উপমিতি বা উপমান প্রমাণ | ন্যায়দর্শন

উপমিতি বা উপমান প্রমাণ (Comparison)




ন্যায়দর্শনে স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে তৃতীয় প্রমাণ হলো উপমান। পূর্ব পরিচিত কোন একটি বস্তুর সঙ্গে নতুন ও অপরিচিত কোন বস্তুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করে যখন নতুন বস্তুটি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হয তখন জ্ঞান লাভের এই পদ্ধতিটিকে উপমান বলা হয়। ন্যায়মতে, উপমান হলো সেই প্রমাণ যার দ্বারা কোন ব্যক্তি প্রথমে জানে কোন একটি বিশেষ শব্দ কোন্ বস্তুকে বোঝায়। শব্দ ও শব্দার্থের জ্ঞান অন্য উপায়ের দ্বারাও হয়ে থাকে। কিন্তু ন্যায়মতে, শব্দ ও শব্দার্থের জ্ঞান কখনও কখনও উপমান বা সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারা হয়ে থাকে। তাই ন্যায়দর্শনে উপমান একটি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকৃত।
 .
অনুমানের ন্যায় ‘উপমান’ও জ্ঞান ও করণ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ‘উপ’ অর্থ সাদৃশ্য, ‘মান’ অর্থ জ্ঞান- এই ব্যুৎপত্তিগত অর্থে উপমান হলো সাদৃশ্যজ্ঞান। করণ অর্থে উপমান ‘উপমিতি’ নামক জ্ঞানের করণ। ন্যায়সূত্র-এ মহর্ষি গৌতম উপমিতির লক্ষণে বলেছেন-

‘প্রসিদ্ধ সাধর্ম্যাৎ সাধ্যসাধনম-উপমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৬)।
অর্থাৎ : কোন পদার্থে প্রসিদ্ধ পদার্থের সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ হলে কোন সাধ্য পদার্থের যে নিশ্চয়াত্মক অনুভব হয়, তাই উপমিতি এবং তার করণ হলো উপমান-প্রমাণ।
 .
গৌতম বলেন, সংজ্ঞা-সংজ্ঞিসম্বন্ধ নির্ণয়ই উপমানের ফল এবং তা অন্য কোন প্রমাণের দ্বারা জন্মে না। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে উপমিতি জ্ঞানের করণকে উপমান বলেছেন। তাই অন্নংভট্ট উপমিতির লক্ষণে বলেছেন-

‘সংজ্ঞাসংজ্ঞিসম্বন্ধ জ্ঞানম্-উপমিতিঃ। তৎ করণং সাদৃশ্যজ্ঞানম্’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : একটি শব্দ (সংজ্ঞা) এবং তার দ্বারা বোধিত বস্তু (সংজ্ঞী)- এই উভয়ের সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞান উপমিতি। সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারা উপমিতি বা উপমান প্রমাণ হয়।

 .
উপমিতি জ্ঞান সাদৃশ্য জ্ঞান থেকে হয়। কোন অজ্ঞাত পদার্থে যদি কোন জ্ঞাত পদার্থের সাদৃশ্যের জ্ঞান হয় এবং ঐ সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারা যদি ঐ অজ্ঞাত পদার্থ ও তার নামের সম্বন্ধের জ্ঞান হয়, তাহলে ঐ জ্ঞানকে উপমিতি বল হয়। যেমন ন্যায়মতে, ‘গবয়ত্ববিশিষ্ট পশুতে গো সাদৃশ্য দর্শনের দ্বারা গবয়ত্ববিশিষ্ট পশুতে গবয় শব্দের বাচ্যত্ব বোধই উপমিতি’।
যখন কোন ব্যক্তি কোন শব্দের অর্থ প্রথম জানে তখন উপমান প্রমাণের প্রয়োগ হয়। এভাবে উপমিতি জ্ঞান হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ-
 .
গবয় নামে একপ্রকার পশু আছে যাকে ‘নীলগাই’ বলে। তার গলদেশে গলকম্বল (লম্বমান চর্ম) নাই, তাই তা গো বা গরু নয়, কিন্তু গরু’র সদৃশ।
কোন নগরবাসী গবয় পদার্থ কী তা জানে না। সে কখনও গবয় প্রত্যক্ষ করেনি। অথচ ঐ নগরবাসী গবয় শব্দের সঙ্গে পরিচিত। অর্থাৎ গবয় শব্দটি সে জানে, কিন্তু তার অর্থ জানে না।
সে একজন অরণ্যবাসীর কাছে শুনলো যে, ‘গবয় গরু সদৃশ’। গরুর গলকম্বল (সাস্না) থাকে, গবয়ের তা নেই। গবয়ের অন্যান্য অংশ গরুরই মতো। ‘গবয় গরুরই মতো একপ্রকার পশু’- অরণ্যবাসীর এরূপ বাক্যকে ‘অতিদেশবাক্য’ বলা হয়।
এরপর ঐ নগরবাসী বনে গিয়ে গরুর সদৃশ একটি পশুকে প্রত্যক্ষ করলো। তখন তার ‘গবয় গরুর সদৃশ’ এই পূর্বশ্রুত অতিদেশবাক্যার্থের স্মরণ হলো। এবং তখন তার এরূপ জ্ঞান হলো যে সম্মুখস্থ পশুটি সেই বস্তু যা ‘গবয়’ শব্দের দ্বারা বোধিত হয় (‘অয়ং গবয় পদবাচ্যঃ’)। অর্থাৎ এখানে দৃষ্টপশু (সংজ্ঞী) এবং গবয় শব্দটির (সংজ্ঞা) সম্বন্ধের জ্ঞান হয়। এরূপ সংজ্ঞাসংজ্ঞিসম্বন্ধ জ্ঞানই উপমিতি।
 .
সংজ্ঞা-সংজ্ঞীর এই সম্বন্ধজ্ঞান প্রসিদ্ধ পদার্থের সাদৃশ্যদ্বারা উৎপন্ন হয়। সংজ্ঞার অর্থ হলো কোন বস্তুর বিশদ বিবরণ। সংজ্ঞা দ্বারা যে বস্তু নির্দিষ্ট হয় তাকে সংজ্ঞী বলে। যখন সংজ্ঞার সাহায্যে সংজ্ঞী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ হয় তখন সে জ্ঞানকে উপমান বলা হয়। উপমানলব্ধ জ্ঞানকে উপমিতি বলে।
.
সংজ্ঞা-সংজ্ঞীর সম্বন্ধজ্ঞান হলো নাম-নামীর সম্বন্ধজ্ঞান। কোন একটি পদার্থের সঙ্গে ঐ পদার্থের নামের যে সম্বন্ধজ্ঞান, তাকে বলে ‘নাম-নামীর সম্বন্ধজ্ঞান’। ন্যায়মতে এই সম্বন্ধজ্ঞান নানাভাবে হতে পারে। নাম-নামীর সম্বন্ধজ্ঞান ন্যায় দর্শনে প্রধানত শাব্দজ্ঞানের অন্তর্গত। কিন্তু উপমিতি এক বিশেষ ধরনের নাম-নামীর জ্ঞান। এরূপ জ্ঞান কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে শ্রুত সাদৃশ্যজ্ঞানের স্মরণ ও ব্যক্তির (জ্ঞাতার) পদার্থের প্রত্যক্ষের মাধ্যমে উদ্ভূত।
 .
ন্যায়মতে উপমিতি সর্বদা সাদৃশ্য জ্ঞানের দ্বারাই হয় না, কখনও কখনও উপমিতি অসাধারণ ধর্মের জ্ঞান থেকেও হয়। অর্থাৎ, প্রসিদ্ধ পদার্থের সাধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমে যেমন উপমিতি হয়, তেমনি প্রসিদ্ধ পদার্থের বৈধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমেও উপমিতি হয়। আবার পদার্থের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দর্শনের মাধ্যমেও উপমিতি হয়। এজন্য উপমিতিকে সাধর্ম্য, বৈধর্ম্য ও ধর্মমাত্র ভেদে ত্রিবিধ বলা হয়েছে।
 .
সাধর্ম্য উপমিতি : প্রসিদ্ধ পদার্থের সাদৃশ্য বা সাধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমে যে উপমিতি জ্ঞান হয়, তাই সাধর্ম্য উপমিতি। যেমন-  উপরিউক্ত গোসদৃশ কোন অ-পূর্বদৃষ্ট পশুকে দেখে ‘গবয়’ পদবাচ্যের উপমিতি জ্ঞান।
 .
বৈধর্ম্য উপমিতি : প্রসিদ্ধ পদার্থের বৈসাদৃশ্য বা বৈধর্ম্য দর্শনের মাধ্যমে যে উপমিতি জ্ঞান হয়, তাই বৈধর্ম্য উপমিতি। যেমন- ‘অশ্বের ক্ষুর গরুর ক্ষুরের মতো দ্বিধাবিভক্ত নয়’- গরু ও অশ্বের ক্ষুরাকৃতির এই বৈধর্ম্যের অতিদেশবাক্য (অভিজ্ঞ ব্যক্তির যথার্থ বাক্য) শ্রবণের পর অশ্বক্ষুরে গো-ক্ষুরের বৈধর্ম্যজন্য অশ্ব ও গরুর বৈধর্ম্য-উপমিতি হয়।
 .
ধর্মমাত্র উপমিতি : প্রসিদ্ধ পদার্থের উপমানে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দর্শনের মাধ্যমে যে উপমিতি জ্ঞান হয়, তাই ধর্মমাত্র উপমিতি। যেমন- ‘নাসিকার উপরিভাগ একটি শৃঙ্গ বিশিষ্ট এরূপ জন্তু গণ্ডার’- এই অতিদেশবাক্য শুনে কোন ব্যক্তি ঐরূপ জন্তু প্রত্যক্ষ করার পর উক্ত অতিদেশবাক্যার্থের স্মরণ হলে তার ‘এটি গণ্ডার পদবাচ্য’ এরূপ জ্ঞান হয়। এই জ্ঞানই ধর্মমাত্র উপমিতি জ্ঞান।
 .
নৈয়ায়িকরা উপমানকে জ্ঞান লাভের একটি স্বতন্ত্র উপায় হিসেবে স্বীকৃতি দেন। কিন্তু ভারতীয় অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উপমান প্রমাণ বিষয়ে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। উপমানের সাহায্যে শব্দের বাচ্যার্থ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভ করা যায় না বলে চার্বাক সম্প্রদায় উপমানকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেন না। বৌদ্ধ দর্শনেও উপমান স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকৃত নয়। বৌদ্ধ দার্শনিকেরা উপমানকে প্রত্যক্ষ ও অনুমানের সংযুক্ত ফল বলে মনে করেন। জৈন দার্শনিকেরা উপমানকে প্রত্যভিজ্ঞা’র অন্তর্গত করেন। বৈশেষিক এবং সাংখ্য দার্শনিকেরা উপমানকে অনুমানেরই একটি বিশেষ রূপ বলে ব্যাখ্যা করেন। তবে মীমাংসা এবং বেদান্ত দর্শনে উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে স্বীকার করা হয়, কিন্তু তাদের ব্যাখ্যার সাথে ন্যায়দর্শনের উপমানের ব্যাখ্যার অমিল উল্লেখযোগ্য। মীমাংসকদের উপমিতির আকার হলো- ‘পূর্বদৃষ্ট ও বর্তমানে স্মৃত গরু বর্তমানে দৃষ্ট গবয়ের মতো’, আর নৈয়ায়িকদের উপমিতির আকার হলো- ‘বর্তমানে দৃষ্ট গবয় পূর্বদৃষ্ট ও বর্তমানে স্মৃত গরুর মতো’।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال