নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা, ধারণা , স্বরূপ বা প্রকৃতি ,পরিধি | Definition, concept, nature or scope of ethics |
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতি
(Nature of Ethics)
১। ভুমিকা (Introduction):
আমরা অনেক সময় এরকম বলে থাকি, 'রামের এ কাজ করা উচিত হয়নি'; 'মধু ঠিক কাজই করেছে'; 'শ্যামের ব্যবহার ভাল', 'যদুর স্বভাব খারাপ'; 'দুঃস্থ লোককে সাহায্য করা উচিত', 'সত্য কথা বলা সব সময়ই ভাল' ইত্যাদি। আমরা যখন এরকম কথা বলি তখন অনেক সময় দেখি অনেকে আমাদের এসব কথা মেনে নিতে রাজী হন না; কোন কোন ক্ষেত্রে কেউ কেউ আবার আমাদের মতকে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। যখন আমি বলি, 'রাম খুব ভাল লোক' এবং আমার কোন বন্ধু বলে, 'রাম মোটেই ভাল লোক নয়,' তখন বুঝতে হবে, কোন-না-কোন কারণে সে আমার সঙ্গে একমত হতে পারছে না। হয়ত সে রামের সম্পর্কে এমন কোন কথা জানে যা আমার জানা নেই এবং এ সকল কথা জানলে আমিও হয়ত রামের সম্পর্কে আমার
ভাল ও মন্দ, উচিত ও অনুচিত প্রভৃতির পার্থক্যই নীতিগত পার্থক্য
মত পরিবর্তন করতে পারতান। কিংবা এমনও হতে পারে যে, রামের সম্পর্কে আমরা দুজনে একই কথা জানি, তবু আমি মনে করি, রাম খুব ভাল লোক এবং আমার বন্ধুটি মনে করে, রাম খুবই খারাপ লোক। তাহলে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি 'ভাল' এবং 'মন্দ'-এ দুটি শব্দের পার্থক্য স্বীকার করে নিলেও এর প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে মতভেদ আছে। সে যাই হোক, এখানে এই যে 'ভাল' ও 'মন্দ'-র (বা 'উচিত' ও 'অনুচিত', 'ঠিক' ও 'বেঠিক' প্রভৃতির) পার্থক্য আমরা করছি একেই বলা হয় নীতিগত বা নৈতিক পার্থক্য (moral distinction)। 'ভাল', 'মন্দ', উচিত' ও 'অনুচিত' সম্পর্কে আমাদের যে চেতনা বা জ্ঞান তাকে বলা হয় নৈতিক জ্ঞান বা নৈতিক চেতনা (moral consciousness)। যখন আমরা বলি 'রামের আচরণ হয় ভাল' তখন এটি হল একটা নৈতিক অবধারণ বা বচন (moral judgment)। উপরের বচনটিতে 'ভাল' এই বিধেয়কে বলা হয় নৈতিক বিধের (moral predicate) এবং 'ভাল' 'মন্দ' 'উচিত' 'অনুচিত' এই জাতীয় নৈতিক বিধেয়র ব্যবহারের দ্বারা যে গুণাগুণের কথা বলা হয় তাকে বলা হয় নৈতিক গুণাগুণ (moral qualities)। যেমন পূর্বোক্ত উদাহরণটিতে রামের আচরণের নৈতিক গুণের কথা প্রকাশ করা হয়েছে এবং রামের আচরণ সম্পর্কে আমাদের নৈতিক জান ব্যক্ত করা হয়েছে।
নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে নীতিবিজ্ঞানের অর্থ, নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা, নীতিবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা ও নীতিবিজ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে আমাদের কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন। এই আলোচনাগুলি নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতিকে ভাল করে বুঝে নিতে সাহায্য করবে।
২। নীতি-বিজ্ঞানের অর্থ (Meaning of Ethics):
মানুষের যে একটা নৈতিক জীবন আছে, অর্থাৎ সে যে নিজের বা অপরের কাজ বা আচরণ সম্বন্ধে ভাল-মন্দ বা ঐ জাতীয় পার্থক্য করে একথা অস্বীকার করা যায় না। নৈতিক জীবনে মানুষের বিশ্বাস আছে বলেই মানুষ ভাল-মন্দ, সদাসৎ, ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি, পাপ-পুণ্যে বিশ্বাস করে। এসব নৈতিক ধারণা আমরা নৈতিক ধারণার প্রকৃত আমাদের সামাজিক পরিবেশ থেকে লাভ করি এবং সাধারণতঃ অর্থ না জেনে দৈনন্দিন এসব ধারণার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি না করে, বিনা বিচারেই এ জীবনে প্রয়োগ করা হয় সকল ধারণাকে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু এ সকল শব্দের প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে আমরা যতক্ষণ না একমত হতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত কারও আচরণ সম্পর্কে আমাদের মতামতের কোন তুলনামূলক বা বিজ্ঞানসম্মত বিচার সম্ভব নয়। এ সকল শব্দের প্রকৃত অর্থ কি এবং দৈনন্দিন জীবনে যখন কোন লোকের কোন
কাজকে ভাল বা মন্দ বলি তখন কোন্ নিয়ম বা আদর্শের মাপকাঠিতে আমরা ভাল-মন্দ বিচার করি, উচিত-অনুচিত, সদাসৎ, ন্যায়-অন্যায়-এ জাতীয় কথারই বা প্রকৃত অর্থ কি, এ সকল বিষয়ই নীতিবিজ্ঞান আলোচনা করে। লিলি (Lollir) বলেন, "দৈনন্দিন কথাবার্তায় 'ভাল', 'ঠিক', 'উচিত' প্রভৃতি যেসব শব্দ অহরহ ব্যবহৃত হয় তার যথার্থ অর্থ কী-এ জাতীয় প্রশ্ন নিয়েই নীতিবিজ্ঞান আলোচনা করে। "1
নৈতিক ধারণাগুলির প্রকৃত অর্থ নীতি- বিজ্ঞানের আলোচ্য- বিষয়
সুতরাং, 'ভাল এবং মন্দ', 'উচিত এবং অনুচিত', 'ন্যায় এবং অন্যায়'-এ জাতীয় লৌকিক ধারণাগুলিকে বিচার করে এর প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা এবং যে আদর্শের নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতি
মাপকাঠিতে মানুষের আচরণ ভাল কি মন্দ বিচার করা হয় সেই আদর্শের স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান দেওয়া নীতিবিজ্ঞানের কাজ।
৩। নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা (Definition of Ethics): বিভিন্ন লেখক নীতিবিজ্ঞানের বিভিন্ন রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। মানুষের আচরণের ভাল-মন্দ নিয়ে আলোচনা করে যে বিজ্ঞান তাই হল নীতিবিজ্ঞান। ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) বলেন, "নীতিবিজ্ঞান হল আচরণের মঙ্গল বা Mackenzie-দু সংজ্ঞা ঔচিতোর আলোচনা।" মানুষের আচরণই নীতিবিজ্ঞানের প্রধান আলোচ্য বিষয় এবং মানুষের কাজের ভাল-মন্দ বিচার করাই নীতিবিজ্ঞানের কাজ। মানুষের আচরণের বা ঐচ্ছিক ক্রিয়ার (voluntary action) নৈতিক মূল্য বিচার করে যে বিজ্ঞান তাই হল নীতিবিজ্ঞান।
ইংরেজী 'Ethics' শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে গ্রীক শব্দ 'ethica' থেকে। Ethica- এ শব্দটি এসেছে 'ethos' কথাটি থেকে যার প্রকৃত অর্থ হল 'চরিত্র', 'আচার-ব্যবহার', 'রীতিনীতি' বা 'অভ্যাস (customs, usages or habits) Ethics-কে Moral Philosophy' বা নীতিদর্শন নামেও অভিহিত করা হয়। 'Moral' শব্দটি উদ্ভুত হয়েছে ল্যাটিন শব্দ 'mores' থেকে যার অর্থ হল 'রীতিনীতি' বা 'অভ্যাস'। সুতরাং, Ethics বা নীতিবিজ্ঞান বলতে আমরা বুঝব মানুষের রীতিনীতি বা অভ্যাস সম্পর্কীয়
নীতিবিজ্ঞান মানুষের চরিত্র বা আচার সম্পকীয় বিজ্ঞান
বিজ্ঞান। মানুষের অভ্যাসজাত আচরণই নীতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। অভ্যাসের মাধ্যমেই মানুষের চরিত্র প্রকাশিত হয়। মানুষের চরিত্র বলতে আমরা বুঝি মানুষের মনের অভ্যাসজাত
স্থায়ী কর্মপ্রবণতা যা তার আচরণের সাহায্যে অর্জিত ও প্রকাশিত হয়। সুতরাং নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, 'নীতিবিজ্ঞান হল মানুষের চরিত্র বা আচার সম্পর্কীয় বিজ্ঞান।' নীতিবিজ্ঞান মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার, অভ্যাসের এবং চরিত্রের নৈতিক মূল্য বিচার করে, অর্থাৎ এদের ভালত্ব, মন্দত্ব, ঔচিত্য, অনৌচিত্য প্রভৃতির লক্ষণ ও নিয়ম নির্ণয়ের চেষ্টা করে।
নীতিবিজ্ঞানকে মানুষের জীবনের পরমার্থ সম্পর্কীয় বিজ্ঞানও বলা যেতে পারে (Ethics is the science of the highest good of human life)। 'ন্যায় এবং অন্যায়', 'ভাল ও মন্দ', 'সৎ এবং অসং' প্রভৃতি ধারণাগুনি মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য বা পরমকল্যাণের, অর্থাৎ পরমার্থের সঙ্গে যুক্ত। মানুষের সদাচারণের দ্বারা মানুষের কল্যাণ সাধিত হয় এবং অসৎ বা অন্যায় আচরণের দ্বারা মানুষের অকল্যাণ সাধিত হয়। কিন্তু মানুষের জীবনের চরম লক্ষ্য বা পরমকল্যাণের আদর্শটি কী, যাকে সামনে রেখে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করবে? নীতিবিজ্ঞান মানবজীবনের এই চরম লক্ষ্য বা পরমকল্যাণের, অর্থাৎ পরমার্থের আদর্শটি নির্ধারণ। করার চেষ্টা করে।
নীতিবিজ্ঞান মানুষের জীবনের পরমার্থ সম্পকীয় বিজ্ঞান
আমরা পরে দেখব যে, মানুষের যা পরমকল্যাণ তা কোন বহিরাগত বস্তু নয়, তার জীবনের অন্তরস্থিত বিষয়। এ দিক থেকে বিচার করে Mackenzie বলেন, "মানুষের জীবনের অন্তরস্থিত আদর্শের সাধারণ আলোচনা বা বিজ্ঞানই হচ্ছে নীতিবিজ্ঞান।"
নীতিবিজ্ঞান মানুষের জীবনের অন্তরস্থিত আদর্শের বিজ্ঞান
যে আদর্শকে সামনে রেখে আমরা আমাদের আচরণ ভাল কি মন্দ, বন্যায় কি অন্যায়, সৎ কি অসৎ বিচার করি, সে আদর্শ আমাদের সত্তার মধ্যেই নিহিত হয়ে আছে এবং সেখানেই সন্ধান ক'রে তার স্বরূপটি নির্ধারণ করা দরকার। নীতিবিজ্ঞানকে সেজন্য আমাদের জীবনের অন্তরস্থ আদর্শের বিজ্ঞান বলা যেতে পারে।
Lillie-র সংজ্ঞা
Lillie নীতিবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, "নীতিবিজ্ঞান হল সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচর। সম্পর্কীয় একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যে বিজ্ঞান মানুষের আচরণকে উচিত কি অনুচিত, ভাল কি মন্দ সত্য কি মিথ্যা বা অনুরূপভাবে বিচার করে।"
এই সংজ্ঞাটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নীতিবিজ্ঞান হল একটি বিজ্ঞান এবং অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নির্ভুল, সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ জ্ঞান Lillie-র সংজ্ঞার বিশ্লেষণ দান করাই এর উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়তঃ, নীতিবিজ্ঞান বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান নয়, আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান; অর্থাৎ যে আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করলে আমাদের আচরণ যথোচিত হবে, তা নির্ধারণ করা নীতিবিজ্ঞানের কাজ। তৃতীয়তঃ, নীতিবিজ্ঞান মানুষের আচরণ সম্পর্কে আলোচন। করে। আচরণ শব্দটি ঐচ্ছিক ক্রিয়ার সমষ্টিগত নাম (Conduct is a collective name for voluntary action)। ঐচ্ছিক ক্রিয়া বলতে বুঝি এমন ক্রিয়া যে ক্রিয়া মানুষ পূর্ব থেকে সঙ্কল্প করে সম্পাদন করে। অর্থাৎ যদি সে অন্য রকম সঙ্কল্প করত তবে সে-কাজ সে অন্যভাবে করতে পারত। মানুষের আচরণই নীতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। মনুষ্যেতর জীবের আচরণ নীতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নয়। নীতিবিজ্ঞান যে মানুষের আচরণ আলোচনা করে সে মানুষ সমাজে বসবাসকারী বা সামাজিক জীব। সামাজিক পটভূমিকা আছে বলেই মানুষের কাজের মূল্যায়ন করা এবং সকল আচরণের ভাল-মন্দ বিচার করা সম্ভব হয়। এই সংজ্ঞা থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে, নৈতিক আদর্শের সাহায্যে মানুষের আচরণ বিচার করার জন্য আমরা ভাল বা মন্দ, যথোচিত বা অনুচিত, সৎ বা অসৎ-এ ধরনের নানা শব্দ ব্যবহার করে থাকি।
৪। নীতিবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণা: যথোচিত ও অনুচিত, ভাল ও মন্দ, পরমার্থ, কর্তব্য, সততা এবং চরিত্র (Fundamental concepts of Ethics: Right and, Wrong, Good and Bad, The Highest Good Duty, Virtue and Character):
(ক) যথোচিত ও অনুচিত (Right and Wrong):
মানুষের কাজের বা আচরণের নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করার জন্য আমরা যথাচিত এবং অনুচিত, যথার্থ এবং অযথার্থ, ঠিক এবং বেঠিক প্রভৃতি কথা ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু প্রশ্ন হল-এ জাতীয় শব্দের প্রকৃত অর্থ বা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কি? যখন বলি এ কাজটা ঠিক হয়েছে, তখন কি করে বুঝব কেমন করে কাজ ঠিক বা বেঠিক হয়? এজন্য এ জাতীয় শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য নির্ধারণ করাও নীতিবিজ্ঞানের একটি প্রধান কাজ।
ইংরেজী 'right' শব্দটি ল্যাটিন শব্দ 'rectus' থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার অর্থ হল সোজা (straight) বা বিধি অনুযায়ী (according to rule)। ইংরেজী 'wrong' শব্দটি 'string' শব্দটির সঙ্গে যুক্ত, যার অর্থ হল মোচড়ান (twisted), অর্থাৎ যা বিধি বা নিয়ম অনুযায়ী নয়। যখন বলি কোন মানুষের কাজ বা আচরণ যথোচিত বা ঠিক হয়েছে তখন বুঝি তার কাজ নিয়মমত হয়েছে এবং যখন বলি কোন মানুষের
যথোচিত আচরণ হল যথোচিত আচরণ বলতে বুঝায় সেই আচরণ, নৈতিক নিয়মের নৈতিক নিয়মানুযায়ী সঙ্গে যার সঙ্গতি আছে এবং অন্যায় আচরণ বলতে বুঝব সেই আচরণ কাজ বা আচরণ বেঠিক হয়েছে তখন বুঝি তার কাজ নিয়মমত হয়নি। সুতরাং, আচরণ, নৈতিক নিয়মের সঙ্গে যার সঙ্গতি নেই। অতএব দেখতে পাচ্ছি যে, যথোচিত এবং অনুচিত, হ্যায় এবং অন্যায়-এ জাতীয় ধারণার সঙ্গে নৈতিক নিয়মের বিশেষ সংযোগ আছে।
নৈতিক জীবন যাপন মানে মেনে নৈতিক নিয়ম চলা
নৈতিক জীবন যাপন করা অর্থে বুঝি নৈতিক নিয়ম মেনে চলা। এই কারণে Lillie বলেন, "কোন একটি নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করার ওপর যথোচিত কাজের উপযুক্ততা অনেক সময় নির্ভর করে। কোন একটি লোকের দয়ার কাজকে আমরা উপযুক্ত কাজ বলে মনে করি, কারণ অপরের প্রতি দয়া প্রদর্শন করার সাধারণ নিয়মটি যথোচিত। সুতরাং, নিয়মই ন্যায় এবং অন্যায় নির্ধারণ করার মাপকাঠি, অর্থাৎ নৈতিক নিয়মের সাহায্যেই আমরা কোন কাজ যথোচিত কি অনুচিত, ন্যায় কি অন্যার বিচার করতে পারি। অবস্থা এ নৈতিক নিয়মটিকে যে সকল ক্ষেত্রেই স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে এ নিয়মটি সুপরিব্যক্ত (explicit) থাকে না এবং অনেক সময় নৈতিক
নৈতিক নিয়মাট সকল সময় সুপরিব্যক্ত না থাকে
নিয়ম সম্পর্কে কোন স্পষ্ট ধারণা না করেই আমরা মানুসের আচরণের নৈতিক
বিচার করি।
যথোচিত বা ঠিক কাজ বলতে আমরা বুঝি যা নিয়মানুযায়ী করা হয়। কিন্তু আমরা নিয়ম মানি এজন্য যে, তার দ্বারা আমাদের কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সাধিত হবে বা কল্যণজনক কিছু লাভ করা যাবে। সুতরাং, নৈতিক নিয়ম মেনে চলার প্রধান উদ্দেশ্য হল জীবনের পরমকল্যান বা পরমার্থ (Tht Supreme or the Highest Good of life) লাভ করা। সুতরাং যথোচিত ন্যায় আচরণ বলতে বুঝব সেই আচরণ যা আমাদের পরমার্থলাভের সহায়ক এবং অনুচিত বা অন্যায় আচরণ বলতে বুঝব সেই আচরণ যা পরমার্থলাভের পক্ষে অন্তরায়স্বরূপ। সুতরাং 'যথোচিত' ধারণাটি 'কল্যাণ' বা মঙ্গল ধারণার অধীন (Right is subordinate to good)। সে কাজই যথোচিত কাজ যা কল্যাণলাভের উপায়স্বরূপ।
(খ) ভাল ও মন্দ (Good and Bad):
ইংরেজী good" শব্দটি জার্মান শব্দ 'gut' থেকে উদ্ভূত। কোন একটি জিনিসকে আমরা সাধারণতঃ তখনই ভাল বলি যখন তা আমাদের কোন উদ্দেশ্য সাধন করে। বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে মুক্ত হতে সহায়তা করে বলেই বিভিন্ন রোগের পক্ষে বিভিন্ন ওষুধ ভাল। ম্যালেরিয়ার পক্ষে কুইনাইন ভাল নিমোনিয়ার পক্ষে পেনিসিলিন ভাল, স্বাস্থ্যের পক্ষে পুষ্টিকর খাদ্য ভাল। 'ভাল আচরণ' তখন বুঝতে হবে যে আমাদের যে নৈতিক আদর্শ আছে সেই আদর্শকে লাভ করার পক্ষে সে আচরণ অবশ্য কার্যকর।
'ভাল' বা 'কল্যাণকর' বলতে আমরা কেবলমাত্র উদ্দেশ্য বা অভীষ্ট সিদ্ধির উপায়কেই বুঝি না, উদ্দেশ্য বা অভীষ্টকেও বুঝে থাকি। এই অর্থে ভাল বা কল্যাণকর বলতে আমরা বুঝব কোন কাম্য বিষয় বা অর্থ, স্বাস্থ্য বা অন্য যে কোন বস্তু। তেমন মন্দ বা অকল্যাণকর বলতে বুঝব যা কাম্য বস্তু নয়, নিন্দাত্মক এমন কিছু যাকে আমরা এড়িয়ে চলতে চাই, যেমন দারিদ্র, রোগ, ভীরুতা ইত্যাদি।
নীতিবিজ্ঞান মানুষের আচরণ ভাল কি মন্দ বিচার করে, অর্থাৎ নৈতিক আদর্শ বা উদ্দেশ্যলাভ করার জন্য আমাদের আচরণ কার্যকর কিনা, নীতিবিজ্ঞান তাই বিচার করে। এখন এ উদ্দেশ্য বা আদর্শ বলতে কি বুঝি? আমাদের কোন কাজ করার পিছনে নানারকম উদ্দেশ্য বালক্ষ্য থাকতে পারে; যেমন-গ্রন্থ রচনা করা, অর্থ রোজগার করা, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন করা, খ্যাতি লাভ করা ইত্যাদি। নীতিবিজ্ঞান এ সকল বিশেষ বিশেষ ধরনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা করে না। নীতিবিজ্ঞানের আলোচনার বিষয়বস্তু হল মানবজীবনের চরম লক্ষ্য বা পরম- কল্যাণ বা পরমার্থ (Sumum bonum or Supreme Good), যার দিকে দৃষ্টি রেখে মানুষের সমস্ত আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করা দরকার।
(গ) পরমার্থ বা পরমকল্যাণ (Sumum bonum or The Highest Good):
নীতিবিজ্ঞানে আমরা 'ভাল' বা 'কল্যাণকর' যা কিছু তাকে উপায় এবং উদ্দেশ্য দুভাবেই দেখে থাকি। সুখ যদি হয় লক্ষ্য তাহলে সুখলাভের জন্য ভাল স্বাস্থ্য হল উপায়: উভয়ই ভাল। আবার স্বাস্থ্যলাভ যদি হয় লক্ষ্য এবং কল্যাণকর তাহলে শারীরিক ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাদ্য, ভাল ওষুধ ইত্যাদি স্বাস্থ্য লাভ করার উপায়স্বরূপ এবং সেজন্য কল্যাণকর। সুতরাং, কল্যাণ দুরকম- পরমকল্যাণ ও আপেক্ষিক কল্যাণ। 'পরমকল্যাণ' (Absolute Good) এবং 'আপেক্ষিক কল্যাণে'র (Relative Good) বা 'পরমার্থ' এবং 'বিশেষার্থের' মধ্যে যে প্রভেদ তা জানা দরকার। আপেক্ষিক কল্যাণ বলতে বুঝব এমন কিছু যার মাধ্যমে আমাদের কোন অভীষ্ট বা উদ্দেশ্য লাভ হয়, যাকে তার নিজের জন্যই কামনা করি না। অতএব আপেক্ষিক কল্যাণ অন্য কোন উচ্চতর কল্যাণলাভের উপায়স্বরূপ। অপর দিকে, মানুষের পরমার্থ বা পরমকল্যাণ বলতে বুঝি সেই কল্যাণ যাকে তার নিজের জন্যই কামনা করি। পরমকল্যাণ অন্য কোন কল্যাণের অধীনস্থ নয়, বা উচ্চতর কোন কল্যাণলাভের উপায়স্বরূপ একে ব্যবহার করা যায় না। পরমার্থ মানুষের চরম অভীষ্ট বা লক্ষ্য, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ কাম্য বস্তু।
প্রত্যেক ঐচ্ছিক ক্রিয়ার একটি উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য থাকে এবং এই লক্ষ্যেরও ক্রম- বিন্যাস আছে। মানুষের পরমার্থ বা পরমকল্যাণ মানুষের জীবনের চরম কামনার বা বাসনার শেষ ধাপ, যাকে কামনা করার পর আর কামনা করার কিছুই থাকে না; সুতরাং মানুষের এই পরমকল্যাণ বা পরমার্থ হল নিজ সত্তায় কল্যাণকর (intrinsically good); যেহেতু এর নিজের জন্যেই একে কামনা করা হয়, অন্য কোন অভীষ্ট লাভের হেতু বা উপায় হিসেবে একে কামনা করা হয় না।
পরিশেষে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে যে, মানুষের জীবনে যথার্থ কোন পরমার্থ আছে কি না? মানুষ তো অনেক কিছু কামনা করে-অর্থ স্বাস্থ্য, শক্তি, বুদ্ধি, জান, ভালবাসা ইত্যাদি। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারা যাবে যে, এসব মানুষের কাম্যবস্তু হলেও এগুলিকে মানুষের পরমার্থ মনে করা যেতে পারে না। এগুলির কোনটিই জীবনের চরম লক্ষ্য নয়। যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা যায় যে, সে কেন অর্থ চায়, তাহলে সে বলবে যে, অর্থের সাহায্যে সে অন্য কোন বস্তু লাভ করতে চায়। সুতরাং, অর্থ যেহেতু অন্য কিছুকে পাবার উপায়স্বরূপ সেহেতু অর্থকে চরম অভিষ্ট মনে করা যেতে পারে না। এভাবে স্বাস্থ্য, শক্তি যাই বলি না কেন, সব কিছুই কামনা করা হয় অপর কোন উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যকে লাভ করার জন্য। মানুষের জীবনে পরমার্থ কি-তার উত্তর এখন দেওয়া সম্ভব নয়। মানুষের জীবনে পরম উদ্দেশ্য বা আদর্শ আছে-এটাই আমাদের প্রারম্ভে মেনে নিতে হবে এবং নীতিবিজ্ঞানের আলোচনায় অগ্রসর হয়ে যথাসময়ে আমরা এ আদর্শের স্বরূপটি নির্ধারণ করতে চেষ্টা করব।
(ঘ) কর্তব্য (Duty):
কর্তব্য হল সেই কাজ নৈতিক নিয়মানুসারে যা করা উচিত, অর্থাৎ নৈতিক আদর্শানুযায়ী যেসব কাজ আমাদের করা প্রয়োজন সেগুলিই হল কর্তব্য। কর্তব্য কাজ শেষ পর্যন্ত পরম কল্যাণের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ; সেহেতু এ কাজগুলি সম্পন্ন করার নৈতিক বাধ্যতাবোধ আমরা। অনুভব করি।
নীতিবিজ্ঞান পরমকল্যাণের আদর্শ (Ideal of the Supreme God) এবং কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করে। কর্তব্য সম্পাদনের মাধ্যমেই আমরা পরমকল্যাণের আদর্শ উপলব্ধি করি। যখনই আমাদের মনে পরমকল্যাণলাভের ইচ্ছা জাগে তখনই আমাদের মধ্যে কর্তব্য সম্পাদেনর নৈতিক বাধ্যতাবোধ দেখা দেয়। নৈতিক জীবনের সঙ্গে এই কর্তব্যবোধ অত্যন্ত নিবিড় ভাবে যুক্ত। যেখানে নৈতিক দায়িত্ববোধ আছে সেখানে কর্তব্যবোধও আছে। আর যেখানে কর্তব্যবোধ আছে সেখানে কর্তব্য সম্পন্ন করার নৈতিক বাধ্যতাবোধও আছে।
(ঙ) সততা (Virtue):
নৈতিক নিয়মানুযায়ী কর্তব্য করার যে মানসিক প্রবণতা বা বাসনা তকেই সততা বলা হয়। তাকেই আমরা সৎ লোক বলি যে ব্যক্তি অবিচলিত ভাবে তার কর্তব্য সমাপন করে। কর্তব্য ও সততার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। সততা হল চরিত্রের উৎকর্ষ (excellence)। কর্তব্য হল বহিরাচরণের মাধ্যমে সেই চরিত্রের প্রকাশ। সততা হল অন্তর্মুখী। কর্তব্য হল বর্হিমুখী। মাতা- পিতার সেবা করা, গুরুজনের আদেশ পালন করা মানুষের কর্তব্য। যেমন মাতাপিতার ও গুরুজনদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভক্তি হল মানুষের সদগুণ বা সততা।
মাতাপিতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি থাকলেই মানুষ মাতাপিতার সেবা করা কর্তব্য মনে করে অর্থাৎ কর্তব্যের মাধ্যমেই সততা আত্মপ্রকাশ করে। সুতরাং কর্তব্য ও সততা একই বস্তুর দুটি ভিন্ন দিক। যখন অন্তরের দিকে লক্ষ্য করি তখন যা সততা, যখন বাইরের আচরণের দিকে লক্ষ্য করি তখন তাই কর্তব্য। ম্যাকেঞ্জি বলেন, "সততা হল চরিত্রের সৎ অভ্যাস এবং তা' কর্তব্য থেকে পৃথক। কর্তব্য হল বিশেষ -এক ধরনের কাজ যা আমাদের করা উচিত। মানুষ তার কর্তব্য করে কিন্তু সে 'সদ্গুণের অধিকারী বা সং হয়।"*
(চ) চরিত্র (Character):
কোন ব্যক্তির চরিত্র হল তার বিশেষ মানসিক এবং নৈতিক গঠন, তার অভ্যাসসিদ্ধ ইচ্ছার প্রবণতা (habitual disposition of the will) যা তাকে অন্যায্য ব্যক্তি থেকে 'স্বতন্ত্র করে তোলে। ইচ্ছাকৃত কতকগুলি কাজ বার বার করার ফলেই এই ইচ্ছার অভ্যাস ও প্রবণতা অর্জিত হয়। নোভালিস (Novalis) চরিত্রের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন। "চরিত্র হল সম্পূর্ণভাবে গঠিত ইচ্ছা (a completely fashioned will)। ম্যাকেঞ্জির মতে চরিত্র হল একটি নির্দিষ্ট 'কামনার জগতের' অবিরাম প্রাধান্য। অন্যত্র তিনি বলেছেন- "চরিত্র হল কোন এক ধরনের স্বেচ্ছামূলক কাজের দ্বারা গঠিত একটি সংহতি বা জগৎ।
আচরণ (conduct) কাকে বলে? আচরণ হল মানুষের ঐচ্ছিক এবং অভ্যাস- সিদ্ধ ক্রিয়া। অনৈচ্ছিক ক্রিয়া মানুষের আচরণের বহির্ভূত, যেহেতু উদ্দেশ্য অনুযায়ী পূর্ব থেকে সংকল্প করে এ কাজ করা হয় না। মানুষের আচরণের মধ্যেই তার চরিত্র প্রকাশিত হয়। আচরণ ও চরিত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। চরিত্র হল আচরণের আভ্যন্তরীণ দিক। আচরণ হল চরিত্রের বাহ্য দিক। একটিকে আর একটি থেকে আলাদা করা যায় না। মানুষের কাজ তার চরিত্রের ওপর প্রতিক্রিয়া ঘটায় আর মানুষের চরিত্র তার আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। যে ব্যক্তি সং তার আচরণ স্বভাবতঃই সৎ হয়। শৈশব থেকে যে ব্যক্তি অধর্ম ও অন্যায় আচরণে অভ্যস্ত তার চরিত্র মন্দভাবেই গঠিত হয়।
৫। নীতিবিজ্ঞানের পরিধি (The Province or Scope of Ethics):
ইংরেজীতে কোন বিজ্ঞানের Province বা Scope কথাটির অর্থ হল তার আলোচনার পরিসর বা ক্ষেত্র, অর্থাৎ আলোচ্য বিষয়সমূহ। যে কোন বিজ্ঞান বিশ্বের এক বিশেষ বিভাগ সম্বন্ধে আলোচনা করে এবং সেইটাই তার নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু। সেই নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সে সুশৃঙ্খল ও নির্ভুল জ্ঞানদান করার চেষ্টা করে। এই নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু এবং সংশ্লিষ্ট কতকগুলি আনুষঙ্গিক বিষয় হল বিজ্ঞানের পরিসর বা ক্ষেত্র। অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো নীতিবিজ্ঞানও একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নীতিবিজ্ঞানের আলোচনার পরিসরের অন্তর্ভুক্ত।
(১) নীতিবিজ্ঞান 'ভাল', 'মন্দ', 'উচিত', 'অনুচিত', 'পরমকল্যাণ', 'কর্তব্য', 'সততা' 'চরিত্র' প্রভৃতি কয়েকটি মৌলিক ধারণা নিয়ে আলোচনা করে।
(২) মানুষের আচরণের নৈতিক মূল্য ও আদর্শ নির্ধারণ করাই নীতিবিজ্ঞানের কাজ। মানুষের আচরণ বলতে নীতিবিজ্ঞানে আমরা মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়াকেই বুঝি। সুতরাং ঐচ্ছিক ক্রিয়ার স্বরূপ, ঐচ্ছিক ক্রিয়া (Voluntary Action) ও অনৈচ্ছিক ক্রিয়ার (Non-voluntary Action) মধ্যে প্রভেদ এবং এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতকগুলি বিষয়, যেমন- কামনা (Desire), ক্রিয়ার মূল উৎস (Spring of Action), উদ্দেশ্য (Motive), অভিপ্রায় (Intention) প্রভৃতি নীতিবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
(৩) নৈতিক আদর্শের স্বরূপ নির্ধারণ কর। নীতিবিজ্ঞানের একটি প্রধান কাজ। নীতিবিজ্ঞান মানুষের আচরণের নৈতিক মূল্য বা ভাল-মন্দ বিচার করে। কিন্তু মানুষের আচরণের নৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা হয় একটি নৈতিক আদর্শের মাপকাঠিতে। ঐ আদর্শের সঙ্গে যে কাজের সঙ্গতি থাকে তাকে সৎ বা ভাল কাজ এবং ঐ আদর্শ লঙ্ঘন করে যে কাজ করা হয় তাকে অসৎ বা খারাপ কাজ বলে আমরা অভিহিত করি।
(৪) নীতিবিজ্ঞান নৈতিক বিচারের মানদণ্ড সম্পর্কীয় বিভিন্ন মতবাদ নিয়ে আলোচনা করে। নৈতিক আদর্শের স্বরূপ নির্ধারণ করা নীর্তিবিজ্ঞানের একটি প্রধান সমস্যা। কেননা এ সম্পর্কে সকলে একমত নন, অর্থাৎ বিভিন্ন নীতিবিজ্ঞানী বিভিন্ন ভাবে এ আদর্শের স্বরূপ নির্ধারণ করেছেন। কারও মতে নৈতিক আদর্শ হচ্ছে একটি নিয়ম বা বিধি (Law); কারও মতে এটা সুখ বা শান্তি (Pleasure or Happiness); কারও মতে কৃচ্ছসাধন (Negation of Pleasure); আবার কারও কারও মতে এটা আত্মোপলব্ধি বা পূর্ণতা (Self-realisation or Perfection)। নীতিবিজ্ঞানের অন্যতম কাজ হল এসব বিভিন্ন মতবাদের ব্যাখ্যা করা এবং তাদের দোষ-গুণ নির্ণয় করে কোনটি সর্বোৎকৃষ্ট বা গ্রহণযোগ্য মতবাদ সেটি নির্ধারণ করা।
(৫) নীতিবিজ্ঞান নৈতিক বিচারের স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করে। যে মানসিক ক্রিয়ার দ্বারা আমরা, আচরণের ন্যায়-অন্যায় নির্ণয় করি তাকে বলে নৈতিক বিচার (Moral Judgment)। নৈতিক বিচারের আলোচনা প্রসঙ্গে কতকগুলি প্রশ্ন দেখা দেয়; যেমন-নৈতিক বিচার করার কর্তা (Subject of Moral Judgment) কে; নৈতিক বিচারের যথার্থ বিষয়বস্তু (Object of Moral Judgment) কি এবং আমাদের নৈতিক অবধারণ করার যে বৃত্তি (Faculty of moral Judgement) আছে, তারই বা স্বরূপ কি? নীতিবিজ্ঞান এ সকল প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দেবার চেষ্টা করে।
(৬) নীতিবিজ্ঞান নৈতিক বাধ্যতাবোধ নিয়ে আলোচনা করে; কারণ নৈতিক বিচার নৈতিক বাধ্যতাবোধের (moral obligation) সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। যখন আমরা একটি কাজকে ভাল বা মন্দ বলে ভাবি তখন মন্দ কাজটি না করে ভাল কাজটি করার জন্য আমাদের মনে এক তাগিদ দেখা দেয়; একেই বলে নৈতিক বাধ্যতাবোধ। এই নৈতিক বাধ্যতা- বোধকেই বলে কর্তব্যবোধ বা ঔচিত্যবোধ। Kant বলেন, "যা সঠিক (the right) তা যদি উচিত (ought) না হয় তবে সঠিকের কোন অর্থই হয় না।"' নীতিবিজ্ঞান নৈতিক বাধ্যতাবোধের স্বরূপ কি, বাধ্যতাবোধের উৎপত্তি কিভাবে হল, এ বাধ্যতাবোধের কারণ বা অধিকর্তা কে?-এ সকল প্রশ্ন আলোচনা করে।
(৭) নীতিবিজ্ঞান নৈতিক গৌরব, অগৌরব নিয়ে আলোচনা করে। নৈতিক বাধ্যতাবোধ কাজের গৌরব বা নৈতিক উৎকর্ষ (Merit) এবং অগৌরব বা নৈতিক অপকর্ষের (Demerit) সঙ্গে সংযুক্ত। যে ব্যক্তি সৎ কাজ করে তার কাজ আমরা অনুমোদন করি, তাকে প্রশংসা করি এবং মনে করি কর্তব্য কাজ করার জন্য সে গৌরবের অধিকারী। অপর দিকে, যে ব্যক্তি অসৎ বা অন্যায় কাজ করে তাকে আমরা সমর্থন করি না এবং মনে করি যে, অসৎ কাজ করার জন্য সে নিন্দনীয়। সকল প্রকার বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে কর্তব্য সম্পাদনের মধ্যে গৌরব আছে। কাজকে যথোচিত বা কর্তব্য জেনেও না করার মধ্যে নিহিত আছে অগৌরব। নীতিবিজ্ঞান এই গৌরব ও অগৌরব বা নৈতিক উৎকর্ষ নিয়ে আলোচনা করে।
(৮) নীতিবিজ্ঞান কর্তব্য (Duties) ও নৈতিক অধিকার (Rights) এবং সততা (Virtue) ও অসদাচার (Vice) নিয়ে আলোচনা করে। নৈতিক আদর্শ অনুয়ায়ী যে কাজ আমাদের করা উচিত তাই হল কর্তব্য। আবার কর্তব্য বা অধিকার অনেক সময় একত্র চলে। পিতার প্রতি পুত্রের যে কর্তব্য তাহল পুত্রের নিকট পিতার অধিকার। সুতরাং কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নীতিবিজ্ঞানকে অধিকার সম্বন্ধে আলোচনা করতে হয়। আবার কর্তব্য করলে আমরা সততা অর্জন করি এবং কর্তব্য' অবহেলা করে আমরা সংগ্রহ করি অসততা। এই সততা ও অসদাচার নীতিবিজ্ঞানের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
(9) নীতিবিজ্ঞানকে কতকগুলি সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে তার মূল বিষয়বস্তুকে আলোচনা করতে হয়। প্রতিটি বিজ্ঞানের কতকগুলি স্বীকার্য সত্য (Postulates) আছে। নীতিবিজ্ঞানেরও কতকগুলি স্বীকার্য সত্য আছে: ব্যক্তির সত্তা (Perso- nality), বুদ্ধি বা বিচারশক্তি (Reason) এবং ইচ্ছা-স্বাধীনতা (Freedom of Will) হচ্ছে নীতিবিজ্ঞানের স্বীকার্য সত্য। নীতিবিজ্ঞান এসব স্বীকার্য সত্য নিয়ে আলোচনা করে। ইচ্ছার স্বাধীনতা আছে বলেই আমাদের আচরণের নৈতিক দায়িত্ব আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়।
(১০) নৈতিক দায়িত্ব (Moral Responsibility) সম্পর্কে আলোচনা করাও নীতিবিজ্ঞানের কাজ। কোন ব্যক্তি সমাজ বা রাষ্ট্রের বিপক্ষে নীতিবিরুদ্ধ কাজ করলে সে অপরাধী হয় এবং এজন্য তার শাস্তি পাওয়া উচিত। শান্তির নৈতিক ভিত্তি সম্বন্ধীয় বিভিন্ন মতাবাদগুলি নীতিবিজ্ঞান আলেচনা করে।
(১১) নীতিবিজ্ঞান নৈতিক ভাবাবেগ (Moral Sentiment) নিয়েও আলোচনা করে। কোন ব্যক্তিকে সৎ কাজ করতে দেখলে আমাদের মনে যে প্রীতিকর ভাব জাগে এবং অসৎ কাজ করতে দেখলে মনে যে অপ্রীতিকর ভাব জাগে তাকেই নৈতিক ভাবাবেগ বলে। নৈতিক ভাবাবেগের স্বরূপ, উৎপত্তি এবং নৈতিক বিচারের সঙ্গে নৈতিক ভাবাবেগের সম্পর্ক নীতিবিজ্ঞানে আলোচিত হয়।
(১২) নৈতিক বিচারশক্তিকে বা নৈতিক বিচারের বৃত্তিকেই ইংরেজীতে Moral Faculty বলে। এই Moral Faculty-র অপর নাম হল Conscience, বাংলায় আমরা যাকে বলে থাকি বিবেক। এই বিবেকের স্বরূপ কি এবং এ বিবেক সম্পর্কীয় যেসব বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত আছে, নীতিবিজ্ঞান সেগুলি আলোচনা করে।
(১৩) নীতিবিজ্ঞানও প্রয়োজনানুসারে অন্যান্য বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। মনোবিজ্ঞান, দর্শন বা অধিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অনেক আলোচ্য বিষয় নীতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, যেহেতু এসকল বিজ্ঞানের সঙ্গে নীতিবিজ্ঞানের একটা গভীর সম্পর্ক আছে। মনোবিজ্ঞানের যে বিষয়গুলি নীতিবিজ্ঞান বিশেষ করে আলোচনা করে সেগুলি হল ঐচ্ছিক ক্রিয়ার স্বরূপ, ইচ্ছার স্বাধীনতা, বাসনা এবং সুখের সঙ্গে সম্বন্ধ ইত্যাদি। নীতিবিজ্ঞানে আলোচিত দর্শনের বিষয়গুলি হল মানুষের সত্তা, এ বিশ্বে মানুষের স্থান, ইচ্ছার স্বাধীনতা, আত্মার অমরতা, ঈশ্বরের স্বরূপ এবং অস্তিত্ব, বিশ্বের নৈতিক শাসন ইত্যাদি। সমাজবিজ্ঞানের যে-সব বিষয় নীতিবিজ্ঞানে আলোচিত হয় তাহল ব্যক্তি ও সমাজের সম্বন্ধ, অপরাধ ও সেজন্য শাস্তির ব্যবস্থা ইত্যাদি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যে-সব বিষয় নীতিবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত তাহল ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক, রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি ইত্যাদি।
৬। নীতিবিজ্ঞানের স্বরূপ (Nature of Ethics):
নীতিবিজ্ঞান একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান
আমরা পূর্বে দেখেছি যে, নীতিবিজ্ঞান সমাজে বসবাসকারী মানুষের আচরণ সম্পর্কে একটি আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। প্রকৃতির একটি বিশেষ বিভাগ সম্পর্কে যথাযথ, সুনিশ্চিত, সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বলে। নিজ নিজ বিভাগের বিষয়বস্তু ও ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ করে কতকগুলি সাধারণ নিয়ম আবিষ্কার করা এবং ঐ সকল নিয়মের সাহায্যে বিষয়বস্তুকে ব্যাখ্যা করাই বিজ্ঞানের লক্ষ্য। নীতিবিজ্ঞানকে আমরা বিজ্ঞান বলি, যেহেতু অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো নীতিবিজ্ঞানেরও একটা সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু আছে এবং এ বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিশ্চিত, যথার্থ, সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জ্ঞানদান করা নীতিবিজ্ঞানের লক্ষ্য। নীতিবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়বস্তু হল মানুষের আচরণ, অর্থাৎ ঐচ্ছিক ক্রিয়া, মানুষের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়। প্রধানতঃ পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে মানুষের আচরণকে একটি আদর্শ অনুযায়ী কতকগুলি নিয়মের সাহায্যে ব্যাখ্যা করাই নীতি- বিজ্ঞানের কাজ।
বিজ্ঞানকে এই হিসেবে দুভাগে ভাগ করা হয়; যথা-
বস্তুনিষ্ঠবিজ্ঞান (Positive Science) এবং আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান (Normative Science)
বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান:
যে বিজ্ঞানে বস্তুর উৎপত্তি, বিকাশ ও যথাযথ প্রকৃতির বর্ণনা দেওয়া হয় তাকেই বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলে। যেমন-মনোবিজ্ঞান, জীববিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা প্রভৃতি। চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছা-এই মানসিক প্রক্রিয়া- গুলিকে বিশ্লেষণ করে কতকগুলি সাধারণ নিয়ম নির্ণয় করা মনোবিজ্ঞানের কাজ। মানসিক প্রক্রিয়াগুলির প্রকৃতি কি, মনোবিজ্ঞান তা-ই বর্ণনা করে। মানসিক প্রক্রিয়াগুলি কি রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে মনোবিজ্ঞান আলোচনা করে না।
আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান:
আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান একটি আদর্শের আলোকে বিষয়বস্তুর মূল্য বিচার করে। নীতিবিজ্ঞান আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। পরমকল্যাণের আদর্শের মাপকাঠিতে মানুষের আচরণের মূল্য নির্ধারণ করা নীতিবিজ্ঞানের কাজ। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, সৌন্দর্যবিজ্ঞান এবং তর্কবিজ্ঞান উভয়ই আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। তর্কবিজ্ঞানের আদর্শ হল সত্যতা। কিভাবে আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত করলে আমাদের চিন্তা যথার্থ হতে পারে তর্কবিজ্ঞানের কাজ হল তাই নির্ধারণ করা। অনুরূপ- ভাবে সৌন্দর্যবিজ্ঞানের (Aesthetics) আদর্শ হল সৌন্দর্য (Beauty) এবং বস্তুর সৌন্দর্য ও সৌন্দর্যের অভাব নির্ণয় করার নিয়ম স্থির করা সৌন্দর্যবিজ্ঞানের কাজ।
বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (Natural Science) এবং বর্ণন। মূলক বিজ্ঞান (Descriptive Science) বলা হয়। বস্তুজগতে বিষয়টি যেভাবে বিদ্যমান আছে ঠিক সেইভাবে তাকে জানা এবং তার বর্ণনা দেওয়াই হল বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানের কাজ। যেমন, প্রাণিবিদ্যায় ও উদ্ভিদবিদ্যায় প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রকৃতি নির্ণয় করা হয় এবং তাদের বর্ণনা দেওয়া হয়। বিশ্লেষণ, বর্ণনা এবং ব্যাখ্যাই এ জাতীয় বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। ভাল-মন্দ, উচিত-অনুচিত, সদাসৎ, ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানে উত্থাপন করা হয় না বা কোন আদর্শকে সামনে রেখে বিষয়বস্তুর মূল্য বিচার করা হয় না।
আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানকে মূল্যাব্বারণের বিজ্ঞান বা নিয়ামক বিজ্ঞান বলা হয়। কোন আদর্শের মাপকাঠিতে বস্তুর মূল্য নির্ধারণ করাই আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানের কাজ। বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলে বিষয়টি বা ঘটনাটি কি, আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলে বিষয়টি কী হওয়া উচিত। নীতিবিজ্ঞান আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যেহেতু পরমকল্যাণের আদর্শের মাপকাঠিতে মানুষের আচরণ ভাল কি মন্দ বিচার করা বা মানুষের আচরণের মূল্য নির্ধারণ করাই নীতিবিজ্ঞানের কাজ। মানুষের আচরণের প্রকৃতি, উৎপত্তি এবং বিকাশ কিভাবে হয় তা নির্ণয় করার দায়িত্ব নীতিবিজ্ঞানের নয়, অর্থাৎ কতকগুলি অভিজ্ঞতালব্ধ নিয়মের সাহায্যে মানুষের আচরণের ব্যাখ্যা করা নীতিবিজ্ঞানের কাজ নয়। মানুষের আচরণ কি রকম হওয়া উচিত, যার ফলে মানুষ তার জীবনের পরমার্থ লাভ করতে পারে, তা নির্ধারণ করাই নীতিবিজ্ঞানের কাজ। যে আদর্শের দ্বারা মানুষের চরিত্রের মূল্য নির্ণয় হয়, সেই আদর্শের স্বরূপ নির্ণয় করাই নীতিবিজ্ঞানের লক্ষ্য। বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানের সঙ্গে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানের আরও একদিক থেকে পার্থক্য আছে। যে মানদণ্ডের সাহায্যে আমরা বিচার করি, আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান শুধুমাত্র সেগুলিকে বর্ণনা করে না, সেগুলির যাথার্থ্য বা সত্যতা নিয়েও আলোচনা করে। হিব্রুরা দশটি আদেশের সাহায্যে মানুষের আচরণের বিচার করেছে। এই ধরনের নিয়মের, যার সাহায্যে মানুষ তার আচরণের বিচার করেছে, বর্ণনা করাই শুধুমাত্র নীতিবিজ্ঞানের কাজ নয়। নীতিবিজ্ঞানে আমরা আরও প্রশ্ন তুলি, কেন এই নিয়মগুলি যথার্থ বা কিসের ভিত্তিতে আমাদের এইগুলি মেনে চলা উচিত।
৭। নীতিবিদ্যা কি বিজ্ঞান, না দর্শনের অংশ (Is Ethics a Science or a part of Philosophy):
নীতিবিদ্যা বিজ্ঞান, না দর্শনের অংশ, এই প্রশ্নকে কেন্দ্র করে নীতিবিদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। কোন কোন নীতিবিদ্ যেমন, ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) মনে করেন যে, নীতিবিদ্যাকে বিজ্ঞানরূপে গণ্য না করে, দর্শনের অংশ রূপে গণ্য করাই যুক্তিসঙ্গত। নিজ অভিমত সমর্থন করতে গিয়ে তিনি বলেন, বিজ্ঞানের কাজ মানুষের অভিজ্ঞতার একটা সীমিত অংশ নিয়ে আলোচনা করা। কিন্তু নীতিবিদ্যা একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ক্রিয়া (activity)-র দিক থেকে, অর্থাৎ লক্ষ্য বা আদর্শ অনুসরণ করার দিক থেকে মানুষের সমগ্র অভিজ্ঞতা (whole of experience) নিয়ে আলোচনা করে। যেহেতু বিজ্ঞানের কাজ মানুষের অভিজ্ঞতার কোন সীমিত বিভাগের আলোচনা করা, সেহেতু নীতিবিদ্যাকে কোন মতেই বিজ্ঞানরূপে গণ্য করা সমীচীন নয়। নীতিবিদ্যা দর্শনের অংশ; যেহেতু নীতিবিদ্যা হল সমগ্র অভিজ্ঞতার আলোচনার অংশ বিশেষ (part of the study of experience as a whole)। নীতিবিদ্যা দর্শনের অংশস্বরূপ, কারণ ইচ্ছা বা ক্রিয়ার (will or activity) দিক থেকে জীবনের অভিজ্ঞতার আলোচনা করে নীতিবিদ্যা। চিন্তা করছে বা জানছে যে মানুষ তার আলোচনা নীতিবিদ্যা করলেও করে পরোক্ষভাবে; যে মানুষ ক্রিয়া করছে, অর্থাৎ কিনা কোন লক্ষ্য অনুসরণ করছে, সেই মানুষের আলোচনা করাই নীতিবিদ্যার কাজ। নীতিবিদ্যা, মানুষের সমগ্র ক্রিয়া (whole activity), যে কল্যাণ সে লাভ করতে চায় তার সমগ্র প্রকৃতি এবং সেই কল্যাণলাভে নিয়োজিত তার ক্রিয়ার সমগ্র তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করে। ম্যাকেঞ্জি বলেন, এই কারণে নীতিবিদ্যাকে নীতিবিজ্ঞানরূপে গণ্য না করে নীতিদর্শন রূপে গণ্য করাই সমীচীন, কারণ বিজ্ঞানের নয়, দর্শনেরই কাজ সমগ্র অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করা।
কোন কোন নীতিবিদ মনে করেন নীতিবিদ্যাকে দর্শনের অংশরূপে গণ্য না করে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান (normative science)-রূপে গণ্য করাই যুক্তিযুক্ত। দর্শনের কাজ তত্ত্ব (reality)-র যথাযথ স্বরূপ নিরূপণ করা। জগৎ ও জীবনের স্বরূপ ব্যাখ্যা এবং তার মূল্যাবধারণই দর্শনের কাজ। নীতিবিদ্যা দর্শনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু নীতিবিদ্যাকে দর্শনের অংশরূপে গণ্য না করাই সমীচীন। তত্ত্বের স্বরূপ নিরূপণ করা নীতিবিদ্যার কাজ নয়। ঈশ্বর, জগৎ ও মানুষ যা দর্শনের আলোচ্য বিষয় তার মধ্যে মানুষের সঙ্গে, বিশেষ করে মানুষের! আচরণের ভাল-মন্দ বিচার নিয়েই নীতিবিদ্যার আলোচনা। নীতিবিদ্যার আলোচনায় যেসব দার্শনিক সমক্ষার আলোচনা এসে পড়ে নীতিবিদ্যার কাছে সেগুলি কেবলমাত্র কতকগুলি বিনা প্রমাণে গৃহীত অনুমান মাত্র। তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ এবং যাথার্থ্য নিয়ে নীতিবিদ্যা আলোচনা করে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব, আত্মার অমরতা, ইচ্ছা-স্বাধীনতা এগুলি নীতিবিদ্যার স্বীকার্য সত্য। নীতিবিদ্যা এগুলির যাথার্থ্য প্রমাণে সচেষ্ট হয়নি। সে কারণে কোন কোন নীতিবিদ মনে করেন যে, নীতিবিদ্যাকে দর্শনের অংশরূপে গণ্য না করে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানরূপেই গণ্য করা উচিত।
আমাদের মতে নীতিবিদ্যাকে দর্শনের অংশ মনে না করে বিজ্ঞানরূপেই গণ্য করা উচিত। অবশ্য নীতিবিদ্যা কোন প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়, আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা নীতিবিদ্যা দর্শনের অংশ বিজ্ঞান, যেহেতু অন্যান্য বিজ্ঞানের মতো একটি নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে নয়, আদর্শনিঃ বিজ্ঞান নির্ভুল, সুশৃঙ্খল এবং সুসংবদ্ধ জ্ঞান নীতিবিদ্যা দিতে চায়। নীতিবিদ্যা আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, যেহেতু যে আদর্শকে সামনে রেখে আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করলে আমাদের আচরণ যথোচিত হবে. তা নির্ধারণ করাই নীতিবিদ্যার কাজ।
৮। নীতিবিজ্ঞান কি ব্যবহারিক বিজ্ঞান? (IS Ethics a Practical Science?):
কোন কোন নীতিবিজ্ঞানী মনে করেন যে, নীতিবিজ্ঞান কেবলমাত্র আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান নয়; আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞান উভয়ই; আবার কেউ কেউ মনে করেন, নীতিবিজ্ঞান কেবলমাত্র আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান নয়। এই মতবিরোধ বিচার করার পূর্বে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য বুঝে নেওয়া দরকার:
আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান কোন একটি আদর্শের আলোকে বিষয়বস্তুর মূল্য বিচার করে; অপর দিকে ব্যবহারিক বিজ্ঞান আমাদের কতকগুলি বিধি বা নিয়ম শিক্ষা দেয় যার সাহায্যে আমাদের জ্ঞানকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আমাদের কোন উদ্দেশ সফল হতে পারে। বিজ্ঞান অর্থাৎ তত্ত্বনিষ্ঠ বিজ্ঞান (Theoretical science) শেখায় জানতে আর ব্যবহারিক বিজ্ঞান (Practical science) শেখায় কিভাবে কাজ করতে হবে। যেমন চিকিৎসা বিজ্ঞান হল একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান। আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান আদর্শের স্বরূপ. নির্ণয় করতে চেষ্টা করে, সকল ক্ষেত্রে ব্যবহারিকবিধি বা নিয়মকানুনের নির্দেশ দেয় না; যেমন সৌন্দর্যবিজ্ঞান। সৌন্দর্যবিজ্ঞান হল আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান নয়। সৌন্দর্যের আদর্শের স্বরূপ নির্ণয় করা সৌন্দর্যবিজ্ঞানের কাজ। কিভাবে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যেতে পারে তা নির্ধারণ করা সৌন্দর্যবিজ্ঞানের কাজ নয়। তর্কবিজ্ঞান কিন্তু আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞান উভয়রূপেই গণ্য হয়।
অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি মনে করেন যে, নীতিবিজ্ঞান হল কেবলমাত্র আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান। তাঁর মতে নীতিবিজ্ঞানকে আদর্শের স্বরূপ বুঝে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং কিভাবে সেই আদর্শটিকে লাভ করা যেতে পারে তার জন্য বিধি নির্ণয় করার আশা সে অবশ্যই করবে না। একথা বলা প্রয়োজন যে নীতিবিজ্ঞানকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলার অর্থ এই নয় যে, ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে এর কোন প্রত্যক্ষ সংস্রব বা সম্পর্ক আছে।" নীতিবিজ্ঞান পাঠ করলেই যে মানুষ নীতিনিষ্ঠ বা সাধু হবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। পরমকল্যাণ বা পরমার্থের আদর্শটি নিরূপণ করাই এর কাজ। পরমার্থলাভের উপায় নীতিবিজ্ঞান নির্ধারণ করে না। সুতরাং নীতিবিজ্ঞান আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান নয়। মুরহেড (Muirhead)-ও বলেন, "নীতিবিজ্ঞানকে মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলি থেকে এই অজুহাতে আলাদা করা হয় যে, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানগুলি তাত্ত্বিক বা তত্ত্বনিষ্ঠ, কিন্তু নীতিবিজ্ঞান ব্যবহারিক। 'অবশ্য পরীক্ষা করে দেখলেই বোঝা যায়, এদের পার্থক্য খুব গভীর নয়। একথা সত্য যে, নীতিবিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের যত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, জ্যোতির্বিয়া ও শারীরবৃত্তির সঙ্গে তত নয়; কিন্তু এ আমাদের বেশী দূর নিয়ে যেতে পারেনা। কারণ, অতি সহজেই দেখান যেতে পারে যে, বিজ্ঞান হিসেবে নীতিবিজ্ঞান যেমন জ্যোতির্বিদ্যা ও শারীরবৃত্তের ন্যায় তত্ত্বনিষ্ঠ বা তাত্ত্বিক, তেমনই এ সব বিজ্ঞান আবার নৌবিদ্যা ও আরোগ্যবিয়ার ভিত্তি হিসেবে নীতিবিজ্ঞানের মতন। ব্যবহারিক।"
আবার কোন কোন নীতিবিজ্ঞানী মনে করেন যে, যেহেতু নীতিবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু মানুষের আচরণ বা ঐচ্ছিক ক্রিয়া এবং যেহেতু নীতিবিজ্ঞান কিভাবে মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে সে সম্পর্কে জ্ঞান দেয়, সেহেতু নীতিবিজ্ঞান ব্যবহারিক বিজ্ঞান। সেথ, (Seth) বলেন, যেহেতু তত্ত্বকে (theory) অনুশীলন (Practice) থেকে পৃথক করা চলে না, সেহেতু নীতিবিজ্ঞান তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয়ই। নৈতিক অন্তর্দৃষ্টি (moral insight) নৈতিক জীবনের প্রয়োজনীয় শর্ত এবং যে বিজ্ঞান এ অন্তঃদৃষ্টিকে গভীর করে সে বিজ্ঞান একাধারে তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক।
উপসংহারে বলা যেতে পারে যে, নীতিবিজ্ঞানকে ব্যবহারিক বিজ্ঞানরূপে গণ্য না করাই যুক্তিযুক্ত। নীতিবিজ্ঞান আমাদের নৈতিক আদর্শের স্বরূপ নির্ণয়ের চেষ্টা করে। আদর্শের তাত্ত্বিক আলোচনাই নীতিবিজ্ঞানের মুখ্য উদ্দেশ্য। কি উপায় বা কোন্ নিয়ম অনুসরণ করে এ আদর্শকে আমাদের জীবনে লাভ করা যায় তা নির্দেশ করা নীতিবিজ্ঞানের কাজ নয়। কিভাবে সৎ জীবন যাপন করা যেতে পারে, নীতিবিজ্ঞান তা আমাদের শিক্ষা দেয় না। বস্তুতঃ, আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানের কাজ হল আদর্শের ব্যাখ্যা করা, আদর্শলাভের ব্যবহারিক উপায় নির্ধারণ করা নয়। কোন্ নীতির সহায়তায় জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করা যায়, নীতিবিজ্ঞান সে সম্বন্ধে জান দেয়। কিভাবে এ নীতিকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা যেতে পারে নীতিবিজ্ঞান তা শিক্ষা দেয় না। অবশ্য আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে নীতিবিজ্ঞানের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে তা আমরা অস্বীকার করি না। নীতিবিজ্ঞানের সমস্যার আলোচনা ও তার সমাধানের চেষ্টা আমাদের জীবনে প্রভাব বিস্তার করবেই; কিন্তু এ প্রভাব বিস্তার নীতিবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বা অপরিহার্য পরিণতি নয়। নীতিবিজ্ঞান পাঠ করেও কেউ নীতিভ্রষ্ট জীবন যাপন করতে পারে; আবার নীতিবিজ্ঞান পাঠ না করেও লোকে সৎ জীবন যাপন করতে পারে। নীতিবিজ্ঞান আমাদের নৈতিক আদর্শের স্বরূপ নির্ণয় করে; কিন্তু এ আদর্শকে অনুসরণ করার ইচ্ছা ও দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। নীতিবিজ্ঞানকে এজন্য ব্যবহারিক বিজ্ঞান না বলাই যুক্তিযুক্ত।
৯। নীতিবিজ্ঞান কি কলাবিদ্যা? (Is Ethics an Art?):
নীতিবিজ্ঞানকে যদি ব্যবহারিক বিজান হিসেবে আমরা গণ্য করতে না পারি, তবে তাকে আমরা কলাবিদ্যা হিসেবেও গণ্য করতে পারি না। আমরা কোন আচরণের কলাবিদ্যার কথা বলতে পারি না। কেননা এমন কোন শাস্ত্র বা বিদ্যা নেই যা আমাদের নৈতিক আচরণের কলাকৌশল শিক্ষা দিতে পারে। যদি স্বীকার করে নেওয়া যায় যে, এমন কোন শাস্ত্র আছে যা আমাদের নৈতিক কর্মবিধি বা নৈতিক আচরণের নিয়মাবলী শিক্ষা দেয়, সেই শাস্ত্র কিভাবে সেগুলিকে বাস্তবে প্রয়োগ ক্রতে হবে তা শিক্ষা দেয় না। এমন হতে পারে যে, নৈতিক কর্মবিধিগুলি কি আমরা তা জানি, কিন্তু চরিত্রের দুর্বলতা বা সঙ্কল্পের দৃঢ়তার অভাবের জন্য বাস্তবে সেগুলিকে প্রয়োগ করতে আমরা ব্যর্থ হতে পারি। নীতিবিজ্ঞান একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। পরমকল্যাণের আলোকে আচরণের ঔচিত্য ও অনৌচিত্য নিরূপণ করা নীতিবিজ্ঞানের কাজ। নৈতিক জীবন যাপনের কলাকৌশল নীতিবিজ্ঞান এশিক্ষা দেয় না। নৈতিক কর্মবিধি রচনা করা নীতিবিজ্ঞানের কাজ নয়। কিভাবে আমাদের কামনাবাসনাকে সংযত করতে হয়, ইচ্ছাকে সুদৃঢ় করতে হয় এবং সাধু জীবনের অনুশীলন করতে হয়, নীতিবিজ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেয় না। কাজেই নীতিবিজ্ঞানকে ব্যবহারিক বিজ্ঞান বা কলাবিথ্যা হিসেবে গণ্য না করে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করাই যুক্তিসঙ্গত।
নীতিবিজ্ঞান কি কলাবিদ্যা? (Is Ethics an Art?) |
কোন আচরণের কলাবিদ্যা আছে কী? (Is there any art of Conduct?):
এসম্পর্কে নীতিবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। নীতিবিজ্ঞানী লিলি Lillie)-র' মতে সৎ জীবন যাপনের সঙ্গে কলাবিদ্যার সাদৃশ্য আছে এবং অসাদৃশ্যও আছে এবং এই পার্থক্যের কথা স্মরণ রেগেই সৎ জীবন যাপনের কলার কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু নীতিবিজ্ঞানী ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) কোন আচরণের কলাবিদ্যা স্বীকার করতে চান না। আমরা উভয় নীতিবিজ্ঞানীর যুক্তিগুলি আলোচনা করে দেখব:
লিলির মতে সৎ আচরণের (good conduct) সঙ্গে চিত্রকলা বা সঙ্গীতকলার মত চারুকলার (fine arts) সাদৃশ্য আছে, যার জন্য আচরণ-বিদ্যার (art of conduct) কথা মনে এসে যায়।
প্রথমতঃ, চিত্রকর যেমন দীর্ঘকালীন এবং যত্নশীল অনুশীলনের মাধ্যমে অঙ্কন শিক্ষা করে, তেমনি যা উচিত তা করতে আমরা শিক্ষা করি। আমরা স্বীকার করতে পারি সৌন্দর্যের প্রকৃতি সম্পর্কে উপলব্ধি যেমন চিত্রকরের অঙ্কনে সহায়তা করে তেমনি নৈতিক নীতিগুলির উপলব্ধি ভালত্বের অনুশীলনে সহায়ক হয়। কিন্তু সৎ আচরণ এবং চিত্রাঙ্কন, উভয় ক্ষেত্রেই, তাত্ত্বিক আলোচনার তুলনায় অনুশীলনই অধিকতর সাফল্য নিয়ে আসে।
দ্বিতীয়তঃ, সৎ আচরণ এবং চিত্রাঙ্কন উভয়ই ক্রিয়া যা প্রত্যক্ষভাবে বাহ্য জড় জগতে পরিবর্তন সূচনা করে। উভেয়রই লক্ষ্য হল ক্রিয়া, জ্ঞান নয়।
তৃতীয়তঃ, চারুকলার মত সুন্দর আচরণও এমন কিছু উৎপাদন করে যাও নিজেরই সৌন্দর্য বা উৎকর্ণ আছে। একটি মহৎ কার্য, আমাদের মনে সেই প্রশংসা জাগরিত করে যা একটি সুন্দর চিত্র বা 'মহৎ কবিতা' আমাদের মনে জাগরিত করে। কিন্তু লিলির মতে সৎ আচরণ ও চারুকলার মধ্যে কয়েক বিষয়ে অসাদৃশ্যও বর্তমান।
প্রথমতঃ, কলার সম্পর্ক ব্যক্তির বিশেষ এক ধরনের ক্রিয়ার সঙ্গে, কিন্তু সং আচরণের সম্পর্ক কোন ব্যক্তির সব কাজের সঙ্গে। চিত্রকরের কার্য শুধুমাত্র কলার মানদণ্ডে নয়, নৈতিক মানদণ্ডেও বিচার্য। কেননা তার অঙ্কিত চিত্র সুন্দর বলে স্বীকৃত হলেও, সেই চিত্রের মন্দ প্রভাব থাকতে পারে। দ্বিতীয়তঃ, চিত্রকর কোন সময় তার কলার অনুশীলন করতে পারে, অন্য সময় অনুশীলন থেকে বিরত হতে পারে। কিন্তু সৎ বক্তিকে সকল সময়ই সততার অনুশীলন করতে হবে। নৈতিক জীবনে কোন ছুটি থাকতে পারে না (There can be no holidays in the moral life) অন্যান্য কলারও অনুশীলনের প্রয়োজন আছে। কোন গায়ক যদি অনুশীলন থেকে বিরত হয় তাহলে সেটা তার কলার পক্ষে ক্ষতিকারক হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার জীবনে সব সময়ই তাকে অনুশীলনে রত থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। কিন্তু প্রকৃত সং ব্যক্তিকে সকল সময়ই সৎ আচরণে রত থাকতে হবে।
তৃতীয়তঃ, সৎ অভিপ্রায় কলার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়। আমর, একজন চিত্রকর কি সৃষ্টি করল তা দিয়ে চিত্রকরের বিচার করি, কী সৃষ্টি কর। তার অভিপ্রায় ছিল তাই দিয়ে বিচার করি না। কিন্তু নৈতিকতার ক্ষেত্রে আমরা কোন ব্যক্তিকে সৎ মনে করি, যদি আমরা দেখি যে বাহৃতঃ ভাল ফল উৎপন্ন করতে না পারলেও কর্মকর্তার অভিপ্রায় ভাল ছিল। নীতিবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার কাজের বিচার করতে গিয়ে তার উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের বিচারই করে থাকি, কলার ক্ষেত্রে তা করি না। চতুর্থতঃ, চিত্রকর হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি ভাল চিত্র আঁকতে পারেন। কিন্তু সৎ ব্যক্তি হল এমন একজন ব্যক্তি যিনি শুধু সৎ কাজ সম্পাদন করতে পারেন যে তা নয়, তিনি সৎ কাজ সম্পাদন করেন। চিত্রকর যদি তার কলার অনুশীলন না করেন, তাহলে তার যে দক্ষতা তাকে চিত্রকর নামের যোগ্য করে তোলে, সেই দক্ষতার হানি ঘটবে। কিন্তু সৎ ব্যক্তির সংকার্য করার ক্ষমতা অপ্রকাশিত থেকে যাবে যদি তার প্রকাশের কোন উপযুক্ত সুযোগ না ঘটে। অবশ্য এক্ষেত্রে পার্থক্যটা যতটা মাত্রাগত, ততটা গুণগত নয়। চিত্রকর এবং সৎ ব্যক্তি, উভয়ের ক্ষেত্রেই, সুযোগ এলেই তাঁদের ক্ষমতার প্রকাশের প্রয়োজন আছে।
লিলির বক্তব্য হল, আমর। ছয়' ধরনের নীতিবিস্তার কথ। কলতে পারি, যার মধ্যে সৎ জীবনযাপনের কলাবিদ্যাকে (the art or practice of living a good life) অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।
ম্যাকেঞ্জির (Mackenzie)-র মতে নীতিবিজ্ঞান আমাদের আচরণকলা শেখায়, এরূপ চিন্তা করা যুক্তিসঙ্গত নয়। নীতিবিজ্ঞানের সঙ্গে সৌন্দর্যবিজ্ঞান এবং তর্কবিজ্ঞানের মিল আছে। সৌন্দর্যবিজ্ঞানের সম্পর্ক চারুকলা নিয়ে এবং তর্কবিজ্ঞান সঠিক চিন্তার কলাকৌশলের ভিত্তিটা যুগিয়ে দেয়। কাজেই ধারণা করা হয় যে, নীতিবিজ্ঞানও আমাদের আচরণকলার নীতিগুলি শিক্ষা দেয়। কিন্তু ম্যাকেঞ্জি বলেন, এরূপ সিদ্ধান্ত করার বিরুদ্ধে সর্বপ্রধান যুক্তি হল, আচরণের সারবস্তু কোন বিশেষ ধরনের দক্ষতার অধিকারী হওয়া নয়, আচরণের সারবস্তু হল ইচ্ছার মনোভাব (attitude of will)। ম্যাকেজির মতে কেবলমাত্রই ক্রিয়াতেই সততার অস্তিত্ব (Virtue exists only in activity)। একজন ভাল চিত্রকর হলেন তিনি, যিনি সুন্দরভাবে চিত্র অঙ্কন করতে পারেন। কিন্তু সৎ ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি শুধু যে সঠিকভাবে কাজ করতে সক্ষম তা নয়, যিনি সঠিকভাবে কাজ করেন। ভালত্ব বা সততা কোন সামর্থ্য বা সম্ভাবনা (capacity or potentiality) নয়, বরং ক্রিয়া (activity)। সত্যবাদী ব্যক্তি তিনি নন, যিনি সত্য কথা বলতে পারেন, বরং যিনি সত্যকথা বলে থাকেন। সৎ ব্যক্তি হলেন তিনি যিনি কর্তব্য করার অভ্যাস অনুশীলন করেন। কাজেই সততা ক্রিয়ার ব্যাপার, ক্রিয়াতেই সততার অস্তিত্ব।
সততার সারবস্তু ইচ্ছাতেই নিহিত (The essence of virtue lies in the will)। দক্ষতার অধিকারী হওয়াই হল কলার মূল কথা। কিন্তু ইচ্ছার মনোভাবের দ্বারাই নৈতিকতা বিচার্য। যদিও কোন বাহ্য কাজ বাস্তবে সম্পন্ন হয়নি তবু সেই কাজের পিছনে ইচ্ছার মনোভাব থাকতে পারে-উদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, সঙ্কল্প, নির্বাচন ইত্যাদি। বাহ্য কাজ সম্পাদিত না হলেও নৈতিক আভ্যন্তরীণ মানসিক প্রক্রিয়াতে নিহিত থাকতে পারে। কান্ট (Kant)-এর মতে কি করা হল তার বিচারে নয়, কি ইচ্ছা করা হল তার বিচারেই ইচ্ছার ভালত্ব। কোন ক্রিয়ার নৈতিকতা কাজের ফলাফলের ওপর নির্ভর করে না, আভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়ের ওপর নির্ভর করে। যেখানে বাহ্য ক্রিয়ার সুযোগ নেই সেখানে ইচ্ছার সঠিক বা যথোচিত মনোভাবই (right attitude of the will) নৈতকতা সূচনা করে। কলার উদ্দেশ্য কোন ফল উৎপাদন করা, কিন্তু নৈতিকতার সম্পর্ক উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ের পবিত্রতা বা শুদ্ধতার সঙ্গে, ইচ্ছার সঠিক মনোভাবের সঙ্গে, বিশেষ করে যেখানে বাহ্য ক্রিয়া ঘটবার কোন সম্ভাবনা নেই।
সুতরাং ম্যাকেজির মতে কোন আচরণের কলাবিদ্যা (art of conduct) স্বীকার কর। যুক্তিসঙ্গত নয়।
১০। নাতিবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য (End of Ethics):
নীতিবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য হল সমাজে বসবাসকারী মানুষের পরমকল্যাণ বা পরমার্থের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা। মানবজীবনের পরমার্থ বলতে কি বুঝা যায়, নীতিবিজ্ঞান তাই নির্ধারণ করে। এ-পরমার্থ বা পরমকল্যাণ একাধারে ব্যক্তিগত কল্যাণ ও সামাজিক কল্যাণ। এ পরনকল্যাণের আদর্শই সকল প্রকার নৈতিক বিচারের মূলগুরূণ। মানুষের কোন্ আচরণ শেষ পর্যন্ত ভাল কি মন্দ এই আদর্শের সাহায্যেই তা নির্ধারণ করা সম্ভব। তত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে নীতিবিজ্ঞানের এই হল উদ্দেশ্য। যদিও আমরা নীতিবিজ্ঞানকে ব্যবহারিক বিজ্ঞানরূপে গণ্য করি না তবু একথা স্বীকার করতে হবে যে, পরমকল্যাণের আদর্শ থেকেই নৈতিক কর্তব্য (duty) ও সততার (virtue) ধারণা পাওয়া যায় এবং এ ধারণাকে আমরা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করার ব্যাপারে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। নীতিবিজ্ঞান ব্যবহারিক বিজ্ঞান নয়, অর্থাৎ কিভাবে আমরা সৎ জীবন যাপন করতে পারি, নীতিবিজ্ঞান সে বিষয়ে আমাদের কোন প্রত্যক্ষ নির্দেশ দেয় না। কিন্তু পরমকল্যাণের আদর্শের প্রভাবে আমরা আমাদের কর্তব্য ও সততা সম্পর্কীয় যে ধারণাগুলিকে গঠন করি সেগুলির সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক জীবনের একটা গভীর যোগাযোগ আছে। আমাদের আচরণকে আমরাই নিয়ন্ত্রিত করি, কিন্তু নীতিবিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে জীবনকে পরিচালিত করলে তা হয় সুষ্ঠু ও সুন্দর। অনুশীলনের মাররুতই জ্ঞানের যথার্থ প্রকাশ ও প্রচার হয়।
"There is no meaning in the right unless it involves the
ought." 1
-Kant: Critique of Practical Reason.
১৩
1. "Character means the complete universe or system constituted by acts -
of will of a particular kind,
Mackenzie: A Manual of Ethics; Page 67.
1. "The term virtue is employed to denote a good hab't of character as distinguished from a duty which denotes rather some particular kind of action which we ought to perform. Thus a man does his duty but he possesses a virtue or is virtuous."
1. "It should be carefully observed, lowever, that the term 'good' is used (perhaps even more frequently) to signify not something which is a means to an end but something which is itself taken as an end".
-Mackenzie: A manual of Ethics;
Page 2.
2
1. "The fittingness of a rigtion action often appears to consist in its confor- mity to some rule"
-Lillie: An Introduction to Ethics; Page 7.
1. Ethics is the science or general study of the ideal involved in human life". -Mackenzie: A Manual of Ethics; Page 1.
2. "We may define ethics as the normative science of the conduct of human beings living in societies-a science which judges this conduct to be right or wrong, to be good or bad, or in some similar way."
-William Lillie: An Introduction to Ethies; Page 2,
1. Ethics may be defined as the study of what is right or good in -Mackenzie: A Manual of Ethics; Page 1.
conduct."
1. "This is just the kind of question with which ethics deals what is the true meaning of such words as 'good' and 'right' and 'ought' which are
used so commonly in every day conversation."
-William Lillie: An Introduction to Ethics; Page 1,