নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন: প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্তের পাঠ্যপুস্তকের একটি পরিচিতি

 

নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন: প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্তের পাঠ্যপুস্তকের একটি পরিচিতি


নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন: প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্তের পাঠ্যপুস্তকের একটি পরিচিতি

ভূমিকা

দর্শনের জগতে, নীতিবিজ্ঞান এবং ভারতীয় দর্শন বোঝা ছাত্র-ছাত্রী এবং দর্শনপ্রেমীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্তের নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন বইটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বি-বার্ষিক স্নাতক কোর্সের জন্য একটি অপরিহার্য পাঠ্যপুস্তক। এই ব্লগ পোস্টটি এই বইয়ের মূল বিষয়গুলির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি প্রদান করবে, যা জটিল দার্শনিক ধারণাগুলিকে সহজ এবং বোধগম্য করে তুলেছে।

লেখক সম্পর্কে

প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত বীরভূমের হেতমপুরে অবস্থিত কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের একজন বিশিষ্ট দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক। তিনি দর্শনের বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তাঁর লেখার স্পষ্টতা এবং গভীরতা জটিল দার্শনিক ধারণাগুলিকে সহজবোধ্য করে তোলে। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে মনোবিদ্যা ও সমাজ দর্শন এবং শিক্ষা-মনোবিজ্ঞান

বইটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ

নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন বইটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বি-বার্ষিক স্নাতক কোর্সের পাঠ্যক্রম অনুসারে রচিত। এটি দুটি প্রধান অংশে বিভক্ত:

  1. নীতিবিজ্ঞান: এই অংশে নৈতিকতার স্বরূপ, নৈতিক ও অনৈতিক ক্রিয়া, নৈতিক বিচারের ভিত্তি এবং বিভিন্ন নৈতিক তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
  2. ভারতীয় দর্শন: এই অংশে ভারতের প্রাচীন দার্শনিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন শাখা, যেমন ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, যোগ, মীমাংসা, বেদান্ত, বৌদ্ধ এবং জৈন দর্শন নিয়ে আলোচনা করা হয়।

বইটি সহজ ও স্পষ্ট ভাষায় লেখা, যাতে শিক্ষার্থীরা সহজেই জটিল ধারণাগুলি বুঝতে পারে। বাংলা পরিভাষার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা পাঠকদের জন্য বিষয়টিকে আরও বোধগম্য করে তুলেছে।

নীতিবিজ্ঞান অংশের বিস্তারিত আলোচনা

নীতিবিজ্ঞান অংশটি নৈতিকতার মৌলিক প্রশ্নগুলির উপর আলোকপাত করে। এটি নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা, স্বরূপ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করে। নীচে এই অংশের মূল বিষয়গুলির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল:

নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ

নীতিবিজ্ঞান হল এমন একটি শাস্ত্র যা মানুষের আচরণের সঠিক ও ভুল দিকগুলি বিশ্লেষণ করে। বইটি নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা প্রদান করে এবং এটি বিজ্ঞান না দর্শনের অংশ কিনা তা নিয়ে আলোচনা করে। এটি নীতিবিজ্ঞানের পরিধি এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।

নৈতিক ও অনৈতিক ক্রিয়া

বইটি নৈতিক এবং অনৈতিক ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য ব্যাখ্যা করে। শুধুমাত্র ঐচ্ছিক ক্রিয়াগুলিই নৈতিক বিচারের বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অংশে কামনা, ইচ্ছা এবং সঙ্কল্পের মতো ধারণাগুলির বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

নৈতিক বিচারের ভিত্তি

নৈতিক বিচার কীভাবে করা হয় এবং এর বিষয়বস্তু কী, তা নিয়ে বইটি বিস্তারিত আলোচনা করে। এটি নৈতিক বিচারের পদ্ধতি এবং এর সঙ্গে তর্কবিজ্ঞান ও সৌন্দর্যবিজ্ঞানের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করে।

নৈতিক তত্ত্ব

বইটি বিভিন্ন নৈতিক তত্ত্বের উপর আলোকপাত করে, যেমন:

  • সুখবাদ: এই তত্ত্ব অনুসারে, আনন্দই জীবনের পরম কল্যাণ। এটি মনস্তাত্ত্বিক সুখবাদ এবং নৈতিক সুখবাদে বিভক্ত।
  • উপযোগবাদ: এটি বলে যে সর্বাধিক মানুষের জন্য সর্বাধিক সুখ উৎপন্নকারী ক্রিয়াই নৈতিক।
  • পূর্ণতাবাদ: এটি মানুষের গুণাবলী এবং শ্রেষ্ঠত্বের বিকাশের উপর জোর দেয়।
  • বিবর্তনসম্মত সুখবাদ: এটি বিবর্তনবাদের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে।
  • কৃচ্ছতাবাদ: কান্টের বিচারবাদের উপর ভিত্তি করে, এটি কর্তব্য এবং নৈতিক নিয়মের উপর জোর দেয়।

নীচে নীতিবিজ্ঞান অংশের মূল অধ্যায়গুলির একটি সারণী দেওয়া হল:

অধ্যায় বিষয় পৃষ্ঠা
প্রথম অধ্যায় নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতি ৩-২৫
দ্বিতীয় অধ্যায় নীতি-সম্বন্ধীয় এবং নীতিবহির্ভূত ক্রিয়া ২৬-৪০
তৃতীয় অধ্যায় নৈতিক বিচারের স্বরূপ ও বিষয়বস্তু ৪১-৫০
চতুর্থ অধ্যায় নৈতিক আদর্শ: সুখবাদ, কৃচ্ছতাবাদ ও পূর্ণতাবাদ ৫১-৫৭
পঞ্চম অধ্যায় সুখবাদ ৫৮-৯০
ষষ্ঠ অধ্যায় বিবর্তনসম্মত সুখবাদ ৯১-১০২
সপ্তম অধ্যায় কৃচ্ছতাবাদ ১০৩-১১৭
অষ্টম অধ্যায় পূর্ণতাবাদ ১১৮-১৩১

ভারতীয় দর্শন অংশ

ভারতীয় দর্শন অংশে ভারতের প্রাচীন দার্শনিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করা হয়। যদিও প্রদত্ত পাঠে এই অংশের বিস্তারিত সূচীপত্র নেই, তবে এই ধরনের পাঠ্যপুস্তকে সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকে:

  • ন্যায়: জ্ঞানতত্ত্ব এবং তর্কশাস্ত্রের উপর জোর দেয়, প্রমাণের উপায় (প্রমাণ) নিয়ে আলোচনা করে।
  • বৈশেষিক: অধিবিদ্যার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, পদার্থ এবং তাদের গুণাবলী নিয়ে আলোচনা করে।
  • সাংখ্য: দ্বৈতবাদী দর্শন, যা পুরুষ (চেতনা) এবং প্রকৃতি (জড়) নামে দুটি মৌলিক বাস্তবতার কথা বলে।
  • যোগ: সাংখ্যের অধিবিদ্যার উপর ভিত্তি করে, মুক্তির জন্য যোগাভ্যাসের উপর জোর দেয়।
  • মীমাংসা: বৈদিক গ্রন্থের ব্যাখ্যা এবং ধর্মের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
  • বেদান্ত: উপনিষদ এবং ব্রহ্মের ধারণার উপর কেন্দ্রীভূত, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত এবং দ্বৈতের মতো উপ-শাখা নিয়ে আলোচনা করে।
  • বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন: যদিও এগুলি বৈদিক প্রমাণ স্বীকার করে না, তবুও ভারতীয় দর্শনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
  • চার্বাক (লোকায়ত): জড়বাদী দর্শন, যা প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর জোর দেয়।

এই শাখাগুলি বাস্তবতা, জ্ঞান এবং নীতিশাস্ত্রের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, যা ভারতীয় দর্শনের বৈচিত্র্য এবং গভীরতা প্রদর্শন করে।

বইটির গুরুত্ব

এই বইটি শুধুমাত্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বরং যে কোনো দর্শনপ্রেমীর জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। এটি জটিল ধারণাগুলিকে সহজ ভাষায় উপস্থাপন করে, যা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমের প্রয়োজন মেটাতে এবং সাধারণ পাঠকদের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাতে সহায়ক। বইটির প্রকাশক, ব্যানার্জী পাবলিশার্স, এটিকে ১৯৭৯ সালে প্রকাশ করেছিলেন, এবং এটি এখনও শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়।

মেটা ডেসক্রিপশন

প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্তের নীতিবিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন বইটির মূল বিষয়গুলির একটি পরিচিতি। এই ব্লগ পোস্টটি নীতিবিজ্ঞান এবং ভারতীয় দর্শনের জটিল ধারণাগুলিকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করে, যা শিক্ষার্থী এবং দর্শনপ্রেমীদের জন্য আদর্শ।

ট্যাগ

  • নীতিবিজ্ঞান
  • ভারতীয় দর্শন
  • দর্শন পাঠ্যপুস্তক
  • কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
  • প্রমোদবন্ধু সেনগুপ্ত
  • নৈতিক দর্শন
  • সুখবাদ
  • উপযোগবাদ
  • পূর্ণতাবাদ
  • ন্যায়
  • বেদান্ত
  • সাংখ্য
  • যোগ
  • মীমাংসা
  • বৌদ্ধ দর্শন
  • জৈন দর্শন

উৎস

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال