দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াস



দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াস

এ-পর্যন্ত আলোচনা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য দার্শনিকেরা সবচেয়ে বড় যুক্তি হিসেবে চৈতন্যের নজির দেখাতে চেয়েছেন। আগুন, বাতাস, জল, মাটি– সবই অচেতন বা জড় বস্তু। দেহের উপাদান হিসেবে আর কিছু মানার সুযোগ নেই; অন্তত চার্বাকেরা আর কিছুই মানতে রাজি নন। কিন্তু এই জাতীয় নিছক জড় বা অচেতন বস্তু দিয়ে যা গড়া তাও তো সহজ সরল যুক্তিতে নেহাত অচেতনই হবার কথা। মানুষ তো আর তা নয়। আমাদের মধ্যে চৈতন্যর পরিচয় রয়েছে। তার ব্যাখ্যাটা কী হবে? কিংবা চৈতন্যর পর্যাপ্ত ব্যাখ্যার জন্য দেহ ছাড়াও দেহস্থ চেতন আত্মা স্বীকার না করে উপায় কী?
উত্তরে চার্বাকেরা বলতে চান, উপায় আছে। বস্তুবিশেষ প্রস্তুতের উপাদানগুলিতে স্বতন্ত্র বা মিলিত অবস্থায় কোনো গুণ বা লক্ষণের পরিচয় না থাকলেও সেগুলিরই কোনো একরকম বিশেষ পরিবর্তনের ফলে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ওই গুণ বা লক্ষণের উদ্ভব এমন কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। নজির : মদশক্তি। যেমন মদের গুণ, চৈতন্যও তেমনি দেহেরই গুণ। মদ তৈরির কোনো উপকরণে মদশক্তির পরিচয় নেই। তেমনি দেহ গঠনের কোনো উপকরণেও চৈতন্যের পরিচয় নেই। উভয় ঘটনাই সমজাতীয়।

শুধু শঙ্করাচার্যের কথাই নয়, ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য প্রখ্যাত প্রতিনিধিদের লেখা থেকেও অনায়াসেই বোঝা যায়, দেহাত্মবাদ নিয়ে যত বিতর্ক তার মধ্যে মূল কথা বলতে একটাই। এর সঙ্গে অবশ্য অনেকে অনেক সময় অনেক রকম বাড়তি যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছেন– পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকমত বর্ণনা প্রসঙ্গেও করেছেন, খণ্ডন প্রসঙ্গেও। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এ-প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন,–
অত্যুক্তির অপবাদ না কুড়িয়েও বলা যায়, অনেকে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি ও যুক্তিকৌশলের উৎকর্ষ দেখাবার উৎসাহেই করেছেন বলে সন্দেহের অবকাশ আছে। কেননা, চার্বাকদের পক্ষে যে-ধরনের কূট তর্ক আদপেই তোলবার দরকার ছিলো না, স্বাভাবিকও নয়, এমনতর অনেক কথাই দেহাত্মবাদের বিচার প্রসঙ্গে অনেকের লেখায় চোখে পড়ে। উৎসাহী-পাঠকেরা তার নমুনা হিসেবে প্রভাচন্দ্র, শান্তরক্ষিত, কমলশীল বা গুণরত্নের বিস্তৃত আলোচনা উলটে দেখতে পারেন। কিন্তু কথা হলো, চার্বাকপক্ষ থেকে দেহাত্মবাদের সমর্থনে যেটা সবচেয়ে মোক্ষম নজির বলে মনে করার পর্যাপ্ত কারণ আছে– অর্থাৎ ওই মদশক্তির নজির– তা বাস্তবিকই খণ্ডন করবার চেষ্টা কতটুকু সার্থক হয়েছে? এই নজির খণ্ডন করতে না-পারলে হাজারো রকম কূট তর্কের অবতারণা করলেও দেহাত্মবাদ কি সত্যিই খণ্ডন করা যায়?’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮২)

এক্ষেত্রে আমরা একান্তই আগ্রহী পাঠকের জ্ঞাতার্থে প্রথমে এ-ধরণের যুক্তি-তর্ক বিস্তারের কিছু সংক্ষিপ্ত নমুনা উপস্থাপন করতে পারি দার্শনিক-নজির সংরক্ষণের বাড়তি খেয়ালে। কেননা আমাদের ভুলে গেলে চলে না যে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে দেহ ও আত্মা বিষয়ক বিতর্কটাই আসলে সবচেয়ে মৌলিক প্রপঞ্চ এবং তার উপরেই মূলত স্ব-স্ব দর্শনগুলির অন্য সব তত্ত্ব উপস্থাপনের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। এই নমুনা উপস্থাপন শেষে, এরপর, চার্বাকী দেহাত্মবাদী সিদ্ধান্ত যাচাই ও পর্যালোচনা করে উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার একটা যৌক্তিক উপায় অন্বেষণ করে সে-মোতাবেক এগিয়ে যাবার প্রয়াস নেবো। উল্লেখ্য, দেহাত্মবাদ খণ্ডনে বিভিন্ন দার্শনিকদের যুক্তি বিস্তারের নমুনা চয়নে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রধানত লতিকা চট্টোপাধ্যায়ের ‘চার্বাক দর্শন’ গ্রন্থে উপস্থাপিত রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

.
দেহাত্মবাদ খণ্ডনে তর্ক ও যুক্তি বিস্তার :
১.
সাংখ্যাচার্য বিজ্ঞানভিক্ষু তাঁর ‘সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য’ গ্রন্থে (সাভা-৩/২০, ২২) দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে চার্বাকপক্ষের মদশক্তিবৎ দৃষ্টান্তে ত্রুটি প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে বাইরে প্রকাশ না পেলেও সূক্ষ্ম মাদকাশক্তি সুরার উপাদান হিসেবে বর্ণিত দ্রব্যগুলির মধ্যে বর্তমান থাকে এবং এই শক্তি সমষ্টিগতভাবে পরে মাদকতা উৎপাদনের কাজে সহায়তা করে। বিজ্ঞানভিক্ষুর সমালোচনা এক্ষেত্রে চার্বাকী দৃষ্টান্তকে কতোটা আঘাত করে সেটা বিবেচনার বিষয়, কারণ চার্বাকপক্ষ থেকে প্রত্যুত্তর আসতে পারে যে সুরার উপাদানে বর্তমান অদৃশ্য মাদকশক্তির মতো জীবদেহের উপাদানেও আমরা প্রচ্ছন্ন চৈতন্যশক্তির অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারি।
এ ধরনের চার্বাকী প্রত্যুত্তরের সম্ভাবনাকে বিজ্ঞানভিক্ষুও পরিহার করতে পারেননি। কিন্তু যে যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তিনি একে অতিক্রম করার চেষ্টা করেছেন, তাকে প্রকৃষ্ট যুক্তির পরিবর্তে পূর্ব-স্বীকৃত অধ্যাত্ববাদী ধারণার অনুকথনই বলা চলে। যুক্তি এখানে আবরণমাত্র। তিনি বলেন যে জীবদেহ সমষ্টিগতভাবে যে ভৌতিক উপাদানে গঠিত সেই উপাদানের সমষ্টির প্রত্যেক অবয়বে সূক্ষ্মভাবে চৈতন্যের উপস্থিতি অনুমান করলে বহুসংখ্যক চৈতন্যশক্তির অবস্থিতি স্বীকার করতে হয় এবং এতে যে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে, সাংখ্য এবং সহযোগী অপর ভারতীয় দর্শনগুলির অনুমোদিত নিত্য এবং অখণ্ড চৈতন্যস্বরূপের কল্পনায় তা দূর হওয়া সম্ভব। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে জীবদেহের উপাদানে ব্যষ্টিগতভাবে অদৃশ্য চৈতন্যশক্তির কল্পনা সমীচীন হয় না।

বিজ্ঞানভিক্ষু বলেন (সাভা-৫/১৩০), চৈতন্যকে যাঁরা দেহের গুণ বলেন আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁরা এ-ক্ষেত্রে ঘটের দৃষ্টান্তের অবতারণা করে দেখান যে জল আহরণ করা ইত্যাদি ঘটধর্ম ঘটের উপাদান মৃত্তিকাতে থাকে না। কিন্তু জীবদেহে সচেতনতার অভিব্যক্তির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এ দৃষ্টান্ত একান্তই দুর্বল এবং এটা গ্রহণ করার বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বিজ্ঞানভিক্ষু বলেন যে ভৌতিক পদার্থে বিশেষ কোন গুণের সৃষ্টি সব সময়ে স্বজাতীয় কারণ গুণের সাহায্যে হয়। কাজেই উপাদান কারণে চৈতন্য না থাকলে দেহে চৈতন্যের উপস্থিতি অকল্পনীয়।

২.
চৈতন্য এবং দেহের মধ্যে কার্যকারণভাবের বিদ্যমানতা অস্বীকার করার সময় বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলও অনুরূপ যুক্তির অবতারণা করেছেন। তিনি তাঁর ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় বলছেন–
‘যত্র যদ্ভাবসিদ্ধৌ ন কিংচিৎ প্রমাণমস্তি ন তত্র তদ্ব্যবহারঃ প্রেক্ষাবতা কার্যঃ, যথা বহ্নৌ শীতব্যবহারঃ। নাস্তি চ বুদ্ধিদেহয়োঃ কার্যকারণভাবসিদ্ধৌ কিংচিৎ প্রমাণম্’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা, পৃঃ-৫২৫)
অর্থাৎ : বিশেষ কোন গুণের কোন বস্তুতে সদ্ভাবের পক্ষে কারণ না থাকলে বস্তুটিকে ঐ বিশেষ গুণের সঙ্গে কার্যকারণসম্বন্ধে আবদ্ধ করা যেতে পারে না, যে জন্য আগুনে আমরা শৈত্য আরোপ করতে পারি না। জ্ঞান এবং দেহের কার্যকারণভাব সিদ্ধির পক্ষে কোন প্রমাণ না থাকায় চার্বাক-অভিপ্রেত এই কার্যকারণভাবে পক্ষে কোন যুক্তি নেই।

এই প্রসঙ্গে ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’তে সাধারণভাবে কার্যকারণ সম্বন্ধ বিচারিত হয়েছে। কমলশীল বলেন–
‘যেষামুপলম্ভে সতি উপলব্ধি লক্ষণ প্রাপ্তম্ পূর্বমনুপলব্ধং সদ্ উপলভ্যতে ইত্যেবমাশ্রয়নীয়ম’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা, পৃঃ-৫২৫)
অর্থাৎ : কোন একটি বস্তুর বর্তমানতায় উপলব্ধি লক্ষণযুক্ত অথচ পূর্বে অনুপলব্ধ অপর একটি পদার্থ যদি উপলব্ধিগোচরে আসে, তাহলে প্রথম বস্তুটিকে দ্বিতীয়টির কারণ বলা যেতে পারে।

এই কার্যকারণতার বিচার অন্যভাবেও করা চলে। কমলশীল বলছেন, দুটি বস্তু বা ঘটনার তুলনামূলক পর্যালোচনায় যদি দেখা যায় যে প্রথমটির ভিতর দ্বিতীয়টির উৎপাদনের উপযোগী বিভিন্ন উপাদানের বর্তমানতা সত্ত্বেও বিশেষ একটি উপাদানের অভাবে দ্বিতীয়টির আবির্ভাব সম্ভব হয় না; সদ্ভাবে হয়, তাহলে–
‘সৎসু তদন্যেষু সমর্থেষু তদ্ধেতুষু যস্যৈকস্যাভাবে ন ভরতীত্যেবং আশ্রয়নীয়ম্’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা, পৃঃ-৫২৬)
অর্থাৎ : যে বিশেষ উপাদানের সদ্ভাবে দ্বিতীয়টির উৎপন্ন বা উপলব্ধি হয় তাকেই দ্বিতীয়টির কারণ হিসেবে নির্দেশ করা উচিত, অপরগুলিকে নয়।

যে কোন দুটি পদার্থের পারস্পরিক কার্যকারণভাবের সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য এই সদ্ভাব এবং অভাবগত উভয়বিধ মানেই প্রথমে বিচার করা প্রয়োজন। একমাত্র এই উপায়ের মাধ্যমেই কারণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে সেই উপাদানকে যার বিশেষ উপস্থিতি আলোচ্য কার্যগুণকে উৎপন্ন করেছে।
কমলশীলের মতে দেহকে মনোগত বিজ্ঞানের কারণ হিসাবে নির্দেশ করার ব্যাপারে এই উভয় প্রকার মানের প্রয়োগ সম্ভব নয়। সদ্ভাবগত মানে বিচারের প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে ভ্রূণ অবস্থায় দেহের সঙ্গে মনের সম্বন্ধের বিষয়ে কিছু বলা অসম্ভব, কারণ ভ্রূণের মানসিক শক্তির বিকাশ হয় না। যে কোন বস্তু পর্যবেক্ষণ করার ব্যাপারে এই বিকাশের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অপর প্রাণীর মন কেউ পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম নয়; কাজেই সে ক্ষেত্রেও দেহ এবং মনের কার্যকারণ সম্বন্ধের বিচার করা চলে না। অভাবগত মানের সম্ভাব্যতার বিপক্ষে বলা যেতে পারে যে শরীরের বিনাশের সঙ্গে একযোগে মনেরও বিলোপ হয় কিনা কারও পক্ষে দেখা সম্ভব নয়, সে শরীর নিজেরই হোক বা অপরেরই হোক। মৃতদেহে গতিশীলতার অভাব থেকে মৃত ব্যক্তির মনোগত বিজ্ঞানের বিনাশ কল্পনা করা অসঙ্গত। কারণ, অপর কোন হেতুর অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে পরিহার করা চলে না, যা মৃত্যুর পরেও বর্তমান এই মানসিক বিজ্ঞানকে মৃতদেহে সচলতা সৃষ্টির পথে বাধা দেয়। কমলশীল এ ব্যাপারে বৌদ্ধ মত ঘোষণা করে বলেন যে মৃত্যুর পূর্বে প্রাণীদেহে অধিষ্ঠিত বিজ্ঞানের বর্তমানতা প্রাণীটির মৃত্যুর পরেও অনস্বীকার্য। কিন্তু এই বিজ্ঞানের অস্তিত্ব সত্ত্বেও মৃত প্রাণীর দেহে সচলতার অভাবের কারণ দেখাতে গিয়ে তিনি বলেন যে মৃত্যুর পূর্বে ঐ বিশেষ দেহটিকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানগত বাসনা ও অবিদ্যার রূপায়ণের যে প্রয়োজন ছিল, সেই প্রয়োজনবোধ তখন লুপ্ত এবং সেইজন্যই দেহটিকে পরিচারিত করার ক্ষমতা বিজ্ঞানটির তখন আর থাকে না।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৯৭)

আমরা নিশ্চয়ই টের পেতে শুরু করেছি যে দেহাত্মবাদের দার্শনিক যুক্তিবিচার কোত্থেকে কোনদিকে বিস্তারিত হতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত এখানে দার্শনিক পরিভাষার ‘জ্ঞান’ শব্দটি সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা রাখা আবশ্যক। ব্যবহারিক জগতে কোন বিষয় বা বস্তুকে জানার মধ্যে দিয়ে জ্ঞানের প্রকাশ দেখা যায়। বহির্জগতের কোন বস্তুর বিশেষ রূপ যখন আমাদের অন্তর্লোকে প্রতিভাত হয়, তখন আমরা সেই বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করি। ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন অনুসারে জ্ঞানের এই সব ব্যক্তিগত প্রকাশ প্রকৃতপক্ষে নিত্যজ্ঞানস্বরূপ আত্ম-চৈতন্যের বিশেষ অভিব্যক্তি। বৌদ্ধরা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, তাঁদের মতে ক্ষণিক বিজ্ঞানপ্রবাহ এই ব্যষ্টি জ্ঞানের আশ্রয়। কিন্তু এ বিষয়ে উভয় শ্রেণীর দার্শনিকেরাই একমত যে মনের এই সচেতন অভিব্যক্তিকে জড় দেহের সঙ্গে একাত্ম করা চলে না এবং এদের উৎপত্তির কেন্দ্র হিসেবে বাহ্যবস্তুনিরপেক্ষ চৈতন্যের বৃহত্তর প্রবাহকে নির্দেশ করা উচিত।

বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিত এবং কমলশীল তাঁদের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থে যখন লোকায়ত মত নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত তখন বৌদ্ধ পরিভাষা অনুসারে ‘জ্ঞান’ ‘মনোধী’ ‘মনোবুদ্ধি’ ইত্যাদি শব্দেরই তাঁরা ব্যবহার করেছেন ‘চৈতন্য’, ‘আত্মা’ ইত্যাদি শব্দের পরিবর্তে। এই প্রসঙ্গে তাঁরা চার্বাক মতের বিবরণ দিয়েছেন কম্বলাশ্বতর নামে এক লোকায়তিকের মত উদ্ধৃত করে। এই মত অনুসারে–
‘কায়াদেব ততো জ্ঞানং প্রাণাপানাদ্যধিষ্ঠিতাৎ, যুক্তং জায়ত ইত্যেতং কম্বলাশ্বতরোদিতস’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৮৬৪)
অর্থাৎ : কম্বলাশ্বতর বলেন– প্রাণ, অপান ইত্যাদি বায়ুর দ্বারা অধিষ্ঠিত দেহ জ্ঞানের আশ্রয়।
কিন্তু, শান্তরক্ষিত বলেন, চার্বাক মতে জ্ঞানের একমাত্র প্রকাশ অর্থাবগতির মধ্যে। যেমন–
‘ন চার্থাবগতেরন্যদ্রূপং জ্ঞানস্য যুজ্যতে’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৮৬৬)
অর্থাৎ : অর্থাবগতি ছাড়া জ্ঞানের প্রকাশ সম্ভব নয়।

‘অর্থ’ এখানে বাহ্য বিষয়ের দ্যোতক এবং ‘অর্থাবগতি’ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বাহ্য বস্তুর প্রকাশনাকে বোঝায়। চক্ষু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্য বস্তুর রূপ আমাদের অবগতিতে আসে এবং সেই রূপ সম্বন্ধে আমরা জ্ঞান লাভ করি। অনুরূপভাবে কর্ণ ইত্যাদি অন্য ইন্দ্রিয়গুলির মাধ্যমে আমরা বাহ্য বিষয়ের শব্দ ইত্যাদি জ্ঞাত হই। চার্বাকমতে এই অর্থাবগতি যেখানে নেই জ্ঞানেরও সেখানে অভাব। সেইজন্য সুপ্তি বা মূর্ছা অবস্থাতে জ্ঞানের অস্তিত্ব লোকায়তরা স্বীকার করেন না। তাই, প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্থের প্রকাশনার মধ্যেই চার্বাকেরা জ্ঞানর সীমানা নির্দিষ্ট রাখেন বলে কমলশীলের মন্তব্য–
‘ইন্দ্রিয়ার্থবলোদ্ভূতং সর্বং বিজ্ঞানম্’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯২১)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) সকল জ্ঞানের উদ্ভব ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অর্থের প্রকাশের মধ্যে।

এই মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে কমলশীল বলেন যে, আমাদের স্বপ্নাবস্থার জ্ঞানের উপযুক্ত কারণ চার্বাকী বিবরণে নির্ণীত হয়নি। স্বপ্নে আমরা যা দেখি ইন্দ্রিয় বা বাহ্য অর্থের উপস্থিতি ব্যতীতই তা আমাদের মনে প্রতিভাত হয়। স্বপ্নাবস্থার এই জ্ঞানকে মনোবিজ্ঞান বলা চলে। এই মনোবিজ্ঞান স্বনির্ভর এবং ইন্দ্রিয় অথবা বাহ্য বস্তুর কোন অপেক্ষা রাখে না। স্বপ্নে বা অন্য অবস্থায় এই স্বনির্ভর বিজ্ঞানের সুপরিস্ফুট অস্তিত্ব থেকে বিজ্ঞান কেবলমাত্র অর্থাবগতির মাধ্যমে প্রতিভাত– লোকায়তদের এই উক্তি নিরর্থক প্রমাণিত হয়।
কমলশীলের বিবরণী পাঠে বোঝা যায় যে সুপ্তি, মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থাতে চিত্তের স্ববেদনানুপলম্ভ বা অনুপলব্ধিই চেতনার তৎকালীন অবর্তমানতার সিদ্ধান্তে চার্বাকদের উপনীত হতে সাহায্যে করেছে। স্বসংবেদনের অনুপলব্ধির মূলে আছে উদাহৃত অবস্থাগুলিতে সংবেদনার অস্তিত্বে নিশ্চয়তাবোধের অভাব। কমলশীলের মতে চিত্তের স্বসংবেদন সম্বন্ধে যে নিশ্চয়তাবোধের অভাব চার্বাকদের এই ধারণার ভিত্তি, সেই অভাবই প্রকৃতপক্ষে সুপ্তি, মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থায় চিত্ত বা মনের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে।

শান্তরক্ষিত এবং কমলশীলের রচনায় এ প্রসঙ্গে সুদীর্ঘ আলোচনা রয়েছে যেখানে প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য উত্তর এবং সেই উত্তরগুলিরও প্রত্যুত্তর লিপিবদ্ধ হয়েছে। চার্বাক পক্ষ থেকে বৌদ্ধমতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে আপত্তি দেখানো হয় যে, জাগরিত অবস্থায় আমরা নিদ্রা বা মূর্ছাকালীন বিজ্ঞানকে যে স্মরণ করতে পারি না তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে নিদ্রাগত বা মূর্ছিত অবস্থায় বৌদ্ধস্বীকৃত বিজ্ঞানের সদ্ভাবের ধারণা ভ্রান্ত।
শান্তরক্ষিত উত্তরে বলেন যে অস্তিত্ব সত্ত্বেও জ্ঞানের অস্পষ্টতা এই অস্মরণের প্রকৃত কারণ। কমলশীল এ প্রসঙ্গে স্বপক্ষের বক্তব্য আরও বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত করেন। নিদ্রা বা মূর্ছাভঙ্গের পর মানুষের যে প্রথম বোধ হয় তার জনক বাহ্যবস্তুনিরপেক্ষ এই কারণ বিজ্ঞান, নিদ্রা বা মূর্ছা অবস্থাতেও যার অস্তিত্ব অব্যাহত ছিলো। পূর্ব অভিজ্ঞতার স্মরণকালে স্মৃতির উদ্ভবের সময়েও এই কারণ বিজ্ঞানেরই কার্যকরিতা দেখা যায়। কমলশীল আরও বলেন যে সুপ্তি, মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থায় এ ধরনের কোন বিজ্ঞানের যদি অস্তিত্ব না থাকতো তাহলে ঐ অবস্থাগুলি মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত হতো।

কিন্তু লোকায়তবাদীরা এ প্রসঙ্গে বলতে চান যে উদাহৃত অবস্থাগুলিতে বিজ্ঞানের অস্তিত্ব লুপ্ত হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু হয় না, কারণ জাগরণকালে আবার সম্পূর্ণ নতুন বিজ্ঞানের আবির্ভাব হয়। উত্তরে ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’তে (পঞ্জিকা-১৯২৮-৩০) বলা হয়েছে যে, এভাবে নতুন বিজ্ঞানের উৎপত্তি স্বীকার করলে মানুষের মৃত্যু কোন রকমেই ব্যাখ্যা করা চলে না। কারণ নতুন বিজ্ঞানের উদ্রেকে যেখাবে মানুষের নিদ্রা বা মূর্ছা ভঙ্গ হয়, সেইভাবে তার মৃত অবস্থারও অবসান হতে পারে এবং এভাবে মৃত ব্যক্তির পক্ষে পুনরায় জীবিত হবার পথে কোন বাধা থাকে না। মোট কথা, চার্বাক মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে বৌদ্ধ দার্শনিকদ্বয় এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হন যে–
‘স্বতন্ত্রা মানসী বুদ্ধিশ্চক্ষুরাদ্যনপেক্ষণাৎ, স্বোপাদানবলেনৈব স্বপ্নাদাবিব বর্ততে’। (তত্ত্বসংগ্রহ-১৯২৯)
অর্থাৎ : সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র মানসী বুদ্ধি বা মনোগত বিজ্ঞান ইন্দ্রিয় অথবা বাহ্য বিষয়ের অপেক্ষা না রেখেই স্বীয় অস্তিত্বে বিরাজমান।

এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে তাঁরা বাস্তবে অসম্ভব আকাশ-কুসুম ইত্যাদি ধারণার উদাহরণ দেন। কারণ, তাঁরা বলতে চান (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯৩১-২), এই জাতীয় জ্ঞানের আবির্ভাবের ঠিক পূর্ববর্তী ঘটনা হিসেবে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বাহ্য বস্তুর যোগগুলিকে কখনোই নির্দেশ করা চলে না এবং চিত্তস্থিত পূর্ববর্তী এক ধারণার কার্যকরিতা সব সময়ে এই জ্ঞানে প্রভাব বিস্তার করে। সে ধারণার অনুপস্থিতিতে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সংযোগে কোনক্রমেই এ জ্ঞান সম্ভব হয় না।
দেহ যদি এই মনোবুদ্ধির উৎস হতো তাহলে দেহগত বৈকল্যের ফলে মানসিক বিজ্ঞানেরও বিকলতা দেখা যেতো। এ ছাড়াও হস্তী ইত্যাদি বৃহৎ শরীরধারী জীবের মানসিক ক্ষমতার কাছে ক্ষুদ্রতর অবয়ব বিশিষ্ট মানুষের মনের শক্তি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হতো। কমলশীল এক্ষেত্রে যুক্তি দেখান যে, একটির পরিবর্তন বা তারতম্যের উপর অপরটির পরিবর্তন বা তারতম্য নির্ভরশীল না হলে প্রথমটিকে দ্বিতীয়টির কারণ বলা চলে না। স্বতন্ত্র মনোবিজ্ঞানের অস্তিত্বের বিরোধী চার্বাকেরা যদি ইন্দ্রিয়সমষ্টি যুক্ত দেহতেই কেবল মনের কারণতা আরোপ করেন, তাহলেও তাঁদের মত গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ, সে ক্ষেত্রে যে কোন ইন্দ্রিয়ের হানি হলেই মানসিক শক্তির বৈলক্ষণ্য দেখা দিতো। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা এর বিপরতীত সাক্ষ্যই বহন করে। ফলে কমলশীল বৌদ্ধমতের সমর্থনে বলেন–
‘প্রসুপ্তিকারোগাদিনা কার্যেন্দ্রিয়াদীনামুপঘাতেহপি মনোধীর বিকৃতৈকাবিকলাং স্বসত্তামনুভবতী’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯৩৪)
অর্থাৎ : পক্ষাঘাত ইত্যাদি ব্যাধিতে কর্মেন্দ্রিয়গুলির সব রকম কার্যক্ষমতা বিনষ্ট হলেও মন তার পূর্ণ শক্তিতে সজীব থাকে।

আবার অনেক সময় শারীরিক অবস্থা সম্পূর্ণ অবিকৃত থাকা সত্ত্বেও মানসিক প্রকৃতির অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে অবশ্য শারীরিক অবস্থা মানসিক ভাবকে কিছুটা প্রভাবান্বিত করে; কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে মনের বিনাশ শরীরের বিলোপের উপর নির্ভরশীল।

চার্বাকেরা হয়তো বলতে পারেন যে দেহ এবং মনোবিজ্ঞানের সহস্থিতি দেহকে এই বিজ্ঞানের কারণ হিসেবে চিন্তা করার একটি প্রধান কারণ। কিন্তু মনোবিজ্ঞান যেমন দেহের সঙ্গে সব সময়ে একত্র অবস্থান করে, দেহও সেইরকম মানসিক জ্ঞানের সঙ্গে সর্বদা একত্রবর্তী; কাজেই যে যুক্তির বলে দেহ মনের কারণ হিসেবে নির্দেশিত, সেই একই যুক্তির প্রভাবে মনোবিজ্ঞানও দেহের কারণরূপে বিবেচিত হতে পারে।
কমলশীলের মতে (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৯৩৪), কেবলমাত্র সহস্থিতি থেকেই কার্যকারণতার বিচার অযৌক্তিক; কারণ, দুটি পদার্থের সহস্থিতিভাবের মূলে তৃতীয় অপর একটি পদার্থের উপস্থিতির সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা চলে না। কাজেই বিজ্ঞানের দেহমূলকতা সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণা বৌদ্ধ মতে গ্রহণযোগ্য নয় এবং দেহ বিনষ্ট হলেও এই বিজ্ঞানের লুপ্ত হবার কোন আশঙ্কা নেই বলে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা মনে করেন।

৩.
ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা অবশ্য চার্বাকী অভিমতকে প্রতিহত করার জন্যেই এক্ষেত্রে ‘বিজ্ঞান’ বা ‘মনোবুদ্ধি’ পদের পরিবর্তে ‘চৈতন্য’ শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। জীবদেহ যে জীব-চৈতন্যের উৎস তার সমর্থনে চার্বাকদের যুক্তি এঁরা প্রথমে লিপিবদ্ধ করেছেন এবং পর স্বপক্ষীয় যুক্তির সাহায্যে এই চার্বাকী যুক্তি প্রতিরোধে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে এই আলোচনার পূর্বভাগে অদ্বৈত বৈদান্তিক শঙ্করাচার্যের ‘ব্রহ্মসূত্রভাষ্য’ বা ‘শাঙ্করভাষ্য’-এ শঙ্কর-বর্ণিত চার্বাকী দেহাত্মবাদের বর্ণনার কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।

আচার্য শঙ্করের ভাষ্যগ্রন্থে (শাঙ্করভাষ্য-৩/৩/৫৩) এ প্রসঙ্গে চার্বাকপক্ষের যে যুক্তিগুলি সন্নিবেশিত হয়েছে তার মধ্যে একটি যুক্তি অনুসারে চৈতন্য থেকে ইচ্ছা, দ্বেষ ইত্যাদি যে মনেবৃত্তিগুলির উদ্ভব, সেগুলি আমাদের শরীর মাধ্যমে অনুষ্ঠিত সব কাজে প্রেরণার উৎস হওয়ায়, চৈতন্যকে শরীরের ধর্ম বলে স্বীকার করা উচিত।
এ ব্যাপারে চার্বাকী অন্য একটি যুক্তির বিবরণও শঙ্করাচার্যের গ্রন্থে আছে। যুক্তিটি এই রকম– কোন বস্তু বর্তমান থাকলে যা দৃশ্য, কিন্তু বস্তুটি অবর্তমানে যা অদৃশ্য, তাকে ঐ বস্তুর ধর্ম বা গুণ বলে ধরে নিতে হয়। উষ্ণতা, দীপ্তি ইত্যাদিকে অগ্নিধর্ম বলা চলে এই যুক্তিরই অনুসরণে; কারণ, আগুনের উপস্থিতিতেই এদের বর্তমানতা, আগুন না থাকলে নয়। প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি ইত্যাদি সচেতনতার যে সব প্রকাশকে আত্মবাদী দার্শনিকেরা আত্মার ধর্ম বলে মনে করেন সেগুলি প্রকৃতপক্ষে দেহতেই বর্তমান এবং দেহের অনুপস্থিতিতে এদের কোন অস্তিত্ব থাকে না; কাজেই এগুলি দেহেরই ধর্ম, দেহব্যতিরিক্ত অন্য কিছুর নয়।

চার্বাকমত খণ্ডন করতে গিয়ে স্বভাবসুলভ সহজ-সরল যুক্তি বিস্তার করে শঙ্করাচার্য বলেন, কোন একটি বস্তুর বর্তমানতার সঙ্গে আর একটির উপস্থিতি জড়িত থাকতে দেখা গেলেই প্রথম বস্তুটিকে দ্বিতীয়টির কারণ হিসেবে নির্দেশ করা চলে না। কাজেই উপরের যুক্তির অনুসরণে সেই গুণগুলির প্রতিদ্বন্দ্বী বা বিরোধী গুণান্তর অনেক ক্ষেত্রেই বর্তমান থাকতে দেখা যায়। শ্যামবর্ণ ও রক্তবর্ণ এইভাবে দ্রব্যবর্তী পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি গুণ। প্রতিদ্বন্দ্বী এই উভয় গুণের এক দ্রব্যে একই সময় অবস্থান সম্ভব নয়। সেইজন্য কোন একটি গুণ দ্রব্য থেকে বিলীন হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অপর গুণের দ্রব্যে আবির্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়– যেমন অগ্নিপাককে উপলক্ষ করে ঘটগত শ্যামবর্ণ প্রতিদ্বন্দ্বী রক্তবর্ণে রূপান্তর লাভ করে।
চৈতন্যকে কিন্তু দ্রব্যগত এই ধরনের গুণগুলির সঙ্গে সমপর্যায়ভুক্ত করা চলে না। কারণ, চৈতন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী এমন কোন গুণ দেখা যায় না যার সঙ্গে চৈতন্যের সহাবস্থান সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে চৈতন্য শরীরের গুণ হলে বিনাশের পূর্ব পর্যন্ত শরীর অবশ্যই চৈতন্যযুক্ত থাকতো, কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতার সাক্ষ্যের সঙ্গে এ ধারণার সঙ্গতি থাকে না। কাজেই চৈতন্যকে দেহের ধর্ম বলে স্বীকার করা চলে না।

অন্যান্য দার্শনিকদের মতো অদ্বৈত বেদান্তের প্রবক্তা শঙ্করাচার্য (শাঙ্করভাষ্য-৩/৩/৫) মরণোত্তর প্রাণীদেহে সচেতন অভিব্যক্তির অনুপস্থিতির সাক্ষ্য থেকে চৈতন্যের দেহধর্মতার প্রতিকূলে অভিমত প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে দেহ অবর্তমানে চৈতন্যের অভাব সম্বন্ধে চার্বাকী সিদ্ধান্তকেও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁর মতে রঙ, আকার ইত্যাদি দেহধর্মগুলি দর্শনেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সকলের প্রত্যক্ষযোগ্য, কিন্তু চৈতন্য, স্মৃতি ইত্যাদি সকলের অনুভবগ্রাহ্য নয়। তা সত্ত্বেও প্রাণীর জীবিতকালে প্রাণীদেহে ঐগুলির উপস্থিতি সাধারণভাবে সকলের স্বীকৃত। দেহ ধ্বংস পাবার সঙ্গেই চৈতন্য ইত্যাদিও বিনষ্ট হয়– চার্বাকদের এ ধারণার মূলেও শঙ্করাচার্য প্রমাণের কোন সমর্থন পান না। চার্বাকী সিদ্ধান্তের অনুকূলে প্রমাণের অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে শঙ্করাচার্য ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে অনুমোদিত শ্রুতিপ্রমাণের ভিত্তিতে আত্মা সম্বন্ধে স্বীয় অভিমতকে দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। তাঁর মতে দেহস্থিত এই চৈতন্যের বিনাশ নেই এবং এই চৈতন্যই আত্মা সংজ্ঞায় অভিধেয়। সাধারণত দেহের সঙ্গে যুক্ত অবস্থাতেই কেবল আত্মা আমাদের জ্ঞানের গোচরীভূত, কিন্তু এ থেকে দেহের বাইরে আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করা চলে না।

চৈতন্য আর দেহ যে ভিন্ন ভিন্ন সত্তা তার সমর্থন করে শঙ্কর অন্যত্র বলেন যে, প্রাণী অঙ্গের সর্বত্রই চৈতন্যের ব্যাপ্তি দেখা যায়– হস্ত, পদ ইত্যাদি প্রাণীদেহের প্রত্যেকটি অবয়বই সচেতন। শরীর চৈতন্যের উৎপত্তিস্থল হলে শরীরের প্রতিটি অবয়ব স্বস্থানবর্তী চৈতন্যের জনক হতো এবং এর ফলে একই শরীরে বহু চৈতন্য সৃষ্টির প্রসঙ্গকে পরিহার করা সম্ভব হতো না। প্রতিদেহবর্তী প্রাণীর বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে কিন্তু চেতনার ঐক্য প্রকাশ পায় যার ফলে মানুষের এক বিশেষ অবয়ব, হস্ত, যে প্রেরণার বশবর্তী হয়ে খাদ্যদ্রব্য স্পর্শ করে, তার রসনা সেই প্রেরণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ভোজনে প্রবৃত্ত হয়। প্রাণীদেহের প্রতিটি অঙ্গের এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ সঙ্গতিপূর্ণ কাজের ব্যাখ্যা এক দেহে বহু চৈতন্যের স্বীকৃতিতে সম্ভব নয়। শঙ্করের যুক্তিগুলির অনুরূপ যুক্তি ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের ‘ন্যায়ভাষ্যে’ও বিশদভাবে রয়েছে।

৪.
এ প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বলেন যে,–
‘শরীরং শরীরাবয়বাশ্চ সর্ব্বে চেতনোৎপত্ত্যা ব্যাপ্তা ইতি ন ক্কচিদনুৎপত্তিশ্চেতনায়াঃ, শরীরবচ্ছরীরাবয়বাশ্চেতনা ইতি প্রাপ্তং চেতনবহুত্বং। তত্র যথা প্রতিশরীরং চেতনবহুত্বে সুখদুঃখজ্ঞানানাং ব্যবস্থা লিঙ্গং, এবমেকশরীরেহপি স্যাৎ? নতু ভবতি, তস্মান্ন শরীর গুণশ্চেতনেতি।’ (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৫০)
অর্থাৎ :
শরীর এবং শরীরের সমস্ত অবয়ব চৈতন্যের উৎপত্তি কর্তৃক ব্যাপ্ত; সুতরাং (শরীরের) কোন অবয়বে চৈতন্যের অনুৎপত্তি নাই, শরীরের ন্যায় শরীরের সমস্ত অবয়ব চেতন এ জন্য চেতনের বহুত্ব প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ শরীর ও ঐ শরীরের প্রত্যেক অবয়ব চেতন হইলে একই শরীরে বহু চেতন স্বীকার করিতে হয়। তাহা হইলে যেমন প্রতিশরীরে অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন শরীরে চেতনের বহুত্বে সুখ, দুঃখ ও জ্ঞানের ব্যবস্থা (নিয়ম) লিঙ্গ, অর্থাৎ অনুমাপক হয়, এইরূপ এক শরীরেও হউক? কিন্তু হয় না, অতএব চৈতন্য শরীরের গুণ নহে। (তর্জমা- ফণিভূষণ তর্কবাগীশ)

বাৎস্যায়নের মতে, বস্তুবিশেষের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক গুণকেই বস্তুটির স্বধর্ম বলে নির্দেশ করা চলে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি উষ্ণ কোন আধারস্থিত জলের সঙ্গে যুক্ত তরলতা এবং উষ্ণতা, এই গুণ দুটির উল্লেখ করেন। তাঁর মতে জলের স্বধর্ম প্রথমটি, দ্বিতীয়টি নয়; কারণ এই বিশেষ ক্ষেত্রে জলে উষ্ণতা দেখা গেলেও ভিন্ন আধারস্থিত জলে তা অদৃশ্য। ন্যায়ভাষ্যে বলা হয়েছে–
‘স্বগুণোহপ্স, দ্রবত্বমুপলভ্যতে, পরগুণশ্চোষ্ণতা। তেনাহয়ং সংশয়ঃ, কিং শরীরগুণশ্চেতনা শরীরে গৃহ্যতে? তথ দ্রব্যান্তরগুণ ইতি’। (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৪৬)
অর্থাৎ :
জলে স্বকীয় গুণ দ্রব্যত্ব উপলব্ধ হয়, পরের গুণ অর্থাৎ জলের অন্তর্গত অগ্নির গুণ উষ্ণতাও উপলব্ধ হয়। অতএব কি শরীরের গুণ চেতনা শরীরে উপলব্ধ হয়? অথবা দ্রব্যান্তরের গুণ চেতনা শরীরে উপলব্ধ হয়? এই সংশয় জন্মে।

তাঁর মতে, জলের সঙ্গে এইভাবে বহু ক্ষেত্রে যুক্ত হলেও উষ্ণতা প্রকৃতপক্ষে আগুনের স্বধর্ম। অনুরূপভাবে দেহের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে যুক্ত থাকার নিদর্শন থেকেই চৈতন্যের দেহধর্মতার অনুকূলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হয় না। দৃষ্টান্তস্থিত উষ্ণতা যেমন জল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আগুনের ধর্ম, চৈতন্যকেও সেইরকম দেহ থেকে পৃথক আত্মার স্বভাব বলা চলে। শরীরের স্বধর্ম হিসেবে বাৎস্যায়ন কৃষ্ণ, গৌর ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের দেহবর্ণের উল্লেখ করেন, যার অস্তিত্ব প্রাণীদেহে সব সময়েই থাকে, এমনকি মৃত প্রাণীর শরীরেও। আগুনের সঙ্গে উষ্ণতার একত্র বর্তমানতার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করে চার্বাকেরা যখন দেহকে চৈতন্যের কারণ হিসেবে নির্দেশ করেন, তখন তাঁদের উপস্থাপিত দৃষ্টান্ত স্পষ্টতই ত্রুটিমুক্ত হয় না। উষ্ণতা এবং দীপ্তির সঙ্গে আগুনের যোগ সব সময় থাকে। এ থেকে বোঝা যায় যে এগুলি আগুনের স্বভাব, কারণ স্বভাব তার আশ্রয়কে কখনও পরিত্যাগ করে না। চৈতন্যের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক কিন্তু অনুরূপ নয়। চৈতন্য সব সময়ে দেহকে কেন্দ্র করেই বিকশিত এবং দেহ অবর্তমানে চৈতন্য অদৃশ্য– চার্বাকপক্ষের এ বক্তব্য অস্বীকার্য নয় বটে, কিন্তু মৃত্যু বা সংজ্ঞাহীনতার কবলিত অচেতন দেহের অস্তিত্বও সকলের কাছে সুপরিচিত। কাজেই উষ্ণতার সঙ্গে আগুনের স্বাভাবিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত চৈতন্যের সঙ্গে দেহের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না। এ-প্রসঙ্গে ‘ন্যায়ভাষ্যে’ বাৎস্যায়ন বলেন–
‘ন রূপাদিহীনং শরীরং গৃহ্যতে, চেতনাহীনন্তু গৃহ্যতে, যতোষ্ণতাহীনা আপঃ, তস্মান্ন শরীরগুণশ্চেতনেতি।’- (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৪৭)
অর্থাৎ : রূপাদিশূন্য শরীর প্রত্যক্ষ হয় না। কিন্তু চেতনাশূন্য শরীর প্রত্যক্ষ হয়, যেমন উষ্ণতাশূন্য জল প্রত্যক্ষ হয়,– অতএব চেতনা শরীরের গুণ নহে।

চার্বাকদের সমালোচনা করার সময় চার্বাকী যুক্তির এই ত্রুটির উল্লেখ অনেকেই করেছেন। সাংখ্যাচার্য বিজ্ঞানভিক্ষুর (সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য-৩/২১) মতে মৃত্যুর পরে এবং অন্য নানা অবস্থায় দেহের মধ্যে চৈতন্যের যে অভাব দেখা যায় তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে চৈতন্য দেহের স্বাভাবিক ধর্ম নয়।

এই মতের বিরোধিতা প্রসঙ্গে দেহাত্মবাদীদের পক্ষ থেকে যে ধরনের আপত্তি উত্থাপিত হতে পারে সে সম্বন্ধেও ন্যায়ভাষ্যে আলোচনা আছে। তাঁরা হয়তো বলতে পারেন যে প্রাণীদেহে চৈতন্যের মতো ঘটে যে শ্যাম রূপের প্রকাশ, সেই রূপও ঘটদেহে চিরকাল থাকে না। অগ্নিদগ্ধ ঘটে এই রূপ সম্পূর্ণ রূপে অন্তর্হিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রূপকে ঘটের উপাদানের ধর্ম বলতে কারও দ্বিধা নেই। অনুরূপভাবে চৈতন্যকেও ভৌতিক উপাদানে গঠিত জীবদেহের ধর্ম বলে স্বীকার করতে অসম্মত হওয়া উচিত নয়।
আপত্তির উত্তরদান প্রসঙ্গে বাৎস্যায়ন বলেন যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তটি এ ক্ষেত্রে সঠিক প্রযোজ্য নয়। ঘটের শ্যামতার যে বিলুপ্তি দেখা যায়, তা প্রকৃতপক্ষে অবস্থার রূপান্তর মাত্র। অগ্নিদগ্ধ ঘটে বর্ণের পরিবর্তন হয়– শ্যামবর্ণ রক্তবর্ণে পরিণতি লাভ করে। মৃত প্রাণীদেহে চৈতন্যের যেভাবে সম্পূর্ণ অবলোপ হয়, অগ্নিদগ্ধ ঘটদেহে শ্যামতার অবসান সেভাবে হয় না। এ ক্ষেত্রে বাৎস্যায়ন শরীরস্থিত চৈতন্যের সঙ্গে দ্রব্যগত শ্যামতা ইত্যাদি গুণের প্রভেদের বিষয় উল্লেখ করে বলেন–
‘নাত্যন্তং রূপোপরমো দ্রবস, শ্যামে রূপে নিবৃত্তে পাকজং গুণান্তরং রক্তং রূপ মুৎপদ্যতে। শরীরে তু চেতনামাত্রোপরমোহত্যন্তমিতি।’- (ন্যায়ভাষ্য-৩/২/৪৮)
অর্থাৎ : দ্রব্যের আত্যন্তিক রূপাভাব হয় না, শ্যাম রূপ নষ্ট হলে পাকজন্য গুণান্তর রক্ত রূপ উৎপন্ন হয়। কিন্তু শরীরে চৈতন্যমাত্রের অত্যন্তাভাব হয়।

৫.
চার্বাকী ভূতচৈতন্যবাদের নিরসন প্রসঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষের দার্শনিকেরা স্বসমর্থিত আত্ম-সম্বন্ধীয় মতবাদের অবতারণা করেছেন– দেহধারী জীবের মধ্যে সচেতনতার অভিব্যক্তির ব্যাখ্যার ব্যাপারে স্বপক্ষীয় মতের উপযোগিতাই যে একমাত্র স্বীকার্য, তা ব্যক্ত করা এ ক্ষেত্রে তাঁদের অভিপ্রায়। নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের ‘ন্যায়মঞ্জরী’তেও এইভাবে চার্বাকী ধারণার বিপরীত অধ্যাত্মবাদী ধারণা উপস্থাপিত করা হয়েছে।
চার্বাকপক্ষের মতকে প্রতিহত করে স্বপক্ষীয় অভিমতকে এইভাবে উপস্থাপিত করার সময় জয়ন্তভট্ট ভূতচৈতন্যবাদের সমর্থনে চার্বাকী যুক্তির এক বিবরণ দিয়ে বলছেন–
‘ভূতেষ্বন্নপানাদ্যুপযোগপুষ্টেষু পাট্বী চেতনা ভবতি তদ্বিপর্যয়ে বিপর্যয়ঃ, ব্রাহ্মীঘৃতাদ্যুপযোগসংস্কৃতে চ কুমার শরীরে পটুপ্রজ্ঞতা জায়তে।’- (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) বুদ্ধি বা চৈতন্যের বিকাশ শরীরের সম্যক পরিপুষ্টির উপর নির্ভরশীল। ভোজন, পান ইত্যাদির দ্বারা দেহ পুষ্ট থাকলেই চৈতন্যের সতেজ স্ফূর্তি দৃষ্ট হয়। ব্রাহ্মীঘৃত অথবা অন্য ঔষধাদি সেবনের ফলে বালকের মধ্যেও যথেষ্ট প্রজ্ঞার সঞ্চার হতে দেখা যায়।

অপর পক্ষে অপুষ্ট শরীরে বুদ্ধি বা চৈতন্য সম্যক বিকশিত হতে পারে না। আবার দধি, আর্দ্র পরিবেশ ইত্যাদি ভৌতিক দ্রব্যের বিবিধ সংস্থান নানাবিধ কৃমি পতঙ্গাদির উৎপত্তির কারণ হয়। চার্বাকদের মতে ভৌতিক দ্রব্য থেকে চৈতন্যের উৎপত্তি সমর্থনে এই কারণগুলিকে নিশ্চয়ই উপেক্ষা করা চলে না। ভৌতিক দেহকে চৈতন্যের উৎপত্তিস্থল হিসেবে গণ্য করার কারণ হিসেবে চার্বাকেরা শরীরের মাধ্যমে চৈতন্যলক্ষণযুক্ত ইচ্ছা, দ্বেষ ইত্যাদির আরম্ভ এবং নিবৃত্তির উল্লেখ করেন। শঙ্করাচার্যের ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে এবং ন্যায়সূত্র ও ন্যায়ভাষ্যেও ভূতচৈতন্যবাদীদের এই বক্তব্যের অন্তর্ভুক্তি আছে। জয়ন্তভট্ট শরীরের সঙ্গে চৈতন্যকে একাত্ম করার চার্বাকী এই প্রয়াসের বিরোধিতা করার সময় তাঁর স্বভাবসুলভ হেঁয়ালীপূর্ণ ভাষায়  শরীরের নিত্যপরিবর্তনশীলতার বিষয় উল্লেখ করে বলেন–
‘শরীরং চ বাল্যাদ্যবস্থাভেদেন ভিন্নমতন্তস্য নাশ্রয়ো ভবিতুমর্হতি সন্তানান্তরবদ্ যথা হি দেবদত্ত দৃষ্টেহর্থে যজ্ঞদত্তস্য ন স্মরণমেবং বাল শরীরাদ্যনুভূতে যুবশরীস্য তন্ন স্যাৎ।’- (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : বাল্যদেহ, যৌবনের দেহ ও বৃদ্ধদেহ ভিন্ন ভিন্ন হলেও বাল্যকালের অভিজ্ঞতা যৌবনে এবং যৌবনের অভিজ্ঞতা বার্ধক্যকালে স্মরণ হয়। দেবদত্ত নামের ব্যক্তির দৃষ্ট অভিজ্ঞতা কি যজ্ঞদত্ত নামের অপর কেউ স্মরণ করতে পারে?

জয়ন্তভট্ট বলতে চেয়েছেন, জীবদেহ প্রতি পদে রূপান্তরিত হয়, শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য ইত্যাদি দশাভেদে। একের দৃষ্ট বিষয় যেমন অপরকে স্মরণ করতে দেখা যায় না এবং একের স্মৃতি বা অনুভবকে অপরের ইচ্ছার কারণ বলা চলে না সেই রকম ভূতচৈতন্যবাদকে স্বীকৃতি দিলে জীবদেহের কোন অবস্থায় প্রত্যক্ষীকৃত বিষয়ের স্মরণ সেই একই জীবের অন্য অবস্থায় ব্যাখ্যা করা যায় না এবং স্মৃত কোন বিষয় থেকেও পরবর্তী অবস্থার দেহে অভিব্যক্ত ইচ্ছাদিকে উৎপন্ন বলা চলে না। কাজেই প্রাণী চৈতন্যের যে ঐক্য পরম্পরাবদ্ধ অর্থবিজ্ঞান, স্মৃতি, ইচ্ছা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রতিভাত, শরীরের সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থার মধ্যেও যা অভিন্ন এক জীবের পরিচিতি বহন করে, ভূতচৈতন্যবাদের সঙ্গে তার কোন সঙ্গতি নেই।

৬.
স্বতন্ত্র আত্মার ধারণায় বিশ্বাসী দার্শনিকদের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে চার্বাকপক্ষ এতক্ষণ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, চৈতন্যধর্মী আত্মা এই চার্বাকদের মতে দেহের সঙ্গে অভিন্ন। কিন্তু এই শ্রেণীর চার্বাকেরা ছাড়াও–
আত্মগত ধারণার ভিত্তিতে আরও তিনটি পৃথক শ্রেণীতে বিভক্ত চার্বাকদের বর্ণনা সদানন্দের ‘বেদান্তসার’ গ্রন্থে পাওয়া যায় এবং… ‘বেদান্তসারে’র অভিমতে দৃষ্টিভঙ্গীর তারতম্য অনুযায়ী চার্বাকী বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন স্তর বিন্যাস আছে এবং এই স্তরের প্রকারভেদ অনুসারে চার্বাকেরা স্থূলতম বিষয় থেকে অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম বিষয় সম্বন্ধে ধারণায় সমর্থ, যদিও বেদান্ত-অভিপ্রেত সচ্চিদানন্দরূপী শুদ্ধ আত্মস্বরূপ এঁদের প্রত্যেকেরই অবগতির বহির্ভূত। এই বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত চার্বাকদের মধ্যে দেহাত্মবাদীরাই স্থূলতম ধারণার অংশীদার এবং বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনায় এই দেহাত্মবাদী বা ভূতচৈতন্যবাদীরাই উল্লিখিত হয়েছেন। জয়ন্তভট্ট তাঁর গ্রন্থে আত্মসম্বন্ধীয় আলোচনার প্রসঙ্গে ভূতচৈতন্যবাদ ছাড়াও ইন্দ্রিয় চৈতন্যবাদ এবং মনশ্চৈতন্যবাদ এই দু’ধরনের মতের উল্লেখ করেছেন। সদানন্দের বর্ণনায় ইন্দ্রিয় এবং বুদ্ধির সঙ্গে যাঁরা আত্মাকে অভিন্ন বলে মনে করেন সেই চার্বাকদের ধারণা চিত্রিত হয়েছে। এই মতবাদগুলির কোনটাই অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের আত্মসম্বন্ধীয় ধারণার সমগোত্রীয় নয় এবং ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থেও এই মতবাদগুলির বিরোধিতা করা হয়েছে।
জয়ন্তভট্ট তাঁর আলোচনায় ‘সুশিক্ষিত’ এই বিশেষণের মাধ্যমে আর এক শ্রেণীর চার্বাকদের পরিচিতি দিয়েছেন যাঁদের মতে আত্মা ‘প্রমাতৃতত্ত্ব’, স্থূল দেহ থেকে ভিন্ন। সচেতন ব্যবহারের সব কিছু এই আত্মা বা ‘প্রমাতৃতত্ত্বে’ এই শ্রেণীর চার্বাকেরা আরোপ করেন, কিন্তু এই আত্মার স্থায়িত্ব তাঁদের অভিমত অনুযায়ী শরীরের স্থায়িত্বকে অতিক্রম করে যেতে পারে না এবং দেহনাশের পর এই আত্মার বর্তমানতা এবং দেহান্তর পরিগ্রহ সুশিক্ষিত চার্বাকেরা স্বীকার করেন না।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৫-৬)

জয়ন্তভট্ট বর্ণিত এই ‘সুশিক্ষিত’ চার্বাকেরা আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমণের বিরোধিতা করেছেন। ‘ন্যায়মঞ্জরী’র ভাষ্যানুযায়ী এঁরা বলেন–
‘যদি হ্যেবং ভবেত্তদিহ শরীরে শৈশবদশানুভূতপদার্থস্মরণবৎ অতীতজন্মানুভূতপদার্থ স্মরণমপি তস্য ভবেন্ন হি তস্য……তস্মাদুর্ধ্বং দেহান্নাস্ত্যেব প্রমাতা’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ :
আত্মা বা প্রমাতার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমণ সম্ভব হলে শৈশবে অনুভূত পদার্থের মতো জন্মান্তরে অনুভূত পদার্থেরও স্মরণে কোন বাধা থাকতো না এবং আমরা বিগত জন্মের ঘটনাগুলির স্মৃতিও অনায়াসেই বহন করতে সমর্থ হতাম। কিন্তু জন্মান্তরের ঘটনা স্মরণ করতে মানুষকে দেখা যায় না। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে শরীর নাশের পর শরীরস্থিত প্রমাতারও অস্তিত্বের লোপ হয়।

‘সুশিক্ষিত’ বিশেষণে ভূষিত চার্বাকেরা আত্মাকে দেহের সঙ্গে অভিন্ন বলে স্বীকার না করায় ভারতীয় অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের বিচারে এঁদের দৃষ্টিভঙ্গি দেহাত্মবাদী বৃহৎ গোষ্ঠির তুলনায় উন্নততর বলা হলেও এঁরা কিন্তু ভারতীয় অধ্যাত্মধারণার সম অংশীদার নন। কারণ তাঁদের অনুমোদিত প্রমাতৃতত্ত্ব দেহ থেকে পৃথক হয়েও দেহেরই সমকালীন বিনাশের কবলে পতিত হয়।
জয়ন্তভট্টের বিবরণীতে এই চার্বাকদের মতবাদে ত্রুটি দেখানো হয়েছে। নৈয়ায়িকেরা কার্যকারণভাবে বিশ্বাসী এবং জয়ন্তভট্টের মতে যে কোন সৎ বস্তুর বিনাশ কল্পনা করতে হলে বিনাশের মূলে নির্দিষ্ট কোন হেতুর আগে স্বীকৃতি হওয়া উচিত। কারণ–
‘ন চাস্তিত্বাবিনাভাবী ভাবানাং বিনাশঃ স্বাভাবিকঃ কিন্তু হেত্বন্তরনিমিত্তকঃ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : স্বাভাবিকভাবে যাকে সৎ বা বর্তমান বলে স্বীকার করা যায়, কারণ না থাকলে তাকে বিনষ্ট বলে ঘোষণা করা অযৌক্তিক।

নৈয়ায়িক আচার্য জয়ন্তভট্ট নানাভাবে বিচার করে দেখাতে চান যে আত্মার বিনাশের কোন কারণ আবিষ্কার করা সুকঠিন।
অনুমানের মাধ্যমে এই আত্মার বিনাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। ‘সুশিক্ষিত’ সংজ্ঞায় বিশেষিত চার্বাকদের অভিমত হলো আত্মা জড় দেহ থেকে পৃথক। কাজেই জড় বস্তুর ধর্ম আত্মাতে আরোপ করে আত্মার ধ্বংসের কারণ অনুসন্ধান করা যেতে পারে না। জড় বস্তুনিচয় প্রধানত অবয়বী, অর্থাৎ বিভিন্ন অবয়ব বা অংশের সংযোগে এদের উৎপত্তি এবং এই অবয়বের বিনাশই এদের বিনাশের হেতু। এ ধরনের অবয়বের বিভাগ জড় বস্তু থেকে ভিন্ন আত্মাতে সম্ভব নয়। দ্রব্যাদির গুণ যেমন আশ্রয়দ্রব্যের বিনাশের সঙ্গে লুপ্ত হয়, আত্মার সেই ধরনের বিনাশও অনুমেয় নয়, কারণ আত্মাকে দ্রব্যবিশেষের গুণ বলা চলে না। কাজেই স্থূল দেহের ধ্বংসের সঙ্গে দেহাতিরিক্ত আত্মার বিলোপের কোন যোগ নেই এবং অন্য হেতু অবর্তমানে দেহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার সমকালীন এই আত্মার বিনাশের কল্পনা যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
জয়ন্তর মতে দেহাতিরিক্ত এই আত্মার বিনাশ প্রত্যক্ষ প্রমাণেরও বিরোধী। আত্মার ধ্বংস কোন ব্যক্তির প্রত্যক্ষের গোচরে কখনো আসেনি, যদিও মৃত দেহটির ক্ষেত্রে এ জাতীয় অভিজ্ঞতা খুব সাধারণ, কারণ অগ্নিদাহ বা হিংস্র পশুর আক্রমণের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে মৃতদেহকে প্রায়ই দেখা যায়।

পরিশেষে জয়ন্তভট্ট মন্তব্য করেন যে প্রত্যক্ষ এবং অনুমান, এই উভয়বিধ প্রমাণের যে কোনটিরই মাধ্যমে দেহনাশের সমকালীন আত্মার বিলোপের সপক্ষে ‘সুশিক্ষিত’ চার্বাকদের অভিমত গ্রাহ্য হতে পারে না। কাজেই ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনে অনুমোদিত নিত্য প্রমাতা বা আত্মার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য ঘোষণা করে বলা হচ্ছে–
‘তস্মাদস্তি নিত্যঃ পরলোকে প্রমাতেতি’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : লোকে বা পরলোকে নিত্য প্রমাতা বা আত্মার অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।

৭.
প্রকৃতপক্ষে চার্বাক দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনের মৌল বিভেদ আত্মার অমরত্বের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে রূপায়িত। আত্মার অমরত্বের ধারণার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনগুলির অনুমোদিত জন্মান্তরবাদ ও পরলোকতত্ত্ব। দেহাতীত যে আত্মা দেহনাশের সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হয় না একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব পুনরায় নতুন জন্মে এবং নতুন পরিবেশে ভিন্ন দেহের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করা। কিন্তু আত্মার অমরত্বে বা অস্তিত্বে চার্বাকদের কোন সম্মতি নেই। জীবদেহে অভিব্যক্ত চৈতন্যে তাঁরা যে নশ্বরতার ছাপ দেন তা জন্মান্তরবাদের ধারণার সঙ্গে একেবারেই সামঞ্জস্যহীন। বৌদ্ধ দার্শনিক কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় চার্বাকমত হিসেবে বর্ণিত হয়েছে যে, চার্বাক মতে দেশান্তর, অবস্থান্তর বা কালান্তরকে পরলোক বলা যায়। চার্বাকমতের বর্ণনায় এ-প্রসঙ্গে একটি লোকায়ত বা বার্হস্পত্য সূত্রেরও উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে–
পরলোকিনোহভাবাৎ পরলোকাভাবঃ। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৫৮)
অর্থাৎ : (চার্বাক মতে) যেহেতু পরলোক নাই, তাই পরলোকীও নাই।

এ ব্যাপারে চার্বাকদের সমালোচনায় তৎপর দার্শনিকেরা প্রত্যেকেই আত্মার ক্ষণস্থায়িত্ব বা অস্তিত্বহীনতা সম্বন্ধে চার্বাকী ধারণার বিরোধিতা করেছেন আত্মার অমরত্ব এবং অবিনশ্বরত্ব সম্বন্ধে নিজ নিজ ধারণার বিবরণী দিয়ে।
চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনের অন্য গোষ্ঠির মতো বৌদ্ধদর্শনও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী। জন্মান্তরবাদের এই বৌদ্ধ ধারণাও স্বাভাবিকভাবে চার্বাকেরা স্বীকার করেন না এবং এই প্রসঙ্গে এই দুই গোষ্ঠির পারস্পরিক তর্কযুদ্ধের কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থে এবং কমলশীল-কৃত এই গ্রন্থের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’র ব্যাখ্যাতে।

বৌদ্ধরা আত্মার পরিবর্তে অবিচ্ছিন্ন ‘বিজ্ঞান-সন্ততি’র অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেন এবং এই ‘বিজ্ঞান’ তাঁদের মতে দেহ, মন বা ইন্দ্রিয়– এগুলির কোনটার মাধ্যমেই উৎপন্ন হয় না। এই ‘বিজ্ঞান-সন্ততি’র অন্তর্ভুক্ত যে কোন বিজ্ঞানের জনক ঠিক তার পূর্ববর্তী অপর একটি ‘বিজ্ঞান’, ‘যে বিজ্ঞানে’র কারণরূপে নির্দেশ করা চলে অনুরূপ আর একটি ‘বিজ্ঞান’কে। এইভাবে প্রতিটি বিজ্ঞানের উৎস হিসেবে পূর্ববর্তী অপর বিজ্ঞানের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হলে শিশুমনের আদি বিজ্ঞানের কারণরূপেও কোন বিজ্ঞানের অস্তিত্বের ধারণা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বৌদ্ধ জন্মান্তরবাদের ভিত্তি এই ধারণাতে। বৌদ্ধরা শিশুমনের আদি চেতনার কারণ হিসেবে পূর্ববর্তী জন্মের অন্তিম বিজ্ঞানকে নির্দেশ করেন। এই উভয় বিজ্ঞান অচ্ছেদ্য কার্যকারণ সূত্রে আবদ্ধ থেকে বিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্ন প্রবাহকে অক্ষুণ্ন রাখে। এইভাবেই গড়ে ওঠে প্রতিটি জন্মের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অপর জন্মগুলির অস্তিত্বের ধারণা।
পূর্ববর্তী জন্মের অন্তিম বিজ্ঞান একমাত্র তখনই পরবর্তী জীবনের বিজ্ঞানের উৎস হয় যথন তা রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি ধর্মের দ্বারা সম্পৃক্ত হয়। সম্পূর্ণভাবে বীতরাগ ব্যক্তি পুরাতন দেহের বন্ধন ছিন্ন হবার পর নূতন দেহের বন্ধনে পুনরায় আবদ্ধ হন না। অন্য মানুষের ক্ষেত্রে পূর্বতন জীবনের বিজ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি মানসিক ধর্ম পরবর্তী জীবনে শিশুমনে সংক্রামিত হয়।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১০৮-৯)

কিন্তু চার্বাক মতে দেহই জ্ঞানের একমাত্র আশ্রয় এবং দেহনাশের সঙ্গে দেহাশ্রিত এই জ্ঞানেরও সম্পূর্ণ বিনাশ হয়। বৌদ্ধরা যখন পূর্বজন্মের মরণকালীন চিত্ত বা বিজ্ঞানকে পরবর্তী জন্মের প্রারম্ভিক বিজ্ঞানের কারণ বলেন– অথবা বর্তমান দৃশ্যমান দেহে যে সচেতনতার অভিব্যক্তি তার সঙ্গে অতীত কোন দেহের বিজ্ঞানের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধসূত্র আবিষ্কার করেন, তখন চার্বাকেরা তার মধ্যে যুক্তির কোন সমর্থন পান না। প্রথমত, পূর্বজন্মবর্তী যে দেহের অবসানকালে জাত বিজ্ঞানকে বৌদ্ধরা বর্তমান দেহের বিজ্ঞানের সঙ্গে কার্যকারণের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে যুক্ত করতে অভিলাষী, সেই দেহের অস্তিত্বই চার্বাক মতে নির্ভরযোগ্য প্রমাণের দ্বারা অসমর্থিত। তাছাড়া দুটি বিভিন্ন দেহবর্তী বিজ্ঞানকে একই বিজ্ঞান প্রবাহে অন্তর্ভুক্ত করার বৌদ্ধ প্রচেষ্টাতেও চার্বাকেরা ত্রুটি খুঁজে পান। ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’র পূর্বপক্ষীয় বর্ণনায় দেখা যায়, চার্বাকরা বলেন যে–
‘ন চৈকসন্তান বর্তিনোশ্চেতসো দেহান্তর সমাশ্রয়ণং যুক্তম্, গজবাজ্যাদিচিত্তবদেকসন্তান-সম্বন্ধিত্বহানি প্রসঙ্গাৎ’। (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা-১৮৭০)
অর্থাৎ : (চার্বাক বলেন) ভিন্নদেহবর্তী গজ ও অশ্ব অথবা বরাহ ও মহিষের চিত্তকে আমরা কখনও একই বিজ্ঞানসন্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি না, কারণ এক প্রবাহবর্তী চেতনার ভিন্নদেহ আশ্রয় করার ধারণা অযৌক্তিক।

অতএব, চার্বাকমতে, অনুরূপভবে ইহলোকবর্তী এবং পরলোকগত দেহ পরস্পর ভিন্ন হওয়ার ফলে সেই দেহান্তর্গত বিজ্ঞানগুলিকেও এক অভিন্ন প্রবাহভুক্ত করা চলে না।
এক্ষেত্রে বৌদ্ধরা হয়তো বলতে পারেন যে সদৃশ বস্তু থেকেই কেবল অপর সদৃশ বস্তুর আবির্ভাব সম্ভব, অসদৃশ বস্তু থেকে নয় এবং এইজন্যই আদি বিজ্ঞানের উৎপত্তির কারণ অনুসন্ধান করতে হলে পূর্ববর্তী অপর বিজ্ঞানের অস্তিত্বের কল্পনা ব্যতীত গত্যন্তর নেই।
কিন্তু চার্বাকেরা বলবেন যে, এই যুক্তির অনুসরণে ধোঁয়ার কারণ হবার যোগ্যতা কেবল ধোঁয়ারই থাকে, আগুনের নয়। যদি বলা হয়, ধোঁয়া এবং আগুন উভয় বস্তুই ‘রূপরূপতা’ এই ধর্মে সদৃশ, অর্থাৎ দুটি বস্তুরই রূপ আছে, যা একটিকে অপরটির কারণ হবার যোগ্যতা দিয়েছে, তাহলে চার্বাক পক্ষ থেকেও ভূত এবং বিজ্ঞান উভয়েরই সদৃশ ধর্ম হিসেবে ‘স্বলক্ষণরূপতা’কে নির্দেশ করা চলে; অর্থাৎ দুটি বস্তু নিজস্ব লক্ষণযুক্ত রূপে প্রকাশমান এবং এই সদৃশ ধর্মের ভিত্তিতেই একটি অপরটির কারণ হিসেবে নির্দেশিত হতে পারে।
বৌদ্ধরা আপত্তি প্রসঙ্গে বলতে পারেন যে ভৌতিক পদার্থ বিজ্ঞানের মতোই স্বালক্ষণ্যে অবিচল থাকলেও ভৌতিক বস্তুতে বিজ্ঞানরূপতা নেই, যে কারণে বিজ্ঞানের উপাদান কারণ হবার যোগ্যতা ভৌতিক পদার্থে থাকতে পারে না। এর উত্তরে চার্বাকেরা বলতে পারেন যে, এ যুক্তি গ্রহণ করলে আগুনও ধূমের উপাদান কারণ হতে পারে না, কারণ আগুনের মধ্যে ধূমরূপতার অভাব। কাজেই আগুনকে যাঁরা ধোঁয়ার কারণ রূপে নির্দেশ করেন, ভূতসংঘাতকে বিজ্ঞানের জনক বলতে তাঁদের কোন বাধা থাকতে পারে না।

প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের তর্কযুদ্ধের কোন নির্দিষ্ট পর্যায়ে সীমারেখা টানা যায় না এবং ভূতচৈতন্যবাদীদের সঙ্গে জন্মান্তরবাদের সমর্থকদের যে সংঘর্ষ ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সুদীর্ঘকাল ধরে প্রসারিত তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রথম পক্ষের যোদ্ধারা বিজয়ীর সম্মান দাবি করেছেন, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিতীয় পক্ষের তর্কবাণের আক্রমণে তাঁরা পরাভূত বলে মনে হয়েছে। প্রকৃত কথা হলো, অন্যান্য বহু বিষয়ের মতো জন্মান্তরবাদও ভারতীয় দর্শনে যুক্তির পথ দিয়ে প্রবেশ করেনি।

৮.
জন্মান্তরবাদ ছাড়াও জন্মান্তরবাদের সঙ্গেই অচ্ছেদ্য বন্ধনসূত্রে আবন্ধ চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনগুলির অনুমোদিত অপর ধারণাটি হলো কর্মফলবাদ। এই কর্মফলবাদ ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় অধ্যাত্মজীবনের স্তম্ভ স্বরূপ।
জন্ম থেকে জন্মান্তরে ভিন্ন ভিন্ন শরীরের মাধ্যমে জীবের যে ভোগবৈচিত্র্য তার কারণ হিসাবে ভারতের দর্শনে কর্মবৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জীবের প্রাক্তন কর্মের ক্ষয় একমাত্র ভোগের মাধ্যমেই হতে পারে, এবং এই ভোগের বিভিন্নতা ভারতীয় দার্শনিকদের মতে পূর্বকৃত কর্মের বৈচিত্র্যের উপর নির্ভরশীল। দেহধারী জীবের পক্ষেই কেবল এই বিচিত্র ভোগ সম্ভব এবং সেইজন্য ভোগের মাধ্যমে প্রাক্তন কর্মের সংস্কার ক্ষয় করার জন্য বিশেষ পরিবেশে বিশেষ শরীরে মানুষকে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করতে হয়। ভারতের অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা তাই শরীর সৃষ্টির উপাদান হিসাবে পঞ্চ মহাভূতকে স্বীকৃতি দিলেও এ ব্যাপারে মহাভূতের স্বতন্ত্র কারণতা অনুমোদন করেন না। তাঁদের মতে পঞ্চভূত থেকে জীবদেহের উৎপত্তির মূলে কার্যকরী জীবনের পূর্বকৃত কর্মের সংস্কারের প্রেরণা।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-১১১-২)।
এ-প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রের দৃষ্টান্তে বলা হয়েছে–
‘পূর্ব্বকৃত-ফলানুবন্ধাৎ তদুৎপত্তিঃ’। (ন্যায়সূত্র-৩/২/৬০)
অর্থাৎ : পূর্বকৃত কর্মফলের (ধর্ম ও অধর্ম নামক অদৃষ্টের) সম্বন্ধপ্রযুক্ত সেই শরীরের উৎপত্তি হয় (অর্থাৎ শরীর-সৃষ্টি আত্মার কর্ম বা অদৃষ্ট-নিমিত্তক, এটাই তত্ত্ব)।

কিন্তু জন্মান্তরবাদে অবিশ্বাসী চার্বাকেরা স্বাভাবিক কারণেই জন্মান্তরবাদের সঙ্গে সমসূত্রে গাঁথা কর্মফলবাদকেও স্বীকৃতি দিতে অসম্মত। অধ্যাত্মবাদীরা যেখানে স্থূল ভূতের উপাদানে গঠিত বস্তুনিচয়কে তাত্ত্বিকক্রমে গৌণ মর্যাদা দেন, নাস্তিক চার্বাকদের বিবেচনায় সেখানে ভৌতিক স্থূল পদার্থের মুখ্য ভূমিকা জাগতিকক্রমে। এবং এই জড় ভূতের উপাদানে গঠিত দেহ থেকেই উৎপন্ন জাগতিক অপরাপর তত্ত্ব, মন, বুদ্ধি চৈতন্য ইত্যাদি। ন্যায়ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের মতে, ন্যায়সূত্রে নাস্তিকদের এই মনোভাব উল্লেখ করে বলা হয়েছে–
‘ভূতেব্যো মূর্ত্ত্যুপাদানবত্তদুপাদানম্’। (ন্যায়সূত্র-৩/২/৬১)
অর্থাৎ : (নাস্তিকমতে) ভূতবর্গ হতে (উৎপন্ন) মূর্তদ্রব্যের অর্থাৎ সাবয়ব বালুকা প্রভৃতি দ্রব্যের গ্রহণের ন্যায় তার (শরীরের) গ্রহণ হয়।

তার মানে, নাস্তিকেরা জীবদেহসৃষ্টিতে জীবের অনুষ্ঠিত প্রাক্তন কর্মের নিমিত্ততা স্বীকার করেন না। শর্করা, পাষাণ ইত্যাদি উপকরণের সাহায্যে যেভাবে নানা ধরনের মূর্তির নির্মাণ, প্রাণীদেহও তাঁদের মতে ঠিক সেই ভাবেই বিভিন্ন ভৌতিক উপাদানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে কর্মফলবাদের অন্তর্ভুক্তির মূলে যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রেরণা, সে দৃষ্টিভঙ্গি চার্বাকদর্শনে অনুপস্থিত। এ কারণেই আত্মা, জন্মান্তরবাদ ইত্যাদির মতো এই কর্মফলবাদের ধারণাও চার্বাক মতবাদীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে।

কর্মফলের মতো মোক্ষও স্বাভাবিকভাবেই ভূতচৈতন্যবাদী চার্বাকদের ধারণায় প্রবেশ লাভ করেনি। চার্বাক-মতে মৃত্যুর পর দেহের বিনাশকেই মোক্ষ সংজ্ঞায় অভিহিত করা যায়। চার্বাকেতর বিভিন্ন দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থে চার্বাকমতের বর্ণনায় এ-প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–
‘দেহোচ্ছেদো মোক্ষঃ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
‘দেহস্য নাশো মুক্তিঃ’। (সর্বদর্শন সংগ্রহ)
‘মরণেব চ মোক্ষঃ’। (সর্বমতসংগ্রহ)
নরকানুভবো বৈরিশস্ত্রব্যাধ্যাদ্যুপদ্রবঃ।
মোক্ষস্তু মরনং তচ্চ প্রাণবায়ুনিবর্তনম্ । (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১০)
অর্থাৎ :
(লোকায়তিক-চার্বাক মতে) দেহের উচ্ছেদই মোক্ষ। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।  দেহের নাশই মুক্তি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।  মরণেই মোক্ষ। (সর্বমতসংগ্রহ)।। শত্রুর অস্ত্র অথবা ব্যাধি প্রভৃতির উপদ্রবই নরকানুভব। মরণই মুক্তি এবং সেই মরণ হলো প্রাণবায়ুর চিরতরে বহির্গমন। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/১০)।।

এছাড়া ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক ইত্যাদি সম্বন্ধীয় অপর কয়েকটি ধারণা ভারতীয় অধ্যাত্মধারণার আবশ্যিক অঙ্গ না হয়েও ভারতীয় জনমানসে বহুদিন থেকে স্থায়ী আসন অধিকার করে আছে। চার্বাক-মতে স্বর্গ, নরক ইত্যাদির ভোগ ইহজন্মেই হয়। যেমন–
‘স্বর্গনরকাবপি ন স্তঃ’। (সর্বমতসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) স্বর্গ বা নরক বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই।
কিংবা–
ইহলোকাৎ পরো নান্যঃ স্বর্গোহস্তি নরকা ন চ।
শিবলোকাদয়ো মূঢ়ৈঃ কল্প্যন্তেহন্যৈঃ প্রতারকৈঃ।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৮।।
অর্থাৎ : (লোকায়তিক মতে) ইহলোক থেকে পৃথক স্বর্গ অথবা নরক নামক কোন স্থান নেই। মূর্খ এবং প্রতারকেরাই শিবলোকাদির কল্পনা করে থাকে।
এবং–
ন স্বর্গো নাপবর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ।
নৈব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : স্বর্গ বলে কিছু নেই, অপবর্গ বা মুক্তি বলেও নয়, পরলোকগামী আত্মা বলেও নয়। বর্ণাশ্রম-বিহিত ক্রিয়াকর্মও নেহাতই নিষ্ফল।

ফলে চার্বাকেরা দেশের রাজাকেই পরমেশ্বর আখ্যায় সংজ্ঞায়িত করেছেন–
‘অতএব কণ্টকাদি-জন্যং দুঃখমেব নরকঃ।
লোক-সিদ্ধ রাজা পরমেশ্বরঃ।। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) সুতরাং কণ্টকাদি জন্য দুঃখই নরক। লোকপ্রসিদ্ধ রাজই পরমেশ্বর।
কারণ, প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতিতে রাজা বহু ক্ষেত্রেই ঈশ্বর পদবাচ্য। এমনকি, মজার বিষয় হলো, ‘মনুস্মৃতি’তেও এই নজির বিরল নয়, যেমন–
‘বালোহপি নাবমন্তব্যো মনুষ্য ইতি ভূমিপঃ।
মহতী দেবতা হ্যেষা নররূপেণ তিষ্ঠতি।।’ (মনুসংহিতা-৭/৮)
অর্থাৎ : রাজা বালক হলেও তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। কারণ, এই রাজা প্রকৃতপক্ষে একজন অসাধারণ দেবতা, ইনি মানুষের আকারে পৃথিবীতে অবস্থান করেন।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال