‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কথাটি ব্যাপক। এ কারণে এর বিষয়বস্তুর সীমা নির্দিষ্ট করা কষ্টকর। সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে সৌন্দর্যানুভূতি, শিপ্লকলার বিচার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য প্রভৃতি সমস্যাকে সাধারণত অন্তর্ভূক্ত মনে করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সঙ্গে নীতিশাস্ত্রেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ-ক্ষেত্রে সমাজ-সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনে সৌন্দর্যতত্ত্বের ভূমিকা আলোচিত হয়।
সাধারণভাবে সৌন্দর্যানুভুতিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আদিম অনুভূতি বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির মোকাবেলায় আদিমকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। এরুপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনো কোনোটি মানুষের মনের আবেগময় প্রতিক্রিয়া। এই আবেগময় প্রতিক্রিয়ার মূলে মানুষের জীবন রক্ষার অচেতন জৈবিক প্রয়োজনই আদিকালে সমধিক কাজ করেছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা এবং শক্তির প্রকাশকে আপন জীবন রক্ষার সহায়ক কিংবা ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করেছে। এ সমস্ত শক্তিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মনে জাগরূক রাখার সে চেষ্টা করেছে। এই আদিম বোধ থেকেই আদি শিল্পকার্যের সৃষ্টি। এই উৎস থেকে সামাজিক ভালোমন্দ বোধেরও উৎপত্তি।
মানুষের নিজের জীবনের মতোই সৌন্দর্যানুভূতির ইতিহাস দীর্ঘ। সভ্যতার জটিল বিকাশের ধারায় সৌন্দর্যতত্ত্বকেও প্রাথমিক যুগে সহজ এবং আধুনিককালে জটিল এবং অবাস্তবের লক্ষণযুক্ত দেখা যায়।
কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তির মনের আবেগময় অনুভূতি এবং তার ভাষাগত প্রকাশ ব্যতীত শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত এবং অন্যান্য মানবিক সৃষ্টিকে সুন্দর কিংবা অসুন্দর এবং ভালো কিংবা মন্দ হিসাবে বিচারের প্রয়াসকে সৌন্দর্যতত্ত্ব বলে অভিহিত করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্ব বলতে উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে বিশেষ কোনো তত্ত্বকে বুঝায় না। এর দ্বারা উপরোক্ত বিষয়গুলির উপরে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা ভাবধারার কথা বুঝায়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সামগ্রকি আলোচনায় সুন্দর এবং অসুন্দরের অথবা ভালৌ এবং মন্দের কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ কিংবা মানদণ্ড আছে কিনা সে প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করা হয়।
সৌন্দর্য়তত্ত্বের উদ্ভব প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলন, মিসর, ভারতবর্ষ এবং চীনের দাস-প্রধান সমাজে লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে গ্রিসের হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিসস্টটল এবং অপরাপর দার্শনিকের রচনায় সৌন্দর্যতত্ত্বের জটিলতর বিকাশের আমরা সাক্ষাৎ পাই। প্রাচীন রোমের দার্শনিক লুক্রেশিয়াস এবং হোরেসও সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। মধ্যযুগে সেণ্ট অগাস্টিন এবং টমাস একুইনাস প্রমুখ ধর্মতাত্ত্বিকগণ সৌন্দর্যতত্ত্বে রহস্যবাদের আমদানি করেন। তাঁদের মতে, জগতাতীত এক ঐশ্বরিক সুন্দরের অস্তিত্ব রয়েছে। সেই ঐশ্বরিক সুন্দরের মানদণ্ডেই জাগতিক বস্তুনিচয়ের সৌন্দর্য পরিমাপ করতে হবে। মধ্যযুগের এই রহস্যবাদের প্রতিক্রিয়া ঘটে পরবর্তীকালে নব-জাগরণের চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকগণের মধ্যে। এঁদের মধ্যে পেতরার্ক, আলবার্ট, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, দুরার,ব্রুনো এবং মণ্টেনের নাম বিখ্যাত। পাশ্চাত্যের নব-জাগরণের পরবর্তী জ্ঞানাস্বেষণের যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে বার্ক, হোগার্ত, ডিডেরক, রুশো, লেসিং প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন। মানবতাবাদের এই ঐতিহ্যকে বহন করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে শিলার এবং গ্যেটে ঘোষণা করেন যে, সৌন্দর্য এবং শিল্পের উৎস হলো মানুষ এবং তার বাস্ত জীবন।
সৌন্দর্যতত্ত্বের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ সব যুগেই পাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে সৌন্দর্য সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা; অপরটি ভাববাদী। ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব সৌন্দর্যকে অতি-প্রাকৃতিক একটি সত্তা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অতি-প্রাকৃতিক এই সত্তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং সিদ্ধির অতীত। সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই মাত্র এই নিকষ সুন্দরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এরূপ ব্যাখ্যায় ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং সুন্দরের ধর্মীয় রহস্যবাদী কল্পনায় কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার মোহ আবদ্ধ রাখার প্রয়াস সমাজের শক্তিমান শ্রেণীগুলো সব যুগেই করে এসেছে। সৌন্দর্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শনের অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নের ন্যায় ভাববাদের বিরোধী ব্যাখ্যা হচ্ছে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মানুষের বাস্তব পরিবেশ এবং জীবনের মধ্যেই সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি এবং বিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধ সমাজের শোষক এবং শোষিতের বাস্তব বিরোধের ভাবগত প্রতিফলন।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সৌন্দর্যতত্ত্বে তিনটি প্রশ্ন মূল (১) বস্তুজগতে সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং বিকাশ; (২) মনোজগতে সৌন্দর্যানুভূতির ব্যাখ্যা, এবং (৩) শিল্পকর্মের মূল্যায়ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের প্রবহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের ধারাতে ক্রমাধিক পরিমাণে আনন্দজনক জীবনযাপনের তাগিদে সুন্দর, অসুন্দর, মহৎ, হীন, হর্ষ এবং বিষাদ প্রভৃতি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাপকতার দিক থেকে সৌন্দর্যতত্ত্ব কেবল শিল্পকলার সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করে না। শিল্পকলার সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি প্রয়োগগত দিক মাত্র। ব্যাপকভাবে সৌন্দর্যতত্ত্বের আলোচ্য হচ্ছে মানুষ। তার সৃজনশীল ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশে, মহতের জন্য জীবন উৎসর্গে, দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামে যে আনন্দানুভূতি সে বোধ করে কিংবা বর্বরতার আঘাতে যে ঘৃণা তার মনে উদ্ভূত হয়, তার বিকাশ-প্রক্রিয়া এবং বৈশিষ্ট্য।
তথ্যসূত্র
১. সরদার ফজলুল করিম; দর্শনকোষ; প্যাপিরাস, ঢাকা; জুলাই, ২০০৬;