স্বভাববাদ
ইতঃপূর্বে দেহাত্মবাদের আলোচনায় ‘স্বভাব’ বা ‘স্বভাববাদ’ বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত হয়েছে। কোন প্রসঙ্গে? চার্বাকমতে আগুন বাতাস জল মাটি বলে চৈতন্যহীন ভূতবস্তুরই কোনো একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে চৈতন্যবিশিষ্ট দেহের উৎপত্তি হয়। কিন্তু কী করে হয়? আত্মপক্ষ সমর্থনে চার্বাক অবশ্যই দাবি করবেন এ জাতীয় বিশেষ পরিণামের ব্যাখ্যায় ভূতবস্তুগুলি ছাড়া আর কিছু মানার দরকার নেই, কেননা ভূতবস্তুগুলির ‘স্বভাব’ই ওই– অবস্থাবিশেষে তা দেহাকারে পরিণত হয়। কিন্তু, প্রশ্ন উঠবে, এইভাবে চার্বাকমত সমর্থন করার পক্ষে সত্যিই কি কোনো প্রমাণ আছে? কিংবা, যা একই কথা, চার্বাক কি বাস্তবিকই ‘স্বভাব’ বলে কিছু মানতেন?
শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে স্বভাববাদী চার্বাকদের অভিমতের এক বিবরণে বলা হয়েছে–
‘ন কল্প্যৌ সুখদুঃখাভ্যাং ধর্মাধর্মৌ পরৈরিহ।
স্বভাবেন সুখী দুঃখী জনোহন্যন্নৈব কারণম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৪)।।
‘শিখিনশ্চিত্রয়েৎ কো বা কোকিলান্ কঃ প্রকূজয়েৎ।
স্বভাবব্যতিরেকেণ বিদ্যতে নাত্র কারণম্ ।।’ (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৫)।।
অর্থাৎ :
(লোকায়তিক চার্বাকমতে) অপরবাদিগণ কর্তৃক সুখদুঃখরূপ হেতুর দ্বারা ধর্ম ও অধর্মের অনুমান করা অযৌক্তিক। স্বভাববশতই মানুষ সুখ এবং দুঃখ পেয়ে থাকে। এই বিষয়ে ধর্ম ও অধর্ম নামক কারণান্তরের অপেক্ষা নেই। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৪)।। ময়ূরদের কে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করে দেয়? কোকিলদেরই বা কে কূজন করায়? বস্তুত স্বভাব ব্যতীত এক্ষেত্রে অন্য কোন কারণ নেই। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৫)।।
তার মানে, এই মত অনুসারে, শিখিপুচ্ছে নানা রঙের বৈচিত্র্য বা কোকিলের কণ্ঠে মধুর স্বরের সমাবেশ স্বাভাবিক যে নিয়মে হয়, মানুষের সুখ-দুঃখেও সেই নিয়মেরই প্রভাব দৃষ্ট হয়। এসবের কারণ হিসেবে ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদির কল্পনা অসঙ্গত। এই স্বাভাবিক নিয়মই হলো স্বভাব-নিয়ম; যাকে স্বভাববাদ বলে চিহ্নিত করা হয়। অন্যান্য চার্বাকী ধারণার মতো স্বভাববাদও ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখার সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। তবে এ আলোচনায় যাওয়ার আগে স্বভাববাদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আমাদের পক্ষে কিছু প্রাচীন নজির অনুসন্ধান করা আবশ্যক, যা থেকে প্রমাণ হয় যে, চার্বাক বস্তুত স্বভাববাদী ছিলেন।
.
। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের নজির।
প্রসিদ্ধ দর্শন-গবেষক শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় তাঁর ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে বলেছেন, স্বভাববাদ সম্ভবত আদিতে স্বতন্ত্র মত হিসেবে ভারতের চিন্তাক্ষেত্রে সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে আবির্ভূত হয়েছিলো। চার্বাক মতের সঙ্গে এই মতের একীকরণ পরবর্তী পর্যায়ে বলে অনেকের ধারণা। শাস্ত্রী মহাশয়ের এই বক্তব্যের উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রাচীন নজির হিসেবে ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’কেই লক্ষ্য হিসেবে ধরে নিতে হয়। কেননা, ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে স্বভাববাদের সবচেয়ে পুরোনো নজির বলতে ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ’।
উপনিষদের নামটি অবশ্য কিছুটা অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কেননা দেবীপ্রসাদের মন্তব্য অনুসারে ‘শ্বেতাশ্বতর’ শব্দটির অর্থ সোজা কথায় ‘সাদা খচ্চর’। উপনিষদটির মধ্যেও ঋষি নিজেকে এই শ্বেতাশ্বতর নামেই উল্লেখ করেছেন–
উপনিষদের নামটি অবশ্য কিছুটা অদ্ভুত ঠেকতে পারে। কেননা দেবীপ্রসাদের মন্তব্য অনুসারে ‘শ্বেতাশ্বতর’ শব্দটির অর্থ সোজা কথায় ‘সাদা খচ্চর’। উপনিষদটির মধ্যেও ঋষি নিজেকে এই শ্বেতাশ্বতর নামেই উল্লেখ করেছেন–
‘তপঃপ্রভাবাৎ দেবপ্রসাদাচ্চ ব্রহ্ম হ শ্বেতাশ্বতরোহথ বিদ্বান্ ।
অত্যাশ্রমিভ্যঃ পরমং পবিত্রং প্রোবাচ সম্যগ্-ঋষিসঙ্থ-জুষ্টম্ ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৬/২১)
অর্থাৎ :
শ্বেতাশ্বতর নামে এক বিদ্বান অর্থাৎ ব্রহ্মতত্ত্বে জ্ঞানী তপস্যাবলে আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। কিন্তু কেবল তপস্যাবলেই নয়, দেবতার অনুগ্রহে ব্রহ্মজ্ঞ হয়েছিলেন। তারপর, তিনি সেই পরম-পবিত্র ঋষিগণ-সেবিত সেই সত্য ব্রহ্মজিজ্ঞাসু পূজনীয় আশ্রমিকদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন।
পরবর্তীকালের অধ্যাত্মবাদীদের কাছেও নামটা নিশ্চয়ই বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তাই, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্যে–
‘শঙ্করানন্দ এর একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা উদ্ভাবন করতে চেয়েছেন : শ্বেত মানে বিশুদ্ধ এবং ঔপচারিক অর্থে অশ্ব মানে ইন্দ্রিয়। ‘বিশুদ্ধ ইন্দ্রিয়’ : কিন্তু মুস্কিল হলো, গ্রন্থ এবং তার প্রবক্তা ঋষিটির নাম শ্বেত-অশ্বতর এবং অশ্ব ও অশ্বতর এক নয়। একালে রাধাকৃষ্ণণও বুঝেছেন, ব্যাপারটা বেশ একটু গোলমেলে; ফলে নামটার নামে করেছেন, ‘সাদা খচ্চরের মালিক’। কিন্তু ব্যাকরণের পরোয়া করলে এমন মানে দাঁড় করানো কঠিন। এবং যদিই বা দাঁড় করানো যায় তাহলেও সাদা খচ্চরের মালিকানাটা এমন কিছু আহামরি ব্যাপার হবে না যে তা থেকে নিজের নাম এবং তাঁরই নামে প্রচলিত উপনিষদটির নামকরণ করে কেউ খুব একটা অধ্যাত্ম-গৌরব অনুভব করতে পারেন।
পক্ষান্তরে আমাদের ধারণা, নৃতত্ত্ববিদরা যাকে প্রাচীন ‘টোটেম বিশ্বাস’ বলেন, নামটার পিছনে তার কোনো ইংগিত থাকা অসম্ভব নয়; কেননা এহেন বিশ্বাসের মূল কথাই হলো গাছগাছড়া বা জন্তুজানোয়ার থেকে মানবদলের নামকরণ– দলের সবাই নিজেকে তারই বংশধর বলে কল্পনা করতো। টোটেম বিশ্বাস অবশ্যই আদিম সমাজের পরিচায়ক; কিন্তু বিশেষত আমাদের দেশে তার রেশ দীর্ঘযুগ ধরে টিকে থেকেছে। আজো আছে।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১০৮-৯)
তবে উপনিষদটির নামকরণের কারণ যাই হোক-না-কেন, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে গ্রন্থটির গুরুত্ব বড় কম নয়। কেননা এই উপনিষদেই, ধারণা করা হয়, সর্বপ্রথম বিশিষ্ট দার্শনিক মত হিসেবে ‘স্বভাব’ বা ‘স্বভাববাদে’র উল্লেখ পাওয়া যায়। উপনিষদটির প্রথম দুটি শ্লোকেই পাওয়া যায়, যদিও শ্লোক দুটির আক্ষরিক অর্থ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা– অতএব মতভেদ– আছে। কিন্তু অতশত সূক্ষ্ম বিচারে আমাদের আপাতত প্রয়োজন নেই; মোটকথা অর্থটাই যথেষ্ট। এখানে বলা হয়েছে–
‘ব্রহ্মবাদিনো বদন্তি–
‘কিং কারণং ব্রহ্ম, কুতঃ স্ম জাতা, জীবাম কেন, ক্ব চ সম্প্রতিষ্ঠাঃ।
অধিষ্ঠিতাঃ কেন সুখেতরেষু বর্তামহে ব্রহ্মবিদো ব্যবস্থাম্ ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-১/১)
‘কালঃ স্বভাবো নিয়তির্যদৃচ্ছা ভূতানি যোনিঃ পুরুষ ইতি চিন্ত্যা।
সংযোগ এষাং ন ত্বাত্মভাবাৎ আত্মাহপি অনীশঃ সুখদুঃখহেতোঃ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-১/২)
অর্থাৎ :
পরম সত্য (উপনিষদের ভাষায় ব্রহ্ম) নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন উঠলো– পরম সত্য (বা ব্রহ্ম) আসলে কী? কী থেকে আমাদের জন্ম, কিসের উপর নির্ভর করে আমরা বাঁচি এবং শেষ পর্যন্ত কিসে ফিরে যাই? আমাদের সুখদুঃখের কারণ কী? (শ্বেতাশ্বতর-১/১)।। কাল, বস্তুর স্বভাবধর্ম, নিয়তি (কারণ ও তার কার্য), যদৃচ্ছা (আকস্মিক ঘটনা), ভূতবস্তু, যোনি, পুরুষ (জীবাত্মা), এই সবের কোনও একটি কি জগতের কারণ? কোন একটি কারণ, না সব কটি কারণ একসঙ্গে যুক্ত হয়ে এই সৃষ্টি-কাজ সফল করেছে? এই সবগুলিকে একত্রিত করতে পারে জীবাত্মাই (পুরুষ); কিন্তু আবার সুখ-দুঃখের অধীন কোন জীবাত্মাই নিজের প্রভু অর্থাৎ স্বাধীন নয়। তাহলে এই যে সৃষ্টি-পরিণাম এর কারণ কী? (শ্বেতাশ্বতর-১/২)।।
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের দ্বিতীয় শ্লোক থেকে বোঝা যায় যে, প্রথম শ্লোকের প্রশ্নগুলি নিয়ে সেকালে রকমারি মত চালু ছিলো। তার তালিকাটাও খুব চিত্তাকর্ষক। একটা মতে, ‘কাল’ই পরম সত্য। অর্থাৎ, ‘কাল’ থেকেই সব কিছুর উৎপত্তি; ‘কালে’ই সবকিছুর স্থিতি; ‘কালে’র মধ্যেই সব কিছু আবার বিলীন হয়। মতটাকে তাই ‘কালবাদ’ বলার প্রথা আছে। আধুনিক বিদ্বানরা বলছেন, ‘অথর্ববেদ’ থেকেই এই জাতীয় মতের পরিচয় পাওয়া যায় এবং এককালে একদল চিন্তাশীলের মধ্যে– বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহলে– মতটা বেশ চালু ছিলো।
দ্বিতীয় মতে, ‘স্বভাব’ই পরম সত্য। আমাদের উৎপত্তি, স্থিতি এবং বিলয়ের মূলে এই ‘স্বভাব’ ছাড়া আর কিছু নেই। মতটাকে তাই ‘স্বভাববাদ’ বলা হয়।
তৃতীয় মতে, ‘ভূতবস্তু’ই পরম সত্য। মতটা অবশ্যই চার্বাকদের কথা মনে পড়িয়ে দেয়, কেননা প্রাচীনকালে আর কেউ নিছক ভূতবস্তুকে একমাত্র সত্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
চতুর্থ ও পঞ্চম মতে, ‘নিয়তি’ এবং ‘যদৃচ্ছা’ (অর্থাৎ আকস্মিকত্বই বা কারণহীনতাই) পরম সত্য।
এর পর উপনিষদ্-এ ‘যোনি’ এবং ‘পুরুষ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শব্দ দুটি নিয়ে বিদ্বানদের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক আছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ে ভাষ্যে–
‘কেউ বলেন ‘কারণ’ অর্থে যোনি শব্দটাকে উপরিউক্ত মতগুলির সঙ্গে মিলিয়ে বুঝতে হবে। অপর মতে ‘যোনি’ বলতে স্বতন্ত্র মত উল্লিখিত। যোনি শব্দের আক্ষরিক অর্থ অবশ্যই নারীর জননাঙ্গ; সেদিক থেকে জন্ম বা উৎপত্তি-সূচক মনে করে কারণ অর্থে প্রয়োগ অসম্ভব নয়। অপরে বলেন, এখানে স্বতন্ত্র একটি কারণ অর্থে যোনি শব্দের প্রয়োগ। সে-অর্থ গ্রহণ করলে হয়তো তন্ত্রমতের কোনো আদিম সংস্করণের আভাস পাওয়া যেতে পারে। আবার কেউ বলছেন, স্বতন্ত্র পরম সত্য হিসেবে এখানে সাংখ্যমতের কোনো আদি-সংস্করণের নির্দেশ অসম্ভব নয়, কেননা সাংখ্যমতে যে ‘প্রকৃতি’ জগৎকারণ তা আদি-নারীরূপেই কল্পিত।’
‘এ-হেন ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে কিন্তু সাংখ্যদর্শনের আদিরূপ হিসেবে যার আভাস পাওয়া যায় তার সঙ্গে সাংখ্যদর্শনের পরবর্তী সংস্করণের মিল থাকে না। কেননা এই ‘যোনিবাদ’ অনুসারে নিছক প্রকৃতি বা প্রকৃতিমাত্রই জগৎকারণ, কেননা উপনিষদ্কার এখানে স্বতন্ত্রভাবে ‘পুরুষ’-এর কথা– বা ‘পুরুষবাদ’– উল্লেখ করেছেন। ‘ঋগ্বেদ’ থেকেই অবশ্য ‘পুরুষ’কে আদি কারণ বলে ঘোষণা করার প্রথা আমাদের জানা আছে (পুরুষসূক্ত), যদিও কিছু পরবর্তীকালে উপনিষদের চরম ভাববাদীরা বিশুদ্ধ আত্মা বা চিন্ময় পরব্রহ্মেরই প্রতিশব্দ হিসেবেও ‘পুরুষ’ শব্দ গ্রহণ করতে চেয়েছেন।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১০)
এই বিশুদ্ধ আত্মা বা চিন্ময় পরব্রহ্মের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘পুরুষ’ শব্দ গ্রহণের দৃষ্টান্ত হিসেবে যেমন ‘বৃহদারণ্যক উপনিষদ্’-এ আছে–
‘ইয়ং পৃথিবী সর্বেষাং ভূতানাং মধু, অসৌ পৃথিব্যৈ সর্বাণি ভূতানি মধু। যশ্চায়মাস্যাং পৃথিব্যাং তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুয়ুষো যশ্চায়মধ্যাত্বং শারীরস্তেজোময়োহমৃতময়ঃ পুরুষোহয়মেব স যোহয়মাত্মা; ইদং অমৃতং, ইদং ব্রহ্মেদং সর্বম্’।। (বৃহদারণ্যক-২/৫/১)
অর্থাৎ :
এই পৃথিব্যাদি ভূতচতুষ্টয় সবার কাছে মধুস্বরূপ, মধুভাণ্ড বা মধুচক্র। আবার এই পৃথিবীর কাছেও, যা কিছু আছে, যত জীব আছে সবই মধুস্বরূপ। এই পৃথিবীতে যিনি তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ আছেন, এবং জীব শরীরের অভ্যন্তরে যে তেজোময়, অমৃতময় পুরুষ আছেন– ইনিই তিনি। দুই-ই এক (মধু); যিনি হলেন এই এই আত্মা, এই অমৃত, এই ব্রহ্ম, এই সব কিছু।
কিন্তু এ-আলোচনা আমাদের পক্ষে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়। ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এ ‘যোনি’ ও ‘পুরুষ’ শব্দ ব্যবহারের পিছনে উপনিষদ্কারের বুদ্ধিস্থ আসলে কী ছিলো, সে-বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া সহজসাধ্য নয়। কিন্তু একটি বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে আলোচ্য উপনিষদটির প্রতিপাদ্য বিষয় ঈশ্বরই প্রকৃত জগৎকারণ। যেমন–
‘স্বভাবমেকো কবয়ো বদন্তি কালং তথান্যে পরিমুহ্যমানাঃ।
দেবস্যৈষ মহিমা তু লোকে যেনেদং ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রম্ ।।’ (শ্বেতাশ্বতর-৬/১)
অর্থাৎ :
অনেক কবি বা দ্রষ্টার ধারণা, সৃষ্টির মূল কারণ হলো স্বভাব। বস্তুর স্বভাবধর্মই হলো সৃষ্টি করা, রূপ দেয়া। তাঁদের এ ধারণা ভুল। আবার কারও মতে জগতের উৎপত্তি কাল থেকে, অর্থাৎ কালই জগৎনস্রষ্টা। এই ধারণাও ভুল। বস্তুত পরমেশ্বর পরমাত্মাই এই ব্রহ্মচক্র অর্থাৎ জগতের কারণ।
কিন্তু ঈশ্বরই প্রকৃত জগৎকারণ এই প্রতিপাদ্য-বিষয় ব্যাখ্যা করার আগে তাই সেকালে প্রচলিত কয়েকটি বিরুদ্ধ মত বর্জনার্থে অন্যান্য ধারণাগুলির উল্লেখ করা হয়েছে। সেকালে মতগুলির বিশেষ প্রভাব না-মানলে এই উল্লেখের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ফলে অনুমান করা যায় যে, ওই সুদূর প্রাচীনকালেই মতগুলি বিশেষ প্রভাবশীল ছিলো। এগুলির মধ্যে আমাদের আলোচনায় বিশেষ প্রাসঙ্গিক বলতে দুটি মত– ‘স্বভাববাদ’ ও ‘ভূতবাদ’।
.
। ভূতবাদ ও স্বভাববাদ।
‘ভূতবাদ’ বলতে চার্বাকমত– বা তারই খুব নিকটাত্মীয় কোনো প্রাচীন বস্তুবাদ– বলে গ্রহণ করায় বোধহয় বিশেষ কোন আপত্তির আশঙ্কা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘স্বভাববাদ’-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? স্বভাববাদ প্রসঙ্গে ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর সাক্ষ্যই যদি এক্ষেত্রে একমাত্র সম্বল হতো তাহলে অবশ্য ভূতবাদ ও স্বভাববাদকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বলে মানতে বাধ্য হতে হতো, কেননা উপনিষদটিতে স্বতন্ত্রভাবে মত দুটির উল্লেখ রয়েছে। এ-জাতীয় পার্থক্য স্বীকার করলে স্বভাববাদকে চার্বাক বা লোকায়ত মতের পরিচায়ক বলে মনে করায় বাধা হয় বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। কেননা, ভূতবাদই লোকায়ত বা চার্বাকমতের প্রাণবস্তু।
কিন্তু তুলনায় কিছু পরবর্তীকালের নজির থেকে অবধারিতভাবেই প্রমাণ হয় যে, ভূতবাদী চার্বাক স্বভাববাদীও ছিলেন; বস্তুত স্বভাববাদ না-মানলে চার্বাকের ভূতবাদ বা চরম বস্তুবাদ প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। এখানে উল্লেখ্য, উপনিষদে চার্বাক তো দূরের কথা লোকায়ত নামেরই কোন উল্লেখ নেই; কিন্তু প্রখর বস্তুবাদের বা ভূতবাদের বিস্তর নজির আছে। এই ভূতবাদের সঙ্গে স্বভাববাদের অনিবার্য আত্মীয়তার কথা ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এ উপলব্ধ হোক-আর-নাই-হোক, পরবর্তী সাহিত্যে উল্লিখিত হয়েছে। সম্ভবত তারই নজির মনে রেখে গোপীনাথ কবিরাজ মন্তব্য করেছেন–
‘মনে হয় চরম স্বভাববাদের প্রতিনিধি বলতে সুপ্রাচীন ভারতের একদল একেবারে স্বাধীন চিন্তাশীল ছিলেন; আদিতে এঁদেরই লোকায়ত বলে উল্লেখ করার প্রথা ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এঁরাই অনেক ব্যাপকভাবে চার্বাক নামে পরিচিত হন। তাঁদের মতের আদিরূপটির বৈশিষ্ট্য বলতে কট্টর বস্তুবাদ, অদৃষ্টে (অর্থাৎ কর্মফলে) অবিশ্বাস, আপসহীন যুক্তিবাদ– বা হয়তো বিতণ্ডাও।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১১)
বিতণ্ডা বলতে বোঝায় বৃথাতর্ক বা শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক। লোকায়তিকদের ঘাড়ে বিতণ্ডাবাদের অপবাদটা যে-উদ্দেশ্যে চাপানো হয়েছিলো তার যাথার্থ্য বড় জোর সংশয়-সাপেক্ষ। কিন্তু সে বিতর্ক না-তুলেও নিশ্চয়ই মন্তব্য করার সুযোগ আছে যে, ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর উক্তি সত্ত্বেও অন্তত কিছু দিনের মধ্যেই স্বভাববাদকে লোকায়ত বা চার্বাক বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। আর তাই হয়তো ‘মহাভারত’-এ সরাসরিই বলা হয়েছে–
কিন্তু তুলনায় কিছু পরবর্তীকালের নজির থেকে অবধারিতভাবেই প্রমাণ হয় যে, ভূতবাদী চার্বাক স্বভাববাদীও ছিলেন; বস্তুত স্বভাববাদ না-মানলে চার্বাকের ভূতবাদ বা চরম বস্তুবাদ প্রমাণ করা দুঃসাধ্য। এখানে উল্লেখ্য, উপনিষদে চার্বাক তো দূরের কথা লোকায়ত নামেরই কোন উল্লেখ নেই; কিন্তু প্রখর বস্তুবাদের বা ভূতবাদের বিস্তর নজির আছে। এই ভূতবাদের সঙ্গে স্বভাববাদের অনিবার্য আত্মীয়তার কথা ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এ উপলব্ধ হোক-আর-নাই-হোক, পরবর্তী সাহিত্যে উল্লিখিত হয়েছে। সম্ভবত তারই নজির মনে রেখে গোপীনাথ কবিরাজ মন্তব্য করেছেন–
‘মনে হয় চরম স্বভাববাদের প্রতিনিধি বলতে সুপ্রাচীন ভারতের একদল একেবারে স্বাধীন চিন্তাশীল ছিলেন; আদিতে এঁদেরই লোকায়ত বলে উল্লেখ করার প্রথা ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এঁরাই অনেক ব্যাপকভাবে চার্বাক নামে পরিচিত হন। তাঁদের মতের আদিরূপটির বৈশিষ্ট্য বলতে কট্টর বস্তুবাদ, অদৃষ্টে (অর্থাৎ কর্মফলে) অবিশ্বাস, আপসহীন যুক্তিবাদ– বা হয়তো বিতণ্ডাও।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১১)
বিতণ্ডা বলতে বোঝায় বৃথাতর্ক বা শুধু তর্কের খাতিরে তর্ক। লোকায়তিকদের ঘাড়ে বিতণ্ডাবাদের অপবাদটা যে-উদ্দেশ্যে চাপানো হয়েছিলো তার যাথার্থ্য বড় জোর সংশয়-সাপেক্ষ। কিন্তু সে বিতর্ক না-তুলেও নিশ্চয়ই মন্তব্য করার সুযোগ আছে যে, ‘শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্’-এর উক্তি সত্ত্বেও অন্তত কিছু দিনের মধ্যেই স্বভাববাদকে লোকায়ত বা চার্বাক বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। আর তাই হয়তো ‘মহাভারত’-এ সরাসরিই বলা হয়েছে–
‘স্বভাবং ভূতচিন্তকাঃ’। (মহাভারত)
অর্থাৎ : যাঁরা শুধু ভূতবস্তু বিষয়েই চিন্তা করেন (অর্থাৎ শুধু ভূতবস্তুকেই মানেন) তাঁরা স্বভাববাদী।
আর ‘বৃহৎ-সংহিতা’-র ব্যাখ্যায় ভট্ট উৎপল বলছেন– ‘অন্যেরা, অর্থাৎ লোকায়তিকেরা স্বভাবকেই জগৎকারণ বলে গ্রহণ করেন; স্বভাবের জন্যই বৈচিত্র্যময় জগতের উৎপত্তি, স্বভাববশতই তার বিলোপ।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১২)। এবং ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-তে চার্বাকমতের ব্যাখ্যায় মাধবাচার্য বলছেন–
ননু অদৃষ্টানিষ্টৌ জগদ্-বৈচিত্র্যম্ আকস্মিকং স্যাদিতি চেৎ? ন তদ্ ভদ্রম্, স্বভাবাদেব তদুপপত্তেঃ। তদুক্তম্–
‘অগ্নিরুষ্ণো জলং শীতং সমস্পর্শস্তথাহনিলঃ।
কেনেদং চিত্রিতং তস্মাৎ স্বভাবাৎ তদ্-ব্যবস্থিতিঃ।।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ :
[চার্বাক দর্শনের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠবে :] তোমরা যদি ‘অদৃষ্ট’ (অর্থাৎ পূর্বকর্মের ফল ধর্ম-অধর্ম) না মানো তাহলে পৃথিবীর এতো বৈচিত্র্য তো আকস্মিক (অর্থাৎ অকারণ) বলে স্বীকার করতে বাধ্য হবে। [চার্বাকেরা কিন্তু বলবেন], এমনতর কথা (বা আপত্তি) ঠিক নয়, [কেননা জগৎ-বৈচিত্র্যের] ব্যাখ্যার জন্য ‘স্বভাব’ স্বীকার করাই পর্যাপ্ত। [এই প্রসঙ্গে মাধব চার্বাকদের লোকগাথা উদ্ধৃত করেন]–
‘অগ্নি উষ্ণ, জল শীতল, বাতাস সমস্পর্শ অর্থাৎ অনুষ্ণ ও অশীত (গরমও নয়, ঠাণ্ডাও নয়)। এতো বৈচিত্র্য কার সৃষ্টি? (কারুরই নয়;) স্বভাবের জন্যই এগুলি ওই রকম।’
হরিভদ্রর লেখা ‘ষড়্দর্শনসমুচ্চয়’ ব্যাখ্যায় জৈন দার্শনিক গুণরত্ন স্বভাববাদের আরো কিছুটা বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন এবং সেই প্রসঙ্গে আরো কয়েকটি প্রামাণিক লোকগাথা উদ্ধৃত করেছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কিছুটা স্বাধীন তর্জমায় তা উদ্ধৃত করা যেতে পারে–
‘স্বভাববাদীরা নিম্নোক্ত দাবি করবেন। স্বভাব বলতে বোঝায় বস্তুর স্বীয় বা স্বকীয় পরিণাম। স্বভাব-জন্যই সবকিছুর উৎপত্তি; যেমন, মৃত্তিকার পরিণাম ঘট, পট নয়। তেমনি তন্তু বা সুতো থেকে শুধু পটই তৈরি হয়। [শুধুমাত্র মাটি থেকেই ঘট তৈরি হয়, কাপড় বোনা যায় না; তেমনি শুধুমাত্র সুতো থেকেই কাপড় তৈরি হয়, ঘট হয় না। অতএব, মাটির স্বভাবই এমন এবং সুতোরও স্বভাবই এমন যে প্রথমটি থেকে শুধু ঘট এবং দ্বিতীয়টি থেকে শুধু পট তৈরি হয়; অন্যথা তো মটি থেকেও পট এবং সুতো থেকেও ঘট তৈরি হতে পারতো]। স্বভাব ছাড়া এজাতীয় পরিণাম-নিয়মের কোনো ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়। অতএব, সবকিছুই স্বভাবের পরিণাম বলে মানতে হবে। [এ-বিষয়ে লোকগাথা আছে]–
কণ্টককে কে তীক্ষ্ণ করলো?
মৃগ-পক্ষীদের এত বৈচিত্র্যই বা কার সৃষ্টি?
এ সবই স্বভাব থেকে উৎপন্ন;
এগুলি কারুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরিণাম নয়।।
.
খেজুর গাছের কাঁটা তীক্ষ্ণ,
কোনোটা ঋজু, কোনোটা বাঁকা।
কিন্তু (গাছটার) ফল গোলাকার।
এসব আর কার সৃষ্টি– বলতে পারো?
‘অন্যান্য পরিণামের কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল। এমনকি স্বভাব ছাড়া মুগডালও (মুদ্গ) সেদ্ধ হয় না। রান্নার পাত্র, চুল্লির আগুন, ফোটাবার সময় (কাল) প্রভৃতি সমস্ত আয়োজন-উপকরণ সত্ত্বেও কাঁকরের মুগডাল (‘কঙ্কদুকমুদ্গ’? ডালের মতো দেখতে কাঁকর) সেদ্ধ সম্ভব নয়। অতএব, যার অভাবে কিছুর উৎপত্তি হয় না এবং যার উপস্থিতিতে উৎপত্তি হয়– উভয় দিক থেকেই স্বভাবকেই কারণ বলে মানতে হবে। [অর্থাৎ, স্বভাবই কারণ; কেননা স্বভাব থাকলে ঘটনাটা ঘটে, না থাকলে ঘটে না : মুগডালের স্বভাবই এমন যে তা সিদ্ধ হয়; (ডালের মতো দেখতে) কাঁকরের স্বভাবই এমন যে তা সেদ্ধ হয় না।] অতএব, মুগডাল যে সেদ্ধ হয় তারও কারণ স্বভাব। তাই স্বীকার করতে হবে, সব ঘটনারই কারণ বলতে ‘স্বভাব’।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-১১২-৩)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অন্তত কালক্রমে লোকায়ত বা চার্বাকমতে স্বভাবই সব ঘটনার কারণ বলে স্বীকৃত। এককালে এই স্বভাবের ব্যাখ্যায় কিছু প্রামাণিক লোকগাথাও প্রচলিত ছিলো। এবং ঈশ্বরবাদ ছাড়াও কর্মফলবাদের পক্ষ থেকে নানা দার্শনিক স্বভাববাদ খণ্ডন করার সাধ্যমতো চেষ্টাও করেছেন। তাঁদের এই খণ্ডন প্রচেষ্টা যে মূলত অদৃষ্ট অনুমান-ভিত্তিক কার্য-কারণ ভাবের উপর প্রতিষ্ঠিত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু চার্বাকেরা অদৃষ্ট অনুমান-ভিত্তিক কার্য-কারণ সম্বন্ধ স্বীকার করেন না।