চার্বাক / লােকায়ত দর্শনের না না বিদ সমস্যা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় the various problem s of carvaka philosophy according to deviprasad chattapadhhayay

চার্বাক / লােকায়ত দর্শনের না না বিদ সমস্যা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় The various problem s of carvaka philosophy according to deviprasad chattapadhhayay





চার্বাক / লােকায়ত দর্শনের রকমারি সমস্যা । 

        চার্বাক নিয়ে অনেক সমস্যা আছে ।
চার্বাক মানে কি ?চার্বাক কি কোনাে ব্যক্তির নাম , নাকি কোনাে সম্প্রদায়ের নাম ?

         সাবেক কালের ভারতীয় দর্শনের ব্যাখ্যায় লেখা একালের নানা বইতে চার্বাক শব্দের প্রধানত দুরকম মানে দাঁড় করাবার চেষ্টা দেখা যায় ।
এক : ‘ চারু বাক্ ’ থেকে চার্বাক । 
দুই : ‘ চর্ব ( অর্থাৎ চর্বণ ) থেকে চার্বাক ।
কিন্তু হাঙ্গামা আছে । ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে কোনােটাই টেকে না।

    ‘ চারু + বাক্‌ ’ থেকে ‘ চারুবাক্ হবার কথা , চার্বাক নয় ।অবশ্য মাবখানের উ ’ - কারটা লুপ্ত হতে পারে ।তাহলেও কিন্তু কথাটা হবে ‘ চারবাক্ বা চার্বাক , অর্থাৎ শব্দটির শেষে ‘ ক ’ - এর হসন্ত বা ‘ ক ’ হবার কথা ।অথচ ভারতীয় দর্শনের সব বইতেই শব্দটি ' অ - কারান্ত ।কোথাওই ' চার্বাক ' লেখা নেই ;সর্বত্রই চার্বাক ।
           তাহলে কি ‘ চব থেকে চার্বাক ?বলা হয় , চর্বণ করে যে ' — এই অর্থে চার্বাক ।কিন্তু ব্যাকরণ অনুসারে ‘ চর্বণ করে যে ' — এই অর্থে চার্বাক ’ শব্দ নিষ্পন্ন হবার কথা , চার্বাক নয় ।মাঝখানে একটা ' আ - কার আসবে কোথা থেকে ?
              অবশ্য ব্যাকরণের কূটকচাল নিয়ে আমাদের আলােচনা নয় ।আমাদের আলােচনা দর্শন বা মতাদর্শ নিয়ে ।সেদিকে থেকে কিন্তু বিশেষ করে নজর দেবার মতাে একটা ব্যাপার এখানে আছে ।ব্যাকরণের বিচারে চার্বাক শব্দের এই দুরকম মানে দাঁড় করাবার চেষ্টায় গলদ থাকলেও , মতাদর্শ বিচারের দিক থেকে কোনােটাই নিরর্থক নয় ।দুরকম চেষ্টার পিছনেই বরং একই উৎসাহ । কীসের উৎসাহ ?ঠেস দেবার বা খোঁচা দেবার উৎসাহ ।কিছুটা সাধু ভাষায় যাকে বলে ব্যঙ্গ - বিদ্রুপ ।চালু কথায় প্রােপাগাণ্ডা ।চারু থেকে চার্বাক ।অর্থাৎ যে - সব কথাবা যার বা যাদের কথা বেশ সুন্দর , চারু ;মনের মতাে কথা , মনকে সহজে টানবার মতাে কথা ।কিন্তু তারিফ নয় , বিদ্রুপ ।আসল বক্তব্যটা এই যে কথাগুলাে নেহাতই আপাত - মনােরম বা আপাত - সুন্দর ।কীরকম কথা ?খাও , দাও , ফুর্তি করাে , পরকাল - পরলােক নিয়ে মাথাব্যথার কোনাে কারণ নেই ;কেননা এসব নেহাতই লােক - ঠকানাে গাল - গল্প ।উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তাৎপর্যটা খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন : “ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ভােগের দিকে ।দর্শনের সিদ্ধান্ত গভীর চিন্তার পর জ্ঞাত সত্য হিসাবে যদি এই সব প্রবৃত্তির সাফাই গাওয়া হয় , তবে সেই সিদ্ধান্ত বহু নরনারীর চিত্ত আকর্ষণ করিবে , ইহাতে আর আশ্চর্য কী ?চার্বাকের অদৃষ্টে সেই বাহবা জুটিয়াছিল ।.প্রবৃত্তির উপাসনার সহায়ক তাহার শ্রুতিসুখকর — সেইজন্য চারু ।কত অনায়াসে মতটাকে হেয় করবার আয়ােজন ।চার্বাক শব্দ থেকেই বােঝা যায় , মতটার মধ্যে মহত্তর আদর্শের বালাই নেই ;বরং একেবারে অধঃপাতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা ।কিংবা , চার্বাকদের সম্বন্ধে বেশ কড়া হুঁশিয়ারি ।ওসব মনভােলানাে কথায় কান দিলে ইহকাল - পরকাল ঝরঝরে হবার আশঙ্কা ।চর্ব থেকে চার্বাক ।এই ধরনের মানে দাঁড় করানাের পিছনেও একই উৎসাহ ।খানাপিনাটুকুই বুঝি পরম পুরুষার্থ ।এর চেয়ে বেশি কিছু বােঝে না এবং অপরকে বুঝতে দিতে চায় না বলেই নাম চার্বাক ।অতএব সাবধান ।এই মত একেবারে সর্বনেশে মত , সরাসরি উচ্ছন্নে পাঠাবার উপদেশ ।তাহলে , ব্যাকরণের বিচারে টিকুক আর নাই টিকুক , দুরকম মানে দাঁড় করাবার পিছনে একই উৎসাহ ।একই বিদ্বেষ ।বিদ্বেষটা শুধু একালের লেখাতেই নয় ।বহু শতাব্দী ধরে বহু গ্রন্থে এই বিদ্বেষের পরিচয় ।রাশিরাশি নজর আছে ।কিন্তু কার বিরুদ্ধে এত বিদ্বেষ ?নিশ্চয়ই একটা দার্শনিক মতের বিরুদ্ধে ।কিন্তু দার্শনিক মতের কথা ভাবতে গেলে মানুষের কথাও ভাবতে হয় — যে বা যারা ওই মতের প্রবর্তক বা সমর্থক ।দার্শনিক মত হাওয়ায় গজায় না ।অর্থাৎ , চার্বাক বলতে একটা দার্শনিক মত বােঝালেও চার্বাক - মতানুসারী মানুষের কথাও ভাবা দরকার । তাহলে প্রশ্ন ওঠে : চার্বাক কি কোনাে ব্যক্তিবিশেষের নাম , নাকি কোনাে সম্প্রদায়ের নাম — যে সম্প্রদায়ের সকলেই চার্বাকপন্থী ? ব্যক্তির নাম মনে করলে অবশ্যই অনেক প্রশ্ন উঠবে । কোথাকার লােক ? কবেকার লােক ? কেননা , দেশটা ছােট নয় । দেশের ইতিহাসও সুদীর্ঘ । তাই স্থান - কাল বাদ দিয়ে কারুর পরিচয়ও পর্যাপ্ত হয় না । আবার , চার্বাক যদি ব্যক্তিবিশেষের নাম না হয়ে সম্প্রদায় - নাম বলেই বিবেচিত হয় , তাহলেও রকমারি প্রশ্ন থেকে সহজে রেহাই পাওয়া যাবে না । কোথাকার সম্প্রদায় ? কবেকার সম্প্রদায় ? আর কি কোনাে শাখা - প্রশাখা বা উপসম্প্রদায় ছিল ? প্রশ্নগুলাে অবশ্যই অবান্তর নয় । এগুলাে একেবারে এড়িয়ে যেতে গেলে চার্বাকের আলােচনা অনেকাংশে অবাস্তব হবার আশঙ্কা । কিন্তু শুরুতেই এসবের বিচারে এগােতে গেলে খানিকটা ফেঁসে যাবারও ভয় থাকে । তার কারণ ছােট করে বলে রাখা যাক । প্রথমেই সবিনয়ে স্বীকার করা দরকার , প্রশ্নগুলাের নির্ভুল উত্তর এখনাে পাওয়া যায়নি । ইতিহাসের গবেষণা আরাে গভীর হলে ভবিষ্যতে এসব সমস্যার কোনাে কিনারা হবে কিনা তা নিয়ে এখুনি মাথা ঘামিয়েও লাভ নেই । তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে হাল - আমলের বিদ্বারা সমস্যাগুলাের আলােচনা করেননি । অনেকেই করেছেন অনেক রকম আলােচনা । এবং বিদ্বান হিসেবে তাদের অনেকের নাম এমনই শ্রদ্ধেয় , যাদের কথা উড়িয়ে দেওয়া বেশ কিছুটা দুঃসাহসের ব্যাপার । কিন্তু মুস্কিল এই যে তাদের পরস্পরের মধ্যেও মিল নেই ; একের কথা অপরে অনেক সময় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন , অনেক সময় একেবারে বরবাদ করে দিতে চেয়েছেন । তার একটা কারণও আছে । তাদের মন্তব্য সব সময় ঠিক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তর মতাে নয় , বা সিদ্ধান্ত হিসেবে এগুলি ঠিক বৈজ্ঞানিক মর্যাদার দাবিদার নয় । প্রায়ই বেশ কিছুটা জল্পনা - কল্পনার মতাে । যৎসামান্য তথ্য থেকে বড়সড় কথা প্রমাণ করার উৎসাহও চোখে পড়ে । তথ্য নিয়েও হাঙ্গামা আছে । প্রায়ই যে - কথা চার্বাক সংক্রান্ত তথ্য বলে ধরে নেওয়া হয় , তা হয়তাে তথ্যই নয় , তথ্য - বিকৃতি , কখনাে - বা নেহাতই বিরুদ্ধ প্রচার । যাকে বলে প্রােপাগাণ্ডা । পরে দেখবাে , চার্বাকদের বিরুদ্ধে প্রােপাগাণ্ডার বহর কতখানি , আর তার পিছনে আসল উৎসাহটাও কেন অতি প্রবল । হাঙ্গামা আরাে আছে । পুরােনাে পুঁথিপত্রে চার্বাক প্রসঙ্গে যে - সব কথা লেখা আছে , তার মধ্যে অনেক সময় অন্তত আপাতদৃষ্টিতে মিল খুঁজে পাওয়াও কঠিন । এইসব নানা কারণে প্রাচীন চার্বাক নিয়ে আধুনিক বিদ্বানদের বিবিধ ও বিচিত্র সিদ্ধান্ত । প্রায়ই পরস্পর - বিরুদ্ধ সিদ্ধান্তও । এই কারণে শুধু তাদের বিদ্যার নজির থেকেই সিদ্ধান্তর সার্থকতা অনুমান করা নিরাপদ নয় । সােজা কথায় অনেক তর্ক আছে । তর্ক আরাে বাড়ানাে যায় । কিন্তু শুরুতেই সে - সবের আলােচনা তুলতে গেলে সমস্যাগুলাে আরাে ঘােলাটে হবার ভয় । যেটুকু মােটের উপর সুনিশ্চিত এবং বিশেষ করে আজকের দিনে চার্বাক নিয়ে আলােচনার যেটা আসল তাগিদ তাও রকমারি বিতর্কের আর পুঁথি - বিচারের অলিগলিতে হারিয়ে যাবার ভয় । 

কথাটা আরাে একটু স্পষ্ট করে বলবার চেষ্টা করা যাক । চার্বাক মানে কী , চার্বাক কোনাে ব্যক্তির নাম না সম্প্রদায়ের নাম — এই সব প্রশ্ন নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকলেও , অন্তত একটি বিষয়ে তর্ক তােলর বড় একটা সুযােগ নেই । কী বিষয়ে ? 

আনুমানিক খ্রীস্টীয় অষ্টম শতক থেকে প্রসিদ্ধ ভারতীয় দার্শনিকদের মধ্যে একটি প্রথা প্রায় অবিচল হয়ে দাঁড়ায় । এই প্রথা অনুসারে , চার্বাক বলতে আমরা একরকম আপসহীন বস্তুবাদী দর্শন বা তার প্রবক্তা বস্তুবাদী দার্শনিক বুঝতে বাধ্য । খ্রীস্টীয় অষ্টম শতক থেকে কেন বলছি এবং তার আগে এই দার্শনিক মতের কোনাে পরিচয় পাওয়া যায় কিনা — এসব কথা তােলবার আগে দার্শনিক পরিভাষা প্রসঙ্গে কিছুটা আলােচনা সেরে নেওয়া ভালাে ।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال