জর্জ বার্কলের জীবনী ও রচনাবলী (George Berkeley's Life and writings) (1685-1753)
জর্জ বার্কলের জীবনী :-
১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই মার্চ আয়ারল্যান্ডের কিলকেন্নি (Kilkenny in Ireland) নগরে বার্কলে জন্মগ্রহণ করেন। বার্কলের পিতা-মাতা আইরিশ হলেও তাঁদের পূর্বপুরুষগণ ইংরেজ ছিলেন। কিলকেন্নি বিদ্যালয়ে (Kilkenny School) বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে বার্কলে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজে (Trinity College in Dublin) ভর্তি হন এবং সেখানে ভাষাতত্ত্ব, গণিতশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ট্রিনিটি কলেজে ‘ফেলো’ (fellow) এবং টিউটররূপে (tutor) তের বৎসরকালক নিযুক্ত থাকেন। এই সময়ে তিনি তাঁর মূল্যবান গ্রন্থগুলি রচনা করেন। বাস্তবিক পক্ষে, বার্কলের কম বয়সের রচনাগুলিই –২২ বৎসর থেকে ২৮ বৎসর বয়সের রচনাগুলিই-উৎকৃষ্ট রচনা, ২৮ বৎসরের পরবর্তীকালের রচনাগুলির গুরুত্ব অপেক্ষাকৃত কম*।
১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে বার্কলে ট্রিনিটি কলেজ থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে লন্ডনে বসবাস করেন। এইসময় তিনি তৎকালীন পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে—সুইফট (Swift), স্টিলে (Steele), অ্যাডিসন, পোপ প্রমুখের সঙ্গে—ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। এরপর কিছুদিন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ– ফ্রান্স, ইটালি প্রভৃতি কয়েকটি দেশ পরিভ্রমণের পর আয়ারল্যান্ডের ট্রিনিটি কলেজে সিনিয়র ফলোরূপে (Senior Fellow) যোগদান করেন। ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফেলোশিপ (fellow ship) পরিত্যাগ করে উচ্চ বেতনে বাৎসরিক ১৫০০ পাউন্ড বেতন, ডেরীর ডিম্ (Dean of Derry) পদে নিযুক্ত হন।
ডেরীর ডিন্ পদে নিযুক্ত থাকার কিছুদিন পর বার্কলে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে লন্ডন যাত্রা করেন। উদ্দেশ্যটি হল— আমেরিকার প্রত্যন্ত দ্বীপ বারমুডায় (island of Bermuda) একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের এবং নিগ্রোদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে তাদের শিক্ষিত ও সভ্য করে তোলা এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের ইংরেজ সরকারের কাছে কিছু অর্থসাহায্য লাভ করা। বারমুডা দ্বীপে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি ইংরেজ জনসাধারণেরা বিপুলভাবে সমর্থিত হয় এবং বার্কলে জনগণের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ চাঁদারূপে (subscription) সংগ্রহ করেন। ইংরেজ সরকারও ২০,০০০ পাউন্ড অনুদান (grant) দিতে সম্মত হন। কিন্তু ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুত অর্থ দিতে বিলম্ব করায় বার্কলে তার নব-বিবাহিত স্ত্রীরে সঙ্গে নিয়ে আমেরিকায় গমন করেন এবং বারমুডার পরিবর্তে রোডে দ্বীপের অন্তর্গত নিউপার্ট-এ (Newport in Rhode island) সস্ত্রীক বসবাস করেন। রোডে দ্বীপের অধিবাসীদের কাছ থেকে বার্কলে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন এবং তাঁর দার্শনিক অভিমতের অনুরাগী অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং কলেজের অধ্যাপকের সঙ্গে— ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হন। মনোরম ও কাঙ্ক্ষিত পরিবেশে বার্কলে রোড-এ দ্বীপে ৩ বৎসরকাল অতিবাহিত করেন।
বিদেশে থাকার জন্য এবং তিন বৎসর যাবৎ ব্যক্তিগতভাবে বারমুডা কলেজের ব্যাপারে তদারক না করার জন্য ইংরেজ সরকার, বিশেষ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট ওয়ালপোল, (Sir Robert Walpole) বারমুডা পরিকল্পনার জন্য বরাদ্দ অর্থ (২০,০০০ পাউণ্ড) প্রদান করতে অযথা বিলম্ব করেন। বরাদ্দ অর্থ কোনদিন পাওয়া যাবে না, এটা অনুমান করে বার্কলের বন্ধুবর্গ তাঁকে (বার্কলেকে) সেই বার্তা জানালে ভগ্ন হৃদয়ে বার্কলে ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে প্রত্যাবর্তন করেন।
এরপর ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের অন্তর্গত ক্লয়েন-এর ধর্মযাজক রূপে (Bishop of Cloyne in South Ireland) নির্বাচিত করা হলে, অবসর জীবন যাপনের জন্য, বার্কলে তাতে সম্মত হন এবং বাকি জীবন সেখানেই অতিবাহিত করেন। এইসময় বার্কলে স্থানীয় ক্ষেত খামারের দরিদ্র চাষী-মজুরদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেন এবং বাকি সময় বিদ্যার্জনে ও গ্রন্থ রচনায় অতিবাহিত করেন। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল – এই সময় বার্কলে আলকাতরা থেকে পরিশুদ্ধ জল নিয়ে (tar-water) গভীরভাবে গবেষণা করেন। আমেরিকায় অবস্থানকালে তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেখানকার অধিবাসীরা বসন্ত রোগের (Smallpox) প্রতিষেধকরূপে আলকাতরা-পরিষোধিত জলকে ব্যবহার করে এবং সুফলও লাভ করে। একদা ক্লয়েন-এ (cloyne) বসন্তরোগ মহামারীরূপে দেখা দিলে তিনি আলকাতরা পরিশুদ্ধ জলকে ঔষধ রূপে ব্যবহার করতে বলেন, কেননা বার্কলের বদ্ধমূল বিশ্বাস হল, ঐ জল একপ্রকার বলবর্ধক ঔষধ যা জীবনীশক্তিকে বৃদ্ধি করে। বার্কলের কথায়, ‘এককাপ আলকাতরা-জল মানুষকে আনন্দিত করে, নেশাগ্রস্ত করে না।” আলকাতরার পরিশুদ্ধ জলের উপকারিতা সম্পর্কে বার্কলে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, Siris। তৎকালে গ্রন্থটি একটি উৎকৃষ্ট গবেষণা-গ্রন্থরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। সাধারণ মানুষও বার্কলের তত্ত্বসংক্রান্ত গ্রন্থগুলি অপেক্ষা Siris গ্রন্থটিকে অনেক বেশি মূল্যবানরূপে গণ্য করে, কেননা গ্রন্থটির একটা প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক দিক আছে যা অপরাপর গ্রন্থের নেই। আলকাতরা পরিশুদ্ধ জল এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, মানুষ যে-কোন অসুখেই ঐ জল ব্যবহার করে এবং তাদের রোগমুক্তিও ঘটে। এমনকি Journal of a Voyage to Lisbon গ্রন্থের মুখবন্ধে হেনরি ফিল্ডিং (Henry Fielding), যিনি আলকাতরা-পরিশুদ্ধ জল পান করে উদরীরোগ (dropsy) থেকে নিরাময় লাভ করেন, এমনও বলেন যে, বার্কলে আবিষ্কৃত আলকাতরা-জল ছাড়া সম্ভবত আর কোন ওষুধ ছিল না যা সেবন করে রোগমুক্ত হয়ে তার পক্ষে গ্রন্থটি রচনা করা সম্ভব ছিল। তবে, তৎকালীন মানুষের ধারণা একপ্রকার হলেও প্রকৃত পক্ষে আলকাতরা পরিশুদ্ধ জলের রোগ নিরাময়-শক্তি ছিল না এবং চিকিৎসার জগতেও ঐ জল দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়নি।
স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে বার্কলে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলি অক্সর্ফোডে বসবাসের ইচ্ছা জ্ঞাপন করে, ক্লয়েন-এর ধর্ম যাজকের পদে ইস্তফা দেবার জন্য, একটি ইস্তফা-পত্রও পেশ করেন। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় জর্জ (George II) বার্কলের যোগ্যতাবিচার করে তাঁর ইস্তফা-পত্রটি নাকচ করেন যদিও অক্সফোর্ডে বসবাসের জন্য সম্মতি প্রদান করেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে বার্কলে সপরিবারে অক্সফোর্ড গমন করেন এবং সেখানে হলিওয়েল স্ট্রিটের একটি বাড়িতে বসবাস করেন। মাত্র কয়েকমাস পরে, ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জানুয়ারী যখন তিনি স্ত্রীর সঙ্গে চা-পানে রত, অকস্মাৎ সবার অজ্ঞাতে বার্কলের হৃৎ-স্পন্দন বন্ধ হয় এবং তিনি যে জীবিত নয়, মৃত, – তা জানা যায় বার্কলের কন্যা বার্কলেকে দ্বিতীয় কাপ চা পান করে দেবার পর। বার্কলের মরদেহ অক্সফোর্ডে Cathedral of Christ Church-এ এসমাধিস্থ করা হয়।
বার্কলের উদার চরিত্রের জন্য তিনি সবার কাছে ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় পাত্র এবং শ্রদ্ধার প্রাত্র। অ্যাটাবেরীর (Atterbury) মতো ছিদ্রান্বেষীও বার্কলে সম্পর্কে প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করে বলেন’, ‘দেবদূত ছাড়া কোন মানুষের যে এমন উপলব্ধি, এত জ্ঞান, এত সারল্য, এত বিনয় থাকতে পারে, বার্কলেকে দেখার আগে আমার জানা ছিল না।” “বার্কলে সম্পর্কে সাধারণভাবে একথাই বলা হয় যে, ‘শিক্ষিত মানুষের মধ্যে বার্কলে হলেন অন্যতম নিখুঁত চরিত্রের ব্যক্তি।
রচনাবলী (Writings)
প্রকাশকাল-ক্রম অনুসারে বার্কলের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলির নাম উল্লেখ করা হল: 1. An Essay towards a New Theory of Vision, (1709) গ্রন্থটিতে বার্কলে মনস্তত্ত্ব সংক্রান্ত কয়েকটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। যথা সমস্যা, বস্তুর আকার ও অবস্থান প্রত্যক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যা। - দূরত্ব প্রত্যক্ষণ সংক্রান্ত
A Treatise concerning the Principles of Human Knowledge, Part I (1710) গ্রন্থটিতে বার্কলে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাঁর সমগ্র তত্ত্বদর্শন সন্নিবেশিত করেন। 3. Three Dialogues between Hylas and Philonous, (1713). গ্রন্থটিতে বার্কলে লক-এর বস্তুবাদ (Realism) খণ্ডন করে ভাববাদ (Idealism) প্রতিষ্ঠা করেন।
8. Alciphron or the Minute Philosopher, (1732). গ্রন্থটিতে বার্কলে খ্রিস্টান ধর্মের স্বপক্ষে এবং ধর্ম-বিরোধীদের বিপক্ষে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন।
৫. The Analyst or a Discourse addressed to an Infidel Mathematician,(17 34). গ্রন্থটিতে বার্কলে মূলত নিউটনের (Newton) রহস্যময় গণিততত্ত্বের (fluxions) সমালোচনায় বলেন, গণিতে এ-প্রকার দুর্ভেয় বিষয় স্বীকার করা গেলে ধর্মের ঈশ্বরকে দুর্জের বললে কোন দোষ হয় না।
৬. The Querist, (1737). গ্রন্থটিতে বার্কলে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসীদের (Irish)
প্রতি নানা উপদেশ – অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উপদেশ–লিপিবদ্ধ করেন।
৭. Siris, (1744) গ্রন্থটিতে বার্কলে আলকাতরা-পরিশুদ্ধ জলের রোগ-প্রতিষেধক শক্তি
সম্পর্কে তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন এবং সেইসঙ্গে কিছু দার্শনিক আলোচনাও সন্নিবেশিত করেন। ৮. Farther Thoughts on Tar-water (1752), সম্ভবত এই গ্রন্থটি বার্কলের সর্বশেষ রচনা, যেখানে আলকাতরা-জল সম্পর্কে তার বিধিসম্মত ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেন।
তথ্যসূত্র
- *History of Western Philosophy. P. 624. B. Russell.1. "The fastidious -- Atterbury is reported to have said of him - so much understanding, so much innocence, so much humility, I did not think had been the portion of any but angels till I saw this gentleman". Locke Berkeley Hume P. 65. C. R. Morris.2. "It has fairly been said of him that he was one of the most perfect chracters among men of letters". Ibid.3. "These are the cups that cheer, but do not inedbriate'. Quotation from Russell's History of Western Philosophy. P. 624.