প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ

 প্রত্যক্ষ-প্রাধান্যবাদ


প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ।
চার্বাক দর্শন সম্বন্ধীয় বিভিন্ন গ্রন্থে বিশেষত দর্শনের সঙ্কলন গ্রন্থগুলিতে চার্বাক নামের সঙ্গে প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদিতা অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। যেমন কৃষ্ণমিশ্র রচিত একাদশ শতকের রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ বলা হয়েছে–
‘লোকায়তমেব শাস্ত্রং যত্র প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্…বাচস্পতিনা প্রণীয় চার্বাকায় সমর্পিতম্।
তেন চ শিষ্যপ্রশিষ্যদ্বারেনাস্মিল্লোকে বহুলীকৃতং তন্ত্রম্’। -(প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৪)।
অর্থাৎ : লোকায়তশাস্ত্রমতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। …বাচস্পতি বা বৃহস্পতি প্রণীত এই লোকায়ত শাস্ত্রমতটিকে চার্বাক শিষ্য-প্রশিষ্যের মাধ্যমে চতুর্দিকে প্রচার করেন। (মুক্ত তর্জমা)।

বেদান্ত অনুসারী সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক দর্শনের বর্ণনায় বলা হয়েছে–
‘প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদিতয়া অনুমানাদেরনঙ্গীকারেণ প্রামাণ্যাভাবাৎ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিত্ব হেতু অর্থাৎ একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলেন বলে, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ অস্বীকার করেন বলে দেহাতিরিক্ত আত্মাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নয়।

‘অদৃষ্ট’ স্বীকারে চার্বাকদের আপত্তি; কারণ দৃষ্টিসীমার বহির্ভূত হওয়ার ফলে প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ‘অদৃষ্ট’ বিচারযোগ্য নয়। অদৃষ্টবাদীদের দ্বারাও অদৃষ্ট কখনও দৃষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায় না। তাছাড়া, বিশেষ কোন স্থানে বা কোন সময়ে দৃষ্ট হলেও এর অদৃষ্ট নামের সার্থকতা থাকে না। নিত্য অদৃষ্ট কোন বস্তুর সত্তাকে যদি আমরা অনুমোদন করি তাহলে ‘শশশৃঙ্গ’ বা অনুরূপ অসম্ভব পদার্থের অস্তিত্বকেও আমাদের স্বীকৃতি দিতে হয়। চার্বাকী বা লোকায়তিক এই মতবাদই বর্ণিত হয়েছে অদ্বৈতবেদান্তের প্রবর্তক শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে–
‘প্রত্যক্ষগম্যমেবাস্তি নাস্ত্যদৃষ্টমদৃষ্টতঃ।
অদৃষ্টবাদিভিশ্চাপি নাদৃষ্টং দৃষ্টমুচ্যতে।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।
‘ক্বাপি দৃষ্টমদৃষ্টঞ্চেদদৃষ্টং ব্রুবতে কথম্ ।
নিত্যাদৃষ্টং কথং সৎ স্যাৎ শশশৃঙ্গাদিভিঃ সমম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।
অর্থাৎ :
লোকায়তিকেরা বলেন, যা কিছু প্রত্যক্ষসিদ্ধ তা-ই আছে। অদৃষ্ট যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু অদৃষ্ট বলে কিছু নেই। অদৃষ্ট দৃষ্ট হয়ে থাকে– এমন কথা অদৃষ্টবাদিগণও বলেন না। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/২)।।  যদি অদৃষ্ট কোথাও দেখে থাকো, তবে সেই দৃষ্ট বস্তুকে অদৃষ্ট কেন বলো? আবার শশশৃঙ্গাদির ন্যায় নিত্যই যা অদৃষ্ট, তা কিভাবে সৎ হতে পারে? (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৩)।।

নৈয়ায়িক জয়ন্ত ভট্ট ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের এক জায়গায় প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে চার্বাকের বর্ণনায় বলছেন–
তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী-১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।
‘সর্বমতসংগ্রহ’ গ্রন্থেও চার্বাকদেরকে বলা হয়েছে–
‘প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিনো’। (সর্বমতসংগ্রহ)
অর্থাৎ : কেবল প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী।

বলা যায়, ভারতীয় গোটা দর্শন সাহিত্যেই চার্বাকের প্রধান পরিচিতি প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে। তবে কি অন্যান্য দর্শনগুলি প্রত্যক্ষকে স্বীকার করেন না? অবশ্যই করেন। প্রমাণসমূহের অন্যতম হিসেবে ভারতীয় দর্শনে প্রত্যক্ষের স্বীকৃতির উল্লেখ আছে সবকটি দর্শন-মতেই, ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে তার উল্লেখ আমরা আগেই করেছি।
লৌকিক মতে প্রত্যক্ষ চাক্ষুষ জ্ঞানের দ্যোতক। কিন্তু দার্শনিক পরিভাষায় এর অর্থ পৃথক। আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয়ের পর্যায়ে সাধারণত পাঁচটি ইন্দ্রিয় অন্তর্ভুক্ত। এগুলির কোনও একটির সাহায্যেই প্রত্যক্ষজ্ঞানের উদ্ভব হতে পারে। চক্ষু এই জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির অন্যতম হলেও কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক– এই চারটি ইন্দ্রিয়ের ভূমিকাও প্রত্যক্ষজ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোন অংশে কম নয়। এই ইন্দ্রিয় পাঁচটির প্রত্যেকটিই নিজ নিজ বিভাগে জ্ঞান আহরণের বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। কোন বস্তু যখন বিশেষ কোন জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে আসে তখন ইন্দ্রিয়টির প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আমরা বস্তুটি সম্বন্ধে বিশেষ ধরনের জ্ঞান লাভ করি। যেমন একটি ফুল সম্বন্ধীয় প্রত্যক্ষজ জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে চক্ষু, নাসিকা এবং ত্বকেরই কেবল কার্যকারিতা দেখা যায়, অন্য ইন্দ্রিয়ের নয়। চোখ দিয়ে আমরা ফুলটিকে দেখি; নাকের সাহায্যে গন্ধ উপভোগ করি এবং ত্বক দিয়ে ফুলটিকে স্পর্শ করি। আবার গান শোনা বা সুখাদ্য ভোজন ইত্যাদি ব্যাপারে যথাক্রমে কর্ণ এবং জিহ্বার বৈশিষ্ট্য কাজ করে, অন্য ইন্দ্রিয় নয়। মনের ভূমিকা কোন কোন ক্ষেত্রে বাহ্য বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের মাধ্যম হিসেবে, আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র এক ইন্দ্রিয় রূপে। জ্ঞানেন্দ্রিয় হিসেবে মন আন্তর প্রত্যক্ষের কারণ হয়, অন্য ইন্দ্রিয়গুলির বা বাহ্য বস্তুনিচয়ের যেখানে কোন কার্যকরিতা নেই।

প্রমাণগুলির মধ্যে একমাত্র এই প্রত্যক্ষের সঙ্গেই যাঁরা চার্বাকের যোগ স্বীকার করেন তাঁদের মতে চার্বাকের জ্ঞানের রাজ্যে সঞ্চয় এই ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারপথেই কেবল হওয়া সম্ভব। জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরির ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে লোকায়ত প্রসঙ্গে এ-ধরনের উক্তিই দেখা যায়–
‘লোকায়তা বদন্ত্যেবং নাস্তি দেবো ন নির্বৃতিঃ।
ধর্মাধর্মৌন বিদ্যেতে ন ফলং পুণ্যপাপয়োঃ।।
এতাবানেব লোকোহয়ং যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮১)
অর্থাৎ : লোকায়তরা বলেন, দেবতা বলে কিছু নেই, মোক্ষ বলেও নয়। ধর্ম ও অধর্ম বলে কিছু হয় না, পুণ্য ও পাপের ফল বলেও নয়। যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক (অতএব সত্য)।

তার মানে, ষড়্দর্শনসমুচ্চয়ের বক্তব্য হলো, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যতটুকু জানা সম্ভব চার্বাকের জগৎ তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এভাবে বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’-তেও অনুরূপ একটি লোকায়ত বচনের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, যেমন–
‘এতবানেব পুরুষো যাবানিন্দ্রিয়গোচরঃ’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা)
অর্থাৎ : যতটুকু ইন্দ্রিয়গোচর ততটুকুই ইহলোক।

চার্বাক দর্শন সম্বন্ধে চার্বাকেতর দার্শনিকদের সাধারণ মনোভাব এই ধারণারই অনুগামী বলে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে চার্বাকের পরিচিতিও সেই ধারণারই অনুসরণে গড়ে উঠেছে বা তৈরি করা হয়েছে। ইন্দ্রিয়গুলির দ্বারপথে মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডারে একমাত্র বস্তুজগতের মালমসলাই সঞ্চিত হয়। প্রত্যক্ষকে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম করার জন্য এই উপাদানের অতিরিক্ত অন্য কিছু চার্বাকের জ্ঞানের রাজ্যে তার সঞ্চয় রাখতে পারে না, ফলে স্থূল বস্তুজগৎকে কেন্দ্র করেই রূপায়িত হয়ে ওঠে চার্বাকের সম্পূর্ণ নিজস্ব বস্তুবাদী সিদ্ধান্ত।
কিন্তু সাধারণভাবে এই রূপে চার্বাকের পরিচিতি তৈরি করা হলেও ভারতীয় সাহিত্যের অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে চার্বাকের সামগ্রিক রূপের প্রতিফলন এখানে হয়নি এবং কেবল প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবেও চার্বাককে সব ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা যায় না। ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে চার্বাক সম্প্রদায়ের শ্রেণীভেদ প্রসঙ্গে চার্বাকগোষ্ঠির মধ্যে বৈতণ্ডিক, ধূর্ত, সুশিক্ষিত ইত্যাদি একাধিক মতবাদের প্রচলনের উল্লেখ করা হয়েছে এবং চার্বাক সিদ্ধান্তের সামগ্রিক রূপের বিচারের জন্য এগুলির আলোচনা সহ বিভিন্ন দার্শনিকগোষ্ঠির মনোভাব বিশ্লেষণও  আবশ্যক বলেই মনে হয়।

.
চার্বাক প্রসঙ্গে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টর বক্তব্য এবং তত্ত্বোপপ্লবসিংহ :
যদিও চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তভট্টর প্রকৃত বক্তব্য নির্ণয় করার বেশ সমস্যা রয়েছে, তবু এ প্রসঙ্গে চার্বাক সম্বন্ধে ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে জয়ন্তভট্টর মন্তব্য উল্লেখ্য। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী হিসেবে চার্বাক গোষ্ঠিকে সাধারণভাবে বিশেষিত করে ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের এক জায়গায় সরাসরি বলেছেন–
তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।

শুধু এটুকু বললে সিদ্ধান্ত করা যেতো যে, তাঁর দৃষ্টিতে চার্বাকমতে প্রত্যক্ষাতিরিক্ত অনুমান বলে কোনো প্রমাণ সম্ভব নয়। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে, এই ‘ন্যায়মঞ্জরী’রই অন্যত্র তিনি ভিন্ন ধরনের অপর এক মতবাদকে চার্বাক নামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন এবং এই মতবাদের সমর্থক চার্বাকেরা তাঁর ভাষায় ‘ধূর্ত’ সংজ্ঞায় চিহ্নিত। যেমন–
‘চার্বাকধূর্তঃ তু অথ অতঃ তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ ইতি প্রতিজ্ঞায় প্রমাণ-প্রমেয়-সংখ্যা-লক্ষণ-নিয়ম-অশক্য-করণীয়ত্বম্ এব তত্ত্বং ব্যাখ্যাতবান্’। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৫৯)।
অর্থাৎ : ধূর্ত চার্বাক কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো– এবার আমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো; কিন্তু ‘তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো’ বলে চার্বাক আসলে দেখাতে চাইলো যে প্রমাণ ও প্রমেয়র সংখ্যা ও লক্ষণ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই সম্ভব নয়।

জয়ন্তের বর্ণনায়, এই শ্রেণীর চার্বাকদের মতে প্রমাণ এবং প্রমেয়ের সংখ্যা এবং লক্ষণের নিয়ম করা সম্ভব নয়। সংখ্যা এবং লক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়মের অনৈক্যই এঁদের পরিভাষায় ‘তত্ত্ব’ আখ্যা পেয়েছে এবং এই অর্থানুসারী তত্ত্বের ব্যাখ্যাকে আশ্রয় করে এঁরা এমন অনেক প্রমিতির উদাহরণ দিয়েছেন যাদের উদ্ভব প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের মাধ্যমে হয় না। সহজভাবে বললে, এই শ্রেণীর চার্বাকদের মতে কোন রকম প্রমাণেরই লক্ষণ নির্ণয় করা সম্ভব নয়, মানে কোন রকম প্রমাণই সম্ভব নয়– ফলে প্রত্যক্ষও সংশয়াতীত নয়। তার মানে, এই মতটি যে অবশ্যই প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী চার্বাকদের মতাদর্শ নয়, এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আবার এই একই ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেই জয়ন্ত ভট্ট আবার ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকদের সম্পর্কেও বলেন–
অশক্য এব প্রমাণসংখ্যানিয়ম ইতি সুশিক্ষিত চার্বাকাঃ। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৩৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়।

.
এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ইতঃপূর্বে উল্লেখকৃত মন্তব্যটি পুনরায় প্রণিধানযোগ্য–
জয়ন্তর স্বীয় সম্প্রদায়ের– অর্থাৎ ন্যায় সম্প্রদায়ের– দাবি এই যে প্রমাণ আসলে চার রকম। অতএব স্বমত সমর্থনে যে-দার্শনিকেরা প্রমাণের সংখ্যা চারের চেয়ে বেশি বলে মনে করেন, জয়ন্তর পক্ষে তাঁদের মত খণ্ডনের প্রয়োজন বোধ করার কথা। কিন্তু কারা চারের চেয়ে বেশি প্রমাণ মানেন? জয়ন্ত বলছেন : প্রভাকর-পন্থী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ পাঁচ রকমের; কুমারিলভট্টর অনুগামী মীমাংসকরা বলেন, প্রমাণ ছয় রকমের; কেউ-কেউ আবার বলেন, প্রমাণ আট রকমের; কিন্তু ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’রা বলেন, প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। কথাটার তাৎপর্য কি এই যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, নাকি, প্রমাণ বলেই কিছু নেই? -(ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।

মোটকথা, জয়ন্তভট্ট বর্ণিত চার্বাক-গোষ্ঠির সম্পূর্ণ চিত্রায়ণ কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ এ প্রসঙ্গে চার্বাক পক্ষের নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপিত করতে পারে এমন রচনার প্রকৃত অভাব। এ-প্রেক্ষিতে ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আলোচিত জয়রাশি ভট্টর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ নামের গ্রন্থটির উল্লেখ করা যেতে পারে। তার মধ্যেই জয়ন্ত বর্ণিত ধূর্ত চার্বাকদের ছবি আবিষ্কার করা হয়তো সম্ভব হতে পারে। প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণের মর্যাদা দান সম্বন্ধে চার্বাক প্রসঙ্গে সাধারণ যে ধারণার প্রচলন করা হয়েছে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র সাক্ষ্য তারও পরিপন্থী। এই গ্রন্থের গ্রন্থকার জয়রাশি ভট্ট অন্য প্রমাণের সঙ্গে প্রত্যক্ষকেও প্রমাণের আসর থেকে বহিষ্কার করতে আগ্রহী এবং প্রত্যক্ষোপার্জিত বস্তুজগতের বিষয়গুলিও তাঁর কাছে প্রমেয়ের মর্যাদা লাভে বঞ্চিত। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ বিচারে আমরা যাকে ‘তত্ত্ব’ বলি বিভিন্ন প্রমাণগ্রাহ্য সেই তত্ত্বের অস্তিত্বকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলেছেন–
‘পৃথিব্যাদীনি তত্ত্বানি লোকে প্রসিদ্ধানি, তান্যপি বিচার্যমানানি ন ব্যবতিষ্ঠন্তে, কিং পুনরন্যানি’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১)।
অর্থাৎ : সাধারণ লোকে যে পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ এই পঞ্চভূতকে তত্ত্ব বলে স্বীকার করেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করলে দেখা যায় যে এরকম কোন প্রমেয় তত্ত্বেরই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। (মুক্ততর্জমা)

নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় জয়রাশি যে তত্ত্বকে উপজীব্য করেন, প্রমাণের সংখ্যা এবং লক্ষণসম্বন্ধীয় নিয়মের অনৈক্যের সঙ্গে তা একার্থক। বাস্তবিকপক্ষে জাগতিক বস্তুনিচয়ের সত্যাসত্য নির্ণয় করার মান, আমরা যেভাবেই ঠিক করি না কেন– কোন সময়েই তা ত্রুটিমুক্ত হতে পারে না, এটা প্রদর্শন করাই তত্ত্বোপপ্লববাদীর উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য জয়রাশি তর্কের বিভিন্ন কলাকৌশল উদ্ভাবন করে একই সঙ্গে ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখার সিদ্ধান্তে ত্রুটি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র মতে–
‘কথং কথং তানি ন সন্তি? তদুচ্যতে সল্লক্ষণনিবন্ধনং মানব্যবস্থানং, মাননিবন্ধনা চ মেয়স্থিতিঃ, তদভাবে ন তথা সদ্ব্যবহারবিষয়ত্বং কথং…’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১)
অর্থাৎ : প্রমাণের অস্তিত্ব সৎ লক্ষণের উপর নির্ভরশীল, আবার এই প্রমাণের মাধ্যমেই প্রমেয় বস্তুবিষয়ের ব্যবস্থাপনা। প্রমাণের লক্ষণে যদি ত্রুটি থাকে, তাহলে তাকে কখনই সৎ বলা চলে না এবং এই ত্রুটিপূর্ণ লক্ষণযুক্ত প্রমাণের অস্তিত্বও স্বীকৃত হতে পারে না। প্রমাণ অস্বীকৃত হলে প্রমাণের মাধ্যমে আমরা প্রমেয় যে বস্তু বা বিষয়ের ধারণা করি সেগুলিকেও অগ্রাহ্য করতে হয়।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, প্রমাণসম্বন্ধীয় নিয়মের বিরোধিতা প্রকৃতপক্ষে চার্বাকদের প্রগতিবাদী মনোভাবের ঐক্য সূচক, যা দার্শনিক মতবাদ ছাড়াও আমাদের আচরণ বিধির প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ম-বন্ধনকে শিথিল করার প্রয়াসে তৎপর। আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি যে সুকঠোর বিধিনিয়মের ভারে ভারাক্রান্ত বৈদিক আচারের প্রভাব থেকে মুক্তির প্রচেষ্টার মধ্যেই চার্বাকী চিন্তার প্রথম উন্মেষ। আবির্ভাবের প্রাথমিক মুহূর্তে যে প্রগতিবাদী দৃষ্টি চার্বাকী মনে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করেছিলো, উত্তর যুগের চার্বাকী চিন্তাতেও সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব লক্ষণীয়।
এরই ধারাবাহিকতায় ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন বিভাগে প্রমাণের সংখ্যা এবং লক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়ম প্রসঙ্গে যে সূক্ষ্ম মতভেদ, চার্বাকী সমালোচনা তার মূলে আঘাত করেছে। এ-ব্যাপারে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র গ্রন্থকার জয়রাশি ভট্টকেও কেউ কেউ হয়তো নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের অনুসরণ করে চার্বাকগোষ্ঠির অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করতে চেয়েছেন। শ্রদ্ধেয় লতিকা চট্টোপাধ্যায়ও এ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন কিনা তা অস্পষ্ট। যদিও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বিদ্বজ্জনদের মধ্যেই জয়রাশি ভট্টকে চার্বাকগোষ্ঠির অন্তর্ভুক্তিকরণে তীব্র মতভেদ রয়েছে। সে যাক্, তবে জয়রাশির সঙ্গে ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে ধূর্ত সংজ্ঞায় অভিহিত চার্বাকগোষ্ঠির সম্পূর্ণ ঐকমত্য রয়েছে বলেই মনে হয়।

এ-প্রেক্ষিতে লতিকা চট্টোপাধ্যায় বলেন–
সংখ্যা ও লক্ষণের নিয়মে প্রমাণের শ্রেণীবিভাগে ব্রতী দার্শনিকদের বিরুদ্ধে চার্বাকদের যে ধরনের প্রতিবাদ ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে দেখা যায় তারই অনুরূপ প্রতিবাদে সোচ্চার চার্বাক জয়রাশি বৈয়াকরণকৃত শব্দের লক্ষণগত নিয়মের বিপক্ষে, তাঁর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে। বৈয়াকরণেরা প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের দুর্লঙ্ঘ্য বন্ধনে শব্দকে আবদ্ধ রেখেছেন। ব্যাকরণের সূত্রগুলি তাঁদের মতে লক্ষণের পর্যায়ভুক্ত। এবং এই লক্ষণান্বিত শব্দসমূহকে তাঁরা ‘সাধু’ আখ্যায় ভূষিত করেন। এইভাবে সাধুত্বের ছাড়পত্র লাভে যে শব্দগুলি সক্ষম, একমাত্র সেগুলিই তাঁদের নির্দেশে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত।
চার্বাক জয়রাশির সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণা প্রসারিত হয়েছে বৈয়াকরণ নির্দেশিত বিশেষ লক্ষণযুক্ত সাধু শব্দের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ব্যাপারে। বৈয়াকরণদের মতে বিশেষ লক্ষণ দ্বারা যেগুলি নির্দেশিত হয় না, সেগুলি অসাধু শব্দ এবং এই অসাধু শব্দের প্রয়োগকে তাঁরা অনুমোদন করেন না। জয়রাশি অসাধু শব্দের প্রয়োগের ফলে সম্ভাব্য কয়েকটি দোষের উল্লেখ করে যুক্তির মাধ্যমে সব কটি দোষেরই অবাস্তবতা প্রতিপাদন করেছেন। আর উপসংহারে সাধু শব্দের সঙ্গে অসাধু শব্দেরও সমান সার্থকতা সম্বন্ধে নিজস্ব মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭০)

কিন্তু এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’ জয়রাশি অবলম্বিত প্রতিপক্ষ খণ্ডন পদ্ধতি কিরূপ? এ সম্বন্ধে একান্ত আগ্রহী পাঠকের ধারণা লাভের ব্যাপারে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে বর্ণিত প্রত্যক্ষ প্রমাণসম্বন্ধীয় প্রারম্ভিক আলোচনার কিছুটা আলোকপাত করতে পারে। এ-বিষয়ে লতিকা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৭০-৭২) ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র প্রতিপক্ষ খণ্ডন পদ্ধতি সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত করেছেন। আমরা এ-ক্ষেত্রে সংক্ষেপে তাঁর আলোচনা-রীতিই অনুসরণ করতে পারি।

আমরা জানি যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ন্যায়দর্শনেই প্রমাণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা রয়েছে বলে ন্যায়দর্শন নামান্তরে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবেই প্রসিদ্ধ। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বহির্জগতের সঙ্গে সরাসরি যোগের ফলে আমাদের যে জ্ঞান হয়, প্রত্যক্ষ প্রমাণকে তার মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষের লক্ষণ বর্ণনা করে বলেছেন–
‘ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপনং জ্ঞানম্ অব্যোপদেশ্য অব্যভিচারী ব্যবসায়ত্মকম্ প্রত্যক্ষম্’। (ন্যায়সূত্র: ১/১/৪)।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে যে অব্যাপদেশ্য (অশাব্দ), অব্যভিচারী  (অভ্রান্ত) এবং ব্যবসায়াত্মক (নিশ্চয়াত্মক) জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাই প্রত্যক্ষ।

সহজ কথায়, প্রত্যক্ষ বলতে সেই ধরনের জ্ঞান বোঝায় যা ইন্দ্রিয় এবং অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তুর সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন হয়। তবু ইন্দ্রিয় এবং অর্থ পরস্পর নিকটবর্তী হলেই যে প্রকৃত প্রত্যক্ষজ জ্ঞান সম্ভব হয় না তা বোঝাবার জন্য সূত্রকার ‘অব্যপদেশ্য’ বা অশাব্দ, ‘অব্যভিচারী’ বা অভ্রান্ত এবং ‘ব্যবসায়াত্মক’ বা নিশ্চয়াত্মক, এই কয়েকটি বিশেষণে এই জ্ঞানকে চিহ্নিত করেছেন।

প্রথম বিশেষণ ‘অব্যাপদেশ্য’ দ্বারা সংজ্ঞা, পরিচয় ইত্যাদির মাধ্যমে বিশেষভাবে ব্যাখ্যাত বস্তুকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের পরিধি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। সম্মুখস্থ কোন ব্যক্তির আকৃতি ইত্যাদি সম্বন্ধে সাক্ষাৎভাবে যে জ্ঞান আমাদের মনের গোচরীভূত হয় তাকে প্রত্যক্ষ বলা চলে। লোকটি সম্বন্ধে আমাদের পূর্ববর্তী জ্ঞানের সহযোগিতায় নাম ধাম ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত তার যে সম্পূর্ণ পরিচয় আমরা তখন লাভ করি তা প্রত্যক্ষ-বহির্ভূত।
সূত্রে ব্যবহৃত ‘অব্যভিচারী’ পদ মিথ্যা জ্ঞানকে প্রত্যক্ষের পরিসর থেকে অপসারিত করেছে। সূর্যকিরণে (মরীচিকায়) জলের বা রজ্জুতে সর্পের বোধ প্রকৃত প্রত্যক্ষ পদবাচ্য নয়।
আর ‘ব্যবসায়াত্মক’ শব্দের দ্বারা প্রকৃত বিচার বা অবধারণাকে জ্ঞানের একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, যার অভাবে কেবল মাত্র অর্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষের ফলে জ্ঞানের উৎপত্তি সম্ভব নয়। চক্ষুর সন্নিকটে অসংখ্য বস্তু উপস্থাপিত হলেই যে তাদের সবগুলির প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় তা বলা চলে না। বস্তুগুলির মধ্যে বিশেষভাবে যেটি অবধারণায় আসে সেটিই প্রত্যক্ষপদবাচ্য। সেটি যদি ফুল হয় তাহলে জ্ঞাতা ব্যক্তির ধারণা জন্মে ‘এটি একটি ফুল’। ‘ব্যবসায়’ নামে অভিহিত এই বিশেষ ধারণা ন্যায়ের অভিমতে প্রকৃত প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অপরিহার্য সোপান।

প্রত্যক্ষলক্ষণের বিচার প্রসঙ্গে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ প্রথমেই ন্যায়সূত্রবর্ণিত এই লক্ষণকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে এর সর্বাত্মক ত্রুটি প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হয়েছে। ন্যায়সূত্র-বর্ণিত ‘অব্যভিচারী’ পদ গ্রন্থমতে আরও বিস্তারের অপেক্ষা রাখে। অব্যভিচারিতা নানাভাবে হতে পারে– যে কারক বা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে এই জ্ঞানের উৎপাদন তার অদুষ্টতা, জ্ঞানের পথে বাধার অস্তিত্বের অভাব অথবা প্রবৃত্তিসামর্থ্য। প্রথমটিকে অব্যভিচারিতার কারণ হিসাবে নির্দেশ করা সম্ভব নয়। কারণ চক্ষু ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ের কুশলতার বিচার ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে হয় না, যে জন্য প্রত্যক্ষ এই বিচারের মাধ্যম হতে পারে না। এ ব্যাপারে অনুমানেরও অসার্থকতা একই সঙ্গে প্রতিপন্ন হয়, কারণ অনুমানের কার্যকারিতা প্রত্যক্ষজ্ঞানেরই ভিত্তিতে। যে হেতু বা লিঙ্গ অনুমানের অপরিহার্য অঙ্গ, সেই লিঙ্গ এখানে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উদ্ভূত জ্ঞান। ইন্দ্রিয়োত্থ জ্ঞানেরই সহায়তায় ইন্দ্রিয়ের অদুষ্টতা বিচার করে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে লব্ধ প্রত্যক্ষজ্ঞানের অব্যভিচারিতা প্রমাণের চেষ্টা করলে ইতরেতরাশ্রয়দোষের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।
বাধারহিতত্ব এবং প্রবৃত্তিসামর্থ্য– অব্যভিচারী জ্ঞান উৎপাদনে এ দুটির মধ্যেও কোনটি যে প্রকৃত কারণ হতে পারে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়,– সম্ভাব্য নানা রকম দৃষ্টিকোণ থেকে এ দুটিকে বিচার করার পর এ সম্বন্ধে গ্রন্থকার তাঁর মন্তব্য করেন। মোট কথা, বিশেষ কোন বস্তু সম্বন্ধীয় জ্ঞানে প্রত্যক্ষজ জ্ঞান প্রকৃতই বস্তুটির পরিচয় বহন করে কিনা স্থির করার প্রস্তুতি হিসাবে অব্যভিচারী জ্ঞানের বিভিন্ন কারণ আগে নির্ণয় করা প্রয়োজন, যেগুলির অনুপস্থিতিতে যথার্থ জ্ঞানের পর্যায়ে কোন জ্ঞান উন্নীত হতে পারে না। কিন্তু এই কারণগুলি নির্ণয়যোগ্য না হওয়ায় ‘অব্যভিচারী’ বিশেষণও কোন জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।
তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র মতে প্রত্যক্ষলক্ষণে ‘ইন্দ্রিয়ার্থসন্নিকর্ষ’ পদকে অন্তর্ভুক্ত করে নৈয়ায়িকেরা ‘অব্যভিচারী’ পদকে আরও অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছেন। বাহ্য বস্তুর জ্ঞানে অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তু যদি ইন্দ্রিয়ের নিকটবর্তী হয় তাহলে আপনা থেকে জ্ঞানে ব্যভিচারিতা শঙ্কার নিবৃত্তি হয়। নৈয়ায়িকেরা এ ক্ষেত্রে স্বপক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেন যে ইন্দ্রিয় অর্থ বা জ্ঞেয় বস্তুর সন্নিকৃষ্ট হলেও বহু ক্ষেত্রে প্রকৃত বস্তুজ্ঞানের পরিবর্তে ভ্রমের উৎপাদন হয়। যেমন সূর্যরশ্মিতে জলের প্রতীতি। এ যুক্তির বিপরীত পক্ষে গ্রন্থকারের যুক্তি এই যে উল্লিখিত নয়নেন্দ্রিয়ের যোগ হয় নিকটবর্তী সূর্যরশ্মির সঙ্গে; যে উদক বা জলের প্রতীতি এ ক্ষেত্রে হয়, সেই উদক নয়নের সন্নিকটে একেবারেই আসে না। কাজেই ন্যায়সূত্রবর্তী ‘অব্যভিচারী’ পদ এখানে সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে গ্রন্থকার ব্যভিচারী জ্ঞান বা ভ্রম সম্বন্ধে সুদীর্ঘ এক আলোচনার অবতারণা করেছেন। সূক্ষ্ম বিচারে কোন জ্ঞানই যে ‘অব্যভিচারী’ সংজ্ঞা লাভ করতে পারে না নানাভাবে তা দেখানো হয়েছে।’- (চার্বাক দর্শন, লতিকা চট্টোপাধ্যায়)

অতএব, ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থের অভিমতে ন্যায়সূত্রে অন্তর্ভুক্ত ‘অব্যভিচারী’ পদটি সব দিক দিয়েই অসার্থক–
‘তস্মাৎ স্থিতমেতদ্ অব্যভিচারিপদমনর্থকম্’। (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃষ্ঠা-১৭)
অর্থাৎ : তাই স্থির সিদ্ধান্ত যে, ‘অব্যভিচারী’ পদের ব্যবহার অর্থহীন। (মুক্ততর্জমা)

ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষ লক্ষণ সম্বন্ধে প্রযুক্ত অপর তিনটি পদের অসার্থকতাও ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে অনুরূপভাবেই অসার্থক প্রতিপন্ন করার প্রয়াস দেখা যায়। পরিশেষে গ্রন্থকার প্রত্যক্ষে ইন্দ্রিয় বা বাহ্য অর্থের যে কোন অবদানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের অকার্যকারিতার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য শাখাতেও প্রত্যক্ষ সম্বন্ধে নিজস্ব লক্ষণ আছে। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’র সমালোচনা থেকে এগুলিও বাদ যায়নি। দর্শনের সূক্ষ্ম তর্ককে উপজীব্য করায় তাতে বিভিন্ন শাস্ত্র সম্বন্ধে পাণ্ডিত্য এবং হেতুবাদের পূর্ণ প্রকাশ পরিলক্ষিত হলেও এই সমালোচনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নীরস। তাই এ প্রসঙ্গে আলোচনা দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কেননা, কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি আদৌ চার্বাকী মতবাদী নয় বরং সর্বপ্রমাণবিরোধী সংশয়বাদের নিদর্শক গ্রন্থ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। কারণ, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য হলো, প্রমাণমাত্রেরই খণ্ডন। ভারতীয় প্রতিটা দর্শনেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তগুলিকে প্রমাণের নিমিত্তে নিজস্ব যুক্তির অনুকূলে ন্যায় বা তর্কশাস্ত্রীয় চর্চাটাকে খুবই গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এবং এসব যুক্তিশাস্ত্রে প্রমাণের স্বপক্ষে বিভিন্ন ধরনের প্রপঞ্চের আমদানি ঘটালেও প্রমাণ হিসেবে প্রত্যক্ষকে অতীব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তার নমুনাস্বরূপ ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে প্রমাণশাস্ত্র হিসেবে ন্যায়দর্শনের উদাহরণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ন্যায়মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ প্রমাণের মধ্যে প্রত্যক্ষই হলো প্রথম বা সবচেয়ে সেরা বা সবচেয়ে মৌলিক। অন্যদিকে দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই একবাক্যে দাবি করেন যে, লোকায়ত বা চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অথচ জয়রাশি ভট্ট প্রথমেই দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ বলে আসলে কোনো প্রমাণই হতে পারে না। অর্থাৎ এক তূণে তিনি সকল তত্ত্ব বা দর্শনকেই উড়িয়ে দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, বইটির নাম ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ এর অর্থ হচ্ছে সোজা বাংলায়– সিংহের মতো দর্পে তত্ত্বমাত্রকে– অর্থাৎ সবরকম দার্শনিক মতকে– উপপ্লব বা উৎখাত করে দেবার দাবি।

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ-বাদী, কিন্তু সর্বপ্রমাণ-বিরোধী নয়। সর্বপ্রমাণ-বিরোধী হিসেবে যাঁরা ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ তাঁরা আসলে চরম ভাববাদী, মোটেও বস্তুবাদী নন। এই চরম ভাববাদী দর্শনগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ দুটো হলো বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের (১৭৫ খ্রিস্টাব্দ) শূন্যবাদ এবং অদ্বৈত-বেদান্তী দার্শনিক শঙ্করাচার্যের (৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) মায়াবাদ। এদিক থেকে দেখলে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-এর জয়রাশির অবস্থান আসলে বস্তুবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত দৃষ্টিকোণযুক্ত অদ্বৈত-বেদান্ত ও বৌদ্ধ-শূন্যবাদের সঙ্গে একই পঙক্তিতে থাকার কথা। তাই জয়রাশি ভট্টের উদ্দেশ্য নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে যে ব্যাপক অস্পষ্টতা রয়েছে তা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বইটি সম্পর্কে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটি প্রয়োজন বিবেচনায় আবারো উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন–

মনে রাখা দরকার, বইটির অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তু থেকে সম্পাদকরা এটিকে প্রসিদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে দাবি করেননি। করা সম্ভবও নয়। শুরুতেই গ্রন্থকার বলছেন, সাধারণ লোকের মধ্যে প্রসিদ্ধি আছে যে মাটি, জল, আগুন, বাতাস– এগুলিই মূল সত্য। কিন্তু দার্শনিক বিচারের ধোপে তাও টেকে না! তার মানে প্রসিদ্ধ চার্বাক মত বর্জন থেকেই বই-এর শুরু। গ্রন্থশেষে জয়রাশি আস্ফালন করে বলেছেন, স্বয়ং দেবগুরু বা বৃহস্পতির মাথাতেও যা আসেনি তা এই পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের বইতে ব্যাখ্যা করা হলো। বৃহস্পতি-মতের কোনো প্রকৃত সমর্থকের পক্ষে এমন আস্ফালন সহজবোধ্য নয়, কেননা গুরুমারা বিদ্যের স্থান আর যেখানেই থাকুক না কেন, অন্তত ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্যে থাকতে পারে না। বরং, প্রতিটি দার্শনিক মতের প্রকৃত প্রবক্তারা পরের যুগে কোনো নতুন কথা বলার সময়ও যেন-তেন-প্রকারেণ কথাটা সম্প্রদায়-প্রবর্তকের প্রকৃত অভিপ্রায় বলেই প্রচার করতে চান। পাষণ্ডদর্পচ্ছেদনের ব্যাপারটাও উড়িয়ে দেবার মতো নয়। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে প্রচলিত রকমারি গালিগালাজের মধ্যে ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধদের পাষণ্ড আখ্যা দিয়ে সন্তোষ লাভ করলেও, ব্রাহ্মণ-বৌদ্ধ উভয়ের পক্ষেই চার্বাককে সমস্বরে পাষণ্ডশিরোমণি হিসাবেই দেখবার কথা।
তাহলে বইটিতে চার্বাক-প্রবণতার পরিচয় শুরুতেও নেই, শেষেও নেই। আরো বড় কথা হলো, বইটির প্রধানতম প্রতিপাদ্য-বিষয়ের মধ্যেও নয়। ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ অবশ্যই সহজপাঠ্য বই নয়; যুক্তিতর্ক-কণ্টকিত রীতিমতো কঠিন বই। তবুও সাধ্যমতো সহজ করে এবং সংক্ষেপে তার সারমর্ম বলে রাখা দরকার।
জয়রাশি কী করে দেখাতে চান যে কোনো রকম দার্শনিক মতই স্বীকারযোগ্য নয়? সংক্ষেপে তাঁর বক্তব্য এই : যে-কোনো দার্শনিক মত বা তত্ত্ব হোক না কেন, স্বীকারযোগ্য হতে গেলে তার পক্ষে তো প্রমাণ থাকা দরকার। অথচ বিচার করলে বোঝা যায় যে, কোনো রকম তথাকথিত প্রমাণেরই প্রামাণ্য– বা প্রমাণ করার যোগ্যতা থাকতে পারে না। ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ, অনুমান, প্রভৃতির প্রমাণ হিসেবে প্রসিদ্ধি আছে। কিন্তু জয়রাশি দেখাতে চান, সে-প্রসিদ্ধি আসলে অলীক, কেননা নামে প্রমাণ হলেও এগুলি সবই আসলে অসার; কোনোটিকেই প্রমাণ বলা যায় না। আর প্রমাণ বলেই যদি কিছু না থাকে তাহলে কোনো রকম দার্শনিক মত বা তত্ত্ব স্বীকার করার কারণও থাকতে পারে না। অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’– সিংহদর্পে সর্বতত্ত্বের উপপ্লব বা উৎখাত।’ (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-২৯)।

অতএব ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থটিকে চার্বাক মতের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা তা প্রয়োজনীয় পর্যালোচনার দাবি রাখে অবশ্যই। যেহেতু চার্বাকমতের নিজস্ব রচনার প্রকৃত অভাব রয়েছে তাই কারো কারো মতে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ আলোচনা করলে চার্বাক দর্শনের ভিন্ন এক ধরনের পরিচয় আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। কিংবা চার্বাকদর্শনের রূপরেখা গঠনে গ্রন্থটি কোন কোন ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। কেননা ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহে’ অন্তর্ভুক্ত কোন কোন ক্ষেত্রে চার্বাকী ধারণার সাদৃশ্য থাকতে পারে।
চার্বাকেতর বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনায় প্রত্যক্ষনির্ভর বস্তুবাদী এক দর্শন হিসেবে চার্বাকের যে পরিচিতি, তা থেকে স্বভাবতই ধারণা হতে পারে যে চার্বাক সিদ্ধান্তে যে ইতিবাচক বক্তব্য আছে, যার কেন্দ্র হলো স্থূল বস্তুবাদ এবং এই বক্তব্যের বিপরীত সব কিছুই এই দর্শনের সমালোচনার বিষয়ীভূত। অনুমান প্রমাণের বিরোধিতায় চার্বাকপক্ষের তৎপরতার মূল এই ব্যাপারে, এবং একই কারণে চার্বাকেরা বাদ দিতে চান আত্মা, পরলোক ইত্যাদিকে– প্রত্যক্ষের মাপকাঠি দিয়ে যেগুলির বিচার চলে না। কিন্তু ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে যখন দেখা যায় যে চার্বাকদের প্রত্যক্ষকেও প্রমাণের আসর থেকে বহিষ্কৃত করতে উন্মুখ এবং প্রত্যক্ষোপার্জিত বস্তুজগতের বিষয়গুলিকেও প্রমেয়ের মর্যাদা দিতে আপত্তি তখন গ্রন্থ-রচয়িতার নির্দিষ্ট বক্তব্য সম্বন্ধে সংশয় জাগে।

ইতঃপূর্বে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিতণ্ডা প্রসঙ্গে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছিলো। এই বিতণ্ডারই পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ গ্রন্থে। কেননা, বৈতণ্ডিকের কাজ শুধুই অপরপক্ষের সমালোচনা। এই সমালোচনাতেই বৈতণ্ডিক তাঁর সমগ্র প্রয়াস কেন্দ্রীভূত করেন এবং পক্ষদ্বয়ের মধ্যে অপরপক্ষের প্রতিপক্ষ যে স্বপক্ষ, সেই স্বপক্ষের মতামত সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। সোজা কথায়, বিতণ্ডা হলো একপ্রকার যুক্তিহীন তর্ক, যেখানে কোন পক্ষই নিজের মত প্রতিষ্ঠা না করে কেবল অপরের মত খণ্ডন চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। প্রকৃতপক্ষে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’বাদী জগতের কোন তত্ত্বই মানেন না, কিন্তু নিজস্ব কোন তত্ত্বের প্রতিষ্টাও তাঁর মধ্যে দেখা যায় না। অপরের বিচারের ত্রুটি প্রদর্শন করাই যে জয়রাশির মুখ্য উদ্দেশ্য, আলোচ্য গ্রন্থের পরস্পরবিরোধী কয়েকটি সিদ্ধান্ত থেকেও তা পরিস্ফুট হয় বলে লতিকা চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য। যেমন–
ন্যায়দর্শনের সমালোচনা প্রসঙ্গে জাতি বা সামান্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকৃতি জানিয়ে (তত্ত্বোপপ্লবসিংহ, পৃপৃ:৪-৭) একই গ্রন্থে জয়রাশি ভট্ট বৌদ্ধদের বিচারে ত্রুটি প্রদর্শনকালে জাতির বিরুদ্ধে তাঁদের যুক্তি খণ্ডনে তৎপর হয়েছেন (ঐ, পৃপৃ:৪৬-৫১)। বৌদ্ধ ক্ষণিকসন্তানবাদীদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় গ্রন্থকারের প্রয়াস দেখে মনে হয় তিনি বুঝি আত্মবাদী দার্শনিকদেরই সগোত্র (ঐ, পৃ:৫৫)। কিন্তু পরক্ষণেই অধ্যাত্ম দর্শনে অনুসৃত অনুমান প্রমাণের সাহায্যে আত্মার ধারণাকে খণ্ডন করার প্রয়াস থেকে বোঝা যায় (ঐ, পৃপৃ:৭৪-৮৩) যে ইতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া [তাঁর] লক্ষ্য নয়।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৪)

কারো কারো মতে এই ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’বাদীরা চার্বাক-সম্প্রদায়েরই ভিন্ন একটি গোষ্ঠি। সেক্ষেত্রে বলতে হবে, প্রত্যক্ষবাদী হিসেবে বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক দর্শনের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে চার্বাকের এক বৃহৎ গোষ্ঠিই এই নেতিবাচক প্রবণতায় সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেনি এবং প্রত্যক্ষকে স্বীকৃতি দিয়ে সাধারণগ্রাহ্য এই প্রমাণের মাধ্যমে পাওয়া বস্তুজগৎকে তার বিষয়বস্তুর পরিসরে এনেছে। এই স্বাভাবিক ধারণারই প্রতিফলন দেখা যায় বস্তুবাদের সঙ্গে চার্বাকী মতবাদের একাত্মীকরণে। এ-প্রসঙ্গে লতিকা চট্টোপাধ্যায় মনে করেন–
কিন্তু চার্বাকের এই বস্তুবাদী প্রকাশকে তার নেতিবাচক প্রবণতারই অঙ্গবিশেষ হিসাবে দেখাটা বোধ হয় অযৌক্তিক নয়। প্রকৃতপক্ষে চার্বাক মতকে বস্তুবাদের পরিবর্তে হেতুবাদের সঙ্গেই একাত্ম করা অধিকতর সমীচীন। এই হেতুবাদেরই দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী প্রকাশের মধ্যে একটির আশ্রয় বস্তুজগৎ, প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যার পরিচিতি। অপরটির প্রকাশ ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’তে রূপায়িত চার্বাকী ধারায়, বস্তুজগৎকে স্বীকৃতি দিতে না পারায় যা বাস্তববাদী দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত বৌদ্ধ এবং অদ্বৈত বেদান্তের সমপর্যায়ভুক্ত হয়েছে।’- (চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৪)
এ-প্রেক্ষিতে জৈন দার্শনিক বিদ্যানন্দীর ‘তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক’ গ্রন্থের বক্তব্যটি স্মর্তব্য–
‘সর্বথা শূন্যবাদিনস্তত্ত্বোপপ্লববাদিনো ব্রহ্মবাদিনো বা জাগ্রদুপলব্ধার্থক্রিয়ায়ং কিং ন বাধকপ্রত্যয়ঃ’। (তত্ত্বার্থশ্লোকবার্তিক)
অর্থাৎ : শূন্যবাদী, তত্ত্বোপপ্লববাদী ও ব্রহ্মবাদী জাগ্রতোপলব্ধিজাত অর্থক্রিয়া বা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বস্তুজগতের সত্তাকে সত্য বলে স্বীকার করেন না। (মুক্ততর্জমা)

শ্রীহর্ষের ‘খণ্ডনখণ্ডখাদ্য’ গ্রন্থেও এই তিনটি মতবাদ একই শ্রেণীর অন্তর্গত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, এ গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদে চার্বাক প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে যে– ‘চার্বাকেরা কোন প্রমাণকে স্বীকার করেন না’–
‘সোহয়মপূর্বঃ প্রমাণাদিসত্তানভ্যুপগমাত্মা’। (খণ্ডনখণ্ডখাদ্যম্ : পৃষ্ঠা ২৬)।

হেতুবাদ প্রসঙ্গেও ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে আলোচনার চেষ্টা হয়েছে। অতএব, সে আলোচনা না বাড়িয়ে এটুকু বলা যায় যে, হেতুবাদের বিপরীতধর্মী দুটি অভিব্যক্তির মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষ যেখানে প্রামাণ্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত, প্রচলিত পরিভাষায় ‘চার্বাক’ সংজ্ঞা সেই দর্শনেরই পরিচয় বহন করে। প্রচলিত প্রত্যক্ষবাদী চার্বাক মতে তত্ত্বের বর্তমানতা প্রত্যক্ষের মাধ্যমে লভ্য বস্তুজগতকে কেন্দ্র করে। এই বস্তুজগতের মূলগত উপাদানের সংখ্যা ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মতে পাঁচ– ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী বা মাটি, অপ্ বা জল, তেজ বা আগুন, মরুৎ বা বাতাস এবং ব্যোম বা আকাশ। যেমন ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে–
‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)
অর্থাৎ : ক্ষিতি বা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ।

কিন্তু প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকেরা এই মূল তত্ত্বের সংখ্যা চারে সীমিত রাখতে চান। ব্যোম বা আকাশকে তারা গ্রাহ্য করেন না যেমন–
‘পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি।
তৎ-সমুদায়ে শরীরেন্দ্রিয়-বিষয়-সংজ্ঞা।’ (বার্হস্পত্য-সূত্র)।
অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু- এই চারটিই তত্ত্ব। এর সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।
চার্বাকেতর দার্শনিকদের বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক-মতের পরিচয়ে এই বিষয়টিকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন অদ্বৈত-বেদান্তবাদী শঙ্করাচার্য তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে বলেছেন–
লোকায়তিকপক্ষে তু তত্ত্বং ভূতচতুষ্টয়ম্ ।
পৃথিব্যাপস্তথা তেজো বায়ুরিত্যেব নাপরম্ ।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১)।।
অর্থাৎ : লোকায়ত মতে চারটি ভূতকেই তত্ত্ব বলা হয়। উক্ত চারটি ভূত হলো যথাক্রমে পৃথিবী, জল, তেজ এবং বায়ু। অপর কোন ভূত এই মতে স্বীকৃত নয়।

মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকমতে তত্ত্বের উল্লেখ এবং একই লোকায়তিক মতের উপস্থাপনায় এ-প্রসঙ্গে যে লোকগাথাটি উল্লেখ করেছেন, তা হলো–
তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : এই চার্বাকমতে পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু– এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।
.
অত্র চত্বারি ভূতানি ভূমি-বারি-অনল-অনিলাঃ ।
চতুর্ভ্যঃ খলু ভূতেভ্যঃ চৈতন্যম্ উপজায়তে ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে) মাটি, জল, আগুন, বাতাস– শুধুমাত্র এই চার রকম ভূতবস্তুই বর্তমান। এই চার রকম ভূতবস্তু থেকেই চৈতন্য উৎপন্ন হয়।
কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’-এ এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–
‘পৃথিব্যপ্ তেজোবায়বস্তত্ত্বানি’। (প্রবোধচন্দ্রোদয়)
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে), পৃথিবী, জল, আগুন ও বায়ু– এই চারটি তত্ত্ব।
জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরির ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে লোকায়ত প্রসঙ্গে চতুর্ভূত প্রসঙ্গে এ-ধরনের উক্তিই দেখা যায়–
‘পৃথ্বী জলং তেজো বায়ুর্ভূত চতুষ্টয়ম্’…। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়)
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে), পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু– এই চারটি ভূত স্বীকৃত।

এভাবে বিভিন্ন গ্রন্থে চার্বাক বা লোকায়তিক মতের বহু উল্লেখ করা যেতে পারে। বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’-তেও সূত্রের মাধ্যমে চতুর্ভূত সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণার অভিব্যক্তি দেখা যায়–
‘পৃথিব্যাপস্তেজোবায়ুরিতি চত্বারি তত্ত্বানি…’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৫৯)
অর্থাৎ : পৃথিবী বা মাটি, জল, তেজ বা আগুন ও বায়ু– এই চারটি তত্ত্ব।

চার্বাকেতর দর্শন-স্বীকৃত পঞ্চভূতের মধ্যে চার্বাক-মতে ব্যোম বা আকাশকে যে তত্ত্ব হিসেবে গ্রাহ্য করা হয় না তার একটাই কারণ, ব্যোম বা মহাশূন্যের জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে হয় না। প্রত্যক্ষবাদী চার্বাকদের কাছে প্রত্যক্ষসিদ্ধ এই চারটি তত্ত্ব ছাড়া অন্য কিছু অনুমোদন লাভ করেনি। এই চার তত্ত্বের সমবায়ে দেহ, ইন্দ্রিয় এবং জাগতিক সব পদার্থের সৃষ্টি। বৌদ্ধদার্শনিক কমলশীল তাই এ-প্রসঙ্গে লোকায়তসূত্র উদ্ধৃত করে আরো বলেন–
‘তৎসমুদায়ে বিষয়েন্দ্রিয়সংজ্ঞা’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৬০)
অর্থাৎ : তার (চতুর্ভূতের) সমন্বয়ে শরীর, ইন্দ্রিয়, চৈতন্য ইত্যাদি সৃষ্ট।

বিভিন্ন প্রাণিদেহের উপাদানরূপেও মৌল এই চারটি তত্ত্বের নির্দেশ চার্বাক দর্শনে রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বস্তুজগতের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে অনুমোদিত চার্বাকী তত্ত্বের সংখ্যা ভারতের প্রচলিত ধারণার ব্যতিক্রম হলেও, চার্বাক-দর্শনের ইতিহাসে এটা কাকতালীয় কিনা কে জানে, প্রাচীন গ্রিক চিন্তায়ও কিন্তু এর এক অনুলিপি দেখা যায়। যেমন–
(Plato) প্লেটো’র মতে– ‘there are four elements out of which the body is composed, earth and fire and water and air…’।
আর অ্যারিস্টটল বলেন– ‘Since the bodies of all animals, and likewise of all plants, are composed from the four elements, in some of them earth predominates, as in plants, in others, water, as in aquatic animals, and in others air of fire, as in pedestrious and winged animals.‘ -(‘plato Dictionary, p.74’ : সূত্র: লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৭৬)

অতএব, এই আলোচনা থেকে চার্বাক-মত প্রসঙ্গে এই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে, চার্বাকেরা অবশ্যই প্রত্যক্ষ-প্রমানবাদী। কিন্তু তাঁরা প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদী কিনা অর্থাৎ চার্বাকেরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য করেন কিনা এই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আমাদেরকে প্রমাণবাদের অন্যতম অনুমান-প্রমাণের আলোচনায় প্রবিষ্ট হতে হবে।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال