চার্বাকী বস্তুবাদ

চার্বাকী বস্তুবাদ
ভারতীয়  দর্শন

চার্বাক সিদ্ধান্তের আলোচনার সময় প্রথমেই আমাদের যে বিষয়টি মনে রাখা আবশ্যক তা হলো, চার্বাককে দেখা উচিত ভারতীয় একটি দর্শন হিসেবেই এবং এই চার্বাক দর্শনের সামগ্রিক চিত্রায়ণ ভারতীয় দর্শনের সাধারণ ধারার পরিপ্রেক্ষিতেই করা উচিত। সে বিবেচনায়, আমরা আগেই দেখেছি যে কেবল থিওরি বা মতবাদের মধ্যে ভারতের কোন দর্শনই আসলে সম্পূর্ণভাবে রূপায়িত নয়। আর তাই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দর্শনটি যে আকারে প্রতিভাত, দর্শনের সম্পূর্ণ রূপরেখার বিচারে তার আলোচনাও আবশ্যক বৈকি।

মতবাদের ক্ষেত্রে চার্বাক নাস্তিক, অর্থাৎ ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনকে কেন্দ্র করে যে মূল্যবোধ ভারতীয় ঐতিহ্যে বহুকাল ধরে সঞ্চিত, তার সমালোচনার ভিত্তিতে নেতিবাচক রূপে চার্বাকের প্রতিষ্ঠা। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই নাস্তিকতার রূপায়ণ কি সম্ভব? এই প্রশ্নটিকে ঘিরে ভারতীয় দার্শনিক গোষ্ঠীতে এই চার্বাকগোষ্ঠীর আবির্ভাব ইতিবাচক বিশেষ কোন আচরণবিধির পটভূমিতে নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করা চলে, এই আচরণবিধি ভারতের সনাতন ধারার পরিপন্থী হলেও। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘নাস্তিক’ শব্দ যদিও নেতিবাচক রূপই প্রকাশ করে, তবুও চার্বাক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাহচর্যের ফলে এই সংজ্ঞা ইতিবাচক কিছু অর্থের দ্যোতক অবশ্যই। এবং নাস্তিকদের এই ইতিবাচক রূপের প্রকাশ সনাতনগোষ্ঠীর বিরোধী কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে।

সনাতনপন্থী দার্শনিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে চার্বাকগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নামে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক মত প্রচার করার প্রবণতা ইতঃপূর্বেই লক্ষ্য করেছি। সেক্ষেত্রে আমাদের বিচারে পুরন্দরপন্থী চার্বাকমতই যে আসলে দার্শনিক দৃষ্টিতে প্রকৃত চার্বাকমত হওয়ার যোগ্য– এবং হয়তো সেটাই ছিলো– তাও আমরা ঐতিহাসিক বিবেচনায় অনুসন্ধান ও রূপায়নের প্রচেষ্টা করেছি। এই চার্বাকগোষ্ঠীই হলো বস্তুবাদী চার্বাক। তবে– ‘এই চার্বাকদের পরিপূর্ণ আলেখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিকদের গ্রন্থে অদৃশ্য। কারণ এই দার্শনিকদের মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে কেবল চার্বাকী হেতুবাদ, তর্কের সাহায্যে যা প্রতিপক্ষের ত্রুটি উন্মোচনে উন্মুখ। চার্বাকদের রীতিনীতি এবং আচরণবিধির কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় দর্শনের সঙ্কলন গ্রন্থগুলিতে এবং সমসাময়িক অন্যান্য কিছু গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চার্বাকদের বিবরণী থেকে। প্রতিদ্বন্দ্বী দার্শনিকেরা চার্বাকী আক্রমণের আঘাত থেকে নিজ নিজ মতবাদগুলিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন– ফলে তাঁদের বর্ণনা হয়েছে পারস্পরিক তর্কযুদ্ধের এক বিবরণী। অন্যান্য ব্যাপারগুলিকে নিজেদের আলোচনার পরিসরে তাঁরা অন্তর্ভুক্ত করেননি। অন্যান্য গ্রন্থগুলিতে অবশ্য তর্কযুদ্ধের এ ছবি নেই, আছে কেবল চার্বাকী আচরণবিধির এবং কোন কোন ক্ষেত্রে এই আচরণবিধির সমর্থনে চার্বাক পক্ষের যুক্তির কিছু বর্ণনা।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৪)

যেমন– ‘বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রে’র বর্ণনা অনুসারে (কামসূত্র-১/২/২৯/৩০) চার্বাকদের জগৎ প্রধানতঃ বর্তমানকে কেন্দ্র করে। বাৎস্যায়ন ‘কামসূত্রে’র ‘সাধারণািধকরণম্’-এর দ্বিতীয় অধ্যায় ‘ত্রিবর্গপ্রতিপত্তিঃ’-তে লোকায়তিক বর্ণনায় বলছেন–
‘নধর্ম্মাংশ্চরেৎ; এষ্যৎফলত্বাৎ, সাংশয়িকত্বাচ্চ।।
কো হ্যবালিশো হস্তগতং পরগতং কুর্য্যাৎ।।
বরমদ্য কপোতঃ শ্বো ময়ূরাৎ।।
বরং সংশয়িকান্নিষ্কাদসাংশয়িকঃ কার্যাপণঃ।–ইতি লৌকায়তিকাঃ।’-
(কামসূত্র-১/২/২১-২৪)।।
অর্থাৎ :
‘ধর্ম্মাচরণ করিবার প্রয়োজন নাই;– কারণ তাহার ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না এবং যজ্ঞাদি সাধিত হইলেও ফল হইবে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহও আছে’। ২১।। ‘মূর্খ ভিন্ন কোন্ ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরগত করে?’ ২২।। ‘আগামী কল্যকার ময়ূর লাভ অপেক্ষা অদ্যকার পারাবত লাভ মন্দের মধ্যে ভাল’। ২৩।। ‘সংশয়সঙ্কুল হেমশত লাভ অপেক্ষা নিঃসন্দেহে এক কার্যাপণ লাভও মন্দের ভাল।– একই কথা লোকায়তিক নাস্তিকেরা বলিয়া থাকে’। ২৪।। (তর্জমা– গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর)।


যে বর্তমান সুনিশ্চিত তাকে উপেক্ষা করে সংশয়িত ভবিষ্যতের লক্ষ্যে চার্বাকেরা অগ্রসর হতে চান না, ভবিষ্যৎ যদিও উজ্জ্বল সম্ভাবনার রঙে রঞ্জিত থাকে। এই গ্রন্থে বর্ণিত চার্বাকেরা পরবর্তী দিনে ময়ূর লাভের আশায় বর্তমান দিনে হস্তগত পারাবতকে উপেক্ষা করেন না এবং ভবিষ্যতে স্বর্ণমুদ্রার প্রতীক্ষায় থেকে বর্তমানের তাম্রমুদ্রাকে বিসর্জন দিতেও তাঁরা প্রস্তুত নন। তাঁদের কর্মপ্রচেষ্টাকে বিতর্কিত ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে প্রসারিত করার পরিবর্তে বর্তমানে নিশ্চিতলভ্য বস্তুগুলির দিকে নিয়োজিত করতে তাঁদের আগ্রহ ‘কামসূত্রে’র বর্ণনায় সুপরিস্ফুট।’ – (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৪)

চার্বাকেরা বৈষয়িক এবং জাগতিক ভোগসুখে আকণ্ঠ নিমজ্জিত– এরকম অভিমতই বর্ণিত হয়েছে মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে। এতে আরো বলা হয়েছে, এই ভোগকাঙ্ক্ষার চরিতার্থতাই তাঁদের জীবনে মূল লক্ষ্য। দুঃখবাদী অধ্যাত্মদর্শনের কোন প্রভাব চার্বাক দর্শনে নেই। চার্বাকমতে জগৎ ভোগসুখের সম্ভাবনায় সমুজ্জ্বল। এবং এই জাগতিক সুখকে করায়ত্ত করার প্রচেষ্টায় চার্বাকেরা তাঁদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করতে আগ্রহী। বস্তুজগৎ তার মনোহারী রূপ নিয়ে সুখের আকর্ষণে মানুষকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে। অধ্যাত্মবাদীদের দাবি অনুসারে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে এই আকর্ষণকে দমন করার শিক্ষা আছে এবং এই বস্তুজগতের বিপরীতগামী পথই সেখানে চরম শান্তির পথ হিসেবে নির্দেশিত। মাধবের মতে, চার্বাকেরা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন পথের পথিক। বিষয়রসে মগ্ন হয়ে তাঁরা তাঁদের উপভোগস্পৃহা চরিতার্থ করতে আগ্রহী। যেমন–
‘অঙ্গনাদ্যালিঙ্গনাদি-জন্য-সুখমেবঃ পুরুষার্থঃ। ন চাস্য দুঃখসম্ভিন্নতয়া পুরুষার্থত্বমেব নাস্তীতি মন্তব্যম্, অবর্জনীয়তয়া প্রাপ্তস্য দুঃখস্য পরিহারেণ সুখমাত্রস্যৈব ভোক্তব্যত্বাৎ।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ :
(চার্বাকেরা বলেন,) অঙ্গনার আলিঙ্গন, চুম্বন, মর্দন প্রভৃতি জন্য এবং কাম্য বিষয়ের প্রাপ্তিজন্য সুখই পুরুষার্থ। এই সুখ দুঃখ-সম্ভিন্ন অর্থাৎ দুঃখ-মিশ্রিত বলে পুরুষার্থই নয়, তা মনে করবেন না। কারণ অবর্জনীয়রূপে প্রাপ্ত দুঃখের পরিহারের দ্বারা সুখমাত্রই সকলের ভোক্তব্য হয়ে থাকে।

তার মানে, দুঃখের যে সংমিশ্রণ এই জাগতিক সুখে থাকে চার্বাকদের ভোগের পথে তা বাধার সৃষ্টি করে না। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র এই বিবরণীতে মাধবাচার্য চার্বাকদের কর্মোদ্যমের বিশেষ এক পরিচিতি তুলে ধরে বলেছেন যে, চার্বাকেরা জাগতিক সুখের উপভোগে প্রয়াসী বাধা বা বিপদের সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। কণ্টকের উপস্থিতি তাঁদের পুষ্প আহরণ থেকে প্রতিনিবৃত্ত করতে পারে না। চার্বাক মতে ধানে তুষ থাকে বলে ধানের ক্ষুধা নিবৃত্তির ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে ধান ফেলে দেবার পক্ষে কোন যুক্তি নেই। মৎস্য ভোজনের সুখ যাঁরা আস্বাদন করতে চান তাঁদের প্রথমে কাঁটাযুক্ত মাছই সংগ্রহ করতে হয়। যে দুঃখ অপরিহার্য সুখের পথে অগ্রসর হতে গেলে তাকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা উচিত। শস্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় মানুষ মাটিতে বীজ বপন করে। রন্ধনকার্যে প্রবৃত্ত হবার মূলেও থাকে তার ভোজনে পরিতৃপ্তির আশা। কিছু কিছু আশঙ্কা অনেক সময় এই আশার সঙ্গি হয়, কতকগুলি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অপরিহার্য অমঙ্গল মানুষের এ্ সুখ সম্ভাবনার পক্ষে বহু ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করে। পশুপাখি এবং কীট পতঙ্গের দ্বারা ভূমিতে উৎপাদিত শস্য বিনষ্ট হতে পারে। রন্ধনকর্তার সুখাদ্য ভোজনে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করার জন্য অনাহুত ভিক্ষুকের উপস্থিতির সম্ভাবনাকেও পরিহার করা চলে না। চার্বাকেরা কিন্তু এই দুঃখময় সম্ভাবনার ভয়ে ভীত হনা না এবং সুখ দুঃখময় জগতে চলার পথে দুঃখকে সব সময়ে উপেক্ষা করে সুখের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন। এই মনোবৃত্তি যে প্রকৃতই চার্বাকমতই, তা বোঝাতে মাধবাচার্য কিছু প্রামাণিক লোকগাথাও উদ্ধৃত করেন–
‘ত্যাজ্যং  সুখং বিষয়জন্ম পুংসাং
দুঃখোপসৃষ্টমিতি মুর্খবিচারণৈষা।
ব্রীহীন্ জিহাসতি সিতোত্তমতণ্ডুলাঢ্যান্
কো নাম ভোস্তুষকণোপহিতান্ হিতার্থী।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাক বলেন,) পুরুষের বিষয়ভোগজন্য সুখ যেহেতু দুঃখ মিশ্রিত সেহেতু তাকে পরিত্যাগ করতে হবে– এটা নেহাৎই মূর্খের বিচার। এমন হিতার্থী কে আছেন– যিনি তুষকণাযুক্ত বলে পরিষ্কার উত্তম তণ্ডুলপূর্ণ ধান্য পরিত্যাগ করেন?

ইহজগতে ভোগসুখকে উপেক্ষা করে কৃচ্ছ্রসাধন চার্বাকদের অভিপ্রেত নয়। সন্ন্যাস বা ত্যাগের পথ তাঁদের অনুমোদন লাভ করেনি। ত্রিদণ্ড, ভস্মের আবরণ ইত্যাদি সন্ন্যাসের উপকরণগুলি চার্বাকমতে বুদ্ধি বা পৌরুষহীন ব্যক্তির জীবিকার উপায়। এই বিবরণের সপক্ষে লোকগাথার উদ্ধৃতি রয়েছে মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ ও শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে–
‘অগ্নিহোত্রং ত্রয়ো বেদাস্ত্রিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম্ ।
বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১৪)।
অর্থাৎ : অগ্নিহোত্র, (ঋক, সাম ও যজু) তিন বেদ, ত্রিদণ্ডধারণ (সন্ন্যাস), ভস্মানুলেপন প্রভৃতি বুদ্ধি ও পৌরুষহীন মানুষের জীবিকার্জনের উপায় বলে বৃহস্পতি মনে করেন।

চার্বাক সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থের বিবরণীতে চার্বাকেরা নিয়ম বন্ধন-বিহীন ইন্দ্রিয়-সুখপরায়ণ হিসেবেই অভিহিত হয়েছেন। এই গ্রন্থগুলির বর্ণনা থেকে মনে হয় যে ভোগের দুর্দম আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত করার কোনো বাঁধন চার্বাক দর্শনে নেই এবং চার্বাকেরা তাঁদের কাজে ঔচিত্য বা নীতিবোধের প্রেরণায় চালিত হন না। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ উদ্ধৃত বিশেষ একটি শ্লোকে উল্লিখিত ঘৃতপায়ী চার্বাক সাধারণের কাছে সুপরিচিত–
‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাক মতে,) যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে? 

এই চার্বাক সুখের রসের স্বাদে বঞ্চিত হতে অনিচ্ছুক। ঘৃতপানকে যদি তিনি এই লক্ষ্যে উপনীত হবার উপায় বিবেচনা করেন, তাহলে এই ঘৃতপানের ব্যয় বহন করার জন্য ঋণ করতেও তাঁর কুণ্ঠা নেই। চার্বাকমতের নামে এই বিশেষ শ্লোকটি অতি প্রচলিত। আবার ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থেরই ভিন্ন এক স্থানে এই শ্লোকটির অনুরূপ অপর একটি শ্লোক দেখা যায় লোকগাথা বা লোকপ্রবাদের পরিচিতি নিয়ে। যেমন–
‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেন্নান্তি মৃত্যোরগোচরঃ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : যতদিন বাঁচো সুখেই বাঁচো, মৃত্যুর পর আর কিছুই নেই। ভস্মীভূত দেহের পুনরাগমন কোনভাবেই হতে পারে না।

এমনকি জয়ন্তভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’তেও দ্বিতীয় শ্লোকটির কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত রূপে উদ্ধতি দেখা যায়। সেখানে ‘দেহস্য’ শব্দের পরিবর্তে ‘শান্তস্য’ শব্দের ব্যবহার হয়েছে কেবল। এই শ্লোকে বর্ণিত চার্বাক সুখলিপ্সু সন্দেহ নেই, কিন্তু সুখের প্রয়োজনে নীতিবোধ বিসর্জন দেবার কোন ইঙ্গিত কি এই শ্লোকে আছে? দেহনাশের পরে আত্মার সত্তায় বিশ্বাসের অভাব এই শ্লোকে পরিস্ফুট, যে কারণে পারলৌকিক সুখকে কামনা না করে বর্তমান জীবনের সুখেই তাঁরা মগ্ন থাকতে চান।

চার্বাকদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে ধর্ম তাঁদের জীবনের লক্ষ্য নয়, অর্থ এবং কাম, বিশেষত কাম তাঁদের নিকট পুরুষার্থরূপে গণ্য। ভারতীয় অধ্যাত্ম চিন্তায় মনুষ্যজীবনের চারপ্রকার লক্ষ্য পুরুষার্থ-রূপে কথিত হয়, যথা– ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। কিন্তু চার্বাকেরা অর্থ ও কামের উপাসক।
মোক্ষ সম্বন্ধে ইতঃপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি। মানুষের সব দুঃখের এবং সেই সঙ্গে জাগতিক ভোগসুখেরও একান্ত অবসান এই মোক্ষ বা মুক্তির মধ্যে। ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে মোক্ষ চরম লক্ষ্য হিসেবে নির্দেশিত হলেও সাধারণ সংসারী মানুষের কর্মপ্রচেষ্টা এই লক্ষ্যের পথে প্রসারিত নয়। সেজন্য সাধারণভাবে চতুর্বর্গ হিসেবে অভিহিত হলেও সাংসারিক মানুষের জীবনে পুরুষার্থ প্রধানত ত্রিবর্গাত্মক, অর্থাৎ– ধর্ম, অর্থ এবং কাম এই তিনটি বিভিন্ন লক্ষ্যের সমবায়ে গঠিত। ভারতীয় চিন্তায় ‘অর্থ’ শব্দটি ধনসম্পদের বাচক এবং ‘কাম’ শব্দটি ইন্দ্রিয়জ সুখের বাচক। সাংসারিক ভোগসুখ অর্থ ও কামের অন্তর্গত। সম্পূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে কিন্তু ‘অর্থ’ ও ‘কাম’ কখনও নির্দেশিত হয়নি। অর্থ ও কাম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্মের দ্বারা। এই ধর্মযুক্ত ‘অর্থ’ ও ‘কাম’ ত্রিবর্গ আখ্যায় অভিহিত। (দ্রষ্টব্য : লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৭)

কিন্তু একটি বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, ভারতীয় চিন্তাধারায় অর্থ এবং কামের পরিচর্যাকে কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্যের বাইরে রাখা হয়নি। অর্থ এবং কামকে যথাক্রমে উপজীব্য করেও অর্থশাস্ত্র এবং কামশাস্ত্র সনাতনপন্থীদের সমালোচনার বিষয় হয়নি। কারণ হয়তো, ‘অর্থশাস্ত্র’কার কৌটিল্য এবং ‘কামসূত্রে’র রচয়িতা বাৎস্যায়ন ধর্মের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্রে’ বলা হয়েছে–
‘ধর্মার্থকামেভ্যো নমঃ’। (কামসূত্র-১/১/১)
‘অন্যোহন্যানুবন্ধং পরম্পরানুপঘাতকং ত্রিবর্গং সেবেত’। (কামসূত্র-১/২/১)
অর্থাৎ : (মুক্ততর্জমা)
ধর্ম, অর্থ ও কামকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করো। (কামসূত্র-১/১/১)।।  এরা একে অন্যের অনুবন্ধ। কোনটি বর্জন না করে এই ত্রিবর্গের অনুসরণ করা কর্তব্য। (কামসূত্র-১/২/১)।।
এবং কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ বলা হয়েছে–
‘ধর্মার্থাবিরোধেন কামং সেবেত, ন নিঃসুখঃ স্যাত্ । সমং বা ত্রিবর্গমন্যোন্যানুবন্ধম্ । একো হ্যত্যাসেবিতো ধর্মার্থকামানামাত্মানমিতরৌ চ পীড়য়তি। অর্থ এব প্রধান ইতি কৌটিল্যঃ। অর্থমূলৌ হি ধর্মকামাবিতি।’ (অর্থশাস্ত্র-১/৭/২)
অর্থাৎ :
ধর্ম ও অর্থের সঙ্গে অবিরোধে তিনি (রাজা) কাম নামক তৃতীয় পুরুষার্থের সেবা করবেন, সম্পূর্ণ সুখবর্জিত ভাবে থাকবেন না। অথবা, তিনি পরস্পরসংসৃষ্ট ধর্ম, অর্থ ও কামরূপ ত্রিবর্গের সেবা সমানভাবে অর্থাৎ তুল্যমাত্রায় করবেন। কারণ, ধর্ম, অর্থ ও কাম (এই তিনটির মধ্যে) যে কোনও একটির অতিরিক্তভাবে সেবা (অনুষ্ঠান) করলে নিজের পক্ষে এবং অপর দুটির পক্ষেও (অর্থাৎ অর্থ ও কাম, ধর্ম ও কাম, বা ধর্ম ও অর্থ– এগুলির পক্ষে) তা পীড়াদায়ক হয়ে থাকে। কৌটিল্যের মতে (ধর্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গের মধ্যে) অর্থ-ই প্রধান, কারণ, ধর্ম ও কাম– এই দুটির মূল-ও অর্থ (অর্থাৎ ধর্ম ও কামের অনুষ্ঠান অর্থের উপরই নির্ভর করে)।


বোঝা-ই যায়, ‘অর্থশাস্ত্র’ ও ‘কামসূত্রে’ ধর্মের প্রতি আনুগত্য আছে– অর্থাৎ, নাস্তিকতার মনোভাব তাঁদের মধ্যে নেই। সেইজন্যই অর্থ এবং কামকে অবলম্বন করেও এঁদের বস্তুবাদ কখনও নিন্দিত হয়নি।

ধর্মবিরোধী হিসাবে চার্বাকী আচরণের পরিচিতি প্রধানতঃ সমালোচকদের বিবৃতির মাধ্যমেই আমাদের কাছে উপস্থাপিত। এ সম্বন্ধে চার্বাকপক্ষের নিজস্ব অভিমত আমাদের জানা নেই; তবে ধর্ম যদি সনাতন ধারার প্রতি আনুগত্যের দ্যোতক হয় তাহলে নিঃসন্দেহে চার্বাকী মনোভাব এই ধর্মের বিরোধী। প্রকৃতপক্ষে নাস্তিকতার মধ্য দিয়ে চার্বাক মতবাদে যে বিদ্রোহী রূপের প্রকাশ, সাধারণ আচরণবিধির মানদণ্ড হিসাবে গৃহীত তথাকথিত ‘ধর্মে’র সঙ্গে তার কোন সামঞ্জস্য থাকতে পারে না। আর এই ধর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষায় চার্বাকেরা অসমর্থ বলেই চার্বাকী আচরণে সমালোচকেরা অনুসরণীয় সাধারণ মানের অভাব লক্ষ্য করেছেন।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১৮)

চার্বাকদের আচরণকে ধর্মের বিরোধী বলে অভিহিত করায় চার্বাকী নৈতিকমান যে সনাতনপন্থীদের নীতিগত মানদণ্ডের অনুকূল নয় সেটাই প্রকাশ পায়। সনাতনগোষ্ঠির অনভিপ্রেত যে কোন আচরণই বোধহয় এইভাবে ‘চার্বাক’ সংজ্ঞার সঙ্গে অভিন্ন সত্তায় নিজেকে একাত্ম করেছে।
মোট কথা, ভারতীয় সনাতনপন্থীদের বিচারে চার্বাকগোষ্ঠি চিরদিন অবজ্ঞেয় এবং সেইজন্য এই সম্প্রদায়ের আচরিত অধিকাংশ ক্রিয়াকলাপই তাঁদের কাছে দুর্নীতিপরায়ণতার পরিচায়ক বলে গণ্য হয়েছে। এই কারণেই চার্বাকদের বিরুদ্ধে যখন সনাতনপন্থীরা উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগ করেন, সেই অভিযোগকেও আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করার আমাদের পক্ষে সঙ্গত হবে না বলেই মনে হয়।

চার্বাকদের বিরুদ্ধে সনাতনপন্থী অধ্যাত্মবাদীদের অভিযোগের অন্ত নেই। তার প্রধান কারণই হয়তো চার্বাক ‘ধর্ম’ মানে না। এই ‘ধর্ম’ মানে কী? এই তথাকথিত ‘ধর্ম’ চার্বাকদের কাছে আসলে ‘শাস্ত্রশাসন’। কোন্ শাস্ত্র? ধর্মবাদীদের দৃষ্টিতে যা বেদবিহিত তাই শাস্ত্র। বৈদিক সংস্কৃতির প্রতিভূ এই শাস্ত্র তথা ‘বেদ’ সম্পর্কে চার্বাকদের মনোভাব কী তার যৎসামান্য কিছু ধারণা আমরা ইতোমধ্যেই অবগত হয়েছি। কিন্তু চার্বাকী বস্তুবাদের আলোচনাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যেতে এ-বিষয়ে আরো কিছু আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে আলোচনাটা লক্ষ্যনিষ্ঠ হবে যদি বেদ প্রসঙ্গে চার্বাকদের মনোভাবের যথাযথ বিশ্লেষণটুকু করা সম্ভব হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال