের দোষ বেদবচনে আরোপিত হয়েছে। বেদে পুনরুক্তদোষ আছে– এটি চার্বাকমতে বেদের অপ্রামাণ্যের তৃতীয় হেতু। এই চার্বাকী যুক্তির বর্ণনায় ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলা হয়েছে–
‘পুনরুক্তদোষাচ্চ অভ্যাসে দেশ্যমানে। “ত্রিঃ প্রথমামন্বাহ, ত্রিরুত্তমা”মিতি পুনরুক্তদোষো ভবতি, পুনরুক্তঞ্চ প্রমত্তবাক্যমিতি। তস্মাদপ্রমাণং শব্দোহনৃতব্যাঘাতপুনরুক্তদোষেভ্য ইতি।’- (ন্যায়ভাষ্য-২/১/৫৭)
অর্থাৎ :
বিধীয়মান অভ্যাসে অর্থাৎ মন্ত্রবিশেষের অভ্যাস বা পুনরাবৃত্তির বিধায়ক বেদবাক্যে পুনরুক্ত-দোষবশত বেদের প্রামাণ্য নাই। কিভাবে? “প্রথম মন্ত্রকে তিনবার অনুবচন করবে, অন্তিম মন্ত্রকে তিনবার অনুবচন করবে”– এতে অর্থাৎ এই বেদবাক্যের দ্বারা প্রথম ও অন্তিম সামিধেনীর তিনবার পাঠের বিধান করায় পুনরুক্তদোষ হয়। পুনরুক্ত প্রমত্তবাক্য। অতএব অনৃত, ব্যাঘাত ও পুনরুক্তদোষ-বশত শব্দ অর্থাৎ বেদনামক শব্দবিশেষ অপ্রমাণ।
বেদে তথা তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ-৩/৫) এগারটি ‘সামিধেনী’ অর্থাৎ অগ্নিপ্রজ্জ্বলন-মন্ত্র পঠিত হয়েছে। অথচ শতপথ-ব্রাহ্মণে (শতপথ ব্রাহ্মণ-১/৩/৫) পনেরটি সামিধেনী মন্ত্রের পাঠ বিহিত হয়েছে, এবং বলা হয়েছে হোতা পঞ্চদশ সামিধেনী মন্ত্র পাঠ না করলে যজ্ঞ নিষ্ফল হবে। এজন্য এই এগারটি সামিধেনী মন্ত্রের প্রথম ও শেষ মন্ত্রটি তিন তিনবার পাঠের বিধান করা হয়েছে। একই মন্ত্রকে তিনবার উচ্চারণ করলে পুনরুক্তি হয়। প্রমত্ত ব্যক্তিই ঐরূপ পুনরুক্তি করে। আর পুনরুক্ত হলে তা প্রমত্ত-বাক্যই বলতে হবে। প্রমত্ত ব্যক্তি আপ্ত নন, সুতরাং তাঁর বাক্য আপ্তবাক্য না হওয়ায় তা প্রমাণ হতে পারে না। অতএব পূর্বোক্তভাবে, চার্বাক-মতে, প্রথমত অনৃত, দ্বিতীয়ত ব্যাঘাত ও তৃতীয়ত পুনরুক্ত দোষবশত বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করা যায় না।
এভাবে বেদের মধ্যে আরো অনেক স্ববিরোধ অপরিদৃষ্ট নয়। যেমন বেদের কোথায়ও ‘মা হিংস্যাৎ’ এই বচনের দ্বারা হিংসা বা জীবহত্যা কোথায়ও নিষিদ্ধ হয়েছে, আবার বিরুদ্ধার্থক অপর বচনের দ্বারা গোহত্যা অনেক ক্ষেত্রে বেদের সমর্থন লাভ করেছে। আরও দেখা যায়, একটি মন্ত্রে রুদ্রের সংখ্যা এক, আবার অপর একটি মন্ত্রে এই সংখ্যা বহু। বেদবিদদের মধ্যেও আবার দুটি দল– কর্মবাদী (যেমন পূর্ব-মীমাংসক) ও জ্ঞানবাদী (যেমন উত্তর-মীমাংসক বা বৈদান্তিক)। এই দুটি দলের মধ্যে পারস্পরিক বিরুদ্ধাচরণের প্রবণতা বেদের মধ্যে সুপরিস্ফূট। এইভাবেও ব্যাঘাত বা বিরুদ্ধাচরণের দোষে দুষ্ট বৈদিক মন্ত্র চার্বাক মতে প্রামাণ্যের মর্যাদা লাভের যোগ্য নয়। মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ এই চার্বাকী যুক্তির বিবরণ পাওয়া যায়–
‘বৈদিকন্মন্যৈরেব ধূর্ত্তবকৈঃ পরস্পরং কর্মকাণ্ড-প্রামাণ্যবাদিভিঃ জ্ঞানকাণ্ডস্য জ্ঞানকাণ্ড-প্রামাণ্যবাদিভিঃ কর্মকাণ্ডস্য চ প্রতিক্ষিপ্তত্বেন।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ :
(চার্বাক বলেন) বৈদিকমনা ধূর্তবক কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্যবাদী মীমাংসকগণ ও জ্ঞানকাণ্ডের প্রামাণ্যবাদী বেদান্তিগণ পরস্পর বেদের জ্ঞানকাণ্ডের ও কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য খণ্ডন করেছেন, অর্থাৎ মীমাংসক জ্ঞানকাণ্ডের এবং বেদান্তী কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য খণ্ডন করেছেন। পরস্পর পরস্পরের প্রামাণ্য খণ্ডন করায় সমস্ত বেদেরই প্রামাণ্য খণ্ডিত হয়েছে।
এখানে বেদের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড বিষয়ে মীমাংসক ও বেদান্তীদের মধ্যে বিরোধটা কোথায়? ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র ভাষ্যে চার্বাকের বক্তব্য ও ব্যাখ্যায়, যাজ্ঞিক কর্ম মীমাংসকের বক্তব্য হলো, যে বাক্য বা বাক্য সমূহের দ্বারা পুরুষের কোন ক্রিয়াতে প্রবৃত্তি ও কোন ক্রিয়া থেকে নিবৃত্তি জন্মায়, তাই শাস্ত্র। শাস্ত্র হিত বিষয় উপদেশ করেন। যা হিত ও প্রয়োজনবৎ অর্থের বোধ জন্মায়, তা প্রমাণ হয়ে থাকে। বেদের কর্মকাণ্ড বিধেয় ও নিষেধ্য ক্রিয়ার উপদেশ করে পুরুষের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির বোধ জন্মায় বলে প্রমাণ হয়েছে। জ্ঞানকাণ্ড উপনিষদ বা বেদান্ত কোন ক্রিয়ার উপদেশ করেনি। সে ব্রহ্মকে উপদেশ করেছে। ব্রহ্ম ক্রিয়া বা সাধ্য নয়। তা দ্বারা কারও প্রবৃত্তি বা নিবৃত্তি জন্মে না। ব্রহ্ম সিদ্ধ বস্তু। সিদ্ধ বস্তুতে শব্দের শক্তিজ্ঞান সম্ভব নয় বলে বেদান্ত ব্রহ্মের বোধও জন্মাতে পারে না। অতএব তা শাস্ত্রও নয়, প্রমাণও নয়। কর্ম-মীমাংসক এভাবে বেদান্তের প্রামাণ্য খণ্ডন করেছেন।
অন্যদিকে জ্ঞানকাণ্ডী বেদান্তিরা বলছেন যে, যে বাক্য বা বাক্যসমূহ হিত উপদেশ করে, তাই শাস্ত্র, তাই প্রমাণ। ক্রিয়ার ফল স্বর্গাদি অনিত্য। তার বিনাশ আছে। ব্রহ্মজ্ঞানের ফল ব্রহ্মস্বরূপের প্রাপ্তি। তা-ই মুক্তি। তা নিত্য। তার বিনাশ নাই। তাই কর্ম অপেক্ষা ব্রহ্ম শ্রেষ্ঠ। বেদান্ত সেই ব্রহ্মের উপদেশ করেছে। বিচার সহকারে বেদান্ত বাক্য থেকে ব্রহ্মের প্রত্যক্ষ বৃত্তি উৎপন্ন হলে তা সমস্ত দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যার উচ্ছেদ করে দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি জন্মায়, আর কখনও তার দুঃখ সম্বন্ধ হয় না।
বেদান্তিরা আরও বলেন, আর যে কর্ম-মীমাংসক বলেছেন– সিদ্ধ বস্তুতে শক্তিজ্ঞান হয় না, তাও সঙ্গত নয়। আনয়ন ও নয়নাদি ক্রিয়া দ্বারা যেমন কার্যে বা কার্যবিশিষ্ট অর্থে শক্তিজ্ঞান হয়। তদ্রূপ হর্ষ, ভয়, শোক প্রভৃতি দ্বারা সিদ্ধ বস্তুতেও শক্তিজ্ঞান হয়ে থাকে। ব্রহ্মশব্দের ব্রহ্মে শক্তি জ্ঞান হলে ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ ‘তত্ত্বমসি’ ইত্যাদি মহাবাক্যের দ্বারা পরম পুরুষার্থের সাধক ব্রহ্ম স্বরূপের অনুভব উৎপন্ন হবে। কর্মকাণ্ড পুরুষার্থ নির্বাহের জন্য প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিকে আশ্রয় করেছে। বেদান্ত কর্মজনিত শ্রম বিনাই পুরুষার্থ সম্পাদন করে বলে তা অবশ্যই শাস্ত্র হবে। বিশেষ, বিহিত ক্রিয়া ব্রহ্মজ্ঞানের প্রয়োজক বলে এগুলি গৌণ প্রয়োজন, মুখ্য প্রয়োজন নয়। সুতরাং কর্মকাণ্ড প্রয়োজনবৎ অর্থের বোধক নয় বলে প্রমাণ নয়, বেদান্তই প্রমাণ। এই বলে বেদান্তিগণ কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য খণ্ডন করেছেন। ফলে সম্পূর্ণ বেদের প্রামাণ্য খণ্ডিত হওয়ায় বেদকে প্রমাণ বলা যায় না। এরই সমর্থনে ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ প্রামাণিক চার্বাক-ষষ্ঠির সমর্থন উদ্ধৃত করা হয়েছে (চার্বাকষষ্ঠি-২৪)–
‘প্রলাপমপি বেদস্য ভাগং মন্যধ্ব এব চেৎ ।
কেনাভাগ্যেন দুঃখান্ন বিধীনপি তথেচ্ছথ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।
অর্থাৎ : (চার্বাক বলেন,) যদি বেদের অংশবিশেষকেও প্রলাপোক্তি বলেই মেনে থাক, তবে কোন্ দুর্ভাগ্যবশে দুঃখকর বিধানগুলোকে তেমন স্বীকার করছ না?
এর তাৎপর্য হলো, কেবল বেদান্তিরাই যে কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য খণ্ডন করেছেন, তাই নয়। কর্ম-মীমাংসকরাও কোন বিষয় থেকে প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জন্মায় না বলে কর্মকাণ্ডের অর্থবাদ ভাগ, মন্ত্রভাগ ও নামধেয় ভাগকে অপ্রমাণ বলায় ফলত সম্পূর্ণ বেদকেই অপ্রমাণ বলেছেন। কারণ বেদের একটি ভাগ প্রমাণ, অপর ভাগগুলিকে অপ্রমাণ বলা যায় না। তাতে ‘অর্দ্ধজরতীয় ন্যায়’-এর উপস্থিতি হয়। অর্ধেক একরূপ, অন্য অর্ধ অন্যরূপ হলে তাকে ন্যায়ের পরিভাষায় অর্দ্ধজরতী বলে। যেমন একটি কুকুরের অর্ধেক দেহ যৌবনবিশিষ্ট, অপর অর্ধদেহ বার্ধক্য-বিশিষ্ট হলে ঐ কুকুরটিকে অর্দ্ধজরতী বলা যায়। তা যেমন অর্ধেক পাকের জন্য এবং অর্ধেক ডিম্বপ্রসবের জন্য হয় না। তেমনি অর্ধেক প্রমাণ, অর্ধেক অপ্রমাণ হতে পারে না। সুতরাং, চার্বাক মতে, বেদ প্রলাপ বাক্য। তা কখনও প্রমাণ হতে পারে না। জীবিকা নির্বাহ ছাড়া এর কোনো প্রয়োজন নেই।
(৪)
জৈমিনির ‘পূর্বমীমাংসাসূত্রে’ পূর্বপক্ষ হিসেবে বেদবিরোধীদের যে মত উদ্ধৃত হয়েছে তার সঙ্গে চার্বাক মতের অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়। সূত্রবর্ণিত পূর্বপক্ষীয় মত অনুসারে–
‘ইহার চারটি শৃঙ্গ, তিনটি চরণ, দুইটি মস্তক এবং সাতটি হস্ত’, বেদমন্ত্রে (ঋকবেদ-৪/৫৮/৩) অন্তর্ভুক্ত এই জাতীয় উক্তি অসম্ভব এবং অবাস্তব পদার্থের বিদ্যমানতার উল্লেখ করে।
‘হে ওষধি, তুমি একে রক্ষা কর; হে কুঠার তুমি একে হিংসা করো না; হে প্রস্তর সমূহ, তোমরা শোন’– ইত্যাদি মন্ত্রে ওষধি, প্রস্তর, কুঠার ইত্যাতি জড় বস্তুসমূহের সম্বোধন করার বৈদিক প্রচেষ্টা হাস্যকর।
‘বেদমন্ত্রে পরস্পর বিরোধিতার উদাহরণ হিসেবে পূর্বমীমাংসাসূত্রে বর্ণিত পূর্বপক্ষে ‘অদিতিই দ্যৌ এবং অদিতিই অন্তরীক্ষ’ ও ‘রুদ্র একজন দ্বিতীয় নাই এবং জগতে অসংখ্য সহস্র রুদ্র’– এই মন্ত্রগুলির উল্লেখ আছে।
‘সৃণ্যেব জর্ভরী তুর্ফরীতূ’ ‘ইন্দ্রঃ সোমস্য কাণুকা’ ইত্যাদি মন্ত্রের কোন অর্থ হয় না। (শাবরভাষ্য-মীমাংসাসূত্র-১/২/৩৪-৮)
এছাড়া– ‘বেদের নিত্যত্ব এবং অপৌরুষেয়ত্বের খণ্ডন প্রসঙ্গে এই পূর্বপক্ষীয় মতে কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে যে, বেদে ‘কীকট’ নামে জনপদ, ‘প্রমঙ্গদ’ নামে রাজা, ইত্যাদির অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে এই সব জনগদ বা নরপতির অস্তিত্বের পরবর্তী বেদের রচনাকাল। বেদের কোন কোন অংশে প্রাবাহণি উদ্দালকি ইত্যাদি মরণশীল মানুষের উল্লেখ আছে। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে বেদের এই বিশেষ অংশসমূহ উল্লিখিত ব্যক্তিগণের অস্তিত্বের পরবর্তী যুগে রচিত। কাঠক, পৈপ্পলাদ, কৌথুম ইত্যাদি বেদ শাখাগুলির বিশেষ বিশেষ নামের মধ্যেও কঠ, পিপ্পলাদ ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ বেদকর্তার অস্তিত্বের পরিচয় সুপরিস্ফূট। কাজেই বেদকে নিত্য বা অপৌরুষেয় মনে করার কোন কারণ নেই,– বেদবিরোধীদের এটাই অভিমত এবং জৈমিনির মীমাংসাসূত্রে পূর্বপক্ষ হিসাবে এই মতের উল্লেখ দেখা যায়।
পূর্বমীমাংসাসূত্রের শবরস্বামীকৃত ভাষ্যে (শাবরভাষ্য-১/১/৫) বেদের অপ্রামাণ্যবাদীদের মতের এক বিবরণ দেখা যায়। এই মত অনুসারে যে বস্তুর উপলব্ধি বিষয়বোধের সঙ্গে একাত্ম নয় তাকে অসৎ বলা উচিত– উদাহরণ হিসাবে এ ক্ষেত্রে তাঁরা শশশৃঙ্গের উল্লেখ করেন। পশু প্রভৃতির বাস্তব অস্তিত্ব অস্বীকার্য নয়, কিন্তু পশুকামী ব্যক্তি পশুলাভের আশায় যজ্ঞ করা সত্ত্বেও কাম্য পশু অদৃশ্যই থাকে। যে কোন ক্রিয়ার ফল হিসাবে কোন বস্তুর সদ্ভাবকে স্বীকার করতে হলে ক্রিয়ার সমকালীন বস্তুটির আবির্ভাব একান্ত প্রয়োজন। শরীরের মর্দনজনিত সুখ শরীর মর্দন করার সময়েই হয়, পরে নয়। বেদের অপ্রামাণ্যবাদীদের মত অনুসারে বৈদিক যজ্ঞে যে ফলের প্রতিশ্রুতি থাকে সেই ফল যজ্ঞের অনুষ্ঠানের সময়ে উৎপন্ন হয় না। প্রতিশ্রুত ফলের সদ্ভাব যখন দেখা যায় যজ্ঞ সে সময় অবিদ্যমান থাকে। অবিদ্যমান এই যজ্ঞকে ফলের কারণ হিসাবে কল্পনা করার স্বপক্ষে বেদবিরুদ্ধবাদীরা কোন যুক্তি দেখতে পান না। ফলপ্রাপ্তির সমকালীন অন্য নানা উপায়ের বর্তমানতা দেখা যায়, যেগুলিকে স্পষ্টভাবে এই ফলের কারণরূপে নির্দেশ করা যেতে পারে। শাবরভাষ্যে উল্লিখিত এই মত অনুসারে দৃষ্ট এই সব কারণগুলিকে উপেক্ষা করে অদৃষ্ট বৈদিক যজ্ঞাদিকে এই ফলের কারণ হিসাবে উল্লেখ করার কোন অর্থ হয় না। স্বর্গ ইত্যাদি অদৃষ্ট হলেও বৈদিক যজ্ঞসমূহের কারণতা স্বীকার করার পক্ষে কোন যুক্তি নেই।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১২৮-৯)
শ্রীহর্ষের ‘নৈষধীয়’ কাব্যে চার্বাক মতের মাধ্যমে বৈদিক ক্রিয়াপদ্ধতির তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। যাজকদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞের অনুষ্ঠানের ফল হিসেবে তাঁরা পুত্রলাভকে নির্দেশ করেন। পুত্রজন্মের বিকল্প পুত্রজন্মগ্রহণ না করা, এবং এই দুটি বিকল্পের একটিকে ফল হিসেবে যজ্ঞকারী লাভ করতে বাধ্য। যজ্ঞকারীর পুত্রলাভ হলে ধূর্ত যাজকেরা তাঁদের নির্দেশিত যজ্ঞকেই পুত্রলাভের কারণ হিসেবে প্রচার করেন। পুত্র জন্মগ্রহণ না করার ক্ষেত্রে যাজকেরা যজ্ঞের অঙ্গবৈকল্যকে সমস্ত ব্যাপারের জন্য দায়ী করেন। তাঁরা মন্তব্য করেন যে যজ্ঞানুষ্ঠান যথাবিহিত নিয়মানুসারী না হওয়ার ফলে যজমান যজ্ঞের মাধ্যমে অভিলষিত ফললাভে বঞ্চিত হয়েছেন। চার্বাকষষ্ঠিতে তাই বলা হয়েছে–
‘একং সন্দিগ্ধয়োস্তাবদ্ ভাবি তত্রেষ্টজন্মনি।
হেতুমাহুঃ স্বমন্ত্রাদীনসঙ্গানন্যথা বিটাঃ।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-১৯)।।
অর্থাৎ : উভয়পক্ষে সন্দেহের মধ্যে একটি অবশ্যই হবে। তার মধ্যে ঈপ্সিত বস্তুর প্রাপ্তি হলে ধূর্তেরা নিজেদের মন্ত্র প্রভৃতিকে তার কারণ বলে, অন্যথা হলে সেগুলোর অঙ্গহানি উল্লেখ করে।
শ্রীহর্ষের বর্ণনা অনুযায়ী ধূর্ত ব্রাহ্মণদের এ ধরনের কৈফিয়ৎ বিশ্বাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। চার্বাক মতে বেদের কোন কোন অংশের অপ্রামাণ্য প্রতিপাদন করার পর অবশিষ্ট অংশকে প্রামাণ্যের মর্যাদা দেওয়া অর্থহীন; কারণ এতে অনবস্থা দোষের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ আমরা অনুরূপ আলোচনা পর্যবেক্ষণ করেছি। সুতরাং বেদের কোন অংশই প্রমাণ নয়– এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই শ্রেয়। ‘নৈষধীয়’তে যে চার্বাকদের মত আলোচিত হয়েছে তাঁরা বৈদিক বচনে পরলোকের অস্তিত্বে সন্দেহের বিষয় উল্লেখ করেছেন। বৈদিক সাহিত্যের একেক জায়গায় একেক ধরনের পরলোকীয় বর্ণনা লক্ষ্য করা যায়। পরলোক প্রসঙ্গে বেদ বচনেই যখন সন্দেহ বর্তমান, তখন বেদবাক্যে আস্থাবান ব্যক্তিদের পরলোক সম্বন্ধীয় চার্বাকী ধারণায় ত্রুটির অনুসন্ধান করা অসমীচীন। আর পরলোক প্রসঙ্গে চার্বাকষষ্ঠিতে বলা হয়েছে–
‘কো হি বেদাস্ত্যমুষ্মিন্ বা লোকে ইত্যাহ যা শ্রুতিঃ।
তৎপ্রামাণ্যাদমুং লোকং লোকঃ প্রত্যেতু বা কথম্ ।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-২৬)।।
অর্থাৎ : কে জানে পরলোকে (সুখ) আছে কি-না– এইভাবে যে বেদ বলেছে, তাকে প্রমাণ ধরে নিয়ে পরলোক সম্বন্ধে লোকে কীভাবে বিশ্বাস করবে?
বেদ এবং বেদানুসারী ধর্মশাস্ত্রসমূহের বচনে নানা ভাবে ব্রহ্মচর্যের বিধান আছে; মানুষের উচ্ছৃঙ্খল কাম প্রবৃত্তিকে সংযত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উপদেশ এই গ্রন্থগুলিতে প্রচারিত। ‘নৈষধীয়’র অন্তর্গত চার্বাকী মতে বৈদিক দেবতা এবং ধর্মশাস্ত্রকারদের ব্যক্তিগত চরিত্রে অসংযম এবং উচ্ছৃঙ্খলতার বিভিন্ন দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করা হয়েছে। চার্বাক-ষষ্ঠিতে বলা হয়েছে–
‘পরদারনিবৃত্তির্যা সোহয়ং স্বয়মনাদৃতঃ।
অহল্যাকেলিলোলেন দম্ভো দম্ভোলিপাণিনা।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-৭)।।
‘গুরুতল্পগতৌ পাপকল্পনাং ত্যজত দ্বিজাঃ।
যেষাং বঃ পত্যুরত্যুচ্চৈর্গুরুদারগ্রহে গ্রহঃ।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-৮)।।
‘যস্ত্রিবেদবিদাং বন্দ্যঃ স ব্যাসোহপি জজল্প বঃ।
রামায়া জাতকামায়াঃ প্রশস্তা হস্তধারণা।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-১১)।।
‘বলাৎ কুরুত পাপানি সন্তু তান্যকৃতানি বঃ।
সর্বান্ বলকৃতান্ দোষানকৃতান্ মনুরব্রবীৎ ।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-১৩)।।
‘ন ভ্রাতুঃ কিল দেব্যাং স ব্যাসঃ কামাৎ সমাসজৎ।
দাসীরতস্তদাসীদ্ যন্মাত্রা তত্রাপ্যদেশি কিম্ ।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-৩০)।।
অর্থাৎ :
পরস্ত্রী থেকে যে নিবৃত্ত থাকা– সেটা হলো দম্ভ। বজ্রপাণি ইন্দ্র অহল্যার সঙ্গে কামক্রীড়ায় তৎপর হয়ে স্বয়ং তা উপেক্ষা করেছেন। (চার্বাকষষ্ঠি-৭)।। ওহে ব্রাহ্মণের দল! তোমরা এমন, যাদের পতি চাঁদের গুরুপত্নী সম্ভোগে অত্যন্ত আগ্রহ। অতএব গুরুপত্নী সম্ভোগে যে পাপ তার কল্পনা ত্যাগ কর। (চার্বাকষষ্ঠি-৮)।। ত্রিবেদজ্ঞ পণ্ডিত তোমাদের আরাধ্য ব্যাসদেবও বলেছেন– কামার্ত রমণীর হস্তধারণ যুক্তিযুক্ত। (চার্বাকষষ্ঠি-১১)।। জোর করে পাপ কর, সে-সব তোমাদের না-করা হিসেবে থাকবে। মনুই তো বলেছেন– বলপূর্বক সব কিছু করে ফেলা তো না-করা দোষ। (চার্বাকষষ্ঠি-১৩)।। ঐ ব্যাস ভ্রাতৃবধূর প্রতি নাকি কামবশে আসক্ত হয় নি। তখন দাসীর সঙ্গে সে যে রত ছিল, তাতেও কি মা আদেশ করেছিলেন? (চার্বাকষষ্ঠি-৩০)।।
এই দৃষ্টান্তগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে বেদানুসারী নীতিবাক্যগুলির অর্থহীনতায় কোন সন্দেহ থাকে না। যে ব্রাহ্মণেরা নিজেদের ক্রোধ সংযত করতে অসমর্থ তাঁরাই নানাভাবে ক্রোধকে দমন করার পরামর্শ দেন–
‘অক্রোধং শিক্ষয়ন্ত্যন্যৈঃ ক্রোধনা যে তপোধনাঃ।
নির্ধনাস্তে ধনায়ৈব ধাতুবাদোপদেশিনঃ।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-৪৪)।।
অর্থাৎ : যে ক্রোধী তপস্বীরা অপরকে ক্রোধের অভাব বিষয়ে শিক্ষা দেয়, তারা নির্ধন হওয়ায় ধনের জন্যই ধাতুবিষয়ক কথার উপদেশ দেয়।
বেদাদি শাস্ত্রসমূহের প্রবক্তা ব্রাহ্মণদের নিজস্ব আচরণ এবং নির্দেশনার মধ্যে এ ধরনের পরস্পর-বিরোধিতার প্রচুর নমুনা থাকায় চার্বাকেরা এঁদের উপদেশ সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে নিজ নিজ অভিরুচি অনুযায়ী বিচরণ করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন–
‘শ্রুতিস্মৃত্যর্থবোধেষু ক্কৈকমত্যং মহাধিয়াম্ ।
ব্যাখ্যা বুদ্ধিবলাপেক্ষা সা নোপেক্ষ্যা সুখোন্মুখী।।’ (চার্বাকষষ্ঠি-১৫)।।
অর্থাৎ : বেদ ও স্মৃতিশাস্ত্রের অর্থবোধের বিষয়ে মহাজ্ঞানীদের মধ্যে কোথায় ঐকমত্য রয়েছে? ব্যাখ্যা বুদ্ধিবলের উপর নির্ভরশীল। সুখের অভিমুখী ব্যাখ্যা উপেক্ষণীয় নয়।
(৫)
বিভিন্ন গ্রন্থে উদ্ধৃত লোকায়ত বৃহস্পতিবচনের মধ্যে লৌকিক ব্যবহারের সঙ্গে তুলনায় বৈদিক অনুষ্ঠানগুলির অযৌক্তিকতা এবং অর্থহীনতা প্রতিপাদনের চেষ্টা দেখা যায়। যেমন, শ্রীহর্ষের ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়ে’র বর্ণনায় বার্হস্পত্য-মতে যজ্ঞের সাক্ষাৎ ফল হলো–
‘কর্তৃক্রিয়াদ্রব্যবিনাশ’। (প্রবোধচন্দ্রোদয়)
অর্থাৎ, তার তাৎপর্য্য হলো, মৃত্যুর মাধ্যমে যজ্ঞকর্তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়, যজ্ঞানুষ্ঠানের পরেই যজ্ঞক্রিয়া অতীতের গহ্বরে প্রবেশ করে, যজ্ঞে ব্যবহৃত দ্রব্যাদিও কিছুক্ষণের মধ্যে বিনষ্ট হয়।
আর তাই ‘সর্বমতসংগ্রহ’ গ্রন্থে এই বৃহস্পতির মত বর্ণনায় বলা হয়েছে–
‘স্বর্গঃ কর্তৃক্রিয়াদ্রব্যবিনাশে যদি যজনাম্ ।
ততো দাবাগ্নিদগ্ধানাং ফলং স্যাদ্ ভুরি ভুরুহাম্ ।।’ (সর্বমতসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (বার্হস্পত্যরা বলেন,) যে অনুষ্ঠানের অঙ্গীভূত সব অংশই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তার সাহায্যে যদি যজ্ঞকারীর জন্য স্বর্গের দ্বার উন্মোচিত হয়, তাহলে দাবানলে বনের যাবতীয় বৃক্ষ ভস্মীভূত হবার পরও সেই বিনষ্ট বৃক্ষ থেকে আমরা অনুরূপভাবে প্রচুর ফল আশা করতে পারি।
বেদমতে জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে যে পশুকে বলি দেওয়া হয় সেই পশুর স্বর্গপ্রাপ্তি ঘটে। বৃহস্পতিবচনে ঐ ক্ষেত্রে মন্তব্য করা হয়েছে, যা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, এই বিশ্বাস যজ্ঞে পশুবলির প্রকৃত কারণ হলে যজমান পশুর পরিবর্তে নিজ পিতাকেই যজ্ঞের বলি হিসেবে মনোনীত করতে পারেন; কারণ, পিতার স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য অনুষ্ঠেয় ব্যয়সাপেক্ষ অন্য পদ্ধতির তুলনায় এই উপায় অনেকাংশে সহজতর।–
‘পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গং জ্যোতিষ্টোমে গমিষ্যতি।
স্বপিতা যজমানেন তত্র কস্মান্ন হিংস্যতে।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে নিহত পশু যদি সরাসরি স্বর্গেই যায়, তাহলে যজমান কেন নিজের পিতাকে হত্যা করে না? (অর্থাৎ, স্বর্গে যাবার অমন সোজা সড়ক থাকতেও যজমান কেন নিজের পিতাকে তা থেকে বঞ্চিত করে?)
চার্বাক মতে দেহনাশের পরই জীবের যাবতীয় অস্তিত্বের অবসান। কাজেই মানুষের মরণোত্তর আত্মার তৃপ্তি বিধানের জন্য শ্রাদ্ধাদি যে সব অনুষ্ঠানের বিধান বেদে আছে, চার্বাকী বর্ণনায় সেগুলিকে নানাভাবে সমালোচনা করা হয়েছে। নির্বাপিত দীপ যেমন ঘৃত ইত্যাদির যথেষ্ট সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও আলোকদানে অক্ষম, জীবনদীপ যে ব্যক্তির নির্বাপিত হয়েছে সেও এইভাবে শ্রাদ্ধের মাধ্যমে উৎসর্গীকৃত বিবিধ ভোজ্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও ভোজনরহিত তৃপ্তিলাভে সমর্থ হয় না। ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ ও ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ একই নমুনা শ্লোক উদ্ধৃত করে এই চার্বাকী মনোভাব উপস্থাপন করা হয়েছে।–
‘মৃতানামপি জন্তূ’নাং শ্রাদ্ধং চেৎ তৃপ্তিকারণম্।
নির্বাণস্য প্রদীপস্য স্নেহঃ সংবর্ধয়েৎ শিখাম্।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : কেউ মারা যাবার পর শ্রাদ্ধকর্ম যদি তার তৃপ্তির কারণ হয়, তাহলে তো প্রদীপ নিভে যাবার পরেও তেল ঢেলে তার শিখা প্রদীপ্ত করা যেতো।
আসলে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানের মূলে অন্তর্নিহিত এই ধারণার স্বীকৃতি থাকে যে ভোজ্যবস্তুর কাছে সাক্ষাৎভাবে উপস্থিত না থেকেও ভোজ্যবস্তু উপভোগ করা সম্ভব– যার ভিত্তিতে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে অনুপস্থিত মৃত আত্মার পক্ষেও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দেয় ভোজ্যবস্তুর মাধ্যমে পরিতৃপ্তির অধ্যাত্মবাদী কল্পনাতে কোন অসঙ্গতি দেখা যায় না। কিন্তু চার্বাক মতে এ জাতীয় ধারণায় প্রকৃত সার্থকতা থাকলে দূরযাত্রী পথিক সঙ্গে কোনদিন খাদ্যাদি বহন করতো না; কারণ, গৃহের অভ্যন্তর থেকে কোন ব্যক্তি যদি তার উদ্দেশ্যে ভোজ্য উৎসর্গ করতো তাহলেই পথে তার ক্ষুধার নিবৃত্তি হতো। অনুরূপভাবে এক গৃহের অন্তর্গত অধিবাসীদের প্রত্যেকের কাছে খাদ্য সরবরাহ করারও কোন প্রয়োজন হতো না, উপরের তলার ব্যক্তিরা নীচের তলায় রাখা খাবারের সাহায্যেই উদরপূর্তি করতে সক্ষম হতো। এটিই চার্বাক মত হিসেবে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। যেমন–
‘গচ্ছতামিহ জন্তূ’নাং ব্যর্থং পাথেয়কল্পনম্।
গেহস্থকৃতশ্রাদ্ধেন পথি তৃপ্তিরবারিতা।।’
‘স্বর্গস্থিতা যদা তৃপ্তিং গচ্ছেয়ুস্তত্র দানতঃ।
প্রাসাদস্যোপরিস্থানামত্র কস্মান্ন দীয়তে ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ :
যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার পাথেয়-ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো। (অর্থাৎ গ্রামান্তরগামীর পক্ষে তো তাহলে পাথেয় হিসেবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার হতো না।)।। যিনি স্বর্গে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে দান নেহাতই বৃথা, কেননা তাহলে যিনি প্রাসাদের উপরে উঠে গেছেন তাঁর উদ্দেশ্যে (মাটিতে বসে) দান করলেও তো তাঁর তৃপ্তি হবার কথা।।
‘রামায়ণে’ জাবালির মাধ্যমে যে চার্বাক মতবাদের প্রকাশ, বৈদিক যাগযজ্ঞের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ তার ভিতরও সুপরিস্ফূট। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বিরোধিতা প্রসঙ্গেও জাবালি একই ধরনের যুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন–
‘অষ্টকাপিতৃদৈবত্যমিত্যয়ং প্রসৃতো জনঃ।
অন্নস্যোপদ্রবং পশ্য মৃতো হি কিমশিষ্যতি।।
যদি ভুক্তমিহান্যেন দেহমন্যস্য গচ্ছতি।
দদ্যাৎ প্রবসতাং শ্রাদ্ধং ন তৎ পথ্যদানং ভবেৎ।।’ (রামায়ণ-২/১০৮/১৪-৫)
অর্থাৎ :
শ্রাদ্ধে অর্পিত পিণ্ড-অষ্টক বা ভোজ্য বস্তুর দ্বারা যদি পরলোকস্থিত আত্মার ভোজনস্পৃহা নিবৃত্ত হয়, তাহলে একইভাবে প্রবাসী এবং দূরগামী ব্যক্তিরাও তৃপ্তি পেতে পারেন। বৈদিক শ্রাদ্ধের যাঁরা নির্দেশ দেন শ্রাদ্ধের বিধানের পরিবর্তে তাঁদের এইভাবে ইহলোকস্থ নিজ নিজ বন্ধু ও আত্মীয়ের পথ্য-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত ছিলো।
‘বিষ্ণুপুরাণে’ নাস্তিকবাদী মায়ামোহকৃত বেদ ও বৈদিক যাগযজ্ঞের নিন্দার মধ্যে পশুবলি ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের বিরোধিতা প্রাধান্য লাভ করেছে। যজ্ঞে পশুবধের সমর্থনে বেদবিহিত নির্দেশ এই মতে অযৌক্তিক। তাই সেখানে বলা হয়েছে–
‘নৈতদ যুক্তিসহং বাক্যং হিংসা ধর্মায় নেষ্যতে।’ (বিষ্ণুপুরাণ-৩/১৮/২৪)
অর্থাৎ : অযৌক্তিক হিংসার পথে কখনও ধর্মের অনুষ্ঠান হতে পারে না।
‘যজ্ঞাগ্নিতে ঘৃতাহুতির মাধ্যমে যজ্ঞকারী তাঁর আকাঙ্ক্ষিত ফলের অধিকারী হতে পারেন– বেদের এ ধরনের বিধানকে মায়ামোহের উক্তিতে বালকের বচন বলা হয়েছে; কারণ, পরিণতবুদ্ধি কোন ব্যক্তির মুখে এ জাতীয় বাক্য শোভা পায় না। যজ্ঞে ইন্দ্রাদি দেবতার ভোজ্য হিসেবে শমী ইত্যাদি কাষ্ঠের ব্যবহার প্রসিদ্ধ। এই সব কাষ্ঠের তুলনায় পশুখাদ্যরূপে ব্যবহৃত কোমল বৃক্ষপত্র গুণগত বিচারে শ্রেয়ত্বের দাবি রাখে। ‘বিষ্ণুপুরাণে’র অন্তর্গত নাস্তিক মত অনুসারে বেদের নির্দেশ কার্যত এই সব দেবতাদের পশু অপেক্ষাও হীন প্রতিপন্ন করে।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১৩২)
বৈদিক যজ্ঞগুলির অন্তর্ভুক্ত কোন কোন ক্রিয়াপদ্ধতি শালীনতার মাপকাঠির বিচারে সমর্থনযোগ্য নয় বলে মনে করা হয়। এই প্রসঙ্গে অশ্বমেধ যজ্ঞের নাম উল্লেখযোগ্য। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ উদ্ধৃত বৃহস্পতি বচনে অশ্বমেধ যজ্ঞের অঙ্গীভূত কোন বিশেষ আচারের নিন্দা দেখা যায়। এই জাতীয় অশ্লীল আচারের যাঁরা বিধান দেন বৃহস্পতিবচনে তাঁদেরকে ‘ভণ্ড’ সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়েছে–
‘অশ্বস্যাত্র হি শিশ্নং তু পত্নীগ্রাহ্যং প্রকীর্তিতম্ ।
ভণ্ডৈস্তদ্বৎ পরং চৈব গ্রাহ্যজাতং প্রকীর্তিতম্।
মাংসানাং খাদনং তদ্বন্নিশাচর-সমীরিতম্।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (বৃহস্পতি বলেন,) সেই ভণ্ডরাই বিধান দিয়েছেন, অশ্বমেধ-যজ্ঞে যজমান-পত্নী অশ্বের শিশ্ন গ্রহণ করবে। তেমনি প্রতারকেরাই (নিশাচর) মাংস খাবার মতলবে (যজ্ঞে পশুবলির) বিধান দিয়েছেন।
(৬)
বৈদিক কর্মকাণ্ডকে ভারতীয় দর্শনকারেরা সকলে সমর্থন না করলেও বেদ সম্বন্ধে ছাঁচাছোলা চার্বাকী মন্তব্য যে বহুক্ষেত্রে বেদ সমর্থকদের বিরক্তি উৎপাদন করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বেদের প্রামাণ্য যুক্তির সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে না; কাজেই যুক্তির মাধ্যমে চার্বাকী আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে এঁদের ভূমিকা বিশেষ সাফল্যমণ্ডিত নয়। বৈদিক মন্ত্র ও ক্রিয়াকলাপের মধ্যে যে অলৌকিক জগতের ইঙ্গিত মেলে, সেই ইঙ্গিতের সূত্র ধরেই বিভিন্ন ভারতীয় দর্শন তাদের মতবাদের ব্যবহারিক ভিত্তি গড়ে তুলেছে। বেদের মাহাত্ম্যের মূলে আছে এই অলৌকিকত্ব। ফলে লৌকিক কোন প্রমাণের মাধ্যমে ভারতীয় ঐতিহ্যের ভিত্তিরূপী এই কর্মকাণ্ডের প্রামাণ্য নিরূপণের প্রয়াস সার্থক হতে পারে না। এ ব্যাপারে বেদের প্রামাণ্যের সপক্ষে চার্বাক মতের সমালোচকদের (ন্যায়কুসুমাঞ্জলী-২/৩) এটাই বক্তব্য যে, বৈদিক কর্ম পদ্ধতি যাঁদের দ্বারা অনুমোদিত তাঁরা প্রকৃত সংযমী এবং সর্বপ্রকার প্রতারণার উর্ধ্বে। তাঁদের মতে বৈদিক কর্মকাণ্ড এই কারণেই উপেক্ষণীয় নয়।
বীতরাগ অথবা কৃতধর্মা পুরুষের উক্তি হিসেবে বেদকে অনেকে প্রামাণ্য দিতে ইচ্ছুক। বেদপ্রামাণ্যের সমর্থক এই দার্শনিকেরা যুক্তি দেখান যে, ‘আপ্ত’ সংজ্ঞায় পরিচিত এই ব্যক্তিদের বচন সব সময়েই অবিসংবাদী এবং সত্য। কারণ ক্ষীণদোষ এই পুরুষদের মিথ্যা বলার কোন হেতু থাকতে পারে না। কিন্তু চার্বাকমতে বলা হয়, পুরুষের আপ্তসম্বন্ধীয় জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে হতে পারে না। একমাত্র অনুমানের সাহায্যেই জানা সম্ভব কোনও ব্যক্তি প্রকৃত আপ্ত কিনা। কিন্তু এ ব্যাপারে অনুমানের কার্যকরিতা চার্বাকদের অনুমোদন সাপেক্ষ নয়।
চার্বাকেতর ভারতীয় দার্শনিকদের দ্বারা সাধারণভাবে স্বীকৃত তিনটি প্রমাণ– প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং আপ্তবাক্যের উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। প্রমাণগুলির মধ্যে প্রথম দুটি, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও অনুমান সম্বন্ধে চার্বাকী মনোভাব ও সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। অধ্যাত্মবাদী ভারতীয় দার্শনিকদের কাছে তৃতীয় প্রমাণ অর্থাৎ শব্দপ্রমাণ বা আপ্তবাক্য বহুক্ষেত্রে বেদের সঙ্গে অভিন্ন। এই তৃতীয় প্রমাণ সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণা কিরূপ তা বেদ বিষয়ে চার্বাকী মনোভাবের ইঙ্গিত আমরা ইতোমধ্যেই উপরিউল্লিখিত সীমিত আলোচনা থেকে পেয়ে গেছি নিশ্চয়ই। অধ্যায়ান্তরে উপস্থাপিত চার্বাকষষ্ঠির প্রামাণিক লোকগাথাগুলি এরকম আরো অনেক প্রামাণ্য-নজির বহন করে।
মোট কথা, বেদের প্রামাণ্য যে অলৌকিকতাকে কেন্দ্র করে, যুক্তি বা অন্য লৌকিক প্রমাণের অপেক্ষা না রেখে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে প্রচারিত– চার্বাকেরা যুক্তির সাহায্যে তার আবরণ উন্মোচন করতে চেয়েছেন। এ প্রচেষ্টার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা, অতীন্দ্রিয় যে জগতের অস্তিত্বের ইঙ্গিতে বেদবচনের প্রকৃত মাহাত্ম্য নিহিত, সেই অতীন্দ্রিয়তাই বহু ক্ষেত্রে যাজকসম্প্রদায়ের যথেচ্ছচারিতায় মাধ্যম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চার্বাক মতবাদের আবির্ভাবের জন্য বৈদিক অলৌকিকতার এই অপপ্রয়োগকেই অনেকাংশে দায়ি করা চলে বলে মনে করা হয়। যথেচ্ছচারিতার পথের দিকে অলৌকিকতা বহু ক্ষেত্রেই প্রসারিত। তাই যাজক সম্প্রদায়ের অনাচার যাঁরা প্রতিহত করতে চেয়েছেন তাঁরা অলৌকিকতাকে প্রামাণ্যের আসর থেকে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কৃত করে এই যথেচ্ছচারিতার মূলোচ্ছেদে অগ্রসর হয়েছেন। ফলে চার্বাক মতবাদের আবির্ভাব বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের এই আতিশয্যের যুগে নির্ভুল লৌকিক প্রমাণের উপর এই দর্শনে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
চার্বাকী বস্তুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনার এ-পর্যায়ে এসে নিশ্চয় এমন প্রশ্ন অস্বাভাবিক হবে না যে, চার্বাককে কী অর্থে বস্তুবাদী দর্শন বলা যায়? অর্থাৎ, কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা বলতে পারি যে চার্বাকদর্শন প্রকৃতই বস্তুবাদী দর্শন? এ প্রশ্নে উত্তর নির্ণয়ের সুবিধার্থে ছোট্ট একটি প্রাক্-প্রশ্নও মনে রাখা দরকার, বস্তুবাদের বিপরীতার্থক শব্দ যে ভাববাদ, যার প্রতিপক্ষ হয়ে চার্বাকেরা তাঁদের বস্তুবাদী সিদ্ধান্তগুলিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে, সামান্য কথায় সেই ভাববাদ বলতেই বা কী বুঝি আমরা?
বীতরাগ অথবা কৃতধর্মা পুরুষের উক্তি হিসেবে বেদকে অনেকে প্রামাণ্য দিতে ইচ্ছুক। বেদপ্রামাণ্যের সমর্থক এই দার্শনিকেরা যুক্তি দেখান যে, ‘আপ্ত’ সংজ্ঞায় পরিচিত এই ব্যক্তিদের বচন সব সময়েই অবিসংবাদী এবং সত্য। কারণ ক্ষীণদোষ এই পুরুষদের মিথ্যা বলার কোন হেতু থাকতে পারে না। কিন্তু চার্বাকমতে বলা হয়, পুরুষের আপ্তসম্বন্ধীয় জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে হতে পারে না। একমাত্র অনুমানের সাহায্যেই জানা সম্ভব কোনও ব্যক্তি প্রকৃত আপ্ত কিনা। কিন্তু এ ব্যাপারে অনুমানের কার্যকরিতা চার্বাকদের অনুমোদন সাপেক্ষ নয়।
চার্বাকেতর ভারতীয় দার্শনিকদের দ্বারা সাধারণভাবে স্বীকৃত তিনটি প্রমাণ– প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং আপ্তবাক্যের উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। প্রমাণগুলির মধ্যে প্রথম দুটি, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও অনুমান সম্বন্ধে চার্বাকী মনোভাব ও সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে আলোচিত হয়েছে। অধ্যাত্মবাদী ভারতীয় দার্শনিকদের কাছে তৃতীয় প্রমাণ অর্থাৎ শব্দপ্রমাণ বা আপ্তবাক্য বহুক্ষেত্রে বেদের সঙ্গে অভিন্ন। এই তৃতীয় প্রমাণ সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণা কিরূপ তা বেদ বিষয়ে চার্বাকী মনোভাবের ইঙ্গিত আমরা ইতোমধ্যেই উপরিউল্লিখিত সীমিত আলোচনা থেকে পেয়ে গেছি নিশ্চয়ই। অধ্যায়ান্তরে উপস্থাপিত চার্বাকষষ্ঠির প্রামাণিক লোকগাথাগুলি এরকম আরো অনেক প্রামাণ্য-নজির বহন করে।
মোট কথা, বেদের প্রামাণ্য যে অলৌকিকতাকে কেন্দ্র করে, যুক্তি বা অন্য লৌকিক প্রমাণের অপেক্ষা না রেখে যা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে প্রচারিত– চার্বাকেরা যুক্তির সাহায্যে তার আবরণ উন্মোচন করতে চেয়েছেন। এ প্রচেষ্টার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কেননা, অতীন্দ্রিয় যে জগতের অস্তিত্বের ইঙ্গিতে বেদবচনের প্রকৃত মাহাত্ম্য নিহিত, সেই অতীন্দ্রিয়তাই বহু ক্ষেত্রে যাজকসম্প্রদায়ের যথেচ্ছচারিতায় মাধ্যম হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চার্বাক মতবাদের আবির্ভাবের জন্য বৈদিক অলৌকিকতার এই অপপ্রয়োগকেই অনেকাংশে দায়ি করা চলে বলে মনে করা হয়। যথেচ্ছচারিতার পথের দিকে অলৌকিকতা বহু ক্ষেত্রেই প্রসারিত। তাই যাজক সম্প্রদায়ের অনাচার যাঁরা প্রতিহত করতে চেয়েছেন তাঁরা অলৌকিকতাকে প্রামাণ্যের আসর থেকে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কৃত করে এই যথেচ্ছচারিতার মূলোচ্ছেদে অগ্রসর হয়েছেন। ফলে চার্বাক মতবাদের আবির্ভাব বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের এই আতিশয্যের যুগে নির্ভুল লৌকিক প্রমাণের উপর এই দর্শনে অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
চার্বাকী বস্তুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনার এ-পর্যায়ে এসে নিশ্চয় এমন প্রশ্ন অস্বাভাবিক হবে না যে, চার্বাককে কী অর্থে বস্তুবাদী দর্শন বলা যায়? অর্থাৎ, কোন্ কোন্ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমরা বলতে পারি যে চার্বাকদর্শন প্রকৃতই বস্তুবাদী দর্শন? এ প্রশ্নে উত্তর নির্ণয়ের সুবিধার্থে ছোট্ট একটি প্রাক্-প্রশ্নও মনে রাখা দরকার, বস্তুবাদের বিপরীতার্থক শব্দ যে ভাববাদ, যার প্রতিপক্ষ হয়ে চার্বাকেরা তাঁদের বস্তুবাদী সিদ্ধান্তগুলিতে অনড় অবস্থান নিয়েছে, সামান্য কথায় সেই ভাববাদ বলতেই বা কী বুঝি আমরা?
Tags
চার্বাক দর্শন