স্বভাববাদ খণ্ডন-প্রচেষ্টা

স্বভাববাদ খণ্ডন-প্রচেষ্টা


স্বভাববাদ খণ্ডন-প্রচেষ্টা
স্বভাববাদ বিরোধীরা বলেন, দুটি ঘটনার একাধিক ক্ষেত্রে ক্রমিক সংঘটনের ব্যাপারে বিশ্লেষণ করলে উভয় ঘটনার আশ্রয় বস্তুগুরির অন্তর্নিহিত সামান্য ধর্মে অধিকাংশ সময়েই কার্যকারণভাবের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়। অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তিজ্ঞানের জনক হিসেবে এই কার্যকারণভাবের উল্লেখ করা যেতে পারে।
কিন্তু কার্যকারণভাবে অবিশ্বাসী চার্বাকেরা মনে করেন যে দুটি ঘটনার একত্র যোগাযোগ নেহাতই অহেতুক এবং এ থেকে ভবিষ্যতেও অতীতের এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনুমান করা যায় না। কারণ, অতীতে দৃষ্ট হয়নি এবং সেইজন্য আমাদের কল্পনাতেও আসেনি এমন অনেক বিষয়ের উপস্থিতিতে হয়তো ভবিষ্যতে ঘটনাগুলির ক্রমিকতা নষ্ট হতে পারে।

অনেক সময় ঐশ্বর্যপ্রাপ্তি বা রোগনিবৃত্তির জন্য রত্নধারণ, মন্ত্রপ্রয়োগ বা ঔষধ ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। এতে অভীষ্টসিদ্ধি না হলে কেউ কি তা ব্যবহার করতো? কিন্তু চার্বাকদের মতে, কার্যকারণবাদীদের উপস্থাপিত এই দৃষ্টান্ত ত্রুটিপূর্ণ। কেননা, এ সবের মাধ্যমে অভীষ্টসিদ্ধি কোন কোন ক্ষেত্রে হলেও চার্বাকদের মতে এগুলির ব্যবহার এবং ফলপ্রাপ্তি, উভয়ের মধ্যে কার্যকারণ কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, অনেক সময় মণি, মন্ত্র বা ঔষধ প্রয়োগেও ফল পাওয়া যায় না। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলির ব্যবহার ছাড়াই উদ্দেশ্যসিদ্ধি হয়। ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-তে মাধবাচার্যের চার্বাকমত বর্ণনায় মণি, মন্ত্র বা ঔষদের প্রয়োগ এবং সেই প্রয়োগের ফলে আংশিক ক্ষেত্রে লব্ধ ফল– উভয়ের পরস্পর সম্বন্ধ চার্বাকী পরিভাষায় ‘যাদৃচ্ছিক’ আখ্যা পেয়েছে। যেমন–
‘ক্বচিৎ ফল-প্রতিলম্ভস্তু মণি-মন্ত্রৌষধাদিবদ্ যাদৃচ্ছিকঃ। অতঃ তৎ-সাধ্যম্ অদৃষ্টাদিকমপি নাস্তি।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : কখনো কোন স্থলে ফল প্রাপ্তি (বিষয় প্রাপ্তি) কিন্তু মণি, মন্ত্র ও ঔষধাদির ন্যায় যাদৃচ্ছিক। অতএব অনুমান সাধ্য অদৃষ্ট (পাপ ও পুণ্য) প্রভৃতিও নেই।


তার মানে, চার্বাক মত অনুসারে জগতের অন্য যে সমস্ত ঘটনাকে আপাতঃ দৃষ্টিতে কার্যকারণঘটিত বলে মনে হয়, অনুরূপ বিচারে সেগুলিও ‘যাদৃচ্ছিক’ প্রতিপন্ন হয়। তবে চার্বাকদের অভিমতে অগ্নির উষ্ণতা, জলের শৈত্য ইত্যাদি যেমন স্বাভাবিক এবং এই ধরনের কয়েকটি বিশেষ বস্তুর বিশেষ কোন গুণের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মূলে কোন বস্তু বা ঘটনাকে যেমন কারণ হিসেবে নির্দেশ করা চলে না, সেইরকম জগতের বিভিন্ন ঘটনাবলী, মানুষের সুখ-দুঃখ, উত্থান-পতন ইত্যাদিও স্বাভাবিকভাবেই হয়। ‘অদৃষ্ট’ ‘ধর্ম-অধর্ম’ ইত্যাদিকে জগতের বৈচিত্র্যের কারণ হিসেবে স্বীকার করার পক্ষে কোন যৌক্তিকতা নেই। এই স্বভাববাদ অনুসারে, শিখিপুচ্ছে নানা রঙের বৈচিত্র্য বা কোকিলের কণ্ঠে মধুর স্বরের সমাবেশ স্বাভাবিক যে নিয়মে হয়, মানুষের সুখ-দুঃখেও সেই নিয়মেরই প্রভাব দৃষ্ট হয়। এসবের কারণ হিসেবে ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদির কল্পনা অসঙ্গত। এই মতের সমর্থন শঙ্করের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকী প্রামাণিক লোকগাথার দৃষ্টান্তে ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি। এয়াড়াও ‘সর্বসিদ্ধান্তগ্রন্থে’ অন্য আরো প্রামাণিক লোকগাথা অনুযায়ী দেখা যায়, ‘অদৃষ্ট’ স্বীকারে চার্বাকদের আপত্তি; কারণ দৃষ্টিসীমার বহির্ভূত হওয়ার ফলে প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ‘অদৃষ্ট’ বিচারযোগ্য নয়। অদৃষ্টবাদীদের দ্বারাও অদৃষ্ট কখনও দৃষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, আরো বলা হয়, বিশেষ কোন স্থানে বা কোন সময়ে দৃষ্ট হলেও এর অদৃষ্ট নামের সার্থকতা থাকে না। নিত্য অদৃষ্ট কোন বস্তুর সত্তাকে যদি আমরা অনুমোদন করি তাহলে ‘শশশৃঙ্গ’ বা অনুরূপ অসম্ভব পদার্থের অস্তিত্বকেও আমাদের স্বীকৃতি দিতে হয়। যেমন–
‘প্রত্যক্ষগম্যমেবাস্তি নাস্ত্যদৃষ্টমদৃষ্টতঃ।
অদৃষ্টবাদিভিশ্চাপি নাদৃষ্টং দৃষ্টমুচ্যতে।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।
‘ক্বাপি দৃষ্টমদৃষ্টঞ্চেদদৃষ্টং ব্র“বতে কথম্ ।
নিত্যাদৃষ্টং কথং সৎ স্যাৎ শশশৃঙ্গাদিভিঃ সমম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।
অর্থাৎ :
লোকায়তিকেরা বলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে– এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।  যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে? (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।

আমরা আগেই দেখেছি যে ‘অদৃষ্ট’ ‘ধর্ম-অধর্ম’ ইত্যাদি ধারণা ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনের অনুমোদিত কর্মফলবাদের আবশ্যিক অঙ্গ। কাজেই এই ধারণাগুলির বিরোধিতার মাধ্যমে কর্মফলবাদও যে প্রকারান্তরে অস্বীকৃতি লাভ করে তা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু অধ্যাত্মবাদীরা স্বভাববাদকে এতো সহজে ছেড়ে দিতে রাজী নন। নৈয়ায়িকদেরকেও এই চার্বাকী ধারণার সমালোচনায় যথেষ্ট তৎপর হতে দেখা যায়। যেমন ‘ন্যায়সূত্রে’ পূর্বপক্ষীয় যুক্তিতে বলা হয়েছে–
‘অনিমিত্ততো ভাবোৎপত্তিঃ কণ্টকতৈক্ষ্ণ্যাদিদর্শনাৎ’। (ন্যায়সূত্র-৪/১/২২)
অর্থাৎ : (পূর্বপক্ষীয় যুক্তিতে) ভাববস্তুগুলির [অর্থাৎ, পৃথিবীতে বর্তমান বস্তুগুলির] নিমিত্তকারণ [অর্থাৎ, কর্তা অর্থে কারণ] নেই; কেননা কণ্টকের তৈক্ষ্ণ্য দর্শন [থেকেই তা বোঝা যায়]।

স্বভাববাদের প্রসিদ্ধ নজির ‘কণ্টকের তীক্ষ্ণতা’ থেকে বোঝাই যায়, এটা স্বভাববাদী চার্বাকী যুক্তি। যাঁর মতে উপাদান-কারণের ‘স্বভাব’ থেকেই সমস্ত জাগতিক বস্তুর উৎপত্তি। ন্যায়সূত্রকার এই যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে আরো দুটি সূত্র রচনা করে একটি ‘প্রকরণ’– অর্থাৎ, সহজ কথায়, একটা আলোচনার স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিচয়– সম্পন্ন করেছেন। বাকি সূত্র দুটির তর্জমা হলো–
‘নিমিত্ত অন্য, নিমিত্তের প্রত্যাখ্যান অন্য; কিন্তু তাই বলেই নিমিত্ত প্রত্যাখ্যান হয় না।’ (ন্যায়সূত্র-৪/১/২৩)।।
‘[পূর্বসূত্রের এই যুক্তি] অসিদ্ধ; কেননা নিমিত্ত এবং অনিমিত্ত-র অর্থ সম্পূর্ণই আলাদা।’ (ন্যায়সূত্র-৪/১/২৪)।।

তার মানে কি ‘নিমিত্তকারণের অভাব’ স্বীকারও এক অর্থে তাকেই নিমিত্তকারণের স্থান দেওয়া? সূত্রগুলি এমনই সাঁটে লেখা যে আলোচনার প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা সহজসাধ্য অবশ্যই নয়। তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, তর্কটা জগতে বিদ্যমান বস্তুর বা ভাবপদার্থের ‘নিমিত্তকারণ’ নিয়ে। ‘নিমিত্তকারণ’ মানে কী? সোজা কথায় বললে, উপাদান-অতিরিক্ত কর্তাকে নিমিত্তকারণ বলে। যেমন ঘটের উপাদান মৃত্তিকা; কিন্তু শুধু মৃত্তিকা থাকলেই তো ঘট হয় না; তাছাড়াও কুম্ভকার বলে কারণ মানতে হবে। এই দৃষ্টান্তে কুম্ভকারই ঘটের নিমিত্তকারণ।
তাহলে, দেবীপ্রসাদের মতে, ‘ন্যায়সূত্র’র এই তিনটি সূত্রে আসল তর্কটা জাগতিক বস্তুগুলির কোনো নিমিত্তকারণ আছে কিনা– তাই নিয়ে। এগুলির উপাদান-কারণ তো সুবিদিত : ভারতীয় দর্শনে আগুন-বাতাস-জল-মাটি– এই চতুর্ভূত, কিন্তু অনেক সময় তার সঙ্গে ‘আকাশ’ ধরে পঞ্চভূতকে জগতের উপাদান-কারণ বলে স্বীকার করা হয়। অন্তত নৈয়ায়িকরা তা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এছাড়াও জাগতিক বস্তুর নিমিত্তকারণ হিসেবে স্বীকার করতে হবে, শুধু চতুর্ভূত বা পঞ্চভূতের ‘স্বভাব’ থেকেই সমস্ত জাগতিক বস্তুর উৎপত্তি। অতএব আসল তর্ক হলো : স্বভাববাদ-বনাম-নিমিত্তকারণবাদ নিয়ে– যে নিমিত্তকারণ বলতে ঈশ্বর, অদৃষ্ট, প্রভৃতির উল্লেখ করা হয়।

ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন এই সূত্রগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। প্রথমোক্ত ন্যায়সূত্রে ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন স্বভাববাদের অনুরূপ যে চিন্তাধারার উল্লেখ পান জাগতিক ঘটনাসমূহের মূলে নিমিত্তের অবদান তাতে স্বীকৃত নয়। এই মতবাদ অনুসারে প্রকৃতির বিভিন্ন অভিব্যক্তি, যথা কণ্টকের তীক্ষ্ণতা, রঙের বৈচিত্র্য ইত্যাদি যেমন নিজেকে প্রকাশ করতে কারণের অপেক্ষা রাখে না, সেই রকম বিভিন্ন উপাদানের সমবায়ে গঠিত মানুষের দেহ প্রভৃতি বস্তু নিমিত্ত কারণ ব্যতিরেকেই স্বরূপে পরিণতি লাভ করে।
এই মতের আলোচনা প্রসঙ্গে ভাষ্যকার মন্তব্য করেন যে–
‘যতশ্চোৎপদ্যতে তন্নির্মিত্তম। অনিমিত্তস্য নিমিত্তত্বান্নার্নিমিত্তো ভাবোৎপত্তিরিতি’। (ন্যায়ভাষ্য-৪/১/২৩)
অর্থাৎ :
ভাবোৎপত্তির নিমিত্ত হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে অনিমিত্তকে; ফলে নিমিত্তকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে স্বভাববাদীরা অগ্রসর হয়েছেন নিমিত্তেরই সাহায্য নিয়ে, যদিও এই নিমিত্ত হিসেবে তাঁরা অনিমিত্তকে ব্যবহার করেছেন।


তার মানে, ন্যায়ভাষ্যকার বলতে চান, স্বভাববাদীরা এক্ষেত্রে যে ধারণাকে অস্বীকার করতে প্রবৃত্ত সেই বিশেষ ধারণাই এখানে তাঁদের অবলম্বন। তাঁদের এ ধরনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

অন্যদিকে আরেক নৈয়ায়িক উদ্যোতকর তাঁর ‘ন্যায়বার্তিক’ গ্রন্থে স্বভাববাদের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেন– ‘নিমিত্তের অভাব কণ্টকাদি বিশেষ কয়েকটি বস্তুর ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য, না প্রতিটি বস্তুর ব্যাপারে এর প্রয়োগ স্বীকার্য? যদি কয়েকটি মাত্র বস্তুকে অনিমিত্ত মনে করা হয়, তাহলে অবশিষ্ট সব দ্রব্যের নিমিত্তমূলকতা প্রমাণিত হয়। অপর পক্ষে, প্রত্যেক বস্তু অনিমিত্ত– এ ধরনের স্বীকৃতিতে স্ববিরোধ দোষের প্রসঙ্গ এসে পড়ে। কারণ, স্বভাববাদের প্রচারকের এ-ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য অপরের মনে একটি বিশেষ ধারণা উৎপাদন করা। স্বভাববাদের সমর্থনে উৎপন্ন ধারণা নিমিত্তকে কেন্দ্র করেই সম্পাদিত। ফলে স্বভাববাদ এখানে ব্যাহত এবং কার্যের নিমিত্তমূলকতা শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য। কয়েকটি অংশের সমবায়ে গঠিত হবার ফলে কণ্টক প্রভৃতি দ্রব্য স্বরূপে পরিণতির জন্য কারণের অপেক্ষা রাখে– চার্বাক মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে ন্যায়বার্তিককার এই সিদ্ধান্তের অনুকূলে মন্তব্য প্রকাশ করেন।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৫)

প্রকৃতপক্ষে, কার্যের উৎপত্তি বা ঘটনার সংঘটনের মূলে কারণের অস্তিত্বকে স্বীকার না করলে বিশেষ এক সময়ে কোন কার্য বা ঘটনা কেন উৎপন্ন বা সংঘটিত হয়, সব সময়ে হয় না– এ প্রশ্নের সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। স্বভাববাদের এই মূলগত ত্রুটি স্বভাববাদ বিরোধীদের অস্ত্র হিসাবে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। এই মতবাদের আলোচনার সময় উদয়ন (ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-১/৫) বলেন যে কার্যের উৎপাদন কারণের উপর নির্ভরশীল হলে তবেই তার বিশেষ কোন সময়ে আবির্ভাবের যৌক্তিকতা থাকে এবং এই জন্যই কার্যের উৎপত্তির মূলে কারণকে অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ ও তার টীকাকে অনুসরণ করে এ সম্বন্ধে আরও বলা যায়– স্বভাব শব্দের অর্থ প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য কার্যের কিংবা কারণের। প্রথম সম্ভাবনায় উৎপত্তির পূর্বে কার্যের এবং সেই সঙ্গে তার বৈশিষ্ট্যেরও অস্তিত্ব না থাকায় স্বভাবের মাধ্যমে কার্যের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে না। স্বভাবকে যদি কারণের অস্তিত্ব বলে ধরে নেওয়া হয় তাহলে স্বভাববাদের সমর্থকেরা প্রকারান্তরে কারণবাদকেই স্বীকৃতি দেন এবং স্বভাববাদের কোন স্বাধীন সত্তা থাকে না।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৬)

এই ধরনের দার্শনিক কূট-যুক্তি ও তর্কের সমাহার আমরা ইতঃপূর্বে অন্যক্ষেত্রেও দেখেছি। অধ্যাত্মবাদের সমর্থকরা যে ভূতবাদের মতোই স্বভাববাদকেও কখনোই মেনে নিতে প্রস্তুত নন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু স্বভাববাদের দৃষ্টিকোণ থেকেই একটা খটকা থেকে যায়। স্বভাববাদীরাও কি সব-অর্থে ‘নিমিত্তকারণ’ অস্বীকার করে পার পাবেন? ঈশ্বর, অদৃষ্ট প্রভৃতি আধ্যাত্মিক অর্থে ‘নিমিত্তকারণ’ বলে কিছু না মানলেও সাধারণভাবে ও সর্বত্র ‘নিমিত্তকারণ’-মাত্রই অস্বীকার করা অসম্ভব; চার্বাক যদি তা করে থাকেন তাহলে সেটা তাঁর দার্শনিক দুর্বলতারই পরিচায়ক হবে বলে দেবীপ্রসাদ প্রমুখ আধুনিককালের বিদ্বানদের অভিমত। মৃত্তিকাই ঘটের কারণ; কিন্তু এই কারণ বলতে ঐকান্তিক অর্থে ‘নিমিত্তকারণে’র নিষেধ করে শুধুমাত্র ‘স্বভাব’ মানাই পর্যাপ্ত হবে না। কেননা, নিছক স্বভাব ছাড়া নিমিত্তকারণ হিসেবে সবকিছু প্রত্যাখ্যান করলে তা মাটি থাকলেই ঘট হবার কথা। কিন্তু তা হয় না। নিমিত্তকারণ হিসেবে কুম্ভকারও মানতেই হবে। তন্তুর নিছক স্বভাবকেই বস্ত্রের পর্যাপ্ত কারণ বলা যায় না। কেননা সুতো থাকলেই কাপড় হয় না; সুতো থেকে কাপড় বোনবার জন্যে তাঁতী বলে নিমিত্তকারণও মানা দরকার। তবুও অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে এই নিমিত্তকারণও স্বভাব-নিরপেক্ষ নয়; পক্ষান্তরে স্বভাব-সাপেক্ষই। তা নাহলে তো মাটি থেকেই তাঁতী কাপড় বুনতে পারতো বা সুতো থেকেই কুমোর ঘট গড়তে পারতো।

চার্বাক প্রসঙ্গে আমাদের যেটুকু তথ্যের সম্বল তা থেকে অনুমানের সুযোগ নেই যে, এ-হেন পার্থিব অর্থে নিমিত্তকারণ বলে চার্বাক কিছু স্বীকার করতেন। যদি না করে থাকেন তাহলে তা প্রাচীন বস্তুবাদের একটা উল্লেখযোগ্য দুর্বলতারই পরিচায়ক হবে। আমরা বরং স্বভাববাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটির দিকে আলোকপাত করতে পারি। তিনি বলছেন–
সাধারণত, স্বভাব শব্দের ইংরেজি করা হয় ‘নেচার’। যে-কোনো জাগতিক ঘটনার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যায় তার জাগতিক কারণটুকুই পর্যাপ্ত। তার জন্যে অতি-প্রাকৃত বা প্রকৃতি-বহির্ভূত আর কিছু মানবার প্রশ্ন ওঠে না। ঈশ্বর নয়, অতীত কর্মের ফল হিসেবে ধর্মাধর্ম (বা পারিভাষিক অর্থে ‘অদৃষ্ট’)– এসব কিছুই নয়। আরো একটু ব্যাখ্যা করে বলবার সুযোগ দিলে হয়তো দাবি করা যেতে পারে যে, স্বভাব বলতে আমাদের প্রাচীন বস্তুবাদীরা ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বা অন্তত তারই খুব কাছাকাছি একটি ধারণা অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতিবিজ্ঞানে আজকাল আমরা যাকে বলি ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বা ‘ল অব নেচার’। অবশ্যই সুপ্রাচীন কালের দার্শনিকদের কাছে থেকে এই ধারণার আধুনিক অর্থে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় প্রত্যাশা করা ঐতিহাসিকভাবে অবাস্তব হবে। কিন্তু এই ধারণারই প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস স্বভাববাদের মধ্যে খোঁজবার চেষ্টা অত্যুক্তি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রাচীন ধ্যানধারণার মধ্যে আধুনিক– এবং অনেক সময় অতি-আধুনিক– বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনুসন্ধান অবশ্যই অচল। কখনো বা তার ফলে রকমারি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।… কিন্তু… প্রাচীন কালের চিন্তার মধ্যেও সেখানে যতটুকু বিজ্ঞান-চেতনার প্রতিশ্রুতি ছিল সেটুকুকেও সম্পূর্ণ তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। স্বভাববাদের মধ্যে প্রাকৃতিক নিয়ম বা ‘ল অব্ নেচার’ একেবারে আধুনিক অর্থে অবশ্যই প্রত্যাশিত নয়; কিন্তু তারই যতটুকু প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস স্বভাববাদের মধ্যে অনুমিত হয় তাও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা কোনো কাজের কথা নয়। বরং একরকম যেন পাল্টা ভুল। একটা ভুল– এবং তা যত বড় ভুলই হোক-না-কেন– সংশোধন করার জন্য পাল্টা-ভুলের পথ ধরা যুক্তিযুক্ত নয়। স্বভাববাদের বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা একেবারে অস্বীকার করা এই রকম একটা পাল্টা-ভুল বলেই মনে হয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১৩-৪)

.
সে যাক্, তারপরেও ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে ‘স্বভাববাদ’ নিয়ে– ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃতই হোক– একধরনের বিভ্রান্তির প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। যেমন মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-এর উৎস নির্দেশ করে লতিকা চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন–
চার্বাক মত অনুসারে জগতের অন্য যে সমস্ত ঘটনাকে আপাতঃ দৃষ্টিতে কার্যকারণঘটিত বলে মনে হয়, অনুরূপ বিচারে সেগুলিও ‘যাদৃচ্ছিক’ প্রতিপন্ন হয়। চার্বাকদের অনুসৃত এই দৃষ্টিভঙ্গীরই পরিপ্রেক্ষিতে চার্বাক দর্শনের অপর সংজ্ঞা ‘যাদৃচ্ছিকবাদ’ বা ‘স্বভাববাদ’।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৪)

সুস্পষ্টভাবেই, এই মন্তব্যে, ‘যাদৃচ্ছিকবাদ’ ও ‘স্বভাববাদ’কে অনুরূপ বা অভিন্ন মত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সত্যি কি এই দুটি মত এক ও অভিন্ন? এ-বিষয়টিও নিশ্চয়ই আলোচনার দাবি রাখে। এবং বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার নজির হিসেবেও আলোচনাটি অবান্তর হবে না বলেই মনে হয়।

.
। স্বভাব ও যদৃচ্ছা।
শ্রদ্ধেয় দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-১১৪) স্বভাববাদীদের মধ্যে দুটি সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব স্বীকার করেন– (১) যাঁরা স্বভাবকে কারণের স্বীকৃতি দেন এবং (২) যাঁরা কার্যকারণবাদের বিরোধী এবং মনে করেন যে জগতের সবকিছু ঘটনাই অহেতুক। দ্বিতীয় দলের স্বভাববাদীদের যাদৃচ্ছিক বলা হয়।
শাস্ত্রী মহাশয় অবশ্য স্বভাববাদীদের মতদ্বৈধ অনুযায়ী চার্বাকগোষ্ঠির মধ্যেও দুটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। যদিও এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে তিনি কোন তথ্য সরবরাহ করেন না।

সম্ভবত, শাস্ত্রী মহাশয় এখানে ‘যাদৃচ্ছিকবাদ’কে ‘স্বভাববাদ’ থেকে বিযুক্ত না করে তারই অংশ-বিশেষ বা ভিন্ন বিভাগ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। সেকালের মতো একালের কোনো কোনো লেখকও বোধহয় ‘স্বভাববাদ’-কে– কিছুটা খেলো করবার উৎসাহেই কিনা কে-জানে– ‘যদৃচ্ছাবাদ’ বলে আর একটা প্রাচীন মতের সঙ্গে তার তাদাত্ম্য দেখাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ, এঁদের বিচারে ‘স্বভাববাদ’-ও যা, ‘যদৃচ্ছাবাদ’-ও তাই। যদৃচ্ছাবাদের মূল কথা কিন্তু কার্যকারণবাদ সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক ঘটনাবলী নেহাতই অহেতুক, অকারণ; অঘটনের সামিল। যদি সত্যিই তাই হয়, দেবীপ্রসাদের মতে, তাহলে প্রাকৃতিক ঘটনার কোনো কারণ খুঁজতে যাওয়া বেকুবির পরিচায়ক হবে। অর্থাৎ, যদৃচ্ছাবাদ সম্পূর্ণ অর্থে বিজ্ঞান-বিরোধী, কেননা বিজ্ঞানের একটা মূল উদ্দেশ্যই হলো, প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ অনুসন্ধান। নিউটন যদি ভাবতেন, ফলটা মাটির দিকে অকারণেই বা এমনিই পড়েছে– তাহলে আর এ নিয়ে তাঁর কোনো জিজ্ঞাসা জাগতো না। বিজ্ঞানও হতো না।

কিন্তু, এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ বলেন, স্বভাববাদকে এইভাবে ‘যদৃচ্ছাবাদে’র সঙ্গে অভিন্ন মনে করার পিছনে না আছে কোনো যুক্তি, না কোনো নির্ভরযোগ্য বা প্রামাণ্য তথ্য। ইতঃপূর্বে বর্তমান প্রসঙ্গে উদ্ধৃত ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর দৃষ্টান্ত থেকেও দেখা যায় যে, উপনিষদ্কার ‘স্বভাববাদ’ ও ‘যদৃচ্ছাবাদ’– এই দুটি মতকে সম্পূর্ণ পৃথক অর্থেই উল্লেখ করেছেন। তুলনায় পরবর্তীকালের নানা দার্শনিকও তাই-ই করেছেন। এঁদের প্রত্যেকের প্রতিটি উক্তি হয়তো এখানে উদ্ধৃত করার সুযোগ নেই, দরকারও নেই। বর্তমান আলোচনার পক্ষে পর্যাপ্ত বিবেচনায় শুধু একটি নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে। স্বভাববাদের সঙ্গে যদৃচ্ছাবাদের মূল পার্থক্য দেখাবার উদ্দেশ্যে জৈন দার্শনিক গুণরত্ন যদৃচ্ছাবাদের খুবই প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কিছুটা স্বাধীন তর্জমায় তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম উদ্ধৃত করা যেতে পারে। গুণরত্ন বলছেন,–
‘যদৃচ্ছা বলতে বোঝায় কোনো রকম পূর্ব-পরিস্থিতি ছাড়াই ঘটনার ব্যাখ্যাপ্রয়াস। প্রশ্ন ওঠে : এ হেন মতবাদের সমর্থক বলতে কে বা কারা? উত্তর : কার্যকারণবাদকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে যাঁরা সব কিছুকেই একেবারে অকারণ বলে মনে করেন, তাঁরা। তাঁদের মূল যুক্তি হলো, কার্যকারণবাদ মানবার কোনো প্রশ্ন ওঠে না, কেননা তার পক্ষে কোনোরকম প্রমাণ নেই। যেমন, পদ্মবনেও শালুকফুল ফোটে, গোবরের গাদাতেও ফোটে। কিংবা, একটা অগ্নিকুণ্ড থেকে যেমন কোনো কিছুতে আগুন ধরানো যায়, তেমনি চকমকি পাথর ঠুকেও তা সম্ভব হয়। কিংবা, কলাগাছের গুঁড়ি থেকে নতুন কলাগাছ জন্মাতে পারে, আবার বীজ পুঁতেও কলাগাছ ফলানো সম্ভব। ধোঁয়ো থেকেও ধূম উৎপন্ন হয়, কাঠে অগ্নিসংযোগের ফলেও হয়। অতএব, কার্যকারণ বলে সম্বন্ধের কথাটা অলীক। মানতেই হবে, প্রাকৃতিক ঘটনাবলী নিছক অকারণ বা অহেতুক। প্রকৃত বিদ্বানেরা তাই তথাকথিত কার্যকারণ সম্বন্ধের দৃষ্টান্তগুলিকে কাকতালীয়র মতোই বিবেচনা করেন; অর্থাৎ কাক উঠে গেল, আর এদিকে গাছ থেকে তাল পড়ল, দুটো ঘটনার মধ্যে আসলে কোনো রকম সম্বন্ধ না-থাকলেও একটিকে অপরটির কারণ বলে কল্পনা করার সামিল।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১৫)

তাহলে প্রশ্ন, আগুন কেন উষ্ণ? যদৃচ্ছাবাদী বলবেন, ব্যাপারটা নেহাতই অহেতুক; এর কোনো কারণ খোঁজাই বেকুবি। কাঁটা কেন তীক্ষ্ণ? তারও কোনো কারণ নেই। কারণ খুঁজতে যাওয়াই বেকুবি। তাই দেবীপ্রসাদ বলেন, এ-হেন মত মানলে আর-যাই-হোক, প্রকৃতি-বিজ্ঞান বলে কিছুই হতে পারে না। স্বভাববাদও নয়। কেননা, স্বভাববাদের মূল কথা হলো, প্রতিটি ঘটনারই পর্যাপ্ত কারণ থাকতে বাধ্য; কিন্তু সেই কারণের সন্ধানে প্রাকৃতিক বিষয় ছেড়ে অতি-প্রাকৃত বা প্রকৃতির অতীত কিছু খুঁজতে যাওয়া সম্পূর্ণ নিরর্থক। প্রাকৃতিক নিয়ম থেকেই প্রাকৃতিক ঘটনার পর্যাপ্ত কারণ পাওয়ার কথা।

দুটি মতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নিয়ে আমাদের বর্তমান আলোচনা পল্লবিত করার প্রয়োজন হবে না। একালের অগ্রণী বিদ্বান গবেষকেরা তা করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করাই বর্তমান উদ্দেশ্যের পক্ষে পর্যাপ্ত হবে বলে বিশ্বাস। অবশ্যই দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কিছুটা ব্যাখ্যামূলক স্বাধীন তর্জমায়। ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক্যের আলোচনা প্রসঙ্গে হিরিয়ান্না (Hiriyanna) মন্তব্য করেছেন–
‘কিন্তু এখানে তার মধ্যে দুটির (অর্থাৎ দুটি নাস্তিক্যমতের) পার্থক্য করা ভালো; কেননা ভারতীয় দর্শনের কয়েকটি বিষয় প্রসঙ্গে পরবর্তী আলোচনায় তা কাজে লাগবে। তার মধ্যে একটি হলো ‘আপতনবাদ’ (accidentalism), দার্শনিক পরিভাষায় ‘যদৃচ্ছাবাদ’ বা ‘অনিমিত্তবাদ’। অপরটি হলো ‘প্রকৃতি-সর্বস্ববাদ’ (naturalism) বা ‘স্বভাববাদ’। ‘শ্বেতাশ্বতর’ উপনিষদ্-এ দুটি স্বতন্ত্রভাবে উল্লিখিত হয়েছে, এবং পরবর্তী দার্শনিক গ্রন্থেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য স্বীকৃত (যেমন ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’-১/৫)। প্রথমটি অনুসারে বিশ্বপ্রকৃতি বিশৃঙ্খলার রাজ্য, তার মধ্যে যেটুকুবা নিয়মানুবর্তিতার পরিচয় পাওয়া যায় তা নেহাতই আকস্মিক ঘটনামাত্র। দ্বিতীয় মতে বিশ্বপ্রকৃতি স্বীয়স্বভাব-নিয়ন্ত্রিত (‘মহাভারত’-১২/২২২/২৭ : ‘স্বভাব-ভাবিনো ভাবান্’)। প্রথমটি কার্যকারণ-সম্বন্ধ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। দ্বিতীয়টি কার্যকারণভাবকে বিশ্বজনীন নিয়ম বলে মানে; কিন্তু এই মতে সমস্ত পরিবর্তন যে-বস্তুতে পরিদৃষ্ট হয় তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রতি বস্তুই অনুপম; এবং তার পুরো ইতিহাসটাই এই অনুপমতার দ্বারা পূর্বনিয়ন্ত্রিত। অতএব স্বভাববাদ অনুসারে যে-জগতে আমাদের বাস সেই জগৎ মোটেই নিয়মহীন নয়; কেবল সেই নিয়মের নিয়ন্তা বলতে প্রকৃতিবাহ্য কিছু কল্পনা করা চলবে না। জগৎ আত্ম-নিয়ন্ত্রিত; অনিয়ন্ত্রিত নয়। অতএব অন্য মতটির সঙ্গে এই মতের পার্থক্য হলো, এই মতে যাবতীয় ঘটনা অমোঘ নিয়মের অনুবর্তী; কিন্তু এই অমোঘ নিয়ম বস্তুস্বরূপেরই অন্তর্ভুক্ত– বাহ্য কোনো কর্তার আয়ত্তাধীন নয়। এ-বিষয়ে আমরা অন্ধ বলেই কল্পনা করি যে, প্রকৃতিতে নিয়ম বলে কিছু নেই বা আমরা স্বেচ্ছায় যা-খুশি করতে পারি। উভয় মতের মধ্যে মিল শুধু এইটুকুই যে উভয়ই জগৎনিয়ন্তা কোনো ঐশ্বরিক শক্তি অস্বীকার করে। তাছাড়া, দুটি মতের কোনোটিই শাস্ত্রবচন বা ঈশ্বর-আস্নাত বলে আত্মপক্ষ সমর্থন করে না। [ হিরিয়ান্না অবশ্য এখানে খানিকটা হাল্কাভাবেই চার্বাকমতের পিছনে যদৃচ্ছাবাদের প্রভাব কল্পনা করেছেন; কিন্তু আমরা ইতিপূর্বে সে-জাতীয় কল্পনা বর্জনের যুক্তি দেখিয়েছি। যাই হোক, তিনি আর যদৃচ্ছাবাদ নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেননি; পরন্তু একটু পরেই তিনি স্বভাববাদের সঙ্গেই লোকায়ত-মতের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। ]
‘এককালে স্বভাববাদ নিশ্চয়ই যথেষ্ট প্রচলিত ছিল, কেননা শঙ্কর (‘ব্রহ্মসূত্র-ভাষ্য’-১/১/২) প্রভৃতি পুরোনো কালের দার্শনিকদের রচনায় আমরা তার উল্লেখ পাই। ‘মহাভারত’-এর নানা প্রসঙ্গে মতটির পরিচয় আছে (মহাভারত-১২/১৭৯/২২২ ও ২২৪)। মতটি প্রসঙ্গে প্রথম লক্ষণীয় বিষয় হলো তার বস্তুতান্ত্রিকতা (positivistic character)। ‘অদৃষ্টবাদ’-এর বা প্রকৃতি-অতীত বিশ্বাসের সঙ্গে স্বভাববাদের যে রকম বিরোধ সেই রকমই বিরোধ ‘উপনিষদ্’-এর অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে। মনে হয় ‘লোকায়ত’ (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহলোক সংক্রান্ত দর্শন) বলতে আদিতে স্বভাববাদের এই বস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই বোঝাতো, যদিও পরবর্তী সাহিত্যে লোকায়ত শব্দটিই সাধারণভাবে প্রচলিত। মতটির আর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলতে দেহান্তরগামী আত্মার অস্বীকৃতি, যদিও অবশ্য এমন কথা অনুমানের সুযোগ আছে যে যতদিন দেহে প্রাণ বর্তমান ততদিন পর্যন্ত কোনো এক অর্থে আত্মার বর্তমানতা স্বীকার করায় স্বভাববাদের পক্ষে হয়তো বাধা ছিল না। কিন্তু মতটির সঙ্গে প্রধান বিরোধ বলতে অধ্যাত্মবাদেরই, কেননা অধ্যাত্মবাদের মূল কথাই হলো ভূত-অতিরিক্ত আত্মায় বিশ্বাস। যে-সব তথ্যের উপর নির্ভর করে আমাদের এই আলোচনা তার মধ্যে ‘মহাভারত’-এর একটি উক্তি হলো, ‘মৃত্যুতেই জীবের পরম পরিসমাপ্তি’। আসলে, স্বভাববাদের বিশেষ প্রবণতা বলতে প্রকৃতি-অতীত বস্তু অস্বীকারই। এইভাবে স্থায়ী আত্মা অস্বীকার করার ফলে সাধারণত কর্মফল বলতে যা বোঝায় তাও স্বভাববাদে অস্বীকৃত। বস্তুজগতের মূল উপাদান এক বা একাধিক– এবিষয়ে স্বভাববাদীর মত সম্বন্ধে আমাদের পক্ষে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়, কেননা মহাকাব্যে দু-রকম মতেরই ইংগিত পাওয়া যায়। যেমন, মহাকাব্যের এক জায়গায় উক্ত হয়েছে জীবদেহ অবশ্যই পঞ্চভূতের পরিণাম; অন্যত্র মোটের উপর একই কথা– স্বভাববাদীর মতে পঞ্চভূতই পরম সত্য। কিন্তু আবার প্রসঙ্গান্তরে উক্ত হয়েছে স্বভাববাদ অনুসারে জগৎ বৈচিত্র্যের মূলে একই বস্তু।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১৬-৭)

প্রাচীন সাহিত্যে বিবিধ প্রসঙ্গে ছড়ানো স্বভাববাদ-সংক্রান্ত নানা মন্তব্যে নানা রকম ঝোঁক থাকার ফলে আমাদের কাছে আজ মতবাদটি প্রসঙ্গে অল্পবিস্তর অস্পষ্টতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবুও কিন্তু, দেবীপ্রসাদের মতে, দুটি কথা জোর দিয়ে বলার সুযোগ আছে।–
এক।। প্রাচীন লোকায়ত ও চার্বাকমতে জগৎ-বৈচিত্র্যের কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা খোঁজা নিষ্ফল, কেননা স্বভাববাদের মধ্যেই তার পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অবশ্য ভারতীয় দর্শনে লোকায়ত ছাড়া আর কোনো দর্শনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বভাববাদ স্বীকৃত কিনা– এ প্রশ্ন স্বতন্ত্র।
দুই।। মতটি খুব প্রাচীন বলেই ভারতীয় দর্শনে এ সম্বন্ধে যে সব কথা পাওয়া যায় তারই উপর নির্ভর করে আধুনিক কোনো মতের সঙ্গে তার তুলনা হয়তো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। কিন্তু অত্যুক্তির আশঙ্কা এড়িয়েও বোধহয় দাবি করা যেতে পারে যে আধুনিক প্রকৃতি-বিজ্ঞানে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’ বলতে যা বোঝায় স্বভাববাদের মধ্যেই তার অন্তত প্রতিশ্রুতি বা পূর্বাভাস খোঁজা নিষ্ফল নয়।

এ-ব্যাপারে সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই যে ভারতীয় দর্শনে অন্যতম প্রাচীন মত হিসেবে ‘স্বভাববাদ’ অবশ্যই চার্বাক-সম্মত। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে, ভারতীয় দর্শনে লোকায়ত ছাড়া আর কোনো দর্শনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই স্বভাববাদ স্বীকৃত কিনা?
এক্ষেত্রে কিছু কিছু প্রাচীন সাহিত্যের দৃষ্টান্ত নজরে আসলে খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই কিছু কৌতুহল জেগে উঠে অবশ্যই। যেমন, দেবীপ্রসাদ দেখাচ্ছেন, ‘মহাভারত’-এর ব্যাখ্যায় (শান্তিপর্ব-২৩২/২১) নীলকণ্ঠ বলছেন–
‘স্বভাব ইতি পরিণামবাদিনাং সাংখ্যানাম্’। (মহাভারত-১২/২৩২/২১)
অর্থাৎ : পরিণামবাদী সাংখ্যমতে ‘স্বভাব’ স্বীকৃত।
আবার ‘সাংখ্যকারিকা’র ভাষ্যে গৌড়পাদও মন্তব্য করেছেন–
‘সাংখ্যানাং স্বভাবো নাম কশ্চিৎ কারণমস্তি’। (সাংখ্যকারিকাভাষ্য)
অর্থাৎ : সাংখ্যদর্শনের অনুগামীদের মতে ‘স্বভাব’ নামের একরকম কারণ আছে।


এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন– ‘হয়তো এজাতীয় নজিরের উপর নির্ভর করেই টি. ই. হিউম (T. E. Hume) ‘শ্বেতাশ্বতর-উপনিষদ্’-এর তর্জমা প্রসঙ্গে স্বভাববাদকে সাংখ্যবাদীর মত বলে গ্রহণ করেছেন। তাঁর সমর্থনে শঙ্করাচার্যের উক্তি অনায়াসে উদ্ধৃত করা যায়। সাংখ্য-খণ্ডনে তিনি বারবার মতটিতে স্বভাববাদের উপর নির্ভরতা প্রদর্শন করেছেন।
এজাতীয় নজিরগুলির গুরুত্ব স্বীকার করলে অনুমানের সুযোগ থাকে, পরবর্তীকালে সাংখ্যদর্শনে ‘প্রকৃতি’ বা ‘প্রধান’ হিসেবে উল্লিখিত আদিম অচেতন কারণটির সঙ্গে ‘পুরুষ’ নামে এক চেতন তত্ত্ব সংযোজিত হলেও দর্শনটির আদিরূপে হয়তো তা ছিল না : অচেতন প্রধান থেকে স্বভাবের নিয়ম অনুসারেই জগৎ-উৎপত্তি। এই কারণেই কি পরবর্তী সাংখ্যে ‘পুরুষ’ সংযোজিত হলেও তা ‘উদাসীন এবং অপ্রধানে’র চেয়ে বেশি মর্যাদা পাননি? যদি তাইই হয়, তাহলে সুখলালজী এবং সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর ব্যাখ্যা অনুসরণ করে আদি-সাংখ্যকেও কোনো একরকম প্রাচীন বস্তুবাদ বলে অনুমান করার সুযোগ আরো জোরদার হয়। জৈন দার্শনিক শীলাঙ্ক তো সরাসরি এই কথাই বলেছেন। সেদিক থেকে আরো বলা যেতে পারে, বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে চার্বাক বা লোকায়ত একান্তই নিঃসঙ্গ নয়। সম্ভাবনাটি নিয়ে বিদ্বানেরা আশা করি আরো গভীর বিবেচনা করতে সম্মত হবেন। প্রথাবিরুদ্ধ হলেও এবং প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী হলেও আদিসাংখ্য নিয়ে গবেষণার সুযোগটাই অস্বীকার করা মুক্ত মনের পরিচায়ক হবে না, বিশেষত ভারতীয় ঐতিহ্যেই যখন একথা স্বীকৃত যে সাংখ্যর আদিরূপ অনেকাংশেই বিলুপ্ত হয়েছে এবং তার ‘কণামাত্র’ আজ অবশিষ্ট।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১২০)

উল্লেখ্য, সাংখ্য-প্রবচন বা সাংখ্য-সূত্রের ভাষ্যের ভূমিকায় স্বয়ং বিজ্ঞানভিক্ষু বলেছিলেন–
‘কালার্কভক্ষিতং সাংখ্যশাস্ত্রং জ্ঞান-সুধাকরম্ ।
কলাবশিষ্টং ভূয়োহপি পুরয়িষ্যে বচোহমৃতৈঃ।।’- (সাংখ্যাপ্রবচনভাষ্য)
অর্থাৎ : সাংখ্যশাস্ত্র কালসূর্যের গ্রাসে পতিত হয়েছে এবং তার কণামাত্রই অবশিষ্ট আছে; আমি অমৃতবাক্যের দ্বারা তা পূরণ করবো।

অনুমান করা হয়, বিজ্ঞানভিক্ষু যে-ভাবে তা পূরণ করেছিলেন ‘তার ফলে এ-দর্শন আর যাই হোক সাংখ্য-দর্শন থাকেনি– বেদান্তমতে বা অন্তত প্রায়-বেদান্তমতে পরিণত হয়েছিলো। কেননা, নিরীশ্বর সাংখ্যকে সেশ্বর দর্শনে পরিণত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি; শেষ পর্যন্ত তিনি বেদান্তের সঙ্গে সাংখ্যের প্রায় সমস্ত মৌলিক প্রভেদই উড়িয়ে দেবার আয়োজন করেছিলেন।’- (ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ, পৃষ্ঠা-২৩)। সম্ভবত পরবর্তীকালের অনুসারীদের মধ্যেও এই প্রবণতা অব্যাহত ছিলো।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال