জৈন জ্ঞানতত্ত্ব
জৈন জ্ঞানতত্ত্ব
প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক তর্ক ও বিতণ্ডায় প্রমাণ ও তর্কশাস্ত্র হলো নিজ নিজ দার্শনিক বিবেচনার মোক্ষম অস্ত্র, যা দিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের পাশাপাশি নিজের যুক্তি ও মত প্রতিষ্ঠিত করায় বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তা থেকে জৈন দার্শনিকরাও কোন অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। বরং প্রমাণশাস্ত্র জৈনদর্শনের এক মহত্ত্বপূর্ণ শাখা। এক্ষেত্রে খ্রীষ্টিয় প্রথম শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন জৈন দার্শনিকদের প্রত্যক্ষ অবদানে জৈনদর্শনের যে বিশেষ বিকাশ ঘটে, তারই উজ্জ্বলতম নিদর্শন হলো জৈনদের এই প্রমাণশাস্ত্র যা মূলত ভারতীয় দর্শনকেই একাধারে মহিমান্বিত করেছে।
জ্ঞান
জৈনদর্শনে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকৃত। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে যখন সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তখন জ্ঞান উৎপন্ন হয়। বস্তুবাদী হিসেবে জৈনরা চেতনার বাইরে বহির্বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্বে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন, চেতন ও অচেতন বস্তুর মধ্যে যে পার্থক্য তা মৌলিক। মন বা চেতনা কোনভাবেই অচেতন বস্তুকে সৃষ্টি করতে পারে না। চেতনা বস্তুকে প্রকাশ করে মাত্র। বস্তুর সৃষ্টি বা রূপান্তরের ক্ষেত্রে চৈতন্যের কোন ভূমিকা নেই।
জৈনদর্শনে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকৃত। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে যখন সম্বন্ধ স্থাপিত হয় তখন জ্ঞান উৎপন্ন হয়। বস্তুবাদী হিসেবে জৈনরা চেতনার বাইরে বহির্বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্বে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। তাঁরা মনে করেন, চেতন ও অচেতন বস্তুর মধ্যে যে পার্থক্য তা মৌলিক। মন বা চেতনা কোনভাবেই অচেতন বস্তুকে সৃষ্টি করতে পারে না। চেতনা বস্তুকে প্রকাশ করে মাত্র। বস্তুর সৃষ্টি বা রূপান্তরের ক্ষেত্রে চৈতন্যের কোন ভূমিকা নেই।
.
জৈনমতে চৈতন্য আত্মার স্বরূপ বা স্বাভাবিক গুণ। এই চৈতন্যের উপমা দেয়া হয় সূর্যের সাথে। সূর্যের প্রকাশ থেকে অন্য বস্তুরাজির প্রকাশের (=দৃশ্যমান) সাথে সাথে যেমন সূর্য নিজেও প্রকাশ হয়, তেমনি স্বরূপত চৈতন্যময় আত্মা যখন বহির্জগৎ ও আন্তর্জগতের সংস্পর্শে আসে তখন আমাদের বহির্বিষয় ও আন্তরবিষয়ের জ্ঞান হয়। এই মতে প্রতিটি আত্মা স্বরূপত সর্বজ্ঞ, অর্থাৎ জীবকে অনন্ত জ্ঞানবিশিষ্ট বলে স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু কর্মের আবরণে জীবের শুদ্ধ চৈতন্যরূপ আচ্ছাদিত থাকে। জীবের কর্ম বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন পরিমাণে স্বাভাবিক চৈতন্যকে আবৃত করে বা চৈতন্যের প্রকাশে বাধা দান করে। জৈনমতে এমনকি দেহ, ইন্দ্রিয় এবং মনও চৈতন্যের স্বাভাবিক প্রকাশের পরিপন্থী। এর ফলে আত্মা সর্বজ্ঞ হতে পারে না। বদ্ধ জীব সব সময় কোন না কোন বাধার সম্মুখীন হয়। এইজন্য বদ্ধজীবের জ্ঞান কম-বেশি সীমিত।
.
জ্ঞানের প্রামাণ্য
জ্ঞানের প্রামাণ্য হলো মূলত জ্ঞানের সত্যতা বা যথার্থতা নির্ণয়। যার মাধ্যমে জ্ঞানের যথার্থতা নির্ণয় করা হয় তা হলো প্রমাণ। জৈনদার্শনিক হেমচন্দ্র সূরি ‘প্রমাণমীমাংসা’ গ্রন্থে প্রমাণের সংজ্ঞা দিয়েছেন-
.
জ্ঞানের প্রামাণ্য
জ্ঞানের প্রামাণ্য হলো মূলত জ্ঞানের সত্যতা বা যথার্থতা নির্ণয়। যার মাধ্যমে জ্ঞানের যথার্থতা নির্ণয় করা হয় তা হলো প্রমাণ। জৈনদার্শনিক হেমচন্দ্র সূরি ‘প্রমাণমীমাংসা’ গ্রন্থে প্রমাণের সংজ্ঞা দিয়েছেন-
‘সম্যগর্থনির্ণয়ঃ প্রমাণম্ ইতি।’- (প্রমাণমীমাংসা-২/২)
অর্থাৎ : সম্যক্ভাবে বিষয়ের নিশ্চয়কে প্রমাণ বলা হয়।
‘পরীক্ষামুখসূত্র’ গ্রন্থে মাণিক্যনন্দী বলেন-
‘হিতাহিতপ্রাপ্তিপরিহারসমর্থং হি প্রমাণম্’। (পরীক্ষামুখসূত্র-১/১)
অর্থাৎ : হিত বা প্রিয়কে গ্রহণে ও অহিত বা অপ্রিয়কে পরিহারে যা সমর্থ তা হচ্ছে প্রমাণ।
মাণিক্যনন্দীর সূত্রের ব্যাখ্যায় ‘প্রমেয়কমলমার্ত্তণ্ড’ গ্রন্থে প্রভাচন্দ্র প্রমাণের লক্ষণে বলেন-
‘স্বাপূর্বার্থব্যবসায়াত্মকং জ্ঞানং প্রমাণম্’।
অর্থাৎ : পূর্বে অনধিগত বিষয়ের ব্যবসায়াত্মক জ্ঞানই প্রমাণ।
কোনকিছু ত্যাজ্য হলে ত্যাগ করতে, গ্রাহ্য হলে গ্রহণ করতে বা উপেক্ষণীয় হলে উপেক্ষা করতে যা সমর্থ তা-ই প্রমাণ। আর প্রামাণ্য হলো প্রত্যক্ষ প্রভৃতি প্রমাণগত ধর্ম, যার নামান্তর প্রমাত্ব বা জ্ঞানের যথার্থতা। জ্ঞানের প্রামাণ্য বিষয়ে বিভিন্ন দর্শন সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন। মীমাংসক-মতে যে কারণ হতে জ্ঞান উৎপন্ন হয় সেই কারণ হতেই জ্ঞানে প্রামাণ্য বা প্রমাত্ব উৎপন্ন হয় এবং যে কারণ হতে জ্ঞানের জ্ঞান হয় সেই কারণ হতেই জ্ঞানগত প্রামাণ্যেরও জ্ঞান হয়। এই উভয়স্থলে অন্য কোন সামগ্রীর অপেক্ষা থাকে না, অর্থাৎ জ্ঞান ও জ্ঞপ্তি স্বয়ংপ্রকাশ। একে স্বতঃপ্রামাণ্যবাদ বলে।
অন্যদিকে ন্যায়-বৈশেষিক মতে জ্ঞানে প্রামাণ্য স্বতঃ উৎপন্ন হয় না, জ্ঞানসামান্যের সামগ্রী হতে প্রবৃত্তি-সামর্থ্য নামক অতিরিক্ত গুণকে অপেক্ষা করে। গুণজন্য হলেই জ্ঞানে প্রামাণ্য থাকে অর্থাৎ জ্ঞানটি প্রমা হয়। যেমন জলজ্ঞানের ক্ষেত্রে, এটা যে মরিচিকা নয়, তা নির্ভর করে তার জ্বলন নিবৃত্তি ও পিপাসা উপশমের সামর্থের উপর। এভাবে প্রমাত্বের জ্ঞানও জ্ঞানগ্রাহক সামগ্রী হতে অতিরিক্ত সামগ্রীকে অপেক্ষা করে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে জ্ঞান যে-ক্ষণে বস্তুকে প্রকাশ করে সেইক্ষণে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। বিষয় প্রকাশের পরক্ষণে জ্ঞান নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। এজন্য ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে জ্ঞানের জ্ঞানকে বলা হয় ‘অনুব্যবসায়’। জ্ঞানের জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রমাণের (=অনুব্যবসায়ের) দ্বারা গম্য হলে জ্ঞানগত প্রামাণ্যের জ্ঞান ‘এই জ্ঞানটি প্রমা, কেননা তা সংবাদিপ্রবৃত্তির জনক’ এরূপ অনুমান (=অনুমিতির) দ্বারা গম্য হয়। একে পরতঃপ্রামাণ্যবাদ বলে।
জৈনমতে আত্মা যখন অন্য বস্তুকে প্রকাশিত করে, তখন তা নিজেকেও প্রকাশ করে। কিন্তু জৈনমতে জ্ঞান যে-ক্ষণে বিষয়কে প্রকাশ করে সেইক্ষণে নিজেকেও প্রকাশ করে। অর্থাৎ জ্ঞান ‘স্বয়ংপ্রকাশ’। তবে জ্ঞানের প্রামাণ্যের ক্ষেত্রে জৈনদর্শন একই সঙ্গে স্বতঃ ও পরতঃপ্রামাণ্যবাদী বলে পরিচিত, অর্থাৎ তাঁরা মনে করেন যে জ্ঞানের প্রামাণ্য জ্ঞানাতিরিক্ত শর্তের উপর সবসময় নির্ভরশীল নয়। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য যে, সাধারণ জীবের জ্ঞানের ক্ষেত্রে ও অপরিচিত বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে জৈনরা পরতঃপ্রামাণ্যবাদী। মুক্ত জীবের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং পরিচিত বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁরা স্বতঃপ্রামাণ্যবাদী। কেননা, জৈনমতে মুক্ত জীবের জ্ঞান তার প্রামাণ্যের জন্য জ্ঞানাতিরিক্ত কোন শর্তের উপর নির্ভর করে না। অর্থাৎ তাঁদের সম্মত হচ্ছে উভয়তঃ প্রামাণ্যবাদ। তাই ‘পরীক্ষামুখসূত্র’ গ্রন্থে বলা হয়েছে-
‘তৎপ্রামাণ্যং স্বতঃ পরতশ্চ’। (পরীক্ষামুখসূত্র-১/১৩)
অর্থাৎ : তার (জ্ঞানের) প্রামাণ্য স্বতঃ ও পরতঃ উভয়ই।
জৈনমতে জ্ঞানের জ্ঞপ্তিতে ও স্বকার্যে অভ্যাস ও অনভ্যাস দশার উপর নির্ভর করে কোথাও স্বতঃ এবং কোথাও পরতঃ প্রামাণ্য স্বীকৃত। যেমন, অভ্যাস দশাপন্ন নিজের করতল প্রভৃতির প্রত্যক্ষ জ্ঞানে প্রামাণ্য স্বতঃগ্রাহ্যতা নিশ্চিত হয়। এই মতে, প্রমাতাকে যদি আর কোন প্রমাণের দ্বারা জ্ঞানের প্রামাণ্য যাচাই করতে না হয়, সকল প্রকারের ব্যভিচার শঙ্কা দূর হলে সর্ববিধ অনুমানেই সর্বথা প্রামাণ্যের স্বতগ্রাহ্যতা স্বীকার করা হয়। কিন্তু অনভ্যস্ত দশাপন্ন প্রত্যক্ষ স্থলে প্রামাণ্যের নিশ্চয় পরতঃ হয়। তাই ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ বলা হয়েছে-
‘তত্রাভ্যাসাৎ প্রমাণত্বং নিশ্চিতং স্বত এব নঃ।
অনভ্যাসে তু পরতঃ ইত্যাহুঃ কেচিদঞ্জসা।।’- (পরীক্ষামুখসূত্র)
অর্থাৎ : আমাদের (=জৈনমতে) মতে অভ্যাসদশায় স্বতঃপ্রামাণ্যের নিশ্চয় হয়, কিন্তু অনভ্যাস দশায় পরতঃপ্রামাণ্য স্বীকার করা হয়। তবে দৃষ্টার্থ প্রত্যক্ষ স্থলে বিষয়ের অব্যভিচার দুর্জ্ঞেয় বলে প্রামাণ্যের পরতঃ নিশ্চয় সংবাদী প্রবৃত্তিরূপ অনুমান প্রমাণের অধীন হয়ে থাকে।
জ্ঞানের জ্ঞপ্তিতেও অনভ্যাসদশায় প্রামাণ্য স্বতঃ অবস্থান করে না, কেননা সত্য বা অসত্য এরূপ সন্দেহবিপর্যয় দেখা যায়। কিন্তু অভ্যাসদশায় প্রামাণ্য ও অপ্রামাণ্য উভয়ই স্বতঃ গৃহীত হয়। তবে অভ্যাসদশায় বিষয়ের প্রতি গমনরূপ প্রবৃত্তিলক্ষণ স্বকার্যে স্বতঃ প্রামাণ্য থাকে না, কেননা তা অপ্রামাণ্যের মতো স্বগ্রহণ সাপেক্ষ হয়ে থাকে। যেমন- তা ‘অসত্য’ এই জ্ঞান নিবৃত্তিমূলক স্বকার্যকারী হয়, অন্যক্ষেত্রে (অর্থাৎ অজ্ঞাত হয়ে অভ্যাসদশায়) তা হয় না। এভাবেই জৈনসম্প্রদায় স্বতঃ ও পরতঃ এই উভয়তঃ প্রামাণ্যের উপযোগ গ্রহণ করেছেন।
জ্ঞানের ভেদ- যথার্থ ও অযথার্থ :
জৈনমতে যে জ্ঞানের দ্বারা ইষ্টলাভ হয় ও অনিষ্ট পরিহার করা হয় সেই জ্ঞান হলো সত্য বা যথার্থ। জ্ঞানের এই যথার্থ নির্ণয় হয় প্রমাণের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে প্রমাণ হলো জ্ঞান-প্রকাশক। জৈনদার্শনিক সিদ্ধসেন দিবাকর বলেছেন-
‘বিজ্ঞানম্ স্বপরভাসি প্রমাণম্ বাধবর্জিতম্’। (ন্যায়াবতার)
অর্থাৎ : প্রমাণ হলো তা-ই যা নিজেকে এবং অপর বিষয়কে প্রকাশ করে এবং যা বিরোধমুক্ত।
জৈনমনীষী অকলঙ্ক ও হেমচন্দ্রও যথার্থজ্ঞানকে অনুরূপভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন। এ বিষয়ে জৈনমতের সঙ্গে ন্যায়মত ও বৌদ্ধমতের মিল পাওয়া যায়। ন্যায়মতে অর্থপ্রাপকত্ব বা প্রবৃত্তিসামর্থ্য হলো প্রামাণ্যের মাপকাঠি। বৌদ্ধমতে অবিসংবাদিত্ব বা অবাধিতত্ত্ব হলো প্রামাণ্যের মাপকাঠি। জৈনদর্শন মনে করে, যথার্থ জ্ঞান যেমন অর্থপ্রাপক তেমনি আবার অবিসংবাদী। যে জ্ঞান বিষয়ের অযথার্থ রূপকে প্রকাশ করে সে জ্ঞান হলো অপ্রমা বা মিথ্যাজ্ঞান। তাই জৈনমতে জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়- যথার্থ ও অযথার্থ। কোন কোন জৈন-দার্শনিকের মতে- অবধি, মনঃপর্যায়, কেবল, মতি ও শ্রুত ভেদে যথার্থ জ্ঞান পাঁচ প্রকার। যথার্থ জ্ঞান যেহেতু মিথ্যা জ্ঞান নয়, তাই তাকে শুধু জ্ঞান হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। অন্যদিকে যাতে যা নেই তাতে তার জ্ঞান, অথবা যা যেরূপ নয় তাকে সেভাবে জানা হচ্ছে অযথার্থ জ্ঞান। জৈনমতে স্মৃতি যথার্থ হয়, কিন্তু ন্যায়মতে অযথার্থ স্মৃতিও স্বীকৃত। অযথার্থ বা মিথ্যজ্ঞান জৈনমতে তিনপ্রকার- বিপর্যয়, সংশয় ও অনধ্যবসায়।
বিপর্যয় : যে বস্তুতে যা নেই তাতে তার জ্ঞান বা যে যা নয় তাকে সেরূপে জানা হচ্ছে বিপর্যয়। নামান্তরে তাকে ভ্রম বা বিপর্যাসও বলা হয়। ‘প্রমাণমীমাংসা’ গ্রন্থে হেমচন্দ্র বিপর্যয়ের লক্ষণে বলেছেন-
‘অতস্মিংস্তদেবেতি বিপর্যয়ঃ’।
অর্থাৎ : বিপর্যয় হলো বস্তুস্বরূপের বিপরীত জ্ঞান।
আমরা যখন শুক্তিতে রজত প্রত্যক্ষ করি, তখন এরূপ জ্ঞানকে বলা হয় বিপর্যয়। বিপর্যয় প্রকৃতপক্ষে ভ্রমজ্ঞান। সংশয় ও অনধ্যবসায় জ্ঞানের সঙ্গে বিপর্যয়ের পার্থক্য হলো, সংশয় বা অনধ্যবসায় জ্ঞানে আমরা বস্তুর কোন গুণ সম্বন্ধেই নিশ্চিত হই না। কিন্তু বিপর্যয় জ্ঞানে আমরা বস্তুর অযথার্থ গুণকে নিশ্চিতভাবে জেনে থাকি। যখন তিমিররোগগ্রস্ত ব্যক্তি এক চন্দ্রকে দুই চন্দ্র বলে জানেন, কিংবা ভ্রমণজনিত কারণে যখন গতিহীন বৃক্ষাদিকে গতিশীল বলে মনে হয়, তখন এই সকল জ্ঞানকে বলা হয় বিপর্যয়। ন্যায়মতে একে অন্যথাখ্যাতি বলা হয়।
সংশয় : একই বিষয়ে যখন উভয় কোটির প্রত্যয় হয় তখন সেই জ্ঞানকে বলা হয় সংশয়। কোন বিষয় সম্বন্ধে বিকল্পগুলিকে বলা হয় ‘কোটি’। সংশয়ের লক্ষণে প্রমাণমীমাংসায় হেমচন্দ্র বলেছেন-
‘অনুভয়ত্রোভয়কোটিস্পর্শী প্রত্যয়ঃ সংশয়ঃ’।
অর্থাৎ : একই সাথে উভয় কোটিস্পর্শী প্রত্যয় হচ্ছে সংশয়।
ন্যায়সূত্রকার মহর্ষি গৌতম সংশয়কে ‘বিমর্ষ’ বলেছেন। বিমর্ষ হলো অনবধারণ জ্ঞান। কোন বিষয় সম্বন্ধে যখন নিশ্চিত অবধারণ থাকে না, তখন সেই জ্ঞানকে বলা হয় সংশয়। হেমচন্দ্রের লক্ষণের সঙ্গে গৌতম-প্রদত্ত সংশয়ের লক্ষণের বহুলাংশে সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। তবে প্রাচীন ন্যায়ে সংশয়ের কোটি বিষয়ে মতভেদ আছে। ক্ষেত্র বিশেষে নৈয়ায়িকগণ দুই-এর অধিক কোটি স্বীকার করেছেন। হেমচন্দ্রের লক্ষণে অবশ্য উভয় (দুই) কোটির কথাই বলা হয়েছে।
.
অন্ধকারে যখন আমরা দূর থেকে উর্ধ্বাকার কোন বস্তুকে দেখে সাধক ও বাধক প্রমাণের অভাব হলে ‘এটি স্থাণু (নির্জীব বস্তু) বা পুরুষ’ এরূপ অনিশ্চিত-অবধারণ বা অনবধারণযুক্ত হই, তখন এই জ্ঞানকে বলা হয সংশয়। তাতে সংশয়ের নিরাকরণের জন্য জৈন স্যাদবাদের অনেকান্তিক যুক্তিতে ‘ঘট আছে ও নেই’, ‘আত্মা নিত্য ও অনিত্য’ ইত্যাদি ভঙ্গিও প্রয়োগ করা যায় না। আমাদের অনবধারণের রূপ হলো- ‘স্থাণুর্বা বা পুরুষো বা অয়ম্’, ‘অস্তি বা নাস্তি বা ঘটঃ’, ‘নিত্য বা অনিত্য বা আত্মা’ ইত্যাদি। মোটকথা, সংশয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন কোটিদ্বয়ের মধ্যে কোনোটি সম্বন্ধেই আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। এরকম জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের মন একটা অস্বস্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
অনধ্যবসায় : অনধ্যবসায় হলো বস্তুর ‘অনিশ্চিত সামান্য জ্ঞান’। প্রমাণমীমাংসায় অনধ্যবসায়ের লক্ষণে হেমচন্দ্র বলেছেন-
অন্ধকারে যখন আমরা দূর থেকে উর্ধ্বাকার কোন বস্তুকে দেখে সাধক ও বাধক প্রমাণের অভাব হলে ‘এটি স্থাণু (নির্জীব বস্তু) বা পুরুষ’ এরূপ অনিশ্চিত-অবধারণ বা অনবধারণযুক্ত হই, তখন এই জ্ঞানকে বলা হয সংশয়। তাতে সংশয়ের নিরাকরণের জন্য জৈন স্যাদবাদের অনেকান্তিক যুক্তিতে ‘ঘট আছে ও নেই’, ‘আত্মা নিত্য ও অনিত্য’ ইত্যাদি ভঙ্গিও প্রয়োগ করা যায় না। আমাদের অনবধারণের রূপ হলো- ‘স্থাণুর্বা বা পুরুষো বা অয়ম্’, ‘অস্তি বা নাস্তি বা ঘটঃ’, ‘নিত্য বা অনিত্য বা আত্মা’ ইত্যাদি। মোটকথা, সংশয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন কোটিদ্বয়ের মধ্যে কোনোটি সম্বন্ধেই আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। এরকম জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের মন একটা অস্বস্তিপূর্ণ অবস্থায় থাকে।
অনধ্যবসায় : অনধ্যবসায় হলো বস্তুর ‘অনিশ্চিত সামান্য জ্ঞান’। প্রমাণমীমাংসায় অনধ্যবসায়ের লক্ষণে হেমচন্দ্র বলেছেন-
‘বিশেষানুল্লেখ্যনধ্যবসায়ঃ’।
অর্থাৎ : বিশেষের অনুল্লেখী হচ্ছে অনধ্যবসায়।
এইরূপ জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুর বৈশিষ্ট্য বা গুণ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট বোধ হয় না। পথ চলতে চলতে অন্ধকারে যখন কোন কিছুর স্পর্শ আমাদের পায়ে অনুভূত হয়, তখন প্রশ্ন জাগে- এটা কী ? এক্ষেত্রে বস্তুর নিছক স্পর্শগত বোধ আমাদের হয়ে থাকে। কিন্তু বস্তু সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ধারণা আমাদের হয় না। দূর, অন্ধকার প্রভৃতির দরুন অসাধারণ ধর্মের প্রশ্নমূলক অনিশ্চয়াত্মক প্রত্যয় হলো অনধ্যবসায়। যেমন ‘এটি কী ?’ অন্যেরা প্রত্যক্ষ প্রমাণজন্য জ্ঞান মনে করলেও অনির্দেশ্যতার কারণে এটি অনধ্যবসায়, কেননা এখানে বিশেষের উল্লেখ হয় না। বৈশেষিক দর্শনেও এরূপ অনধ্যবসায়ের নাম অবিদ্যা (=অযথার্থ জ্ঞান) স্বীকৃত হয়েছে। এই জ্ঞান ঔদাসীন্যের দরুন উৎপন্ন হয়।
জ্ঞানের বিভাগ
অন্যান্য দর্শনের মতোই জৈনগণও প্রমাণজন্য বা যথার্থ জ্ঞানকে পরোক্ষ (mediate) ও অপরোক্ষ (direct, imediate) ভেদে দুইভাগে ভাগ করেছেন।
জ্ঞান নিজেকে ও অন্য বস্তুকে প্রকাশ করে। এই জ্ঞান বাধারহিতভাবে উৎপন্ন হলে প্রমাণ (=নিশ্চিত জ্ঞান) বলে বিবেচিত হয়। প্রমেয় বিষয় যে প্রকারে প্রকাশিত হয় সে অনুসারে কোন জ্ঞানকে অপরোক্ষ (=প্রত্যক্ষ) এবং কোন জ্ঞানকে পরোক্ষ বলা হয়। সাধারণভাবে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা সরাসরি লব্ধ জ্ঞানকে অপরোক্ষ এবং অনুমানাদিকে পরোক্ষজ্ঞান বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এ বিষয়ে জৈনমত সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যান্য দর্শনের সাথে এখানে পার্থক্য হলো, ইন্দ্রিয় ও মনের সহযোগে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে জৈনমতে পরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়, প্রত্যক্ষ নয়। আর আত্মসাপেক্ষ জ্ঞান হচ্ছে অপরোক্ষ।
জৈনমতে সকল প্রকার ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান হলো পরোক্ষজ্ঞান। আর অপরোক্ষজ্ঞান হলো সেই জ্ঞান, যে জ্ঞান ইন্দ্রিয় বা মনের দ্বারা লব্ধ না হয়ে সরাসরি আত্মার দ্বারা লব্ধ। বিভিন্ন জৈনশাস্ত্রে জ্ঞানের বিভিন্ন প্রকার বিভাগের উল্লেখ রয়েছে। জৈনগণ জ্ঞানের বিভাগের ক্ষেত্রে প্রধানত দুটি ভিন্ন ধারা অনুসরণ করেছেন। একটি হলো আগমিক এবং অপরটি হলো যৌক্তিক। আগমিক বিভাগ আবার বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্ন রকমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন-
‘ভগবতিসূত্রে’ বলা হয়েছে বলা হয়েছে, জ্ঞান পাঁচপ্রকার- (১) অভিনিবোধিক, (২) শ্রুত, (৩) অবধি, (৪) মনঃপর্যায় ও (৫) কেবল।
আবার ‘স্থানাঙ্গসূত্রে’ জ্ঞানকে প্রথমে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। অবধি, মনঃপর্যায় ও কেবলজ্ঞানকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান এবং অভিনিবোধিক ও শ্রুত জ্ঞানকে পরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়েছে।
অন্যদিকে যৌক্তিক দিক থেকে জৈনগণ যথার্থ জ্ঞানকে প্রাথমিকভাবে দুইভাগ করেছেন- প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ।
প্রত্যক্ষ জ্ঞানের করণ হচ্ছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আর পরোক্ষ জ্ঞানের করণ দুই প্রকার- অনুমান ও শব্দ। সুতরাং জৈনদর্শনে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ ভেদে তিন প্রকার প্রমাণ স্বীকার করা হয়। প্রত্যক্ষ হচ্ছে সকলের স্বীকৃত প্রমাণ। লোকব্যবহারের দৃষ্টিতে জৈনরা অনুমানকে প্রামাণিক বলে স্বীকার করেন এবং তীর্থঙ্করদের উপদেশবাক্যকে শব্দ প্রমাণ বলে মনে করেন। শব্দের অন্য নাম হচ্ছে আগম।
প্রত্যক্ষজ্ঞান আবার দুই প্রকার- সাংব্যবহারিক ও মুখ্য। মুখ্যজ্ঞান তিনপ্রকার- অবধি, মনঃপর্যায় এবং কেবলজ্ঞান। আর সাংব্যবহারিক-প্রত্যক্ষ জ্ঞান দুই প্রকার- মতি জ্ঞান ও শ্রুত জ্ঞান। অপরদিকে পরোক্ষজ্ঞান পাঁচপ্রকার- স্মৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা, তর্ক, অনুমান ও আগম। ফলে সাধারণভাবে প্রচলিত অনুমান, উপমান ও শব্দ প্রমাণ জৈনদর্শনে স্বীকৃত কি না তাও পরিষ্কার নয়। মনে করা যেতে পারে যে, জৈন দার্শনিকগণ আগমীয় ধারাকে অনুসরণ করে জ্ঞানকে মূলত পরোক্ষ ও অপরোক্ষ- এই দুইভাগে ভাগ করেছেন। কিন্তু যৌক্তিক দিক থেকে তাঁরা প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ এই চতুর্বিধ প্রমাণকেই স্বীকার করেন।
আবার পরোক্ষজ্ঞান প্রধানত দুই প্রকার- মতি ও শ্রুত। এই দুইপ্রকার জ্ঞান ছাড়াও অকলঙ্ক প্রভৃতি জৈন দার্শনিকগণ স্মৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা, তর্ক, অনুমান এবং আগমকেও পরোক্ষজ্ঞান বলে উল্লেখ করায় বোঝা যায় যে, জৈনমতে স্মৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা, তর্ক প্রভৃতিও প্রমাণ। যদিও জৈনদার্শনিক উমাস্বাতি অনুমানাদিকে পৃথক প্রমাণ বলে স্বীকার করেননি। কিন্তু সিদ্ধসেন শব্দ ও অনুমানকে পরোক্ষজ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, মতি ও শ্রুত এই দুইপ্রকার পরোক্ষজ্ঞান জৈনদর্শনে ‘সাংব্যবহারিক প্রত্যক্ষজ্ঞান’ বলে পরিচিত। এই দুই প্রকার জ্ঞান তাই যেমন পরোক্ষজ্ঞানের প্রকাররূপে আলোচিত হয়, তেমনি আবার প্রত্যক্ষজ্ঞানের প্রকাররূপেও আলোচিত হয়। জৈনমতে অপরোক্ষজ্ঞান তিন প্রকার- অবধি, মনঃপর্যায় এবং কেবলজ্ঞান। সাধারণ জীব যেহেতু মন বা ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই জ্ঞান লাভ করে থাকে, সেহেতু পরোক্ষজ্ঞানকে সাধারণজ্ঞানও বলা হয়। এইদিক থেকে শ্রুত ও মতি জ্ঞানকে সাধারণ প্রত্যক্ষজ্ঞান এবং অবধি, মনঃপর্যায় এবং কেবল জ্ঞানকে অসাধারণ প্রত্যক্ষজ্ঞান বলা যেতে পারে। সংক্ষেপে জৈনদর্শন-স্বীকৃত এই পাঁচ প্রকার জ্ঞান হলো-
‘মতিশ্রুতাবধি মনঃপর্য্যায়কেবলানি জ্ঞানমিতি’।
অর্থাৎ : জ্ঞান পাঁচপ্রকার- মতি, শ্রুত, অবধি, মনঃপর্যায় ও কেবল জ্ঞান।
জৈনদর্শনে আগমিক ও যৌক্তিক এই দুটি ধারায় জ্ঞানের বিভাগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জৈনদার্শনিকদের বিভিন্ন প্রক্রিয়া থাকলেও পর্যালোচনার সুবিধার্থে আমরা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় জ্ঞানের বিভাগ সম্বন্ধে আলোচনা করতে পারি।
জৈনমতে যথার্থ জ্ঞান দুই প্রকার- (ক) প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও (খ) পরোক্ষ জ্ঞান।
(ক) প্রত্যক্ষ জ্ঞান
প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপলব্ধিতে আত্মা স্বয়ং কারণ হয় এবং তার জন্য পদার্থের প্রয়োজন হয় না। বলা হয়ে থাকে, যা কেবল আত্মার যোগ্যতাবশত উৎপন্ন হয়, তার জন্য ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তার প্রয়োজন হয় না। প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে মাণিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ বলা হয়েছে-
‘বিশদং প্রত্যক্ষস্য লক্ষণম্’।- (পরীক্ষামুখসূত্র-২/৩)
অর্থাৎ : বিশদ-ই প্রত্যক্ষের লক্ষণ।
এখানে বিশদ অর্থ বলা হচ্ছে স্পষ্ট, যার প্রকাশের জন্য অন্য কোন প্রতীতির দরকার হয় না। অর্থাৎ স্পষ্ট যে জ্ঞান তাকে প্রত্যক্ষ বলে। জৈনদর্শনে প্রত্যক্ষ জ্ঞান তিন প্রকার- অবধি, মনঃপর্যায় ও কেবল।
(১) অবধি জ্ঞান : অতীন্দ্রিয় শক্তির সাহায্যে অতীত, ভবিষ্যৎ, সূক্ষ্ম ও বহু দূরবর্তী বস্তুর যে জ্ঞান লাভ হয় তাকে বলে অবধি। সাধারণভাবে জীব ইন্দ্রিয়াদির নিকট সমুপস্থিত বস্তুরই জ্ঞান লাভ করে। যে সকল বস্তু ইন্দ্রিয়াদির নিকট সমুপস্থিত নয়, সেই সকল বস্তুর জ্ঞান লাভ করতে পারে না। কিন্তু ‘অবধি’ নামক জ্ঞানে জীব, যে সকল বস্তু ইন্দ্রিয়াদির কাছে সমুপস্থিত নয় সেই সকল বস্তুরও জ্ঞান লাভ করতে পারে। এইরূপ জ্ঞানকে দূরদর্শন বলা হয়ে থাকে।
অবধি হচ্ছে সীমা। এজন্যে এই জ্ঞান হচ্ছে অবধিজ্ঞান। কর্মের বাধা অপসৃত হলে বিশেষ স্থান, কাল পর্যন্ত অবচ্ছিন্ন বস্তুর যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাই অবধি জ্ঞান। নিজের কর্মকে অংশত নষ্ট করলে পর মানুষ এমন শক্তিলাভ করে যে সে দুরস্থ, সূক্ষ্ম বস্তুরও জ্ঞান প্রাপ্ত হতে পারে।
অবধি জ্ঞান আবার দুই প্রকার- ভবপ্রত্যয় ও গুণপ্রত্যয়। জন্মসিদ্ধ অনুরূপ জ্ঞান হচ্ছে ভবপ্রত্যয় এবং তপস্যা প্রভৃতির দ্বারা আচরণীয় কর্মের কিছু ক্ষয় হলে লব্ধ অনুরূপ জ্ঞানকে গুণপ্রত্যয় বলে। এর মধ্যে দেবতা ও নরকবাসীদের পাখির মতো আকাশে গমনের জ্ঞান হচ্ছে ভবপ্রত্যয়, আর মানুষ ও তির্যক (যারা মানুষের মতো সোজা না হেঁটে বাঁকা হাঁটে এমন বুদ্ধিহীন নিম্নজাতির জানোয়ার) প্রাণীদের গুণপ্রত্যয় হয়।
(২) মনঃপর্যায়জ্ঞান : যে অসাধারণ জ্ঞানের দ্বারা কোন ব্যক্তি অপরের মনোগত বিষয় বা মানসিক অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে পারে তাকে মনঃপর্যায় জ্ঞান বলে। অপরের মানসিক অবস্থা বলতে ভিন্ন কোন ব্যক্তির সুখ, দুঃখ, অনুভূতি, চিন্তা ও ভাবনার কথা বোঝানো হয়েছে। জীব আপন চেষ্টায় অপরের এই সকল মানসিক অবস্থাকে সরাসরি জানতে পারে। সাধারণত দূরশ্রবণ বলতে যে ধরনের জ্ঞানকে নির্দেশ করা যায়, মনঃপর্যায় সেই ধরনের জ্ঞান।
মানুষ রাগদ্বেষ প্রভৃতি মানসিক বাধাকে জয় করতে পারলে অন্যের মনোগত ভূত ও ভবিষ্যৎ বিষয়ের পরিষ্কার ও স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারে। এই জ্ঞানের সাথে নৈয়ায়িকদের অলৌকিক প্রত্যক্ষের সাদৃশ্য রয়েছে।
(৩) কেবলজ্ঞান : বস্তুর সরাসরি পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সর্বজ্ঞাপক জ্ঞান হলো কেবলজ্ঞান। স্বরূপত সর্বজ্ঞ আত্মা যখন কর্ম, ইন্দ্রিয় এবং মনের বাধাকে অতিক্রম করে বস্তুকে সরাসরি জানে তখন সেই জ্ঞানকে বলা হয় কেবলজ্ঞান। কেবলজ্ঞান জৈন দর্শনে যেমন জ্ঞানতত্ত্বের সর্বোচ্চস্তর তেমনি জৈনদের নৈতিক জীবনেরও সর্বোচ্চ আদর্শ। কর্মবন্ধনে আবদ্ধ জীব এই জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে না। কর্মবন্ধনমুক্ত সিদ্ধপুরুষই কেবলমাত্র সর্ব বিষয়ের সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ করতে পারে। কেবলজ্ঞান দেশ ও কালের সীমানা দ্বারা সীমিত নয়। শুদ্ধ পরিপূর্ণ এই জ্ঞানকে অনুভব করা যায়, বর্ণনা করা যায় না।
সমস্ত বাধা দূর হয়ে গেলে জীব পূর্ণ ও অনন্ত জ্ঞান লাভ করতে পারে। এই জ্ঞান কেবল মুক্ত জীবের হয়ে থাকে। যে জ্ঞানের জন্য তপস্বীরা তপস্যা প্রভৃতি ক্রিয়াবিশেষ অবলম্বন করে, অন্য সকল জ্ঞানের অসংস্পৃষ্ট অর্থাৎ স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন সেই স্বয়ং প্রকাশিত নির্বাধ স্পষ্ট জ্ঞানই হচ্ছে কেবল জ্ঞান। জৈনমতে জিন বা তীর্থঙ্কররা এই জ্ঞানের অধিকারী। নিরন্তর কঠোর তপস্যা এবং সম্যগদর্শন, সম্যগজ্ঞান ও সম্যকচরিত্র এই ত্রিরত্নের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে ধ্যানের শক্তিতে জ্ঞানের আবরক ঘাতীয় কর্মের ক্ষয় হয়ে চেতনাস্বভাব আত্মার স্বরূপের আবির্ভাবকে কেবল জ্ঞান বলে। এই জ্ঞানের অন্য নাম মুখ্য প্রত্যক্ষ এবং একেই মোক্ষের সাধনীভূত তত্ত্বজ্ঞান বলে।
অন্যভাবে আবার প্রত্যক্ষ জ্ঞান দুই প্রকার- ব্যবহারিক প্রত্যক্ষ ও পারমার্থিক প্রত্যক্ষ।
পারমার্থিক জ্ঞান মন বা বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতীত স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয় এবং তা কর্মজনিত ফল হতে উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ থাকে না। কোন ব্যক্তি কর্মজনিত শৃঙ্খল হতে মুক্ত না হলে এজাতীয় জ্ঞান লাভ করতে পারে না। সুতরাং পারমার্থিক জ্ঞানলাভের জন্য তাকে অপরিহার্যভাবে কর্মের ধ্বংস করতে হয়।
ব্যবহারিক জ্ঞান মন ও বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে উৎপন্ন হয় বলে স্বাভাবিকভাবেই পারমার্থিক জ্ঞান হতে ভিন্ন। সাধারণ লোক ব্যবহারিক জ্ঞানলাভ করতে পারে, কিন্তু পারমার্থিক জ্ঞান যে কোন ব্যক্তিমাত্রের প্রাপ্য হতে পারে না। রাগ ও ঈর্ষা হতে মুক্ত অর্হৎ-ব্যক্তিই পারমার্থিক জ্ঞানের অধিকারী হয়।
পারমার্থিক জ্ঞান আবার দুই প্রকার- কেবল ও বিকল জ্ঞান।
ঘাতীয় ও অঘাতীয় কর্মের ফল হতে মুক্ত হলে নিসর্গত যে পারমার্থিক প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয় তা সমস্ত বিষয়ের প্রমা জ্ঞান হলে তাকে কেবল (বা সকল) জ্ঞান বলে। কেবল জ্ঞান সমস্ত প্রকার জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ। আর কোন বিশেষ বিষয়ের সেরূপ জ্ঞান হলে তাকে বিকল পারমার্থিক জ্ঞান বলে। এই বিকল পারমার্থিক জ্ঞান দুই প্রকার- অবধি ও মন-পর্যায়।
জৈনমতে ব্যবহারিক প্রত্যক্ষ জ্ঞান চার প্রকার- অবগ্রহ, ঈহা, অবায় ও ধারণা।
কোন কিছুকে পৃথক করে যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় তাকে অবগ্রহ বলে। যেমন ‘তিনি পুরুষ’, এই জ্ঞান হচ্ছে অবগ্রহ।
এরপর ‘এই ব্যক্তি কি সিলেটি না ঢাকাইয়া’ এরূপ সংশয় হলে ‘এ নিশ্চয়ই সিলেটি’ এধরনের যে জ্ঞান হয় তা হচ্ছে ঈহা। তবে এ জ্ঞান নিশ্চয় নয়, তাকে উৎপ্রেক্ষা বলা হয়।
তারপর তার ভাষা ইত্যাদি জানার ফলে ‘এ হচ্ছে সিলেটি’ এরকম যে জ্ঞান হয় তা হচ্ছে অবায়।
এরপর সেই বিষয়েরই পুনরায় যে জ্ঞান সংস্কারকে উৎপন্ন করে তা হলো ধারণা। এই ধারণার দরুন সেই বিষয়ের স্মরণ বা স্মৃতি হয়। তবে এই চার প্রকার জ্ঞানকে পরোক্ষ মতি জ্ঞানের চারটি স্তর বা জ্ঞানের প্রক্রিয়াও বলা হয়।
(খ) পরোক্ষ জ্ঞান
প্রমেয় বিষয় যে প্রকারে জ্ঞানে প্রকাশিত হয় সে অনুসারে জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বলা হয়। জৈনদার্শনিক মানিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ বিশদকে প্রত্যক্ষজ্ঞানের লক্ষণ বলে প্রত্যক্ষ ভিন্নকে পরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়েছে-
‘পরোক্ষমিতরৎ’।- (পরীক্ষামুখসূত্র-২/৩/১)
অর্থাৎ : পরোক্ষ হচ্ছে প্রত্যক্ষভিন্ন।
জৈনগ্রন্থ ‘প্রমাণমীমাংসা’তেও অবিশদকে পরোক্ষ বলা হয়েছে-
‘অবিশদঃ পরোক্ষম্’।- (প্রমাণমীমাংসা)
অর্থাৎ : অবিশদ-ই পরোক্ষ জ্ঞান।
তার মানে, বিশদ অর্থাৎ সম্যগভাবে বিষয়ের নির্ণয় প্রমাণের লক্ষণ হলে, অবিশদ অথচ সম্যগভাবে বিষয়ের নির্ণয় হলো পরোক্ষের লক্ষণ। আর এই পরোক্ষ প্রমাণের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান হচ্ছে পরোক্ষ জ্ঞান। তাই বলা হয়েছে-
‘বিজ্ঞানং স্বপরাভাসি প্রমাণং বাধবর্জিতম্ ।
প্রত্যক্ষং চ পরোক্ষং চ দ্বিধা মেয়বিনিশ্চয়াৎ।।’
অর্থাৎ : বিজ্ঞান নিজেকে ও অন্য বস্তুকে প্রকাশ করে। তা যখন সমস্ত বাধারহিতভাবে উৎপন্ন হয় তখন তা নিশ্চিত জ্ঞান। এই নিশ্চিত জ্ঞানকেই প্রমাণ বলে। এবং প্রমেয় বিষয় যে প্রকারে জ্ঞানে প্রকাশিত হয় সে অনুসারে জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বলা হয়।
জৈনমতে পরোক্ষ জ্ঞান দুই প্রকার- মতি জ্ঞান ও শ্রুত জ্ঞান।
(১) মতি জ্ঞান : ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তায় বিষয়ের যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে মতি জ্ঞান বলে। বাহ্যপ্রত্যক্ষ, আন্তরপ্রত্যক্ষ, প্রত্যভিজ্ঞা প্রভৃতি জ্ঞান হলো মতিজ্ঞান। ইন্দ্রিয়-মনের সংযোগ ভিন্ন মতি জ্ঞান হয় না। জ্ঞানের আবরণের ক্ষয় বা উপশম হলে ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তায় তাদের সাথে সংযুক্ত পদার্থের যে যথার্থ জ্ঞান বা মনন তা হচ্ছে মতি। অতএব মতি হচ্ছে মননাত্মক জ্ঞান।
তবে ইন্দ্রিয় ও মনের সংযোগভিন্ন যে জ্ঞান হয় তাকে মতি বলে না। তা হলো জ্ঞানের আবরণ অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধক তিন প্রকার- মনোগত, ইন্দ্রিয়গত ও বিষয়গত।
মাৎসর্য প্রভৃতি মনোগত প্রতিবন্ধক। কামনা, বাতিক প্রভৃতি রোগ ইন্দ্রিয়গত। বস্তুর সূক্ষ্মত্ব, অন্ধকার প্রভৃতিতে ব্যাপৃত থাকা হচ্ছে বিষয়গত প্রতিবন্ধক। আবরণের সর্বথা বা পূর্ণ নাশ হচ্ছে ক্ষয়। বিদ্যমান আবরণের অনুদ্ভূত অবস্থা অর্থাৎ পূর্ণক্ষয়ের নাম উপশম।
মতি জ্ঞান আবার দুই প্রকার- ইন্দ্রিয়জন্য ও অনিন্দ্রিয়জন্য।
বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞানকে ইন্দ্রিয়জন্য এবং মানস জ্ঞানকে অনিন্দ্রিয়জন্য জ্ঞান বলা হয়।
জৈনমতে মতি জ্ঞানের চারটি স্তর স্বীকার করা হয়েছে। যেমন- অবগ্রহ, ঈহা, অবায় ও ধারণা। এগুলিকে জৈনমতে জ্ঞান উৎপত্তির প্রক্রিয়াও বলা হয়ে থাকে।
জ্ঞানের প্রক্রিয়া :
সাংব্যবহারিক প্রত্যক্ষজ্ঞানের উৎপত্তি সম্বন্ধে জৈন দার্শনিকগণ একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন। এই প্রক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে জৈনদার্শনিক হেমচন্দ্র সূরি তাঁর ‘প্রমাণমীমাংসা’ গ্রন্থে বলেছেন-
‘ইন্দ্রিয়মনোনিমিত্তোহবগ্রহেবায়ধারণাত্ম সাংব্যবহারিকম্’।- (প্রমাণমীমাংসা)
অর্থাৎ : অবগ্রহ-ঈহা-অবায়-ধারণা এই প্রক্রিয়া-ক্রমে ইন্দ্রিয় ও মনের নিমিত্ত-বিষয়ের সাংব্যবহারিক জ্ঞানের অর্থাৎ মতিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়।
এখানে ‘আত্ম’ শব্দের দ্বারা ক্রমোৎপদ্যমান অবগ্রহাদির পরস্পর অত্যন্তভেদ নিরাস করা হয়েছে। তাই এই ধারাক্রমে পূর্ববর্তী স্তরগুলি উত্তরোত্তর-রূপে পরিণত হয় বলে এই প্রক্রিয়াকে একটি প্রক্রিয়াই বলা হয়। এ যেন একই প্রক্রিয়ার চারটি স্তর। এই চারটি স্তর হলো- অবগ্রহ, ঈহা, অবায় এবং ধারণা। জৈনদার্শনিক হেমচন্দ্র অবগ্রহাদি চতুষ্টয়কে লক্ষ্য করে চতুঃসূত্রী রচনা করেছেন।
অবগ্রহ : বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষের দরুন উৎপন্ন জ্ঞানের প্রথম স্তর হচ্ছে ‘অবগ্রহ’। উমাস্বাতি বলেছেন, অবগ্রহ হলো অনির্ণীত প্রত্যক্ষকরণ। এই অনির্ণীত প্রত্যক্ষকরণ দ্রব্য ভিন্ন গুণের জ্ঞান দিতে পারে না। একে সমুগ্ধ, আলোচন, গ্রহণ ও অবধারণ বলা হয়। অবগ্রহ হলো প্রত্যক্ষের পূর্ববর্তী অবস্থা। এই অবস্থা উদ্ভাসিত হয় কোন বস্তু দর্শনের ফলে। অবগ্রহের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে হেমচন্দ্র বলেছেন-
‘অক্ষার্থযোগেদর্শন অনন্তরম্ অর্থগ্রহণম্ অবগ্রহঃ’।- (প্রমাণমীমাংসা)
অর্থাৎ : বিষয়ের সঙ্গে চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়ের যোগাযোগের অনন্তর বিষয়ের বিদ্যমানতার যে নিরাকার জ্ঞান হয় তাই অবগ্রহ।
মনুষ্যত্বাদি সামান্যধর্মবিশিষ্ট বস্তুর যে গ্রহণ অর্থাৎ মনুষ্যত্বরূপে সাধারণভাবে মানুষের যে জ্ঞান হয় তাকে অবগ্রহ বলে। জৈনদার্শনিকগণ অবগ্রহকে আবার দুটি স্তরে ভাগ করেছেন- বিজ্ঞানাবগ্রহ ও অর্থাবগ্রহ। বিজ্ঞানাবগ্রহ হচ্ছে কেবল জ্ঞেয়ের সাথে জ্ঞাতার সম্বন্ধ, আর অর্থাবগ্রহে জ্ঞাতা জ্ঞেয়কে জানা ছাড়াও অনুভব করে।
ঈহা : অর্থাবগ্রহের পরবর্তী ও মতি জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে ‘ঈহা’। তা হলো বিশেষ আকাঙ্ক্ষা। এই দ্বিতীয় স্তরে আত্মা দৃষ্ট বস্তুর গুণের বা ধর্মের মূল্যায়ন করতে পারে। যেমন কোন শব্দ বা গোলমাল শুনলে কেউ প্রথমে কিসের শব্দ তা বুঝতে পারে না। ‘এই শব্দটি কি শঙ্খের না শৃঙ্গের’ এরকম সংশয় হলে মাধুর্য প্রভৃতি শাঙ্খ ধর্ম উপলব্ধ হলে এবং কার্কশ্যাদি উপলব্ধ না হলে এরূপ অন্বয় ও ব্যতিরেকরূপ পর্যালোচনার মাধ্যমে মতির যে চেষ্টা তা-ই ঈহা। এই স্তরে মানুষ সংবেদনের বিশেষ জ্ঞান এবং অন্য বস্তুর সঙ্গে এর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য জানার জন্য উৎসুক হয়। এই স্তরকে প্রকাশ করতে গিয়ে হেমচন্দ্র বলেছেন-
‘অবগৃহীত বিশেষাকাক্সক্ষণম্ ঈহা’।- (প্রমাণমীমাংসা)
অর্থাৎ : অবগ্রহ পরবর্তী বিশেষ আকাক্সক্ষার নাম ঈহা।
মনুষ্যত্বাদিরূপে মানুষের সাধারণ জ্ঞান হলে ঐ মানুষের বিশেষ জ্ঞানের জন্য আমাদের মনে আকাক্সক্ষা জেগে ওঠে। কোন শব্দ শ্রবণের অনন্তরই তাকে সঠিকভাবে জানার জন্য আমাদের মধ্যে ‘এই শব্দ কিসের শব্দ?’- এরূপ জিজ্ঞাসার উদয় হয়। প্রত্যক্ষের এরূপ স্তরকে বলে ‘ঈহা’।
এই স্তরে জ্ঞাতা শব্দের উৎস জানতে পারে, কিন্তু মতির প্রথম স্তর অবগ্রহে তা থাকে না। এই সংশয়পূর্ণ দ্বিতীয় মতিস্তরের জ্ঞানে বিষয়ের সম্যক নির্ণয় না থাকায় তাকে প্রমাণ বলা যায় না। কিন্তু অনির্ণয়াত্মক বলে অপ্রমাণও বলা যাবে না, কেননা তাতে নিজ বিষয়ের নির্ণয় হয়।
অবায় : এই স্তরে মানুষ অতীতের সঙ্গে বর্তমানে অনুভূত সংবেদনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ধারণ করে বস্তুর সবিশেষ জ্ঞান লাভ করে। অবায়ের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে হেমচন্দ্র বলেছেন-
‘ঈহিতাবশেষনির্ণয়ো অবায়ঃ’।- (প্রমাণমীমাংসা)
অর্থাৎ : এই স্তরে ঈহিত বিষয়ের সবিশেষ জ্ঞান হয়, তাই অবায়।
কোন ব্যক্তি সম্বন্ধে ‘ঈহা’ স্তরে যে সংশয় দেখা দেয়, এই স্তরে সেই সংশয় দূরীভূত হয়। ‘অব’ উপসর্গের অর্থ দৃঢ়, নিশ্চিত এবং ‘অয়’ শব্দের অর্থ জানা। মতির যে স্তরে জ্ঞাতা বিষয়টিকে নিশ্চিতভাবে জানতে পারে তাকে অবায় বলে। ঈহিত বিষয়ের নির্ণয় হয় এই স্তরে। ঈহাকে স্বীকার করে কোন বস্তুতে ‘এটি শঙ্খের শব্দ, শৃঙ্গের নয়’ এরূপ বিশেষের যে নিরূপণ হয় তা হচ্ছে অবায়। এই স্তরে উদাহৃত শব্দের উৎসস্থানকে নিশ্চিত করতে পারে। কোন শব্দ শুনে আমরা যখন বলি যে, এই শব্দটি কোন ব্যক্তির কণ্ঠস্বর, তখন এই স্তরটিকে বলা হয় অবায়।
ধারণা : এটি হলো মতির অস্তিম স্তর। এই স্তরে জ্ঞাতার অন্তঃকরণে বিষয়ের একটি সামগ্রিক জ্ঞান হতে সংস্কার বা স্মৃতির উৎপন্ন হয়। সুতরাং স্মৃতির হেতু হচ্ছে ধারণা। ধারণার লক্ষণ দিতে গিয়ে আচার্য হেমচন্দ্র বলেছেন-
‘স্মৃতিহেতুর্ধারণা’।- (প্রমাণমীমাংসা)
অর্থাৎ : স্মৃতির হেতুই ধারণা।
হেমচন্দ্র ধারণাকে ‘সংস্কাররূপ’ বলে বর্ণনা করেছেন। ন্যায়দর্শনের ব্যাখ্যা থেকে এই ব্যাখ্যা ভিন্ন। নৈয়ায়িকরা সংস্কারকে ধারণা বলে স্বীকার করেন না। জৈনমতে ধারণা হলো জ্ঞানের স্থিতিশীল স্তর। এই স্তরে জ্ঞান স্মৃতিহেতুরূপে মনে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। প্রত্যভিজ্ঞা, প্রত্যক্ষ ও অনুমান পুরোপুরি এই স্তরে অন্তর্গত থাকে।
(২) শ্রুতজ্ঞান : অপরের কথা শুনে বা গ্রন্থ পাঠ করে আমাদের যে জ্ঞান হয় জৈন দার্শনিকগণ তাকে শ্রুতজ্ঞান বলেছেন। অর্থাৎ, যা শব্দ-জ্ঞান হতে উৎপন্ন হয় তাকে শ্রুতজ্ঞান বলে। জ্ঞানের আবরণক্ষয় উপশমিত হলে মতিজনিত যে স্পষ্ট জ্ঞান উৎপন্ন হয় তা হচ্ছে শ্রুতজ্ঞান। মতিজ্ঞান শ্রুতজ্ঞানের পূর্ববর্তী। মতিজ্ঞানে বস্তুর যে প্রকৃতি অনুভূত হয়, শ্রুতজ্ঞানে বস্তুর সেই প্রকৃতি-ই ভিন্ন উপায়ে জ্ঞাত হয়ে থাকে। নৈয়ায়িকমতে একে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়েছে। জৈনমতে এ জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন হলেও স্বয়ং প্রত্যক্ষ বলে অতীন্দ্রিয়, তা আর ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানের বিষয় হয় না। সেকারণে এই জ্ঞানকে শ্রুত বলা হয়েছে।
জৈনরা বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। তাই তাঁরা জৈনশাস্ত্র ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির নিকট থেকে পাওয়া জ্ঞানকেই ‘শ্রুতজ্ঞান’ বলেছেন। সায়ন মাধবাচার্য ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের জৈনপ্রস্থানে শ্রুতজ্ঞানকে মতিজ্ঞানের তুলনায় উচ্চতর বলে বর্ণনা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে যে, জ্ঞানের আবরণের আরও ক্ষয় ও উপশম হলে মতিজনিত যে সুস্পষ্টজ্ঞান তাই শ্রুত। মতিজ্ঞান যথার্থজ্ঞান হলেও তা প্রাথমিক; শ্রুতজ্ঞানে জ্ঞান আরও স্পষ্ট হয়।
মতি জ্ঞান ও শ্রুত জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হলো, মতি জ্ঞানের স্থিতি কেবল বিদ্যমান পদার্থে হয়, পরেরটি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই ত্রৈকালিক বিষয়ে হয়ে থাকে।
শ্রুত জ্ঞান দুই প্রকার- অঙ্গবাহ্য ও অঙ্গপ্রবিষ্ঠ। প্রথমটিতে জৈনশাস্ত্রের জ্ঞান এবং দ্বিতীয়টিতে এ ছাড়া অন্য শ্রুত জ্ঞান অন্তর্গত হয়েছে।
যথার্থ জ্ঞান :
এছাড়া অন্যভাবে পরোক্ষ জ্ঞান পাঁচ প্রকার- (১) স্মৃতি, (২) প্রত্যভিজ্ঞা, (৩) তর্ক বা ঊহ, (৪) অনুমান ও (৫) আগম। জৈনমতে এগুলো হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান।
(১) স্মৃতি :
জৈনমতে স্মৃতিকে যথার্থ জ্ঞান বলা হয়েছে। স্মৃতির লক্ষণে বলা হয়-
(২) শ্রুতজ্ঞান : অপরের কথা শুনে বা গ্রন্থ পাঠ করে আমাদের যে জ্ঞান হয় জৈন দার্শনিকগণ তাকে শ্রুতজ্ঞান বলেছেন। অর্থাৎ, যা শব্দ-জ্ঞান হতে উৎপন্ন হয় তাকে শ্রুতজ্ঞান বলে। জ্ঞানের আবরণক্ষয় উপশমিত হলে মতিজনিত যে স্পষ্ট জ্ঞান উৎপন্ন হয় তা হচ্ছে শ্রুতজ্ঞান। মতিজ্ঞান শ্রুতজ্ঞানের পূর্ববর্তী। মতিজ্ঞানে বস্তুর যে প্রকৃতি অনুভূত হয়, শ্রুতজ্ঞানে বস্তুর সেই প্রকৃতি-ই ভিন্ন উপায়ে জ্ঞাত হয়ে থাকে। নৈয়ায়িকমতে একে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়েছে। জৈনমতে এ জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন হলেও স্বয়ং প্রত্যক্ষ বলে অতীন্দ্রিয়, তা আর ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানের বিষয় হয় না। সেকারণে এই জ্ঞানকে শ্রুত বলা হয়েছে।
জৈনরা বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না। তাই তাঁরা জৈনশাস্ত্র ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির নিকট থেকে পাওয়া জ্ঞানকেই ‘শ্রুতজ্ঞান’ বলেছেন। সায়ন মাধবাচার্য ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের জৈনপ্রস্থানে শ্রুতজ্ঞানকে মতিজ্ঞানের তুলনায় উচ্চতর বলে বর্ণনা করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে যে, জ্ঞানের আবরণের আরও ক্ষয় ও উপশম হলে মতিজনিত যে সুস্পষ্টজ্ঞান তাই শ্রুত। মতিজ্ঞান যথার্থজ্ঞান হলেও তা প্রাথমিক; শ্রুতজ্ঞানে জ্ঞান আরও স্পষ্ট হয়।
মতি জ্ঞান ও শ্রুত জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হলো, মতি জ্ঞানের স্থিতি কেবল বিদ্যমান পদার্থে হয়, পরেরটি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই ত্রৈকালিক বিষয়ে হয়ে থাকে।
শ্রুত জ্ঞান দুই প্রকার- অঙ্গবাহ্য ও অঙ্গপ্রবিষ্ঠ। প্রথমটিতে জৈনশাস্ত্রের জ্ঞান এবং দ্বিতীয়টিতে এ ছাড়া অন্য শ্রুত জ্ঞান অন্তর্গত হয়েছে।
যথার্থ জ্ঞান :
এছাড়া অন্যভাবে পরোক্ষ জ্ঞান পাঁচ প্রকার- (১) স্মৃতি, (২) প্রত্যভিজ্ঞা, (৩) তর্ক বা ঊহ, (৪) অনুমান ও (৫) আগম। জৈনমতে এগুলো হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান।
(১) স্মৃতি :
জৈনমতে স্মৃতিকে যথার্থ জ্ঞান বলা হয়েছে। স্মৃতির লক্ষণে বলা হয়-
‘বাসনোদ্বোধহেতুকা তদিত্যাকারা স্মৃতিঃ’।
অর্থাৎ : সংস্কার মাত্র হতে উৎপন্ন জ্ঞানকে স্মৃতি বলে।
(২) প্রত্যভিজ্ঞা :
পূর্বে দৃষ্ট বস্তুকে দেখে ‘এই সে’ এরূপ যে জ্ঞান হয় তাকে প্রত্যভিজ্ঞা বলে। প্রত্যভিজ্ঞার লক্ষণে বলা হয়-
‘দর্শনস্মরণসম্ভবং সঙ্কলনং প্রত্যভিজ্ঞানম্’।
অর্থাৎ : পূর্বদৃষ্ট বস্তুকে দেখে স্মৃতিতে সংরক্ষিত জ্ঞানের যে প্রকাশ তাই প্রত্যভিজ্ঞা।
(৩) তর্ক :
পক্ষ ও সাধ্যের ব্যাপ্তি জ্ঞানকে তর্ক বা ঊহ বলে। ঊহের লক্ষণ প্রকাশ করতে গিয়ে বলা হয়েছে-
‘উপলম্ভানুপলম্ভনিমিত্তং ব্যাপ্তিজ্ঞানম্ ঊহঃ’। (প্রমানমীমাংসা-২/৫)
অর্থাৎ : উপলম্ভ ও অনুপলম্ভের মধ্যে যে ব্যাপ্তিজ্ঞান তাই ঊহ।
ব্যাপ্তি জ্ঞান দুই প্রকার- অন্বয়ব্যাপ্তি ও ব্যতিরেকব্যাপ্তি।
যে ব্যাপ্তিতে সাধ্যে হেতুর ব্যাপকতা প্রতীত হয় তা হচ্ছে অন্বয়ব্যাপ্তি (affirmative generalization)। যেমন, ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’। ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’ এরূপ অনুমানে সাধ্য বহ্নিতে হেতু ধূমের ব্যাপকতা আছে।
আর যে যে অধিকরণে সাধ্যের অভাব থাকে সেই সকল অধিকরণে যে অভাব থাকে সেই অভাবের প্রতিযোগিতাকে ব্যতিরেকব্যাপ্তি (negative generalization) বলে। যেমন, ‘যেখানে ধূম থাকে না সেখানে বহ্নিও থাকে না’।
(৪) অনুমান :
অনুমানের লক্ষণ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছে-
‘সাধনাৎ সাধ্যবিজ্ঞানম্ অনুমানম্’। (প্রমাণমীমাংসা-২/৭)
অর্থাৎ : হেতুর দ্বারা সাধ্যের জ্ঞান হচ্ছে অনুমান।
অনুমানে পক্ষ, সাধ্য ও হেতু এই তিনটি প্রধানত থাকে। অনুমিতিতে যা উদ্দেশ্যরূপে প্রতীত হয় বা যাতে সিদ্ধ করা হয় তাকে পক্ষ, যা বিধেয় বা যাকে সিদ্ধ করা হয় তাকে সাধ্য এবং যার দ্বারা সিদ্ধ করা হয় তাকে সাধন বা হেতু বলে। যেমন, ‘পর্ব্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’- এই অনুমিতিতে পর্বত হচ্ছে পক্ষ, বহ্নি হচ্ছে সাধ্য, আর ধূম হলো হেতু।
এই অনুমান স্বার্থ ও পরার্থ ভেদে দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান।
হেতুদর্শন, ব্যাপ্তিস্মরণ, পরামর্শের দ্বারা যে স্থলে স্বয়ং সাধ্যকে জানে তাকে স্বার্থানুমান বলে। স্বার্থানুমানের লক্ষণে জৈনদার্শনিক হেমচন্দ্র তাঁর ‘প্রমাণমীমাংসায় বলেছেন-
‘স্বার্থং স্বনিশ্চিতসাধ্যাবিনাভাবৈকলক্ষণাৎ সাধনাৎ সাধ্যজ্ঞানম্’। (প্রমাণমীমাংসা-২/৯)
অর্থাৎ : নিজের নিশ্চিত সাধ্যের অবিনাভাব একলক্ষণরূপ সাধন হতে সাধ্যজ্ঞান হচ্ছে স্বার্থানুমান।
অবিনা অর্থ অভাবহীন। এখানে অবিনাভাব অর্থে ব্যাপ্তি বোঝানো হয়েছে। অবিনাভাব লক্ষণ সম্বন্ধে জৈনশাস্ত্রে বলা হয়েছে-
‘সহক্রমভাবিনোঃ সহক্রমভাবনিয়মোঃ অবিনাভাবঃ’। (প্রমাণমীমাংসা-২/১০)
অর্থাৎ : সহক্রমভাবী দুটি বস্তুর সহক্রমভাবের নিয়মই হলো অবিনাভাব।
একত্রে ক্রমে ও কার্যকারণ সম্বন্ধে দুটি বস্তুর মধ্যে জৈনমতে অবিনাভাব বা ব্যাপ্তি স্বীকৃত। যেমন একটি সামগ্রির অধীন ফলাদিগত রূপ ও রসের এবং ব্যাপ্য ও ব্যাপক শিংশপাত্ব (চারাগাছ) ও বৃক্ষত্বের মধ্যে অবিনাভাব থাকে। কৃত্তিকা নক্ষত্রের উদয়ের ক্রমে শকট বা রোহিণী নক্ষত্রের উদয় হয়। এরূপ কার্যকারণ ধূম ও বহ্নির মধ্যে সহভাবের নিয়ম রয়েছে। সাধ্যসাধন সহভাবী দুটির মধ্যে সহভাবনিয়ম এবং ক্রমভাবী দুটি বস্তুর মধ্যে ক্রমভাবের নিয়ম হচ্ছে অবিনাভাব। এই অবিনাভাবের নিশ্চয় হলো যার জ্ঞান লাভ হয় সেই সাধ্যজ্ঞানের অঙ্গ। সাধ্য ও সাধনের (হেতুর) মধ্যে এই ব্যাপ্তি বা অবিনাভাবের জ্ঞান হতে অনুমিতি হয়। জৈনমতে অনুমিতির উপযোগী সাধন (=হেতু) হলো পাঁচপ্রকার-
‘স্বভাবঃ কারণং কার্যমেকার্থসমবায়ি বিরোধি চেতি পঞ্চধা সাধনম্’। (প্রমাণমীমাংসা-২/১২)
অর্থাৎ : সাধন পাঁচপ্রকার- স্বভাব, কারণ, কার্য, একার্থসমবায়ি ও বিরোধি।
স্বার্থানুমান নিজ জ্ঞানের জন্য করতে হয়। আর পরার্থানুমান অপরের নিকট কোন কিছু প্রমাণের নিমিত্ত প্রয়োজন হয়। স্বার্থানুমানের ক্ষেত্রে আশ্রয়বাক্য উল্লেখ না করলেও চলে। কিন্তু পরার্থানুমান যেহেতু অপরের প্রয়োজন সাধক, তাই পরার্থানুমানে বাক্য প্রয়োগ করতে হয়।
স্বার্থানুমানের বিষয় সাধ্যের সামনে অন্যকে বুঝাবার জন্য পরামর্শী বাক্য হতে জাত (=উৎপন্ন) জ্ঞানকে পরার্থানুমান বলে। সুতরাং বাক্যাত্মক হচ্ছে পরার্থানুমান। ন্যায়ানুসারী জৈনদের মতে পঞ্চ অবয়বাত্মক বাক্য স্বীকার করা হয়। যেমন- ১.প্রতিজ্ঞা, ২.হেতু, ৩.দৃষ্টান্ত, ৪.উপনয় ও ৫.নিগমন।
তবে জৈনাচার্য ভদ্রবাহুর মতে দশ অবয়বাত্মক বাক্যের প্রয়োগ করা হয়। যেমন, উদাহরণস্বরূপ (সূত্র: ড. বিশ্বরূপ সাহা/ নাস্তিকদর্শনপরিচয়ঃ, পৃষ্ঠা-৯৫)-
১.প্রতিজ্ঞা- হিংসা পরিহার হচ্ছে পরম ধর্ম।
২.প্রতিজ্ঞাবিভক্তি- জৈন তীর্থঙ্করদের মতে হিংসা পরিহার সবচেয়ে ভালো।
৩.হেতু- হিংসাপরিহার মহত্তম ভালো, কেননা যে হিংসা পরিহার করে সে ঈশ্বরের প্রিয় হয় এবং ঈশ্বরকে পূজা করা মানুষের ধর্মীয় কর্তব্য।
৪.হেতুবিভক্তি- একমাত্র হিংসাপরিহারকারীই স্বর্গে বাস করতে পারে।
৫.বিপক্ষ- কিন্তু যারা তীর্থঙ্করদের অবজ্ঞা ও হিংসা করে তারা ঈশ্বরের প্রিয় হয়, তারা ধার্মিক বলে সম্মাননীয় হয়, যারা যজ্ঞে হিংসা করে তারা স্বর্গে বাস করে।
৬.বিপক্ষপ্রতিষেধ- জৈন তীর্থঙ্কর হিংসাকারীদের হানি করে। এরূপ ব্যক্তি অর্হন্ হবার যোগ্য নয়। তাদেরকে ঈশ্বর পছন্দ করে না।
৭.দৃষ্টান্ত- অর্হন্ ও জৈনগণ শেষে অজানন্তে হিংসা করেন এই ভেবে ভোজন প্রস্তুত করেন না, অন্যের গৃহে তাঁরা প্রস্তুত ভোজন গ্রহণ করেন।
৮.আশঙ্কা- অর্হন্ ও জৈন সন্ন্যাসীদের জন্যও গৃহীদের গৃহে ভোজন প্রস্তুত থাকে। ভোজন প্রস্তুতে হিংসা অনুষ্ঠিত হয়। জৈন মুনি ও অর্হন্রা স্বাভাবিকভাবে হিংসাজন্য পাপের ভাগী হন। সুতরাং প্রাগুক্ত দৃষ্টান্ত দৃষ্ট।
৯.আশঙ্কাপ্রতিষেধ- অর্হন্ ও জৈনমুনিরা গৃহীদেরকে নিজেদের আগমন জানান না। তাঁরা কখনো নির্দিষ্ট সময়ে ভিক্ষা করেন না। সেকারণে গৃহীরা তাঁদের জন্য ভোজন প্রস্তুত করে, একথা ঠিক নয়। সুতরাং গৃহস্থের গৃহে ভোজনপ্রস্তুতে উৎপন্ন হিংসাজনিত পাপে অর্হন্ ও জৈনমুনিরা ভাগী হবেন না।
১০.নিগমন- অতএব হিংসাপরিহার করা সর্বশ্রেষ্ঠ সৎকর্ম।
অনুমানে দোষ :
অনুমানে পক্ষ, সাধ্য ও হেতু এই তিনটি প্রধানত থাকে। অনুমিতিতে যা উদ্দেশ্যরূপে প্রতীত হয় বা যাতে সিদ্ধ করা হয় তাকে পক্ষ, যা বিধেয় বা যাকে সিদ্ধ করা হয় তাকে সাধ্য এবং যার দ্বারা সিদ্ধ করা হয় তাকে সাধন বা হেতু বলা হয়। এই সাধন আবার কারক (=জনক) ও জ্ঞাপক ভেদে দুই প্রকার। যেমন বহ্নি হচ্ছে ধূমের কারকরূপে হেতু, কিন্তু ধূমের জ্ঞান বহ্নিজ্ঞানের প্রযোজক হওয়ায় ধূম বহ্নির জ্ঞাপক হেতু।
পক্ষ, সাধ্য ও সাধন এই তিনের মধ্যে সম্বন্ধের বৈকল্যে অনুমানে দোষ উদ্ভূত হয়। সাধ্যের পক্ষ ও হেতুর সাথে সম্বন্ধের দোষবশত পক্ষাভাস ও হেত্বাভাস হয়। এছাড়াও দৃষ্টান্তাভাস ও দূষণাভাস নামে আরো দু’প্রকার অনুমানদোষ জৈনমতে স্বীকার করা হয়েছে। ‘আভাস’ শব্দটির পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে দোষ। এখানে ‘আভাস’ শব্দের অর্থ অবাস্তবিক রূপ।
পক্ষাভাস : সাধ্যে পক্ষের বিনাশ বা অসম্ভাবনায় পক্ষাভাস দোষ হয়। এক্ষেত্রে পক্ষটি পক্ষের মতো হয়, কিন্তু আসলে তা পক্ষ নয়। অনুমান প্রক্রিয়ার বিষয় সেই বস্তুটি যার মধ্যে সাধ্যের স্থিতি সন্দিগ্ধ, একথাই এখানে বলা হয়েছে। জৈনরা ছয় প্রকার পক্ষাভাস স্বীকার করেছেন, যেমন- অনিষ্ট, প্রত্যক্ষবাধিত, অনুমানবাধিত, আগমবাধিত, লোকবাধিত ও স্ববচনবাধিত।
হেত্বাভাস : জৈনদের প্রমাণশাস্ত্রে যাদের লক্ষণ বলা হয়েছে তাদের মধ্যে সেই লক্ষণ না থাকলে তারা তত্তদাভাস নামে সুপ্রসিদ্ধ। যেমন প্রমাণের সাধারণ লক্ষণ না থাকায় সংশয়, বিপর্যয় ও অনধ্যবসায় হচ্ছে প্রমাণাভাস এবং সংশয়াদির লক্ষণ না থাকলে সংশয়াভাস, বিপর্যয়াভাস ও অনধ্যবসাভাস হয়। এভাবে প্রত্যক্ষলক্ষণের অভাবে প্রত্যক্ষাভাস। অনুরূপভাবে পরোক্ষের অন্তর্গত স্মৃতি প্রভৃতির নিজ নিজ লক্ষণের অভাবে সেই সেই আভাস হয় এবং হেতুর নিজ লক্ষণের অভাবে হেত্বাভাস হয়।
যা হেতুর লক্ষণের অভাবের দরুন হেতু নয় (=অহেতু) অথচ হেতুর মতো আভাসমান বা প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে হেত্বাভাস। এই ব্যুৎপত্তিতে হেত্বাভাস শব্দটি দুষ্ট হেতুকে বোঝায়, হেতুর দোষকে নয়। হেতুদোষ বোঝাতে যে যে দোষ থাকলে আপাতত হেতুর মতো প্রতীয়মান হলেও প্রকৃত হেতু বলা যায় না তা বোঝানো হয়। জৈনমতে হেত্বাভাস তিন প্রকার- অসিদ্ধ, বিরুদ্ধ ও অনৈকান্তিক।
অসিদ্ধি দোষযুক্ত হেত্বাভাস হচ্ছে অসিদ্ধ। অবিদ্যমান অথচ অন্যভাবে উপপন্ন হয় না এভাবে সত্ত্বের অসিদ্ধিতে অসিদ্ধ হেত্বাভাস হয়। মূলত দর্শনশাস্ত্রের স্বরূপাসিদ্ধ দোষকেই জৈনমতে অসিদ্ধ বলা হয়েছে। পক্ষে হেতু না থাকলে স্বরূপাসিদ্ধি দোষ হয়। যেমন- শব্দ অনিত্য, কেননা তা চাক্ষুষ নয়। এই চাক্ষুষত্ব হেতুটি পক্ষ শব্দে স্বরূপত থাকে না। শ্রোত্রেন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে শব্দে শ্রবণত্ব থাকে। উল্লেখ্য, আশ্রয়াসিদ্ধ ও ব্যাপ্যত্বাসিদ্ধকে জৈনমতে হেত্বাভাস বলে স্বীকার করা হয় না।
বিরুদ্ধ হেত্বাভাস সম্বন্ধে পরীক্ষামুখসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিপরীতনিশ্চিতাবিনাভাবো বিরুদ্ধঃ অপরিণামী শব্দ কৃতকত্বাৎ’। (পরীক্ষামুখসূত্র-৬/২৯)
অর্থাৎ : যে হেতু বা সাধন স্বীকৃত সিদ্ধান্তের বিরোধ করে অর্থাৎ স্বীকৃত সাধ্যকে ব্যাহত করে তা হচ্ছে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস।
যেমন- বহ্নি উষ্ণ নয়, কেননা তা দ্রব্য। যেহেতু বহ্নির উষ্ণত্ব প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ, তাই এখানে হেত্বাভাস পরিলক্ষিত হয়। সে কারণে বিরুদ্ধ হেত্বাভাস সম্বন্ধে প্রমাণমীমাংসাতে বলা হয়েছে-
‘বিপরীতনিয়মোঃ অন্যথৈবোপপদ্যমানো বিরুদ্ধঃ’। (প্রমাণমীমাংসা-২/২০)
অর্থাৎ : সাধ্যস্বরূপের বিপরীতের সাথে অবিনাভাব (=ব্যাপ্তি) নিশ্চিত হলে বিরুদ্ধ হয়।
অনৈকান্তিক হেত্বাভাস সম্বন্ধে পরীক্ষামুখসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিপক্ষেহপ্যবিরুদ্ধবৃত্তি অনৈকান্তিকঃ’। (পরীক্ষামুখসূত্র-৬/৩০)
অর্থাৎ : বিপক্ষেও অবিরুদ্ধ বৃত্তি হচ্ছে অনৈকান্তিক হেত্বাভাস।
কোন কিছুর অন্তে নিয়ত হচ্ছে ঐকান্তিক, তার বিপরীত অনৈকান্তিক, অর্থ সব্যভিচার। পক্ষ ও সপক্ষ হতে ভিন্নতে বৃত্তি হচ্ছে ব্যভিচার। যা পক্ষ ও সপক্ষে থাকা সত্ত্বেও অন্যত্র বা বিপক্ষেও থাকে তাকে ব্যভিচারী বলা হয়। যেভাবে লোকে পক্ষ, সপক্ষ ও বিপক্ষে বিদ্যমান কোন ব্যক্তিকে ব্যভিচারী বলা হয়, সেভাবে অনৈকান্তিক হেতুকে বুঝতে হবে। অতএব, যে সাধন বা হেতু ঐকান্তিক নয় অর্থাৎ এক অন্তে থাকে না, অথবা যার ব্যভিচার কোন স্থানে অব্যবস্থিত আছে তাকে অনৈকান্তিক বা সব্যভিচার বলে। তা দুইপ্রকার- নিশ্চিতবৃত্তি ও শঙ্কিতবৃত্তি।
(৫) শব্দ বা আগম :
ন্যায় ও মীমাংসা দর্শনের মতো জৈনদর্শনে আগম নামে শব্দ প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। জৈন দার্শনিক মানিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ বলা হয়েছে-
‘আপ্তবচনাদিনিবন্ধম্ অর্থজ্ঞানম্ আগমঃ’।- (পরীক্ষামুখসূত্র-৩/৯৯)
অর্থাৎ : আপ্তবাক্য হস্তসঙ্কেত প্রভৃতি হতে উৎপন্ন বিষয়ের জ্ঞান হচ্ছে আগম।
জৈনরা বেদকে অপৌরুষেয় বলে স্বীকার করেন না এবং সেরূপ বেদবাক্যের প্রামাণ্যও স্বীকার করেন না। তবে তীর্থঙ্করদের উপদেশে বিশ্বাস করেন। তাদের মতে শব্দ ও অঙ্গের মধ্যে প্রতিপাদ্য-প্রতিপাদকভাব নাম স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকায় স্পষ্টতই শব্দ প্রভৃতি বস্তুর প্রতিপাদক হেতু। জৈনরা অন্বিতাভিধানবাদ বা অভিহিতান্বয়বাদ স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, প্রকৃতি প্রভৃতির অন্বিতাভিধানে কিংবা অভিহিত পদগুলির অন্বয়ে পদার্থের প্রতিপত্তি (=জ্ঞান) হয়ে থাকে।
জৈনমতে আগম দুই প্রকার- লৌকিক ও অলৌকিক।
Tags
জৈন-দর্শন