সাংখ্যের প্রকৃতিতত্ত্ব

সাংখ্যের প্রকৃতিতত্ত্ব


           সৎকার্যবাদী সাংখ্য দর্শন প্রকৃতিকেই জগতের আদি উপাদান ও অধিষ্ঠান বলে মনে করেন। এই মতে বিচিত্র জগৎ প্রকৃতির পরিণাম ছাড়া আর কিছুই নয়। সাংখ্যমতেজগতের আদি কারণ কোন চৈতন্যস্বরূপ পুরুষ বা জড় পরমাণু নয়। পুরুষ জগতের আদি কারণ হতে পারে না। পুরুষ চৈতন্যস্বরূপচৈতন্য জড় জগতের কারণ হতে পারে না। আবার অপরিণামী জড় পরমাণু থেকে মনবুদ্ধি বা অহংকারের মতো সূক্ষ্ম তত্ত্ব উৎপন্ন হতে পারে না। সুতরাং পরমাণু জগতের আদি কারণ নয়। জগতের আদি কারণ হলো পরমাণু থেকে সূক্ষ্মতর এক পরিণামশীল জড়তত্ত্ব। এই পরিণামশীল জড়তত্ত্বই প্রকৃতিপ্রধান বা অব্যক্তরূপে পরিচিত।
         সাংখ্যমতে প্রকৃতি নিত্য। এই নিত্য প্রকৃতির অভিব্যক্তিই জগৎ। কারণপ্রকৃতিতে জগৎ অব্যক্ত থাকে বলে প্রকৃতিকে অব্যক্ত বলা হয়। প্রকৃতি হলো নির্বিশেষ ও নিরবয়ব। এজন্য প্রকৃতি প্রত্যক্ষগোচর নয়। প্রকৃতি হলো এক সর্বব্যাপীঅতিসূক্ষ্মঅসীম ও জগতের আদিকারণরূপ জড়শক্তি। প্রকৃতিতে জগতের স্থিতি এবং প্রকৃতিতেই জগতের লয়। কারণরূপ প্রকৃতি অব্যক্ত ও প্রধানএবং কার্যরূপ প্রকৃতি সৎরূপে প্রকাশিত। সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ ষোড়শ কারিকায় প্রকৃতির স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন
কারণমন্ত্যব্যক্তং প্রবর্ত্ততে ত্রিগুণতঃ সমুদয়াচ্চ।
পরিণামতঃ সলিলবৎ প্রতিপ্রতিগুণাশ্রয়বিশেষাৎ।।’  -(সাংখ্যকারিকা১৬)
অর্থাৎ অব্যক্ত প্রধান বা প্রকৃতি (সত্ত্বরজঃ ও তমঃ– এইত্রিগুণরূপে সমবেত হয়ে কার্যাকারে পরিণত হয়। একই জল যেমন ভিন্ন ভিন্ন আধারে নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয়সেরূপ এক একটি গুণের প্রাধান্য অনুযায়ী ও সহকারীভেদে একই প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয়।
 
সাংখ্যমতে প্রকৃতির পরিণামের ফলে জগতের সৃষ্টিআবার প্রকৃতির পরিণামের ফলে জগতের লয়। সত্ত্বরজঃ ও তমঃ গুণ যখন সাম্যাবস্থায় থাকেতখন তাদের মধ্যে পৃথক পৃথক ভাবে পরিণাম ঘটে। অর্থাৎ সত্ত্ব সত্ত্বরূপেরজঃ রজোরূপে এবং তমঃ তমোরূপে পরিণত হয়। এরূপ পরিণামকে বলা হয় প্রকৃতির স্বরূপ পরিণাম বা সদৃশ পরিণাম। এই পরিণাম গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থায় ঘটে। এই সাম্যাবস্থা যখন বিনষ্ট হয়তখন প্রকৃতিতে অপর একপ্রকার পরিণাম দেখা যায়। এই পরিণামে সত্ত্বরজঃ ও তমঃএর পারস্পরিক শক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব ঘটে। এর ফলে কখনও সত্ত্বকখনও রজঃ আবার কখনও তমঃ গুণের প্রাধান্য ঘটে। প্রকৃতির এরূপ পরিণামকে বিরূপ পরিণাম বা বিসদৃশ পরিণাম বলে। বিরূপ পরিণামের ফলে জগতের সৃষ্টি এবং স্বরূপ পরিণামের ফলে জগতের লয় সূচিত হয়।
 .
ষোড়শ কারিকার ব্যাখ্যাকল্পে তাই বাচস্পতি মিশ্র তাঁর ‘সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী’ গ্রন্থে বলেন
প্রতিসর্গাবস্থায়াং সত্ত্বং রজস্তমশ্চ সদৃশপরিণামাবি ভবন্তি। পরিণামস্বভাবা হি গুণা নাপরিণম্য ক্ষণমপ্যবতিষ্টন্তে। তস্মাৎ সত্ত্বং সত্ত্বরূপতয়ারজো রজোরূপতয়াতমস্তমোরূপতয়া প্রতিসর্গাবস্থায়ামপি প্রবর্ত্ততে।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ প্রলয়কালে সত্ত্বরজ ও তম গুণের সদৃশ পরিণাম হয়। গুণগুলির স্বভাব পরিণাম। পরিণত না হয়ে এরা ক্ষণকালও থাকতে পারে না। তাই সত্ত্ব সত্ত্বরূপেরজঃ গুণ রজোরূপে ও তমঃ গুণ তমোরূপে প্রলয়কালেও পরিণাম প্রাপ্ত হয়।
 .
সাংখ্যমতে বলা হয়প্রকৃতির লক্ষণ বা স্বভাব হলো সত্ত্বরজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা। কিন্তু খেয়াল রাখা আবশ্যক যেএই মতেপ্রকৃতির দুটি অবস্থা– ব্যক্ত বা কার্যাবস্থা এবং অব্যক্ত বা অকার্যাবস্থা। প্রকৃতির অকার্যাবস্থাকে বলে মূলপ্রকৃতি বা প্রধান। মূলপ্রকৃতি বা প্রধানের লক্ষণ হলো এই ‘সত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা’ বা সত্ত্বরজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা। স্বভাবতএটিকে প্রকৃতির লক্ষণ বললে লক্ষণটি অব্যাপ্তি দোষদুষ্ট হবে। কারণএই লক্ষণটি প্রকৃতির ব্যক্ত ও অব্যক্ত অবস্থাদুটির মধ্যে কেবলমাত্র অব্যক্ত অবস্থাকে নির্দেশ করেব্যক্ত অবস্থাকে নির্দেশ করে না। তাই ঈশ্বরকৃষ্ণের তৃতীয় কারিকার ব্যাখ্যাকল্পে বাচস্পতি মিশ্র তাঁর সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে মূলপ্রকৃতি শব্দের অর্থ নিরূপণ প্রসঙ্গে বলেন
মূলপ্রকৃতিরবিকৃতিঃ’ ইতি। প্রকরোতীতি প্রকৃতিঃ প্রধানম্ সত্ত্বরজস্তমসাং সাম্যাবস্থা। সা অবিকৃতিঃপ্রকৃতিরেবেত্যর্থঃ।’– (সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদী)
অর্থাৎ মূলপ্রকৃতি অবিকৃতি (অর্থাৎ কেবল কারণযা কোন তত্ত্বের কার্য নয়)। যিনি প্রকৃষ্ট রূপে কার্য উৎপন্ন করেন তিনিই প্রকৃতি বা প্রধান– তিনি সত্ত্বরজঃ ও তমঃ– এই তিন গুণের সাম্যাবস্থা। তিনি অবিকৃতি– অর্থাৎ তিনি কেবল কারণ।
 .
প্রকৃতি’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলোপ্রকরোতি বা যা প্রকৃষ্ট কারণতাই প্রকৃতি। সাংখ্যমতে অন্যান্য কারণের তুলনায় উপাদান কারণই প্রকৃষ্ট কারণ। সুতরাং এই জগতের যা উপাদান কারণ তাই প্রকৃতি। এই প্রকৃতির স্বরূপ হলো সত্ত্বরজঃ ও তমঃ গুণের সাম্যাবস্থা। এই কারণে প্রকৃতিকে ত্রৈগুণ্য বলে। যেহেতু প্রকৃতির কারণ স্বীকার করলে অনবস্থা দেখা দেয়তাই প্রকৃতি হলো অকারণ (মূলে মূলাভাবাৎ অমূলম্ মূলম্)
 .
অব্যক্ত প্রকৃতির অস্তিত্বসিদ্ধি

সূক্ষ্ম প্রকৃতি যেহেতু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়সেহেতু প্রকৃতির অস্তিত্ব যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। সাংখ্যমতে এই প্রকৃতির নামান্তর হলো প্রধান। এই প্রধানকে অব্যক্তও বলা হয়। অব্যক্ত প্রত্যক্ষযোগ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলোআকাশকুসুমবন্ধ্যাপুত্র প্রভৃতির প্রত্যক্ষ না হওয়ায় তাদের অলীকত্ব যেমন সিদ্ধ হয়অনুরূপভাবে কেন বলা যাবে না যেপ্রধানের প্রত্যক্ষ না হওয়ায় প্রধান প্রভৃতির অলীকত্ব সিদ্ধ হোক ?
 .
এই আশঙ্কার উত্তরে বলা হয়েছেপ্রত্যক্ষ না হলেও তার অসত্ত্ব প্রমাণিত হয় না। প্রত্যক্ষ না হওয়া অর্থাৎঅনুপলব্ধির বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন– আকাশের অনেক উচ্চতায় পাখি উড়তে থাকলেও অতিদূরত্ববশত প্রত্যক্ষের দ্বারা তার উপলব্ধি হয় না। আবার অত্যন্ত নিকটে থাকায় নিজের চোখের কাজল দৃষ্টিগোচর হয় না। তৃতীয়তকোন ইন্দ্রিয় বিকল অর্থাৎ অপটু হলে অর্থাৎঅন্ধত্ববধিরত্ব প্রভৃতি থাকলে বিদ্যমান রূপ ও শব্দ প্রত্যক্ষগোচর হয় না। চতুর্থতঅন্যমনস্কতাবশত পদার্থ প্রত্যক্ষের বিষয় হয় না। অন্যমনস্কতা দু’ভাবে হতে পারে। প্রথমতমন যদি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়তাহলে অন্যমনস্কতা হয়। দ্বিতীয়তমনের যে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ হওয়া প্রয়োজনসেই ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ না হয়ে অন্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সংযোগ হলেও অন্যমনস্কতা হয়। আবার কামক্রোধ এবং লোভবশত যার মন বিবশ হয়েছেসেই ব্যক্তি অতি উজ্জ্বল আলোর মধ্যে থাকা ইন্দ্রিয়সম্বন্ধযুক্ত বিষয়কেও দেখতে পায় না। তাছাড়া অতিসূক্ষ্ম পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। এই কারণে কোন ব্যক্তি একাগ্রচিত্ত হলেও এবং পরমাণুদ্ব্যণুকআকাশকাল প্রভৃতির সঙ্গে চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হলেওঐ সকল পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। এক্ষেত্রে সূক্ষ্ম শব্দের অর্থ যে দ্রব্যে মহত্বের ও উদ্ভূতরূপের অভাব থাকে। আর দেওয়াল প্রভৃতির ব্যবধানবশত গৃহের মধ্যে থাকা পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না। সর্বোপরি অভিভববশত অভিভূত পদার্থের প্রত্যক্ষ হয় না।
 .
সুতরাংকোন বস্তুর প্রত্যক্ষ না হলেই তার অভাব সিদ্ধ হয় না। যে বস্তুটি প্রত্যক্ষযোগ্য অর্থাৎবস্তুটির প্রত্যক্ষের কারণগুলি আছে অথচ অতিদূরত্ব প্রভৃতি প্রতিবন্ধক নেইসেই অবস্থায় যদি ঐ বস্তুটির প্রত্যক্ষ না হয়তাহলে সেই বস্তুটির অভাব সিদ্ধ হয়। আলোচ্যস্থলে প্রধানের প্রত্যক্ষযোগ্যতা নেই। প্রত্যক্ষের অযোগ্য পদার্থের প্রত্যক্ষ না হলে প্রধানের অভাব সিদ্ধ হয় না।
 .
সাংখ্যমতে প্রকৃতি হলো ত্রিগুণাত্মক অর্থাৎ ত্রিগুণস্বরূপ। সাংখ্যে গুণ শব্দের প্রসিদ্ধ অর্থ হলো সত্ত্বরজঃ ও তমঃ। সত্ত্ব হলো লঘুপ্রকাশ ও সুখশক্তিবিশিষ্ট। রজঃ হলো গুরুলঘুর সমাবেশ সাধকউপষ্টম্ভকবাধা ও বলের সমাবেশকারকচলনশীল এবং দুঃখাত্মক। তমঃ হলো গুরুআবরক অর্থাৎপ্রকাশের প্রতিবন্ধক এবং মোহস্বরূপ। গুণের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে যেএরা যথাক্রমে প্রীতি বা সুখঅপ্রীতি বা দুঃখ এবং বিষাদ বা মোহের কারণ। জগতের যেকোন পদার্থই হয় সুখনা হয় দুঃখ না হয় মোহের কারণ। সুতরাংজগৎসৃষ্টির মূল কারণ প্রকৃতিকেও সুখদুঃখমোহস্বরূপ রূপে কল্পনা করা হয়েছে।
প্রাত্যহিক জীবনে দেখা যায়কার্য কারণগুণাত্মকযেমন– কাপড় সুতোর গুণে অন্বিত। অনুরূপভাবে সুখদুঃখমোহাত্মক মহদাদি কার্যের কারণ অব্যক্ত প্রধানও সুখদুঃখমোহাত্মক হবে। সুতরাং কার্য কারণগুণাত্মক বলে অব্যক্ত প্রধানের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
 .
ন্যায় ও বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকগণ বলেনব্যক্ত থেকে ব্যক্ত উৎপন্ন হয়। পরমাণুগুলি ব্যক্ত। সেগুলি থেকে দ্ব্যণুকইত্যাদি ক্রমে স্থূল পৃথিবী ইত্যাদিরূপ কার্য ব্যক্তের উৎপত্তি হয়। পৃথিবী ইত্যাদিতে কারণের গুণানুসারে রূপ ইত্যাদিরও উৎপত্তি হয়। অতএবব্যক্ত থেকে ব্যক্ত এবং তার গুণের উৎপত্তি সম্ভব হলে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত অব্যক্ত কল্পনার প্রয়োজন কী ?
এরূপ আশঙ্কার উত্তরে প্রকৃতির অস্তিত্বসাধক যুক্তিগুলিকে ঈশ্বরকৃষ্ণ তাঁর সাংখ্যকারিকার পঞ্চদশ কারিকায় প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন
ভেদানাং পরিমাণাৎ সমন্বয়াৎ শক্তিতঃ প্রবৃত্তেশ্চ।
কারণকার্যবিভাগাদবিভাগাদ্বৈশ্বরূপ্যস্য।। (সাংখ্যকারিকা১৫)
অর্থাৎ ভেদাদি (অর্থাৎ মহদাদি ত্রয়োবিংশতি কার্যবিশেষ বা বিভিন্ন বস্তুপরিমিত বা পরিমাণবিশিষ্ট বলেবিভিন্ন কারণ ও কার্যের মধ্যে (গুণের দিক থেকেসমন্বয়ের উপস্থিতি বা সমতা থাকায়, (কারণেরশক্তি থেকে কার্যের উৎপত্তি হওয়ায়সকল উৎপন্ন বস্তুতে (সৃষ্টি কালেকারণ ও কার্যের বিভাগ থাকায় এবং (প্রলয় কালেঐরূপ বিভাগ না থাকায় সকল বস্তুর অধিষ্ঠানের প্রয়োজন হেতু অব্যক্ত প্রধান বা প্রকৃতির অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
 
উক্ত কারিকায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা প্রধানের অস্তিত্ব স্বীকারের সমর্থনে পাঁচটি হেতুর উল্লেখ করা হয়েছেযেমন– (ভেদানাং পরিমাণাৎঅর্থাৎ মহদাদি বিভিন্ন বস্তু বিভিন্ন পরিমাণবিশিষ্ট হেতু, (সমন্বয়াৎঅর্থাৎ বিভিন্ন কারণের মধ্যে সমন্বয়ের উপস্থিতি হেতু, (শক্তিতঃ প্রবৃত্তেঃঅর্থাৎ শক্তি থেকে কার্যের উৎপত্তি হেতু, (কারণকার্যবিভাগাৎঅর্থাৎ কারণ ও কার্যের বিভাগ হেতু এবং (বৈশ্বরূপ্যস্য অবিভাগাৎঅর্থাৎ উৎপত্তির পূর্বে ও প্রলয়ের পরে সকল বস্তুর অধিষ্ঠানের প্রয়োজন হেতু।
 .
সাংখ্যকারিকা গ্রন্থের টীকাগ্রন্থ সাংখ্যতত্ত্বকৌমুদীতে বাচস্পতি মিশ্র এই পাঁচটি হেতুর সাংখ্যতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন।
 .
প্রথম হেতু: (ভেদানাংপরিমাণাৎ)– সাংখ্যমতে কার্যবস্তু কারণে বিদ্যমান থাকে অথচ কারণ থেকে আবির্ভূত হয়ে ভিন্নভাবে প্রতীত হয়। কার্যের তুলনায় কারণ সূক্ষ্ম ও ব্যাপক। মহৎ থেকে শুরু করে সকল কার্যবস্তু কমবেশি ব্যক্ত ও স্থূল। বলা হয় মহৎতত্ত্ব পরিমিত। অর্থাৎমহৎতত্ত্বে পরিমাণ থাকার জন্য মহৎতত্ত্ব চরম অব্যক্ত হবে না। যে বস্তু পরিমিততার উৎপত্তি অবশ্যস্বীকার্য। সুতরাংমহৎতত্ত্বের কারণরূপে পরম অব্যক্ত অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অহংকার অপেক্ষা মহৎতত্ত্ব অব্যক্ত হলেও প্রকৃতিই পরম অব্যক্ত। এইভাবে অনুমান প্রমাণের দ্বারাই মহৎতত্ত্বের তথা মহদাদি কার্যবস্তুর কারণরূপে পরম অব্যক্ত প্রকৃতিকে স্বীকার করতে হয়।
 .
দ্বিতীয় হেতু: (সমন্বয়াৎ)– যদিও জগৎ বৈচিত্র্যপূর্ণতবুও জগতের বিচিত্র বস্তুর মধ্যে সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। সমন্বয় শব্দের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের সমানরূপতা। যথা– পৃথিবী প্রভৃতি মহাভূতগন্ধ প্রভৃতি তন্মাত্রঅহংকারমহৎ প্রভৃতি পরস্পর ভিন্ন হলেও এদের একটা সামান্যরূপ আছে। সেই সামান্য ধর্মই হলো সুখদুঃখমোহস্বরূপতা। বুদ্ধি বা মহতের লক্ষণ হলো অধ্যবসায়অহংকারের লক্ষণ হলো অভিমানতন্মাত্রের লক্ষণ হলো সূক্ষ্ম গন্ধ ইত্যাদিপৃথিবী প্রভৃতির লক্ষণ হলো স্থূলগন্ধ প্রভৃতি। প্রত্যেকটি কার্যে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ বা ধর্ম বর্তমান। এই ভিন্ন ভিন্ন ধর্মবিশিষ্ট কার্য পরম্পরার একটি সাধারণ ধর্ম আছে। বস্তুমাত্রই আমাদের মধ্যে সুখদুঃখ অথবা বিষাদ উৎপন্ন করে। তাই সেই সাধারণ ধর্মটি হলো সুখদুঃখমোহস্বরূপতা। এই সাধারণ ধর্মটি পৃথিবী প্রভৃতি প্রত্যেকটিতে থাকায় সুখদুঃখমোহস্বরূপত্ববিশিষ্ট অব্যক্তকারণ অবশ্য স্বীকার্য।
সাংখ্যমতে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে সত্ত্বরজঃ ও তমঃ– এই তিনগুণের সমন্বিত উপস্থিতিবশতই এরূপ হয়ে থাকে। জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই যদি সত্ত্বরজঃ ও তমোর সমন্বয় ঘটেতাহলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যেসত্ত্বরজঃ ও তমো গুণান্বিত কোন একটিমাত্র বিশেষ কারণ থেকে এই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। জগতের এই বিশেষ কারণকেই প্রকৃতি বলা হয়।
 .
তৃতীয় হেতু: (শক্তিতঃপ্রবৃত্তেশ্চ)– কারণের শক্তি থেকে কার্য উৎপন্ন হয়। কারণ যদি অশক্ত অর্থাৎ শক্তিহীন হয় তাহলে তার দ্বারা কার্য উৎপন্ন হয় না। যেমন– তিল থেকে তেল উৎপন্ন হয়বালি থেকে তেল উৎপন্ন হয় না। কারণ তিলে তেল উৎপাদনের শক্তি আছেবালিতে ঐ শক্তি নেই। শক্তি থাকলে কার্য হয়শক্তি না থাকলে কার্য হয় না– এরূপ অন্বয়ব্যতিরেকের দ্বারা শক্তি সিদ্ধ হয়। এই শক্তি স্বীকার না করলে কোন কার্যেরই উৎপত্তি সম্ভব নয়। এই জগতের সকল প্রবৃত্তিই শক্তির দ্বারা হয়ে থাকে। এইভাবে কারণে যে শক্তি অবশ্যস্বীকার্য হয়সেই শক্তি কোন অতিরিক্ত পদার্থ নয়কারণনিষ্ঠ ঐ শক্তি কারণে স্থিত কার্যেরই অব্যক্ত অবস্থা। অর্থাৎ এই বৈচিত্র্যময় জগৎসৃষ্টির পূর্বে নিশ্চয়ই সৃষ্টিক্ষমতাসম্পন্ন কোন এক অব্যক্ত কারণে সুপ্তাবস্থায় ছিলো। যে অব্যক্ত শক্তির এই বৈচিত্র্যময় জগতের অধিষ্ঠান হবার যোগ্যতা আছেতাই প্রকৃতি।
 .
চতুর্থ হেতু: (কারণকার্যবিভাগাৎ)– সাংখ্যমতে কারণ ও কার্যের মধ্যে একই সঙ্গে ভেদ ও অভেদ বর্তমান। স্বর্ণনির্মিত অলঙ্কার যেমন স্বর্ণ থেকে অভিন্নতেমনি আবার আকৃতিপ্রাপ্ত অলংকার হিসেবে তা উপাদান স্বর্ণ থেকে ভিন্ন। পরিণামপ্রাপ্ত জগতের সকল বিষয়ের সঙ্গে যে উপাদান কারণ একই সঙ্গে ভিন্ন ও অভিন্নরূপে বর্তমানতাই প্রকৃতি। যেহেতু কারণ থেকে কার্যের বিভাগ হয় অর্থাৎঅভিব্যক্তি হয় ও ভিন্নরূপে প্রতীতি হয়সেহেতু চরম কারণ অব্যক্ত অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। এই অব্যক্তই প্রকৃতি।
 .
পঞ্চম হেতু: (অবিভাগাৎ বৈশ্বরূপ্যস্য)– বৈশ্বরূপ্য এবং বিশ্বরূপ একই অর্থ বহন করে। বিশ্বরূপ শব্দের অর্থ কার্যসমূহ। মাটি থেকে উৎপন্ন ঘট যখন বিনষ্ট হয়তখন ঐ ঘট মাটিতে প্রবেশ করে এবং অব্যক্তাবস্থা প্রাপ্ত হয়। এই মাটি অব্যক্ত হলেও তার অব্যক্ত হওয়া আপেক্ষিক। একমাত্র প্রকৃতিই প্রকৃত অব্যক্ত। প্রকৃতি কখনো কোথাও প্রবিষ্ট বা তিরোভূত হয় না। সেই কারণে প্রকৃতি সকল কার্যের চরম অব্যক্ত। সুতরাংউৎপত্তির পূর্বে নিজের উপাদান কারণে কার্যের বিদ্যমান থাকা এবং বিনাশের পর কার্যের নিজের উপাদান কারণে লীন হওয়া– উভয়ই অব্যক্ত অবস্থা। অতএববিশ্বরূপ যে অধিষ্ঠানে প্রলয়কালে বিলীন হয় এবং যে অধিষ্ঠান থেকে বিশ্বরূপ সৃষ্টি হয়সেই অধিষ্ঠানই হলো প্রকৃতি।
 .
এভাবেই সাংখ্যদর্শনে জগৎ সৃষ্টির প্রতি উপাদানকারণরূপে প্রকৃতির অস্তিত্ব সাধিত হয়েছে।
 .
প্রকৃতির গুণত্রয়

সাংখ্য দর্শনে ব্যক্ত ও অব্যক্তকে ত্রিগুণ এবং সত্ত্বরজঃ ও তমঃ এই গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থাকে প্রকৃতি বলা হয়েছে। অর্থাৎ সত্ত্বরজঃ ও তমঃ হলো প্রকৃতির গুণত্রয়।
 .
গুণ’ শব্দটি নানা অর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ‘গুণ’ বলতে কোন দ্রব্যের বা বস্তুর ধর্মকে বোঝানো হয়। ন্যায়বৈশেষিক মতেযা দ্রব্যে সমবেত ও কর্ম থেকে ভিন্ন তাকেই গুণ বলা হয়েছে। এই মতে দ্রব্য গুণের সমবায়ী কারণ ও তার আশ্রয় বা অধিষ্ঠান। কিন্তু সাংখ্য দর্শনে ‘গুণ’ শব্দটি এই অর্থে গৃহীত হয়নি। সাংখ্যসম্মত সত্ত্বরজঃ ও তমঃ গুণ দ্রব্যের বা বস্তুর ধর্ম নয়। এগুলি দ্রব্য এবং জাগতিক যাবতীয় দ্রব্য বা বস্তুমাত্রেরই উপাদান।
সাংখ্যকারিকাকার ঈশ্বরকৃষ্ণ দ্বাদশ কারিকায় গুণত্রয়ের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেন
প্রীত্যপ্রীতিবিষাদাত্মকাঃ প্রকাশপ্রবৃত্তিনিয়মার্থাঃ।
অন্যোহন্যাভিভবাশ্রয়জননমিথুনবৃত্তশ্চ গুণাঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা১২)
অর্থাৎ সত্ত্বরজঃ ও তমঃ– এই গুণগুলি সুখদুঃখ ও মোহস্বরূপ। প্রকাশপ্রবৃত্তি ও নিয়ম তাদের অর্থ বা প্রয়োজন। পরস্পরকে অভিভূত করাপরস্পরকে আশ্রয় করাপরস্পরের সাহায্যে বৃত্তির জনক হওয়া এবং পরস্পরের নিত্যসঙ্গী হওয়া তাদের বৃত্তি।
 .
আবার কোন্ গুণ কীরূপকেনই বা এরূপ হয়এ প্রসঙ্গে ঈশ্বরকৃষ্ণ ত্রয়োদশ কারিকায় বলেন
সত্ত্বং লঘু প্রকাশকমিষ্টমুপষ্টম্ভকং চলঞ্চ রজঃ।
গুরুবরণকমেব তমঃ প্রদীপবচ্চার্থতো বৃত্তিঃ।।’– (সাংখ্যকারিকা১৩)
অর্থাৎ সত্ত্বগুণ লঘুপ্রকাশক ও ইষ্টরজোগুণ চালকআরম্ভক ও চঞ্চলএবং তমোগুণ ভারী ও আবরক। প্রয়োজন বা কার্যসিদ্ধির জন্য প্রদীপের মতো তাদের বৃত্তি বা কার্য হয়।
 .
এই কারিকা দুটিতে প্রাপ্ত ঈশ্বরকৃষ্ণের বক্তব্য থেকে গুণত্রয়ের স্বরূপপ্রয়োজন ও কার্য সম্বন্ধে জানা যায়।
 .
সত্ত্বগুণ সুখাত্মকরজঃ দুঃখাত্মক এবং তমঃ বিষাদাত্মক। সত্ত্বগুণের কার্য প্রকাশরজোগুণের কার্য প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের কার্য নিয়ম বা আবরণ। গুণ মানে পরার্থঅর্থাৎ যা অপরের অর্থ বা প্রয়োজন সাধন করে। গুণত্রয় পরস্পরবিরুদ্ধস্বভাব হলেও কার্যক্ষেত্রে পরস্পর পরস্পরের সহায়ক হয়। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে কেউ কারোর বাধক হয় না। তিনটি গুণ কখনো একই সঙ্গে উদ্বুদ্ধ বা কার্যোন্মুখ হয় না। যখন একটি গুণ উদ্বুদ্ধ হয়তখন অপর দুটি গুণ অভিভূত হয় বা তার বশ্যতা স্বীকার করে। তিনটি গুণ যদি একই সঙ্গে উদ্বুদ্ধ হতোতাহলে তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতিবন্ধক হওয়ায় কোন কার্যই উৎপন্ন হতে পারতো না।
 .
সত্ত্বগুণ লঘুস্বচ্ছ ও প্রকাশক। সত্ত্বগুণ স্বভাবত লঘু হওয়ায় তা উর্ধ্বগতিসম্পন্ন। সত্ত্বগুণ সব থেকে স্বচ্ছ হওয়ায় তাতে পুরুষের সুস্পষ্ট প্রতিবিম্বন সম্ভব হয় এবং তার দ্বারা সকল বস্তু প্রকাশিত হয়। রজোগুণ উত্তেজক এবং ক্রিয়াশীল। জাগতিক সকল বস্তুর গতিক্রিয়া ও চঞ্চলতার জন্য রজোগুণই কারণ। তমোগুণ গুরু এবং আবরক। বস্তুত তমঃ সত্ত্বগুণের প্রকাশ এবং রজোগুণের প্রবৃত্তির নিবারক। স্বচ্ছতাবশত সত্ত্বগুণকে শ্বেতবর্ণের সঙ্গেচাঞ্চল্যবশত রজোগুণকে রক্তবর্ণের সঙ্গে এবং আবরণবশত তমোগুণকে কৃষ্ণবর্ণের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
 .
উল্লেখ্যরজোগুণের প্রয়োজন প্রবৃত্তিআর সত্ত্ব ও তমোগুণ নিজেরা ক্রিয়াহীন। রজোগুণ তাদের চালনা করে অর্থাৎ অবসর থেকে মুক্ত করে তাদের নিজ নিজ কার্যে উৎসাহ সঞ্চার করে বা যতœ করে। তাই বলা হয় রজোগুণ অন্য গুণের চালক। কেন রজোগুণ এরূপ করে এর উত্তরে বলা হয়েছেরজোগুণ চল অর্থাৎ ক্রিয়াস্বভাব। ক্রিয়াস্বভাব বলে রজোগুণ সত্ত্ব ও তমোগুণকে সকল কার্যে চালনা করতে গিয়ে গুরু ও আবরক এবং প্রবৃত্তির ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী তমোগুণের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কোন কোন বিষয়ে মাত্র প্রবৃত্ত হয়সকল বিষয়ে প্রবৃত্ত হয় না। তাই সেই সেই বিষয় থেকে ব্যাবৃত্ত করে বলে অর্থাৎ কোন কোন বিষয়ে প্রবৃত্তির প্রতিবন্ধক হয় বলে তমোগুণকে নিয়ামক বা আচ্ছাদক বলা হয়।
 
জগতের কোন বস্তুই কেবল সত্ত্ববা কেবল রজঃ কিংবা কেবল তমোগুণের দ্বারা গঠিত নয়। জগতের প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই ত্রিবিধ গুণ বর্তমান। তবে কোন একটি বস্তুতে কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে সত্ত্বগুণ প্রাধান্য লাভ করেআবার কোন এক সময় রজঃ বা তমঃ গুণ প্রাধান্য লাভ করে। তৈলবর্তি এবং অগ্নি এই তিনটির কোন একটিমাত্র যেমন প্রদীপের কার্য সম্পাদন করতে পারে না অথচ এদের পারস্পরিক সহযোগিতায় যেমন প্রদীপের কার্য সম্পন্ন হয়তেমনি গুণত্রয়ের কোন একটির উদ্ভব এবং অপর দুটির অভিভববশত পরিণামী প্রকৃতির কার্য সম্পন্ন হয়।
 .
মোটকথাসাংখ্যমতে গুণগুলির প্রত্যক্ষ হয় না। সুখদুঃখ এবং মোহরূপ কার্যের দ্বারা গুণগুলির অনুমান হয়। সত্ত্ব গুণ হলো লঘু ও প্রকাশক। রজোগুণ চঞ্চল ও প্রেরণাদায়ক। আবার তমোগুণ হলো ভারী ও আবরণকারী। সুখসন্তোষ এবং প্রকাশ সত্ত্বগুণের বৈশিষ্ট্য। রজোগুণের জন্য দুঃখ এবং বিষাদ হয়। তমোগুণের আধিক্য থাকলে মোহজড়তা উদাসীনতা দেখা যায়। তিনটি গুণের মধ্যে একটি ক্রিয়া করতে আরম্ভ করলে অন্যগুলি নিষ্ক্রিয় থাকে। আবার সত্ত্বগুণ স্বয়ং নিষ্ক্রিয় হলেও রজোগুণ সত্ত্বকে ক্রিয়াশীল করে। কিন্তু তমোগুণ সত্ত্বের ক্রিয়াশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তিনটি গুণ কখনোই পরস্পরকে ছেড়ে থাকে না। এদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সহযোগিতার পারস্পরিক সহঅবস্থানই দেখা যায়।
 .
সাংখ্যমতে গুণত্রয় নিয়ত পরিণামশীল। তবে পরিণামশীল হলেও গুণত্রয় নিত্য ও সকল বস্তুর মৌলিক উপাদান বিশেষ। তারা সকল বস্তুর উৎপত্তির বা পরিণামের কারণ হলেও তাদের নিজেদের উৎপত্তি বা বিনাশ নেই।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال