চার্বাক সিদ্ধান্ত, আলোচনা-সমালোচনা

চার্বাক সিদ্ধান্ত, আলোচনা-সমালোচনা

ইতোমধ্যেই আমাদের বোঝার বাকি থাকে না যে, ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনগুলির নিকট চার্বাকমত বুঝি এক জীবন্ত প্রহেলিকা। যুক্তিনিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে অধ্যাত্ম বা অলৌকিকতার বিরুদ্ধে লৌকিক বাস্তবতার প্রচণ্ড সাঁড়াশি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিত যে-দর্শনমতের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিলো তাকে অধ্যাত্মবাদীরা যে প্রাণপণে প্রতিহত করবেন তাতে আর আশ্চর্যের কী! অধ্যাত্মবাদীদের এই প্রতিহতকরণ-প্রচেষ্টা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছিলো তা অনুধাবন করা যায় চার্বাকদের বিরুদ্ধে তাঁদের ঘৃণা আর খেদোক্তি বা অভিশন্তাপের বাহুল্য দেখেও। প্রচলিত সাধারণ-জনমানসেও দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে বিরোধী কাউকে মনমতো শায়েস্তা করতে না পারলে অক্ষম যন্ত্রণায় শেষতক অভিশাপ দিয়েই সান্ত্বনা খোঁজে, ‘ধর্মই তোর বিচার করবে, তুই নরকবাসী হবি!’

এই নরকবাস আসলে কী? শান্ত্রে নরকের নানারকম বর্ণনা পাওয়া যায়। বোঝাই যায় শাস্ত্রমতে নরক একরকমের নয়। কেবল ‘মনুস্মৃতি’তেই (মনুসংহিতা-৪/৮৮-৯০) একুশ রকম নরকের ফর্দ রয়েছে। ‘মনুস্মৃতি’র এই ফর্দ থেকেই বোঝা যায় সম্ভব-অসম্ভব রকমারি পার্থিব যন্ত্রণার বিবরণই নরক-কল্পনার মূল উপাদান। যেমন–
তামিস্রমন্ধতামিস্রং মহারৌরবরৌরবৌ।
নরকং কালসূত্রঞ্চ মহানরকমেব চ।। (মনু-৪/৮৮)
সঞ্জীবনং মহাবীচিং তপনং সম্প্রতাপনম্ ।
সংঘাতঞ্চ সকাকোলং কুড্মলং পূতিমৃত্তিকম্ ।। (মনু-৪/৮৯)
লোহশঙ্কুমৃজীষঞ্চ পন্থানং শাল্মলীং নদীম্ ।
অসিপত্রবনঞ্চৈব লোহদারকমেব চ।। (মনু-৪/৯০)

 অর্থাৎ : এই একুশ-রকমের নরকগুলি– তামিম্র (অন্ধকার), অন্ধতামিস্র (নিবিড় অন্ধকার), মহারৌরব (মহাকোলাহলপরিপূর্ণ), রৌরব (কোলাহলপরিপূর্ণ), কালসূত্র (যেখানে সকলরকম উপায়ে পীড়ন করা হয়), সঞ্জীবন (যেখানে বার বার বাঁচিয়ে বার বার মেরে ফেলা হয়), মহানরক (যেখানে অগ্নিপ্রভৃতির দ্বারা সন্তাপ দেওয়া হয়), মহাবীচি (মতান্তরে, অবীচি; যেখানে অত্যন্ত জলতরঙ্গ), তপন (আগুন প্রভৃতির দ্বারা দগ্ধ করা হয় যেখানে), সম্প্রতাপন (কুম্ভীপাক; যেখানে কুম্ভে নিক্ষেপ করা হয়), সংঘাত (যেখানে অত্যন্ত সংকীর্ণস্থানে বহু লোককে স্থাপন করা হয়), কাকোল (যেখানে কাকদের দ্বারা ভক্ষণ করানো হয়), কুড্মল (যেখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে পীড়ন দেওয়া হয়), পূতিমৃত্তিক (যেখানকার মাটি বিষ্ঠার গন্ধে পূর্ণ), লোহশঙ্কু (যেখানে সূচের দ্বারা ভেদন করানো হয়), ঋজীষ (যেখানে তপ্ত কড়াইতে নিক্ষেপ করা হয়), পন্থা (যেখানে বারংবার গমনাগমন করানো হয়), শাল্মলী (অন্যমতে, শাল্মল; যেখানে শাল্মলীর কাঁটার দ্বারা শরীরকে বিদ্ধ করানো হয়), নদী (বৈতরণী প্রভৃতি যে সব নদী দুর্গন্ধ-রুধির পূর্ণ, অস্থিপ্রভৃতির দ্বারা আচ্ছন্ন, উষ্ণজলপরিপূর্ণ ও বেগবতী– তার উপর ভাসানো হয়), অসিপত্রবন (যেখানে তরবারীর তীক্ষ্ণাংশদ্বারা শরীর ছিন্নভিন্ন করা হয়) এবং লোহদারক (যেখানে লৌহশৃঙ্খলের দ্বারা বেঁধে রাখা হয়)। (মনসংহিতা-৪/৮৮-৯০)।।


কোন্ পাপে কার জন্য কোন্ নরকের নিবন্ধন ঘটে তাও নিশ্চয়ই শাস্ত্রে বর্ণিত আছে। আর টীকাকার কুল্লুকভট্টই বলছেন, রকমারি নরকের আরো বিস্তৃত বিবরণের জন্য ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণ’ প্রভৃতি দ্রষ্টব্য। কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় নরক-বর্ণনা নয়। তবে এতো রকমের নরকের একটি যে মহানরক, যেখানে সমস্ত রকম যন্ত্রণার আয়োজনই রাখা হয়েছে তা বোধ করি বোঝার বাকি নেই। এই মহানরকের উল্লেখ করা হচ্ছে এজন্যেই যে, প্রসিদ্ধ ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিক বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘ভামতি’ গ্রন্থে (ভামতি-৩/৩/৫৪) বলছেন–
‘এ-হেন মহানরকেই নাস্তিক চার্বাকের স্থান। অবশ্য সাধারণত মরবার পরে নরকে যাবার কথা। কিন্তু চার্বাকের অবস্থা তা নয়। মহানরকবাসের জন্যে তার মরবারও দরকার পড়ে না, জীবদ্দশাতেই ঐ নরকবাস। কেননা, চার্বকের এমনই মত যে তা মানলে মহানরকের যন্ত্রণা ছাড়া গত্যন্তর নেই।’

বাচস্পতির এই উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ (পৃষ্ঠা-৪৩) থেকে। কিন্তু কী এমন মত যে তা মানলে জীবদ্দশাতেই এ-হেন যন্ত্রণা? দেবীপ্রসাদ-কৃত উদ্ধৃতিতে বাচস্পতি বলছেন–
‘চার্বাক প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণই মানে না। তাই তার অবস্থা জানোয়ারেরও বেহদ্দ। জানোয়ারেরাও হিত-প্রাপ্তি ও অহিত-পরিহারের ব্যাপারটা বোঝে, কিন্তু বুঝতে গেলে অনুমানের উপর নির্ভর করতে হয়। যেমন, জানোয়ারেরাও হিতপ্রাপ্তির জন্যে কোমল ঘাসের ক্ষেত্রে বিচরণ করে; অহিত পরিহারের জন্যে শুকনো কাঁটার জঙ্গল এড়িয়ে যায়। নিছক প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করে এজাতীয় ব্যবহার সম্ভব নয় : হিতপ্রাপ্তির ও অহিত-পরিহারের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির জন্যে অনুমানের উপর নির্ভরতা প্রয়োজন। কিন্তু চার্বাক অনুমান বলে কোনো প্রমাণই মানে না; পশুর ব্যবহারের মধ্যে যেটুকু অনুমানের আয়োজন তাও নয়। তাছাড়া, চার্বাকের পক্ষে তো বেবাক বোবা হয়ে থাকবার কথা, কেননা অপরকে কিছু বলতে গেলে শব্দ ব্যবহার প্রয়োজন এবং শব্দ প্রত্যক্ষ হলেও শব্দ থেকে শব্দযোগ্য পদার্থ অনুমানসাপেক্ষ। অতএব চার্বাক জন্মান্তরের কথা উড়িয়ে দিতে গেলেও ইহজন্মেই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, নিশ্চেষ্ট এবং মূক অবস্থায় মহানরকের যন্ত্রণা ভোগ করতে বাধ্য।’

ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বাচস্পতি মিশ্র যে যেনতেন লোক নন, দার্শনিক হিসেবে দিকপাল-বিশেষ, তা বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণই অবগত। নানা প্রসিদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় তাঁর গ্রন্থ প্রামাণ্য বলেই স্বীকৃত। কিন্তু বিদগ্ধ চিন্তাশীলও যখন চিন্তাচেতনার বালাই চুকিয়ে দিয়ে চার্বাককে এমন গাল দিতে উদ্যত হন তা নিশ্চয়ই হেলাফেলার বিষয় নয়। কিন্তু চার্বাকের নিন্দা– বিশেষত তার প্রত্যক্ষপরায়ণতার বিবরণ যে অতিরঞ্জিত এটুকু অনুমান করতে কষ্ট হয় না। কেননা চার্বাকদের বিরুদ্ধে একটা প্রচলিত অভিযোগ এই যে সুখাদ্যের প্রতি চার্বাকের অত্যন্ত অভিরুচি। তাই কচি ঘাস দেখে ছাগলেও তার প্রতি আকৃষ্ট হবার জন্য যতটুকু অনুমান-পরায়ণতার পরিচয় দেয়, চার্বাকের মধ্যে তারও অভাব– এমনতর অসম্ভব উক্তি দার্শনিক প্রতিভা তো দূরের কথা, সামান্যতম সততারও পরিচায়ক নয় বলে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত। বিষয়গুলি স্পষ্টতর হওয়ার লক্ষ্যেই ভারতীয় দর্শনে চার্বাকী-সিদ্ধান্তের আলোচনায় আমরা অনুপ্রবিষ্ট হতে পারি। তবে এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা আবশ্যক যে, আলোচনার স্পষ্টতার নিরীখে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইতঃপূর্বে আলোচিত চার্বাক সাহিত্য-সংশ্লিষ্ট বিশেষ কিছু দৃষ্টান্তের পুনরোল্লেখ ঘটতে পারে প্রাসঙ্গিক বিবেচনার আলোকে।

নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال