স্যাদবাদ (relativity of knowledge ) বা সপ্তভঙ্গিনয় (Seven Modes of Predication)
নয়ের অর্থ কোন বস্তুর সাপেক্ষ নিরূপণ। যে নীতি অনুসারে স্যাদ্বাদের অনুকূলে বস্তুর স্বরূপ নিরূপণ হয় তাকে ’নয়’ বলে।
জৈনমতে (Jainism) একটি বস্তুর অসংখ্য গুণ বা ধর্ম আছে। সাধারণ মানুষ তার সীমিত জ্ঞানের সাহায্যে বিশেষ বিশেষ সময়ে বস্তুর বিশেষ বিশেষ গুণ বা ধর্মকে জানতে পারে। সসীম বা সীমাবদ্ধ জীবের পক্ষে একাধারে বস্তুর সব গুণ জানা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র সর্বজ্ঞ পুরুষ তাঁর কেবলজ্ঞানের (absolute knowledge) দ্বারা বস্তুর অসংখ্য গুণ বা ধর্মগুলিকে জানতে পারেন। কিন্তু অপূর্ণ মানুষ একটি বিশেষ সময়ে কোন একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বস্তু দেখে থাকে। এই কারণে বস্তুর একটি বিশিষ্টধর্মই সে জানতে পারে। কোন একটি বস্তুর অনন্তধর্মের মধ্যে এরূপ একটি বিশিষ্টধর্মের জ্ঞানকে বলে ‘নয়’। তাই জৈনমতে ‘নয়’কে আংশিক জ্ঞানও বলা হয়ে থাকে। তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মটি জ্ঞাত হয় সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানটি যথার্থ। কিন্তু বস্তুর সামগ্রিক জ্ঞান হিসেবে এটি যথার্থ নয়। জ্ঞানের এই আপেক্ষিকতা সম্বন্ধে আমরা অবহিত থাকি না বলেই আমাদের মধ্যে কলহ এবং মতবিরোধ দেখা দেয়।
.
জ্ঞানের এই আপেক্ষিকতার বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করার জন্য জৈনগণ কয়েকজন অন্ধ ব্যক্তির হাতি দেখার দৃষ্টান্তকে উপস্থাপন করেন। কয়েকজন অন্ধ ব্যক্তি একটি হাতির বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করে যে জ্ঞান লাভ করে তা তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে। যে ব্যক্তি হাতির পা স্পর্শ করে তার মতে হাতি স্তম্ভের মতো; যে ব্যক্তি হাতির কান স্পর্শ করে তার মতে হাতি কুলার মতো; যে হাতির দেহ স্পর্শ করে তার মতে হাতি পাহাড়ের মতো; যে হাতির শুঁড় স্পর্শ করে তার মতে হাতি লতার মতো। বিভিন্ন অন্ধ ব্যক্তির এই অবধারণগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিরোধমূলক। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে প্রতিটি ব্যক্তির অবধারণই পরিপূর্ণ সত্য। কিন্তু বস্তুতপক্ষে তাদের অবধারণগুলি আপেক্ষিক এবং আংশিক সত্যকে প্রকাশ করে। অন্ধ ব্যক্তিগণ যখন তাদের অবধারণের আপেক্ষিকতা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবে, তখন তারা প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করবে এবং তাদের অবধারণগুলির মধ্যে আপাত পারস্পরিক বিরোধিতা দূও হবে। এইরূপ জ্ঞান প্রকাশক অবধারণ বা পরামর্শকেও ‘নয়’ বলা হয়।অন্ধ ব্যক্তিদের হাতি দেখার উপরিউক্ত দৃষ্টান্তকে ভিত্তি করে জৈনদর্শন এব চরম দার্শনিক তত্ত্বকে প্রকাশ করেছে। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। এই সব ভিন্ন ভিন্ন মতের মধ্যে আপাত বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। এই বিরোধের কারণ, আমরা বিভিন্ন মতের আপেক্ষিকতা ভুলে যাই। বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কিত কোন বর্ণনাই পরিপূর্ণ বা এককভাবে সত্য নয়। প্রতিটি দার্শনিক মতই জগৎ ও জীবনের এক একটি বিশেষ দিককে প্রকাশ করে।
যৌক্তিক দিক থেকে জৈনগণ অবধারণের আপেক্ষিকতা বোঝাবার জন্য অবধারণের পূর্বে আপেক্ষিকতা সূচক ‘স্যাৎ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। জৈনদের তর্কশাস্ত্রের একটি মূল কথা হলো স্যাৎ-বাদ (relativity of knowledge)। স্যাদবাদের মূল কথা হচ্ছে- বস্তু বা সত্তার স্বরূপ বহুমুখী, তাই বিভিন্নভাবেই তা বর্ণিত হতে পারে। এর মধ্যে কোন বর্ণনাই মিথ্যা নয়, আবার কোন বর্ণনাই একমাত্র সত্য নয়। যেহেতু সত্তার বহুমুখী দিক বা স্বরূপ সম্বন্ধে সামগ্রিক উক্তি একমাত্র পূর্ণজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব, তাই সাধারণ দৃষ্টিতে প্রত্যেক বিষয়ে আমাদের প্রতিটি উক্তিই শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনামূলক এবং এই সম্ভাবনার নির্দেশক শব্দ হলো স্যাৎ। স্যাৎ মানে কোনভাবে সম্ভব। ‘স্যাৎ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘হয়তো’ বা ‘হতে পারে’। ব্যাকরণের দিক থেকে ‘স্যাৎ’ শব্দ সম্ভাবনানির্দেশক। কিন্তু জৈন দার্শনিকগণ ‘স্যাৎ’ শব্দটিকে এই অর্থে গ্রহণ করেননি। বরং জৈন দর্শনে এই শব্দটি প্রকাশিত অবধারণ ভিন্ন অন্য অবধারণের সম্ভাবনা নির্দেশক। এই ‘স্যাৎ’ শব্দ দ্বারা কোন একটি অবধারণের যেমন আপেক্ষিকতাকে প্রকাশ করা হয়, তেমনি আবার অন্য অবধারণের সম্ভাবনাকেও প্রকাশ করা হয়। তাই জৈন দর্শনে ব্যবহৃত ‘স্যাৎ’ শব্দটি কোনভাবেই প্রকাশিত অবধারণের নিছক সম্ভাবনা সূচনা করে না। প্রকাশিত অবধারণ সম্বন্ধে এখানে কোন সংশয়েরও অবকাশ নেই।
জৈনদর্শন সংশয়বাদী নয়। একটি অবধারণ আপেক্ষিক এবং এই অবধারণ ছাড়াও অন্য অবধারণ সম্ভব এক কথা, আর অবধারণটি সম্ভাব্য কিংবা সংশয়াত্মক আরেক কথা। ‘হস্তী স্তম্ভ ইব’ বা ‘হাতি স্তম্ভের মতো’- এই অবধারণ একটা অনাপেক্ষিক সত্যকে প্রকাশ করে, কিন্তু ‘স্যাৎ হস্তী স্তম্ভ ইব’ বা ‘হাতি স্তম্ভের মতো হতে পারে’- এইরূপ অবধারণ একটা আপেক্ষিক সত্যকে প্রকাশ করে। প্রথম অবধারণ স্থান-কাল নিরপেক্ষভাবে হাতিকে স্তম্ভের মতো বলে বর্ণনা করে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার অবধারণ স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে কোন এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হাতিকে স্তম্ভের মতো বলে বর্ণনা করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম প্রকার অবধারণ ঐকান্তিক ও অসত্য, কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার অবধারণ অনৈকান্তিক ও সত্য। সুতরাং জৈন দর্শনে ‘স্যাৎ’ শব্দ অবধারণের সাপেক্ষ-সদর্থক-রূপকে গ্রহণ করার এবং নিরপেক্ষরূপকে বর্জন করার পক্ষপাতী। তাই আমাদের প্রত্যেক উক্তির সঙ্গে স্যাৎ শব্দ যোগ করা প্রয়োজন। তাছাড়াও সবরকম বিকল্প-সম্ভাবনার কথা মনে রাখাও প্রয়োজন। অতএব কোন বিষয়ে শুধু অস্তি (=আছে) বা নাস্তি (=নাই) বলে নিশ্চয় করা ঠিক নয়। তার বদলে একই বিষয়ে আরো কতকগুলি সম্ভাবনাকে যুক্ত করতে হয়।
.
স্যাৎ-বাদ বুঝাতে জৈনাচার্যগণ সাতটি পরামর্শ বা বাক্যের প্রয়োগ করেন। প্রত্যেক বাক্যকে এক একটি ‘ভঙ্গি’ নামে ডাকা হয়। সেকারণে সাত প্রকার বাক্যকে একত্রে সপ্তভঙ্গি বলা হয়। এর পূর্ণনাম ‘সপ্তভঙ্গিনয়’। ‘ভগবতীসূত্র’ অনুযায়ী স্বয়ং মহাবীর ‘স্যাৎ অস্তি’ (সম্ভবত আছে), ‘স্যাৎ নাস্তি’ (সম্ভবত নেই), ‘স্যাৎ অব্যক্তব্যম্’ (সম্ভবত অবক্তব্য) এই তিনটি ভঙ্গের উল্লেখ করেছেন। এ কারণে এই ভঙ্গত্রয়কে মূলভঙ্গ বলা হয়। পরবর্তীকালে এই ভঙ্গত্রয়ের পারস্পরিক মিশ্রণে ‘সপ্তভঙ্গি নয়ের’ উদ্ভব হয়েছে। ‘অস্তিত্ব, নাস্তিত্ব ও অবক্তব্য’ এদের মিশ্রণের দ্বারা সাত প্রকার বিধেয় পাওয়া যায়-
.
(১) স্যাৎ অস্তি (সম্ভবত আছে),
(২) স্যাৎ নাস্তি (সম্ভবত নেই),
(৩) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ (সম্ভবত আছেও নেইও),
(৪) স্যাৎ অব্যক্তব্যম্ (সম্ভবত অবক্তব্য),
(৫) স্যাৎ অস্তি চ অব্যক্তব্যম্ চ (সম্ভবত আছেও অবক্তব্যও),
(৬) স্যাৎ নাস্তি চ অব্যক্তব্যম্ চ (সম্ভবত নেইও অবক্তব্যও),
(৭) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অব্যক্তব্যম্ চ (সম্ভবত আছেও, নেইও, অবক্তব্যও)।
.
তর্কশাস্ত্রে গুণ অনুসারে বস্তু বা সত্তার অবধারণ বা পরামর্শকে (judgement) দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- সদর্থক বা ভাববাচক এবং নঞর্থক বা নেতিবাচক বা নিষেধাত্মক। সদর্থক ভঙ্গিতে কোন একটি গুণ বা ধর্ম একটি বস্তু সম্বন্ধে স্বীকার করা হয়। যেমন ‘ঘটোহস্তি’ বা ঘটটি আছে। আর নঞর্থক ভঙ্গিতে কোন একটি গুণ বা ধর্ম কোন বস্তু সম্পর্কে অস্বীকার করা হয়। যেমন ‘ঘটো নাস্তি’ বা ঘট নেই। জৈন দার্শনিকগণ এই বিভাগের কিছু সংশোধন করে উভয় পরামর্শে ‘স্যাৎ’ অর্থাৎ ‘হয়তো’ বা ‘সম্ভবত’ কথাটি যুক্ত করেন। ফলে উক্ত সাত প্রকার পরামর্শে ‘স্যাৎ অস্তি’, ‘স্যাৎ নাস্তি’ এই দু’টি বাক্য অন্তর্গত হয়েছে। কোন দেশে, কালে এবং কোন একটি দৃষ্টিতে কোন বস্তুকে ‘সৎ’ (=বিদ্যমান) বলা গেলেও অন্য দেশ, কাল ও দৃষ্টিভেদে সেই বস্তুকে ‘অসৎ’ (=অবিদ্যমান) বলা যায়। এভাবে অস্তি এবং নাস্তি রূপ প্রথম দু’টি ভঙ্গি পৃথক ব্যাখ্যাত হলে অস্তি এবং নাস্তির একত্র সমাবেশ হওয়াতেই তৃতীয় ভঙ্গিও ব্যাখ্যাত হয়। অস্তি ও নাস্তির বিরোধবশত একত্র প্রাপ্তি সম্ভব না হলে সমাধানের যে প্রকার তা অব্যক্তরূপ চতুর্থ ভঙ্গিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে অস্তির সাথে অব্যক্তব্যতা যোগে পঞ্চম, নাস্তির সাথে অবক্তব্যতা যোগে ষষ্ঠ এবং অস্তি নাস্তি উভয়ের সাথে অবক্তব্যতার যোগে সপ্তম এই তিনটি ভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছে। এটাই হচ্ছে সংপ্তিভাবে প্রসিদ্ধ জৈন সপ্তভঙ্গিনয়।
.
একাদশ শতকের দিগম্বর জৈন দার্শনিক অনন্তবীর্য তাঁর ‘পরীক্ষামুখপঞ্জিকা বা প্রমেয়রত্নমালা’ গ্রন্থে সপ্তভঙ্গির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-
নয়ের অর্থ কোন বস্তুর সাপেক্ষ নিরূপণ। যে নীতি অনুসারে স্যাদ্বাদের অনুকূলে বস্তুর স্বরূপ নিরূপণ হয় তাকে ’নয়’ বলে।
জৈনমতে (Jainism) একটি বস্তুর অসংখ্য গুণ বা ধর্ম আছে। সাধারণ মানুষ তার সীমিত জ্ঞানের সাহায্যে বিশেষ বিশেষ সময়ে বস্তুর বিশেষ বিশেষ গুণ বা ধর্মকে জানতে পারে। সসীম বা সীমাবদ্ধ জীবের পক্ষে একাধারে বস্তুর সব গুণ জানা সম্ভব নয়। কেবলমাত্র সর্বজ্ঞ পুরুষ তাঁর কেবলজ্ঞানের (absolute knowledge) দ্বারা বস্তুর অসংখ্য গুণ বা ধর্মগুলিকে জানতে পারেন। কিন্তু অপূর্ণ মানুষ একটি বিশেষ সময়ে কোন একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বস্তু দেখে থাকে। এই কারণে বস্তুর একটি বিশিষ্টধর্মই সে জানতে পারে। কোন একটি বস্তুর অনন্তধর্মের মধ্যে এরূপ একটি বিশিষ্টধর্মের জ্ঞানকে বলে ‘নয়’। তাই জৈনমতে ‘নয়’কে আংশিক জ্ঞানও বলা হয়ে থাকে। তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মটি জ্ঞাত হয় সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞানটি যথার্থ। কিন্তু বস্তুর সামগ্রিক জ্ঞান হিসেবে এটি যথার্থ নয়। জ্ঞানের এই আপেক্ষিকতা সম্বন্ধে আমরা অবহিত থাকি না বলেই আমাদের মধ্যে কলহ এবং মতবিরোধ দেখা দেয়।
.
জ্ঞানের এই আপেক্ষিকতার বিষয়টিকে সুস্পষ্ট করার জন্য জৈনগণ কয়েকজন অন্ধ ব্যক্তির হাতি দেখার দৃষ্টান্তকে উপস্থাপন করেন। কয়েকজন অন্ধ ব্যক্তি একটি হাতির বিভিন্ন অঙ্গ স্পর্শ করে যে জ্ঞান লাভ করে তা তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রকাশ করে। যে ব্যক্তি হাতির পা স্পর্শ করে তার মতে হাতি স্তম্ভের মতো; যে ব্যক্তি হাতির কান স্পর্শ করে তার মতে হাতি কুলার মতো; যে হাতির দেহ স্পর্শ করে তার মতে হাতি পাহাড়ের মতো; যে হাতির শুঁড় স্পর্শ করে তার মতে হাতি লতার মতো। বিভিন্ন অন্ধ ব্যক্তির এই অবধারণগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিরোধমূলক। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে প্রতিটি ব্যক্তির অবধারণই পরিপূর্ণ সত্য। কিন্তু বস্তুতপক্ষে তাদের অবধারণগুলি আপেক্ষিক এবং আংশিক সত্যকে প্রকাশ করে। অন্ধ ব্যক্তিগণ যখন তাদের অবধারণের আপেক্ষিকতা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হবে, তখন তারা প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করবে এবং তাদের অবধারণগুলির মধ্যে আপাত পারস্পরিক বিরোধিতা দূও হবে। এইরূপ জ্ঞান প্রকাশক অবধারণ বা পরামর্শকেও ‘নয়’ বলা হয়।অন্ধ ব্যক্তিদের হাতি দেখার উপরিউক্ত দৃষ্টান্তকে ভিত্তি করে জৈনদর্শন এব চরম দার্শনিক তত্ত্বকে প্রকাশ করেছে। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেছেন। এই সব ভিন্ন ভিন্ন মতের মধ্যে আপাত বিরোধ পরিলক্ষিত হয়। এই বিরোধের কারণ, আমরা বিভিন্ন মতের আপেক্ষিকতা ভুলে যাই। বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জগৎ ও জীবনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কিত কোন বর্ণনাই পরিপূর্ণ বা এককভাবে সত্য নয়। প্রতিটি দার্শনিক মতই জগৎ ও জীবনের এক একটি বিশেষ দিককে প্রকাশ করে।
যৌক্তিক দিক থেকে জৈনগণ অবধারণের আপেক্ষিকতা বোঝাবার জন্য অবধারণের পূর্বে আপেক্ষিকতা সূচক ‘স্যাৎ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। জৈনদের তর্কশাস্ত্রের একটি মূল কথা হলো স্যাৎ-বাদ (relativity of knowledge)। স্যাদবাদের মূল কথা হচ্ছে- বস্তু বা সত্তার স্বরূপ বহুমুখী, তাই বিভিন্নভাবেই তা বর্ণিত হতে পারে। এর মধ্যে কোন বর্ণনাই মিথ্যা নয়, আবার কোন বর্ণনাই একমাত্র সত্য নয়। যেহেতু সত্তার বহুমুখী দিক বা স্বরূপ সম্বন্ধে সামগ্রিক উক্তি একমাত্র পূর্ণজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব, তাই সাধারণ দৃষ্টিতে প্রত্যেক বিষয়ে আমাদের প্রতিটি উক্তিই শেষ পর্যন্ত সম্ভাবনামূলক এবং এই সম্ভাবনার নির্দেশক শব্দ হলো স্যাৎ। স্যাৎ মানে কোনভাবে সম্ভব। ‘স্যাৎ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো ‘হয়তো’ বা ‘হতে পারে’। ব্যাকরণের দিক থেকে ‘স্যাৎ’ শব্দ সম্ভাবনানির্দেশক। কিন্তু জৈন দার্শনিকগণ ‘স্যাৎ’ শব্দটিকে এই অর্থে গ্রহণ করেননি। বরং জৈন দর্শনে এই শব্দটি প্রকাশিত অবধারণ ভিন্ন অন্য অবধারণের সম্ভাবনা নির্দেশক। এই ‘স্যাৎ’ শব্দ দ্বারা কোন একটি অবধারণের যেমন আপেক্ষিকতাকে প্রকাশ করা হয়, তেমনি আবার অন্য অবধারণের সম্ভাবনাকেও প্রকাশ করা হয়। তাই জৈন দর্শনে ব্যবহৃত ‘স্যাৎ’ শব্দটি কোনভাবেই প্রকাশিত অবধারণের নিছক সম্ভাবনা সূচনা করে না। প্রকাশিত অবধারণ সম্বন্ধে এখানে কোন সংশয়েরও অবকাশ নেই।
জৈনদর্শন সংশয়বাদী নয়। একটি অবধারণ আপেক্ষিক এবং এই অবধারণ ছাড়াও অন্য অবধারণ সম্ভব এক কথা, আর অবধারণটি সম্ভাব্য কিংবা সংশয়াত্মক আরেক কথা। ‘হস্তী স্তম্ভ ইব’ বা ‘হাতি স্তম্ভের মতো’- এই অবধারণ একটা অনাপেক্ষিক সত্যকে প্রকাশ করে, কিন্তু ‘স্যাৎ হস্তী স্তম্ভ ইব’ বা ‘হাতি স্তম্ভের মতো হতে পারে’- এইরূপ অবধারণ একটা আপেক্ষিক সত্যকে প্রকাশ করে। প্রথম অবধারণ স্থান-কাল নিরপেক্ষভাবে হাতিকে স্তম্ভের মতো বলে বর্ণনা করে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার অবধারণ স্থান ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে কোন এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হাতিকে স্তম্ভের মতো বলে বর্ণনা করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম প্রকার অবধারণ ঐকান্তিক ও অসত্য, কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার অবধারণ অনৈকান্তিক ও সত্য। সুতরাং জৈন দর্শনে ‘স্যাৎ’ শব্দ অবধারণের সাপেক্ষ-সদর্থক-রূপকে গ্রহণ করার এবং নিরপেক্ষরূপকে বর্জন করার পক্ষপাতী। তাই আমাদের প্রত্যেক উক্তির সঙ্গে স্যাৎ শব্দ যোগ করা প্রয়োজন। তাছাড়াও সবরকম বিকল্প-সম্ভাবনার কথা মনে রাখাও প্রয়োজন। অতএব কোন বিষয়ে শুধু অস্তি (=আছে) বা নাস্তি (=নাই) বলে নিশ্চয় করা ঠিক নয়। তার বদলে একই বিষয়ে আরো কতকগুলি সম্ভাবনাকে যুক্ত করতে হয়।
.
স্যাৎ-বাদ বুঝাতে জৈনাচার্যগণ সাতটি পরামর্শ বা বাক্যের প্রয়োগ করেন। প্রত্যেক বাক্যকে এক একটি ‘ভঙ্গি’ নামে ডাকা হয়। সেকারণে সাত প্রকার বাক্যকে একত্রে সপ্তভঙ্গি বলা হয়। এর পূর্ণনাম ‘সপ্তভঙ্গিনয়’। ‘ভগবতীসূত্র’ অনুযায়ী স্বয়ং মহাবীর ‘স্যাৎ অস্তি’ (সম্ভবত আছে), ‘স্যাৎ নাস্তি’ (সম্ভবত নেই), ‘স্যাৎ অব্যক্তব্যম্’ (সম্ভবত অবক্তব্য) এই তিনটি ভঙ্গের উল্লেখ করেছেন। এ কারণে এই ভঙ্গত্রয়কে মূলভঙ্গ বলা হয়। পরবর্তীকালে এই ভঙ্গত্রয়ের পারস্পরিক মিশ্রণে ‘সপ্তভঙ্গি নয়ের’ উদ্ভব হয়েছে। ‘অস্তিত্ব, নাস্তিত্ব ও অবক্তব্য’ এদের মিশ্রণের দ্বারা সাত প্রকার বিধেয় পাওয়া যায়-
.
(১) স্যাৎ অস্তি (সম্ভবত আছে),
(২) স্যাৎ নাস্তি (সম্ভবত নেই),
(৩) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ (সম্ভবত আছেও নেইও),
(৪) স্যাৎ অব্যক্তব্যম্ (সম্ভবত অবক্তব্য),
(৫) স্যাৎ অস্তি চ অব্যক্তব্যম্ চ (সম্ভবত আছেও অবক্তব্যও),
(৬) স্যাৎ নাস্তি চ অব্যক্তব্যম্ চ (সম্ভবত নেইও অবক্তব্যও),
(৭) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অব্যক্তব্যম্ চ (সম্ভবত আছেও, নেইও, অবক্তব্যও)।
.
তর্কশাস্ত্রে গুণ অনুসারে বস্তু বা সত্তার অবধারণ বা পরামর্শকে (judgement) দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- সদর্থক বা ভাববাচক এবং নঞর্থক বা নেতিবাচক বা নিষেধাত্মক। সদর্থক ভঙ্গিতে কোন একটি গুণ বা ধর্ম একটি বস্তু সম্বন্ধে স্বীকার করা হয়। যেমন ‘ঘটোহস্তি’ বা ঘটটি আছে। আর নঞর্থক ভঙ্গিতে কোন একটি গুণ বা ধর্ম কোন বস্তু সম্পর্কে অস্বীকার করা হয়। যেমন ‘ঘটো নাস্তি’ বা ঘট নেই। জৈন দার্শনিকগণ এই বিভাগের কিছু সংশোধন করে উভয় পরামর্শে ‘স্যাৎ’ অর্থাৎ ‘হয়তো’ বা ‘সম্ভবত’ কথাটি যুক্ত করেন। ফলে উক্ত সাত প্রকার পরামর্শে ‘স্যাৎ অস্তি’, ‘স্যাৎ নাস্তি’ এই দু’টি বাক্য অন্তর্গত হয়েছে। কোন দেশে, কালে এবং কোন একটি দৃষ্টিতে কোন বস্তুকে ‘সৎ’ (=বিদ্যমান) বলা গেলেও অন্য দেশ, কাল ও দৃষ্টিভেদে সেই বস্তুকে ‘অসৎ’ (=অবিদ্যমান) বলা যায়। এভাবে অস্তি এবং নাস্তি রূপ প্রথম দু’টি ভঙ্গি পৃথক ব্যাখ্যাত হলে অস্তি এবং নাস্তির একত্র সমাবেশ হওয়াতেই তৃতীয় ভঙ্গিও ব্যাখ্যাত হয়। অস্তি ও নাস্তির বিরোধবশত একত্র প্রাপ্তি সম্ভব না হলে সমাধানের যে প্রকার তা অব্যক্তরূপ চতুর্থ ভঙ্গিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে অস্তির সাথে অব্যক্তব্যতা যোগে পঞ্চম, নাস্তির সাথে অবক্তব্যতা যোগে ষষ্ঠ এবং অস্তি নাস্তি উভয়ের সাথে অবক্তব্যতার যোগে সপ্তম এই তিনটি ভঙ্গির সৃষ্টি হয়েছে। এটাই হচ্ছে সংপ্তিভাবে প্রসিদ্ধ জৈন সপ্তভঙ্গিনয়।
.
একাদশ শতকের দিগম্বর জৈন দার্শনিক অনন্তবীর্য তাঁর ‘পরীক্ষামুখপঞ্জিকা বা প্রমেয়রত্নমালা’ গ্রন্থে সপ্তভঙ্গির ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-
‘তদ্বিধানবিবক্ষায়াং স্যাদস্তীতি গতির্ভবেৎ।
স্যান্নাস্তীতি প্রয়োগঃ স্যাত্তন্নিষেধে বিবক্ষিতে।।
ক্রমেণোভয়বাঞ্ছায়াং প্রয়োগঃ সমুদায়ভাক্ ।
যুগপত্তদ্বিবক্ষায়াং স্যাদবাচ্যমশক্তিতঃ।।
আদ্যাবাচ্যবিবক্ষায়াং পঞ্চমো ভঙ্গ ইষ্যতে।
অন্ত্যাবাচ্যবিবক্ষায়াং ষষ্ঠভঙ্গসমুদ্ভবঃ।।
সমুচ্চয়েন যুক্তশ্চ সপ্তমো ভঙ্গ উচ্যতে।।’ ইতি।- (পরীক্ষামুখপঞ্জিকা)
অর্থাৎ :
কোন বস্তুর বিধান বা অস্তিত্ব প্রতিপাদন করতে চাইলে ‘স্যাদস্তি’ এরূপ বলা হবে। তার নিষেধ প্রতিপাদনে ‘স্যান্নাস্তি’। ক্রমে দু’টি বলতে ‘স্যাদস্তি চ স্যান্নাস্তি চ’ প্রয়োগ হবে। দু’টিকে একসঙ্গে বলতে বিরোধ হলে ‘স্যাদবাচ্য’ প্রয়োগ হবে। প্রথমটি (অবক্তব্য) বুঝাতে পঞ্চম ভঙ্গি, দ্বিতীয়টি (নাস্তিত্ব) ও অবাচ্যত্ব বুঝাতে ষষ্ঠ ভঙ্গি, অস্তিত্ব নাস্তিত্ব ও অবক্তব্যত্বের সমুচ্চয় বুঝাতে সপ্তম ভঙ্গি প্রযুক্ত হবে।
(নাস্তিকদর্শন পরিচয়/ ড. বিশ্বরূপ সাহা।) যেমন-
(১) স্যাদস্তি (কিছুর অপেক্ষায় কোন বস্তু আছে)- এটি হচ্ছে প্রথম পরামর্শ। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা হয় ‘ঘটোহস্তি’ তবে তার অর্থ হবে কোন বিশেষ দেশ, কাল ও প্রসঙ্গে ঘটটি আছে। এটি একটি ভাবাত্মক বাক্য বা পরামর্শ।
(২) স্যান্নাস্তি (কিছুর অপেক্ষায় কোন বস্তু অবিদ্যমান)- এটি অভাবাত্মক পরামর্শ। উপাদান, স্থান, কাল ও পটাদি অন্য বস্তুর স্বরূপে ঘট বিদ্যমান নয়।
(৩) স্যাদস্তি চ নাস্তি চ (কিছুর অপেক্ষায় কোন বস্তু একসাথে বিদ্যমান ও অবিদ্যমান উভয়বিধ)। কোনভাবে ঘট আছে ও তা নেই।
(৪) স্যাদ্ অবক্তব্যঃ (কিছুর অপেক্ষায় বস্তুর স্বরূপ নির্দিষ্ট করা যায় না)। যদি কোন পরামর্শে পরস্পর বিরোধী গুণের সম্বন্ধে একসাথে বিচার করা হয় তবে সেই বিষয়ে ‘অবক্তব্য’ শব্দ প্রয়োগ করতে হয়। এটি হচ্ছে চতুর্থ পরামর্শ।
(৫) স্যাদস্তি চাবক্তব্যশ্চ (কিছুর অপেক্ষায় বস্তুটি আছে তথা অনির্দিষ্ট হবে)। বস্তু একই সময়ে থাকতে পারে অথচ নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
(৬) স্যান্নাস্তি চাবক্তব্যশ্চ (কিছুর অপেক্ষায় বস্তুটি নেই তথা তার রূপনির্দিষ্ট করা যায় না)। দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভঙ্গি যোগে এই ষষ্ঠ পরামর্শটি হয়েছে।
(৭) স্যাদস্তি চ নাস্তি চাবক্তব্যশ্চ। তৃতীয় ও চতুর্থ ভঙ্গি যুক্ত করে অর্থাৎ অস্তিত্ব, নাস্তিত্ব ও অবক্তব্যত্বের সমুচ্চয় করে এই সপ্তম ভঙ্গরূপ পরামর্শটি তৈরি হয়েছে।
.
বিষয়টিকে দৃষ্টান্তের সাহায্যে আরেকটু স্পষ্টরূপে প্রকাশ করা যেতে পারে।
(১) স্যাদস্তি (কিছুর অপেক্ষায় কোন বস্তু আছে)- এটি হচ্ছে প্রথম পরামর্শ। উদাহরণস্বরূপ যদি বলা হয় ‘ঘটোহস্তি’ তবে তার অর্থ হবে কোন বিশেষ দেশ, কাল ও প্রসঙ্গে ঘটটি আছে। এটি একটি ভাবাত্মক বাক্য বা পরামর্শ।
(২) স্যান্নাস্তি (কিছুর অপেক্ষায় কোন বস্তু অবিদ্যমান)- এটি অভাবাত্মক পরামর্শ। উপাদান, স্থান, কাল ও পটাদি অন্য বস্তুর স্বরূপে ঘট বিদ্যমান নয়।
(৩) স্যাদস্তি চ নাস্তি চ (কিছুর অপেক্ষায় কোন বস্তু একসাথে বিদ্যমান ও অবিদ্যমান উভয়বিধ)। কোনভাবে ঘট আছে ও তা নেই।
(৪) স্যাদ্ অবক্তব্যঃ (কিছুর অপেক্ষায় বস্তুর স্বরূপ নির্দিষ্ট করা যায় না)। যদি কোন পরামর্শে পরস্পর বিরোধী গুণের সম্বন্ধে একসাথে বিচার করা হয় তবে সেই বিষয়ে ‘অবক্তব্য’ শব্দ প্রয়োগ করতে হয়। এটি হচ্ছে চতুর্থ পরামর্শ।
(৫) স্যাদস্তি চাবক্তব্যশ্চ (কিছুর অপেক্ষায় বস্তুটি আছে তথা অনির্দিষ্ট হবে)। বস্তু একই সময়ে থাকতে পারে অথচ নির্দিষ্ট করে বলা যায় না।
(৬) স্যান্নাস্তি চাবক্তব্যশ্চ (কিছুর অপেক্ষায় বস্তুটি নেই তথা তার রূপনির্দিষ্ট করা যায় না)। দ্বিতীয় ও চতুর্থ ভঙ্গি যোগে এই ষষ্ঠ পরামর্শটি হয়েছে।
(৭) স্যাদস্তি চ নাস্তি চাবক্তব্যশ্চ। তৃতীয় ও চতুর্থ ভঙ্গি যুক্ত করে অর্থাৎ অস্তিত্ব, নাস্তিত্ব ও অবক্তব্যত্বের সমুচ্চয় করে এই সপ্তম ভঙ্গরূপ পরামর্শটি তৈরি হয়েছে।
.
বিষয়টিকে দৃষ্টান্তের সাহায্যে আরেকটু স্পষ্টরূপে প্রকাশ করা যেতে পারে।
(১) স্যাৎ অস্তি : ‘স্যাৎ অস্তি’ হলো জৈন যুক্তিবিজ্ঞানের সকল প্রকার সদর্থক অবধারণের সাধারণ রূপ। সদর্থক অবধারণ কোন একটি বস্তুতে কোন একটি গুণ বা ধর্মের অস্তিত্বকে সূচনা করে।
যেমন, প্রথম অবধারণ বা পরামর্শের দৃষ্টান্ত হলো ‘ফলটি সবুজ’। এই পরামর্শকে প্রকাশ করতে গিয়ে জৈন দার্শনিকরা বলেন ‘হয়তো ফলটি সবুজ’ বা একদিক থেকে ফলটি সবুজ। এর অর্থ হলো কোন নির্দিষ্ট স্থানে ফলটি সবুজ হলেও, সবসময় ফলটি সবুজ নাও হতে পারে। এই কারণে সব সদর্থক পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি’।
(২) স্যাৎ নাস্তি : দ্বিতীয়ত, ‘স্যাৎ নাস্তি’ হলো জৈন যুক্তিবিজ্ঞানের সকল প্রকার নঞর্থক অবধারণের সাধারণ রূপ। নঞর্থক অবধারণ কোন একটি বস্তুতে কোন একটি গুণ বা ধর্মের অনস্তিত্ব সূচনা করে।
যেমন, নিষেধাত্মক পরামর্শের দৃষ্টান্ত হলো ‘ফলটি সবুজ নয়’। এই পরামর্শটিকে প্রকাশ করতে গিয়ে জৈন দার্শনিকরা বলেন ‘হয়তো ফলটি সবুজ নয়’। এর অর্থ হলো কোন বিশেষ সময়ে কোন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফলটি সবুজ হলেও সবসময় ফলটি সবুজ নাও হতে পারে। এই কারণে জৈনমতে সব নঙর্থক পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ নাস্তি’।
(৩) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ : তৃতীয় প্রকার ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ’ একই সঙ্গে একটি বস্তুর সদর্থক ও নঞর্থক ধর্ম বা গুণ প্রকাশক অবধারণের সাধারণ রূপ। জৈনমতে সদর্থক অবধারণ যেমন একটি বস্তুতে কোন একটি ধর্ম বা গুণের স্বীকৃতি বোঝায়, তেমনি নঞর্থক অবধারণ সেই বস্তুতে অপর কোন ধর্ম বা গুণের অস্বীকৃতি বোঝায়। এই দুইপ্রকার অবধারণ ছাড়াও একটি অবধারণ একই সঙ্গে একই স্থানে কোন একটি বস্তুতে কোন একটি ধর্মের স্বীকৃতি ও অন্য একটি ধর্মের অস্বীকৃতি বোঝাতে পারে। এইরূপ ক্ষেত্রে অবধারণটি স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির সংযুক্ত রূপ পরিগ্রহ করে।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ, পরামর্শটি হলো ‘ফলটি সবুজ আবার সবুজ নয়’। জৈন মত অনুযায়ী প্রকাশ করতে হলে বলতে হবে ‘হয়তো ফলটি সবুজ এবং সবুজ নয়’। একটি ফল প্রথমে সবুজ থাকে, পরে পাকলে হলদে হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ আবার সবুজ নাও থাকতে পারে। কোন বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা প্রকাশ করতে হলে অথবা বস্তুর সদর্থক ও নঙর্থক ধারণাকে সামগ্রিকভাবে জানতে হলে এই জাতীয় পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ’।
(৪) স্যাৎ অবক্তব্যম্ : জৈন যুক্তিবিজ্ঞান-স্বীকৃত চতুর্থপ্রকার অবধারণের রূপ হলো ‘স্যাৎ অব্যক্তম্’। স্থান-কাল নিরপেক্ষভাবে সর্বাবস্থায় কোন একটি বস্তুতে কোন একটি ধর্মের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি সম্ভব নয়।
যেমন, ফলটি কখনো সবুজ, কখনো হলুদ, এই অবস্থায় যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, সকল অবস্থায় ফলটির বর্ণ কী ? সেক্ষেত্রে বলতে হবে যে, সকল অবস্থায় ফলটির বর্ণ কী তা বলা যায় না। অর্থাৎ তা হলো অবক্তব্য। এই কারণে চতুর্থ পরামর্শের সাধারণ রূপ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘স্যাৎ অব্যক্তব্যম্’। এই ধরনের পরামর্শ নির্দেশ করে যে সাধারণভাবে যে কোন বস্তুই অনির্বচনীয়। যদিও বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, উক্ত বক্তব্যের দ্বারা বোঝানো হয় যে এমন অনেক দার্শনিক সমস্যা আছে যার সরাসরি কোন উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া, পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম একই বস্তুতে আরোপ করা চলে না- জৈন দার্শনিকরা এই সত্য স্বীকার করেন এবং সেই কারণে জৈনরা বিরোধবাধক নিয়ম ভঙ্গ করেন- এই অভিযোগ সত্য নয়। বরং একথা বলা চলে যে, বিরোধবাধক নিয়ম তাঁরা মেনে চলেন। সেই কারণেই তাঁরা স্বীকার করেন যে পরস্পর বিরুদ্ধ দু’টি ধর্মকে একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন বস্তুর উপর একই সময়ে আরোপ করা চলে না।
(৫) স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ : জৈনদের পঞ্চম প্রকার অবধারণের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’। প্রথম প্রকার অবধারণের সঙ্গে চতুর্থ প্রকার অবধারণ যুক্ত করলে এই অবধারণটি পাওয়া যায়। দেশ-কাল সাপেক্ষে যখন কোন একটি বস্তুতে কোন একটি গুণ বা ধর্মের স্বীকৃতি বোঝানো হয় এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে ঐ বস্তুটিকে অবর্ণনীয় বলে প্রকাশ করা হয়, তখন এইরূপ অবধারণের উদ্ভব হয়।
যেমন, ফলটি বিশেষ বিশেষ সময়ে সবুজ। কিন্তু সব অবস্থায় ফলটি কী রকম তা বর্ণনা করা যায় না। এই কারণে জৈনরা বলেন ‘হয়তো ফলটি সবুজ এবং অবক্তব্য’। তাই পঞ্চম পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’।
(৬) স্যাৎ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ : জৈনদের ষষ্ঠ প্রকার অবধারণের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’। দ্বিতীয় প্রকার অবধারণের সঙ্গে চতুর্থ প্রকার অবধারণ যুক্ত করলে এই অবধারণটি পাওয়া যায়। এই প্রকার অবধারণের ক্ষেত্রে দেশ-কাল সাপেক্ষে একটি বস্তুতে কোন ধর্মের অবিদ্যমানতা এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে ঐ ধর্মের অবর্ণনীয়তাকে প্রকাশ করা হয়।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ, ফলটি সময় বিশেষে সবুজ নয়, কিন্তু সব অবস্থায় ফলটি কী রকম তা বর্ণনা করা যায় না। এই কারণে এই পরামর্শটিকে প্রকাশ করতে হলে আমাদের বলতে হয় ‘হয়তো ফলটি সবুজ নয় এবং অবক্তব্য’। তাই ষষ্ঠ প্রকার পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’।
(৭) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ : জৈনদের সপ্তম প্রকার অবধারণের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’। তৃতীয় প্রকার অবধারণের সঙ্গে চতুর্থ প্রকার অবধারণ যুক্ত করলে এই অবধারণটি পাওয়া যায়। কোন একটি বস্তুতে নির্দিষ্ট স্থানে ও কালে যখন কোন একটি গুণ বা ধর্মের স্বীকৃতি আবার ভিন্ন কোন স্থানে বা কালে ঐ বস্তুতে ঐ ধর্ম বা গুণের অস্বীকৃতি এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে ঐ বস্তুর অবর্ণনীয়তাকে প্রকাশ করা হয় তখন এইরূপ অবধারণের উদ্ভব হয়।
যেমন, ফলটি সময় বিশেষে সবুজ অথবা সময় বিশেষে সবুজ নয় এবং সব অবস্থায় ফলটি কী তা বলা যায় না। এই বক্তব্য প্রকাশ করতে বলা হয়েছে ‘হয়তো ফলটি সবুজ এবং সবুজ নয় এবং অবক্তব্য’। তাই সপ্তম প্রকার পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’।
.
সুতরাং জৈনমতে ‘নয়’ বা শর্তাধীন পরামর্শের সংখ্যা সাত। এই মতে যদিও কোন বস্তুর অনন্ত ধর্ম আছে তবুও কোন বস্তুর বর্ণনা করতে হলে এই সাতপ্রকার পরামর্শের মধ্যে যে কোন একটিকে ব্যবহার করতে হবে। পরামর্শের সংখ্যা সাতের বেশি কখনও হতে পারবে না। ফলে বলা যায় যে, কোন পরামর্শ করার সময় যদি ঐকান্তিকভাবে করা হয় এবং আপেক্ষিকভাবে করা না হয় তাহলে সেই পরামর্শ মিথ্যা ‘নয়’ বা নয়া-ভাস।
.
প্রশ্ন হতে পারে, জৈনদর্শনে সপ্তভঙ্গি নয়ে কেন ‘স্যাৎ’ বাক্যের সংখ্যা কেবল সাতটিই স্বীকার করা হয়েছে ? জৈনদের সাতটি বাক্যে নিয়ত থাকা ন্যায়সঙ্গত। কেননা অস্তি, নাস্তি ও অবক্তব্য পদগুলিকে ‘স্যাৎ’ এই অব্যয়ের সাথে যোগ করে ব্যস্ত ও সমস্তভাবে সাতটিই ভেদ হবে, সাতের কম বা বেশি বাক্য সম্ভব নয়।
.
স্যাৎ-বাদকে সন্দেহবাদ (scepticism) বলা যায় না। কেননা সন্দেহবাদ জ্ঞানের সম্ভাবনায় সন্দেহ করে। কিন্তু জৈনগণ জ্ঞানের সম্ভাবনার সত্যতায় বিশ্বাস করেন। তাঁরা পূর্ণজ্ঞানের সম্ভাবনাতেও বিশ্বাস করেন। সাধারণ জ্ঞানের সম্ভাবনায় স্যাৎবাদ সন্দিগ্ধ নয়। অতএব স্যাৎবাদকে সন্দেহবাদ বলা সঙ্গত নয়।
.
জৈনমতে স্থান, কাল ও দৃষ্টিকোণের উপর জ্ঞান ও জ্ঞানের আকার নির্ভর করে। সেকারণে স্যাৎবাদকে সাপেক্ষবাদ বলা যায়। জৈনমতে বস্তুর অনন্ত গুণ স্বীকার করা হয। এই গুণ দ্রষ্টা বা জ্ঞাতার উপর নির্ভর করে না, কিন্তু গুণগুলির স্বতন্ত্র সত্তা আছে। জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞানের উপর বা জ্ঞাতার মনের উপর আদৌ নির্ভরশীল নয় অর্থাৎ জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে বলে জৈন দার্শনিকগণ বিশ্বাস করেন। তাঁরা বস্তুর বাস্তবিকতায় বিশ্বাসী। এরূপ মতবাদ বস্তুবাদের (realism) তুল্য এবং তাই ভারতীয় দর্শনে জৈনগণকে বস্তুবাদী দার্শনিকের তুল্য পর্যায়ে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে কেউ কেউ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
.
যেমন, প্রথম অবধারণ বা পরামর্শের দৃষ্টান্ত হলো ‘ফলটি সবুজ’। এই পরামর্শকে প্রকাশ করতে গিয়ে জৈন দার্শনিকরা বলেন ‘হয়তো ফলটি সবুজ’ বা একদিক থেকে ফলটি সবুজ। এর অর্থ হলো কোন নির্দিষ্ট স্থানে ফলটি সবুজ হলেও, সবসময় ফলটি সবুজ নাও হতে পারে। এই কারণে সব সদর্থক পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি’।
(২) স্যাৎ নাস্তি : দ্বিতীয়ত, ‘স্যাৎ নাস্তি’ হলো জৈন যুক্তিবিজ্ঞানের সকল প্রকার নঞর্থক অবধারণের সাধারণ রূপ। নঞর্থক অবধারণ কোন একটি বস্তুতে কোন একটি গুণ বা ধর্মের অনস্তিত্ব সূচনা করে।
যেমন, নিষেধাত্মক পরামর্শের দৃষ্টান্ত হলো ‘ফলটি সবুজ নয়’। এই পরামর্শটিকে প্রকাশ করতে গিয়ে জৈন দার্শনিকরা বলেন ‘হয়তো ফলটি সবুজ নয়’। এর অর্থ হলো কোন বিশেষ সময়ে কোন বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফলটি সবুজ হলেও সবসময় ফলটি সবুজ নাও হতে পারে। এই কারণে জৈনমতে সব নঙর্থক পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ নাস্তি’।
(৩) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ : তৃতীয় প্রকার ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ’ একই সঙ্গে একটি বস্তুর সদর্থক ও নঞর্থক ধর্ম বা গুণ প্রকাশক অবধারণের সাধারণ রূপ। জৈনমতে সদর্থক অবধারণ যেমন একটি বস্তুতে কোন একটি ধর্ম বা গুণের স্বীকৃতি বোঝায়, তেমনি নঞর্থক অবধারণ সেই বস্তুতে অপর কোন ধর্ম বা গুণের অস্বীকৃতি বোঝায়। এই দুইপ্রকার অবধারণ ছাড়াও একটি অবধারণ একই সঙ্গে একই স্থানে কোন একটি বস্তুতে কোন একটি ধর্মের স্বীকৃতি ও অন্য একটি ধর্মের অস্বীকৃতি বোঝাতে পারে। এইরূপ ক্ষেত্রে অবধারণটি স্বীকৃতি ও অস্বীকৃতির সংযুক্ত রূপ পরিগ্রহ করে।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ, পরামর্শটি হলো ‘ফলটি সবুজ আবার সবুজ নয়’। জৈন মত অনুযায়ী প্রকাশ করতে হলে বলতে হবে ‘হয়তো ফলটি সবুজ এবং সবুজ নয়’। একটি ফল প্রথমে সবুজ থাকে, পরে পাকলে হলদে হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ আবার সবুজ নাও থাকতে পারে। কোন বস্তুর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা প্রকাশ করতে হলে অথবা বস্তুর সদর্থক ও নঙর্থক ধারণাকে সামগ্রিকভাবে জানতে হলে এই জাতীয় পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ’।
(৪) স্যাৎ অবক্তব্যম্ : জৈন যুক্তিবিজ্ঞান-স্বীকৃত চতুর্থপ্রকার অবধারণের রূপ হলো ‘স্যাৎ অব্যক্তম্’। স্থান-কাল নিরপেক্ষভাবে সর্বাবস্থায় কোন একটি বস্তুতে কোন একটি ধর্মের স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি সম্ভব নয়।
যেমন, ফলটি কখনো সবুজ, কখনো হলুদ, এই অবস্থায় যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, সকল অবস্থায় ফলটির বর্ণ কী ? সেক্ষেত্রে বলতে হবে যে, সকল অবস্থায় ফলটির বর্ণ কী তা বলা যায় না। অর্থাৎ তা হলো অবক্তব্য। এই কারণে চতুর্থ পরামর্শের সাধারণ রূপ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘স্যাৎ অব্যক্তব্যম্’। এই ধরনের পরামর্শ নির্দেশ করে যে সাধারণভাবে যে কোন বস্তুই অনির্বচনীয়। যদিও বিশেষ বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, উক্ত বক্তব্যের দ্বারা বোঝানো হয় যে এমন অনেক দার্শনিক সমস্যা আছে যার সরাসরি কোন উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া, পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম একই বস্তুতে আরোপ করা চলে না- জৈন দার্শনিকরা এই সত্য স্বীকার করেন এবং সেই কারণে জৈনরা বিরোধবাধক নিয়ম ভঙ্গ করেন- এই অভিযোগ সত্য নয়। বরং একথা বলা চলে যে, বিরোধবাধক নিয়ম তাঁরা মেনে চলেন। সেই কারণেই তাঁরা স্বীকার করেন যে পরস্পর বিরুদ্ধ দু’টি ধর্মকে একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কোন বস্তুর উপর একই সময়ে আরোপ করা চলে না।
(৫) স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ : জৈনদের পঞ্চম প্রকার অবধারণের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’। প্রথম প্রকার অবধারণের সঙ্গে চতুর্থ প্রকার অবধারণ যুক্ত করলে এই অবধারণটি পাওয়া যায়। দেশ-কাল সাপেক্ষে যখন কোন একটি বস্তুতে কোন একটি গুণ বা ধর্মের স্বীকৃতি বোঝানো হয় এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে ঐ বস্তুটিকে অবর্ণনীয় বলে প্রকাশ করা হয়, তখন এইরূপ অবধারণের উদ্ভব হয়।
যেমন, ফলটি বিশেষ বিশেষ সময়ে সবুজ। কিন্তু সব অবস্থায় ফলটি কী রকম তা বর্ণনা করা যায় না। এই কারণে জৈনরা বলেন ‘হয়তো ফলটি সবুজ এবং অবক্তব্য’। তাই পঞ্চম পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’।
(৬) স্যাৎ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ : জৈনদের ষষ্ঠ প্রকার অবধারণের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’। দ্বিতীয় প্রকার অবধারণের সঙ্গে চতুর্থ প্রকার অবধারণ যুক্ত করলে এই অবধারণটি পাওয়া যায়। এই প্রকার অবধারণের ক্ষেত্রে দেশ-কাল সাপেক্ষে একটি বস্তুতে কোন ধর্মের অবিদ্যমানতা এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে ঐ ধর্মের অবর্ণনীয়তাকে প্রকাশ করা হয়।
যেমন, উদাহরণস্বরূপ, ফলটি সময় বিশেষে সবুজ নয়, কিন্তু সব অবস্থায় ফলটি কী রকম তা বর্ণনা করা যায় না। এই কারণে এই পরামর্শটিকে প্রকাশ করতে হলে আমাদের বলতে হয় ‘হয়তো ফলটি সবুজ নয় এবং অবক্তব্য’। তাই ষষ্ঠ প্রকার পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’।
(৭) স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ : জৈনদের সপ্তম প্রকার অবধারণের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’। তৃতীয় প্রকার অবধারণের সঙ্গে চতুর্থ প্রকার অবধারণ যুক্ত করলে এই অবধারণটি পাওয়া যায়। কোন একটি বস্তুতে নির্দিষ্ট স্থানে ও কালে যখন কোন একটি গুণ বা ধর্মের স্বীকৃতি আবার ভিন্ন কোন স্থানে বা কালে ঐ বস্তুতে ঐ ধর্ম বা গুণের অস্বীকৃতি এবং দেশ-কাল নিরপেক্ষভাবে ঐ বস্তুর অবর্ণনীয়তাকে প্রকাশ করা হয় তখন এইরূপ অবধারণের উদ্ভব হয়।
যেমন, ফলটি সময় বিশেষে সবুজ অথবা সময় বিশেষে সবুজ নয় এবং সব অবস্থায় ফলটি কী তা বলা যায় না। এই বক্তব্য প্রকাশ করতে বলা হয়েছে ‘হয়তো ফলটি সবুজ এবং সবুজ নয় এবং অবক্তব্য’। তাই সপ্তম প্রকার পরামর্শের সাধারণ রূপ হলো ‘স্যাৎ অস্তি চ নাস্তি চ অবক্তব্যম্ চ’।
.
সুতরাং জৈনমতে ‘নয়’ বা শর্তাধীন পরামর্শের সংখ্যা সাত। এই মতে যদিও কোন বস্তুর অনন্ত ধর্ম আছে তবুও কোন বস্তুর বর্ণনা করতে হলে এই সাতপ্রকার পরামর্শের মধ্যে যে কোন একটিকে ব্যবহার করতে হবে। পরামর্শের সংখ্যা সাতের বেশি কখনও হতে পারবে না। ফলে বলা যায় যে, কোন পরামর্শ করার সময় যদি ঐকান্তিকভাবে করা হয় এবং আপেক্ষিকভাবে করা না হয় তাহলে সেই পরামর্শ মিথ্যা ‘নয়’ বা নয়া-ভাস।
.
প্রশ্ন হতে পারে, জৈনদর্শনে সপ্তভঙ্গি নয়ে কেন ‘স্যাৎ’ বাক্যের সংখ্যা কেবল সাতটিই স্বীকার করা হয়েছে ? জৈনদের সাতটি বাক্যে নিয়ত থাকা ন্যায়সঙ্গত। কেননা অস্তি, নাস্তি ও অবক্তব্য পদগুলিকে ‘স্যাৎ’ এই অব্যয়ের সাথে যোগ করে ব্যস্ত ও সমস্তভাবে সাতটিই ভেদ হবে, সাতের কম বা বেশি বাক্য সম্ভব নয়।
.
স্যাৎ-বাদকে সন্দেহবাদ (scepticism) বলা যায় না। কেননা সন্দেহবাদ জ্ঞানের সম্ভাবনায় সন্দেহ করে। কিন্তু জৈনগণ জ্ঞানের সম্ভাবনার সত্যতায় বিশ্বাস করেন। তাঁরা পূর্ণজ্ঞানের সম্ভাবনাতেও বিশ্বাস করেন। সাধারণ জ্ঞানের সম্ভাবনায় স্যাৎবাদ সন্দিগ্ধ নয়। অতএব স্যাৎবাদকে সন্দেহবাদ বলা সঙ্গত নয়।
.
জৈনমতে স্থান, কাল ও দৃষ্টিকোণের উপর জ্ঞান ও জ্ঞানের আকার নির্ভর করে। সেকারণে স্যাৎবাদকে সাপেক্ষবাদ বলা যায়। জৈনমতে বস্তুর অনন্ত গুণ স্বীকার করা হয। এই গুণ দ্রষ্টা বা জ্ঞাতার উপর নির্ভর করে না, কিন্তু গুণগুলির স্বতন্ত্র সত্তা আছে। জ্ঞেয় বস্তু জ্ঞানের উপর বা জ্ঞাতার মনের উপর আদৌ নির্ভরশীল নয় অর্থাৎ জ্ঞেয় বস্তুর জ্ঞাননিরপেক্ষ স্বতন্ত্র সত্তা আছে বলে জৈন দার্শনিকগণ বিশ্বাস করেন। তাঁরা বস্তুর বাস্তবিকতায় বিশ্বাসী। এরূপ মতবাদ বস্তুবাদের (realism) তুল্য এবং তাই ভারতীয় দর্শনে জৈনগণকে বস্তুবাদী দার্শনিকের তুল্য পর্যায়ে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে কেউ কেউ এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
.
স্যাদবাদের সমালোচনা
স্যাৎবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় বিভিন্ন দার্শনিক পক্ষ থেকে অনেক আক্ষেপ করা হয়েছে। যেমন-
.
১) বৌদ্ধ ও বেদান্তী দার্শনিকরা স্যাৎবাদকে বিরোধাত্মক সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন। জৈনগণ বিরোধাত্মক গুণকে একসাথে সমন্বয় করেছেন। রামানুজের মতে সত্তা ও নিঃসত্তাকে পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম আলো ও অন্ধকারের মতো একত্রিত করা যায় না। শঙ্করাচার্যের মতে (ব্রহ্মসূত্র: ২/২/৩৩) যে পদার্থ অবক্তব্য তা কিভাবে বলা যায়। বলা হচ্ছে এবং বলা যায় না, এই দু’টি কথা পরস্পর বিরোধী। সেকারণে তিনি স্যাৎবাদকে পাগলের প্রলাপ বলেছেন।
.
২) বেদান্তী দার্শনিকদের মতে স্যাৎবাদ অনুযায়ী যদি সকল বস্তুই সম্ভবমাত্র হয়, তবে স্যাৎবাদ স্বয়ংই সম্ভবমাত্র হয়ে যাবে। ফলে স্যাৎবাদ হতেও পারে নাও হতে পারে। কিন্তু এরূপ কোন সিদ্ধান্ত সমীচীন হতে পারে না।
.
৩) মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট প্রমুখ সমালোচক মনে করেন, জৈনদের সপ্তভঙ্গি নয়ের শেষ তিন প্রকার নয় অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্যমাত্র। সেগুলি কেবল প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নয়ের সঙ্গে চতুর্থ নয়ের সংমিশ্রণ। এজাতীয় সংযুক্তি যদি স্বীকার করা হয় তাহলে এভাবে শত শত নয় পাওয়া সম্ভব। তাই কেবলমাত্র প্রথম চারটি নয়ের যৌক্তিকতা স্বীকার করা যেতে পারে।
.
৪) প্রথম চারপ্রকার নয়ও জৈনরা আবিষ্কার করেন নি। বেদান্ত দর্শনে চারটি কোটীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে- সৎ, অসৎ, সদসৎ ও সদসৎ ভিন্ন। বৌদ্ধ দর্শনেও এই চারটি কোটী ভিন্ন তত্ত্বকে শূন্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে জৈন সিদ্ধান্ত নতুন কোন তত্ত্ব নয়।
.
৫) স্যাৎবাদ অনুসারে আমাদের সকল কিছু সাপেক্ষ ও আংশিক। জৈনগণ কেবল সাপেক্ষকে স্বীকার করেন, নিরপেক্ষ সত্তা স্বীকার করেন না। নিরপেক্ষের অভাবে স্যাৎবাদের সাতটি পরামর্শ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাদের সমন্বয় সম্ভব নয়।
.
৬) জৈনদর্শনে কেবলজ্ঞানে বিশ্বাস করা হয়েছে। কেবলজ্ঞান সত্য, বিরোধশূন্য ও সংশয়শূন্য মনে করা হয়। এই জ্ঞানকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। কিন্তু কেবলজ্ঞানে বিশ্বাস করে জৈনগণ নিরপেক্ষ জ্ঞানে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সাপেক্ষ সত্যের সমাহারকে পূর্ণ সত্য বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সাপেক্ষ সত্য যোগ করলে কি করে নিরপেক্ষ বা পূর্ণ সত্য পাওয়া যায় তা বোঝা যায় না। জৈনরা দিয়েছেন ভেদ ও অভেদের জ্ঞান। ভেদের মধ্যে অভেদের ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেন নি। ফলে সাপেক্ষতার নামান্তর এই স্যাৎবাদ সিদ্ধান্তটি অসঙ্গত হয়ে যায়।
স্যাৎবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনায় বিভিন্ন দার্শনিক পক্ষ থেকে অনেক আক্ষেপ করা হয়েছে। যেমন-
.
১) বৌদ্ধ ও বেদান্তী দার্শনিকরা স্যাৎবাদকে বিরোধাত্মক সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন। জৈনগণ বিরোধাত্মক গুণকে একসাথে সমন্বয় করেছেন। রামানুজের মতে সত্তা ও নিঃসত্তাকে পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্ম আলো ও অন্ধকারের মতো একত্রিত করা যায় না। শঙ্করাচার্যের মতে (ব্রহ্মসূত্র: ২/২/৩৩) যে পদার্থ অবক্তব্য তা কিভাবে বলা যায়। বলা হচ্ছে এবং বলা যায় না, এই দু’টি কথা পরস্পর বিরোধী। সেকারণে তিনি স্যাৎবাদকে পাগলের প্রলাপ বলেছেন।
.
২) বেদান্তী দার্শনিকদের মতে স্যাৎবাদ অনুযায়ী যদি সকল বস্তুই সম্ভবমাত্র হয়, তবে স্যাৎবাদ স্বয়ংই সম্ভবমাত্র হয়ে যাবে। ফলে স্যাৎবাদ হতেও পারে নাও হতে পারে। কিন্তু এরূপ কোন সিদ্ধান্ত সমীচীন হতে পারে না।
.
৩) মীমাংসা দার্শনিক কুমারিল ভট্ট প্রমুখ সমালোচক মনে করেন, জৈনদের সপ্তভঙ্গি নয়ের শেষ তিন প্রকার নয় অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্যমাত্র। সেগুলি কেবল প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় নয়ের সঙ্গে চতুর্থ নয়ের সংমিশ্রণ। এজাতীয় সংযুক্তি যদি স্বীকার করা হয় তাহলে এভাবে শত শত নয় পাওয়া সম্ভব। তাই কেবলমাত্র প্রথম চারটি নয়ের যৌক্তিকতা স্বীকার করা যেতে পারে।
.
৪) প্রথম চারপ্রকার নয়ও জৈনরা আবিষ্কার করেন নি। বেদান্ত দর্শনে চারটি কোটীর কথা বর্ণনা করা হয়েছে- সৎ, অসৎ, সদসৎ ও সদসৎ ভিন্ন। বৌদ্ধ দর্শনেও এই চারটি কোটী ভিন্ন তত্ত্বকে শূন্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে জৈন সিদ্ধান্ত নতুন কোন তত্ত্ব নয়।
.
৫) স্যাৎবাদ অনুসারে আমাদের সকল কিছু সাপেক্ষ ও আংশিক। জৈনগণ কেবল সাপেক্ষকে স্বীকার করেন, নিরপেক্ষ সত্তা স্বীকার করেন না। নিরপেক্ষের অভাবে স্যাৎবাদের সাতটি পরামর্শ অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তাদের সমন্বয় সম্ভব নয়।
.
৬) জৈনদর্শনে কেবলজ্ঞানে বিশ্বাস করা হয়েছে। কেবলজ্ঞান সত্য, বিরোধশূন্য ও সংশয়শূন্য মনে করা হয়। এই জ্ঞানকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। কিন্তু কেবলজ্ঞানে বিশ্বাস করে জৈনগণ নিরপেক্ষ জ্ঞানে বিশ্বাস করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সাপেক্ষ সত্যের সমাহারকে পূর্ণ সত্য বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সাপেক্ষ সত্য যোগ করলে কি করে নিরপেক্ষ বা পূর্ণ সত্য পাওয়া যায় তা বোঝা যায় না। জৈনরা দিয়েছেন ভেদ ও অভেদের জ্ঞান। ভেদের মধ্যে অভেদের ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেন নি। ফলে সাপেক্ষতার নামান্তর এই স্যাৎবাদ সিদ্ধান্তটি অসঙ্গত হয়ে যায়।
Tags
জৈন-দর্শন