বৌদ্ধমতের দার্শনিক সিদ্ধান্ত (Buddhism and Its Philosophy)
“অনিত্য, দুঃখ, অনাত্ম” (অঙ্গুত্তরনিকায়: ৩/১/৩৪)- এই একটিমাত্র সূত্রেই বুদ্ধের সমস্ত দর্শন গ্রথিত আছে বলে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। এই সূত্রের মূল বক্তব্য হচ্ছে-
‘সর্বং অনিচ্চং, সর্বং দুক্খং, সর্বং অনাত্মং।’ (অঙ্গুত্তরনিকায়-৩/১/৩৪)
অর্থাৎ : যা কিছু সমস্তই অনিত্য, সমস্তই দুঃখ, সমস্তই অনাত্ম।
.
বুদ্ধমতে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এই তিনটি বিষয়ে সম্যক জ্ঞান না থাকাই হচ্ছে অবিদ্যার লক্ষণ। অতএব, বৌদ্ধদর্শনের প্রতিপাদ্য বিষয়ই হলো এই তিনটি বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ। তবে বুদ্ধের মতবাদের দার্শনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগে বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার যে, গৌতম বুদ্ধ কোন অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদের দার্শনিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন নি। তিনি সংসারের ক্লেশকর প্রপঞ্চগুলো থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় হিসেবে কিছু আচারমার্গের নীতিপন্থা প্রচারেই আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দার্শনিক তত্ত্বকে তিনি সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পারেননি। কেননা নৈতিক ও ধর্মীয় উপদেশেরও দার্শনিক ভিত্তি বর্তমান। দার্শনিক ভিত্তি ছাড়া নৈতিক ও ধর্মীয় উপদেশ যুক্তিহীন স্তোকবাক্যে পরিণত হয়। তাই সাগ্রহে না হলেও বুদ্ধ কতকগুলি দার্শনিক তত্ত্ব-বিষয়ে তাঁর স্বাধীন ও স্বকীয় সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বলাই বাহুল্য যে, তাঁর দার্শনিক মত অত্যন্ত দুরূহ ও অনন্যসাধারণ। তাঁর অনেক সিদ্ধান্তই সাধারণ মানুষের সংস্কারকে রীতিমতো বিচলিত করে।
তার উপর ভিত্তি করেই বর্তমানে তাঁর সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী ধর্মমতের মধ্যে দার্শনিক প্রপঞ্চের যে সন্ধান আমরা পাই তা মূলত বুদ্ধের অনুসারী পরবর্তীকালের মেধাবী দার্শনিকদেরই অবদান। তাঁদের মাধ্যমেই বৌদ্ধদর্শন প্রকৃতপক্ষে দর্শনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
.
দুঃখবাদ
সর্বগ্রাসী দুঃখের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানই গৌতম বুদ্ধের সাধনার লক্ষ্য। জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে এবং দুঃখ নিরোধ সম্ভব, এই দুঃখরহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়েই বুদ্ধের সাধনায় সিদ্ধিলাভ। এবং এই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে আচারমার্গের নির্দেশনাই বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মমত। গোটা বৌদ্ধমত দুঃখকেন্দ্রিক চারটি আর্যসত্য নির্ভর। সবকিছু ছাপিয়ে দুঃখই সত্য বলে বৌদ্ধদর্শন মূলত দুঃখবাদেরই নামান্তর। তথাগত বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন-
তার উপর ভিত্তি করেই বর্তমানে তাঁর সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী ধর্মমতের মধ্যে দার্শনিক প্রপঞ্চের যে সন্ধান আমরা পাই তা মূলত বুদ্ধের অনুসারী পরবর্তীকালের মেধাবী দার্শনিকদেরই অবদান। তাঁদের মাধ্যমেই বৌদ্ধদর্শন প্রকৃতপক্ষে দর্শনের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।
.
দুঃখবাদ
সর্বগ্রাসী দুঃখের কারণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানই গৌতম বুদ্ধের সাধনার লক্ষ্য। জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে এবং দুঃখ নিরোধ সম্ভব, এই দুঃখরহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়েই বুদ্ধের সাধনায় সিদ্ধিলাভ। এবং এই দুঃখ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে আচারমার্গের নির্দেশনাই বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মমত। গোটা বৌদ্ধমত দুঃখকেন্দ্রিক চারটি আর্যসত্য নির্ভর। সবকিছু ছাপিয়ে দুঃখই সত্য বলে বৌদ্ধদর্শন মূলত দুঃখবাদেরই নামান্তর। তথাগত বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন-
‘জাতি পি দুক্খা, জরা পি দুক্খা, ব্যাধি পি দুক্খা, মরণং পি দুক্খং, সোক-পরিদেব-দুক্খদোমনস্স-উপায়াসা পি দুক্খা, যং পি ইচ্ছং ন লভতি তং পি দুক্খং, সংকখিত্তেন পঞ্চুপাদানক্খন্দা দুক্খা।’- (মহা সতিপতানসূত্ত-২২/১৮)
অর্থাৎ : জন্মে দুঃখ, নাশে দুঃখ, রোগ দুঃখময়, মৃত্যু দুঃখময়। অপ্রিয়ের সংযোগ দুঃখময়, প্রিয়জনের বিয়োগ দুঃখময়। রোগ হতে উৎপন্ন পঞ্চস্কন্ধ দুঃখময়। সকল কিছু দুঃখময়।
.
এই দুঃখ অল্প নয়, প্রচুর, অপর্যাপ্ত। ‘ধম্মপদে’র জরাবর্গে তিনি বলেছেন-
এই দুঃখ অল্প নয়, প্রচুর, অপর্যাপ্ত। ‘ধম্মপদে’র জরাবর্গে তিনি বলেছেন-
‘অনেকজাতি সংসারং সন্ধাবিস্সং অনিব্বিসং,
গহকারকং গবেসন্তো, দুক্খা জাতি পুনপপুনং।’ (ধম্মপদ-জরাবর্গ-৮)
অর্থাৎ : এ (দেহরূপ) গৃহের নির্মাতাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে (জ্ঞানাভাবে) তাকে না পেয়ে আমি বহু জন্মজন্মান্তর সংসার পরিভ্রমণ করলাম। বার বার জন্ম গ্রহণ করা দুঃখজনক।
.
সংসার দুঃখেই পরিপূর্ণ। এবং সকল দুঃখের নিদান যে প্রকৃতপক্ষে পঞ্চস্কন্ধরূপ দেহ ও দেহ-সম্পর্কিতই, ধম্মপদের সুখবর্গে বুদ্ধ-বচনে তা-ই প্রতিধ্বনিত হয়েছে-
সংসার দুঃখেই পরিপূর্ণ। এবং সকল দুঃখের নিদান যে প্রকৃতপক্ষে পঞ্চস্কন্ধরূপ দেহ ও দেহ-সম্পর্কিতই, ধম্মপদের সুখবর্গে বুদ্ধ-বচনে তা-ই প্রতিধ্বনিত হয়েছে-
‘নত্থি রাগসমো অগ্গি নত্থি দোসসমো কলি,
নত্থি খন্ধাসমা দুক্খা নত্থি সন্তিপরং সুখং।’ (ধম্মপদ-সুখবর্গ-৬)
অর্থাৎ : আসক্তির (রাগ) ন্যায় আগুন নেই, দ্বেষের সমান পাপ কলি নেই, পঞ্চস্কন্ধের মতো দুঃখ নেই এবং নির্বাণের চেয়ে সুখ নেই।
কার্যে কারণে সবকিছুতেই দুঃখের এই বিপুল উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কেউ কেউ বৌদ্ধদর্শনকে নৈরাশ্যবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেন, যার সাথে কিছুতেই একমত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা সবকিছুই দুঃখময় হলেও চূড়ান্ত বিচারে এই দুঃখ নিবৃত্তিই বৌদ্ধদর্শনের অনিবার্য লক্ষ্য। বরং বৌদ্ধদর্শন চমৎকারভাবে একটি আশাবাদপূর্ণ দর্শন। কেননা সবকিছুই দুঃখময় হলেও চূড়ান্ত বিচারে এই দুঃখ নিবৃত্তিই বৌদ্ধদর্শনের অনিবার্য লক্ষ্য। বুদ্ধের উপদেশ-সংবলিত ‘ধম্মপদে’র ‘পিয়বগগে’ তিনি বলে গেছেন-
‘মা পিয়েহি সমাগঞ্ছি অপ্পিয়েহি কুদাচনং,
ডপয়ানং অদস্সনং দুক্খং অপ্পিয়ানঞ্চ দস্সনং।’ (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-২)
‘তস্মা পিয়ং ন কয়িরাথ পিয়াপায়োহি পাপকো,
গন্থা তেসং ন বিজ্জন্তি যেসং নত্থি পিয়াপ্পিয়ং।’ (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-৩)
‘পিয়তো জায়তে সোকো পিয়তো জায়তে ভয়ং,
পিয়তো বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতো ভয়ং।’ (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-৪)
‘পেমতো জায়তে সোকো পেমতো জায়তে ভয়ং,
পেমতো বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতোভয়ং।’ (ঐ-৫)
‘রতিয়া জায়তে সোকো রতিয়া জায়তে ভয়ং,
রতিয়া বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতো ভয়ং।’ (ঐ-৬)
‘কামতো জায়তে সোকো কামতো জায়তে ভয়ং,
কামতো বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতো ভয়ং।’ (ঐ-৭)
‘তণ্হায় জায়তে সোকো তণ্হায় জায়তে ভয়ং,
তণ্হায় বিপ্পমুত্তস্স নত্থি সোকো কুতোভয়ং।’ (ঐ-৮)
অর্থাৎ :
প্রিয় কিংবা অপ্রিয় কোন কিছুতে অনুরক্ত হয়ো না। কারণ প্রিয়বস্তুর অদর্শন এবং অপ্রিয়বস্তুর দর্শন উভয়ই দুঃখজনক (প্রিয়বর্গ-২)। তাই (কোন বস্তু বা ব্যক্তির) প্রিয়ানুরাগী হয়ো না, প্রিয়বিচ্ছেদ দুঃখজনক। যাঁর প্রিয়-অপ্রিয় কিছুই নেই তাঁর কোন বন্ধন থাকে না (প্রিয়বর্গ-৩)। প্রিয় থেকে শোক উৎপত্তি হয়; প্রিয় থেকে ভয় উৎপত্তি হয়। যিনি প্রিয়াসক্তি থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কিভাবে? (প্রিয়বর্গ-৪) প্রেম থেকে… আসক্তি (রতি) থেকে… কাম (বিষয়-বাসনা) থেকে… তৃষ্ণা থেকে শোক উৎপত্তি হয় ; প্রেম…আসক্তি…কাম…তৃষ্ণা থেকে ভয় উৎপত্তি হয়। যিনি প্রেম…আসক্তি…কাম…তৃষ্ণা থেকে উত্তীর্ণ তাঁর শোক থাকে না, ভয় থাকবে কিভাবে?- (ধম্মপদ-প্রিয়বর্গ-৫-৮)।
.
শুধু তা-ই নয়, বুদ্ধের দর্শন চরম নিয়তিবাদের বিরোধী বলে এখানে দুঃখ মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া কোন অদৃষ্টবাদী নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়। নিজের অবিদ্যাপ্রসূত কর্ম দ্বারাই মানুষ দুঃখকে বরণ করে জন্মশৃঙ্খলে বন্দি হয়, আবার সম্যক জ্ঞানের মাধ্যমে অবিদ্যা দূর করে নির্বাণলাভের মাধ্যমে মানুষ এই জন্মরূপ দুঃখ থেকে পরিত্রাণও পেতে পারে। এজন্যে মানুষকে অন্য কোন অলৌকিক নিয়ন্ত্রকের অধীনস্থ হতে হয় না। ধম্মপদের দণ্ডবগগো’তে তাই বুদ্ধ বলেছেন-
শুধু তা-ই নয়, বুদ্ধের দর্শন চরম নিয়তিবাদের বিরোধী বলে এখানে দুঃখ মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া কোন অদৃষ্টবাদী নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়। নিজের অবিদ্যাপ্রসূত কর্ম দ্বারাই মানুষ দুঃখকে বরণ করে জন্মশৃঙ্খলে বন্দি হয়, আবার সম্যক জ্ঞানের মাধ্যমে অবিদ্যা দূর করে নির্বাণলাভের মাধ্যমে মানুষ এই জন্মরূপ দুঃখ থেকে পরিত্রাণও পেতে পারে। এজন্যে মানুষকে অন্য কোন অলৌকিক নিয়ন্ত্রকের অধীনস্থ হতে হয় না। ধম্মপদের দণ্ডবগগো’তে তাই বুদ্ধ বলেছেন-
‘অস্সো যথা ভদ্রো কসানিবিট্ঠো
আতপিনো সংবেগিনো ভবাথ,
সদ্ধায় সীলেন চ বিরিয়েন চ
সমাধিনা ধম্ম বিনিচ্ছয়েন চ,
সম্পন্ন বিজ্জাচররণা পতিস্সতা
পহস্সথ দুক্খমিদং অনপ্পকং। (ধম্মপদ-দন্ডবর্গ-১৬)
অর্থাৎ : কশাঘাত ক্লিষ্ট ভদ্র অশ্ব যেমন ক্ষিপ্র ও বেগবান হয়, তেমনি শ্রদ্ধা, শীল, বীর্য, সমাধি ও ধর্ম বিনিশ্চয় প্রজ্ঞায় বিদ্যাচরণ সম্পন্ন ও স্মৃতিমান হও। তাহলে দুঃখরাশিকে অপনোদন করতে পারবে।
.
এবং সংযুক্তনিকায়ে নির্বাণার্থি ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বুদ্ধ বলেছেন (মজ্ঝিমনিকায়-১০৪ সূত্রেও বুদ্ধের অনুরূপ বাণী রয়েছে)-
এবং সংযুক্তনিকায়ে নির্বাণার্থি ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যে বুদ্ধ বলেছেন (মজ্ঝিমনিকায়-১০৪ সূত্রেও বুদ্ধের অনুরূপ বাণী রয়েছে)-
‘সেয্যথাপি ভিক্খবে! তেলং চ পটিচ্চ বট্টিং প পট্টিচ্চ তেলপ্ পদিপো ঝায়েয্য, তত্র পুরিসো ন কালেন কালং তেলং আসিঞচেয্য, ন বট্টিং চ উপসংহরেয্য। এবং হি সো ভিক্খবে! তেলপ্পদিপো পুরিমন চ উপাদানস্স পরিযাদানা অঞ্ঞস্সচ অনুপাহারা অনাহারো নিব্বায়েয্য। এবং এব খো ভিক্খবে! সঞযোজনীয়েসু ধর্মেসু আদীনবানুগস্সিনো বিহরতো তণ্হা নিরুজ্ঝতি, তণ্হানিরোধা উপাদান-নিরোধোপি। এবং এতস্স কেবলস্স দুক্খখন্ধস্স নিরোধো হোতি।’- (সংযুক্তনিকায়)
অর্থাৎ :
হে ভিক্ষুগণ! তৈল ও বর্তি সংযোগে প্রজ্বলিত প্রদীপে যদি কেউ আর তৈল ও বর্তি যোগ না করে তবে প্রদীপ যেমন উপাদানের অভাবে নির্বাপিত হয়, সেইরূপ যিনি সমস্ত সংযোজনের অস্থিরত্ব উপলব্ধি করে অনাহারে বিচরণ করেন, তাঁর তৃষ্ণা নিরুদ্ধ হয়, তৃষ্ণা-নিরোধে উপাদান নিরুদ্ধ হয় এবং দুঃখের নিদান পঞ্চস্কন্ধের নিরোধ হয়।
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব
গৌতম বুদ্ধ জগতের অন্তর্গত রহস্যকে উদ্ঘাটন করে প্রথম দুঃখবাদ প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মে এই দুঃখবাদকে চারটি আর্যসত্যে সন্নিহিত করা হয়েছে। এই চারটি আর্যসত্য হচেছ- দুঃখ আছে বা জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ নিরোধ করার উপায় আছে এবং দুঃখ নিরোধমার্গ বা নিবৃত্তির উপায় নির্দেশ। দুঃখের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় আর্যসত্যে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তকেই প্রতীত্য-সমুৎপাদ (The doctrine of Dependent Origination) বলা হয়। পালিতে এর নাম ‘পটিচ্যসমুৎপাদ’। শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে ‘প্রতীত্য’ ও ‘সমুৎপাদ’ এ দুটি শব্দের সমাস পাওয়া যায়। ‘প্রতীত্য’ পদের অর্থ ‘কোন বস্তু উপস্থিত হলে পর বা কোন কিছুর অধীন’ (depending), এবং ‘সমুৎপাদ’ শব্দের অর্থ ‘কোন কিছুর উৎপত্তি’ (origination)। অর্থাৎ ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘একটি বস্তুর কিংবা ঘটনার অধীনে বা উপস্থিতিতে (আগমনে) অন্য কোন বস্তুর বা ঘটনার উৎপত্তি’। মজ্ঝিমনিকায় (১/৪/৮) বলা হচ্ছে-
গৌতম বুদ্ধ জগতের অন্তর্গত রহস্যকে উদ্ঘাটন করে প্রথম দুঃখবাদ প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মে এই দুঃখবাদকে চারটি আর্যসত্যে সন্নিহিত করা হয়েছে। এই চারটি আর্যসত্য হচেছ- দুঃখ আছে বা জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখ নিরোধ করার উপায় আছে এবং দুঃখ নিরোধমার্গ বা নিবৃত্তির উপায় নির্দেশ। দুঃখের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় আর্যসত্যে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সিদ্ধান্তকেই প্রতীত্য-সমুৎপাদ (The doctrine of Dependent Origination) বলা হয়। পালিতে এর নাম ‘পটিচ্যসমুৎপাদ’। শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে ‘প্রতীত্য’ ও ‘সমুৎপাদ’ এ দুটি শব্দের সমাস পাওয়া যায়। ‘প্রতীত্য’ পদের অর্থ ‘কোন বস্তু উপস্থিত হলে পর বা কোন কিছুর অধীন’ (depending), এবং ‘সমুৎপাদ’ শব্দের অর্থ ‘কোন কিছুর উৎপত্তি’ (origination)। অর্থাৎ ‘প্রতীত্যসমুৎপাদ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘একটি বস্তুর কিংবা ঘটনার অধীনে বা উপস্থিতিতে (আগমনে) অন্য কোন বস্তুর বা ঘটনার উৎপত্তি’। মজ্ঝিমনিকায় (১/৪/৮) বলা হচ্ছে-
‘অস্মিন্ সতি ইদং ভবতি’-(মজ্ঝিমনিকায়-১/৪/৮)অর্থাৎ : ‘এটি ঘটবার পর ওটি ঘটছে’।
একের বিনাশের পর অন্যের উৎপত্তি- এই নিয়মকেই বুদ্ধ নাম দিয়েছেন প্রতীত্যসমুৎপাদ। তবে প্রতিটি উৎপাদনের কোন না কোন প্রত্যয় বা হেতু থাকে। বুদ্ধ প্রত্যয়ের সেই অর্থ গ্রহণ করেন নি। কেননা প্রত্যয় থেকে উৎপন্নের অর্থ অতীত থেকে উৎপন্ন- অর্থাৎ কোন বস্তু নষ্ট তথা অতীত হয়ে যাওয়ার পর নতুন বস্তুর উৎপাদন। কিন্তু বুদ্ধের প্রত্যয় হলো এমন এক হেতু যাকে অন্য কোন বস্তু কিংবা ঘটনার উৎপন্ন হওয়ার পূর্বক্ষণেই সদা লুপ্ত হতে দেখা যায়। প্রথমক্ষণে উৎপন্ন বস্তু দ্বিতীয়ক্ষণে বিনষ্ট হয় এবং প্রথমক্ষণের সদৃশ অপর একটি বস্তু উৎপন্ন হয়। সেই বস্তুটি আবার তৃতীয়ক্ষণে বিনষ্ট হয়। মানে বস্তু হলো অনবরত পরিবর্তনশীল অবস্থার প্রবাহমাত্র। স্পষ্টতই বুদ্ধের প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুযায়ী কার্য-কারণ নিয়ম অবিচ্ছিন্ন নয়, বিচ্ছিন্ন প্রবাহ (discontinuous continuity)। প্রতীত্য-সমুৎপাদের এই বিচ্ছিন্ন প্রবাহকে নিয়ে বৌদ্ধদার্শনিক নাগার্জুন পরে তাঁর শূন্যবাদকে বিকশিত করেছিলেন।
.বৌদ্ধমতে প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুযায়ী কোন এক ধর্মের উৎপত্তি অপর কোন ধর্মের উপর নির্ভরশীল। জগতে কোন কিছু অকারণ বা কারণহীনভাবে ঘটে না। একটি ধর্মের উৎপত্তি যদি অপর কোন ধর্মের উপর নির্ভর না করতো তাহলে যে কোন দেশে ও যে কোন কালে যে কোন ধর্মের উৎপত্তি সম্ভব হতো। কিন্তু বস্তুতপক্ষে তা হয় না। সুতরাং আমাদের স্বীকার করতে হবে যে একটি ধর্ম অপর কোন ধর্ম থেকেই সমুৎপন্ন হয়।
.
প্রতীত্যসমুৎপাদ নিয়মানুসারে কারণকে অনুসরণ করেই কার্য উৎপন্ন হয়। কারণ ও কার্যের এই সম্বন্ধ ‘অনুলোমনা’, ‘অনুসারিতা’ বা ‘ধর্মতা’ নামে পরিচিত। একটি ধর্মের উৎপত্তি ও অনুৎপত্তি এই নিয়মের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। যা থাকলে একটি ধর্ম উৎপন্ন হয় এবং যা না থাকলে তা হয় না তা ঐ ধর্মের কারণ বলে বিবেচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে কান্ড, কান্ড থেকে শাখা-প্রশাখা এবং শাখা-প্রশাখা থেকে ফুল ও ফল উৎপন্ন হয়। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন কার্য-কারণভাব বর্তমান এবং এই কার্য-কারণভাব ব্যতীত কার্যোৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায় না।
প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি কার্য-কারণভাবকে প্রাকৃতিক ও যান্ত্রিক উপায়ে বর্ণনা করেছে। বৌদ্ধমতে কার্য-কারণ প্রবাহে কোন চেতনকর্তার কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। কারণ ও কার্যের মধ্যে যে অনুলোমতার সম্পর্ক বর্তমান তার মাধ্যমেই কার্য-কারণ ভাবকে ব্যাখ্যা করা যায়। সুতরাং এর অতিরিক্ত কোন চেতনকর্তা স্বীকার কার নিষ্প্রয়োজন। কারণের পরিণামই কার্য। কারণের এই পরিণামে চেতন-কর্তৃত্বের প্রয়োজন হয় না।
.
প্রতীত্যসমুৎপাদকে সমগ্র বৌদ্ধদর্শনের আধার বলা হয়। স্বয়ং বুদ্ধের বাণী থেকেই জানা যায়-
.বৌদ্ধমতে প্রতীত্যসমুৎপাদ অনুযায়ী কোন এক ধর্মের উৎপত্তি অপর কোন ধর্মের উপর নির্ভরশীল। জগতে কোন কিছু অকারণ বা কারণহীনভাবে ঘটে না। একটি ধর্মের উৎপত্তি যদি অপর কোন ধর্মের উপর নির্ভর না করতো তাহলে যে কোন দেশে ও যে কোন কালে যে কোন ধর্মের উৎপত্তি সম্ভব হতো। কিন্তু বস্তুতপক্ষে তা হয় না। সুতরাং আমাদের স্বীকার করতে হবে যে একটি ধর্ম অপর কোন ধর্ম থেকেই সমুৎপন্ন হয়।
.
প্রতীত্যসমুৎপাদ নিয়মানুসারে কারণকে অনুসরণ করেই কার্য উৎপন্ন হয়। কারণ ও কার্যের এই সম্বন্ধ ‘অনুলোমনা’, ‘অনুসারিতা’ বা ‘ধর্মতা’ নামে পরিচিত। একটি ধর্মের উৎপত্তি ও অনুৎপত্তি এই নিয়মের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। যা থাকলে একটি ধর্ম উৎপন্ন হয় এবং যা না থাকলে তা হয় না তা ঐ ধর্মের কারণ বলে বিবেচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে কান্ড, কান্ড থেকে শাখা-প্রশাখা এবং শাখা-প্রশাখা থেকে ফুল ও ফল উৎপন্ন হয়। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ভিন্ন ভিন্ন কার্য-কারণভাব বর্তমান এবং এই কার্য-কারণভাব ব্যতীত কার্যোৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যায় না।
প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি কার্য-কারণভাবকে প্রাকৃতিক ও যান্ত্রিক উপায়ে বর্ণনা করেছে। বৌদ্ধমতে কার্য-কারণ প্রবাহে কোন চেতনকর্তার কর্তৃত্ব থাকতে পারে না। কারণ ও কার্যের মধ্যে যে অনুলোমতার সম্পর্ক বর্তমান তার মাধ্যমেই কার্য-কারণ ভাবকে ব্যাখ্যা করা যায়। সুতরাং এর অতিরিক্ত কোন চেতনকর্তা স্বীকার কার নিষ্প্রয়োজন। কারণের পরিণামই কার্য। কারণের এই পরিণামে চেতন-কর্তৃত্বের প্রয়োজন হয় না।
.
প্রতীত্যসমুৎপাদকে সমগ্র বৌদ্ধদর্শনের আধার বলা হয়। স্বয়ং বুদ্ধের বাণী থেকেই জানা যায়-
“যিনি প্রতীত্য-সমুৎপাদকে দেখেন, তিনি ধর্মকে (বৌদ্ধদর্শন) দেখতে পান, যিনি ধর্মকে দেখেন তিনি প্রতীত্য-সমুৎপাদকে দেখেন। পঞ্চ উপাদান স্কন্ধও প্রতীত্য সমুৎপন্ন।”(মজ্ঝিমনিকায়: ১/৩/৮)।
প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মকে মানব ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বুদ্ধ দ্বাদশাঙ্গ প্রতীত্য-সমুৎপাদের কথা বলেছেন। প্রাচীন উপনিষদের কয়েকজন ব্রাহ্মণ আচার্য নিত্য, ধ্রুব, অবিনশ্বরকে আত্মা বলেছেন। কিন্তু বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদে আত্মা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। এজন্যে আত্মাবাদকে তিনি মহা অবিদ্যা বলেছেন।
.
একইভাবে প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব স্বভাববাদেরও বিরোধী। কেননা স্বভাববাদ অনুসারে কারণ থেকে যে কার্য উৎপন্ন হয় তা বস্তুর স্বভাবজন্য বা নিয়তিনির্দিষ্ট। কিন্তু প্রতীত্য-সমুৎপাদে কার্য-কারণের যে শৃঙ্খলবোধ তাতে মানুষের প্রচেষ্টার যথেষ্ট মূল্য আছে। বুদ্ধের দ্বিতীয় আর্যসত্য অনুযায়ী সবকিছুর যেমন কারণ আছে তেমনি দুঃখেরও কারণ আছে। দুঃখের উৎপত্তিতে একটি কার্যকারণ শৃঙ্খল প্রতিভাত হয়। প্রতীত্য-সমুৎপন্ন এই কার্যকারণ শৃঙ্খলে বারোটি নিদান বা কারণের কথা বলা হয়েছে। এজন্যেই একে দুঃখের দ্বাদশ নিদান বা দ্বাদশাঙ্গ বলা হয়।
.
দ্বাদশ নিদানের তালিকাটি নিম্নরূপ-
পূর্বজন্ম
(১) অবিদ্যা (ignorance)- চারটি আর্যসত্য বিষয়ে অজ্ঞতা
(২) সংস্কার (impression)- পূর্বজন্মের কর্মজাত প্রবণতা
বর্তমান জন্ম
(৩) বিজ্ঞান (consciousness)- গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রাথমিক চেতনা
(৪) নামরূপ (mind body organism)- দেহমন সংগঠন
(৫) ষড়ায়তন (six sense organs)- ছয় ইন্দ্রিয়
(৬) স্পর্শ (sense contact)- বিষয় সংযোগ
(৭) বেদনা (sense-experience)- বিষয় সংবেদন
(৮) তৃষ্ণা (craving)- বিষয় কামনা
(৯) উপাদান (mental clinging)- বিষয়াসক্তি
ভবিষ্যৎ জন্ম
(১০) ভব (the will to be born)- পুনর্জন্ম গ্রহণের প্রবণতা
(১১) জাতি (rebirth)- পুনর্জন্ম
(১২) জরামরণ (old age and death suffering)- বিবিধ দুঃখ
.
.
একইভাবে প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব স্বভাববাদেরও বিরোধী। কেননা স্বভাববাদ অনুসারে কারণ থেকে যে কার্য উৎপন্ন হয় তা বস্তুর স্বভাবজন্য বা নিয়তিনির্দিষ্ট। কিন্তু প্রতীত্য-সমুৎপাদে কার্য-কারণের যে শৃঙ্খলবোধ তাতে মানুষের প্রচেষ্টার যথেষ্ট মূল্য আছে। বুদ্ধের দ্বিতীয় আর্যসত্য অনুযায়ী সবকিছুর যেমন কারণ আছে তেমনি দুঃখেরও কারণ আছে। দুঃখের উৎপত্তিতে একটি কার্যকারণ শৃঙ্খল প্রতিভাত হয়। প্রতীত্য-সমুৎপন্ন এই কার্যকারণ শৃঙ্খলে বারোটি নিদান বা কারণের কথা বলা হয়েছে। এজন্যেই একে দুঃখের দ্বাদশ নিদান বা দ্বাদশাঙ্গ বলা হয়।
.
দ্বাদশ নিদানের তালিকাটি নিম্নরূপ-
পূর্বজন্ম
(১) অবিদ্যা (ignorance)- চারটি আর্যসত্য বিষয়ে অজ্ঞতা
(২) সংস্কার (impression)- পূর্বজন্মের কর্মজাত প্রবণতা
বর্তমান জন্ম
(৩) বিজ্ঞান (consciousness)- গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রাথমিক চেতনা
(৪) নামরূপ (mind body organism)- দেহমন সংগঠন
(৫) ষড়ায়তন (six sense organs)- ছয় ইন্দ্রিয়
(৬) স্পর্শ (sense contact)- বিষয় সংযোগ
(৭) বেদনা (sense-experience)- বিষয় সংবেদন
(৮) তৃষ্ণা (craving)- বিষয় কামনা
(৯) উপাদান (mental clinging)- বিষয়াসক্তি
ভবিষ্যৎ জন্ম
(১০) ভব (the will to be born)- পুনর্জন্ম গ্রহণের প্রবণতা
(১১) জাতি (rebirth)- পুনর্জন্ম
(১২) জরামরণ (old age and death suffering)- বিবিধ দুঃখ
.
এই তালিকা অনুসারে দ্বিতীয় আর্যসত্যের ব্যাখ্যায়, জরামরণ বা দুঃখের কারণ জাতি, জাতির কারণ ভব, ভবের কারণ উপাদান, উপাদানের কারণ তৃষ্ণা, তৃষ্ণার কারণ বেদনা, বেদনার কারণ স্পর্শ, স্পর্শের কারণ ষড়ায়তন, ষড়ায়তনের কারণ নামরূপ, নামরূপের কারণ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের কারণ সংস্কার, সংস্কারের কারণ অবিদ্যা। এভাবে দুঃখের কারণের ব্যাখ্যায় কার্যকারণের শৃঙ্খলাকে বুদ্ধ প্রতিপাদন করেছেন। এই শৃঙ্খলে দুঃখের বারোটি নিদানের একদিকে প্রথম নিদান হচ্ছে জরামরণ, অবিদ্যা হচ্ছে অন্তিম। আবার অন্যদিক থেকে আদিতে অবিদ্যা, আর অন্তে জরামরণ বা দুঃখ। অবশিষ্ট নিদানগুলি এদের মধ্যেই পড়ে। তাই এ তালিকায় এক দৃষ্টিতে যা কারণ, অন্য দৃষ্টিতে তা-ই কার্য। প্রতীত্য-সমুৎপাদের এই দ্বাদশ নিদান পূর্বজন্ম, বর্তমান জন্ম ও ভবিষ্যৎ জন্মের সম্পূর্ণ আলেখ্য। এই কারণে এর নাম ভবচক্র বা সংসারচক্র বা ধর্মচক্র। এই কার্যকারণ পরম্পরা চক্রাকারে পরিবর্তিত হওয়ার ফলে মানুষের জন্ম থেকে জন্মান্তরে আবর্তন সম্ভব। যতক্ষণ অবিদ্যা থাকে ততক্ষণ একটির পর একটি কারণ উৎপন্ন হয়। সুতরং এর মধ্যে একটি অনিবার্যতাও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা বিনষ্ট হলে দ্বাদশ নিদানের কার্যকারণ শৃঙ্খল বিনষ্ট হবে এবং দুঃখরূপ কার্যের অবসান হবে।
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুসারে বাহ্য বা মানস সংসারের যত ঘটনা আছে তাদের কোন-না-কোন কারণ অবশ্যই আছে। এই নিয়ম স্বতঃ পরিচালিত হয়, তার সঞ্চালন কোন চেতন শক্তির দ্বারা হয় না। এই মতে বস্তু নিত্য নয়, কিন্তু তার অস্তিত্বে সন্দেহ করা যায় না। এর উৎপত্তি অন্য পদার্থকে প্রাপ্ত হয়ে হয়, কিন্তু তার পূর্ণতঃ বিনাশ হয় না, তার কিছু কার্য বা পরিণাম অবশ্যই থাকে। এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ হচ্ছে মধ্যম মার্গ, যা পূর্ণতঃ নিত্যতাবাদ বা শাশ্বতবাদ নয়, আবার উচ্ছেদবাদ বা বিনাশবাদও নয়। দুটোর মধ্যবর্তী মতবাদ। নিত্যতাবাদ অনুযায়ী শর্তবিহীন নিত্যসত্তা থাকতে পারে। অর্থাৎ কোন কোন সত্তা নিত্য এবং শর্তনিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। অপরপক্ষে উচ্ছেদবাদ অনুযায়ী কোন কিছুর পূর্ণ বিনাশ হতে পারে। অর্থাৎ কোন কার্য না রেখেই তা বিনষ্ট হতে পারে। কিন্তু প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী সব বস্তুই উৎপন্ন হচ্ছে এবং বিনষ্ট হওয়ার সময় কার্য রেখে যায়। সবকিছুর উৎপত্তি শর্তাধীন এবং সবকিছুর অস্তিত্বও শর্তাধীন। কারণ শর্তরহিত নিত্য বস্তু নেই। যা আছে তা পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সেটি কারণের দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে এবং সেটি কার্য উৎপাদন করবে। এভাবে কার্যকারণের ধারা চলতে থাকবে। আগের অবস্থা কারণ এবং পরের অবস্থা কার্য। অস্তিত্ব অর্থ ধারাবাহিকতা, অর্থাৎ অবস্থার ক্রমিকতা। সুতরাং, নিত্যতা বা পূর্ণ বিনাশ বলে কিছু নেই।
.
আগেই বলা হয়েছে, প্রতীত্য-সমুৎপাদের বারোটি নিদান ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনকে ব্যাপ্ত করে রয়েছে। অবিদ্যা ও সংস্কার অতীত জীবনের সাথে সম্বন্ধ, জরামরণ ও জাতির সম্বন্ধ ভবিষ্যৎ জীবনের সাথে এবং অবশিষ্ট নিদানগুলির সম্বন্ধ বর্তমানের সাথে। নির্বাণের জ্ঞান লাভের জন্য এই দ্বাদশ নিদানের শৃঙ্খলাকে জানা দরকার। নিদানগুলি হচ্ছে দুঃখের কারণ। বুদ্ধের প্রদর্শিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনে তৃষ্ণার নাশ হয় এবং ক্রমে অবিদ্যার নাশ হয়। এভাবে দুঃখের মূলকারণ অবিদ্যার নাশ হচ্ছে নির্বাণ। এই তত্ত্ব থেকে প্রতিভাত হয় যে দুঃখের উৎপত্তি আকস্মিক নয়, বরং শর্তাধীন। সেই শর্ত দূরীভূত হলে দুঃখেরও অবসান ঘটবে।
এই দ্বাদশ নিদানের নামান্তর ‘সংসারচক্র’। কেননা এই প্রতীত্যসমুৎপাদে মানুষের সংসারে যাতায়াত বা জন্মমৃত্যু কিভাবে হয় তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর অন্য নাম ‘ভবচক্র’, কেননা এই সিদ্ধান্তে মানুষের অস্তিত্ব বিচার করা হয়েছে। একে ‘জন্মমরণ চক্র’ও বলা হয়, কেননা এই সিদ্ধান্ত জীবের জীবনমৃত্যুর চক্রকে নিশ্চিত করে। একে ‘ধর্মচক্র’ বলা হয়, কেননা তা ধর্মের স্থান গ্রহণ করেছে। বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন-
‘যে প্রতীত্যসমুৎপাদ জানে সে ধর্ম জানে, যে ধর্ম জানে সে প্রতীত্যসমুৎপাদ জানে।’- (মজ্ঝিমনিকায়-২২)
.
বৌদ্ধদর্শনে প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্বকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে বৌদ্ধদর্শনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলি যেমন কর্মবাদ, অনিত্যতাবাদ, নিরীশ্বরবাদ, নৈরাত্মবাদ প্রভৃতি।
.
কর্মবাদ
ভারতীয় দর্শনে কর্মবাদ হলো নৈতিক জীবনের একটি সার্বিক কার্য-কারণ বিধি। এই বিধি চিরন্তন ও অলঙ্ঘনীয়। চার্বাক ছাড়া আস্তিক ও নাস্তিক সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ই কর্মবাদে বিশ্বাসী। এই বিধির মূল কথা হলো- কর্মফল কর্মানুসারী এবং কর্মফলভোগ কর্মফলানুসারী। মানুষ যেমন কর্ম করে তেমনই ফল লাভ করে। আবার এই স্ব-অর্জিত ফল ভোগ করতেও মানুষ বাধ্য। কোন কর্মফলই বিনষ্ট হয় না বা তাকে হস্তান্তর করা যায় না। মজ্ঝিমনিকায়ে (৩/২০৩, ২০৬) বুদ্ধ কর্মের অবিচ্ছেদ্যতা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘সত্তাসমূহ কম-সক (কর্মই তার স্বীয় আত্মীয়), কম্ম-দায়াদ (স্ব স্ব কর্মের ফলভোগী), কর্মযোনি (কর্মানুসারে জাত), কর্ম-বন্ধু ও কর্ম-পটিসরণ (কর্মাশ্রিত)।
.
এই কর্ম দ্বিবিধ- নিষ্কাম কর্ম ও সকাম কর্ম। কামনা-বাসনা মুক্ত হয়ে যে কর্ম করা হয় তাই নিষ্কাম কর্ম। অপরদিকে কামনা-বাসনার দ্বারা পরিচালিত হয়ে যে কর্ম করা হয় তাই সকাম কর্ম। নিষ্কাম কর্মের কর্মফল নেই, কিন্তু সকাম কর্মের কর্মফল আছে। বুদ্ধ নিষ্কাম কর্মকে ভাজা বীজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভাজা বীজের যেমন অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা নেই, তেমনি নিষ্কাম কর্মের কর্মফল উৎপাদন করার ক্ষমতা নেই।
.
সকাম কর্মের আবার নানা প্রকারভেদ বর্তমান। এই প্রকারগুলির মধ্যে ‘অনারব্ধ’, ‘প্রারব্ধ’, ‘সঞ্চিত’ ও ‘সঞ্চীয়মান’ কর্ম অন্যতম। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়নি তাকে অনারব্ধ কর্ম বলে। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে তাকে প্রারব্ধ কর্ম বলে। অতীত জীবনের যে কৃতকর্মের ফল সঞ্চিত আছে তাকে সঞ্চিত কর্ম এবং যে কর্মের ফল বর্তমান জীবনে সঞ্চিত হচ্ছে তাকে সঞ্চীয়মান কর্ম বলে।
কর্মবাদ অনুযায়ী প্রতিটি সকাম কর্মেরই কর্মফল আছে এবং প্রত্যেক জীবকে স্বকৃত কর্মের ফলভোগ করতে হবে। কোন কর্মের ফলভোগ যদি এক জন্মে শেষ না হয় তাহলেও তা বিনষ্ট হয় না। কর্মফলের সংস্কার সঞ্চিত হয়ে থাকে এবং পরজন্মে তা ভোগ করতে হয়। কর্মবাদ তাই জন্মান্তরবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সর্বকর্মফল নিঃশেষিত হলে তবেই জীবের মুক্তি বা নির্বাণলাভ সম্ভব। কর্মবাদের সমর্থকগণ কর্মবাদের মাধ্যমেই জীবের জীবনবৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে থাকেন।
.
বৌদ্ধদর্শনে মূলতঃ প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব দ্বারাই কর্মবাদের প্রতিষ্ঠা হয়। বুদ্ধের মতে সংসারের যাবতীয় মূর্ত ও অমূর্ত ঘটনার কার্য-কারণ শৃঙ্খলা অনুযায়ী জীবের বর্তমান জীবন হচ্ছে পূর্ব জীবনের কর্মের পরিণাম। বর্তমান জীবনের সাথে ভবিষ্যৎ বা ভাবী জীবনের সম্বন্ধ আছে। অর্থাৎ বর্তমান জীবনে যে কাজ করা হয় তার ফল ভাবী জীবনে পাওয়া যায়।
অবিদ্যাপ্রসূত তৃষ্ণাহেতু জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তির কারণে জীবের মধ্যে জন্মগ্রহণের ভবরূপ প্রবৃত্তির সৃষ্টি হয়, ফলে পুনর্জন্মের মাধ্যমে পুনরায় দুঃখরূপ জরামরণের অধীন হয়। স্পষ্টতই বুদ্ধমতে এই জীবলোক ও বিশ্বলোকের বৈচিত্র্যের পেছনে এমন কোন ঈশ্বর স্বীকৃত হয় নি যে বুদ্ধিপূর্বক এর রচনা করেছে। তাঁর মতে লোকবৈচিত্র্য কোন ঈশ্বরকৃত নয়, বরং জীবের কর্মকৃত। তা সত্ত্বের কর্ম হতে উৎপন্ন হয়।
.
এই কর্ম দুই প্রকার- চেতনা ও চেতয়িত্বা। চেতনা হলো মানস কর্ম। আর চেতনা হতে যে কর্ম উৎপন্ন হয় তা হচ্ছে চেতনাকৃত, তাকেই চেতয়িত্বা কর্ম বলে। এই চেতয়িত্বা কর্ম আবার দুই প্রকার- কায়িক ও বাচিক। অর্থাৎ শেষ বিচারে কর্ম তিন ধরনের- মানস কর্ম, কায়িক কর্ম ও বাচিক কর্ম।
সকল কর্মেরই কোন না কোন কারণ রয়েছে। কায়াকে আশ্রয় করেই সকল কর্ম সিদ্ধ হয় বলে কায়িক কর্মের কারণ হচ্ছে আশ্রয়। স্বভাব হতে উৎপন্ন বলে বাচিক কর্ম বা বাককর্মের কারণ হচ্ছে স্বভাব। আর সকল প্রকার কর্মের সমুত্থান বা আরম্ভ মন থেকে হয় বলে মানস কর্মের কারণ হচ্ছে সমুত্থান। অর্থাৎ কায়িক, বাচিক ও চেতনা বা মানস এই তিন প্রকার কর্মের সিদ্ধি আশ্রয়, স্বভাব ও সমুত্থান এই তিনটি কারণ থেকে হয়।
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুযায়ী বৌদ্ধদর্শন কর্মফলে বিশ্বাসী। যে কর্ম ফল দান করে তাকে বলে ‘উপচিত’ কর্ম। সকল কর্ম ‘উপচিত’ নয় অর্থাৎ ফল দিতে আরম্ভ করে না। ‘কৃত’ কর্ম ও ‘উপচিত’ কর্মের মধ্যে পার্থক্য আছে। অভিধর্মকোশ (৪/১২০)-এ উপচিত কর্মের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে, স্বেচ্ছায় বা বুদ্ধিপূর্বক (সঞ্চিন্ত্য) যে কর্ম করা হয় তা-ই উপচিত কর্ম। অবুদ্ধিপূর্বক কর্ম, বুদ্ধিপূর্বক সহসাকৃত কর্ম বা যে কর্ম ভুলবশে করা হয় তা উপচিত কর্ম নয়। পাপ আবিষ্কৃত হলে পাপের মাত্রা কমে যায় বা পরিক্ষয় হয়। কর্মের পর অনুতাপ হলে কৃতকর্ম ‘উপচিত’ হয় না। পাপ কর্মের প্রতিপক্ষ হলে কৃত কর্ম ‘উপচিত’ হয় না। পাপবিরতি ব্রত গ্রহণে, শুভ অভ্যাসে বুদ্ধাদির শরণে পাপ কর্ম ‘উপচিত’ হয় না।
.
প্রশ্ন আসে, যদি সকল কিছু প্রাক্ কর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয় তবে কোন জীব কিভাবে তা পরিবর্তন করতে পারে ? এ বিষয়ে বুদ্ধ কোন উত্তর দেন নি। তবে তিনি কর্মের সমস্ত বিধান থেকে মুক্ত কর্মের অতিক্রমণ স্বীকার করেছেন। ঋষিদের শুদ্ধ চেতনায় ফল লাভ হয় অর্থাৎ তা উপচিত কর্ম। বলা হয়েছে চেতনা হচ্ছে মানস কর্ম। মানস কর্ম উপচিত কর্ম হয় যদি তা অবিদ্যা নাশে অভীষ্ট হয়। কায়িক ও বাচিক কর্মকে বাদ দিয়ে মানস কর্ম নিজের অভীষ্টকে লাভ করতে পারে। তবে সাধারণত ফল লাভের জন্য চেতনাকে কায় ও বাক-কে অবলম্বন করে সমুত্থিত হতে হয়। বুদ্ধমতে কর্ম যান্ত্রিক নয়। যদিও বর্তমান জীবন অতীত জীবনের কর্মের দ্বারা নির্ধারিত, তবু ভবিষ্যৎ জীবন নির্বাধে আমাদের ইচ্ছার বা কর্মের অধীন হয়ে আছে। বস্তুত কর্মকে যান্ত্রিক বললে জীবের স্বাধীনতা থাকে না বা মানবজীবনে ধর্মের প্রয়োজন থাকে না। বুদ্ধের দর্শন চরম নিয়তিবাদের বিরোধী। জীবের ভবচক্রে সর্বদাই কার্যকারণভাব চলতে থাকে। চক্রের দুই অন্তে বা মাথায় জন্ম ও মৃত্যু সূচকরূপে রয়েছে। পুরাতন নষ্ট হয়, নতুন প্রাদুর্ভূত হয়। বুদ্ধের মতে পরম আধ্যাত্মদশায় কোন কর্ম ফল প্রদান করে না।
অতএব বলা যায়, বৌদ্ধদর্শনে কর্মবাদ কোন অনড় অদৃষ্টবাদ নয়। জীবের বুদ্ধিপূর্বক উপচিত কর্মই তার স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রক।
.
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুসারে বাহ্য বা মানস সংসারের যত ঘটনা আছে তাদের কোন-না-কোন কারণ অবশ্যই আছে। এই নিয়ম স্বতঃ পরিচালিত হয়, তার সঞ্চালন কোন চেতন শক্তির দ্বারা হয় না। এই মতে বস্তু নিত্য নয়, কিন্তু তার অস্তিত্বে সন্দেহ করা যায় না। এর উৎপত্তি অন্য পদার্থকে প্রাপ্ত হয়ে হয়, কিন্তু তার পূর্ণতঃ বিনাশ হয় না, তার কিছু কার্য বা পরিণাম অবশ্যই থাকে। এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ হচ্ছে মধ্যম মার্গ, যা পূর্ণতঃ নিত্যতাবাদ বা শাশ্বতবাদ নয়, আবার উচ্ছেদবাদ বা বিনাশবাদও নয়। দুটোর মধ্যবর্তী মতবাদ। নিত্যতাবাদ অনুযায়ী শর্তবিহীন নিত্যসত্তা থাকতে পারে। অর্থাৎ কোন কোন সত্তা নিত্য এবং শর্তনিরপেক্ষভাবে অস্তিত্বশীল। অপরপক্ষে উচ্ছেদবাদ অনুযায়ী কোন কিছুর পূর্ণ বিনাশ হতে পারে। অর্থাৎ কোন কার্য না রেখেই তা বিনষ্ট হতে পারে। কিন্তু প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী সব বস্তুই উৎপন্ন হচ্ছে এবং বিনষ্ট হওয়ার সময় কার্য রেখে যায়। সবকিছুর উৎপত্তি শর্তাধীন এবং সবকিছুর অস্তিত্বও শর্তাধীন। কারণ শর্তরহিত নিত্য বস্তু নেই। যা আছে তা পরিবর্তনশীল। অর্থাৎ সেটি কারণের দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে এবং সেটি কার্য উৎপাদন করবে। এভাবে কার্যকারণের ধারা চলতে থাকবে। আগের অবস্থা কারণ এবং পরের অবস্থা কার্য। অস্তিত্ব অর্থ ধারাবাহিকতা, অর্থাৎ অবস্থার ক্রমিকতা। সুতরাং, নিত্যতা বা পূর্ণ বিনাশ বলে কিছু নেই।
.
আগেই বলা হয়েছে, প্রতীত্য-সমুৎপাদের বারোটি নিদান ভূত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনকে ব্যাপ্ত করে রয়েছে। অবিদ্যা ও সংস্কার অতীত জীবনের সাথে সম্বন্ধ, জরামরণ ও জাতির সম্বন্ধ ভবিষ্যৎ জীবনের সাথে এবং অবশিষ্ট নিদানগুলির সম্বন্ধ বর্তমানের সাথে। নির্বাণের জ্ঞান লাভের জন্য এই দ্বাদশ নিদানের শৃঙ্খলাকে জানা দরকার। নিদানগুলি হচ্ছে দুঃখের কারণ। বুদ্ধের প্রদর্শিত আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনে তৃষ্ণার নাশ হয় এবং ক্রমে অবিদ্যার নাশ হয়। এভাবে দুঃখের মূলকারণ অবিদ্যার নাশ হচ্ছে নির্বাণ। এই তত্ত্ব থেকে প্রতিভাত হয় যে দুঃখের উৎপত্তি আকস্মিক নয়, বরং শর্তাধীন। সেই শর্ত দূরীভূত হলে দুঃখেরও অবসান ঘটবে।
এই দ্বাদশ নিদানের নামান্তর ‘সংসারচক্র’। কেননা এই প্রতীত্যসমুৎপাদে মানুষের সংসারে যাতায়াত বা জন্মমৃত্যু কিভাবে হয় তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর অন্য নাম ‘ভবচক্র’, কেননা এই সিদ্ধান্তে মানুষের অস্তিত্ব বিচার করা হয়েছে। একে ‘জন্মমরণ চক্র’ও বলা হয়, কেননা এই সিদ্ধান্ত জীবের জীবনমৃত্যুর চক্রকে নিশ্চিত করে। একে ‘ধর্মচক্র’ বলা হয়, কেননা তা ধর্মের স্থান গ্রহণ করেছে। বুদ্ধ স্বয়ং বলেছেন-
‘যে প্রতীত্যসমুৎপাদ জানে সে ধর্ম জানে, যে ধর্ম জানে সে প্রতীত্যসমুৎপাদ জানে।’- (মজ্ঝিমনিকায়-২২)
.
বৌদ্ধদর্শনে প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্বকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেছে বৌদ্ধদর্শনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলি যেমন কর্মবাদ, অনিত্যতাবাদ, নিরীশ্বরবাদ, নৈরাত্মবাদ প্রভৃতি।
.
কর্মবাদ
ভারতীয় দর্শনে কর্মবাদ হলো নৈতিক জীবনের একটি সার্বিক কার্য-কারণ বিধি। এই বিধি চিরন্তন ও অলঙ্ঘনীয়। চার্বাক ছাড়া আস্তিক ও নাস্তিক সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ই কর্মবাদে বিশ্বাসী। এই বিধির মূল কথা হলো- কর্মফল কর্মানুসারী এবং কর্মফলভোগ কর্মফলানুসারী। মানুষ যেমন কর্ম করে তেমনই ফল লাভ করে। আবার এই স্ব-অর্জিত ফল ভোগ করতেও মানুষ বাধ্য। কোন কর্মফলই বিনষ্ট হয় না বা তাকে হস্তান্তর করা যায় না। মজ্ঝিমনিকায়ে (৩/২০৩, ২০৬) বুদ্ধ কর্মের অবিচ্ছেদ্যতা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘সত্তাসমূহ কম-সক (কর্মই তার স্বীয় আত্মীয়), কম্ম-দায়াদ (স্ব স্ব কর্মের ফলভোগী), কর্মযোনি (কর্মানুসারে জাত), কর্ম-বন্ধু ও কর্ম-পটিসরণ (কর্মাশ্রিত)।
.
এই কর্ম দ্বিবিধ- নিষ্কাম কর্ম ও সকাম কর্ম। কামনা-বাসনা মুক্ত হয়ে যে কর্ম করা হয় তাই নিষ্কাম কর্ম। অপরদিকে কামনা-বাসনার দ্বারা পরিচালিত হয়ে যে কর্ম করা হয় তাই সকাম কর্ম। নিষ্কাম কর্মের কর্মফল নেই, কিন্তু সকাম কর্মের কর্মফল আছে। বুদ্ধ নিষ্কাম কর্মকে ভাজা বীজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ভাজা বীজের যেমন অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা নেই, তেমনি নিষ্কাম কর্মের কর্মফল উৎপাদন করার ক্ষমতা নেই।
.
সকাম কর্মের আবার নানা প্রকারভেদ বর্তমান। এই প্রকারগুলির মধ্যে ‘অনারব্ধ’, ‘প্রারব্ধ’, ‘সঞ্চিত’ ও ‘সঞ্চীয়মান’ কর্ম অন্যতম। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়নি তাকে অনারব্ধ কর্ম বলে। যে কর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে তাকে প্রারব্ধ কর্ম বলে। অতীত জীবনের যে কৃতকর্মের ফল সঞ্চিত আছে তাকে সঞ্চিত কর্ম এবং যে কর্মের ফল বর্তমান জীবনে সঞ্চিত হচ্ছে তাকে সঞ্চীয়মান কর্ম বলে।
কর্মবাদ অনুযায়ী প্রতিটি সকাম কর্মেরই কর্মফল আছে এবং প্রত্যেক জীবকে স্বকৃত কর্মের ফলভোগ করতে হবে। কোন কর্মের ফলভোগ যদি এক জন্মে শেষ না হয় তাহলেও তা বিনষ্ট হয় না। কর্মফলের সংস্কার সঞ্চিত হয়ে থাকে এবং পরজন্মে তা ভোগ করতে হয়। কর্মবাদ তাই জন্মান্তরবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সর্বকর্মফল নিঃশেষিত হলে তবেই জীবের মুক্তি বা নির্বাণলাভ সম্ভব। কর্মবাদের সমর্থকগণ কর্মবাদের মাধ্যমেই জীবের জীবনবৈচিত্র্যকে ব্যাখ্যা করে থাকেন।
.
বৌদ্ধদর্শনে মূলতঃ প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব দ্বারাই কর্মবাদের প্রতিষ্ঠা হয়। বুদ্ধের মতে সংসারের যাবতীয় মূর্ত ও অমূর্ত ঘটনার কার্য-কারণ শৃঙ্খলা অনুযায়ী জীবের বর্তমান জীবন হচ্ছে পূর্ব জীবনের কর্মের পরিণাম। বর্তমান জীবনের সাথে ভবিষ্যৎ বা ভাবী জীবনের সম্বন্ধ আছে। অর্থাৎ বর্তমান জীবনে যে কাজ করা হয় তার ফল ভাবী জীবনে পাওয়া যায়।
অবিদ্যাপ্রসূত তৃষ্ণাহেতু জাগতিক বিষয়ের প্রতি অনুরাগ বা আসক্তির কারণে জীবের মধ্যে জন্মগ্রহণের ভবরূপ প্রবৃত্তির সৃষ্টি হয়, ফলে পুনর্জন্মের মাধ্যমে পুনরায় দুঃখরূপ জরামরণের অধীন হয়। স্পষ্টতই বুদ্ধমতে এই জীবলোক ও বিশ্বলোকের বৈচিত্র্যের পেছনে এমন কোন ঈশ্বর স্বীকৃত হয় নি যে বুদ্ধিপূর্বক এর রচনা করেছে। তাঁর মতে লোকবৈচিত্র্য কোন ঈশ্বরকৃত নয়, বরং জীবের কর্মকৃত। তা সত্ত্বের কর্ম হতে উৎপন্ন হয়।
.
এই কর্ম দুই প্রকার- চেতনা ও চেতয়িত্বা। চেতনা হলো মানস কর্ম। আর চেতনা হতে যে কর্ম উৎপন্ন হয় তা হচ্ছে চেতনাকৃত, তাকেই চেতয়িত্বা কর্ম বলে। এই চেতয়িত্বা কর্ম আবার দুই প্রকার- কায়িক ও বাচিক। অর্থাৎ শেষ বিচারে কর্ম তিন ধরনের- মানস কর্ম, কায়িক কর্ম ও বাচিক কর্ম।
সকল কর্মেরই কোন না কোন কারণ রয়েছে। কায়াকে আশ্রয় করেই সকল কর্ম সিদ্ধ হয় বলে কায়িক কর্মের কারণ হচ্ছে আশ্রয়। স্বভাব হতে উৎপন্ন বলে বাচিক কর্ম বা বাককর্মের কারণ হচ্ছে স্বভাব। আর সকল প্রকার কর্মের সমুত্থান বা আরম্ভ মন থেকে হয় বলে মানস কর্মের কারণ হচ্ছে সমুত্থান। অর্থাৎ কায়িক, বাচিক ও চেতনা বা মানস এই তিন প্রকার কর্মের সিদ্ধি আশ্রয়, স্বভাব ও সমুত্থান এই তিনটি কারণ থেকে হয়।
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুযায়ী বৌদ্ধদর্শন কর্মফলে বিশ্বাসী। যে কর্ম ফল দান করে তাকে বলে ‘উপচিত’ কর্ম। সকল কর্ম ‘উপচিত’ নয় অর্থাৎ ফল দিতে আরম্ভ করে না। ‘কৃত’ কর্ম ও ‘উপচিত’ কর্মের মধ্যে পার্থক্য আছে। অভিধর্মকোশ (৪/১২০)-এ উপচিত কর্মের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যে, স্বেচ্ছায় বা বুদ্ধিপূর্বক (সঞ্চিন্ত্য) যে কর্ম করা হয় তা-ই উপচিত কর্ম। অবুদ্ধিপূর্বক কর্ম, বুদ্ধিপূর্বক সহসাকৃত কর্ম বা যে কর্ম ভুলবশে করা হয় তা উপচিত কর্ম নয়। পাপ আবিষ্কৃত হলে পাপের মাত্রা কমে যায় বা পরিক্ষয় হয়। কর্মের পর অনুতাপ হলে কৃতকর্ম ‘উপচিত’ হয় না। পাপ কর্মের প্রতিপক্ষ হলে কৃত কর্ম ‘উপচিত’ হয় না। পাপবিরতি ব্রত গ্রহণে, শুভ অভ্যাসে বুদ্ধাদির শরণে পাপ কর্ম ‘উপচিত’ হয় না।
.
প্রশ্ন আসে, যদি সকল কিছু প্রাক্ কর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয় তবে কোন জীব কিভাবে তা পরিবর্তন করতে পারে ? এ বিষয়ে বুদ্ধ কোন উত্তর দেন নি। তবে তিনি কর্মের সমস্ত বিধান থেকে মুক্ত কর্মের অতিক্রমণ স্বীকার করেছেন। ঋষিদের শুদ্ধ চেতনায় ফল লাভ হয় অর্থাৎ তা উপচিত কর্ম। বলা হয়েছে চেতনা হচ্ছে মানস কর্ম। মানস কর্ম উপচিত কর্ম হয় যদি তা অবিদ্যা নাশে অভীষ্ট হয়। কায়িক ও বাচিক কর্মকে বাদ দিয়ে মানস কর্ম নিজের অভীষ্টকে লাভ করতে পারে। তবে সাধারণত ফল লাভের জন্য চেতনাকে কায় ও বাক-কে অবলম্বন করে সমুত্থিত হতে হয়। বুদ্ধমতে কর্ম যান্ত্রিক নয়। যদিও বর্তমান জীবন অতীত জীবনের কর্মের দ্বারা নির্ধারিত, তবু ভবিষ্যৎ জীবন নির্বাধে আমাদের ইচ্ছার বা কর্মের অধীন হয়ে আছে। বস্তুত কর্মকে যান্ত্রিক বললে জীবের স্বাধীনতা থাকে না বা মানবজীবনে ধর্মের প্রয়োজন থাকে না। বুদ্ধের দর্শন চরম নিয়তিবাদের বিরোধী। জীবের ভবচক্রে সর্বদাই কার্যকারণভাব চলতে থাকে। চক্রের দুই অন্তে বা মাথায় জন্ম ও মৃত্যু সূচকরূপে রয়েছে। পুরাতন নষ্ট হয়, নতুন প্রাদুর্ভূত হয়। বুদ্ধের মতে পরম আধ্যাত্মদশায় কোন কর্ম ফল প্রদান করে না।
অতএব বলা যায়, বৌদ্ধদর্শনে কর্মবাদ কোন অনড় অদৃষ্টবাদ নয়। জীবের বুদ্ধিপূর্বক উপচিত কর্মই তার স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রক।
.
ক্ষণিকবাদ বা ক্ষণভঙ্গবাদ (Doctrine of Momentariness)
সায়ণ-মাধবীয় ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধ প্রস্থানে মাধবাচার্য বলেছেন-
সায়ণ-মাধবীয় ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধ প্রস্থানে মাধবাচার্য বলেছেন-
‘সর্বং ক্ষণিকং ক্ষণিকং দুঃখং দুঃখং স্বলক্ষণং স্বলক্ষণং শূন্যং শূন্যম্ ইতি ভাবনা-চতুষ্টয়মুপদিষ্টং দ্রষ্টব্যম্’।- (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : সমস্তই ক্ষণিক ক্ষণিক, দুঃখ দুঃখ, স্বলক্ষণ স্বলক্ষণ ও শূন্য শূন্য- এই ভাবনা চতুষ্টয় বুদ্ধ কর্তৃক উপদিষ্ট জানবেন।
.
বৌদ্ধমতে পুরুষার্থলাভের হেতু হলো বুদ্ধের ভাবনাচতুষ্টয় বা চারটি ভাবনা। সেগুলো হলো যথাক্রমে- সর্বং ক্ষণিকং ক্ষণিকং বা সব পদার্থই ক্ষণিক, সর্বং দুঃখং দুঃখং বা সব পদার্থই দুঃখময়, সর্বং স্বলক্ষণং স্বলক্ষণম্ বা সব পদার্থই স্বলক্ষণ এবং সর্বং শূণ্যং শূণ্যম বা সব পদার্থই শূণ্য। মূলত এই ভাবনা চতুষ্টয় থেকেই গোটা বৌদ্ধ দর্শনের জন্ম।
যদিও এই সব কয়টি ভাবনাকে বুদ্ধের পরবর্তীকালের দার্শনিক শিষ্যরা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেন নি, একেকটি ভাবনা নিয়ে শিষ্যদের নিজেদের মধ্যে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। যেমন ‘সর্বং শূন্যং শূন্যম্’ এই ভাবনার অর্থ সম্বন্ধে যোগাচার এবং মাধ্যমিক বৌদ্ধদার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। যোগাচার মতে শূন্য অর্থ অলীক। কিন্তু মাধ্যমিক বৌদ্ধরা শূন্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন- ‘চতুষ্কোটীবিনির্মুক্ত শূন্যমেব’। চতুষ্কোটী অর্থ সৎ, অসৎ, সদসৎ এবং সদসৎ-ভিন্ন। তাই মাধ্যমিক বৌদ্ধদের মতে শূন্য অর্থ এই চারটি সম্ভাবনার কোনটিই নয়।
তবে অন্যান্য ভাবনাগুলির তুলনায় প্রথম ভাবনাটি অর্থাৎ ‘সব পদার্থই ক্ষণিক’- এ ভাবনাটি প্রায় সকল বৌদ্ধ দার্শনিকরাই স্বীকার করেছেন। এখানে সর্ব অর্থ হলো আকাশের অতিরিক্ত ভাববস্তুগুলি। বৌদ্ধমতে আকাশ ভাববস্তু নয়। আকাশ আবরণের অভাবমাত্র। সুতরাং, আকাশ ছাড়া সব ভাববস্তুই ক্ষণিক।
.
জীবন ও জগতের নিয়ত পরিবর্তনশীলতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের কথা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দর্শনেই আলোচিত হতে দেখা যায়। গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছেন, একই নদীতে আমরা দুবার অবগাহন করতে পারি না; দ্বিতীয়বার অবগাহনের সময় প্রবহমানা নদীর পূর্বজলরাশির স্থলে নতুন জলরাশির আবির্ভাব ঘটে। বিভিন্ন দর্শনমতেই এটা স্বীকার করা হয় যে, জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং অনাদি অনন্ত প্রাণপ্রবাহ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিবর্তন সৃষ্টি করে চলেছে। বুদ্ধও জগতের এই পরিবর্তনশীলতা এবং জাগতিক বস্তুর অনিত্যতা যথার্থই উপলব্ধি করেছেন। তবে তাঁর মতে জাগতিক বস্তু কেবলমাত্র অনিত্যই নয়, ক্ষণিক।
.
ব্যবহারিক জীবনে আমাদের কাছে যে সকল বস্তুকে স্থির ও নিশ্চল মনে হয়, বৌদ্ধমতে আমাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অবিদ্যাপ্রসূত। জগতের কোন কিছুই স্থির বা নিশ্চল নয়। স্থির ও নিশ্চলরূপ প্রতিভাত বস্তু অসংখ্য সদৃশ ক্ষণিক অবস্থার প্রবাহমাত্র। এই প্রবাহই বৌদ্ধদর্শনে ‘সন্তান’, ‘সন্ততি’ বা ‘ক্ষণ’ বলে পরিচিত। ব্যবহারিক জীবনে আমরা প্রবহমান কালকে বছর, মাস, দিন, ঘণ্টা, মিনিট প্রভৃতিতে ভাগ করি। এই সব ভাগ বোধগম্য ও ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু আমরা কালের এমন একটি অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম ভাগের কথা চিন্তা করতে পারি যা লৌকিকভাবে বোধগম্য নয়। কালের এরকম একটি ভাগকেই ‘ক্ষণ’ বলে। ন্যায়ভাষ্যেও বলা হয়েছে-
বৌদ্ধমতে পুরুষার্থলাভের হেতু হলো বুদ্ধের ভাবনাচতুষ্টয় বা চারটি ভাবনা। সেগুলো হলো যথাক্রমে- সর্বং ক্ষণিকং ক্ষণিকং বা সব পদার্থই ক্ষণিক, সর্বং দুঃখং দুঃখং বা সব পদার্থই দুঃখময়, সর্বং স্বলক্ষণং স্বলক্ষণম্ বা সব পদার্থই স্বলক্ষণ এবং সর্বং শূণ্যং শূণ্যম বা সব পদার্থই শূণ্য। মূলত এই ভাবনা চতুষ্টয় থেকেই গোটা বৌদ্ধ দর্শনের জন্ম।
যদিও এই সব কয়টি ভাবনাকে বুদ্ধের পরবর্তীকালের দার্শনিক শিষ্যরা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেন নি, একেকটি ভাবনা নিয়ে শিষ্যদের নিজেদের মধ্যে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। যেমন ‘সর্বং শূন্যং শূন্যম্’ এই ভাবনার অর্থ সম্বন্ধে যোগাচার এবং মাধ্যমিক বৌদ্ধদার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। যোগাচার মতে শূন্য অর্থ অলীক। কিন্তু মাধ্যমিক বৌদ্ধরা শূন্যের সংজ্ঞা দিয়েছেন- ‘চতুষ্কোটীবিনির্মুক্ত শূন্যমেব’। চতুষ্কোটী অর্থ সৎ, অসৎ, সদসৎ এবং সদসৎ-ভিন্ন। তাই মাধ্যমিক বৌদ্ধদের মতে শূন্য অর্থ এই চারটি সম্ভাবনার কোনটিই নয়।
তবে অন্যান্য ভাবনাগুলির তুলনায় প্রথম ভাবনাটি অর্থাৎ ‘সব পদার্থই ক্ষণিক’- এ ভাবনাটি প্রায় সকল বৌদ্ধ দার্শনিকরাই স্বীকার করেছেন। এখানে সর্ব অর্থ হলো আকাশের অতিরিক্ত ভাববস্তুগুলি। বৌদ্ধমতে আকাশ ভাববস্তু নয়। আকাশ আবরণের অভাবমাত্র। সুতরাং, আকাশ ছাড়া সব ভাববস্তুই ক্ষণিক।
.
জীবন ও জগতের নিয়ত পরিবর্তনশীলতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের কথা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দর্শনেই আলোচিত হতে দেখা যায়। গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছেন, একই নদীতে আমরা দুবার অবগাহন করতে পারি না; দ্বিতীয়বার অবগাহনের সময় প্রবহমানা নদীর পূর্বজলরাশির স্থলে নতুন জলরাশির আবির্ভাব ঘটে। বিভিন্ন দর্শনমতেই এটা স্বীকার করা হয় যে, জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং অনাদি অনন্ত প্রাণপ্রবাহ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিবর্তন সৃষ্টি করে চলেছে। বুদ্ধও জগতের এই পরিবর্তনশীলতা এবং জাগতিক বস্তুর অনিত্যতা যথার্থই উপলব্ধি করেছেন। তবে তাঁর মতে জাগতিক বস্তু কেবলমাত্র অনিত্যই নয়, ক্ষণিক।
.
ব্যবহারিক জীবনে আমাদের কাছে যে সকল বস্তুকে স্থির ও নিশ্চল মনে হয়, বৌদ্ধমতে আমাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও অবিদ্যাপ্রসূত। জগতের কোন কিছুই স্থির বা নিশ্চল নয়। স্থির ও নিশ্চলরূপ প্রতিভাত বস্তু অসংখ্য সদৃশ ক্ষণিক অবস্থার প্রবাহমাত্র। এই প্রবাহই বৌদ্ধদর্শনে ‘সন্তান’, ‘সন্ততি’ বা ‘ক্ষণ’ বলে পরিচিত। ব্যবহারিক জীবনে আমরা প্রবহমান কালকে বছর, মাস, দিন, ঘণ্টা, মিনিট প্রভৃতিতে ভাগ করি। এই সব ভাগ বোধগম্য ও ব্যবহারযোগ্য। কিন্তু আমরা কালের এমন একটি অবিভাজ্য ক্ষুদ্রতম ভাগের কথা চিন্তা করতে পারি যা লৌকিকভাবে বোধগম্য নয়। কালের এরকম একটি ভাগকেই ‘ক্ষণ’ বলে। ন্যায়ভাষ্যেও বলা হয়েছে-
‘ক্ষণশ্চ অল্পীয়ান্ কালঃ’। (ন্যায়ভাষ্য)
অর্থাৎ : কালের সূক্ষ্মতম অংশ হলো ক্ষণ।
.
বৌদ্ধমতে জাগতিক বস্তু প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হয় এবং কোন বস্তুই একক্ষণের অধিককাল স্থায়ী হয় না। এই মতবাদই ‘ক্ষণিকবাদ’ নামে পরিচিত।
ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী একটি বস্তু যে ক্ষণে উৎপন্ন হয় তার পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়। বস্তুর বিনাশক্ষণেই ঐ বস্তুর সদৃশ অপর একটি বস্তু উৎপন্ন হয়। আমরা বস্তুর এই উৎপত্তি ও বিনাশক্ষণের রহস্য জানি না বলেই বস্তুকে স্থির ও অচঞ্চল বলে মনে করি। প্রাচীন বৌদ্ধরা জীবের শরীরের বৃদ্ধি ও হ্রাসের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছেন যে, জীবদেহের বৃদ্ধি কোন একটিমাত্র ক্ষণে হয় না। প্রতিক্ষণেই জীবদেহের বৃদ্ধি সাধিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, প্রতিক্ষণেই জীবদেহ পরিবর্তিত হয়ে একটি সদৃশ জীবদেহ উৎপন্ন করে।
.
সকল বস্তুই ক্ষণিক, বুদ্ধের এ ভাবনায় দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়- বস্তু বা পদার্থ ও ক্ষণ। কালের সূক্ষ্মতম অংশ হচ্ছে ক্ষণ। আর জগতের সমুদয় বস্তুকে বুদ্ধ তিন প্রকারের উপাদানে বিভাজন করেছেন- স্কন্ধ, আয়তন ও ধাতু।
স্কন্ধ সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি যে স্কন্ধ পাঁচটি- রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। বুদ্ধ এই স্কন্ধকে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন বা অনিত্য-সংস্কৃত অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু বা ব্যয়ধর্মী বা বিনাশধর্মী বলে মন্তব্য করেছেন।
আয়তন দ্বাদশ সংখ্যক– ছয়টি ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক ও মন) এবং এই ইন্দ্রিয়কৃত ছয়টি বিষয় (রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ ও অনুভূতি)।
ধাতু অষ্টাদশ– উপরোক্ত ছয় ইন্দ্রিয় এবং তাদের ছয়টি বিষয় এবং এই ইন্দ্রিয় ও বিষয়গুলির সম্পর্ক জাত ছয়টি বিজ্ঞান (চক্ষু-বিজ্ঞান, শ্রোত্র-বিজ্ঞান, ঘ্রাণ-বিজ্ঞান, জিহ্বা-বিজ্ঞান, কায়-বিজ্ঞান ও মন-বিজ্ঞান) নিয়ে মোট অষ্টাদশ ধাতু।
বৌদ্ধমতে জাগতিক বস্তু প্রতিক্ষণে পরিবর্তিত হয় এবং কোন বস্তুই একক্ষণের অধিককাল স্থায়ী হয় না। এই মতবাদই ‘ক্ষণিকবাদ’ নামে পরিচিত।
ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী একটি বস্তু যে ক্ষণে উৎপন্ন হয় তার পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়। বস্তুর বিনাশক্ষণেই ঐ বস্তুর সদৃশ অপর একটি বস্তু উৎপন্ন হয়। আমরা বস্তুর এই উৎপত্তি ও বিনাশক্ষণের রহস্য জানি না বলেই বস্তুকে স্থির ও অচঞ্চল বলে মনে করি। প্রাচীন বৌদ্ধরা জীবের শরীরের বৃদ্ধি ও হ্রাসের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছেন যে, জীবদেহের বৃদ্ধি কোন একটিমাত্র ক্ষণে হয় না। প্রতিক্ষণেই জীবদেহের বৃদ্ধি সাধিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, প্রতিক্ষণেই জীবদেহ পরিবর্তিত হয়ে একটি সদৃশ জীবদেহ উৎপন্ন করে।
.
সকল বস্তুই ক্ষণিক, বুদ্ধের এ ভাবনায় দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়- বস্তু বা পদার্থ ও ক্ষণ। কালের সূক্ষ্মতম অংশ হচ্ছে ক্ষণ। আর জগতের সমুদয় বস্তুকে বুদ্ধ তিন প্রকারের উপাদানে বিভাজন করেছেন- স্কন্ধ, আয়তন ও ধাতু।
স্কন্ধ সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি যে স্কন্ধ পাঁচটি- রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। বুদ্ধ এই স্কন্ধকে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন বা অনিত্য-সংস্কৃত অর্থাৎ ক্ষয়িষ্ণু বা ব্যয়ধর্মী বা বিনাশধর্মী বলে মন্তব্য করেছেন।
আয়তন দ্বাদশ সংখ্যক– ছয়টি ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসা, জিহ্বা, ত্বক ও মন) এবং এই ইন্দ্রিয়কৃত ছয়টি বিষয় (রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ ও অনুভূতি)।
ধাতু অষ্টাদশ– উপরোক্ত ছয় ইন্দ্রিয় এবং তাদের ছয়টি বিষয় এবং এই ইন্দ্রিয় ও বিষয়গুলির সম্পর্ক জাত ছয়টি বিজ্ঞান (চক্ষু-বিজ্ঞান, শ্রোত্র-বিজ্ঞান, ঘ্রাণ-বিজ্ঞান, জিহ্বা-বিজ্ঞান, কায়-বিজ্ঞান ও মন-বিজ্ঞান) নিয়ে মোট অষ্টাদশ ধাতু।
.
বিশ্বের সমুদয় বস্তুই এই তিনটির কোন না কোন একটির অংশীভূত। এদেরকে নাম এবং রূপ দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়, যার মধ্যে নাম চেতনা বা বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। আর রূপ হচ্ছে মূর্ত বা বাস্তব বস্তু। বুদ্ধের মতে এ সবই অনিত্য- “এই-ই অটল নিয়ম- …রূপ (মহাভূত) বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান প্রভৃতি সমস্ত সংস্কার (কৃত বস্তু) অনিত্য।” (অঙ্গুত্তরনিকায় : ৩/১/৩৪)
“রূপ …বেদনা …সংজ্ঞা …সংস্কার …বিজ্ঞান (এই পঞ্চ স্কন্ধ) অবিকৃত নয়।…” (সংযুক্তনিকায় : ১৩)
রূপের (বাস্তব পদার্থের) ক্ষণিকতাকে সহজেই বোঝা যায়, কিন্তু বিজ্ঞান (মন বা চেতনা) তা অপেক্ষাও ণভঙ্গুর। এই চিত্ত মন বা বিজ্ঞান দিবারাত্রই উৎপন্ন হচ্ছে ও বিনষ্ট হচ্ছে। এই হলো বুদ্ধের মত। বুদ্ধের দর্শনে অনিত্যতা এমন এক নিয়ম যার কোনো প্রতিবাদ (antithesis) নেই।
‘বারবার নতুন করে উৎপন্ন হচ্ছে ও বিনষ্ট হচ্ছে’- এই মতানুসারে বুদ্ধের অনিত্যবাদও কোন এক মৌলিক উপাদানের বাহ্যিক পরিবর্তন মাত্র নয়, একের বিনাশ এবং অন্য আর একের সম্পূর্ণ নতুন উৎপাদন। বুদ্ধ কার্য-কারণের নিরন্তর বা অবিচ্ছিন্ন পরম্পরাকে মানতেন না।
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুসারে প্রত্যেক বস্তু কারণানুসারী হয়ে থাকে। কারণের নাশে বস্তুর নাশ হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু অনিত্য। প্রতীত্য-সমুৎপাদ সিদ্ধান্ত অনিত্যবাদকেই প্রতিফলিত করে। অনিত্যবাদ হলো নিত্যবাদ (eternalism) ও উচ্ছেদবাদের (nihilism) মধ্য মার্গ। নিত্যবাদ অনুসারে ‘প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে সৎ (being)’, এবং উচ্ছেদবাদ অনুসারে ‘প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে অসৎ (no-being)’। উভয় মতই একান্তিক বা চূড়ান্ত। কিন্তু বুদ্ধ এই দুই মতকে পরিহার করে মধ্যম মার্গের উপদেশ দিয়েছেন। মধ্যম মার্গের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- জীবন পরিবর্তনশীল (becoming)। জীবনকে পরিবর্তনশীল বলে বুদ্ধ সৎ ও অসতের সমন্বয় করেছেন। বুদ্ধের এই অনিত্যবাদ সিদ্ধান্তকে তাঁর অনুযায়িরা ক্ষণিকবাদে পরিবর্তিত করেন। ক্ষণিকবাদ হচ্ছে অনিত্যবাদের বিকশিত রূপ। এরই অন্য নাম হচ্ছে ক্ষণভঙ্গবাদ।
.
ক্ষণিকবাদ অনুসারে বিশ্বের প্রত্যেক বস্তু কেবল অনিত্য নয়, ক্ষণভঙ্গুরও। নদীর এক-একটি বুদ্বুদ যেমন এক-একটি ক্ষণের জন্য আসে, দ্বিতীয় ক্ষণে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি জগতের সমস্ত বস্তু ক্ষণমাত্রের জন্য নিজের অস্তিত্বকে বজায় রাখে। বৌদ্ধমতে ক্ষণিক অর্থ ক্ষণমাত্র স্থায়ী। প্রথম ক্ষণে যে বস্তুটি উৎপন্ন হয়, দ্বিতীয় ক্ষণে তার বিনাশ হয়। এবং এই দ্বিতীয় ক্ষণেই তার সদৃশ বস্তুর আবার উৎপত্তি হয়। প্রতিক্ষণেই এভাবে ভাববস্তুর জন্ম মৃত্যু প্রবাহ চলতে থাকে। বৌদ্ধমতে তাই সমস্ত ভাববস্তুকে ক্ষণিকরূপে ভাবতে হবে। ধম্মপদে বলা হয়েছে- ‘যাকে নিত্য ও স্থায়ী বলে মনে হয় তারও নাশ হয়। যাকে মহান্ মানা হয় তারও পতন হয়।’ কিংবা-
বিশ্বের সমুদয় বস্তুই এই তিনটির কোন না কোন একটির অংশীভূত। এদেরকে নাম এবং রূপ দ্বারা নির্দিষ্ট করা হয়, যার মধ্যে নাম চেতনা বা বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। আর রূপ হচ্ছে মূর্ত বা বাস্তব বস্তু। বুদ্ধের মতে এ সবই অনিত্য- “এই-ই অটল নিয়ম- …রূপ (মহাভূত) বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান প্রভৃতি সমস্ত সংস্কার (কৃত বস্তু) অনিত্য।” (অঙ্গুত্তরনিকায় : ৩/১/৩৪)
“রূপ …বেদনা …সংজ্ঞা …সংস্কার …বিজ্ঞান (এই পঞ্চ স্কন্ধ) অবিকৃত নয়।…” (সংযুক্তনিকায় : ১৩)
রূপের (বাস্তব পদার্থের) ক্ষণিকতাকে সহজেই বোঝা যায়, কিন্তু বিজ্ঞান (মন বা চেতনা) তা অপেক্ষাও ণভঙ্গুর। এই চিত্ত মন বা বিজ্ঞান দিবারাত্রই উৎপন্ন হচ্ছে ও বিনষ্ট হচ্ছে। এই হলো বুদ্ধের মত। বুদ্ধের দর্শনে অনিত্যতা এমন এক নিয়ম যার কোনো প্রতিবাদ (antithesis) নেই।
‘বারবার নতুন করে উৎপন্ন হচ্ছে ও বিনষ্ট হচ্ছে’- এই মতানুসারে বুদ্ধের অনিত্যবাদও কোন এক মৌলিক উপাদানের বাহ্যিক পরিবর্তন মাত্র নয়, একের বিনাশ এবং অন্য আর একের সম্পূর্ণ নতুন উৎপাদন। বুদ্ধ কার্য-কারণের নিরন্তর বা অবিচ্ছিন্ন পরম্পরাকে মানতেন না।
.
প্রতীত্য-সমুৎপাদ অনুসারে প্রত্যেক বস্তু কারণানুসারী হয়ে থাকে। কারণের নাশে বস্তুর নাশ হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক বস্তু অনিত্য। প্রতীত্য-সমুৎপাদ সিদ্ধান্ত অনিত্যবাদকেই প্রতিফলিত করে। অনিত্যবাদ হলো নিত্যবাদ (eternalism) ও উচ্ছেদবাদের (nihilism) মধ্য মার্গ। নিত্যবাদ অনুসারে ‘প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে সৎ (being)’, এবং উচ্ছেদবাদ অনুসারে ‘প্রত্যেক বস্তু হচ্ছে অসৎ (no-being)’। উভয় মতই একান্তিক বা চূড়ান্ত। কিন্তু বুদ্ধ এই দুই মতকে পরিহার করে মধ্যম মার্গের উপদেশ দিয়েছেন। মধ্যম মার্গের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- জীবন পরিবর্তনশীল (becoming)। জীবনকে পরিবর্তনশীল বলে বুদ্ধ সৎ ও অসতের সমন্বয় করেছেন। বুদ্ধের এই অনিত্যবাদ সিদ্ধান্তকে তাঁর অনুযায়িরা ক্ষণিকবাদে পরিবর্তিত করেন। ক্ষণিকবাদ হচ্ছে অনিত্যবাদের বিকশিত রূপ। এরই অন্য নাম হচ্ছে ক্ষণভঙ্গবাদ।
.
ক্ষণিকবাদ অনুসারে বিশ্বের প্রত্যেক বস্তু কেবল অনিত্য নয়, ক্ষণভঙ্গুরও। নদীর এক-একটি বুদ্বুদ যেমন এক-একটি ক্ষণের জন্য আসে, দ্বিতীয় ক্ষণে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি জগতের সমস্ত বস্তু ক্ষণমাত্রের জন্য নিজের অস্তিত্বকে বজায় রাখে। বৌদ্ধমতে ক্ষণিক অর্থ ক্ষণমাত্র স্থায়ী। প্রথম ক্ষণে যে বস্তুটি উৎপন্ন হয়, দ্বিতীয় ক্ষণে তার বিনাশ হয়। এবং এই দ্বিতীয় ক্ষণেই তার সদৃশ বস্তুর আবার উৎপত্তি হয়। প্রতিক্ষণেই এভাবে ভাববস্তুর জন্ম মৃত্যু প্রবাহ চলতে থাকে। বৌদ্ধমতে তাই সমস্ত ভাববস্তুকে ক্ষণিকরূপে ভাবতে হবে। ধম্মপদে বলা হয়েছে- ‘যাকে নিত্য ও স্থায়ী বলে মনে হয় তারও নাশ হয়। যাকে মহান্ মানা হয় তারও পতন হয়।’ কিংবা-
‘সব্বে সঙ্খারা অনিচ্চাতি যদা পঞ্ঞায় পস্সতি,
অথ নিব্বিন্দতি দুক্খে এস মগ্গো বিসুদ্ধিয়া।’- (মার্গবর্গ-ধম্মপদ-২৭৭)
অর্থাৎ : সকল সংস্কার (সৃষ্ট পদার্থ) অনিত্য। এ সত্য যখন লোকে প্রজ্ঞালোকে অবলোকন করবেন তখন তিনি সমস্ত দুঃখ থেকে নির্বেদপ্রাপ্ত হন। এটাই একমাত্র বিশুদ্ধিলাভের উপায়।
.
ভঙ্গ অর্থ নাশ। অতএব, যে পদার্থ এক ক্ষণ থেকে বিনষ্ট হয় তাই ক্ষণভঙ্গ বা ক্ষণিক।
এই ক্ষণভঙ্গবাদের মাধ্যমে অন্যান্য দার্শনিক পরিমণ্ডলের বিকল্পিত বাদগুলিকে যেমন সাংখ্যের প্রধানবাদ, নৈয়ায়িকদের ঈশ্বরবাদ, চার্বাকদের ভূতচতুষ্টয়বাদ, জৈমিনীয়দের বৈদিক শব্দরাশির নিত্যত্ববাদ এগুলোকে প্রতিষেধ করা হয়েছে। আবার এর মাধ্যমে বহুসত্তাবাদী বৌদ্ধদর্শনের জন্য অদ্বয়বাদের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে।
.
ক্ষণভঙ্গবাদের দার্শনিক বিশ্লেষণ:
কোন বস্তুর অস্তিত্বের তাৎপর্য বা অর্থ হচ্ছে তার ক্ষণিকতা। একেই ক্ষণভঙ্গবাদ বলা হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে সত্তা ও ক্ষণিকতায় বিরোধ প্রতীত হয়। কিন্তু সেই বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্বের দ্বারা যখন বস্তুসত্তার নিশ্চয় হয় তখন সেই ভ্রম দূর হয়। বৌদ্ধশাস্ত্রে বলা হয়-
ভঙ্গ অর্থ নাশ। অতএব, যে পদার্থ এক ক্ষণ থেকে বিনষ্ট হয় তাই ক্ষণভঙ্গ বা ক্ষণিক।
এই ক্ষণভঙ্গবাদের মাধ্যমে অন্যান্য দার্শনিক পরিমণ্ডলের বিকল্পিত বাদগুলিকে যেমন সাংখ্যের প্রধানবাদ, নৈয়ায়িকদের ঈশ্বরবাদ, চার্বাকদের ভূতচতুষ্টয়বাদ, জৈমিনীয়দের বৈদিক শব্দরাশির নিত্যত্ববাদ এগুলোকে প্রতিষেধ করা হয়েছে। আবার এর মাধ্যমে বহুসত্তাবাদী বৌদ্ধদর্শনের জন্য অদ্বয়বাদের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে।
.
ক্ষণভঙ্গবাদের দার্শনিক বিশ্লেষণ:
কোন বস্তুর অস্তিত্বের তাৎপর্য বা অর্থ হচ্ছে তার ক্ষণিকতা। একেই ক্ষণভঙ্গবাদ বলা হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে সত্তা ও ক্ষণিকতায় বিরোধ প্রতীত হয়। কিন্তু সেই বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্বের দ্বারা যখন বস্তুসত্তার নিশ্চয় হয় তখন সেই ভ্রম দূর হয়। বৌদ্ধশাস্ত্রে বলা হয়-
‘অর্থক্রিয়াকারিত্বংলক্ষণং সৎ’।
অর্থাৎ : সৎ-এর লক্ষণ হলো অর্থক্রিয়াকারিত্ব।
.
অর্থক্রিয়াকারিত্ব মানে কার্যকে উৎপাদন করার ক্ষমতা। অর্থাৎ অর্থক্রিয়াকারিত্বের লক্ষণ হচ্ছে সৎ এবং কোন বস্তুর কার্যকারিতা হচ্ছে সত্তা। যেমন বর্তমান ক্ষণের কোন ঘট জলাহরণরূপ অর্থক্রিয়া সম্পাদন করে, অতএব ঘট হচ্ছে সৎ। আবার আকাশকুসুম প্রভৃতি কাল্পনিক বা অসতের কোন কার্য করার যোগ্যতা থাকে না। এতে সিদ্ধ হয় যে, যদি কোন বস্তু কার্য উৎপন্ন করতে পারে তবে তার সত্তা থাকে এবং কার্য উৎপাদন করতে না পারলে তার সত্তা থাকে না।
.
এক বস্তু হতে এক সময়ে একটি কার্যই সম্ভব। যদি এক সময়ে একটি বস্তু হতে একটি কার্য নিষ্পন্ন হয় এবং অন্য সময়ে অন্য কার্য হয় তাতে সিদ্ধ হয় যে, প্রথম বস্তুটির অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র, কেননা দ্বিতীয় বস্তুটি উৎপন্ন হবার সাথে সাথে প্রথম বস্তুর অস্তিত্ব থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বীজ হচ্ছে ক্ষণিক, কেননা তা নিত্য হলে তার কার্য চারাগাছ সর্বদা উৎপন্ন হতে থাকতো। কিন্তু তা হয় না। চারাগাছটি প্রত্যেক ক্ষণে বিকাশ প্রাপ্ত হয়। বিকাশের প্রত্যেক ক্ষণ অন্যক্ষণ হতে ভিন্ন হয় এবং চারাগাছটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল। বীজের মতো সংসারের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র এবং পরিবর্তনশীল। এটাই ক্ষণিকবাদ।
.
এ মতাবাদ অনুযায়ী, যে কোন বস্তু স্থায়ী ও সজাতীয় বলে প্রতীত হয়, পরমার্থগতভাবে তা হচ্ছে ক্ষণিক ও মিশ্রিত রূপ। মানুষ যে আত্মাকে নিত্য পুরুষ বলে মনে করে তা বস্তুতঃ রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার নামক পাঁচটি উপাদান দ্বারা মিশ্রিত রূপ। এই পাঁচটি উপাদান ক্ষণে ক্ষণে নবরূপ প্রাপ্ত হয়। তাদের কোন নিত্য আশ্রয় নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, একটি শিশু সতেরো বছরে একজন অভিন্নজাতীয় কোন যুবা হতে পারে, কিন্তু সে পূর্ব পূর্ব ক্ষণের পুরুষ হতে ভিন্ন। প্রত্যেক ক্ষণে পূর্ব পুরুষ বিনষ্ট হয় এবং অন্য নতুন পুরুষ জন্মায়। সেখানে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন কার্যকারণের পরম্পরা অসুসৃত হয়। কেননা প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী পদার্থ হচ্ছে ভিন্ন ক্ষণিকসমূহের বিগ্রহ। জগৎ হচ্ছে নিরন্তর প্রবাহস্বরূপ। তাকে নিত্য বলে ভাবা হচ্ছে মূলা অবিদ্যাপ্রসূত এবং তা নিরন্তর দুঃখ উৎপন্ন করে।
.
ক্ষণভঙ্গবাদ প্রমাণে দার্শনিক মতান্তর:
ক্ষণিকবাদের ব্যাখ্যা করার সময় এরকম দার্শনিক প্রশ্ন উত্থিত হয় যে, ক্ষণিকবাদ সিদ্ধান্তটি প্রমাণসঙ্গত কিনা ?
.
বলা হয়ে থাকে, ক্ষণিকবাদের সিদ্ধান্ত কার্যকারণ সম্বন্ধের ব্যাখ্যায় অসমর্থ। নৈয়ায়িকদের মতে, তৃতীয় ক্ষণে যার বিনাশ হয় সে ক্ষণিক। অর্থাৎ, নৈয়ায়িক মতে জ্ঞান প্রভৃতি ক্ষণিক পদার্থ মাত্র দু-ক্ষণ থাকে। ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী যদি কারণ ক্ষণমাত্রই থাকে তবে তা থেকে কার্যের উৎপত্তি হতে পারে না, কেননা কার্যের উৎপত্তির জন্য কারণের সত্তা এক ক্ষণের অধিক হওয়া দরকার। কারণ ক্ষণভঙ্গুর হলে কার্যের উৎপত্তি শূন্য হতে আপাদিত (উৎপন্ন) হবে এবং তা বিরুদ্ধ।
আবার প্রত্যক্ষকেও ক্ষণিকবাদের প্রমাণ বলা যায় না। কারণ বাহ্য অথবা আন্তর কোন প্রত্যক্ষেই নিরূপণ করা সম্ভব নয় যে প্রত্যেক পদার্থই এক ক্ষণ থেকে নাশ পায়। বরং কোন বিষয়ের সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হয় তখন আমাদের জ্ঞান হয়, যে কোন পদার্থই কিছুক্ষণ স্থায়ী। সুতরাং ক্ষণভঙ্গবাদ প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ।
.
এজন্যেই বৌদ্ধ দার্শনিকরা অনুমানের দ্বারা ক্ষণিকবাদ প্রমাণ করেন। এ প্রেক্ষিতে বৌদ্ধ দার্শনিক রত্নকীর্তি বীজের উদাহরণ টেনে অনুমান প্রমাণ করেন। তাঁর মতে অনুমানটি এরূপ-
অর্থক্রিয়াকারিত্ব মানে কার্যকে উৎপাদন করার ক্ষমতা। অর্থাৎ অর্থক্রিয়াকারিত্বের লক্ষণ হচ্ছে সৎ এবং কোন বস্তুর কার্যকারিতা হচ্ছে সত্তা। যেমন বর্তমান ক্ষণের কোন ঘট জলাহরণরূপ অর্থক্রিয়া সম্পাদন করে, অতএব ঘট হচ্ছে সৎ। আবার আকাশকুসুম প্রভৃতি কাল্পনিক বা অসতের কোন কার্য করার যোগ্যতা থাকে না। এতে সিদ্ধ হয় যে, যদি কোন বস্তু কার্য উৎপন্ন করতে পারে তবে তার সত্তা থাকে এবং কার্য উৎপাদন করতে না পারলে তার সত্তা থাকে না।
.
এক বস্তু হতে এক সময়ে একটি কার্যই সম্ভব। যদি এক সময়ে একটি বস্তু হতে একটি কার্য নিষ্পন্ন হয় এবং অন্য সময়ে অন্য কার্য হয় তাতে সিদ্ধ হয় যে, প্রথম বস্তুটির অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র, কেননা দ্বিতীয় বস্তুটি উৎপন্ন হবার সাথে সাথে প্রথম বস্তুর অস্তিত্ব থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বীজ হচ্ছে ক্ষণিক, কেননা তা নিত্য হলে তার কার্য চারাগাছ সর্বদা উৎপন্ন হতে থাকতো। কিন্তু তা হয় না। চারাগাছটি প্রত্যেক ক্ষণে বিকাশ প্রাপ্ত হয়। বিকাশের প্রত্যেক ক্ষণ অন্যক্ষণ হতে ভিন্ন হয় এবং চারাগাছটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল। বীজের মতো সংসারের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র এবং পরিবর্তনশীল। এটাই ক্ষণিকবাদ।
.
এ মতাবাদ অনুযায়ী, যে কোন বস্তু স্থায়ী ও সজাতীয় বলে প্রতীত হয়, পরমার্থগতভাবে তা হচ্ছে ক্ষণিক ও মিশ্রিত রূপ। মানুষ যে আত্মাকে নিত্য পুরুষ বলে মনে করে তা বস্তুতঃ রূপ, বিজ্ঞান, বেদনা, সংজ্ঞা ও সংস্কার নামক পাঁচটি উপাদান দ্বারা মিশ্রিত রূপ। এই পাঁচটি উপাদান ক্ষণে ক্ষণে নবরূপ প্রাপ্ত হয়। তাদের কোন নিত্য আশ্রয় নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়, একটি শিশু সতেরো বছরে একজন অভিন্নজাতীয় কোন যুবা হতে পারে, কিন্তু সে পূর্ব পূর্ব ক্ষণের পুরুষ হতে ভিন্ন। প্রত্যেক ক্ষণে পূর্ব পুরুষ বিনষ্ট হয় এবং অন্য নতুন পুরুষ জন্মায়। সেখানে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন কার্যকারণের পরম্পরা অসুসৃত হয়। কেননা প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী পদার্থ হচ্ছে ভিন্ন ক্ষণিকসমূহের বিগ্রহ। জগৎ হচ্ছে নিরন্তর প্রবাহস্বরূপ। তাকে নিত্য বলে ভাবা হচ্ছে মূলা অবিদ্যাপ্রসূত এবং তা নিরন্তর দুঃখ উৎপন্ন করে।
.
ক্ষণভঙ্গবাদ প্রমাণে দার্শনিক মতান্তর:
ক্ষণিকবাদের ব্যাখ্যা করার সময় এরকম দার্শনিক প্রশ্ন উত্থিত হয় যে, ক্ষণিকবাদ সিদ্ধান্তটি প্রমাণসঙ্গত কিনা ?
.
বলা হয়ে থাকে, ক্ষণিকবাদের সিদ্ধান্ত কার্যকারণ সম্বন্ধের ব্যাখ্যায় অসমর্থ। নৈয়ায়িকদের মতে, তৃতীয় ক্ষণে যার বিনাশ হয় সে ক্ষণিক। অর্থাৎ, নৈয়ায়িক মতে জ্ঞান প্রভৃতি ক্ষণিক পদার্থ মাত্র দু-ক্ষণ থাকে। ক্ষণিকবাদ অনুযায়ী যদি কারণ ক্ষণমাত্রই থাকে তবে তা থেকে কার্যের উৎপত্তি হতে পারে না, কেননা কার্যের উৎপত্তির জন্য কারণের সত্তা এক ক্ষণের অধিক হওয়া দরকার। কারণ ক্ষণভঙ্গুর হলে কার্যের উৎপত্তি শূন্য হতে আপাদিত (উৎপন্ন) হবে এবং তা বিরুদ্ধ।
আবার প্রত্যক্ষকেও ক্ষণিকবাদের প্রমাণ বলা যায় না। কারণ বাহ্য অথবা আন্তর কোন প্রত্যক্ষেই নিরূপণ করা সম্ভব নয় যে প্রত্যেক পদার্থই এক ক্ষণ থেকে নাশ পায়। বরং কোন বিষয়ের সঙ্গে যখন ইন্দ্রিয়ের সম্বন্ধ হয় তখন আমাদের জ্ঞান হয়, যে কোন পদার্থই কিছুক্ষণ স্থায়ী। সুতরাং ক্ষণভঙ্গবাদ প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ।
.
এজন্যেই বৌদ্ধ দার্শনিকরা অনুমানের দ্বারা ক্ষণিকবাদ প্রমাণ করেন। এ প্রেক্ষিতে বৌদ্ধ দার্শনিক রত্নকীর্তি বীজের উদাহরণ টেনে অনুমান প্রমাণ করেন। তাঁর মতে অনুমানটি এরূপ-
‘বীজদিকং সর্বং ক্ষণিকং সত্তাৎ’।অর্থাৎ : বীজ প্রভৃতি সকল ভাববস্তুই ক্ষণিক যেহেতু তারা সৎ।
এ অনুমানে বীজ প্রভৃতি সকল ভাব বস্তু হলো পক্ষ। ক্ষণিকত্ব হলো সাধ্য। সত্ত্ব হলো হেতু। এক্ষেত্রে ব্যাপ্তি হবে এরকম- যা সৎ তাই ক্ষণিক যেমন জলধর পটল। এই ভাববস্তুগুলি সেরূপ সৎ। অতএব এগুলিও ক্ষণিক।
.
এক্ষেত্রে যাঁরা পদার্থ মাত্রকেই সৎ বলে স্বীকার করেন না, তাঁরা বলতে পারেন যে সত্তা হেতুটি স্বরূপাসিদ্ধ দোষে দুষ্ট। কারণ এক্ষেত্রে পক্ষে হেতুটি নেই। পক্ষে ব্যাপ্য হেতুটি না থাকলে স্বরূপাসিদ্ধি দোষ হয়।
(স্বরূপাসিদ্ধ মানে স্বরূপ+অসিদ্ধ। স্বরূপ মানে নিজের রূপ বা অস্তিত্ব বা সত্তা, অসিদ্ধ মানে সিদ্ধ হয় নি, অর্থাৎ প্রমাণিত নয়। পক্ষ, সাধ্য, হেতু, ব্যাপ্তি, যুক্তিশাস্ত্রের এই বিষয়গুলো মূলত ন্যায় দর্শনের আলোচ্য।)
.
এই পূর্বপক্ষের যুক্তি খণ্ডন ও ক্ষণভঙ্গবাদ বা ক্ষণিকবাদের সমর্থনে বৌদ্ধমতে ‘অর্থক্রিয়াকারিত্ব’ নামক তর্ক উপপাদন করা হয়। বলা হয়, সত্তার লক্ষণ হলো অর্থক্রিয়াকারিত্ব। অর্থক্রিয়াকারিত্ব অর্থ কার্যকে উৎপন্ন করার সামর্থ। যেমন আগুনের প্রয়োজন বা কার্য হলো দাহ। সেই দাহজনন সামর্থ্যই আগুনের অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা সত্ত্ব। বৌদ্ধমতে স্থির পদার্থ অর্থক্রিয়াকারী হয় না, ক্ষণিক পদার্থই অর্থক্রিয়াকারী হয়। তাই ক্ষণিকত্বের ব্যাপ্য অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা সত্তা। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হলো জলধর পটল। জলধর (মেঘ)-সমূহে অর্থক্রিয়াকারিত্ব অর্থাৎ বর্ষণজনন সামর্থ্য বা সত্ত প্রত্যক্ষ, ক্ষণিকত্বও প্রত্যক্ষ। প্রতিক্ষণেই মেঘ ভিন্ন ভিন্ন হয়, একরূপ থাকে না। সুতরাং যেখানে সত্ত্ব, সেখানে ক্ষণিকত্ব- এরূপ অন্বয় ব্যাপ্তি জলধর দৃষ্টান্তে গৃহীত হয়েছে।
দার্শনিক জ্ঞানশ্রীমিত্রের ক্ষণভঙ্গাধ্যায়ে উক্ত উপরের এই যুক্তির উদ্ধৃতিটি সায়ণ মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে উদ্ধৃত করেছেন-
.
এক্ষেত্রে যাঁরা পদার্থ মাত্রকেই সৎ বলে স্বীকার করেন না, তাঁরা বলতে পারেন যে সত্তা হেতুটি স্বরূপাসিদ্ধ দোষে দুষ্ট। কারণ এক্ষেত্রে পক্ষে হেতুটি নেই। পক্ষে ব্যাপ্য হেতুটি না থাকলে স্বরূপাসিদ্ধি দোষ হয়।
(স্বরূপাসিদ্ধ মানে স্বরূপ+অসিদ্ধ। স্বরূপ মানে নিজের রূপ বা অস্তিত্ব বা সত্তা, অসিদ্ধ মানে সিদ্ধ হয় নি, অর্থাৎ প্রমাণিত নয়। পক্ষ, সাধ্য, হেতু, ব্যাপ্তি, যুক্তিশাস্ত্রের এই বিষয়গুলো মূলত ন্যায় দর্শনের আলোচ্য।)
.
এই পূর্বপক্ষের যুক্তি খণ্ডন ও ক্ষণভঙ্গবাদ বা ক্ষণিকবাদের সমর্থনে বৌদ্ধমতে ‘অর্থক্রিয়াকারিত্ব’ নামক তর্ক উপপাদন করা হয়। বলা হয়, সত্তার লক্ষণ হলো অর্থক্রিয়াকারিত্ব। অর্থক্রিয়াকারিত্ব অর্থ কার্যকে উৎপন্ন করার সামর্থ। যেমন আগুনের প্রয়োজন বা কার্য হলো দাহ। সেই দাহজনন সামর্থ্যই আগুনের অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা সত্ত্ব। বৌদ্ধমতে স্থির পদার্থ অর্থক্রিয়াকারী হয় না, ক্ষণিক পদার্থই অর্থক্রিয়াকারী হয়। তাই ক্ষণিকত্বের ব্যাপ্য অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা সত্তা। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হলো জলধর পটল। জলধর (মেঘ)-সমূহে অর্থক্রিয়াকারিত্ব অর্থাৎ বর্ষণজনন সামর্থ্য বা সত্ত প্রত্যক্ষ, ক্ষণিকত্বও প্রত্যক্ষ। প্রতিক্ষণেই মেঘ ভিন্ন ভিন্ন হয়, একরূপ থাকে না। সুতরাং যেখানে সত্ত্ব, সেখানে ক্ষণিকত্ব- এরূপ অন্বয় ব্যাপ্তি জলধর দৃষ্টান্তে গৃহীত হয়েছে।
দার্শনিক জ্ঞানশ্রীমিত্রের ক্ষণভঙ্গাধ্যায়ে উক্ত উপরের এই যুক্তির উদ্ধৃতিটি সায়ণ মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে উদ্ধৃত করেছেন-
‘যৎ যৎ তৎক্ষণিকং যথা জলধরঃ সন্তশ্চ ভাবা ইমে
সত্তা শক্তিরিহার্থকর্মণি মিতেঃ সিদ্ধেষু সিদ্ধা ন সা।
নাপ্যেকৈববিধাহন্যদাপি পরকৃদ্ নৈব ক্রিয়া বা ভবেৎ
দ্বেধাপি ক্ষণভঙ্গ-সঙ্গতিরতঃ সাধ্যে চ বিশ্রাম্যতি।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : জ্ঞানশ্রীও বলেছেন- যা সৎ (অর্থক্রিয়াকারী), তা ক্ষণিক যেমন জলধর। এই বীজাদি পদার্থও সৎ-অর্থক্রিয়াকারী। অর্থক্রিয়াতে যে শক্তি, তাই সত্তা- এটি এই প্রমাণ থেকে সিদ্ধ হয়। সিদ্ধ বস্তুতে সেই সত্ত্ব বা অর্থক্রিয়াকারিত্ব সিদ্ধ হয় না। ক্রম ও অক্রম এই দুই প্রকারের একটিও স্থির বস্তুতে সিদ্ধ হয় না। স্থিরের অর্থক্রিয়াতে ক্রম ও অক্রম ছাড়া অন্য প্রকারও নেই। দুই প্রকারে পরকৃত উপকারের দ্বারাও স্থিরের অর্থক্রিয়া হয় না। অতএব ক্ষণভঙ্গ বা ক্ষণিকত্বের ব্যাপ্তি সম্বন্ধ সত্ত্ব হেতুতে থাকায় তা ক্ষণিকত্বে বিশ্রান্ত হয় অর্থাৎ ক্ষণিকত্ব সাধ্যের সাধক হয়।
.
কিন্তু যেখানে ক্ষণিকত্ব নেই সেখানে সত্ত্বও নেই এরূপ ব্যতিরেক ব্যাপ্তি গৃহীত না হলে হেতুতে ব্যভিচার সন্দেহ হবে। কেননা অনুমান-প্রমাণে হেতুর ব্যাপ্তি-সিদ্ধতায় অন্বয়ব্যাপ্তি ও ব্যতিরেকব্যাপ্তি উভয়টি সিদ্ধ না হলে প্রমাণ সর্বতো সিদ্ধ হয় না। কিন্তু বৌদ্ধমতে অক্ষণিক স্থির পদার্থ এই ব্যতিরেক নিশ্চয়ের স্থান নয় অর্থাৎ অক্ষণিক স্থির পদার্থ স্বীকৃত হয় না। কারণ সেক্ষেত্রে ক্ষণিকত্বের অভাব থাকলেও সত্ত্বের অভাব নেই, ফলে সেখানে সত্ত্ব আছে মানতে হবে। সুতরাং ক্ষণিকত্ব সত্ত্বের ব্যাপক- এটা বৌদ্ধরা বলতে পারবেন না।
.
এ কারণে বৌদ্ধরা ক্রমাক্রমকে সত্ত্বের ব্যাপক বলেছেন। ক্রমাক্রম অর্থ হলো ক্রম এবং অক্রম বা যুগপৎ। কোন বস্তু ক্রমে ক্রমে অথবা যুগপৎ কার্যকে উৎপন্ন করবে। এছাড়া তৃতীয় কোন বিকল্প উপায়ে অর্থক্রিয়াকারিত্ব থাকতে পারে না। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে দ্রব্য ক্ষণিক নয় তাতে অর্থক্রিয়াকারিত্ব ক্রমে বা অক্রমে থাকতে পারে না। এভাবে অর্থক্রিয়াকারিত্বের দ্বারা বৌদ্ধগণ অক্ষণিক বা তথাকথিত নিত্য দ্রব্যকে ‘অসৎ’ বলে স্বীকার করেন। এ প্রেক্ষিতে শান্তরক্ষিত বলেছেন-
কিন্তু যেখানে ক্ষণিকত্ব নেই সেখানে সত্ত্বও নেই এরূপ ব্যতিরেক ব্যাপ্তি গৃহীত না হলে হেতুতে ব্যভিচার সন্দেহ হবে। কেননা অনুমান-প্রমাণে হেতুর ব্যাপ্তি-সিদ্ধতায় অন্বয়ব্যাপ্তি ও ব্যতিরেকব্যাপ্তি উভয়টি সিদ্ধ না হলে প্রমাণ সর্বতো সিদ্ধ হয় না। কিন্তু বৌদ্ধমতে অক্ষণিক স্থির পদার্থ এই ব্যতিরেক নিশ্চয়ের স্থান নয় অর্থাৎ অক্ষণিক স্থির পদার্থ স্বীকৃত হয় না। কারণ সেক্ষেত্রে ক্ষণিকত্বের অভাব থাকলেও সত্ত্বের অভাব নেই, ফলে সেখানে সত্ত্ব আছে মানতে হবে। সুতরাং ক্ষণিকত্ব সত্ত্বের ব্যাপক- এটা বৌদ্ধরা বলতে পারবেন না।
.
এ কারণে বৌদ্ধরা ক্রমাক্রমকে সত্ত্বের ব্যাপক বলেছেন। ক্রমাক্রম অর্থ হলো ক্রম এবং অক্রম বা যুগপৎ। কোন বস্তু ক্রমে ক্রমে অথবা যুগপৎ কার্যকে উৎপন্ন করবে। এছাড়া তৃতীয় কোন বিকল্প উপায়ে অর্থক্রিয়াকারিত্ব থাকতে পারে না। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে দ্রব্য ক্ষণিক নয় তাতে অর্থক্রিয়াকারিত্ব ক্রমে বা অক্রমে থাকতে পারে না। এভাবে অর্থক্রিয়াকারিত্বের দ্বারা বৌদ্ধগণ অক্ষণিক বা তথাকথিত নিত্য দ্রব্যকে ‘অসৎ’ বলে স্বীকার করেন। এ প্রেক্ষিতে শান্তরক্ষিত বলেছেন-
‘যে তু ব্যোমাদয়ো ভাবা অকৃতত্বেন সংমতা।
বস্তুবৃত্ত্যা ন সন্ত্যেব তে চ শক্তিবিয়োগতঃ।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৮৫)
‘ক্ষণিকাক্ষণিকত্বাদিবিকল্পস্তেধনাস্পদঃ।
তদা বস্তের যেন স্যাৎ ক্ষণিকং যদিবান্যথা।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৮৬)
অর্থাৎ : ব্যোমাদি যে-সকল পদার্থ অকৃতক বলে পরিগণিত হয় সেগুলোর বস্তুরূপে কোন অস্তিত্বই নেই, কারণ সে-সকল পদার্থ ‘শক্তি’-বিহীন (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৮৫)। তাদের বিপরীত ধর্মের বা ক্ষণিকত্ব-অক্ষণিকত্ব ও অর্থক্রিয়াসামর্থের উপরেই বস্তুত্ব নির্ভর করে (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৮৬)।
.
আকাশের ন্যায় অবস্তু সম্বন্ধে ক্ষণিকত্ব ও অক্ষণিকত্বের প্রশ্ন কেন উঠতে পারে না এ প্রসঙ্গে শান্তরক্ষিত বলেছেন-
আকাশের ন্যায় অবস্তু সম্বন্ধে ক্ষণিকত্ব ও অক্ষণিকত্বের প্রশ্ন কেন উঠতে পারে না এ প্রসঙ্গে শান্তরক্ষিত বলেছেন-
‘ক্ষণাবস্থিতরূপং হি বস্তু ক্ষণিকমুচ্যতে।
স্থিররূপসমাক্রান্তং বস্তেবাক্ষণিকং পুনঃ।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৮৭)
‘যদি তু ব্যোমকালাদ্যাঃ সন্তঃ স্যুস্তে তথা সতি।
নাতিক্রামন্তি তেহপ্যেনং ক্ষণভঙ্গং কৃতা ইব।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৯১)
‘তথাহি সন্তো যে নাম তে সর্বে ক্ষণভঙ্গিনঃ।
তদ্যথাসংস্কৃতা ভাবাস্তথাসিদ্ধা অনন্তরম্ ।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৯২)
অর্থাৎ :
বস্তু ক্ষণকালস্থায়ী হলে ক্ষণিক এবং স্থিররূপ হলে অক্ষণিক বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু যা বস্তুই নয় তার সম্বন্ধে এ-প্রশ্ন উঠতে পারে না (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৮৭)। ব্যোম, কাল প্রভৃতি যদি সৎ পদার্থ হয় তাহলে তারাও কৃতক (=উৎপন্ন) পদার্থের মতো ক্ষণভঙ্গী হতে বাধ্য (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৯১)। কারণ সংস্কৃত ভাবাবলির (উৎপন্ন ভাববস্তুর) ন্যায় যাই অস্তিত্বশীল তাই ক্ষণভঙ্গী (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৯২)।
আবার যেহেতু কোন অক্ষণিক স্থায়ী বস্তু ক্রমে বা অক্রমে থাকতে পারে না, তাই যদি কোন বস্তু ক্রমে বা ধারাবাহিকভাবে থাকে তবে তা স্থায়ী হতে পারে না। কেননা ক্রমে থাকলেই প্রতি মুহূর্তে অবস্থার ভিন্নতা আসবে। ফলে তা শাশ্বত না হলে পরিবর্তনশীল হবে। আবার কোন বস্তু অক্রমেও থাকতে পারে না। সতের লক্ষণ অর্থক্রিয়াকারিত্ব। সৎ বস্তু যদি অর্থক্রিয়াকারি হয় (কার্য উৎপন্ন করে), তবে কার্যের উৎপত্তিতে কারণাবস্থার বিনাশ ঘটবে। বিনাশ ঘটলে বস্তু থাকে না, স্থায়ী হয় না। অতএব অর্থক্রিয়াকারিত্ব কেবল ক্ষণিক বস্তুর পক্ষে সম্ভব। শান্তরক্ষিতের কারিকাতেও বলা হয়েছে-
‘নিঃশেষাণি চ কার্যাণি সকৃৎ কৃত্বা নিবর্ততে।
সামর্থ্যাত্মা স চেদর্থঃ সিদ্ধাস্য ক্ষণভঙ্গিতা।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৪১৪)
অর্থাৎ : সামর্থবিশিষ্ট পদার্থ যদি তার সকল কার্য ক্রমানুযায়ী না করে একবারেই শেষ করে নিবৃত্ত হয় তাহলেও পদার্থের ক্ষণিকত্বই সিদ্ধ হয়ে যায়।
.
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ঈশ্বর ও ঘটপটাদি স্থায়ী বস্তুতে কি অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা কার্যোৎপাদনরূপ ক্রিয়া দেখা যায় না ?
.
উত্তরে দুটি বিকল্প উপস্থাপিত করা হয়। ঐ স্থায়ী বস্তুটিতে বর্তমান ভবিষ্যৎকালীন ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য থাকে ? না কি ঐ সামর্থ্য থাকে না ? এক্ষেত্রে সায়ণ মাধবাচার্য্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে দুটি বিকল্প উত্থাপন করে বলেছেন-
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ঈশ্বর ও ঘটপটাদি স্থায়ী বস্তুতে কি অর্থক্রিয়াকারিত্ব বা কার্যোৎপাদনরূপ ক্রিয়া দেখা যায় না ?
.
উত্তরে দুটি বিকল্প উপস্থাপিত করা হয়। ঐ স্থায়ী বস্তুটিতে বর্তমান ভবিষ্যৎকালীন ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য থাকে ? না কি ঐ সামর্থ্য থাকে না ? এক্ষেত্রে সায়ণ মাধবাচার্য্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র বৌদ্ধপ্রস্থানে দুটি বিকল্প উত্থাপন করে বলেছেন-
‘যদ্ যদা যদ্ জননাসমর্থম্, তৎ তদা-তন্ন করোতি। যথা শিলাশকলমঙ্কুরম্ । অসমর্থশ্চায়ং বর্ত্তমানার্থক্রিয়াকরণ-কালে অতীতানাগতয়োরর্থক্রিয়য়োরিতি প্রসঙ্গঃ।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : যে যখন যা করতে অসমর্থ, সে তখন তা করে না। যেমন শিলাখণ্ড অঙ্কুর উৎপাদন করে না। এই স্থির ভাবপদার্থও বর্তমান অর্থক্রিয়াকালে অতীত ও অনাগত অর্থক্রিয়া করে না- এটি প্রসঙ্গানুমান।
.
‘যদ্ যদা যৎ করোতি, তৎ তদা তত্র সমর্থম্; যথা সামগ্রী স্বকার্য্যে। করোতি চায়মতীতানাগতকালে অৎকালবর্ত্তিনৌ অর্থক্রিয়ে ভাব ইতি প্রসঙ্গব্যত্যয়ো বিপর্য্যয়ঃ।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-বৌদ্ধদর্শনম্)
অর্থাৎ : যে যখন যা করে, সে তখন তাতে সমর্থ। যেমন সামগ্রী স্বকার্যে সমর্থ। এই ভাববস্তু অতীত ও অনাগতকালে অতীকাল বর্তিনী ও ভাবিকাল বর্তিনী অর্থক্রিয়া করে। এটি প্রসঙ্গবিপরীত বিপর্যয়।
.
প্রথম বিকল্পে বর্তমানকালীন ক্রিয়া সম্পাদনকালে যদি স্থায়ী বস্তুর অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য থাকে তবে ঐ বস্তু বর্তমান কালেই তার অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদন হতে বিরত থাকতে পারে না। কেননা যে বস্তুর যে ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য বা ক্ষমতা থাকে তার কালক্ষেপণ করার কোন প্রয়োজন নেই। কালক্ষেপণ না করেই সে কার্যটি সম্পাদন করবে। তা-ই বৌদ্ধদার্শনিক রত্নকীর্তি ক্ষণভঙ্গসিদ্ধি নিবন্ধে বলেছেন-
প্রথম বিকল্পে বর্তমানকালীন ক্রিয়া সম্পাদনকালে যদি স্থায়ী বস্তুর অতীত ও ভবিষ্যতের ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য থাকে তবে ঐ বস্তু বর্তমান কালেই তার অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদন হতে বিরত থাকতে পারে না। কেননা যে বস্তুর যে ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য বা ক্ষমতা থাকে তার কালক্ষেপণ করার কোন প্রয়োজন নেই। কালক্ষেপণ না করেই সে কার্যটি সম্পাদন করবে। তা-ই বৌদ্ধদার্শনিক রত্নকীর্তি ক্ষণভঙ্গসিদ্ধি নিবন্ধে বলেছেন-
‘বর্ত্তমানক্ষণভাবিকার্য্যবৎ অতীতানাগতক্ষণভাব্যপি কার্য্যং তদৈব কুর্য্যাৎ। তত্রাপি শক্তত্বাৎ শক্তস্য চ ক্ষেপাযোগাৎ।’ (ক্ষণভঙ্গসিদ্ধি)
অর্থাৎ : স্থায়ীভাব বর্তমান-ক্ষণবর্তী কার্যের ন্যায় অতীত ও ভবিষ্যৎ-ক্ষণবর্তী কার্যও সেই বর্তমানক্ষণেই করুক, কারণ সে সেই কার্যেও সমর্থ। সমর্থের বিলম্বে কার্যকরণের কোন যুক্তি নেই, সামর্থের তারতম্যও নেই।
.
বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের কারিকাতেও অনুরূপ বক্তব্য দেখা যায়-
বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের কারিকাতেও অনুরূপ বক্তব্য দেখা যায়-
‘কার্যাণি হি বিলম্বন্তে কারণাসন্নিধানতঃ।
গমর্থহেতুসদ্ভাবে ক্ষেপস্তেষাং হি কিং কৃতঃ।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৩৯৫)
অর্থাৎ : কারণের অসন্নিধান বশতই কার্য উৎপন্ন হতে বিলম্ব হয়; উপস্থিত থাকলে কার্যের বিলম্ব (ক্ষেপ) ঘটবে কেন?
.
কিন্তু যুগপৎ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালের ক্রিয়া সম্পাদন কোন বস্তুর ক্ষেত্রে দেখা যায় না বলে তাতে সেই সামর্থ্য নেই ধরে নিতে হবে। এটি হচ্ছে প্রসঙ্গানুমান। সুতরাং প্রথম বিকল্পটি গ্রাহ্য নয়।
দ্বিতীয় বিকল্পে বলা হয় যদি অক্ষণিক বস্তুর অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য বর্তমান কালে না থাকে তবে তা কোন কালেই ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারবে না। অর্থক্রিয়াকারিত্ব হচ্ছে সামর্থ্যরে অনুগামী। শান্তরক্ষিতের উদ্ধৃতিতে-
কিন্তু যুগপৎ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান কালের ক্রিয়া সম্পাদন কোন বস্তুর ক্ষেত্রে দেখা যায় না বলে তাতে সেই সামর্থ্য নেই ধরে নিতে হবে। এটি হচ্ছে প্রসঙ্গানুমান। সুতরাং প্রথম বিকল্পটি গ্রাহ্য নয়।
দ্বিতীয় বিকল্পে বলা হয় যদি অক্ষণিক বস্তুর অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য বর্তমান কালে না থাকে তবে তা কোন কালেই ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারবে না। অর্থক্রিয়াকারিত্ব হচ্ছে সামর্থ্যরে অনুগামী। শান্তরক্ষিতের উদ্ধৃতিতে-
‘নিঃশেষশক্তিশূন্যং তু যদ্ধন্ধ্যাসুতসন্নিভম্ ।
সর্বজ্ঞচেতসোহপ্যেতি হেতুত্বং ন কদাচন।।’ (তত্ত্বসংগ্রহ-৪২২)
অর্থাৎ : যা সম্পূর্ণরূপে শক্তিশূন্য এবং সেইজন্য বন্ধ্যাপুত্রের মতোই তার হেতুত্ব সর্বজ্ঞেরও কল্পনাতীত।
.
যে বস্তু যে কালে যে ক্রিয়াসম্পাদন করে না তার সেই কালে সেই ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য নেই। যেমন শিলাখণ্ডে অঙ্কুরোদ্গম হয় না। বর্তমান কালে অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদনে সামর্থ্য থাকে না বলে তা অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না। এটি হচ্ছে বিপর্যয়ানুমান। সুতরাং সর্বদর্শনসংগ্রহে মাধবাচার্যের উত্থাপিত দুটো বিকল্পের দ্বারা স্থির হয় যে, অক্ষণিক স্থায়ী বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব নেই।
.
প্রত্যুত্তরে বলা যেতে পারে, স্থায়ী বস্তুর কার্য উৎপাদনের শক্তি আছে, কিন্তু ক্রমিকভাবে সহকারি কারণ না থাকায় তা কার্য উৎপাদন করতে পারে না।
.
উত্তরে বৌদ্ধরা বলেন যে, শক্তিবিশিষ্ট কোন বস্তুকে সহকারী কারণের সাহায্যে কার্য উৎপাদন করতে দেখা যায় না। সেহেতু বস্তুর কার্য উৎপাদনের শক্তি না থাকলে সহকারী কারণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
তাছাড়া প্রশ্ন হলো, কার্য উৎপাদন কার দ্বারা হচ্ছে ? স্থায়ী বস্তুর দ্বারা অথবা সহকারী কারণের দ্বারা ? যদি স্থায়ী বস্তুই কার্য উৎপাদন করে, তাহলে বলতে হবে সহকারী কারণ অপ্রয়োজনীয়। যেমন স্থির বীজই যদি অঙ্কুর উৎপাদন করে, তাহলে বলা উচিত ঘরের বীজও মাঠের বীজের মতোই কার্য উৎপাদন করতে পারে। কারণ বীজ স্থির হলে ঘরের বীজ ও মাঠের বীজের মধ্যে কোন ভেদ নেই। কিন্তু বাস্তবে মাঠের বীজ থেকেই অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, ঘরের বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না। অতএব বাস্তব ঘটনা স্থিরবাদীর অনুকূল নয়।
.
এক্ষেত্রে পাল্টা বলা যেতে পারে, বীজ নিজে অঙ্কুর উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু মাটি, বাতাস, জল প্রভৃতি সহকারী কারণের সাহায্যে বীজ অঙ্কুর উৎপাদন করতে পারে।
.
এ বক্তব্য খণ্ডনে বৌদ্ধরা বলেন, সহকারী কারণের দ্বারা অঙ্কুর উৎপন্ন করা যদি বীজের স্বভাব হয় তাহলে ঐ স্বভাব বীজে সর্বদা থাকবে। কারণ স্বভাব বস্তুতে সর্বদাই থাকে। কিন্তু অঙ্কুর উৎপাদনের জন্য উক্ত সহকারী কারণগুলো সর্বদা নাও থাকতে পারে। সুতরাং বৌদ্ধমতে সহকারী কারণ নেই। কেবল বীজই অঙ্কুরের কারণ।
কিন্তু বীজ বীজত্বরূপে অঙ্কুরের কারণ হতে পারে না। কারণ তাহলে ঘরের বীজ থেকে অঙ্কুরের উৎপত্তির আপত্তি হবে যেহেতু ঘরের বীজে বীজত্ব থাকে। এই কারণে বৌদ্ধরা যে বীজ অঙ্কুর উৎপন্ন করে, সেই বীজে কূর্বদ্রূপত্ব (সহকারির দ্বারা উৎপন্ন বিশেষ উপযোগ বা অতিশয়) নামক জাতিবিশেষ স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ সহকারী কারণের সহায়তায় কারণ-বস্তুতে ‘অতিশয়’ নামক এক প্রকার গুণ উৎপন্ন হয়। এই অতিশয়ই কার্য উৎপাদনের উপযোগী। বস্তুতপক্ষে সহকারি কারণ যুক্ত হয়ে কারণ যখন অতিশয়ের অধিকারী হয় কেবল তখনই তাকে অর্থক্রিয়াকারী বলতে হয়। এইরূপ কারণকে বৌদ্ধদর্শনে ‘কুর্বদ্রূপত্ব’ বলা হয়। যে ক্ষণে বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় তার অব্যবহিত পূর্বক্ষণই বীজে কূর্বদ্রূপত্ব থাকে। পূর্ববর্তী অন্যান্য ক্ষণের বীজে কূর্বদ্রূপত্ব না থাকায় ঐসব ক্ষণের বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না। সুতরাং প্রতিক্ষণের বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না।
প্রতিক্ষণের বীজ যেহেতু ভিন্ন সেহেতু বীজ মাত্রই ক্ষণিক অর্থাৎ ক্ষণমাত্র স্থায়ী। এর দ্বারা ক্ষণিকবাদই সমর্থিত হয়েছে। বৌদ্ধমতে সৎ-কে অর্থক্রিয়াকারিত্বের লক্ষণ বলা হয়েছে। প্রয়োজনভূত যে ক্রিয়া তার সম্পাদনই হচ্ছে সত্ত্ব, মানে যে-কোন কার্যকারিতা। আকাশকুসুম কোন কার্য সম্পন্ন করতে পারে না বলে তাকে অসৎ বলা হয়। সুতরাং বৌদ্ধমতে স্থায়ী বা নিত্য বস্তু ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না অর্থাৎ অসৎ। যা ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক।
.
এক্ষেত্রে পূর্বপক্ষী বলতে পারেন যে, স্থায়ী বস্তু ক্রমে কার্যকে উৎপন্ন করতে না পারলেও যুগপৎ কার্যকে উৎপন্ন করবে।
এই বক্তব্য খণ্ডনে বৌদ্ধরা বলেন, তাহলে স্থায়ী বস্তু একই সঙ্গে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কার্য উৎপন্ন করবে। কিন্তু তা কখনও সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি স্থায়ী বস্তু যুগপৎ সমস্ত বস্তু উৎপন্ন করে তাহলে পরমুহূর্তে তার উৎপন্ন করার কোন কিছু থাকবে না। উৎপন্ন করার কিছু না থাকলে বস্তুটি অসৎ হয়ে পড়বে। কেননা কার্যক্ষমতা বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বস্তুটিও বিনষ্ট হয়।
.
এক্ষত্রে পূর্বপক্ষী আবার বলতে পারেন যে, পরমুহূর্তে স্থায়ী বস্তুটি ভিন্ন কার্য উৎপন্ন করবে এবং তার পরমুহূর্তে আবার অন্য কার্য উৎপন্ন করবে।
তাহলে, বৌদ্ধরা বলেন, সেক্ষেত্রে ক্রমে কার্য উৎপাদনের বিকল্পের দোষগুলি উপস্থিত হবে। কেননা কোন বস্তুই বিভিন্ন কালে সমকার্য উৎপন্ন করে না। কার্যের উৎপত্তিতে কারণশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় বিভিন্ন কালে সমকার্যের উৎপত্তি সম্ভব নয়।
.
সুতরাং, কোন বস্তুর সম্বন্ধে আমাদের প্রশ্ন হলো- সেটি কি কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ অথবা সমর্থ নয়? যদি সেটি কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ না হয় তাহলে সেটি অসৎ। যদি সেটি কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ হয় তাহলে সেটি নিশ্চয়ই পরক্ষণে কার্যকে উৎপন্ন করবে কারণ জগতে দেখা যায় যে, যে কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ সে কার্যকে উৎপন্ন করতে কালবিলম্ব করে না। কার্যকে উৎপন্ন করে সে কিন্তু আর অর্থক্রিয়াকারী থাকে না যেহেতু তার কার্যকে উৎপাদন করার সামর্থ্য আর থাকে না। সুতরাং, কার্যকে উৎপন্ন করেই সে নাশ পায়। ফলে যে সৎ সে অর্থক্রিয়াকারী। যে অর্থক্রিয়াকারী সে তার পরক্ষণেই কার্যকে উৎপন্ন করবে। কার্যকে উৎপন্ন করেই সে নাশ পাবে। সুতরাং, যে অর্থক্রিয়াকারী যে ক্ষণিক।
.
ক্ষণভঙ্গবাদের দার্শনিক সমালোচনা:
ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সম্প্রদায় ক্ষণভঙ্গবাদের তীব্র সমালোচনা করে এই মতের কিছু দার্শনিক-সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছেন। যেমন-
.
ক্ষণিকবাদ স্বীকারে কর্মসিদ্ধান্ত খণ্ডিত হয়। কর্মসিদ্ধান্ত অনুসারে কর্ম অবশ্য তার ফল প্রদান করে। যদি কোন ব্যক্তি কর্ম করে ও সে ক্ষণিক বলে নষ্ট হয়ে অন্য ব্যক্তি হয় তবে এই দ্বিতীয় ব্যক্তি কিভাবে কর্মফল প্রাপ্ত হবে ? যেমন দেবদত্ত চুরি করলো, চৌর্যের শাস্তি যজ্ঞদত্ত পেলে তাতে অকৃতাভ্যাগমন দোষ প্রসক্ত হবে। দেবদত্ত ক্ষণিক বলে তার কৃত কর্মের ফলভোগের হানি হওয়ায় ‘কৃতহানি’ বা ‘কৃতপ্রণাশ’ এবং কর্মবিশেষের অকর্তা যজ্ঞদত্ত যে জাত হলো তার অকৃত কর্মের ফলের ভোগ স্বীকার করতে হয়, তা হচ্ছে অকৃতাভ্যাগম। আবার ক্ষণিকবাদ স্বীকার করলে ব্যক্তি ক্ষণিক বলে দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য প্রয়াস নিরর্থক, কেননা দুঃখের থেকে নিষ্কৃতি অন্য ব্যক্তি পেয়ে যাবে। মোক্ষপ্রয়াসী ও মোক্ষপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি অভিন্ন না হয়, তাহলে একের প্রচেষ্টায় অপরের মোক্ষপ্রাপ্তির আপত্তি দেখা দেয়। কৃতকর্মের ফল ভোগ না করাকে বলা হয় কৃতহানি বা কৃতপ্রণাশ দোষ, আর অকৃতকর্মের ফল ভোগ করাকে বলা হয় অকৃতাভ্যাগম দোষ। কৃতহানি ও অকৃতাভ্যাগম এই দুটি লোকবিরুদ্ধ, যুক্তিবিরুদ্ধ ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলে দোষবিশেষ। অতএব ক্ষণিকবাদ সঙ্গত নয়।
জৈনদের এই আপত্তির উত্তরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বক্তব্য এই যে, ক্ষণভেদে ব্যক্তি ভেদ স্বীকৃত হলেও দুটি ক্ষণের ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা থাকে। প্রতিটি ক্ষণের ব্যক্তি বিনষ্ট হওয়ার কালে যে সংস্কার রেখে যায় তা পরবর্তীক্ষণের ব্যক্তির মধ্যে প্রবাহিত হয়। এইভাবে ব্যক্তির ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এক ব্যক্তির কর্মফল অন্যের ভোগের আপত্তি যুক্তিহীন বলে বিবেচিত হয়।
.
অন্য মতে ক্ষণিকবাদকে প্রমাণ করা যায় না। যে কোন অনুমানে দৃষ্টান্ত বলে পক্ষে সাধ্যের অনুমান করা হয়। বৌদ্ধরা কিন্তু নিজেদের অনুমানের সমর্থনে কোন দৃষ্টান্তই দিতে পারবেন না। কারণ ক্ষণিকবাদের সমর্থনে অনুমানটি হলো সর্বপক্ষক অনুমিতি। সমস্ত পদার্থই যদি পক্ষের অন্তর্গত হয় তাহলে অন্য কোন স্থল বা পদার্থ থাকে না যেখানে হেতু এবং সাধ্য আছে এরূপ জ্ঞান করা সম্ভব হয়। সুতরাং সর্বপক্ষক অনুমিতির দৃষ্টান্ত না থাকায় এই অনুমিতিকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অনুমিতির দ্বারা যদি ক্ষণিকবাদকে সমর্থন করা না যায় তাহলে ক্ষণিকবাদের সমর্থনে কোন প্রমাণ না থাকায় ক্ষণিকবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
.
আরেকটি বিরুদ্ধ মত হলো, বৌদ্ধমত অনুসারে অর্থক্রিয়াকারিত্ব সত্তার লক্ষণ বললে অনবস্থা দোষ হয়। কোন বস্তুর কার্য থাকাই যদি তার সত্তার প্রমাণ হয়, তাহলে যে কোন একটি বস্তুর সত্তা আছে কিনা জানতে হলে তার কার্যকে জানতে হবে। আবার ঐ কার্যটির সত্তার জন্য ঐ কার্যটির কার্যকে জানতে হবে। ফলে অনাবস্থা দোষ অবশ্যম্ভাবী এবং কোন বস্তুর সত্তা আছে কিনা জানা যায় না। তাছাড়া যাবতীয় বস্তুই যদি ক্ষণিক হয়, তাহলে এই ক্ষণিকত্ব কোন কিছুর দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ক্ষণিকত্ব প্রমাণের জন্য অন্তত একজন স্থির দ্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন।
নৈয়ায়িকদের এই আপত্তির উত্তরে রত্নকীর্তি বলেছেন যে, প্রবহমান বস্তুর ক্ষেত্রে অনবস্থা দোষনীয় নয়। বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব ক্ষণিক হওয়ায় এবং অর্থক্রিয়াকারিত্ব সত্তা হওয়ায় সত্তা থেকে ক্ষণিকত্ব অনুমিত হয়। যা সত্তাবান্ তাই ক্ষণিক, যেমন ঘটপটাদি এরূপ অন্বয় ব্যাপ্তি এবং যা ক্ষণিক নয় তা সত্তাবান্ নয়, যেমন- বন্ধ্যাপুত্র, এইরূপ ব্যতিরেক ব্যাপ্তির দ্বারা বস্তুর ক্ষণিকত্ব প্রমাণিত হওয়ায় কোন স্থিরদ্রষ্টার মাধ্যমে ক্ষণিকত্ব প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
বৌদ্ধ ক্ষণিকবাদের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান আপত্তি হলো, স্থায়ী জ্ঞাতা স্বীকার না করলে স্মৃতি ও প্রত্যভিজ্ঞার ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। পূর্বদৃষ্ট পদার্থকে যখন পরবর্তীকালে পুনরায় প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন ‘এই সেই দেবদত্ত’ রূপ যে জ্ঞান আমাদের হয় তাই প্রত্যভিজ্ঞার দৃষ্টান্ত। অপরদিকে পূর্বানুভবের বিষয়কে যখন কেবল সংস্কারের মাধ্যমে জানা হয় তখন তাকে বলা হয় স্মৃতি। উভয়ক্ষেত্রেই স্থায়ী জ্ঞাতার অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন।
এই আপত্তির উত্তরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলো, প্রত্যভিজ্ঞা যথার্থ জ্ঞান নয়। দুটি সদৃশ পদার্থকে অভিন্ন বলে গ্রহণ করায় প্রত্যভিজ্ঞা ভ্রান্ত বলে বিবেচিত। স্মৃতির ক্ষেত্রেও আমরা দুটি সদৃশ বস্তুকে অভিন্ন বলে মনে করি। বস্তুত প্রত্যভিজ্ঞা ও স্মৃতিজ্ঞান প্রমাণ নয়। তবে প্রমাণ না হলেও প্রত্যভিজ্ঞা ও স্মৃতিজ্ঞান আমাদের হয়। যেহেতু বৌদ্ধমতে চেতনাপ্রবাহ এবং সংস্কারের ধারাবাহিকতা স্বীকৃত, সেহেতু দুটি ভিন্ন জিনিসের স্থায়ী জ্ঞাতা ব্যতীতও অভিন্ন বলে জ্ঞান হতে পারে।
.
প্রচলিত ন্যায়শাস্ত্র অনুযায়ী এই দার্শনিক সমস্যাগুলোর যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করা না গেলেও বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেন (১৫০ খ্রীষ্টপূর্ব) গ্রিক দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ যবনরাজ মিনান্দর (মিলিন্দ) এর সাথে শিয়ালকোটে একটি আকর্ষণীয় দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তি ও উপমা ব্যবহার করে এর চমৎকার সমাধান করেছিলেন, তা অন্যত্র আলোচনা করা হলেও এখানে একটি নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেমন, ক্ষণভঙ্গবাদ অনুযায়ী দুটি ক্ষণের বস্তু বা ব্যক্তি এক না হলেও ব্যক্তির ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এক ব্যক্তির কর্মফল অন্যের ভোগের আপত্তি যে যুক্তিহীন বলে বিবেচিত হয়, তা মিলিন্দের সাথে নাগসেনের কথোপকথন দৃষ্টান্ত-
“মহারাজ! কোনো ব্যক্তি…অর্থের বিনিময়ে একটি ক্ষুদ্র বালিকাকে বিবাহ করে তাকে রেখে দূর দেশে চলে যায়। এরপর সেই শিশুকন্যা যুবতী হলে আর এক ব্যক্তি তাকে অর্থ প্রদান করে বিবাহ করে নেয়। তখন মেয়েটির প্রথম স্বামী এসে বললো- ‘তুমি আমার স্ত্রীকে কেন বিবাহ করলে?’ সে উত্তর দিলো, ‘আমি তো করিনি। যে ছোট্ট মেয়েটিকে তুমি অর্থের বিনিময়ে বিবাহ করেছিলে সে এবং আমার বিবাহিতা এই সুন্দরী যুবতী এক নয়, অন্য।’ মহারাজ! এখন যদি এই মামলা আপনার নিকট আসে তবে আপনি কোন পক্ষ অবলম্বন করবেন?”
“প্রথম ব্যক্তির পক্ষ। …কারণ সেই কন্যাই বড় হয়ে যুবতী হয়েছে।” (মিলিন্দ প্রশ্ন, সংযুক্ত-নিকায়)
.
যে বস্তু যে কালে যে ক্রিয়াসম্পাদন করে না তার সেই কালে সেই ক্রিয়া সম্পাদনের সামর্থ্য নেই। যেমন শিলাখণ্ডে অঙ্কুরোদ্গম হয় না। বর্তমান কালে অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদনে সামর্থ্য থাকে না বলে তা অতীত ও ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়া সম্পাদন করতে পারে না। এটি হচ্ছে বিপর্যয়ানুমান। সুতরাং সর্বদর্শনসংগ্রহে মাধবাচার্যের উত্থাপিত দুটো বিকল্পের দ্বারা স্থির হয় যে, অক্ষণিক স্থায়ী বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব নেই।
.
প্রত্যুত্তরে বলা যেতে পারে, স্থায়ী বস্তুর কার্য উৎপাদনের শক্তি আছে, কিন্তু ক্রমিকভাবে সহকারি কারণ না থাকায় তা কার্য উৎপাদন করতে পারে না।
.
উত্তরে বৌদ্ধরা বলেন যে, শক্তিবিশিষ্ট কোন বস্তুকে সহকারী কারণের সাহায্যে কার্য উৎপাদন করতে দেখা যায় না। সেহেতু বস্তুর কার্য উৎপাদনের শক্তি না থাকলে সহকারী কারণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
তাছাড়া প্রশ্ন হলো, কার্য উৎপাদন কার দ্বারা হচ্ছে ? স্থায়ী বস্তুর দ্বারা অথবা সহকারী কারণের দ্বারা ? যদি স্থায়ী বস্তুই কার্য উৎপাদন করে, তাহলে বলতে হবে সহকারী কারণ অপ্রয়োজনীয়। যেমন স্থির বীজই যদি অঙ্কুর উৎপাদন করে, তাহলে বলা উচিত ঘরের বীজও মাঠের বীজের মতোই কার্য উৎপাদন করতে পারে। কারণ বীজ স্থির হলে ঘরের বীজ ও মাঠের বীজের মধ্যে কোন ভেদ নেই। কিন্তু বাস্তবে মাঠের বীজ থেকেই অঙ্কুর উৎপন্ন হয়, ঘরের বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না। অতএব বাস্তব ঘটনা স্থিরবাদীর অনুকূল নয়।
.
এক্ষেত্রে পাল্টা বলা যেতে পারে, বীজ নিজে অঙ্কুর উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু মাটি, বাতাস, জল প্রভৃতি সহকারী কারণের সাহায্যে বীজ অঙ্কুর উৎপাদন করতে পারে।
.
এ বক্তব্য খণ্ডনে বৌদ্ধরা বলেন, সহকারী কারণের দ্বারা অঙ্কুর উৎপন্ন করা যদি বীজের স্বভাব হয় তাহলে ঐ স্বভাব বীজে সর্বদা থাকবে। কারণ স্বভাব বস্তুতে সর্বদাই থাকে। কিন্তু অঙ্কুর উৎপাদনের জন্য উক্ত সহকারী কারণগুলো সর্বদা নাও থাকতে পারে। সুতরাং বৌদ্ধমতে সহকারী কারণ নেই। কেবল বীজই অঙ্কুরের কারণ।
কিন্তু বীজ বীজত্বরূপে অঙ্কুরের কারণ হতে পারে না। কারণ তাহলে ঘরের বীজ থেকে অঙ্কুরের উৎপত্তির আপত্তি হবে যেহেতু ঘরের বীজে বীজত্ব থাকে। এই কারণে বৌদ্ধরা যে বীজ অঙ্কুর উৎপন্ন করে, সেই বীজে কূর্বদ্রূপত্ব (সহকারির দ্বারা উৎপন্ন বিশেষ উপযোগ বা অতিশয়) নামক জাতিবিশেষ স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ সহকারী কারণের সহায়তায় কারণ-বস্তুতে ‘অতিশয়’ নামক এক প্রকার গুণ উৎপন্ন হয়। এই অতিশয়ই কার্য উৎপাদনের উপযোগী। বস্তুতপক্ষে সহকারি কারণ যুক্ত হয়ে কারণ যখন অতিশয়ের অধিকারী হয় কেবল তখনই তাকে অর্থক্রিয়াকারী বলতে হয়। এইরূপ কারণকে বৌদ্ধদর্শনে ‘কুর্বদ্রূপত্ব’ বলা হয়। যে ক্ষণে বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় তার অব্যবহিত পূর্বক্ষণই বীজে কূর্বদ্রূপত্ব থাকে। পূর্ববর্তী অন্যান্য ক্ষণের বীজে কূর্বদ্রূপত্ব না থাকায় ঐসব ক্ষণের বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না। সুতরাং প্রতিক্ষণের বীজ থেকে অঙ্কুর উৎপন্ন হয় না।
প্রতিক্ষণের বীজ যেহেতু ভিন্ন সেহেতু বীজ মাত্রই ক্ষণিক অর্থাৎ ক্ষণমাত্র স্থায়ী। এর দ্বারা ক্ষণিকবাদই সমর্থিত হয়েছে। বৌদ্ধমতে সৎ-কে অর্থক্রিয়াকারিত্বের লক্ষণ বলা হয়েছে। প্রয়োজনভূত যে ক্রিয়া তার সম্পাদনই হচ্ছে সত্ত্ব, মানে যে-কোন কার্যকারিতা। আকাশকুসুম কোন কার্য সম্পন্ন করতে পারে না বলে তাকে অসৎ বলা হয়। সুতরাং বৌদ্ধমতে স্থায়ী বা নিত্য বস্তু ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না অর্থাৎ অসৎ। যা ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক।
.
এক্ষেত্রে পূর্বপক্ষী বলতে পারেন যে, স্থায়ী বস্তু ক্রমে কার্যকে উৎপন্ন করতে না পারলেও যুগপৎ কার্যকে উৎপন্ন করবে।
এই বক্তব্য খণ্ডনে বৌদ্ধরা বলেন, তাহলে স্থায়ী বস্তু একই সঙ্গে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কার্য উৎপন্ন করবে। কিন্তু তা কখনও সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, যদি স্থায়ী বস্তু যুগপৎ সমস্ত বস্তু উৎপন্ন করে তাহলে পরমুহূর্তে তার উৎপন্ন করার কোন কিছু থাকবে না। উৎপন্ন করার কিছু না থাকলে বস্তুটি অসৎ হয়ে পড়বে। কেননা কার্যক্ষমতা বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বস্তুটিও বিনষ্ট হয়।
.
এক্ষত্রে পূর্বপক্ষী আবার বলতে পারেন যে, পরমুহূর্তে স্থায়ী বস্তুটি ভিন্ন কার্য উৎপন্ন করবে এবং তার পরমুহূর্তে আবার অন্য কার্য উৎপন্ন করবে।
তাহলে, বৌদ্ধরা বলেন, সেক্ষেত্রে ক্রমে কার্য উৎপাদনের বিকল্পের দোষগুলি উপস্থিত হবে। কেননা কোন বস্তুই বিভিন্ন কালে সমকার্য উৎপন্ন করে না। কার্যের উৎপত্তিতে কারণশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় বিভিন্ন কালে সমকার্যের উৎপত্তি সম্ভব নয়।
.
সুতরাং, কোন বস্তুর সম্বন্ধে আমাদের প্রশ্ন হলো- সেটি কি কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ অথবা সমর্থ নয়? যদি সেটি কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ না হয় তাহলে সেটি অসৎ। যদি সেটি কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ হয় তাহলে সেটি নিশ্চয়ই পরক্ষণে কার্যকে উৎপন্ন করবে কারণ জগতে দেখা যায় যে, যে কার্যকে উৎপন্ন করতে সমর্থ সে কার্যকে উৎপন্ন করতে কালবিলম্ব করে না। কার্যকে উৎপন্ন করে সে কিন্তু আর অর্থক্রিয়াকারী থাকে না যেহেতু তার কার্যকে উৎপাদন করার সামর্থ্য আর থাকে না। সুতরাং, কার্যকে উৎপন্ন করেই সে নাশ পায়। ফলে যে সৎ সে অর্থক্রিয়াকারী। যে অর্থক্রিয়াকারী সে তার পরক্ষণেই কার্যকে উৎপন্ন করবে। কার্যকে উৎপন্ন করেই সে নাশ পাবে। সুতরাং, যে অর্থক্রিয়াকারী যে ক্ষণিক।
.
ক্ষণভঙ্গবাদের দার্শনিক সমালোচনা:
ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য সম্প্রদায় ক্ষণভঙ্গবাদের তীব্র সমালোচনা করে এই মতের কিছু দার্শনিক-সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছেন। যেমন-
.
ক্ষণিকবাদ স্বীকারে কর্মসিদ্ধান্ত খণ্ডিত হয়। কর্মসিদ্ধান্ত অনুসারে কর্ম অবশ্য তার ফল প্রদান করে। যদি কোন ব্যক্তি কর্ম করে ও সে ক্ষণিক বলে নষ্ট হয়ে অন্য ব্যক্তি হয় তবে এই দ্বিতীয় ব্যক্তি কিভাবে কর্মফল প্রাপ্ত হবে ? যেমন দেবদত্ত চুরি করলো, চৌর্যের শাস্তি যজ্ঞদত্ত পেলে তাতে অকৃতাভ্যাগমন দোষ প্রসক্ত হবে। দেবদত্ত ক্ষণিক বলে তার কৃত কর্মের ফলভোগের হানি হওয়ায় ‘কৃতহানি’ বা ‘কৃতপ্রণাশ’ এবং কর্মবিশেষের অকর্তা যজ্ঞদত্ত যে জাত হলো তার অকৃত কর্মের ফলের ভোগ স্বীকার করতে হয়, তা হচ্ছে অকৃতাভ্যাগম। আবার ক্ষণিকবাদ স্বীকার করলে ব্যক্তি ক্ষণিক বলে দুঃখ থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য প্রয়াস নিরর্থক, কেননা দুঃখের থেকে নিষ্কৃতি অন্য ব্যক্তি পেয়ে যাবে। মোক্ষপ্রয়াসী ও মোক্ষপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি অভিন্ন না হয়, তাহলে একের প্রচেষ্টায় অপরের মোক্ষপ্রাপ্তির আপত্তি দেখা দেয়। কৃতকর্মের ফল ভোগ না করাকে বলা হয় কৃতহানি বা কৃতপ্রণাশ দোষ, আর অকৃতকর্মের ফল ভোগ করাকে বলা হয় অকৃতাভ্যাগম দোষ। কৃতহানি ও অকৃতাভ্যাগম এই দুটি লোকবিরুদ্ধ, যুক্তিবিরুদ্ধ ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ বলে দোষবিশেষ। অতএব ক্ষণিকবাদ সঙ্গত নয়।
জৈনদের এই আপত্তির উত্তরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বক্তব্য এই যে, ক্ষণভেদে ব্যক্তি ভেদ স্বীকৃত হলেও দুটি ক্ষণের ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়। প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে একটি ধারাবাহিকতা থাকে। প্রতিটি ক্ষণের ব্যক্তি বিনষ্ট হওয়ার কালে যে সংস্কার রেখে যায় তা পরবর্তীক্ষণের ব্যক্তির মধ্যে প্রবাহিত হয়। এইভাবে ব্যক্তির ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এক ব্যক্তির কর্মফল অন্যের ভোগের আপত্তি যুক্তিহীন বলে বিবেচিত হয়।
.
অন্য মতে ক্ষণিকবাদকে প্রমাণ করা যায় না। যে কোন অনুমানে দৃষ্টান্ত বলে পক্ষে সাধ্যের অনুমান করা হয়। বৌদ্ধরা কিন্তু নিজেদের অনুমানের সমর্থনে কোন দৃষ্টান্তই দিতে পারবেন না। কারণ ক্ষণিকবাদের সমর্থনে অনুমানটি হলো সর্বপক্ষক অনুমিতি। সমস্ত পদার্থই যদি পক্ষের অন্তর্গত হয় তাহলে অন্য কোন স্থল বা পদার্থ থাকে না যেখানে হেতু এবং সাধ্য আছে এরূপ জ্ঞান করা সম্ভব হয়। সুতরাং সর্বপক্ষক অনুমিতির দৃষ্টান্ত না থাকায় এই অনুমিতিকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অনুমিতির দ্বারা যদি ক্ষণিকবাদকে সমর্থন করা না যায় তাহলে ক্ষণিকবাদের সমর্থনে কোন প্রমাণ না থাকায় ক্ষণিকবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
.
আরেকটি বিরুদ্ধ মত হলো, বৌদ্ধমত অনুসারে অর্থক্রিয়াকারিত্ব সত্তার লক্ষণ বললে অনবস্থা দোষ হয়। কোন বস্তুর কার্য থাকাই যদি তার সত্তার প্রমাণ হয়, তাহলে যে কোন একটি বস্তুর সত্তা আছে কিনা জানতে হলে তার কার্যকে জানতে হবে। আবার ঐ কার্যটির সত্তার জন্য ঐ কার্যটির কার্যকে জানতে হবে। ফলে অনাবস্থা দোষ অবশ্যম্ভাবী এবং কোন বস্তুর সত্তা আছে কিনা জানা যায় না। তাছাড়া যাবতীয় বস্তুই যদি ক্ষণিক হয়, তাহলে এই ক্ষণিকত্ব কোন কিছুর দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ক্ষণিকত্ব প্রমাণের জন্য অন্তত একজন স্থির দ্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন।
নৈয়ায়িকদের এই আপত্তির উত্তরে রত্নকীর্তি বলেছেন যে, প্রবহমান বস্তুর ক্ষেত্রে অনবস্থা দোষনীয় নয়। বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব ক্ষণিক হওয়ায় এবং অর্থক্রিয়াকারিত্ব সত্তা হওয়ায় সত্তা থেকে ক্ষণিকত্ব অনুমিত হয়। যা সত্তাবান্ তাই ক্ষণিক, যেমন ঘটপটাদি এরূপ অন্বয় ব্যাপ্তি এবং যা ক্ষণিক নয় তা সত্তাবান্ নয়, যেমন- বন্ধ্যাপুত্র, এইরূপ ব্যতিরেক ব্যাপ্তির দ্বারা বস্তুর ক্ষণিকত্ব প্রমাণিত হওয়ায় কোন স্থিরদ্রষ্টার মাধ্যমে ক্ষণিকত্ব প্রমাণ করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
বৌদ্ধ ক্ষণিকবাদের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান আপত্তি হলো, স্থায়ী জ্ঞাতা স্বীকার না করলে স্মৃতি ও প্রত্যভিজ্ঞার ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। পূর্বদৃষ্ট পদার্থকে যখন পরবর্তীকালে পুনরায় প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন ‘এই সেই দেবদত্ত’ রূপ যে জ্ঞান আমাদের হয় তাই প্রত্যভিজ্ঞার দৃষ্টান্ত। অপরদিকে পূর্বানুভবের বিষয়কে যখন কেবল সংস্কারের মাধ্যমে জানা হয় তখন তাকে বলা হয় স্মৃতি। উভয়ক্ষেত্রেই স্থায়ী জ্ঞাতার অস্তিত্ব স্বীকার করা প্রয়োজন।
এই আপত্তির উত্তরে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বক্তব্য হলো, প্রত্যভিজ্ঞা যথার্থ জ্ঞান নয়। দুটি সদৃশ পদার্থকে অভিন্ন বলে গ্রহণ করায় প্রত্যভিজ্ঞা ভ্রান্ত বলে বিবেচিত। স্মৃতির ক্ষেত্রেও আমরা দুটি সদৃশ বস্তুকে অভিন্ন বলে মনে করি। বস্তুত প্রত্যভিজ্ঞা ও স্মৃতিজ্ঞান প্রমাণ নয়। তবে প্রমাণ না হলেও প্রত্যভিজ্ঞা ও স্মৃতিজ্ঞান আমাদের হয়। যেহেতু বৌদ্ধমতে চেতনাপ্রবাহ এবং সংস্কারের ধারাবাহিকতা স্বীকৃত, সেহেতু দুটি ভিন্ন জিনিসের স্থায়ী জ্ঞাতা ব্যতীতও অভিন্ন বলে জ্ঞান হতে পারে।
.
প্রচলিত ন্যায়শাস্ত্র অনুযায়ী এই দার্শনিক সমস্যাগুলোর যথাযথ প্রমাণ উপস্থাপন করা না গেলেও বৌদ্ধ দার্শনিক নাগসেন (১৫০ খ্রীষ্টপূর্ব) গ্রিক দার্শনিক ও শাস্ত্রজ্ঞ যবনরাজ মিনান্দর (মিলিন্দ) এর সাথে শিয়ালকোটে একটি আকর্ষণীয় দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যমে যুক্তি ও উপমা ব্যবহার করে এর চমৎকার সমাধান করেছিলেন, তা অন্যত্র আলোচনা করা হলেও এখানে একটি নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেমন, ক্ষণভঙ্গবাদ অনুযায়ী দুটি ক্ষণের বস্তু বা ব্যক্তি এক না হলেও ব্যক্তির ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় এক ব্যক্তির কর্মফল অন্যের ভোগের আপত্তি যে যুক্তিহীন বলে বিবেচিত হয়, তা মিলিন্দের সাথে নাগসেনের কথোপকথন দৃষ্টান্ত-
“মহারাজ! কোনো ব্যক্তি…অর্থের বিনিময়ে একটি ক্ষুদ্র বালিকাকে বিবাহ করে তাকে রেখে দূর দেশে চলে যায়। এরপর সেই শিশুকন্যা যুবতী হলে আর এক ব্যক্তি তাকে অর্থ প্রদান করে বিবাহ করে নেয়। তখন মেয়েটির প্রথম স্বামী এসে বললো- ‘তুমি আমার স্ত্রীকে কেন বিবাহ করলে?’ সে উত্তর দিলো, ‘আমি তো করিনি। যে ছোট্ট মেয়েটিকে তুমি অর্থের বিনিময়ে বিবাহ করেছিলে সে এবং আমার বিবাহিতা এই সুন্দরী যুবতী এক নয়, অন্য।’ মহারাজ! এখন যদি এই মামলা আপনার নিকট আসে তবে আপনি কোন পক্ষ অবলম্বন করবেন?”
“প্রথম ব্যক্তির পক্ষ। …কারণ সেই কন্যাই বড় হয়ে যুবতী হয়েছে।” (মিলিন্দ প্রশ্ন, সংযুক্ত-নিকায়)
.
অনাত্মবাদ বা নৈরাত্মবাদ (Doctrine of the No-self)
বুদ্ধের পূর্বে উপনিষদের ঋষিদের দ্বারা প্রচারিত ঔপনিষদীয় আধ্যাত্মবাদ অনুসারে আত্মা হলো নিত্য, অর্থাৎ আত্মার উৎপত্তি বা বিনাশ হয় না। তাঁদের মতে আত্মা শুদ্ধ, অর্থাৎ মালিন্যহীন। আত্মা বুদ্ধ, অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। আত্মা মুক্তস্বভাবী, আত্মার কোন পরিবর্তনও হয় না। আত্মা সংক্রান্ত এই নিত্যতাবাদী মতবাদ বলা যায় সমস্ত আস্তিক দর্শনেই স্বীকৃত। যেমন ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে আত্মা নিত্যদ্রব্যরূপে পরিচিত। আবার বেদান্তদর্শনে আত্মাকে বলা হয়েছে সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। অন্যদিকে নাস্তিক জৈন সম্প্রদায় মনে করেন যে, প্রত্যেক জীবের মধ্যে এক অবিনাশী নিত্য আত্মা বর্তমান। তাঁদের মতে জীবের জীবনে দুটি ভিন্ন অংশের সমন্বয় ঘটে। অনিত্য জড়দেহ তার একাংশ এবং নিত্য চেতন আত্মা তার অপরাংশ। জীবের জড়াংশ যে অস্থায়ী ও বিনাশী সে বিষয়ে সকল সম্প্রদায়ই একমত, কিন্তু নিত্য চৈতন্যাংশের অস্তিত্ব বিষয়ে বৈদিক প্রস্থানসমূহ ও জৈনগণের সঙ্গে অবৈদিক চার্বাক ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্য ঘটেছে। জড়বাদী চার্বাকদর্শন মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা।
.
বলাই বাহুল্য, স্থায়ী আত্মার অস্তিত্বের বিরোধী হলেও স্বীকার করেননি। চার্বাকরা চেতনসত্তার ধারণাকে ভ্রান্ত বলে বর্ণনা করে চৈতন্যযুক্ত জড় দেহকেই আত্মা বলেছেন। এইমতে দেহ যতোকাল স্থায়ী তথাকথিত আত্মাও ততোকাল স্থায়ী। কিন্তু বৌদ্ধরা চেতনসত্তার বিরোধী নন। তাঁরা কেবল স্থায়ী সত্তারই বিরোধী। তাঁদের আপত্তি স্থায়িত্বের বিরুদ্ধে, চৈতন্যের বিরুদ্ধে নয়। কারণ চৈতন্যবিশিষ্ট দেহকে আত্মা বলে স্বীকার করলে বৌদ্ধমতে জ্ঞান, প্রত্যভিজ্ঞা, স্মৃতি প্রভৃতির যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। আবার যেহেতু বৌদ্ধমতে নিত্য আত্মার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ বা অনুমানের দ্বারা প্রমাণ করা যায় না, তাই উপনিষদ প্রভৃতির আত্মতত্ত্ববাদকেও বৌদ্ধরা স্বীকার করেননি। বৌদ্ধমতে জীবের চেতন সত্তা ক্ষণস্থায়ী প্রবাহ বা ধারার ন্যায় পরিবর্তনশীল। প্রতিটি ক্ষণের অনুভূতি একটি কার্য-কারণমালা বা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে বলেই আমাদের মনে একটি স্থায়ী আত্মার ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়।
‘সংযুক্ত নিকায়ে’ বলা হয়েছে, বিনাশশীল দেহ অবিনাশী আত্মা হতে পারে না। আবার ইন্দ্রিয়ানুভূতি, প্রবৃত্তি, বুদ্ধি প্রভৃতির সাহায্যেও অবিনাশী আত্মা গঠিত হতে পারে না, কারণ এগুলি বিনাশশীল। বিনাশশীল উপাদান দিয়ে গঠিত আত্মা অবিনাশী হতে পারে না। ‘মজ্ঝিমনিকায়ে’ বলা হয়েছে, স্থায়ী আত্মার ধারণা অজ্ঞান-প্রসূত ও পরিত্যাজ্য।
.
নিত্যতাবাদীদের আত্মা সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তকে বুদ্ধ দুইভাগে ভাগ করেছেন- রূপ বিশিষ্ট (ইন্দ্রিয়গোচর) এবং অরূপ। এই দুই মতবাদী দার্শনিকদের কেউ আবার আত্মাকে অনন্ত বলে মানেন, কেউ সান্ত (অনু সদৃশ)। ফলে মহানিদানসূত্ত অনুযায়ী এদেরকেও নিত্যবাদী এবং অনিত্যবাদী এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে (দীঘনিকায়: ২/১৫)।
.
তবে আত্মাবাদের ব্যাখ্যার জন্য বুদ্ধ ‘সৎকায়-দৃষ্টি’ নামে একটি নতুন শব্দ ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য, বুদ্ধের বোধিবিদ্যা ব্যক্ত করার জন্য সে যুগের প্রচলিত ভাষা তখনো যোগ্য হয়ে ওঠেনি বলে ধারণা করা হয়। তাই নিজের সিদ্ধান্তকে প্রকট করার জন্য তিনি ধর্ম, বস্তু, বিজ্ঞান কিছু প্রাচীন শব্দকে যেমন নব্য অর্থে প্রয়োগ করেছিলেন, তেমনি প্রতীত্য-সমুৎপাদ, সৎকায় প্রভৃতির ন্যায় কিছু নতুন শব্দও সৃষ্টি করেছিলেন। সৎকায় অর্থ কায়ায় বিদ্যমান, অর্থাৎ কায়া হতে অজর অমর সত্তা। সৎকায়ের (আত্মা) ধারণাকে বুদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রে এক কঠিন বাধা বলে মনে করতেন এবং সত্য জ্ঞান লাভের জন্য তা দূর হওয়া সর্বাধিক প্রয়োজনীয় মনে করতেন। বুদ্ধের শিষ্যা পণ্ডিতা ধম্মদিন্না তাঁর এক উপদেশে বলেছেন- ‘পঞ্চ উপাদান-স্কন্দই সৎকায়। এবং সৎকায়-দৃষ্টির কারণ হলো গমনাগমনের তৃষ্ণা।’ (চূলবেদল্লসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়: ১/৫/৪)। এই গমনাগমন হলো পুদ্গল বা আত্মার এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরের অবিদ্যাপ্রসূত সংস্কার-ধারণা।
প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব-সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বুদ্ধ অবিদ্যা এবং তৃষ্ণা থেকে মানুষের সমুদয় প্রবৃত্তির ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সৎকায়-দৃষ্টি বা আত্মাবাদের ধারণাকে নৈসর্গিক বলে মানেননি, তাই বলেছেন- ‘নবজাত দুগ্ধপোষ্য শিশুর সৎকায় সম্বন্ধে কোন ধারণা থাকে না, সৎকায়-দৃষ্টি তার কোথা থেকে আসবে ?’ (মহামালুঙ্ক্যসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়: ২/২/৪)
.
বৌদ্ধ মতে সমস্ত পদার্থই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনই বস্তুর স্বরূপ। যেহেতু সব বস্তুই অনিত্য এবং ক্ষণিক, সেহেতু কোন চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। ভারতীয় অধিকাংশ আধ্যাত্ম দর্শনে আত্মাকে যে স্থায়ী বলে স্বীকার করা হয়, এই মতে ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে ও পরে আত্মার অস্তিত্ব টিকে থাকে এবং তা এক শরীর হতে অন্য শরীরে মৃত্যুর পর প্রবেশ করে। এভাবে আত্মার সত্তা পুনর্জন্মের বিচারকে জীবিত রেখেছে। আরো মনে করা হয়, আত্মা আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছার আধারস্বরূপ। কিন্তু বৌদ্ধমতে একটি জীবন থেকে অন্য কোন জীবনে আত্মার প্রবেশ কল্পনা করা সম্ভব নয়, কেবল ঘটনা পরম্পরায় নতুন জীবনের উদ্ভব হয়। বুদ্ধ অস্থায়ী শরীর ও মনের সঙ্কলনমাত্রকে আত্মা বলে স্বীকার করেছেন। কোন এক মুহূর্তে আমাদের মধ্যে যেসব মানসিক প্রক্রিয়াগুলি দেখা যায়, সেই মানসিক প্রক্রিয়াগুলির ধারা বা প্রবাহই (stream of consciousness) হলো আত্মা। চিন্তা, ইচ্ছা, সুখ-দুঃখ প্রভৃতির প্রত্যেকটি ক্ষণকালের জন্য স্থায়ী। চেতনার এই অবিরাম প্রবাহই হলো বৌদ্ধমতে আত্মা। এই প্রবাহের অন্তরালে কোন শাশ্বত বা চিরন্তন সত্তার অস্তিত্ব নেই। এই মতবাদই নৈরাত্ম্যবাদ বা অনাত্মবাদ নামে পরিচিত।
বুদ্ধ অনাত্মা বলতে আত্মার বিপরীতে কোন অভাবাত্ম বস্তু বোঝাতে চাননি। বৈদিক উপনিষদে আত্মাকেই নিত্য ধ্রুব, বস্তু-সত্য বলে মানা হয়েছে। তাই আত্মার অর্থ যদি নিত্য হয়, তাহলে অনাত্মা মানে অ-নিত্য। তাই তিনি একজায়গায় বলেছেন- ‘রূপ অনাত্মা, বেদনা অনাত্মা, সংজ্ঞা …সংস্কার …বিজ্ঞান …সমগ্র ধর্মই অনাত্মা।’- (চূলসচ্চকসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়-১/৪/৫)
.
অনাত্মবাদ মতে স্থায়ী আত্মায় বিশ্বাস করা এক প্রকার ভ্রম। বুদ্ধ শাশ্বত আত্মাকে নিষেধ করে বলেছেন, বিশ্বে না কোন আত্মা বা আত্মার মতো অন্য কোন বস্তু আছে। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের আধারস্বরূপ হচ্ছে মন বা মনের বেদনা। এদের অতিরিক্ত আত্মা বা আত্মাসদৃশ কোন বস্তু নেই। বুদ্ধমতে জগতের সমস্ত বস্তু অনিত্য। তিনি অনুগামী শিষ্যদের বারবার উপদেশ দিয়েছেন যেন তাঁরা নিত্য আত্মার ধারণা পরিত্যাগ করেন। আত্মভ্রমে পীড়িত ব্যক্তি প্রকৃত আত্মস্বরূপ জানতে পারে না, তথাপি সে আত্মায় অনুরক্ত হয়। একে তিনি কোন অদৃষ্ট অজ্ঞাত পরম সুন্দরী নারীতে কারো অনুরাগের মতো হাস্যাস্পদ বলে উল্লেখ করেন।
.
নৈরাত্ম্যবাদের দার্শনিক মত বিশ্লেষণ:
অনাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থে বুদ্ধ আত্মার অস্তিত্ব কখনোই অস্বীকার করেন নি। আত্মা বলতে তিনি মানসিক প্রক্রিয়ার অবিরাম ধারা বা প্রবাহকে বুঝিয়েছেন। মূলত শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার অস্তিত্বই এই মতবাদে অস্বীকার করা হয়েছে।
নৈরাত্ম্যবাদ এখানে দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে- (১) মানসিক অবস্থাগুলির আশ্রয় কোন দ্রব্য আত্মা নেই, (২) বাহ্য বস্তুতেও কোন স্থিতিশীল সত্তা বা দ্রব্য নেই।
বুদ্ধের পূর্বে উপনিষদের ঋষিদের দ্বারা প্রচারিত ঔপনিষদীয় আধ্যাত্মবাদ অনুসারে আত্মা হলো নিত্য, অর্থাৎ আত্মার উৎপত্তি বা বিনাশ হয় না। তাঁদের মতে আত্মা শুদ্ধ, অর্থাৎ মালিন্যহীন। আত্মা বুদ্ধ, অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। আত্মা মুক্তস্বভাবী, আত্মার কোন পরিবর্তনও হয় না। আত্মা সংক্রান্ত এই নিত্যতাবাদী মতবাদ বলা যায় সমস্ত আস্তিক দর্শনেই স্বীকৃত। যেমন ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে আত্মা নিত্যদ্রব্যরূপে পরিচিত। আবার বেদান্তদর্শনে আত্মাকে বলা হয়েছে সৎ, চিৎ ও আনন্দস্বরূপ। অন্যদিকে নাস্তিক জৈন সম্প্রদায় মনে করেন যে, প্রত্যেক জীবের মধ্যে এক অবিনাশী নিত্য আত্মা বর্তমান। তাঁদের মতে জীবের জীবনে দুটি ভিন্ন অংশের সমন্বয় ঘটে। অনিত্য জড়দেহ তার একাংশ এবং নিত্য চেতন আত্মা তার অপরাংশ। জীবের জড়াংশ যে অস্থায়ী ও বিনাশী সে বিষয়ে সকল সম্প্রদায়ই একমত, কিন্তু নিত্য চৈতন্যাংশের অস্তিত্ব বিষয়ে বৈদিক প্রস্থানসমূহ ও জৈনগণের সঙ্গে অবৈদিক চার্বাক ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্য ঘটেছে। জড়বাদী চার্বাকদর্শন মতে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হলো আত্মা।
.
বলাই বাহুল্য, স্থায়ী আত্মার অস্তিত্বের বিরোধী হলেও স্বীকার করেননি। চার্বাকরা চেতনসত্তার ধারণাকে ভ্রান্ত বলে বর্ণনা করে চৈতন্যযুক্ত জড় দেহকেই আত্মা বলেছেন। এইমতে দেহ যতোকাল স্থায়ী তথাকথিত আত্মাও ততোকাল স্থায়ী। কিন্তু বৌদ্ধরা চেতনসত্তার বিরোধী নন। তাঁরা কেবল স্থায়ী সত্তারই বিরোধী। তাঁদের আপত্তি স্থায়িত্বের বিরুদ্ধে, চৈতন্যের বিরুদ্ধে নয়। কারণ চৈতন্যবিশিষ্ট দেহকে আত্মা বলে স্বীকার করলে বৌদ্ধমতে জ্ঞান, প্রত্যভিজ্ঞা, স্মৃতি প্রভৃতির যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়া যায় না। আবার যেহেতু বৌদ্ধমতে নিত্য আত্মার অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ বা অনুমানের দ্বারা প্রমাণ করা যায় না, তাই উপনিষদ প্রভৃতির আত্মতত্ত্ববাদকেও বৌদ্ধরা স্বীকার করেননি। বৌদ্ধমতে জীবের চেতন সত্তা ক্ষণস্থায়ী প্রবাহ বা ধারার ন্যায় পরিবর্তনশীল। প্রতিটি ক্ষণের অনুভূতি একটি কার্য-কারণমালা বা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে বলেই আমাদের মনে একটি স্থায়ী আত্মার ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়।
‘সংযুক্ত নিকায়ে’ বলা হয়েছে, বিনাশশীল দেহ অবিনাশী আত্মা হতে পারে না। আবার ইন্দ্রিয়ানুভূতি, প্রবৃত্তি, বুদ্ধি প্রভৃতির সাহায্যেও অবিনাশী আত্মা গঠিত হতে পারে না, কারণ এগুলি বিনাশশীল। বিনাশশীল উপাদান দিয়ে গঠিত আত্মা অবিনাশী হতে পারে না। ‘মজ্ঝিমনিকায়ে’ বলা হয়েছে, স্থায়ী আত্মার ধারণা অজ্ঞান-প্রসূত ও পরিত্যাজ্য।
.
নিত্যতাবাদীদের আত্মা সম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তকে বুদ্ধ দুইভাগে ভাগ করেছেন- রূপ বিশিষ্ট (ইন্দ্রিয়গোচর) এবং অরূপ। এই দুই মতবাদী দার্শনিকদের কেউ আবার আত্মাকে অনন্ত বলে মানেন, কেউ সান্ত (অনু সদৃশ)। ফলে মহানিদানসূত্ত অনুযায়ী এদেরকেও নিত্যবাদী এবং অনিত্যবাদী এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে (দীঘনিকায়: ২/১৫)।
.
তবে আত্মাবাদের ব্যাখ্যার জন্য বুদ্ধ ‘সৎকায়-দৃষ্টি’ নামে একটি নতুন শব্দ ব্যবহার করেছেন। উল্লেখ্য, বুদ্ধের বোধিবিদ্যা ব্যক্ত করার জন্য সে যুগের প্রচলিত ভাষা তখনো যোগ্য হয়ে ওঠেনি বলে ধারণা করা হয়। তাই নিজের সিদ্ধান্তকে প্রকট করার জন্য তিনি ধর্ম, বস্তু, বিজ্ঞান কিছু প্রাচীন শব্দকে যেমন নব্য অর্থে প্রয়োগ করেছিলেন, তেমনি প্রতীত্য-সমুৎপাদ, সৎকায় প্রভৃতির ন্যায় কিছু নতুন শব্দও সৃষ্টি করেছিলেন। সৎকায় অর্থ কায়ায় বিদ্যমান, অর্থাৎ কায়া হতে অজর অমর সত্তা। সৎকায়ের (আত্মা) ধারণাকে বুদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রে এক কঠিন বাধা বলে মনে করতেন এবং সত্য জ্ঞান লাভের জন্য তা দূর হওয়া সর্বাধিক প্রয়োজনীয় মনে করতেন। বুদ্ধের শিষ্যা পণ্ডিতা ধম্মদিন্না তাঁর এক উপদেশে বলেছেন- ‘পঞ্চ উপাদান-স্কন্দই সৎকায়। এবং সৎকায়-দৃষ্টির কারণ হলো গমনাগমনের তৃষ্ণা।’ (চূলবেদল্লসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়: ১/৫/৪)। এই গমনাগমন হলো পুদ্গল বা আত্মার এক দেহ থেকে অন্য দেহে স্থানান্তরের অবিদ্যাপ্রসূত সংস্কার-ধারণা।
প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব-সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বুদ্ধ অবিদ্যা এবং তৃষ্ণা থেকে মানুষের সমুদয় প্রবৃত্তির ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সৎকায়-দৃষ্টি বা আত্মাবাদের ধারণাকে নৈসর্গিক বলে মানেননি, তাই বলেছেন- ‘নবজাত দুগ্ধপোষ্য শিশুর সৎকায় সম্বন্ধে কোন ধারণা থাকে না, সৎকায়-দৃষ্টি তার কোথা থেকে আসবে ?’ (মহামালুঙ্ক্যসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়: ২/২/৪)
.
বৌদ্ধ মতে সমস্ত পদার্থই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং এই পরিবর্তনই বস্তুর স্বরূপ। যেহেতু সব বস্তুই অনিত্য এবং ক্ষণিক, সেহেতু কোন চিরন্তন আত্মার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। ভারতীয় অধিকাংশ আধ্যাত্ম দর্শনে আত্মাকে যে স্থায়ী বলে স্বীকার করা হয়, এই মতে ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে ও পরে আত্মার অস্তিত্ব টিকে থাকে এবং তা এক শরীর হতে অন্য শরীরে মৃত্যুর পর প্রবেশ করে। এভাবে আত্মার সত্তা পুনর্জন্মের বিচারকে জীবিত রেখেছে। আরো মনে করা হয়, আত্মা আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছার আধারস্বরূপ। কিন্তু বৌদ্ধমতে একটি জীবন থেকে অন্য কোন জীবনে আত্মার প্রবেশ কল্পনা করা সম্ভব নয়, কেবল ঘটনা পরম্পরায় নতুন জীবনের উদ্ভব হয়। বুদ্ধ অস্থায়ী শরীর ও মনের সঙ্কলনমাত্রকে আত্মা বলে স্বীকার করেছেন। কোন এক মুহূর্তে আমাদের মধ্যে যেসব মানসিক প্রক্রিয়াগুলি দেখা যায়, সেই মানসিক প্রক্রিয়াগুলির ধারা বা প্রবাহই (stream of consciousness) হলো আত্মা। চিন্তা, ইচ্ছা, সুখ-দুঃখ প্রভৃতির প্রত্যেকটি ক্ষণকালের জন্য স্থায়ী। চেতনার এই অবিরাম প্রবাহই হলো বৌদ্ধমতে আত্মা। এই প্রবাহের অন্তরালে কোন শাশ্বত বা চিরন্তন সত্তার অস্তিত্ব নেই। এই মতবাদই নৈরাত্ম্যবাদ বা অনাত্মবাদ নামে পরিচিত।
বুদ্ধ অনাত্মা বলতে আত্মার বিপরীতে কোন অভাবাত্ম বস্তু বোঝাতে চাননি। বৈদিক উপনিষদে আত্মাকেই নিত্য ধ্রুব, বস্তু-সত্য বলে মানা হয়েছে। তাই আত্মার অর্থ যদি নিত্য হয়, তাহলে অনাত্মা মানে অ-নিত্য। তাই তিনি একজায়গায় বলেছেন- ‘রূপ অনাত্মা, বেদনা অনাত্মা, সংজ্ঞা …সংস্কার …বিজ্ঞান …সমগ্র ধর্মই অনাত্মা।’- (চূলসচ্চকসূত্ত, মজ্ঝিমনিকায়-১/৪/৫)
.
অনাত্মবাদ মতে স্থায়ী আত্মায় বিশ্বাস করা এক প্রকার ভ্রম। বুদ্ধ শাশ্বত আত্মাকে নিষেধ করে বলেছেন, বিশ্বে না কোন আত্মা বা আত্মার মতো অন্য কোন বস্তু আছে। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়ের আধারস্বরূপ হচ্ছে মন বা মনের বেদনা। এদের অতিরিক্ত আত্মা বা আত্মাসদৃশ কোন বস্তু নেই। বুদ্ধমতে জগতের সমস্ত বস্তু অনিত্য। তিনি অনুগামী শিষ্যদের বারবার উপদেশ দিয়েছেন যেন তাঁরা নিত্য আত্মার ধারণা পরিত্যাগ করেন। আত্মভ্রমে পীড়িত ব্যক্তি প্রকৃত আত্মস্বরূপ জানতে পারে না, তথাপি সে আত্মায় অনুরক্ত হয়। একে তিনি কোন অদৃষ্ট অজ্ঞাত পরম সুন্দরী নারীতে কারো অনুরাগের মতো হাস্যাস্পদ বলে উল্লেখ করেন।
.
নৈরাত্ম্যবাদের দার্শনিক মত বিশ্লেষণ:
অনাত্মবাদ বা নৈরাত্ম্যবাদ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থে বুদ্ধ আত্মার অস্তিত্ব কখনোই অস্বীকার করেন নি। আত্মা বলতে তিনি মানসিক প্রক্রিয়ার অবিরাম ধারা বা প্রবাহকে বুঝিয়েছেন। মূলত শাশ্বত বা চিরন্তন আত্মার অস্তিত্বই এই মতবাদে অস্বীকার করা হয়েছে।
নৈরাত্ম্যবাদ এখানে দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে- (১) মানসিক অবস্থাগুলির আশ্রয় কোন দ্রব্য আত্মা নেই, (২) বাহ্য বস্তুতেও কোন স্থিতিশীল সত্তা বা দ্রব্য নেই।
সুতরাং নৈরাত্ম্যবাদ বলতে বোঝায় জড় ও চেতন- সব স্থায়ী দ্রব্যের সত্তার অস্বীকার। অর্থাৎ বৌদ্ধমতে আত্মা হলো মানসিক ও বাহ্যিক সত্তার সন্তান বা প্রবাহ। এই মতবাদ সন্তানবাদ নামে পরিচিত। দ্বিতীয়ত মানসিক ও বাহ্যিক সত্তা হচ্ছে সংঘাত বা অবস্থার সমষ্টি। এই মতবাদ সংঘাতবাদ নামে পরিচিত। সুতরাং, নৈরাত্ম্যবাদ এবং সংঘাতবাদ বা সন্তানবাদ একই সিদ্ধান্তের দুটি দিক। নঞ্চর্থক দৃষ্টিভঙ্গিতে যা নৈরাত্ম্যবাদ, সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকেই সংঘাতবাদ বলা যেতে পারে।
.
বুদ্ধ অস্থায়ী শরীর ও মনের সঙ্কলনমাত্রকে আত্মা বলেছেন। তাঁর মতে চেতনা বা বিজ্ঞানপ্রবাহই আত্মা। নদীর জলে যেমন বুদ্বুদ নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকলেও তাতে একময়তা থাকে সেরূপ আত্মার বিজ্ঞানের নিরন্তর পরিবর্তন হলেও তাতে একময়তা থাকে। সেকারণে প্রত্যভিজ্ঞান প্রভৃতির অনুপপত্তি হয় না।
.
বৌদ্ধসাহিত্যে এই সংঘাতবাদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে বহু উপাখ্যান প্রচলিত আছে। তবে বৌদ্ধধর্মের উপদেষ্টা দার্শনিক নাগসেন (১৫০ খ্রিষ্টপূর্ব) ভারতে রাজ্য পরিচালনাকারী গ্রীক রাজা ও বিদ্বান দার্শনিক মিলিন্দ (মিনান্দর)-এর সাথে দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যমে বুদ্ধের দর্শনসূত্রের উদাহরণসহ যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, এর মাধ্যমেই নৈরাত্ম্যবাদে আত্মার স্বরূপ তথা সংঘাতবাদের তাৎপর্য আকর্ষণীয়ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। (‘মিলিন্দ প্রশ্ন’: অনুবাদক ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ। সূত্র: দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)।
.
একবার নাগসেন শিয়ালকোট নগরের অসংখ্যেয় নামক মঠে উপস্থিত হলে রাজা মিলিন্দের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। নাগসেন রাজাকে বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যবাদ ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু মিলিন্দ কিছুতেই নৈরাত্ম্যবাদের পূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করতে পারছেন না দেখে নাগসেন রাজাকে প্রশ্ন করেন- আপনি পদব্রজে এসেছেন, না রথে ? উত্তরে রাজা বলেন যে তিনি রথে চড়ে এসেছেন। তখন নাগসেন রাজাকে আবার প্রশ্ন করেন- রথটা কী ? রথের চুড়ো বা চাকা বা রজ্জু বা অন্যান্য অংশ কি আলাদা আলাদাভাবে রথ ? অথবা এর মিলিত রূপই কি রথ ? কিংবা এর অতিরিক্ত কিছুকে কি রথ বলে ? তখন রাজা বুঝতে পারেন যে রথের কোন একটি অংশ রথ পৃথকভাবে রথ নয়। রথ হলো সমস্ত অংশের সংঘাত বা সমাহার। তখন নাগসেন বলেন- একইভাবে আত্মা হলো কতকগুলি স্কন্ধের সংঘাত বা সমাহার। কেবল আত্মাই নয়, প্রত্যেক জড়বস্তুও কতকগুলি স্কন্ধের সংঘাত বা সমাহার। ‘অবয়বীক আধারে যেমন ‘রথ’-এর সংজ্ঞা নির্ণীত হয়, তেমনই (রূপাদি) স্কন্ধ থেকে এক সত্তাকে (জীবকে) বোঝা যায়।’ (সংযুক্তনিকায়: ৫/১০/৬)
.
এই স্কন্ধ পাঁচ প্রকার- রূপ বা দেহ, বেদনা বা সুখ-দুঃখ প্রভৃতির অনুভূতি, সংজ্ঞা বা প্রত্যক্ষ, সংস্কার তথা রাগ দ্বেষ প্রভৃতি পূর্ব অভিজ্ঞতাজাত প্রবণতা এবং বিজ্ঞান বা আলয় বিজ্ঞান ও প্রবৃত্তি বিজ্ঞানের প্রবাহ। আত্মা নামক সংঘাতের নির্মাতা দৈহিক অবস্থাসমূহকে রূপ বলা হয়। অপরপে বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধকে একত্রে বলা হয় মন বা নাম। সুতরাং আত্মা দেহ-মন বা নামরূপের সংঘাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
জীবদেহের কল্পিত পরিচালক বিশেষ কোন আত্মার অস্তিত্বহীনতা বোঝাতে গিয়ে নাগসেন আরো বলেন- ‘…যদি শরীর থেকে ভিন্ন কোন আত্মাই থাকে যে আমাদের দেহের মধ্যে থেকে উক্ত কর্মসমূহ (দর্শন, শ্রবণ, গন্ধানুভব, রসাস্বাদন, স্পর্শানুভব, জ্ঞাত করানো) সম্পাদন করে, তবে তো চক্ষু উৎপাটিত করলে এবং নাসিকা-কর্ণ-জিহ্বা ছেদন করলেও তার দেখতে, শুনতে, গন্ধ অনুভব এবং রসাস্বাদন করতে আরও সক্ষম হওয়া উচিত এবং সংহার করলেও স্পর্শানুভূতি থাকা যুক্তিসংগত। …এরকম কোন কথা নেই (ঘটে না)। …অতএব আমাদের দেহাভ্যন্তরে কোন আত্মার অস্তিত্বও নেই।’ (সংযুক্তনিকায়: ৩/৪/৪৪)
.
বুদ্ধ বিশ্বের মূল উপাদানকে বিজ্ঞান (নাম) এবং বস্তু (রূপ) এই দুই ভাবে বিভক্ত করেছেন। যত স্থূল বস্তু আছে সবই রূপ, এবং যত সূক্ষ্ম মানসিক বস্তু আছে সবই নাম। …উভয়েই পরস্পরাশ্রিত, একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব থাকে না। সর্বদা একত্রে অবস্থিত। সদাই…প্রবহমান। বৌদ্ধমতে সংঘাতরূপ আত্মা একটি মাত্র ক্ষণকাল সৎ। সংঘাত নিয়ত পরিবর্তনশীল। নামরূপাত্মক আত্মা ক্ষণিক ও পরিবর্তনশীল, যেহেতু আত্মার নির্মাতা উপাদানগুলি ক্ষণিক ও পরিবর্তনশীল। নিয়ত পরিবর্তনশীল সংঘাতরূপ আত্মাকে সন্তান বা ধারা বলা হয়।
.
এখন প্রশ্ন আসে, আত্মা যদি মানসিক অবস্থার ধারা বা প্রবাহ হয় তাহলে ব্যক্তির অভিন্নতাকে কিভাবে ব্যাখা করা যাবে ? কারণ শৈশব প্রভৃতি একই ব্যক্তির বিভিন্ন অবস্থা মাত্র।
.
এর উত্তরে বৌদ্ধমত হচ্ছে, যদিও মানুষের মধ্যে কোন অপরিবর্তনীয় সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই, তথাপি আমাদের জীবনের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। প্রতি পূর্ববর্তী অবস্থা একদিকে অন্য অবস্থা থেকে উদ্ভূত। আবার অন্যদিকে পরবর্তী অবস্থা সৃষ্টি করে চলেছে। সুতরাং জীবনের ধারাবাহিকতার মূলে একটা কার্যকারণ সম্বন্ধের যোগসূত্র আছে। বিষয়টিকে একটি আগুনের শিখার দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। সারারাত ধরে একটা প্রদীপ জ্বলতে থাকলে যদিও প্রতিটি মুহূর্তে আমরা প্রদীপের একটিমাত্র শিখাই দেখি, তবুও আসলে যে-কোন মুহূর্তের শিখাই অন্য মুহূর্তের শিখা থেকে আলাদা। কারণ প্রতি মুহূর্তেই প্রদীপের সলতে বা প্রদীপের তেলের ভিন্ন ভিন্ন অংশই পুড়ছে। অনুরূপভাবে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভিন্ন হলেও সমস্ত জীবনের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। ‘এভাবেই কোন বস্তুর অস্তিত্বের শিহরণের মধ্যে এক অবস্থা উৎপন্ন হয়, এক লয় হয়- এইভাবেই প্রবাহ ক্রমান্বিত থেকে যায়। একটি প্রবাহের দুটি অবস্থার মধ্যে কখনও একটি মুহূর্তও স্তব্ধ থাকে না, একের লয়প্রাপ্তির সঙ্গে আর একটির উদ্ভব হয়। এ কারণেই না তা আত্মা (জীব), না অন্য কিছু। এক জীবনের অন্তিম বিজ্ঞানের (চেতনার) লয়প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অন্য আর এক জীবনের প্রথম বিজ্ঞানের সূচনা হয়।’
.
বৌদ্ধ সম্প্রদায় জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জাতকের বহু গল্পে পুনর্জন্মের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, বৌদ্ধমতে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বে অস্বীকার করলে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করা যায় কি ?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, নৈরাত্ম্যবাদী বুদ্ধমতে নিত্য আত্মার নিষেধ করা হলেও জন্মান্তরে বিশ্বাসী। এ মতে পুনর্জন্মের অর্থ এক আত্মার অন্য শরীরে প্রবেশ করা বা চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ নয়, বরং পুনর্জন্মের অর্থ হচ্ছে বিজ্ঞানপ্রবাহের অবিচ্ছিন্নতা। যখন একটি বিজ্ঞানপ্রবাহের অন্তিম বিজ্ঞানটি সমাপ্ত হয় তখন অন্তিম বিজ্ঞানের মৃত্যু হয়, এবং একটি নতুন শরীরে একটি নতুন বিজ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হয়। একে বুদ্ধ পুনর্জন্ম বলেছেন। কেবলমাত্র বর্তমান জীবন থেকে পরবর্তী জীবনের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ কোন আত্মাই নেই যা দেহ পরিবর্তন করে। একমাত্র ব্যক্তির চরিত্রই চলমান থাকে। যে ব্যক্তির পুনর্জন্ম হয়েছে সে মৃত ব্যক্তির কর্মের উত্তরাধিকারী। কিন্তু সে এক নতুন মানুষ। কোন স্থায়ী অভেদ না থাকলে বিনাশ বা বিচ্ছিন্নতাও নেই। নতুন জীব হলো তাই, তার কর্ম তাকে যেরকম করেছে। এক্ষেত্রে বুদ্ধ পুনর্জন্মের ব্যাখ্যায় দীপকজ্যোতির দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেছেন। দুটি প্রদীপ সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও যেমন একটি দীপ হতে অন্য দীপকে প্রজ্বলিত করা যায়, সেরূপ বর্তমান জীবনের অন্তিম অবস্থা হতে ভবিষ্যৎ জীবনের প্রথম অবস্থার বিকাশ সম্ভব। এভাবেই জন্ম থেকে জন্মান্তরের একটি ধারাবাহিকতার স্রোত বয়ে চলেছে যার জন্য কোন সনাতন বা নিত্য আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।
.
অনুরূপভাবে বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে ধারাবাহিকতা মেনে নিয়ে বৌদ্ধমতে স্মৃতির ব্যাখ্যাও সম্ভব। পূর্ববর্তী মানসিক ক্রিয়া থেকেই উৎপন্ন হয় পরবর্তী মানসিক ক্রিয়া। যেহেতু পূর্ববর্তী মানসিক ক্রিয়ার পূর্ণ বিলোপ হয় না, তার ছাপ বা চিহ্ন থেকে যায়। সুতরাং সেটাই স্মৃতিরূপে প্রকট হয় যখন পরবর্তী মানসিক ক্রিয়া চলতে থাকে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাপ রেখে যায় পরবর্তী অভিজ্ঞতার মধ্যে। বৌদ্ধমতে এই স্মৃতির ব্যাখ্যার জন্য কোন স্থায়ী আধারের প্রয়োজন নেই। কোন আধারের মধ্যে মানসিক অভিজ্ঞতাগুলির ছাপ সংরক্ষিত হয় না। আবার এই মতে নৈতিক দায়িত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য এক ও অভিন্ন ব্যক্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
বৌদ্ধদর্শনে নিত্য আত্মার অস্তিত্ব স্বীকৃত নয় বলে তাকে অনাত্মবাদী দর্শন বলে। এমনকি বৌদ্ধদর্শনে পরিবর্তনশীল দৃষ্ট ধর্মের অতিরিক্ত কোন অদৃষ্ট দ্রব্যের সত্তা স্বীকৃত নয়। বুদ্ধ বলেছেন, যদি আত্মাকে নিত্য স্বীকার করা হয় তবে আসক্তি বাড়বে এবং দুঃখ উৎপন্ন হবে। ভ্রান্ত ব্যক্তিই আত্মাকে সত্য বলে মানে, ফলে তার প্রতি আসক্তি বাড়ে। তাঁর মতে আত্মা সম্পর্কে আলোচনা থেকে সবসময় বিরত থাকতে হবে, কারণ এই আলোচনা নিরর্থক।
.
.
বুদ্ধ অস্থায়ী শরীর ও মনের সঙ্কলনমাত্রকে আত্মা বলেছেন। তাঁর মতে চেতনা বা বিজ্ঞানপ্রবাহই আত্মা। নদীর জলে যেমন বুদ্বুদ নিরন্তর পরিবর্তিত হতে থাকলেও তাতে একময়তা থাকে সেরূপ আত্মার বিজ্ঞানের নিরন্তর পরিবর্তন হলেও তাতে একময়তা থাকে। সেকারণে প্রত্যভিজ্ঞান প্রভৃতির অনুপপত্তি হয় না।
.
বৌদ্ধসাহিত্যে এই সংঘাতবাদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে বহু উপাখ্যান প্রচলিত আছে। তবে বৌদ্ধধর্মের উপদেষ্টা দার্শনিক নাগসেন (১৫০ খ্রিষ্টপূর্ব) ভারতে রাজ্য পরিচালনাকারী গ্রীক রাজা ও বিদ্বান দার্শনিক মিলিন্দ (মিনান্দর)-এর সাথে দার্শনিক বিতর্কের মাধ্যমে বুদ্ধের দর্শনসূত্রের উদাহরণসহ যে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন, এর মাধ্যমেই নৈরাত্ম্যবাদে আত্মার স্বরূপ তথা সংঘাতবাদের তাৎপর্য আকর্ষণীয়ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। (‘মিলিন্দ প্রশ্ন’: অনুবাদক ভিক্ষু জগদীশ কাশ্যপ। সূত্র: দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)।
.
একবার নাগসেন শিয়ালকোট নগরের অসংখ্যেয় নামক মঠে উপস্থিত হলে রাজা মিলিন্দের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। নাগসেন রাজাকে বৌদ্ধ নৈরাত্ম্যবাদ ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু মিলিন্দ কিছুতেই নৈরাত্ম্যবাদের পূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করতে পারছেন না দেখে নাগসেন রাজাকে প্রশ্ন করেন- আপনি পদব্রজে এসেছেন, না রথে ? উত্তরে রাজা বলেন যে তিনি রথে চড়ে এসেছেন। তখন নাগসেন রাজাকে আবার প্রশ্ন করেন- রথটা কী ? রথের চুড়ো বা চাকা বা রজ্জু বা অন্যান্য অংশ কি আলাদা আলাদাভাবে রথ ? অথবা এর মিলিত রূপই কি রথ ? কিংবা এর অতিরিক্ত কিছুকে কি রথ বলে ? তখন রাজা বুঝতে পারেন যে রথের কোন একটি অংশ রথ পৃথকভাবে রথ নয়। রথ হলো সমস্ত অংশের সংঘাত বা সমাহার। তখন নাগসেন বলেন- একইভাবে আত্মা হলো কতকগুলি স্কন্ধের সংঘাত বা সমাহার। কেবল আত্মাই নয়, প্রত্যেক জড়বস্তুও কতকগুলি স্কন্ধের সংঘাত বা সমাহার। ‘অবয়বীক আধারে যেমন ‘রথ’-এর সংজ্ঞা নির্ণীত হয়, তেমনই (রূপাদি) স্কন্ধ থেকে এক সত্তাকে (জীবকে) বোঝা যায়।’ (সংযুক্তনিকায়: ৫/১০/৬)
.
এই স্কন্ধ পাঁচ প্রকার- রূপ বা দেহ, বেদনা বা সুখ-দুঃখ প্রভৃতির অনুভূতি, সংজ্ঞা বা প্রত্যক্ষ, সংস্কার তথা রাগ দ্বেষ প্রভৃতি পূর্ব অভিজ্ঞতাজাত প্রবণতা এবং বিজ্ঞান বা আলয় বিজ্ঞান ও প্রবৃত্তি বিজ্ঞানের প্রবাহ। আত্মা নামক সংঘাতের নির্মাতা দৈহিক অবস্থাসমূহকে রূপ বলা হয়। অপরপে বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধকে একত্রে বলা হয় মন বা নাম। সুতরাং আত্মা দেহ-মন বা নামরূপের সংঘাত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
জীবদেহের কল্পিত পরিচালক বিশেষ কোন আত্মার অস্তিত্বহীনতা বোঝাতে গিয়ে নাগসেন আরো বলেন- ‘…যদি শরীর থেকে ভিন্ন কোন আত্মাই থাকে যে আমাদের দেহের মধ্যে থেকে উক্ত কর্মসমূহ (দর্শন, শ্রবণ, গন্ধানুভব, রসাস্বাদন, স্পর্শানুভব, জ্ঞাত করানো) সম্পাদন করে, তবে তো চক্ষু উৎপাটিত করলে এবং নাসিকা-কর্ণ-জিহ্বা ছেদন করলেও তার দেখতে, শুনতে, গন্ধ অনুভব এবং রসাস্বাদন করতে আরও সক্ষম হওয়া উচিত এবং সংহার করলেও স্পর্শানুভূতি থাকা যুক্তিসংগত। …এরকম কোন কথা নেই (ঘটে না)। …অতএব আমাদের দেহাভ্যন্তরে কোন আত্মার অস্তিত্বও নেই।’ (সংযুক্তনিকায়: ৩/৪/৪৪)
.
বুদ্ধ বিশ্বের মূল উপাদানকে বিজ্ঞান (নাম) এবং বস্তু (রূপ) এই দুই ভাবে বিভক্ত করেছেন। যত স্থূল বস্তু আছে সবই রূপ, এবং যত সূক্ষ্ম মানসিক বস্তু আছে সবই নাম। …উভয়েই পরস্পরাশ্রিত, একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব থাকে না। সর্বদা একত্রে অবস্থিত। সদাই…প্রবহমান। বৌদ্ধমতে সংঘাতরূপ আত্মা একটি মাত্র ক্ষণকাল সৎ। সংঘাত নিয়ত পরিবর্তনশীল। নামরূপাত্মক আত্মা ক্ষণিক ও পরিবর্তনশীল, যেহেতু আত্মার নির্মাতা উপাদানগুলি ক্ষণিক ও পরিবর্তনশীল। নিয়ত পরিবর্তনশীল সংঘাতরূপ আত্মাকে সন্তান বা ধারা বলা হয়।
.
এখন প্রশ্ন আসে, আত্মা যদি মানসিক অবস্থার ধারা বা প্রবাহ হয় তাহলে ব্যক্তির অভিন্নতাকে কিভাবে ব্যাখা করা যাবে ? কারণ শৈশব প্রভৃতি একই ব্যক্তির বিভিন্ন অবস্থা মাত্র।
.
এর উত্তরে বৌদ্ধমত হচ্ছে, যদিও মানুষের মধ্যে কোন অপরিবর্তনীয় সত্ত্বার অস্তিত্ব নেই, তথাপি আমাদের জীবনের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। প্রতি পূর্ববর্তী অবস্থা একদিকে অন্য অবস্থা থেকে উদ্ভূত। আবার অন্যদিকে পরবর্তী অবস্থা সৃষ্টি করে চলেছে। সুতরাং জীবনের ধারাবাহিকতার মূলে একটা কার্যকারণ সম্বন্ধের যোগসূত্র আছে। বিষয়টিকে একটি আগুনের শিখার দৃষ্টান্তের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। সারারাত ধরে একটা প্রদীপ জ্বলতে থাকলে যদিও প্রতিটি মুহূর্তে আমরা প্রদীপের একটিমাত্র শিখাই দেখি, তবুও আসলে যে-কোন মুহূর্তের শিখাই অন্য মুহূর্তের শিখা থেকে আলাদা। কারণ প্রতি মুহূর্তেই প্রদীপের সলতে বা প্রদীপের তেলের ভিন্ন ভিন্ন অংশই পুড়ছে। অনুরূপভাবে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভিন্ন হলেও সমস্ত জীবনের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। ‘এভাবেই কোন বস্তুর অস্তিত্বের শিহরণের মধ্যে এক অবস্থা উৎপন্ন হয়, এক লয় হয়- এইভাবেই প্রবাহ ক্রমান্বিত থেকে যায়। একটি প্রবাহের দুটি অবস্থার মধ্যে কখনও একটি মুহূর্তও স্তব্ধ থাকে না, একের লয়প্রাপ্তির সঙ্গে আর একটির উদ্ভব হয়। এ কারণেই না তা আত্মা (জীব), না অন্য কিছু। এক জীবনের অন্তিম বিজ্ঞানের (চেতনার) লয়প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অন্য আর এক জীবনের প্রথম বিজ্ঞানের সূচনা হয়।’
.
বৌদ্ধ সম্প্রদায় জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জাতকের বহু গল্পে পুনর্জন্মের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠে যে, বৌদ্ধমতে শাশ্বত আত্মার অস্তিত্বে অস্বীকার করলে জন্মান্তরবাদ স্বীকার করা যায় কি ?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, নৈরাত্ম্যবাদী বুদ্ধমতে নিত্য আত্মার নিষেধ করা হলেও জন্মান্তরে বিশ্বাসী। এ মতে পুনর্জন্মের অর্থ এক আত্মার অন্য শরীরে প্রবেশ করা বা চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ নয়, বরং পুনর্জন্মের অর্থ হচ্ছে বিজ্ঞানপ্রবাহের অবিচ্ছিন্নতা। যখন একটি বিজ্ঞানপ্রবাহের অন্তিম বিজ্ঞানটি সমাপ্ত হয় তখন অন্তিম বিজ্ঞানের মৃত্যু হয়, এবং একটি নতুন শরীরে একটি নতুন বিজ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হয়। একে বুদ্ধ পুনর্জন্ম বলেছেন। কেবলমাত্র বর্তমান জীবন থেকে পরবর্তী জীবনের উদ্ভব হয়। অর্থাৎ কোন আত্মাই নেই যা দেহ পরিবর্তন করে। একমাত্র ব্যক্তির চরিত্রই চলমান থাকে। যে ব্যক্তির পুনর্জন্ম হয়েছে সে মৃত ব্যক্তির কর্মের উত্তরাধিকারী। কিন্তু সে এক নতুন মানুষ। কোন স্থায়ী অভেদ না থাকলে বিনাশ বা বিচ্ছিন্নতাও নেই। নতুন জীব হলো তাই, তার কর্ম তাকে যেরকম করেছে। এক্ষেত্রে বুদ্ধ পুনর্জন্মের ব্যাখ্যায় দীপকজ্যোতির দৃষ্টান্ত গ্রহণ করেছেন। দুটি প্রদীপ সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও যেমন একটি দীপ হতে অন্য দীপকে প্রজ্বলিত করা যায়, সেরূপ বর্তমান জীবনের অন্তিম অবস্থা হতে ভবিষ্যৎ জীবনের প্রথম অবস্থার বিকাশ সম্ভব। এভাবেই জন্ম থেকে জন্মান্তরের একটি ধারাবাহিকতার স্রোত বয়ে চলেছে যার জন্য কোন সনাতন বা নিত্য আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করার প্রয়োজন নেই।
.
অনুরূপভাবে বিভিন্ন মানসিক অবস্থার মধ্যে ধারাবাহিকতা মেনে নিয়ে বৌদ্ধমতে স্মৃতির ব্যাখ্যাও সম্ভব। পূর্ববর্তী মানসিক ক্রিয়া থেকেই উৎপন্ন হয় পরবর্তী মানসিক ক্রিয়া। যেহেতু পূর্ববর্তী মানসিক ক্রিয়ার পূর্ণ বিলোপ হয় না, তার ছাপ বা চিহ্ন থেকে যায়। সুতরাং সেটাই স্মৃতিরূপে প্রকট হয় যখন পরবর্তী মানসিক ক্রিয়া চলতে থাকে। পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাপ রেখে যায় পরবর্তী অভিজ্ঞতার মধ্যে। বৌদ্ধমতে এই স্মৃতির ব্যাখ্যার জন্য কোন স্থায়ী আধারের প্রয়োজন নেই। কোন আধারের মধ্যে মানসিক অভিজ্ঞতাগুলির ছাপ সংরক্ষিত হয় না। আবার এই মতে নৈতিক দায়িত্ব ব্যাখ্যা করার জন্য এক ও অভিন্ন ব্যক্তিত্ব স্বীকার করার কোন প্রয়োজন নেই।
.
বৌদ্ধদর্শনে নিত্য আত্মার অস্তিত্ব স্বীকৃত নয় বলে তাকে অনাত্মবাদী দর্শন বলে। এমনকি বৌদ্ধদর্শনে পরিবর্তনশীল দৃষ্ট ধর্মের অতিরিক্ত কোন অদৃষ্ট দ্রব্যের সত্তা স্বীকৃত নয়। বুদ্ধ বলেছেন, যদি আত্মাকে নিত্য স্বীকার করা হয় তবে আসক্তি বাড়বে এবং দুঃখ উৎপন্ন হবে। ভ্রান্ত ব্যক্তিই আত্মাকে সত্য বলে মানে, ফলে তার প্রতি আসক্তি বাড়ে। তাঁর মতে আত্মা সম্পর্কে আলোচনা থেকে সবসময় বিরত থাকতে হবে, কারণ এই আলোচনা নিরর্থক।
.
নিরীশ্বরবাদ বা অনীশ্বরবাদ (Atheism)
বুদ্ধের দর্শনে আত্মার মতোই ঈশ্বর বা ব্রহ্মও অস্বীকৃত। বুদ্ধ আত্মার ওপর যত ব্যাখ্যা করেছেন ঈশ্বরবাদের ওপর ততোটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কেননা বুদ্ধের অনিত্যবাদ, নৈরাত্মবাদ তথা প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জগতে অপরিবর্তনীয় স্থির নিত্য শাশ্বত বস্তু বা আত্মার অস্থিত্ব অসৎ প্রমাণের মাধ্যমে ঈশ্বরাস্তিত্বের প্রতিপাদক প্রমাণেরও খণ্ডন করা হয়েছে।
.
বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী সমস্ত কার্যকারণাত্মক জগৎ হচ্ছে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন, অর্থাৎ সংসারের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র এবং পরিবর্তনশীল। ঈশ্বরের পূর্ব-ধারণা থেকে বিশ্বের-স্রষ্টা, ভর্তা, হন্তা প্রভৃতি এক নিত্য-চেতন-ব্যক্তিত্বের যে অর্থ এসে পড়ে, বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদে এ রকম ঈশ্বরের ক্ষমতা তখনই সম্ভব হয় যখন সমস্ত ‘ধর্ম’ (ঘটনা)-এর ন্যায় তিনিও প্রতীত্য-সমুৎপন্ন হন। কিন্তু প্রতীত্য-সমুৎপন্ন হওয়ার পর তাঁর ঈশ্বরত্বই লোপ পায়। অর্থক্রিয়াকারিত্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যা ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক। স্থায়ী বা নিত্য বস্তু ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না অর্থাৎ অসৎ। কেননা অক্ষণিক স্থায়ী বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব নেই। ফলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা ঈশ্বরত্ব প্রতিষেধ হয়ে যায়। এজন্যেই বৌদ্ধদর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শন বলা হয়।
.
উপনিষদে একজনই বিশ্বসৃষ্টিকর্তা পাওয়া যায়।
‘প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছায় তপস্যা করলেন… মিথুন সৃষ্টি করলেন।’ (প্রশ্নোপনিষদ: ১/৩-১৩)
‘ব্রহ্ম…কামনা করলেন। …তপস্যা দ্বারা তিনি এই সর্ব (বিশ্ব) সৃষ্টি করলেন।’ (তৈত্তিরীয়: ২/৩)
‘আত্মাই প্রথমে একমাত্র ছিলেন। …তিনি ইক্ষণ করলেন ‘লোক সৃষ্টি করবো’ …লোক সৃজন করলেন।’ (ঐতরেয়: ১/১)
আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘প্রথমে আত্মাই ছিলেন। …চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও তিনি দ্বিতীয় কাউকে দেখলেন না। …তাঁর শঙ্কা হলো। সেইজন্য মানুষ যখন একাকী থাকে, একটা ভয়-ভাব অনুভব করে, ভীত হয়। …অন্য সঙ্গি কামনা করে। …(বৃহদারণ্যক: ১/৪/২)
.
এই সৃষ্টিকর্তা, ব্রহ্মা, আত্মা, ঈশ্বর …প্রভৃতির কাল্পনিক সত্তাকে বুদ্ধ মোটেও স্বীকার করতেন না। উপনিষদে ব্রহ্মার বিশ্বসৃষ্টির কারণ প্রসঙ্গে ব্রহ্মর নিঃসঙ্গ থাকার ফলে ভয় হওয়া এবং ‘আর কেউ এখানে আসুক’ জাতীয় চাওয়ার সাধারণ প্রাণীসুলভ মানসিক অবস্থাপ্রসূত কারণে দীঘনিকায়, মজ্ঝিমনিকায় বুদ্ধ কর্তৃক ঈশ্বর খণ্ডন করে ব্রহ্মাকে কটাক্ষরত অনেক পরিহাসপূর্ণ কাহিনী রয়েছে। ‘মূলত বুদ্ধ তাঁর যুগের অসংখ্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন অলীক বস্তুতে বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তোমাদের ঈশ্বর নিত্যধ্রুব নন, তিনি সৃষ্টি বা ধ্বংস কিছুই করেন না, সাধারণ প্রাণীর ন্যায় তিনিও জন্ম ও মরণশীল। এই অগণিত দেবগণের মধ্যে তিনিও একজন মাত্র।’ (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
বুদ্ধের মতে এক দৃষ্টিহীনের অনুসরণকারী আরেকজন অন্ধের মতোই ব্রাহ্মণগণ না জেনে শুনেই ঈশ্বর দেবলোক প্রভৃতিতে বিশ্বাস করেন। দীর্ঘনিকায়ে এরকম উল্লেখ পাওয়া যায়, একবার এক বাশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে বলেছিলেন : ‘হে গৌতম! মার্গ অমার্গ বিষয়ে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ, ছন্দারা ব্রাহ্মণ …বিবিধ পথের সন্ধান দেন, তবুও তাঁরা ব্রহ্মার নিকট পৌঁছান। যেমন, গ্রামের কাছে নানা পথ থাকে তবু সব পথই গ্রামের দিকেই যায়।…’
উত্তরে বুদ্ধ বলেন- ‘বাশিষ্ট! …ত্রৈবিদ্য ব্রাহ্মণের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি নিজের চোখে ব্রহ্মাকে দেখেছেন। …এক আশ্চর্য …এক আচার্য-প্রাচার্য …সপ্তপর্যায় ধরেও আচার্যই হতে পারে না …ব্রাহ্মণগণের পূর্বজ ঋষি, মন্ত্রকর্তা, প্রবক্তা …অষ্টক, বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু… এঁদের মধ্যে কেউ কি ব্রহ্মাকে স্বচক্ষে দেখেছেন ? …যাঁকে দেখেননি, জানেননি তাঁরই অস্তিত্ব বিষয়ে উপদেশ করেন। …বাশিষ্ঠ! এ যেন সেই অন্ধগণকে ক্রমপর্যায়ে পঙক্তিবদ্ধ করা; প্রথমজনও দেখতে পায় না, দ্বিতীয়জনও নয়, তৃতীয়জনও নয়… !’ (তেবিজ্জসূত্ত, দীঘনিকায়: ১/১৩)
.
ঋকমন্ত্র রচয়িতা ঋষিদের প্রতি বুদ্ধের এই বিচার থেকেই বুঝা যায় যে, তথাকথিত ব্রহ্মা বা ঈশ্বরসত্তাকে বুদ্ধ কখনোই স্বীকার করেন নি। অর্থাৎ বুদ্ধের দর্শন সম্পূর্ণই নিরীশ্বরবাদী।
নিরীশ্বরবাদের দার্শনিক বিশ্লেষণ:
বৌদ্ধদর্শনে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় নি, বরং ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষের প্রতিপাদক প্রমাণের খণ্ডন করা হয়েছে যুক্তি দিয়ে। বুদ্ধমতে সমস্ত কার্যকারণাত্মক জগৎ হচ্ছে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন। হেতু ও প্রত্যয়কে স্বীকার করেই সমস্ত ধর্মের ধর্মতা সিদ্ধ হয়। সেকারণে বৌদ্ধ সিদ্ধান্তে ঈশ্বর, ব্রহ্ম প্রভৃতি কল্পিত বস্তুর প্রতিষেধ করা হয়েছে।
.
ঈশ্বরবাদীরা বলেন, অভিপ্রেত বস্তুর সিদ্ধির জন্য যে বস্তু থেকে প্রবৃত্ত হয় তা কোন বুদ্ধিমৎকারণে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোন বস্তু বা ঘটনা সৃষ্টির জন্য অন্য কোন বস্তু কারণ হলেও তার পেছনে কোন বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব থাকে। যেমন কাষ্ঠছেদন বা দ্বৈধীকরণের জন্য কুঠারাদি। কুঠারাদি নিজে প্রবৃত্ত হতে পারে না। কেননা স্বয়ং প্রবৃত্ত হলে তা কখনো ব্যাপার হতে নিবৃত্ত হতো না। সেকারণে কোন প্রবর্তক অবশ্যই থাকবে, যে এই কাজটি করিয়ে নেয়। ঘটাদি বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব চেতনাবিশিষ্টের দ্বারা প্রেরিত হয়ে সংঘটিত হয়। ঘট নিজে নিজে সৃষ্ট হতে পারে না, তার পেছনে অবশ্যই একজন মৃৎশিল্পীর সক্রিয় অবদান রয়েছে।
.
এক্ষেত্রে বৌদ্ধ সিদ্ধান্তী বলেন, এটি ইষ্টসিদ্ধি। কারণ এর দ্বারা ঈশ্বর সিদ্ধ হয় না। সিদ্ধান্তে চেতনারূপ কর্ম স্বীকৃত হয়েছে এবং তাতেই সমস্ত পদার্থ অধিষ্ঠিত। অভিধর্মপিটকে বলা হয়েছে যে, কর্মজ হচ্ছে লোকবৈচিত্র্য।
.
এক্ষেত্রে পূর্বপক্ষী ঈশ্বরবাদী বলতে পারেন, লোকবৈচিত্র্য কেবল কর্মজনিত নয়, এই লোকবৈচিত্র্য ঈশ্বরপ্রেরিত ধর্মাধর্ম হতে হয়ে থাকে। সুতরাং ঈশ্বর অস্বীকারকারী বৌদ্ধদের তা ইষ্টসিদ্ধি হতে পারে না।
কিন্তু বৌদ্ধ সিদ্ধান্তীর প্রত্যুত্তর হচ্ছে, সিদ্ধান্তে চেতনারূপ কর্ম স্বীকৃত হওয়ায় চেনতান্তর ঈশ্বর স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই। নইলে তাঁদের স্বীকৃত ঈশ্বরের জন্য অন্য এক ঈশ্বরকে স্বীকার করতে হবে। যদি অজ্ঞতার কারণে কুলালাদির প্রবৃত্তিকে (কুম্ভকারের চক্র ঘুরানো বা ছোটখাটো কাজের জন্য নগন্য লোক নিয়োগ) ঈশ্বরপ্রেরিত বলে স্বীকার করা হয় তবে স্বীকার করতে হবে যে, সুখদুঃখের উৎপত্তিতে সকলক্ষেত্রে অসমর্থ অজ্ঞ জীব ঈশ্বরপ্রেরিত হয়ে স্বর্গ বা নরক ভোগ করে, জীবের কোন স্বাধীনতা নেই। ফলে ঈশ্বর বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্য (বাছবিচারহীন বৈষম্যসৃষ্টিকারী) দোষগ্রস্ত হবে।
.
বুদ্ধমতে ঈশ্বরের সর্বজ্ঞত্ব ও সর্বকর্তৃত্ব অন্যোন্যাশ্রয় দোষগ্রস্ত। অর্থাৎ ঈশ্বরে প্রথমে সর্বকর্তৃত্ব সিদ্ধ হলেই সর্বজ্ঞত্ব সিদ্ধ হবে এবং সর্বজ্ঞত্ব সিদ্ধ হলে সর্বপ্রেরণকর্তৃত্ব সিদ্ধ হবে। অন্যথায় ঈশ্বরের প্রেরকরূপে অন্য এক ঈশ্বর স্বীকার করতে হবে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, সর্বজ্ঞ ঈশ্বর অজ্ঞ জীবকে সসদ্ব্যবহারে প্রবৃত্ত করে কেন ? বিবেকশীল ব্যক্তি লোককে সদুপদেশ দেয়। কিন্তু সর্বকর্তৃত্বময় ঈশ্বর যখন বিপথগামীকে উৎপন্ন করে তখন তাকে কিভাবে প্রমাণ মানা যায় ? ঈশ্বর জীবকে প্রথমে পাপে প্রবৃত্ত করে পরে তা থেকে প্রত্যাবর্তিত করে যে ধর্মাভিমুখী করে তাতে ঈশ্বরের জটিল নির্ঘৃণ বুদ্ধি প্রকাশ পায়। ফলে ঈশ্বরকে করুণাময় বলা যায় না।
.
ঈশ্বরবাদীরা ঈশ্বরকে নিত্য ও পূর্ণ স্বীকার করে জগতের বিভিন্ন সংস্থানবিশেষকে রচনা অর্থাৎ সমুদয় বস্তু ও জীব উৎপন্ন করার জন্য ঈশ্বরের অভিলাষ ও উপাদানগোচরতা প্রভৃতি স্বীকার করেন। কিন্তু বৃক্ষাদিসংস্থান কেবল বীজাদি কারণবিশেষ হতে সম্পন্ন হয়। এর জন্য পুরুষপূর্বকতার প্রয়োজন হয় না। কেননা কোন সুশিক্ষিত চেতন ব্যক্তি বীজজাতীয় বৃক্ষ উৎপন্ন করতে পারে না। যদি ঈশ্বর বটবৃক্ষ উৎপন্ন করে তবে তা বীজাতিরিক্ত কিছু হতে কেন উৎপন্ন করতে পারে না ? সেকারণে স্বীকার করতে হয়, বৃক্ষবীজে নিহিত বৃক্ষসংস্থানই কালক্রমে বৃক্ষরূপে আবির্ভূত হয়।
.
বুদ্ধমতে এই সংসার প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মে সঞ্চালিত হয়। সারা বিশ্ব উৎপত্তি ও বিনাশের নিয়মাধীন। বিশ্ব পরিবর্তনশীল ও অনিত্য। এই নশ্বর ও পরিবর্তনশীল জগতের জন্য নিত্য ও অপরিবর্তনশীল ঈশ্বর স্বীকার করা সঙ্গত নয়। যদি জগতের স্রষ্টারূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় তবে অনেক সমস্যা দেখা দেবে। ঈশ্বর জগতের নির্মাতা হলে সমস্ত বিশ্বের অপরিবর্তনশীলতা ও অবিনাশ স্বীকার করতে হবে। পক্ষান্তরে সমস্ত জগত পরিবর্তনশীল ও অনিত্য। সংসার দুঃখময় বলে এই অপূর্ণ সংসারের রচয়িতা ঈশ্বরকে পূর্ণ বলা সঙ্গত হবে না।
.
প্রশ্ন হচ্ছে, ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টারূপে স্বীকার করলে পূর্ণ ঈশ্বর কিসের প্রয়োজনে তা করবে। যদি কোন প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করে বলে স্বীকার করা হয় তবে তাকে পূর্ণ বলা সমীচীন হবে না, ঈশ্বরের অপূর্ণতা সিদ্ধ হবে। যদি বিশ্বনির্মাণে ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন না স্বীকার করা হয় তবে ঈশ্বরকে পাগল বলতে হবে।
.
বলা হয়েছে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকারে সংসারের ভালো মন্দ কার্যের কারণরূপে তাকে স্বীকার করতে হবে, যার ফলে জীবের স্বাতন্ত্র্যহানি হবে। ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান স্বীকার করলে তার দ্বারা পাপী ব্যক্তিও মহান হবে। এ অবস্থায় চরিত্রনির্মাণে ও ধার্মিক জীবনে মানুষ উদাসীন হবে। তাই বুদ্ধ তার বিরোধ করে সংসারের সত্তা স্বীকার করেছেন। ঈশ্বর ও দেবতার কল্পনায় মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে তার উপর সমস্ত উত্তরদায়িত্ব ত্যাগ করবে। সেকারণে বুদ্ধ কর্মবিধানকে স্বীকার করেছেন। কর্মব্যতিরেকে সংসারে কোন কার্য সম্পন্ন হতে পারে না। বীজ হতে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর হতে যেভাবে বৃক্ষের পরিণতি হয় সংসারের স্বতঃ সৃষ্টিচক্র সেভাবে সংঘটিত হয়। বুদ্ধের মতে সংসারের কারণ হচ্ছে স্বয়ং সংসার, ঈশ্বর সংসারের রচয়িতা নয়।
বুদ্ধমতে সংসার প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মে সঞ্চালিত হয়। বিশ্বের সমস্ত বস্তুর মধ্যে রয়েছে কার্যকারণের এক শৃঙ্খলা, অকারণক কোন বস্তু নেই। জীবজগৎ বস্তুজগৎ মানুষ দেবতা সকল কিছু কার্যকারণের নিয়মাধীন।
.
আস্তিক্যবাদী দার্শনিকরা কারণনিয়মের সঞ্চালকরূপে ঈশ্বর স্বীকার করেন। কিন্তু বুদ্ধ কারণনিয়মের স্রষ্টা সঞ্চালক ঈশ্বরকে স্বীকার করা দোষপূর্ণ মনে করেন। কারণ, আগেই প্রতিপাদিত হয়েছে যে, ঈশ্বর কোন প্রয়োজন পূর্তির জন্য কারণনিয়মের নির্মাণ করলে তার অপূর্ণতা প্রমাণিত হবে। অতএব কারণনিয়মের আধারে ঈশ্বর স্বীকার করা সমীচীন নয়। বুদ্ধ ছিলেন অবশ্যই বুদ্ধিবাদী (rationalist) এবং বুদ্ধিবাদের সমর্থক হওয়ায় ঈশ্বরকে প্রমাণিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। এভাবে বিভিন্ন যুক্তিতে বুদ্ধ নিরীশ্বরবাদকে প্রমাণিত করেছেন এবং শিষ্যদেরকে আত্মনির্ভর হতে প্রোৎসাহিত করে উপদেশ দিয়েছেন তারা যেন কোনভাবেই ঈশ্বরে নির্ভর না করে। ‘আত্মদীপো ভব’ অর্থাৎ ‘নিজেকে নিজের প্রকাশক হও’ এই উপদেশ দিয়ে অনীশ্বরবাদের ঘোষণা করেছেন। (সূত্র: নাস্তিকদর্শনপরিচয়ঃ, ড. বিশ্বরূপ সাহা)
.
বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় (indeterminable questions)
বুদ্ধ ছিলেন মূলত একজন সমাজসংস্কারক, ধর্মপ্রচারক। কিন্তু অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ঈশ্বর, আত্মা, জগৎ প্রভৃতি বিষয়ের দার্শনিক বিচারে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলো না। তাঁর নীতিশিক্ষা পর্যালোচনা করলে তাতে নীতিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতির উপস্থিতি দেখা গেলেও সেখানে তত্ত্বদর্শন বা অধিবিদ্যা অনুপস্থিত। বরং দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হলে তিনি তখন মৌন থেকে আত্মা, জগৎ ইত্যাদি সম্পর্কিত জনপ্রিয় প্রশ্নের প্রতি ঔদাসীন্য প্রকট করেছেন। এই মৌনতার অর্থ হচ্ছে তা ‘অতিপ্রশ্ন’, যার প্রতিপাদন করা কেবল দুরূঢ়ই নয়, অনাবশ্যকও।
এ বিষয়ে বুদ্ধ অতি সুন্দর উপমাসূচক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের আত্মবাদ বিষয়ে ‘দীঘনিকায়ে’র ‘পোট্ঠপাদ সূত্তে’ বলা হয়েছে-
আত্মাকে স্বর্গসুখ ভোগ করতে কে দেখেছে? না দেখে তার অস্তিত্ব স্বীকার করা নিতান্ত উপহাস্যস্পদ। যদি কোন পুরুষ বলে যে, সে এই দেশের যে জনপদকল্যাণী (=দেশের সুন্দরতম স্ত্রী) তাকে চায়। তাতে লোকে তাকে প্রশ্ন করে, যে স্ত্রীকে সে চায় সে কি ক্ষত্রিয়াণী, ব্রাহ্মণী, বৈশ্যস্ত্রী বা শূদ্রী? অমুক নামধারী বা অমুক গোত্রধারী, লম্বা বা বেটে বা মাঝারি? এরূপ প্রশ্নে ‘না’ বললে (তাকে হয়তো নির্বোধ বা পাগল ঠাউরে) কেউ সেই বাক্যের কোন প্রমাণ চায় না। এরূপ আত্মবাদী ব্রাহ্মণবাক্যের প্রমাণ চাওয়া হয় না।
.
দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি আরো সুন্দর। কোন ব্যক্তি প্রাসাদে আরোহণের জন্য চৌরাস্তায় সিঁড়ি বানালে লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ওহে! তুমি যে প্রাসাদের জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো, তুমি কি জানো সেই প্রাসাদটি পূর্ব দিকে, দক্ষিণ দিকে, পশ্চিমদিকে বা উত্তরদিকে? উঁচু, নিচু বা মাঝারি? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বললে তাকে বলা হয় যে, যাকে তুমি জানো না, দেখোনি সেই প্রাসাদে চড়ার জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো? ঐদি এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হাঁ’ বলা হয় তবে কি তার বাক্য প্রমাণশূন্য হবে না?
.
এই উদাহরণের সহায়তায় গৌতম বুদ্ধ দেখিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণদর্শনে প্রতিপাদিত ‘আত্মা’ নামক কোন পদার্থ নেই। কেননা যখন কেউ আত্মাকে দেখেনি, শোনেনি তখন তার অস্তিত্ব কিভাবে স্বীকার করা হয়? পরলোকে সেই আত্মাকে সুখী বানাতে যে উপায় গ্রহণ করা হয় তা কি নিরর্থক নয়? কেননা যার মূল নেই তাকে সিঞ্চন করা প্রয়োজন হয় না।
বুদ্ধ একজন সমাজসংস্কারকই ছিলেন, দার্শনিক নন। তাই যখনই তাঁকে দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হতো তখন তিনি মৌন থেকেছেন।
.
শ্রাবস্তীর জেতবনে বিহার করার সময় মোগ্গলিপুত্ত তিস্স বুদ্ধকে দশটি প্রশ্ন করেছিলেন, যার উত্তরে বুদ্ধ নিস্পৃহ থেকেছিলেন। এগুলোকেই বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় বলা হয়। মজ্ঝিমনিকায় অনুসারে বুদ্ধের অকথনীয় সূচিতে মাত্র দশটি বাক্য আছে, যা লোক (বিশ্ব), আত্মা এবং শরীরের ভেদাভেদ তথা মুক্ত পুরুষের গতি বিষয়ক। এই প্রশ্নগুলো হলো-
(ক) লোক বিষয়ক:
(১) লোক শাশ্বত বা নিত্য (eternal) কি-না ?
(২) লোক কি অনিত্য (non-eternal) ?
(৩) লোক কি সসীম (finite) ?
(৪) লোক কি অসীম (infinite) ?
(খ) দেহাত্মার একতা বিষয়ক:
(৫) আত্মা ও শরীর কি এক ?
(৬) আত্মা ও শরীর কি ভিন্ন ?
(গ) নির্বাণ-পরবর্তী অবস্থা বিষয়ক:
(৭) মৃত্যুর পর তথাগতের কি পুনর্জন্ম হয়েছে ?
(৮) মৃত্যুর পর কি তথাগতের পুনর্জন্ম হয় নি ?
(৯) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি সত্য ?
(১০) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি অসত্য ?
.
বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধের এ মৌনতার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হয়েছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে বুদ্ধের এই নীরবতা তত্ত্ববিষয়ক অজ্ঞানের প্রতীক। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয় এজন্যেই যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তর না জানলে তিনি ‘বুদ্ধ’ সংজ্ঞায় বিভূষিত হতেন না। বুদ্ধ শব্দের অর্থ জ্ঞানী। আবার কারো কারো মতে বুদ্ধ আত্মা, জগৎ, ঈশ্বর ইত্যাদির অস্তিত্বে সন্দিগ্ধ ছিলেন বলে এই মৌনতা তাঁর সংশয়বাদের স্বীকৃতি। কিন্তু তাঁদের এ ধারণা যে সম্পূর্ণই অর্বাচীন তার প্রমাণ হলো বুদ্ধের অনিত্যবাদ, অনাত্মবাদ, নিরীশ্বরবাদের মধ্য দিয়ে এই বহমান জগতের কোনো বস্তুকেই ধ্রুব বা নিত্য বলে স্বীকার না করা।
.
অনেক পণ্ডিত বুদ্ধের মৌন থাকাকে উদ্দেশ্যমূলক আখ্যায়িত করে বলেন, বুদ্ধ ছিলেন সর্বজ্ঞানী। তিনি তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নোত্তর জানতেন এবং মানবজ্ঞানের সীমাও জানতেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় যত প্রশ্ন আছে তাদের নিশ্চিতভাবে উত্তর হয় না। এরকম কোন প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিকরাও এক মত নন। তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নে সৃষ্ট ঝঞ্ঝাট ব্যর্থ বিবাদকে প্রশ্রয় দেয়। কেননা অন্ধগণ স্পর্শ করে হাতির স্বরূপ বর্ণনা করলে সেই বর্ণনা বিরোধাত্মক ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই তিনি তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের প্রতি মৌন থেকে নিস্পৃহতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, সে সব প্রশ্নের উত্তর ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণে নিষ্প্রয়োজন। বুদ্ধমতে এসব অব্যাকৃত প্রশ্নে আগ্রহী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তরে ব্যবহার বা নীতিমার্গের কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
.
বুদ্ধের মতে সংসার দুঃখে পরিপূর্ণ। দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুঃখের সমাপ্তি সন্ধান। সেকারণে তিনি দুঃখের সমস্যা ও দুঃখনিরোধের উপর অধিক জোর দিয়েছেন। তাই মালুঙ্ক্যপুত্ত যখন বুদ্ধকে এই দশ অকথনীয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন- “ভগবন্ ! যদি এ বিষয়ে জানেন …তবে বলুন …না জানলে …বা যিনি জানেন না বা বোঝেন না তাঁকে সরাসরি বলে দেওয়াই যুক্তিসংগত- ‘আমি জানি না।’ …”
বুদ্ধ এর উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন- “…আমি একে অ-কথনীয় …বলেছি, …কারণ …এর সম্বন্ধে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভিক্ষুচর্যা বা ব্রাহ্মচর্যের জন্য যোগ্য নয়। আবার নির্বেদ-বৈরাগ্য, শান্তি …পরম-জ্ঞান ও নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যও এই অ-কথনীয়ের কোনো আবশ্যকতাই নেই; তাই আমি এদের বলেছি অবক্তব্য।” (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
বুদ্ধের মতে ভবরোগে পীড়িত জীব অধ্যাত্মবিষয় নিয়ে কী করবে ? তার কাছে তো কর্তব্য পথ জেনে চলা হচ্ছে জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এজন্যেই বৌদ্ধধর্ম প্রারম্ভে মানুষকে নীতিশাস্ত্রে আগ্রহী করায় তা ‘নৈতিক যথার্থবাদ’ (ethical realism) নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
.
তবে কোন বদ্ধ চিন্তার পাকে আটকে না থেকে স্বাধীন চিন্তার পক্ষেই বুদ্ধের সম্মতি ও উপদেশ পরিলক্ষিত হয়। যেমন (মজ্ঝিমনিকায়-১/২/৩) বুদ্ধ উপদেশ শুরু করেছিলেন এভাবে-
“ভিক্ষুগণ! আমি সেতুর মতো অতিক্রম করার জন্য তোমাদের ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, ধরে রাখার জন্য নয়। …যেমন, একজন পুরুষ …এমন এক বিরাট নদীর ধারে উপস্থিত হলো যার এপার বিপদসঙ্কুল, ভয়পূর্ণ এবং ওপার সুখ-সমৃদ্ধিপূর্ণ তথা ভয়রহিত। অথচ সেখানে যাওয়ার জন্য কোনো তরীও নেই, নেই কোনো সেতু। …তখন সে …তৃণ-কাষ্ঠ …পত্র সংগ্রহ করে সেতু বেঁধে, তার সাহায্যে দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা স্বস্তিপূর্বক নদী পার হলো। …এরপর তার মনে হলো- ‘এই সেতু আমার উপকার করল, এর সাহায্যে …আমি পার হলাম; অতএব এখন একে আমি কেনই বা মাথায় করে অথবা কাঁধে তুলে… নিয়ে যাব না।’ …তবে কি …ঐ পুরুষকে সেতুটির প্রতি কর্তব্য পালনকারী ধরতে হবে? …না…। ভিক্ষুগণ! ঐ পুরুষ সেতুটি থেকে দুঃখকেই আহরণ করবে।”
.
একবার বুদ্ধকে কেশপুত্র গ্রামের কালামো নানা মতবাদে সত্য-মিথ্যা সন্দেহ করে প্রশ্ন করেছিলেন- “প্রভু! কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কেশপুত্র গ্রামে এসে নিজ নিজ মতবাদ প্রকাশ…করেন, অন্যের মতবাদে দ্বি-মত হন, নিন্দা করেন।… অন্যেরাও…স্বীয় মতবাদ প্রকাশ করে…অন্যের মতবাদে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন। অতএব…আমার মনে এরূপ দ্বিধা হয়- এঁদের মধ্যে…কে সত্য বলেন কেই বা মিথ্যা বলেন?’
উত্তরে বুদ্ধ বলেন- “‘কালামো! তোমার সন্দেহই…ঠিক, যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সন্দেহ করেছ। …কালামো! তুমি শ্রুত কথার (বেদের) ভিত্তিতে কারুর কথা মেনে নিও না; তর্কের খাতিরে, বিনা যুক্তিতে, বক্তার ভব্যরূপে মুগ্ধ হয়ে, নিজের পুরনো সিদ্ধান্তের অনুকূল বলে, এই শ্রমণ আমার গুরু’ বলে মেনে না নিয়ে, নিজের বিচারে যা তুমি ধর্মসংগত, উত্তম, নির্দোষ, অনিন্দিত মনে করবে, যাকে গ্রহণ করা হিতকর ও সুখকর বলে জানবে নির্দ্বিধায় তাকে স্বীকার কর।’”
.
এদিকে বুদ্ধের সমসাময়িক বর্ধমান মহাবীরকে সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী বলা হয়, যার প্রভাব পরবর্তীযুগের বৌদ্ধদর্শনের ওপরেও যে পড়েছিলো তা বলা বাহুল্য। তবুও বুদ্ধ স্বয়ং যে সর্বজ্ঞতার ধারণার বিরোধী ছিলেন তা মজ্ঝিমনিকায়ে বুদ্ধের উপদেশেই পরিলক্ষিত হয়-
বাৎস্যগোত্র প্রশ্ন করেছিলেন- “‘প্রভু! শুনেছি শ্রমণ গৌতম সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী… -(যিনি এ কথা বলেন) …তিনি কি যথার্থই বলেন? মিথ্যাচরণ দ্বারা …ভগবানের নিন্দা করেননি তো?’
“বাৎস্য! আমার সম্পর্কে যিনি এরূপ মত পোষণ করেন …তিনি যথার্থ বলেন না। মিথ্যা দ্বারা …আমার নিন্দাই করেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৩/১)
আবার অন্যত্র দেখা যায়, বুদ্ধ বলেছেন- “এমন কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি একেবারেই সব জানবেন ও দেখবেন; অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা হবেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৪/১০)।
বুদ্ধের দর্শনে আত্মার মতোই ঈশ্বর বা ব্রহ্মও অস্বীকৃত। বুদ্ধ আত্মার ওপর যত ব্যাখ্যা করেছেন ঈশ্বরবাদের ওপর ততোটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করেন নি। কেননা বুদ্ধের অনিত্যবাদ, নৈরাত্মবাদ তথা প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জগতে অপরিবর্তনীয় স্থির নিত্য শাশ্বত বস্তু বা আত্মার অস্থিত্ব অসৎ প্রমাণের মাধ্যমে ঈশ্বরাস্তিত্বের প্রতিপাদক প্রমাণেরও খণ্ডন করা হয়েছে।
.
বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদ তত্ত্ব অনুযায়ী সমস্ত কার্যকারণাত্মক জগৎ হচ্ছে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন, অর্থাৎ সংসারের সমস্ত বস্তুর অস্তিত্ব ক্ষণমাত্র এবং পরিবর্তনশীল। ঈশ্বরের পূর্ব-ধারণা থেকে বিশ্বের-স্রষ্টা, ভর্তা, হন্তা প্রভৃতি এক নিত্য-চেতন-ব্যক্তিত্বের যে অর্থ এসে পড়ে, বুদ্ধের প্রতীত্য-সমুৎপাদে এ রকম ঈশ্বরের ক্ষমতা তখনই সম্ভব হয় যখন সমস্ত ‘ধর্ম’ (ঘটনা)-এর ন্যায় তিনিও প্রতীত্য-সমুৎপন্ন হন। কিন্তু প্রতীত্য-সমুৎপন্ন হওয়ার পর তাঁর ঈশ্বরত্বই লোপ পায়। অর্থক্রিয়াকারিত্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যা ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী তাই ক্ষণিক। স্থায়ী বা নিত্য বস্তু ক্রমে অর্থক্রিয়াকারী হতে পারে না অর্থাৎ অসৎ। কেননা অক্ষণিক স্থায়ী বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব নেই। ফলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা ঈশ্বরত্ব প্রতিষেধ হয়ে যায়। এজন্যেই বৌদ্ধদর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শন বলা হয়।
.
উপনিষদে একজনই বিশ্বসৃষ্টিকর্তা পাওয়া যায়।
‘প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছায় তপস্যা করলেন… মিথুন সৃষ্টি করলেন।’ (প্রশ্নোপনিষদ: ১/৩-১৩)
‘ব্রহ্ম…কামনা করলেন। …তপস্যা দ্বারা তিনি এই সর্ব (বিশ্ব) সৃষ্টি করলেন।’ (তৈত্তিরীয়: ২/৩)
‘আত্মাই প্রথমে একমাত্র ছিলেন। …তিনি ইক্ষণ করলেন ‘লোক সৃষ্টি করবো’ …লোক সৃজন করলেন।’ (ঐতরেয়: ১/১)
আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘প্রথমে আত্মাই ছিলেন। …চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেও তিনি দ্বিতীয় কাউকে দেখলেন না। …তাঁর শঙ্কা হলো। সেইজন্য মানুষ যখন একাকী থাকে, একটা ভয়-ভাব অনুভব করে, ভীত হয়। …অন্য সঙ্গি কামনা করে। …(বৃহদারণ্যক: ১/৪/২)
.
এই সৃষ্টিকর্তা, ব্রহ্মা, আত্মা, ঈশ্বর …প্রভৃতির কাল্পনিক সত্তাকে বুদ্ধ মোটেও স্বীকার করতেন না। উপনিষদে ব্রহ্মার বিশ্বসৃষ্টির কারণ প্রসঙ্গে ব্রহ্মর নিঃসঙ্গ থাকার ফলে ভয় হওয়া এবং ‘আর কেউ এখানে আসুক’ জাতীয় চাওয়ার সাধারণ প্রাণীসুলভ মানসিক অবস্থাপ্রসূত কারণে দীঘনিকায়, মজ্ঝিমনিকায় বুদ্ধ কর্তৃক ঈশ্বর খণ্ডন করে ব্রহ্মাকে কটাক্ষরত অনেক পরিহাসপূর্ণ কাহিনী রয়েছে। ‘মূলত বুদ্ধ তাঁর যুগের অসংখ্য কুসংস্কারাচ্ছন্ন অলীক বস্তুতে বিশ্বাসী এবং শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তোমাদের ঈশ্বর নিত্যধ্রুব নন, তিনি সৃষ্টি বা ধ্বংস কিছুই করেন না, সাধারণ প্রাণীর ন্যায় তিনিও জন্ম ও মরণশীল। এই অগণিত দেবগণের মধ্যে তিনিও একজন মাত্র।’ (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
বুদ্ধের মতে এক দৃষ্টিহীনের অনুসরণকারী আরেকজন অন্ধের মতোই ব্রাহ্মণগণ না জেনে শুনেই ঈশ্বর দেবলোক প্রভৃতিতে বিশ্বাস করেন। দীর্ঘনিকায়ে এরকম উল্লেখ পাওয়া যায়, একবার এক বাশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে বলেছিলেন : ‘হে গৌতম! মার্গ অমার্গ বিষয়ে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ, ছন্দারা ব্রাহ্মণ …বিবিধ পথের সন্ধান দেন, তবুও তাঁরা ব্রহ্মার নিকট পৌঁছান। যেমন, গ্রামের কাছে নানা পথ থাকে তবু সব পথই গ্রামের দিকেই যায়।…’
উত্তরে বুদ্ধ বলেন- ‘বাশিষ্ট! …ত্রৈবিদ্য ব্রাহ্মণের মধ্যে এমন একজনও নেই যিনি নিজের চোখে ব্রহ্মাকে দেখেছেন। …এক আশ্চর্য …এক আচার্য-প্রাচার্য …সপ্তপর্যায় ধরেও আচার্যই হতে পারে না …ব্রাহ্মণগণের পূর্বজ ঋষি, মন্ত্রকর্তা, প্রবক্তা …অষ্টক, বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভরদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কাশ্যপ, ভৃগু… এঁদের মধ্যে কেউ কি ব্রহ্মাকে স্বচক্ষে দেখেছেন ? …যাঁকে দেখেননি, জানেননি তাঁরই অস্তিত্ব বিষয়ে উপদেশ করেন। …বাশিষ্ঠ! এ যেন সেই অন্ধগণকে ক্রমপর্যায়ে পঙক্তিবদ্ধ করা; প্রথমজনও দেখতে পায় না, দ্বিতীয়জনও নয়, তৃতীয়জনও নয়… !’ (তেবিজ্জসূত্ত, দীঘনিকায়: ১/১৩)
.
ঋকমন্ত্র রচয়িতা ঋষিদের প্রতি বুদ্ধের এই বিচার থেকেই বুঝা যায় যে, তথাকথিত ব্রহ্মা বা ঈশ্বরসত্তাকে বুদ্ধ কখনোই স্বীকার করেন নি। অর্থাৎ বুদ্ধের দর্শন সম্পূর্ণই নিরীশ্বরবাদী।
বৌদ্ধদর্শনে কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় নি, বরং ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষের প্রতিপাদক প্রমাণের খণ্ডন করা হয়েছে যুক্তি দিয়ে। বুদ্ধমতে সমস্ত কার্যকারণাত্মক জগৎ হচ্ছে প্রতীত্য-সমুৎপন্ন। হেতু ও প্রত্যয়কে স্বীকার করেই সমস্ত ধর্মের ধর্মতা সিদ্ধ হয়। সেকারণে বৌদ্ধ সিদ্ধান্তে ঈশ্বর, ব্রহ্ম প্রভৃতি কল্পিত বস্তুর প্রতিষেধ করা হয়েছে।
.
ঈশ্বরবাদীরা বলেন, অভিপ্রেত বস্তুর সিদ্ধির জন্য যে বস্তু থেকে প্রবৃত্ত হয় তা কোন বুদ্ধিমৎকারণে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোন বস্তু বা ঘটনা সৃষ্টির জন্য অন্য কোন বস্তু কারণ হলেও তার পেছনে কোন বুদ্ধিমান সত্তার অস্তিত্ব থাকে। যেমন কাষ্ঠছেদন বা দ্বৈধীকরণের জন্য কুঠারাদি। কুঠারাদি নিজে প্রবৃত্ত হতে পারে না। কেননা স্বয়ং প্রবৃত্ত হলে তা কখনো ব্যাপার হতে নিবৃত্ত হতো না। সেকারণে কোন প্রবর্তক অবশ্যই থাকবে, যে এই কাজটি করিয়ে নেয়। ঘটাদি বস্তুর অর্থক্রিয়াকারিত্ব চেতনাবিশিষ্টের দ্বারা প্রেরিত হয়ে সংঘটিত হয়। ঘট নিজে নিজে সৃষ্ট হতে পারে না, তার পেছনে অবশ্যই একজন মৃৎশিল্পীর সক্রিয় অবদান রয়েছে।
.
এক্ষেত্রে বৌদ্ধ সিদ্ধান্তী বলেন, এটি ইষ্টসিদ্ধি। কারণ এর দ্বারা ঈশ্বর সিদ্ধ হয় না। সিদ্ধান্তে চেতনারূপ কর্ম স্বীকৃত হয়েছে এবং তাতেই সমস্ত পদার্থ অধিষ্ঠিত। অভিধর্মপিটকে বলা হয়েছে যে, কর্মজ হচ্ছে লোকবৈচিত্র্য।
.
এক্ষেত্রে পূর্বপক্ষী ঈশ্বরবাদী বলতে পারেন, লোকবৈচিত্র্য কেবল কর্মজনিত নয়, এই লোকবৈচিত্র্য ঈশ্বরপ্রেরিত ধর্মাধর্ম হতে হয়ে থাকে। সুতরাং ঈশ্বর অস্বীকারকারী বৌদ্ধদের তা ইষ্টসিদ্ধি হতে পারে না।
কিন্তু বৌদ্ধ সিদ্ধান্তীর প্রত্যুত্তর হচ্ছে, সিদ্ধান্তে চেতনারূপ কর্ম স্বীকৃত হওয়ায় চেনতান্তর ঈশ্বর স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই। নইলে তাঁদের স্বীকৃত ঈশ্বরের জন্য অন্য এক ঈশ্বরকে স্বীকার করতে হবে। যদি অজ্ঞতার কারণে কুলালাদির প্রবৃত্তিকে (কুম্ভকারের চক্র ঘুরানো বা ছোটখাটো কাজের জন্য নগন্য লোক নিয়োগ) ঈশ্বরপ্রেরিত বলে স্বীকার করা হয় তবে স্বীকার করতে হবে যে, সুখদুঃখের উৎপত্তিতে সকলক্ষেত্রে অসমর্থ অজ্ঞ জীব ঈশ্বরপ্রেরিত হয়ে স্বর্গ বা নরক ভোগ করে, জীবের কোন স্বাধীনতা নেই। ফলে ঈশ্বর বৈষম্যনৈর্ঘৃণ্য (বাছবিচারহীন বৈষম্যসৃষ্টিকারী) দোষগ্রস্ত হবে।
.
বুদ্ধমতে ঈশ্বরের সর্বজ্ঞত্ব ও সর্বকর্তৃত্ব অন্যোন্যাশ্রয় দোষগ্রস্ত। অর্থাৎ ঈশ্বরে প্রথমে সর্বকর্তৃত্ব সিদ্ধ হলেই সর্বজ্ঞত্ব সিদ্ধ হবে এবং সর্বজ্ঞত্ব সিদ্ধ হলে সর্বপ্রেরণকর্তৃত্ব সিদ্ধ হবে। অন্যথায় ঈশ্বরের প্রেরকরূপে অন্য এক ঈশ্বর স্বীকার করতে হবে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, সর্বজ্ঞ ঈশ্বর অজ্ঞ জীবকে সসদ্ব্যবহারে প্রবৃত্ত করে কেন ? বিবেকশীল ব্যক্তি লোককে সদুপদেশ দেয়। কিন্তু সর্বকর্তৃত্বময় ঈশ্বর যখন বিপথগামীকে উৎপন্ন করে তখন তাকে কিভাবে প্রমাণ মানা যায় ? ঈশ্বর জীবকে প্রথমে পাপে প্রবৃত্ত করে পরে তা থেকে প্রত্যাবর্তিত করে যে ধর্মাভিমুখী করে তাতে ঈশ্বরের জটিল নির্ঘৃণ বুদ্ধি প্রকাশ পায়। ফলে ঈশ্বরকে করুণাময় বলা যায় না।
.
ঈশ্বরবাদীরা ঈশ্বরকে নিত্য ও পূর্ণ স্বীকার করে জগতের বিভিন্ন সংস্থানবিশেষকে রচনা অর্থাৎ সমুদয় বস্তু ও জীব উৎপন্ন করার জন্য ঈশ্বরের অভিলাষ ও উপাদানগোচরতা প্রভৃতি স্বীকার করেন। কিন্তু বৃক্ষাদিসংস্থান কেবল বীজাদি কারণবিশেষ হতে সম্পন্ন হয়। এর জন্য পুরুষপূর্বকতার প্রয়োজন হয় না। কেননা কোন সুশিক্ষিত চেতন ব্যক্তি বীজজাতীয় বৃক্ষ উৎপন্ন করতে পারে না। যদি ঈশ্বর বটবৃক্ষ উৎপন্ন করে তবে তা বীজাতিরিক্ত কিছু হতে কেন উৎপন্ন করতে পারে না ? সেকারণে স্বীকার করতে হয়, বৃক্ষবীজে নিহিত বৃক্ষসংস্থানই কালক্রমে বৃক্ষরূপে আবির্ভূত হয়।
.
বুদ্ধমতে এই সংসার প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মে সঞ্চালিত হয়। সারা বিশ্ব উৎপত্তি ও বিনাশের নিয়মাধীন। বিশ্ব পরিবর্তনশীল ও অনিত্য। এই নশ্বর ও পরিবর্তনশীল জগতের জন্য নিত্য ও অপরিবর্তনশীল ঈশ্বর স্বীকার করা সঙ্গত নয়। যদি জগতের স্রষ্টারূপে ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় তবে অনেক সমস্যা দেখা দেবে। ঈশ্বর জগতের নির্মাতা হলে সমস্ত বিশ্বের অপরিবর্তনশীলতা ও অবিনাশ স্বীকার করতে হবে। পক্ষান্তরে সমস্ত জগত পরিবর্তনশীল ও অনিত্য। সংসার দুঃখময় বলে এই অপূর্ণ সংসারের রচয়িতা ঈশ্বরকে পূর্ণ বলা সঙ্গত হবে না।
.
প্রশ্ন হচ্ছে, ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টারূপে স্বীকার করলে পূর্ণ ঈশ্বর কিসের প্রয়োজনে তা করবে। যদি কোন প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করে বলে স্বীকার করা হয় তবে তাকে পূর্ণ বলা সমীচীন হবে না, ঈশ্বরের অপূর্ণতা সিদ্ধ হবে। যদি বিশ্বনির্মাণে ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন না স্বীকার করা হয় তবে ঈশ্বরকে পাগল বলতে হবে।
.
বলা হয়েছে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকারে সংসারের ভালো মন্দ কার্যের কারণরূপে তাকে স্বীকার করতে হবে, যার ফলে জীবের স্বাতন্ত্র্যহানি হবে। ঈশ্বরকে সর্বশক্তিমান স্বীকার করলে তার দ্বারা পাপী ব্যক্তিও মহান হবে। এ অবস্থায় চরিত্রনির্মাণে ও ধার্মিক জীবনে মানুষ উদাসীন হবে। তাই বুদ্ধ তার বিরোধ করে সংসারের সত্তা স্বীকার করেছেন। ঈশ্বর ও দেবতার কল্পনায় মানুষ নিষ্ক্রিয় হয়ে তার উপর সমস্ত উত্তরদায়িত্ব ত্যাগ করবে। সেকারণে বুদ্ধ কর্মবিধানকে স্বীকার করেছেন। কর্মব্যতিরেকে সংসারে কোন কার্য সম্পন্ন হতে পারে না। বীজ হতে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর হতে যেভাবে বৃক্ষের পরিণতি হয় সংসারের স্বতঃ সৃষ্টিচক্র সেভাবে সংঘটিত হয়। বুদ্ধের মতে সংসারের কারণ হচ্ছে স্বয়ং সংসার, ঈশ্বর সংসারের রচয়িতা নয়।
বুদ্ধমতে সংসার প্রতীত্য-সমুৎপাদের নিয়মে সঞ্চালিত হয়। বিশ্বের সমস্ত বস্তুর মধ্যে রয়েছে কার্যকারণের এক শৃঙ্খলা, অকারণক কোন বস্তু নেই। জীবজগৎ বস্তুজগৎ মানুষ দেবতা সকল কিছু কার্যকারণের নিয়মাধীন।
.
আস্তিক্যবাদী দার্শনিকরা কারণনিয়মের সঞ্চালকরূপে ঈশ্বর স্বীকার করেন। কিন্তু বুদ্ধ কারণনিয়মের স্রষ্টা সঞ্চালক ঈশ্বরকে স্বীকার করা দোষপূর্ণ মনে করেন। কারণ, আগেই প্রতিপাদিত হয়েছে যে, ঈশ্বর কোন প্রয়োজন পূর্তির জন্য কারণনিয়মের নির্মাণ করলে তার অপূর্ণতা প্রমাণিত হবে। অতএব কারণনিয়মের আধারে ঈশ্বর স্বীকার করা সমীচীন নয়। বুদ্ধ ছিলেন অবশ্যই বুদ্ধিবাদী (rationalist) এবং বুদ্ধিবাদের সমর্থক হওয়ায় ঈশ্বরকে প্রমাণিত করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। এভাবে বিভিন্ন যুক্তিতে বুদ্ধ নিরীশ্বরবাদকে প্রমাণিত করেছেন এবং শিষ্যদেরকে আত্মনির্ভর হতে প্রোৎসাহিত করে উপদেশ দিয়েছেন তারা যেন কোনভাবেই ঈশ্বরে নির্ভর না করে। ‘আত্মদীপো ভব’ অর্থাৎ ‘নিজেকে নিজের প্রকাশক হও’ এই উপদেশ দিয়ে অনীশ্বরবাদের ঘোষণা করেছেন। (সূত্র: নাস্তিকদর্শনপরিচয়ঃ, ড. বিশ্বরূপ সাহা)
.
বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় (indeterminable questions)
বুদ্ধ ছিলেন মূলত একজন সমাজসংস্কারক, ধর্মপ্রচারক। কিন্তু অধিবিদ্যা বা আধ্যাত্মবাদে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই ঈশ্বর, আত্মা, জগৎ প্রভৃতি বিষয়ের দার্শনিক বিচারে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলো না। তাঁর নীতিশিক্ষা পর্যালোচনা করলে তাতে নীতিবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, তর্কশাস্ত্র প্রভৃতির উপস্থিতি দেখা গেলেও সেখানে তত্ত্বদর্শন বা অধিবিদ্যা অনুপস্থিত। বরং দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হলে তিনি তখন মৌন থেকে আত্মা, জগৎ ইত্যাদি সম্পর্কিত জনপ্রিয় প্রশ্নের প্রতি ঔদাসীন্য প্রকট করেছেন। এই মৌনতার অর্থ হচ্ছে তা ‘অতিপ্রশ্ন’, যার প্রতিপাদন করা কেবল দুরূঢ়ই নয়, অনাবশ্যকও।
এ বিষয়ে বুদ্ধ অতি সুন্দর উপমাসূচক দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। ব্রাহ্মণদের আত্মবাদ বিষয়ে ‘দীঘনিকায়ে’র ‘পোট্ঠপাদ সূত্তে’ বলা হয়েছে-
আত্মাকে স্বর্গসুখ ভোগ করতে কে দেখেছে? না দেখে তার অস্তিত্ব স্বীকার করা নিতান্ত উপহাস্যস্পদ। যদি কোন পুরুষ বলে যে, সে এই দেশের যে জনপদকল্যাণী (=দেশের সুন্দরতম স্ত্রী) তাকে চায়। তাতে লোকে তাকে প্রশ্ন করে, যে স্ত্রীকে সে চায় সে কি ক্ষত্রিয়াণী, ব্রাহ্মণী, বৈশ্যস্ত্রী বা শূদ্রী? অমুক নামধারী বা অমুক গোত্রধারী, লম্বা বা বেটে বা মাঝারি? এরূপ প্রশ্নে ‘না’ বললে (তাকে হয়তো নির্বোধ বা পাগল ঠাউরে) কেউ সেই বাক্যের কোন প্রমাণ চায় না। এরূপ আত্মবাদী ব্রাহ্মণবাক্যের প্রমাণ চাওয়া হয় না।
.
দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি আরো সুন্দর। কোন ব্যক্তি প্রাসাদে আরোহণের জন্য চৌরাস্তায় সিঁড়ি বানালে লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ওহে! তুমি যে প্রাসাদের জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো, তুমি কি জানো সেই প্রাসাদটি পূর্ব দিকে, দক্ষিণ দিকে, পশ্চিমদিকে বা উত্তরদিকে? উঁচু, নিচু বা মাঝারি? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বললে তাকে বলা হয় যে, যাকে তুমি জানো না, দেখোনি সেই প্রাসাদে চড়ার জন্য সিঁড়ি বানাচ্ছো? ঐদি এই প্রশ্নের উত্তরে ‘হাঁ’ বলা হয় তবে কি তার বাক্য প্রমাণশূন্য হবে না?
.
এই উদাহরণের সহায়তায় গৌতম বুদ্ধ দেখিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণদর্শনে প্রতিপাদিত ‘আত্মা’ নামক কোন পদার্থ নেই। কেননা যখন কেউ আত্মাকে দেখেনি, শোনেনি তখন তার অস্তিত্ব কিভাবে স্বীকার করা হয়? পরলোকে সেই আত্মাকে সুখী বানাতে যে উপায় গ্রহণ করা হয় তা কি নিরর্থক নয়? কেননা যার মূল নেই তাকে সিঞ্চন করা প্রয়োজন হয় না।
বুদ্ধ একজন সমাজসংস্কারকই ছিলেন, দার্শনিক নন। তাই যখনই তাঁকে দর্শন শাস্ত্রের কোন প্রশ্ন করা হতো তখন তিনি মৌন থেকেছেন।
.
শ্রাবস্তীর জেতবনে বিহার করার সময় মোগ্গলিপুত্ত তিস্স বুদ্ধকে দশটি প্রশ্ন করেছিলেন, যার উত্তরে বুদ্ধ নিস্পৃহ থেকেছিলেন। এগুলোকেই বুদ্ধের দশ অ-কথনীয় বলা হয়। মজ্ঝিমনিকায় অনুসারে বুদ্ধের অকথনীয় সূচিতে মাত্র দশটি বাক্য আছে, যা লোক (বিশ্ব), আত্মা এবং শরীরের ভেদাভেদ তথা মুক্ত পুরুষের গতি বিষয়ক। এই প্রশ্নগুলো হলো-
(ক) লোক বিষয়ক:
(১) লোক শাশ্বত বা নিত্য (eternal) কি-না ?
(২) লোক কি অনিত্য (non-eternal) ?
(৩) লোক কি সসীম (finite) ?
(৪) লোক কি অসীম (infinite) ?
(খ) দেহাত্মার একতা বিষয়ক:
(৫) আত্মা ও শরীর কি এক ?
(৬) আত্মা ও শরীর কি ভিন্ন ?
(গ) নির্বাণ-পরবর্তী অবস্থা বিষয়ক:
(৭) মৃত্যুর পর তথাগতের কি পুনর্জন্ম হয়েছে ?
(৮) মৃত্যুর পর কি তথাগতের পুনর্জন্ম হয় নি ?
(৯) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি সত্য ?
(১০) তথাগতের পুনর্জন্ম হওয়া বা না হওয়া- উভয়ই কি অসত্য ?
.
বিভিন্ন সময়ে বুদ্ধের এ মৌনতার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা হয়েছে। কোন কোন পণ্ডিতের মতে বুদ্ধের এই নীরবতা তত্ত্ববিষয়ক অজ্ঞানের প্রতীক। কিন্তু এ মত গ্রহণযোগ্য নয় এজন্যেই যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তর না জানলে তিনি ‘বুদ্ধ’ সংজ্ঞায় বিভূষিত হতেন না। বুদ্ধ শব্দের অর্থ জ্ঞানী। আবার কারো কারো মতে বুদ্ধ আত্মা, জগৎ, ঈশ্বর ইত্যাদির অস্তিত্বে সন্দিগ্ধ ছিলেন বলে এই মৌনতা তাঁর সংশয়বাদের স্বীকৃতি। কিন্তু তাঁদের এ ধারণা যে সম্পূর্ণই অর্বাচীন তার প্রমাণ হলো বুদ্ধের অনিত্যবাদ, অনাত্মবাদ, নিরীশ্বরবাদের মধ্য দিয়ে এই বহমান জগতের কোনো বস্তুকেই ধ্রুব বা নিত্য বলে স্বীকার না করা।
.
অনেক পণ্ডিত বুদ্ধের মৌন থাকাকে উদ্দেশ্যমূলক আখ্যায়িত করে বলেন, বুদ্ধ ছিলেন সর্বজ্ঞানী। তিনি তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নোত্তর জানতেন এবং মানবজ্ঞানের সীমাও জানতেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, তত্ত্বশাস্ত্রীয় যত প্রশ্ন আছে তাদের নিশ্চিতভাবে উত্তর হয় না। এরকম কোন প্রশ্নের উত্তরে দার্শনিকরাও এক মত নন। তত্ত্বশাস্ত্রের প্রশ্নে সৃষ্ট ঝঞ্ঝাট ব্যর্থ বিবাদকে প্রশ্রয় দেয়। কেননা অন্ধগণ স্পর্শ করে হাতির স্বরূপ বর্ণনা করলে সেই বর্ণনা বিরোধাত্মক ও ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাই তিনি তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের প্রতি মৌন থেকে নিস্পৃহতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে, সে সব প্রশ্নের উত্তর ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণে নিষ্প্রয়োজন। বুদ্ধমতে এসব অব্যাকৃত প্রশ্নে আগ্রহী হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এসব তত্ত্বশাস্ত্রীয় প্রশ্নের উত্তরে ব্যবহার বা নীতিমার্গের কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
.
বুদ্ধের মতে সংসার দুঃখে পরিপূর্ণ। দর্শনের উদ্দেশ্য হচ্ছে দুঃখের সমাপ্তি সন্ধান। সেকারণে তিনি দুঃখের সমস্যা ও দুঃখনিরোধের উপর অধিক জোর দিয়েছেন। তাই মালুঙ্ক্যপুত্ত যখন বুদ্ধকে এই দশ অকথনীয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলেন- “ভগবন্ ! যদি এ বিষয়ে জানেন …তবে বলুন …না জানলে …বা যিনি জানেন না বা বোঝেন না তাঁকে সরাসরি বলে দেওয়াই যুক্তিসংগত- ‘আমি জানি না।’ …”
বুদ্ধ এর উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেন- “…আমি একে অ-কথনীয় …বলেছি, …কারণ …এর সম্বন্ধে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভিক্ষুচর্যা বা ব্রাহ্মচর্যের জন্য যোগ্য নয়। আবার নির্বেদ-বৈরাগ্য, শান্তি …পরম-জ্ঞান ও নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যও এই অ-কথনীয়ের কোনো আবশ্যকতাই নেই; তাই আমি এদের বলেছি অবক্তব্য।” (দর্শন-দিগদর্শন/ রাহুল সাংকৃত্যায়ন)
.
বুদ্ধের মতে ভবরোগে পীড়িত জীব অধ্যাত্মবিষয় নিয়ে কী করবে ? তার কাছে তো কর্তব্য পথ জেনে চলা হচ্ছে জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এজন্যেই বৌদ্ধধর্ম প্রারম্ভে মানুষকে নীতিশাস্ত্রে আগ্রহী করায় তা ‘নৈতিক যথার্থবাদ’ (ethical realism) নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
.
তবে কোন বদ্ধ চিন্তার পাকে আটকে না থেকে স্বাধীন চিন্তার পক্ষেই বুদ্ধের সম্মতি ও উপদেশ পরিলক্ষিত হয়। যেমন (মজ্ঝিমনিকায়-১/২/৩) বুদ্ধ উপদেশ শুরু করেছিলেন এভাবে-
“ভিক্ষুগণ! আমি সেতুর মতো অতিক্রম করার জন্য তোমাদের ধর্মোপদেশ দিচ্ছি, ধরে রাখার জন্য নয়। …যেমন, একজন পুরুষ …এমন এক বিরাট নদীর ধারে উপস্থিত হলো যার এপার বিপদসঙ্কুল, ভয়পূর্ণ এবং ওপার সুখ-সমৃদ্ধিপূর্ণ তথা ভয়রহিত। অথচ সেখানে যাওয়ার জন্য কোনো তরীও নেই, নেই কোনো সেতু। …তখন সে …তৃণ-কাষ্ঠ …পত্র সংগ্রহ করে সেতু বেঁধে, তার সাহায্যে দৈহিক পরিশ্রমের দ্বারা স্বস্তিপূর্বক নদী পার হলো। …এরপর তার মনে হলো- ‘এই সেতু আমার উপকার করল, এর সাহায্যে …আমি পার হলাম; অতএব এখন একে আমি কেনই বা মাথায় করে অথবা কাঁধে তুলে… নিয়ে যাব না।’ …তবে কি …ঐ পুরুষকে সেতুটির প্রতি কর্তব্য পালনকারী ধরতে হবে? …না…। ভিক্ষুগণ! ঐ পুরুষ সেতুটি থেকে দুঃখকেই আহরণ করবে।”
.
একবার বুদ্ধকে কেশপুত্র গ্রামের কালামো নানা মতবাদে সত্য-মিথ্যা সন্দেহ করে প্রশ্ন করেছিলেন- “প্রভু! কোনো কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কেশপুত্র গ্রামে এসে নিজ নিজ মতবাদ প্রকাশ…করেন, অন্যের মতবাদে দ্বি-মত হন, নিন্দা করেন।… অন্যেরাও…স্বীয় মতবাদ প্রকাশ করে…অন্যের মতবাদে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেন। অতএব…আমার মনে এরূপ দ্বিধা হয়- এঁদের মধ্যে…কে সত্য বলেন কেই বা মিথ্যা বলেন?’
উত্তরে বুদ্ধ বলেন- “‘কালামো! তোমার সন্দেহই…ঠিক, যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সন্দেহ করেছ। …কালামো! তুমি শ্রুত কথার (বেদের) ভিত্তিতে কারুর কথা মেনে নিও না; তর্কের খাতিরে, বিনা যুক্তিতে, বক্তার ভব্যরূপে মুগ্ধ হয়ে, নিজের পুরনো সিদ্ধান্তের অনুকূল বলে, এই শ্রমণ আমার গুরু’ বলে মেনে না নিয়ে, নিজের বিচারে যা তুমি ধর্মসংগত, উত্তম, নির্দোষ, অনিন্দিত মনে করবে, যাকে গ্রহণ করা হিতকর ও সুখকর বলে জানবে নির্দ্বিধায় তাকে স্বীকার কর।’”
.
এদিকে বুদ্ধের সমসাময়িক বর্ধমান মহাবীরকে সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী বলা হয়, যার প্রভাব পরবর্তীযুগের বৌদ্ধদর্শনের ওপরেও যে পড়েছিলো তা বলা বাহুল্য। তবুও বুদ্ধ স্বয়ং যে সর্বজ্ঞতার ধারণার বিরোধী ছিলেন তা মজ্ঝিমনিকায়ে বুদ্ধের উপদেশেই পরিলক্ষিত হয়-
বাৎস্যগোত্র প্রশ্ন করেছিলেন- “‘প্রভু! শুনেছি শ্রমণ গৌতম সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী… -(যিনি এ কথা বলেন) …তিনি কি যথার্থই বলেন? মিথ্যাচরণ দ্বারা …ভগবানের নিন্দা করেননি তো?’
“বাৎস্য! আমার সম্পর্কে যিনি এরূপ মত পোষণ করেন …তিনি যথার্থ বলেন না। মিথ্যা দ্বারা …আমার নিন্দাই করেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৩/১)
আবার অন্যত্র দেখা যায়, বুদ্ধ বলেছেন- “এমন কোনো শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নেই, যিনি একেবারেই সব জানবেন ও দেখবেন; অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বদ্রষ্টা হবেন।” (মজ্ঝিমনিকায়-২/৪/১০)।