চার্বাকী দেহাত্মবাদী সিদ্ধান্ত-খণ্ডন প্রয়াসের
পর্যালোচনা
চার্বাকী দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াসে চার্বাকেতর দার্শনিকদের উপরিউল্লিখিত যুক্তি বিস্তারের নমুনা থেকে শেষপর্যন্ত কী প্রমাণ হলো এবং সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদের কতোটা বোধগম্য হয়েছে তা নিশ্চয় করে বলার সুযোগ নেই। তবে দেবীপ্রসাদের ভাষ্যানুযায়ী তাঁরা নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধি ও যুক্তিকৌশলের উৎকর্ষ দেখাবার উৎসাহেই যুক্তি-বিস্তারণ যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তাতে আসলেই সন্দেহের অবকাশ থেকে যায় যে, চার্বাকদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে এ-ধরনের কূট তর্ক আদপেই তোলবার দরকার ছিলো কিনা। এমনতর অনেক কথাই যে দেহাত্মবাদের বিচার প্রসঙ্গে অনেকের লেখায় চোখে পড়েছে তা হয়তো পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু এতে করে চার্বাকদের পক্ষ থেকে দেহাত্মবাদের সমর্থনে ইতঃপূর্বে যে মদশক্তির উপমা ব্যবহার করা হয়েছে, বিপক্ষ দার্শনিকদের এতো কূটতর্কের অবতারণার পরও সেই দেহাত্মবাদ কি খণ্ডন করা সম্ভব হয়েছে?
বলাই বাহুল্য, মদ্য প্রস্তুতের উপাদানগুলির মধ্যে কোনোটি থেকেই– বা এগুলিকে যেন-তেন-প্রকারে এক জায়গায় জড়ো করলেই– মদ তৈরি হয় না; অর্থাৎ মদশক্তি বা মাদকতা জননের সামর্থ্য সম্ভব নয়। কিন্তু এগুলিরই কোনো একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে মদ তৈরি হয় এবং তাতে মদশক্তি বলে এক অভূতপূর্ব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। যতোই উৎসাহ থাক, কথাটা উড়িয়ে দেওয়া আদৌ কি সম্ভব? বলা যায় একেবারেই অসম্ভব। এবং এই নজির মানতে বাধ্য হলে দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে মূল আপত্তিটা আর অত জোর গলায় তোলার সুযোগ থাকে না হয়তো; কেননা সে-আপত্তি বলতে তো এই যে, আগুন বাতাস জল প্রভৃতি দেহগঠনের উপাদানগুলি দিয়েই তৈরি নিছক দেহের মধ্যে চৈতন্য বলে গুণের পরিচয় সম্ভব নয়। এই কারণেই দেহবাসী চেতন আত্মা মানা দরকার। কিন্তু উপাদান-সামগ্রীতে যে-গুণের পরিচয় নেই সেগুলিরই বিশেষ পরিণামের ফলে ওই উপাদান-গঠিত বস্তুতেই অভূতপূর্ব গুণ– বর্তমান দৃষ্টান্তে চৈতন্য প্রভৃতি গুণ– আবির্ভূত হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়। তার মানে, দেহগঠনের উপাদানগুলি স্বয়ং-অচেতন, শুধুমাত্র এই যুক্তি দিয়ে দেহাত্মবাদ খণ্ডন পর্যাপ্ত হতে পারে না।
‘তাই দেহাত্মবাদের বিচারে আমাদের কাছে প্রধান প্রশ্ন এই নয় যে এই প্রসঙ্গে কত দার্শনিক কতরকম কূট তর্কের নমুনা দেখিয়েছেন। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, চার্বাকমতের পক্ষে এই মূল নজিরটি অন্যান্যরা কতটা সার্থক ভাবে খণ্ডন করতে পেরেছেন?
যতদূর মনে হয়, দৃষ্টান্ত হিসাবে মদশক্তির এই দৃষ্টান্তটি নিয়ে বিপক্ষ দার্শনিকেরা খুব একটা তর্কাতর্কি তোলেননি। তার একটা কারণ এই হতে পারে যে দৃষ্টান্ত হিসাবে এটা উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়, হয়তো সম্ভবও নয়। তাছাড়া, তাঁরা হয়তো বলবেন, শুধুমাত্র একটা দৃষ্টান্তর নজির থেকে অত বড় একটা সিদ্ধান্ত– দেহাত্মবাদ– সুনিশ্চিত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা নিরর্থক। তার মানে অবশ্য এই নয় যে দার্শনিক বিচারে দৃষ্টান্তর গুরুত্ব নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু নিছক কোনো দৃষ্টান্তর– বিশেষত এমন এক দৃষ্টান্তর যা মোটের উপর খুব প্রচলিত নয়, বরং তুলনায় দুর্লভ ক্ষেত্রেই পরিদৃষ্ট হয়– তার উপর ঐকান্তিক নির্ভরতা অতি-বড় অপ্রচলিত দার্শনিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে হয়তো সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। যাই হোক এবং যে-কোনো কারণেই হোক, বিপক্ষ সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা মদশক্তির দৃষ্টান্ত নিয়ে তেমন কিছু তর্কাতর্কি করেননি। তার বদলে অন্যান্য অনেক যুক্তি দেখিয়ে দেহাত্মবাদ খণ্ডনের প্রয়াস করেছেন।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮২-৩)
ইতোমধ্যেই আমরা তঁদের অনেকগুলি যুক্তিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি; যদিও তাঁদের সমস্ত যুক্তির কোনো তালিকা তৈরি করার সুযোগ নেই এবং তা সম্ভবও নয়। তার বদলে তাঁদের কয়েকটি প্রসিদ্ধ– এবং অন্তত আপাতদৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ– যুক্তির বিচারই বর্তমান উদ্দেশ্যের পক্ষে পর্যাপ্ত হতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থের আলোচনা রীতি অনুসরণ করা যেতে পারে, যা আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। দেহাত্মবাদ খণ্ডনে চার্বাকেতর দার্শনিকদের যুক্তি হিেেসব এখানে বোধকরি বিশেষত দুটির আলোচনা যথার্থ হবে।–
ক। দেহাত্মবাদের সমর্থনে চার্বাকেরা আগুন, বাতাস, জল প্রভৃতি স্বয়ং-অচেতন বা জড় ভূতবস্তুগুলির ‘বিশেষ পরিণাম’ হিসেবে যে-কথা বলতে চান তা আসলে বিচারের ধোপে টেকে না। বিশেষত জৈন দার্শনিক গুণরত্ন এই কথাটি বেশ ফলাও করে দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য হলো, আর যে-যাই-বলে-বলুক, বিশেষত চার্বাকদের মুখে একথাটা একেবারেই শোভা পায় না।
খ। চৈতন্য প্রভৃতিকে স্বতন্ত্র কোনো আত্মার ধর্ম বলে স্বীকার না-করে চার্বাকেরা যে-ভাবে নিছক দেহধর্ম বলে প্রতিপন্ন করতে চান তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো মৃতদেহের সাক্ষ্য। চৈতন্য প্রভৃতি যদি শুধুমাত্র দেহেরই গুণ বা লক্ষণ হতো তাহলে যতক্ষণ বা যেখানেই দেহ বর্তমান ততক্ষণ সেখানেই চৈতন্য প্রভৃতি থাকবার কথা। কিন্তু আসলে দেখা যায় যে দেহ থাকা সত্ত্বেও চৈতন্য নাও থাকতে পারে; তারই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত মৃতদেহ। ন্যায়বৈশেষিকের প্রথা অনুসারে জয়ন্তভট্ট যেমন তাঁর স্বভাবসুলভ হেঁয়ালিপূর্ণ বক্তব্যে খুব সাঁটে বলছেন–
‘শরীরং চৈতন্যশূন্যং, শরীরত্বাৎ মৃতশরীরবৎ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : শরীর আসলে চৈতন্যশূন্য, কেননা তা নিছক শরীর, যেমন কিনা মৃতশরীর।
শঙ্করাচার্য অবশ্য যুক্তিটা এরকম সাঁটে বলেননি; তাঁর স্বভাব সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু মূলত একই যুক্তি। এবং অন্যান্য নানা দার্শনিকও এই যুক্তিকেই চলতি কথায় যাকে বলে ‘তুরুপের টেক্কা’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ, অনেকের কাছেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনে এই যেন মোক্ষম প্রমাণ। এছাড়া স্মৃতির নজিরকেও দেহাত্মবাদ খণ্ডনে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের পক্ষ থেকে দেহাত্মবাদ খণ্ডনের নমুনা হিসেবে মূলত এই ক’টি প্রধান যুক্তিই পর্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে যে এ-ক’টির বলে দেহাত্মবাদ সত্যিই খণ্ডন হয় কিনা, কিংবা যা প্রায় একই কথা, দেহ ছাড়াও চৈতন্য-বিশিষ্ট আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু মানবার বাধ্যবাধকতা থাকে কিনা।
.
ক। ‘দেহাকারে পরিণাম’ নিছক ভূতবস্তু না বাড়তি কিছুর ফল?।
‘ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে তাঁরা জানেন, মধ্যযুগ থেকে– কিংবা নাগার্জুনের কথা মনে রাখলে বোধহয় মানতে হবে প্রাচীন কাল থেকেই– এদেশে দার্শনকি দ্বন্দ্বের একটা কৌশল হিসেবে বিপক্ষকে একভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা ছিল। কী-ভাবে কোণ-ঠাসা করা? বিপক্ষের মত উল্লেখ করে প্রথমে দেখানো বিপক্ষের পক্ষেই ঠিক কী কী সম্ভাব্য অর্থে এই মত ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে। তারপর দেখানো, এর মধ্যে কোনো অর্থই যুক্তিসহ নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮৪)
দেহাত্মবাদ খণ্ডন প্রসঙ্গে গুণরত্ন এই রকম একটা দার্শনিক কায়দার পরিচয় দিয়েছেন। কীভাবে?
প্রথমত মনে রাখতে হবে, আগুন-বাতাস-জল-মাটি থেকেই চার্বাকমতে দেহ গঠিত হলেও চার্বাকেরা নিশ্চয়ই মানতে বাধ্য হবে যে ওই ভূতবস্তুগুলিকে যা-হোক-তা-হোক করে একজায়গায় জড়ো করে দিলেই তা থেকে দেহগঠন সম্ভব হবে না, যেমন মদ তৈরির উপকরণগুলি যে-কোনভাবে একত্র করলেই তা থেকে মদ তৈরি হয় না। চার্বাকদের এই বক্তব্যটা নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে বেশ স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন এভাবে–
দেহাত্মবাদ খণ্ডন প্রসঙ্গে গুণরত্ন এই রকম একটা দার্শনিক কায়দার পরিচয় দিয়েছেন। কীভাবে?
প্রথমত মনে রাখতে হবে, আগুন-বাতাস-জল-মাটি থেকেই চার্বাকমতে দেহ গঠিত হলেও চার্বাকেরা নিশ্চয়ই মানতে বাধ্য হবে যে ওই ভূতবস্তুগুলিকে যা-হোক-তা-হোক করে একজায়গায় জড়ো করে দিলেই তা থেকে দেহগঠন সম্ভব হবে না, যেমন মদ তৈরির উপকরণগুলি যে-কোনভাবে একত্র করলেই তা থেকে মদ তৈরি হয় না। চার্বাকদের এই বক্তব্যটা নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্ট তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে বেশ স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন এভাবে–
‘বিশেষ পরিণামের ফলে জড়পদার্থগুলিই কোনোরকম বিশেষ শক্তিসম্পন্ন হলে সেগুলিতেই জ্ঞান বা চৈতন্য উৎপন্ন হয়; যেমন গুড় পিষ্ট প্রভৃতিতে আগে মদশক্তির পরিচয় না-থাকলেও সেগুলিই সুরাকারে পরিণত হলে মদশক্তি লাভ করে। তেমনি ভূতবস্তুগুলি মাটি প্রভৃতি অবস্থায় অচেতন হলেও সেগুলিই ‘দেহাকারে পরিণত’ হলে চৈতন্যবিশিষ্ট হয়।’- (ন্যায়মঞ্জরী)
আগেই বলা হয়েছে, চার্বাকদের বক্তব্য যে মোটের উপর এইরকমই ছিলো তা প্রামাণিক লোকগাথা প্রভৃতি থেকেও স্বীকার করার যথেষ্ট কারণ আছে। অতএব, চার্বাকমতের একটা বৈশিষ্ট্য হিসেবে ‘দেহাকারে পরিণাম’ বলে কোনো একরকম পরিবর্তন স্বীকার না করে উপায় নেই।
এবং ঠিক এই কথাটি নিয়েই গুণরত্ন চার্বাকদের কোণঠাসা করতে চান। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘দেহাকারে’ বা ‘কায়াকারে’ পরিণাম না-মেনে চার্বাকদের গত্যন্তর নেই; কিন্তু চার্বাকরা কীভাবে তার ব্যাখ্যা করবে?
গুণরত্নর মতে, চার্বাকপক্ষ থেকে ঘটনাটার মাত্র তিনরকম ব্যাখ্যা সম্ভব, চতুর্থ কিছু থাকতে পারে না। এইভাবে দেহাত্মবাদীকে কোণঠাসা করে গুণরত্ন দেখাতে চান, তিনটির মধ্যে কোনোটিই চার্বাকমতে স্বীকৃত হতে পারে না। অর্থাৎ দেহাত্মবাদী একদিকে ‘কায়াকারে’ পরিণত হবার কথা বলতে বাধ্য, কিন্তু অপরদিকে স্বমত-সম্মত ভাবে ঘটনাটির কোনোরকম ব্যাখ্যাই দিতে পারেন না।
দেহাত্মবাদীর পক্ষে ‘কায়াকারে’ বা ‘দেহাকারে’ পরিণামের কারণ মোটের উপর তিনরকম হতে পারে–
এক : শুধুমাত্র পৃথিবী প্রভৃতি ভূতই তার কারণ।
দুই : ঘটনাটির আসল কারণ অন্য কিছু। দার্শনিক পরিভাষায় তাকে বলে ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকৃতি।
তিন : ব্যাপারটা অহেতুক, অর্থাৎ তার কোনো কারণই নেই।
প্রথমত, দেহাত্মবাদী নিশ্চয়ই বলতে পারে না যে শুধুমাত্র পৃথিবী প্রভৃতি ভূতবস্তুই কায়াকারে পরিণামের কারণ। কেননা, এই ভূতবস্তুগুলি তো সর্বত্রই বর্তমান এবং শুধুমাত্র এগুলিই যদি শরীররূপে পরিণত হবার পর্যাপ্ত কারণ হয় তাহলে তো সর্বত্রই কায়াকার ঘটবার কথা। তাহলে কি দেহাত্মবাদী বলবে, ভূতবস্তুগুলিই কায়াকারে পরিণত হবার কারণ হলেও এই পরিণতির জন্যে ‘সহকারি কারণ’ হিসেবে আরো কিছু মানা দরকার। যেমন, ধোঁয়ার আসল কারণ অবশ্যই আগুন; কিন্তু গনগনে লোহার পিণ্ডে আগুন থাকলেও ধোঁয়া থাকে না– তার জন্য ভেজা কাঠ জাতীয় সহকারী কারণ থাকা দরকার। কিন্তু ভূতবস্তুর পক্ষেও শরীর-আকারে পরিণত হবার জন্য কোনো রকম সহকারী কারণ কি মানা যায়?
গুণরত্ন বলছেন, সহকারী কারণের কথা আর যার মুখেই শোভা-পাক-না-কেন, অন্তত চার্বাকদের মুখে শোভা পায় না। কেননা তামাম দুনিয়ায় চার্বাকমতে এই ভূতবস্তুগুলি ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই সহকারী কারণ আর কোনো কিছু মানা চার্বাকের পক্ষে অসম্ভব, কিংবা, যা একই কথা, মানতে গেলে চার্বাকের পক্ষে নিজের মূল প্রতিপাদ্যই পরিহার করতে হবে। তথাকথিত ‘সহকারী কারণ’টিকে পৃথিবী প্রভৃতি ভূতপদার্থেরই বৈশিষ্ট্য বলে ব্যাখ্যা করতে গেলে কিন্তু আবার সর্বত্রই দেহাকারে পরিণাম হবার কথা। অতএব, সংক্ষেপে, গুণরত্নর বক্তব্য হলো : হয় ভূতবস্তুকেই একমাত্র সত্য বলে বক্তব্য ছাড়ো, না-হয় তো কায়াকারে পরিণামের কথা ছাড়ো।
আর, এতোশত ঝামেলা এড়াতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি বলতে চাও যে দেহাকারে পরিণাম সম্পূর্ণ অহেতুক– তার কোনো কারণই নেই– তাহলে একদিকে যেমন যখন-তখন যেখানে-সেখানে দেহাকারে পরিণতির সম্ভাবনা স্বীকার করতে হবে, অপরদিকে তেমনই কোথাওই এবং কখনোই তার সম্ভাবনা মানা যাবে না : কোনো নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া একটা ঘটনা যেমন যত্রতত্র ঘটতে পারে আবার তেমনি কোথাওই তা ঘটার সম্ভাবনা থাকে না। মোদ্দা কথা : কোনো ঘটনাকে অহেতুক বললে তা নিয়ে আর কোনো দার্শনিক আলোচনার সুযোগই থাকে না।
এটাকেই কূট-তর্ক বলে কিনা সে-প্রশ্ন না করেও বলা যায় গুণরত্নের যুক্তি-চাতুর্য অবশ্যই স্বীকার্য। ঐতিহাসিকভাবে চার্বাকেরা এজাতীয় যুক্তিবিন্যাসের সত্যিই কোনো জবাব দিতে পারতেন কিনা– বা এই রকম যুক্তির মারপ্যাচের সত্যিই বড় একটা পরোয়া করতেন কিনা– আমাদের পক্ষে মনে হয় আজ তা নিশ্চিতভাবে জানবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে গুণরত্নের যুক্তিটা এমনই অমোঘ যে চার্বাকপক্ষ থেকে তার কোনো জবাবই হয় না। বরং খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, চার্বাকপক্ষ সমর্থনে এহেন যুক্তির জবাব অসম্ভব নয়।
কী জবাব হতে পারে?
দেবীপ্রসাদ বলছেন– ‘একথায় অবশ্যই সন্দেহ নেই যে আগুন-বাতাস-জল-মাটিকে যেমন-তেমন-ভাবে একত্র করলেই ‘দেহাকারে পরিণাম’ সম্ভব নয়। এটুকু কথা যে চার্বাকেরা বুঝতেন না– তা কল্পনা করারও কোনো কারণ নেই। কেননা, চার্বাকদের বেকুব বলে প্রচার করার বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এটুকু প্রত্যক্ষসিদ্ধ ঘটনা তাঁদের পক্ষে অবশ্যই বোঝবার কথা। অতএব গুণরত্ন-বর্ণিত প্রথম পক্ষটি চার্বাক-পক্ষ বলে কল্পনা করার কোনো কারণ নেই। তৃতীয় পক্ষটিও নয় : অর্থাৎ, ‘কায়াকারে পরিণাম’ হিসেবে বর্ণিত ব্যাপারটাকে নেহাতই অহেতুক বলে স্বীকার করে চার্বাকদের পক্ষে একেবারে হাল ছেড়ে দেবার সম্ভাবনাও সুদূর-পরাহত; তাহলে তো মতটা সমর্থন করার আর কোনো সুযোগই থাকে না। অর্থাৎ, গুণরত্নের যুক্তি-খণ্ডনে চার্বাকেরা সত্যিই কী বলতেন-না-বলতেন– আমাদের পক্ষে আজ তা নিশ্চিতভাবে জানবার মতো সুনিশ্চিত কোনো তথ্য না-থাকলেও অন্তত এটুকু অনুমান করার সুযোগ আছে যে, যে-তিনটি সম্ভবপর পক্ষ দেখিয়ে গুণরত্ন তাঁদের কোণঠাসা করতে গিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্তত দুটি চার্বাকপক্ষ থেকে মানবার কোনো কারণ নেই। তাহলে বাকি থাকে মাত্র আর একটি পক্ষ। দার্শনিক পরিভাষায় তা হলো ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকৃতি।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮৬)
এই ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’র ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। চার্বাকমতে প্রকৃত দার্শনিক তত্ত্ব বলতে মাত্র চতুর্ভূত। তামাম দুনিয়ায় এই চতুর্ভূত ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। কিন্তু এই চতুর্ভূতকে যেন-তেন-প্রকারে সমবেত বা একত্র করলেই তো আর দেহাকারে পরিণাম সম্ভব নয়। তাহলে দেহাকারে পরিণামের ব্যাখ্যা হিসেবে আরো বাড়তি কিছু মানতে হবে। অর্থাৎ, চতুর্ভূত ছাড়াও আরো কোনো তত্ত্ব মানতে হবে। ওই বাড়তি কিছুকে ‘তত্ত্বান্তর’ বলা হবে।
তার মানে, গুণরত্ন বলতে চান, তোমার নিজের মতেই শুধুমাত্র যা তত্ত্ব বলে ঘোষণা করতে চাও– বা শুধুমাত্র সত্য বলে ঘোষণা করতে চাও– তোমার নিজের পক্ষ সমর্থনেই শুধুমাত্র তাকেই সত্য বলে মানা চলে না। তাছাড়াও আরো কিছু মানা দরকার। এবং এ-হেন বাড়তি কিছুকে যদি মানতে বাধ্য হও তাহলে নিজের মূল মতটা শোধরাতে রাজি হও। স্বীকার করো যে আগুন-বাতাস-জল-মাটি ছাড়াও আরো কোনো সত্য আছে– এ-হেন বাড়তি সত্য না-মানলে কোনো এক বিশেষ অবস্থায় কায়াকারে পরিণাম সম্ভব নয়– এ-হেন ঘটনার আর কী ব্যাখ্যা দেবে?
কিন্তু এইভাবে ‘তত্ত্বান্তর’– বা বাড়তি তত্ত্ব– মানতে বাধ্য হওয়াটা দার্শনিকের পক্ষে মারত্মক ব্যাপার– যাকে বলে হার স্বীকার করা। নিজেই যাকে শুধুমাত্র সত্য বলে ঘোষণা করছো তা ছাড়াও আরো কিছু সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য হও। সোজা কথায়, নিজের দর্শন থেকেই ইস্তফা দাও।
তাহলে কি দেহাকারে পরিণামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে চার্বাকেরা নিরুপায় হয়ে ‘শুধুমাত্র চতুর্ভূতই সত্য’ এই দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন? গুণরত্নের তর্ক-চাতুর্য মেনে নিয়েও উত্তরে বলা যায়, অন্তত এই সম্ভাবনা অনিবার্য নয়। অর্থাৎ, প্রকৃত অর্থে ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকার করতে বাধ্য না-হয়েও স্বমত-সম্মতভাবে চার্বাকদের পক্ষে দেহাকারে পরিণামের একটা যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব।
কী রকম ব্যাখ্যা?
এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলছেন– ‘আসলে তত্ত্বান্তরের প্রসঙ্গটা ওঠে কখন?
প্রথমে একটা সহজ দৃষ্টান্ত দেখা যাক। সকলেই মানবেন, ‘অগ্নি উষ্ণ’। কিন্তু একথা মানলেই সকলে কি ‘অগ্নি’ ছাড়াও ‘উষ্ণতা’– বা উষ্ণতার ব্যাখ্যায়– বাড়তি কোনো তত্ত্ব স্বীকার করতে বাধ্য? নিশ্চয়ই নয়। কেন নয়? কারণ, ‘উষ্ণতা’ অগ্নি-বহির্ভূত স্বতন্ত্র কিছু নয়। অগ্নির স্বভাবই হলো ‘উষ্ণ’। তাই উষ্ণতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অগ্নি ছাড়া বাড়তি কিছু মানতেই হবে– এ-হেন দাবি চলতি কথায় যাকে বলি এঁড়ে তর্ক। বাজে কথা।
তাহলে ‘স্বভাব’ বলে কোনো কিছু মানার একটা সুযোগ আছে। জল শীতল। কেন শীতল? জলের স্বভাবই তাই। কোনো দার্শনিক মুখে স্বীকার করুন-আর-নাই-করুন, ‘স্বভাব’ বলে একটা কিছু মানতেই হবে, এবং ‘স্বভাব’ বলে কিছু মানা মানেই ‘তত্ত্বান্তর’ স্বীকৃতি নয়। তত্ত্বান্তরের প্রসঙ্গ তাহলে ওঠে কখন? স্বমত-স্বীকৃত তত্ত্বর স্বভাব-বহির্ভূত কোনো কিছু মানলে। নইলে নয়।
এই কথা মনে রাখলে চার্বাকমতের সমর্থনে চতুর্ভূতেরই দেহাকারে পরিণামের ব্যাখ্যার জন্যে তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি অনিবার্য নয়। চার্বাকপক্ষ থেকে অনায়াসেই বলা যায়, চতুর্ভূতের স্বভাবই হলো ‘পরিস্থিতি-বিশেষে তা দেহাকারে পরিণত হয়’। এখানে কোটেশন চিহ্ন ইচ্ছে করে ব্যবহার করছি, কেননা পুরো বক্তব্যটাকেই চতুর্ভূতের স্বভাব বলে বর্ণনা করতে চাই। কূট তার্কিক অবশ্যই আপত্তি তুলতে পারেন যে ‘পরিস্থিতি-বিশেষ’ বলে ব্যাপারটাকে আলাদা করে বুঝতে হবে; ওটাকে চতুর্ভূতের স্বভাবের মধ্যে গুঁজে দেওয়া চলবে না। এবং আলাদা করে ভাবলে তত্ত্বান্তরের স্বীকৃতি থেকে যায়। কিন্তু এ-হেন আপত্তিতে চার্বাকের পক্ষে বিচলিত হবার কারণ নেই। কেননা, পরিস্থিতি-বিশেষকে কেন আমরা আলাদা করে ভাবতে বাধ্য হবো? স্বভাব বলে ব্যাপারটা কখনো বা সরল আবার কখনো বা জটিল হতে পারে। ভারতীয় দর্শনে স্বভাব-এর ব্যাখ্যায় অনেকরকম প্রাকৃতিক নিদর্শন বা নমুনার কথা পড়েছি। নিম তেতো; খেজুর মিষ্টি। কিন্তু কেন? কেননা ওদের স্বভাবই ওই রকম। আধুনিক বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন করুন। নিম কেন তেতো বা খেজুর কেন মিষ্টি– এজাতীয় প্রশ্নের উত্তর হিসেবে তিনি নিশ্চয়ই অল্প-বিস্তর দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেবেন। অত কথা অবশ্যই প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকদের জানা ছিল না, থাকবার কথাও নয়। কিন্তু তাঁরা যখন বলতেন, নিমের স্বভাবই তিক্ততা বা খেজুরের স্বভাবই মধুরতা তখন তাঁদের প্রকৃত বক্তব্যটুকু আজকের দিনে আমরা কী ভাবে বুঝবো? আধুনিক বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায় পুরোটাই জটিল ব্যাপার। কিন্তু পুরোটাকে আলাদা-আলাদাভাবে ভেঙে বোঝাবার চেষ্টা নিরর্থক। পুরো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার প্রতিটি উপাদান ভেঙে এবং আলাদা-আলাদা ভাবে বুঝতে গেলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ‘স্বভাব’ বলে ধারণাটাও অর্থহীন হয়ে যাবার আশঙ্কা। চার্বাক-পক্ষ থেকেও এই কথা, চার্বাকদের বিপক্ষের পক্ষেও একই কথা। তার মানে নিশ্চয়ই এই নয় যে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে অবহেলা করার কোনো প্রস্তাব আমাদের কাছে স্বীকৃত হতে পারে। অবশ্য সেইসঙ্গে একথাও মানা দরকার যে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বিতর্কটার বিচার প্রাচীন ভারতীয় চিন্তার সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই আবদ্ধ রাখা প্রাসঙ্গিক। যেমন ধরা যাক চতুর্ভূত-এর (বা পঞ্চভূত-এর) কথা : আগুন বাতাস জল মাটি (এবং তার সঙ্গে অনেকে আকাশ বলে পঞ্চম একটা ভূতপদার্থ জুড়েছেন)। চার্বাকমতে সত্য চতুর্ভূতই; অন্যান্য নানা দার্শনিকের মতেও ভূতপদার্থের তালিকা মোটামুটি একই রকম। অন্যান্যরা এই ভূত-পদার্থকেই একমাত্র সত্য বলে স্বীকার করতে রাজি না হলেও ভূতপদার্থ বলতে তাঁদের জ্ঞান-গম্মি ওই পর্যন্তই। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আগুন বাতাস জল প্রভৃতির কতটুকু বা আজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে? শুধু প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের কথাই বা কেন? প্রাচীন গ্রীক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শনের বেলাতেও একই কথা। যুগের পর যুগ ধরে ভূতপদার্থের জ্ঞান বেড়েছে, ধারণাও বদলেছে। বিশ্বপ্রকৃতি প্রসঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে। এবং জ্ঞানের এই অগ্রগতির দৌড় আজ এমন প্রচণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে যে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবুও প্রাচীন দর্শনের আলোচনা নিছক অজ্ঞানের আবর্জনা বলে বর্জিত হয়নি, বা অন্তত তা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। মানুষ আজ কোথায় এসে পৌঁছেছে এবং কোনদিকে কীভাবে আগামীকাল তার অগ্রগতির পথ নির্ণীত হবে তা উপলব্ধির জন্যে অতীতকে আরো ভালো করে বোঝবার তাগিদ থেকে গিয়েছে। সোজা কথায়, অজ্ঞানের অপবাদ দিয়ে অতীতটাকে একেবারে মুছে ফেলা যায় না। তাহলে ইতিহাস বলে ব্যাপারটাই বরবাদ হবার আশঙ্কা।… ইতিহাসের চর্চা চলছে, চলবে। কেননা, অতীতের উপর থেকে পর্দা সরাতে পারলেই ভবিষ্যতের পথ নির্ণয় করার প্রয়াস তুলনায় নির্ভুল হয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮৭-৯)
তার মানে, আধুনিক বিজ্ঞানের মানদণ্ডে বিচার করে প্রাচীন দর্শনকে একেবারে বাতিল করার প্রস্তাবটা যুক্তিযুক্ত হবে না। ফলে প্রাচীন দর্শনের বিতর্ক প্রসঙ্গে প্রাচীন যুগের দিকেই ফিরে তাকাতে হবে। সেক্ষেত্রে তাহলে প্রাচীন বিতর্কটার পুনর্বিচারে প্রাচীন কালের ধ্যান-ধারণার সাধারণ চৌহদ্দির কথা ভুলে গেলে চলবে না। সেই চৌহদ্দির মধ্যেই চার্বাকেরা দাবি করেছিলেন, ভূতপদার্থ থেকেই প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতির উদ্ভব। আধুনিক বিজ্ঞানীদের উচ্চাঙ্গ পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা মনে রেখেও বোধ হয় বলা যায় প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতির উদ্ভব বা উৎপত্তি প্রসঙ্গে সমস্যার চরম সমাধান আমাদের পক্ষে এখনো অপেক্ষা-সাপেক্ষ। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা অন্তত বলা চলে যে, সে-সমাধানের আশায় আধুনিক বিজ্ঞান ভূতপদার্থ ছাড়াও আত্মা জাতীয় কিছুর প্রাচীন কল্পনা পুনরুজ্জীবনের তাগিদ বোধ করছে না। অবশ্য ভূতপদার্থের স্বরূপ নির্ণয়ে সেকালের সঙ্গে একালের আকাশ-পাতাল তফাৎ, আবার একালের সঙ্গে আগামীকালের পার্থক্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তাও আন্দাজ করা সহজ নয়। এটাই বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রগতি।
কিন্তু সেই প্রসঙ্গেই একথা বলাও আবশ্যক যে, বৈজ্ঞানিক তথ্যের যৎসামান্য সম্বল সত্ত্বেও চার্বাকেরা যেভাবে সমস্যাটার একটা সন্ধান খুঁজেছিলেন, আধুনিক জ্ঞানের মানদণ্ডে তার মূল্যায়ন অবশ্যই অবান্তর। কিন্তু তারই মধ্যে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের কোনো প্রতিশ্রুতি বা এমনকি কোনোরকম অস্পষ্ট আভাস ছিলো কিনা, এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই অবান্তর নয়। সে-আভাসের কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, নিছক ভূতবস্তু থেকেই প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতির উৎপত্তি ব্যাখ্যার দিকেই আজকের বিজ্ঞানের ঝোঁক, ভূতবস্তু অতিরিক্ত কোনো আত্মার কথায় ফিরে আসবার দিকে নয়। এমনকি, দেবীপ্রসাদের মতে, একথাও বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে এই উৎপত্তির ব্যাখ্যায় আধুনিক বিজ্ঞানেও এক অর্থে শেষ পর্যন্ত স্বভাববাদের উপরই নির্ভরতা। কেননা, স্বভাববাদের মূল কথাটা হলো প্রাকৃতিক নিয়ম। অবশ্যই আধুনিক বিজ্ঞানে প্রাকৃতিক নিয়ম বা স্বভাবকে বোঝবার ব্যাপারেও যে-অগ্রগতি, তার কথা ভুলে যাওয়াও কোনো কাজের কথা নয়; তুলনায় এই প্রসঙ্গে চার্বাকদের যেটুকু জ্ঞান তা একান্তই প্রাথমিক। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা এই যে প্রাথমিক অবস্থা থেকেই মানুষ শুরু করতে বাধ্য। আধুনিক জ্ঞানের প্রকাণ্ড ইমারত রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। এবং এই ইমারত গড়ার ভিত্তিস্থাপনে যাঁরা প্রথম পদক্ষেপের পরিচয় দিয়েছিলেন ইতিহাসের বিচারে তাঁদের অবদান অসীম।
‘অনুমান হয় ভূতপদার্থ থেকে চৈতন্য প্রভৃতির উৎপত্তি প্রসঙ্গে চার্বাকদের পক্ষ থেকে চরম কথা ‘স্বভাব’ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তর্কের খাতিরে এই স্বভাবের কথা চেপে গিয়ে ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’ বলে একটা গুরুগম্ভীর যুক্তির অবতারণা বস্তুনিষ্ঠ দার্শনিক বিচারের পরিচায়ক নয়। স্বভাব শব্দের একটা সংকীর্ণ অর্থ উদ্ভাবন করে বিপক্ষের ঘাড়ে তা চাপিয়ে দেবার চেষ্টাও চলবে না। যেমন ‘অগ্নির স্বভাব উষ্ণ’– শুধু এটুকু বলাই পর্যাপ্ত নয়। আরো বলা দরকার : ‘উষ্ণস্বভাব অগ্নির স্বভাবই এই যে অন্যান্য ভূতপদার্থের সঙ্গে নির্দিষ্ট নিয়মে মিলিত এবং পরিবর্তিত হয়ে তা কায়াকারে বা দেহরূপে পরিণত হয়।’ বাড়তি কথাটুকুকে ‘স্বভাব’ ছাড়াও অন্য কিছু বলে কল্পনা করে ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’-র অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯০)
এ-প্রসঙ্গে তাই মদশক্তির দৃষ্টান্তটা আবার উল্লেখ করা যেতে পারে, কেননা এক্ষেত্রেও কি গুণরত্নের মতো প্রখর তার্কিক ‘তত্ত্বান্তর স্বীকৃতি’র অভিযোগ আনবেন? বা এজাতীয় অভিযোগ তোলবার কোনো সুযোগ আছে? শুষ্ক তর্কের খাতিরে হয়তো থাকতে পারে; কেননা মদ্য প্রস্তুতের উপাদানগুলি যেন-তেন-প্রকারে জড়ো করলেই মদ তৈরি হয় না। এগুলিরই একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে মদ তৈরি হয়। কিন্তু এই বিশেষ পরিণাম স্বীকার করা মানেই বাড়তি তত্ত্বের স্বীকৃতি নয়; তা উপাদানগুলির স্বভাব। তার প্রমাণ, অন্য উপাদান দিয়ে মদ তৈরি করা যায় না; শুধুমাত্র নির্দিষ্ট উপাদান– অতএব সেগুলির নির্দিষ্ট স্বভাব থেকেই মদ তৈরি হয়। ‘বিশেষ পরিণাম’টা তাই তত্ত্বান্তর নয়; উপাদান-সমূহের স্বভাবেরই অন্তর্ভুক্ত।
এখানে উল্লেখ্য, চার্বাকদর্শনের আরেকটি উপপাদ্য হলো ‘স্বভাববাদ’, যে-বিষয়ে আমরা পরে আলোকপাত করবো। তবে এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের আরেকটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য–
‘স্বভাব’ বলে এই ধারণাটি প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে সর্বসম্প্রদায়-স্বীকৃত কোনো ধারণা নয়। সম্প্রদায়-বিশেষে তা স্বীকৃত; সম্প্রদায়-বিশেষে সম্পূর্ণ অস্বীকৃত।… ‘স্বভাববাদ’-এর সমর্থক হিসাবে চার্বাকেরাই একমাত্র দার্শনিক হোন-আর-নাই-হোন অন্তত সবচেয়ে অগ্রণী দার্শনিক। পক্ষান্তরে ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকেরা স্বভাববাদ খণ্ডনের সাধ্যমতো প্রয়াস করেছেন।
কেন করেছেন? কেননা, স্বভাববাদ মানায় দেহাত্মবাদ ছাড়াও অন্যান্য দার্শনিক বিপত্তির আশঙ্কা আছে। এমনকি তার ফলে অধ্যাত্মবাদের ভিত টলে যাবার ভয়। কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে এর একটা বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও উপেক্ষণীয় নয়। বিজ্ঞানী-মহলে– বিশেষত চিকিৎসা-বিজ্ঞানীদের মূল প্রতিপাদ্য প্রসঙ্গে– স্বভাববাদ স্বীকৃত হয়েছে। এদিক থেকে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে চার্বাকমতের একরকম আত্মীয়তা অনুমানের অবকাশ আছে। অন্যান্য দিক থেকেও আছে। আগেও দেখেছি। পরে আরো দেখবো।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯১)
.
খ। মৃতদেহের নজির।
দেহাত্মবাদ খণ্ডনে ভারতীয় দর্শনে একাধিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে মৃতদেহের নজির দেখিয়ে এই যুক্তি প্রস্তাবিত হয়েছে। কিন্তু সহজ সরল ও সুখপাঠ্য হিসেবে সমগ্র ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে শঙ্করাচার্যের রচনা তুলনাহীন বলা চলে। তাই দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে প্রধানতম এই যুক্তিটি বোঝবার জন্য তাঁর লেখাই অনুসরণ করা সুবিধাজনক হবে। তবে যতো সহজ ভাষাতেই শঙ্কর এই যুক্তি প্রকাশ করুন না কেন, ‘ব্যতিরেক’, ‘অব্যতিরেক’ প্রভৃতি কিছু অতি-প্রচলিত পারিভাষিক শব্দ তিনিও ব্যবহার করেছেন। তাই এ-জাতীয় পারিভাষিক শব্দের তাৎপর্য সাধ্যমতো অক্ষুণ্ন রেখে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনার অনুসরণে সাদামাটা ভাষায় দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে এই মূল যুক্তিটি উপস্থাপন ও পর্যালোচনা করা যায়।
প্রথমে, যুক্তিটা কী?
‘দেহ ছাড়া আত্মা বলে যদি আর কিছু না মানো তাহলে আত্মবাদীরা যে ধর্মগুলিকে আত্মধর্ম বলে স্বীকার করতে চান সেগুলিকেও আসলে দেহধর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে। এজাতীয় ধর্ম বলতে শঙ্কর প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য ও স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। দেহাত্মবাদীরা এই ধর্মগুলিকেও নিছক দেহের ধর্ম বলে স্বীকার করতে বাধ্য; অন্য কিছুর ধর্ম বলে মানতে গেলে তো দেহাতিরিক্ত অন্য কিছু– অর্থাৎ আত্মা– মানতে হয়। কিন্তু শঙ্কর দেখাতে চান এগুলিকে নিছক দেহধর্ম বলে প্রমাণ করা অসম্ভব। আসলে আমাদের ক্ষেত্রে দু-রকম ধর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। একরকম হলো নিছক দেহের ধর্ম; আর একরকম ধর্মকে দেহ-অতিরিক্ত কিছুর (আত্মার) ধর্ম বলে স্বীকার না-করে উপায় নেই। তফাৎটা কীভাবে নির্ণয় করা হবে? যা নিছক দেহধর্ম তার লক্ষণ হবে দেহের বিদ্যমানতায় ধর্মটিরও বিদ্যমানতা : যতক্ষণ দেহ থাকবে ততক্ষণ ধর্মটিও থাকতে বাধ্য। যেমন, রূপ। দেহ বর্তমান অথচ তার রূপ অবর্তমান– এ-হেন কথা কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু দেহ বর্তমান হলেও যদি কোন ধর্ম অবর্তমান হয় তাহলে আর কীভাবে তাকে নিছক দেহেরই ধর্ম বলা যাবে? পক্ষান্তরে, এজাতীয় ধর্মকে দেহান্যধর্ম– বা দেহ ছাড়া অন্য কিছুর ধর্ম, অর্থাৎ আরো সহজ কথায়, আত্মার ধর্ম– বলে মানতে আমরা বাধ্য।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯২)
এই যুক্তি মনে রেখে প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি ধর্মগুলির কথা বিচার করা যাক। যদি দেখা যায়, দেহ বর্তমান থাক সত্ত্বেও এই ধর্মগুলি অবর্তমান হয় তাহলে এগুলিকে কিছুতেই নিছক দেহধর্ম বলার সুযোগ থাকে না। অথচ বাস্তবে এই ব্যাপারই দেখা যায়– দেখা যায় দেহ আছে অথচ এই ধর্মগুলি নেই। কোথায় দেখা যায়? মৃতদেহের দৃষ্টান্তে। মৃতদেহও দেহ। তাই মৃতদেহেও নিছক দেহধর্ম বর্তমান। যেমন, রূপ– মৃতদেহ থেকে রূপ বলে ধর্মটি উবে যায় না। কিন্তু প্রাণ, চৈতন্য, চেষ্টা ইত্যাদি? অবশ্যই ভারতীয় দর্শনে বোকা-হাবা বলে চার্বাকদের রকমারি গালিগালাজ দেবার প্রথা ছিলো। কিন্তু তাই বলে কি এমনই হাবা যে ওরা বলবে, মৃতদেহেও প্রাণ, চৈতন্য ইত্যাদির পরিচয় আছে? চার্বাকদের অতি-বড় সমালোচকেরাও ওঁদের ঘাড়ে এরকম অসম্ভব কোনো কথা চাপিয়ে দেননি। মড়াটা যে প্রাণহীন, চৈতন্যহীন ইত্যাদি– এই ব্যাপারটা এমনই প্রকট যে চার্বাকের মতো আকাট বোকাও তা যেন স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু একথা স্বীকার করলে আরো স্বীকার করতেই হবে যে প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি নিছক দেহধর্ম হতে পারে না। লাশটা তো রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কি প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি ধর্মের লেশমাত্র পরিচয় পাওয়া যায়? নিশ্চয়ই নয়। তা সত্ত্বেও কী করে চার্বাকেরা আত্মা বাদ দিয়ে প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতিকে নিছক দেহধর্ম বলে কল্পনা করতে পারেন?
আপাত-দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, চার্বাকদের বিরুদ্ধে এ যেন একেবারে মোক্ষম যুক্তি, যা থেকে চার্বাকপক্ষকে বাঁচানোর আর উপায় নেই। হয়তো এই কারণেই অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনের উৎসাহে মূলত এই যুক্তিই প্রয়োগ করেছেন। যদিও সকলের প্রকাশভঙ্গি সমান নয়– কারুর লেখা কঠিন, কারুর লেখা তুলনায় সহজ; কারুর লেখায় যুক্তির সঙ্গে আরো নানা কথা জুড়ে দিয়ে পুরো আলোচনা অনেক বেশি কঠিন-কঠোর করবার প্রয়াস, কারুর লেখায় সে-চেষ্টার পরিচয় তুলনায় কম। কিন্তু মূল যুক্তিটা একই।
এখানে আমাদের পক্ষে তাঁদের প্রতিটি উক্তি উদ্ধৃত করার সুযোগ নেই। দরকারও নেই। আমরা ইতঃপূর্বেই তার কিছু নমুন দেখেছি। চার্বাকপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে খুচরো-খাচরা তর্ক-বিতর্ক তুলেও আলোচনা পল্লবিত করা যেতে পারে; কিন্তু সে-চেষ্টারও প্রয়োজন নেই। যেমন ধরা যাক, চার্বাকপক্ষ থেকে অনায়াসে বলা যেতে পারে, দেহ এবং মৃতদেহ এক নয়। নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক আত্মাবাদীর আচরণ থেকেই তার প্রকাশ পায়। কীভাবে? যে-গুরুজনকে আজ তিনি অতি ভক্তিভরে প্রণাম করেছেন তাঁরই মৃতদেহ আগামীকাল এমনই অপবিত্র হবে যে ছুঁলে স্নান করার বিধান। অতএব মৃতদেহর নজির দেখিয়ে দেহমাত্র প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আত্মবাদীকেও নতুন করে ভাবতে হবে। কিংবা, চার্বাকপক্ষ থেইে তর্ক তুলে বলা যেতে পারে যে মৃতদেহের নজির থেকে দেহমাত্র প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্তে বাধা আছে। যেমন নিছক দেহের একটা ধর্ম বা লক্ষণ হিসেবে শঙ্কর রূপ প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দেহ এবং মৃতদেহের রূপ প্রভৃতি ধর্মও কি সর্বাংশে সমান?
কিন্তু এখানে এজাতীয় খুচরো যুক্তির তালিকা তৈরি করার দরকার নেই। কেননা, আবার দেহাত্মবাদের খণ্ডনে আত্মাবাদীরা এজাতীয় খুচরো কিন্তু পাল্টা যুক্তির পাল্টা ফর্দ তৈরি করতে পারেন। সে-সবের জটিলতায় ফাঁসলে আসল বিতর্কটা থেকে অল্পবিস্তর বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা। দেহাত্মবাদ-বিরোধী আত্মাবাদীদের চতুর উদ্দেশ্যটাও আসলে এখানেই। তাই, এ-জাতীয় আলোচনার না-তুলে এখানে ভারতীয় প্রমাণবিদ্যার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে বিতর্কটার সোজা ভাষায় পুনর্বিচারে প্রয়াস করা যায়।
দেহাত্মবাদের আলোচনায় আচার্য শঙ্কর দেহ এবং চৈতন্য প্রভৃতির মধ্যে ধর্ম-ধর্মী ভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষায় তাকে কারণ-কার্য সম্বন্ধেরই একটা নমুনা বলে ধরা যেতে পারে। এখানে পঞ্চভূতে গড়া দেহটি কারণ, এবং চৈতন্য প্রভৃতি ধর্ম তারই কার্য। একথা মানলে, ভেবে দেখতে হবে ভারতীয় প্রমাণ-বিদ্যার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মূল পদ্ধতি কী এবং তা খণ্ডনেরই বা মূল শর্ত কী?
প্রমাণ-বিদ্যায় কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার প্রধান শর্ত বলতে দু’রকম– অন্বয় ও ব্যতিরেক–
এক। কারণ থাকলে কার্য থাকবে। যেমন, বহ্নি ধূমের কারণ হলে বহ্নি থাকলে ধূম থাকবে।
দুই। কারণ না থাকলে কার্য থাকে না। যেমন, বহ্নিশূন্য ধূমের অভাব।
প্রমাণ-বিদ্যার পরিভাষায়, প্রথমটিকে বলে ‘অন্বয়’, দ্বিতীয়টিকে বলে ‘ব্যতিরেক’। এবং কার্য-কারণ সম্বন্ধ খণ্ডনের প্রসিদ্ধ নিয়ম হলো, ‘অন্বয়’ এবং ‘ব্যতিরেক’ উভয়েরই গলদ দেখানো। সেক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের বিচারে দেহাত্মবাদীর পক্ষে ‘অন্বয়’ হবে– শরীর থাকলে চৈতন্য প্রভৃতি থাকবে। এবং ‘ব্যতিরেক’ হবে– শরীরের অভাবে চৈতন্য প্রভৃতিরও অভাব হবে।
কিন্তু মৃতদেহের নজির থেকে কতটুকু কথা প্রমাণ হয়? দেহাত্মবাদের পক্ষে শুধু ‘অন্বয়’টুকুর খণ্ডন– শরীর থাকলেও চৈতন্য প্রভৃতির অভাব হতে পারে। মৃতদেহের নজির দেখিয়ে আত্মাবাদীরা এটুকুই দেখাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, তাছাড়াও প্রমাণ-বিদ্যার অনিবার্য শর্ত হিসেবে ‘ব্যতিরেক’টিও খণ্ডন করা দরকার। অর্থাৎ, দেখানো দরকার যে শরীরের অবিদ্যমানতা সত্ত্বেও চৈতন্য প্রভৃতির পরিচয় সম্ভব। আত্মবাদী মহলে এই দ্বিতীয় কথাটি প্রমাণ করবার উৎসাহ বড় একটা চোখে পড়ে না। তার কারণ হয়তো এই যে তা প্রমাণ করা সহজসাধ্য নয়, বা অন্তত সহজবুদ্ধির কাছে গ্রাহ্য হওয়া কঠিন। দেহ নেই অথচ শুধু চৈতন্য আছে– এহেন ঘটনার নজির দেখানো তেমন সোজা নয়।
আত্মাবাদীদের পক্ষ থেকে হয়তো দাবি করা হবে যে দেহের মায়া কাটিয়ে আত্মা মোক্ষলাভ করলে চৈতন্য থাকে, কিন্তু শরীর থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে গেলো নয় কি? কেননা প্রত্যক্ষসিদ্ধ নজিরবিহীন মোক্ষলাভের কথাটা মেনে নিলেও– বিদেহী আত্মার অস্তিত্ব আপাত-কল্পনায় স্বীকার করলেও– মুক্ত আত্মার অবস্থাটা আসলে কীরকম, এ-বিষয়ে আত্মবাদীদের মধ্যেও মতে মিল নেই। যেমন শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অনুসারে, মুক্ত আত্মা চৈতন্যস্বরূপ; কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা তা মানেন না। তাঁদের মতে মুক্ত আত্মার স্বরূপ জড়বস্তুর মতোই; তাতে চৈতন্যের কোন পরিচয় নেই। শুধুমাত্র দেহ, ইন্দ্রিয়, বিষয় বা বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযোগের ফলে আত্মাতে চৈতন্যের উদ্ভব হয়।
তার মানে, দেহের অনুপস্থিতিতেও চৈতন্যের পরিচয় পাওয়া যায়– এই দাবির পক্ষে সুনিশ্চিত প্রমাণ দেখাতে না-পারলে ভারতীয় প্রমাণবিদ্যার প্রথা অনুসারেই দেহাত্মবাদের খন্ডন সর্বাঙ্গীণ বা সম্পূর্ণ হয় না। মৃতদেহের নজির থেকে বড় জোর এটুকুই প্রমাণ হতে পারে যে দেহ বর্তমান থাকলেও চৈতন্যের অভাব সম্ভব। তার বেশি কিছু নয়। অতএব, দেবীপ্রসাদের ভাষ্য হলো–
‘জীবদেহ ও মৃতদেহকে দেহ অর্থে সম্পূর্ণ অভিন্ন বলে স্বীকার করলেও শুধুমাত্র তারই নজির থেকে দেহাত্মবাদের পূর্ণাঙ্গ খণ্ডন হয় না। অন্তত ভারতীয় ন্যায়বিদ্যার নিরিখে নয়। কিংবা, দাবাড়ে ভাষায়, শুধু মড়ার নজিরের চাল দিয়ে দেহাত্মবাদকে মাৎ করে দেওয়া সম্ভব নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯৫)
এ প্রসঙ্গে তাই হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন–
‘যেহেতু চেতনা জীবদেহেরই একটা বিশেষ গুণ তাই দেহের সঙ্গে সঙ্গেই চেতনার জন্ম ও মৃত্যু। এর অকাট্য অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ হল :
যে পর্যন্ত দেহ জীবিত থাকে সে পর্যন্ত চেতনা থাকে। মৃতদেহে কোনো চেতনার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা চেতনা বিশিষ্ট দেহ দেখতে পাই, চেতনাশূন্য দেহও দেখতে পাই। কিন্তু দেহহীন স্বাধীন চেতনা কোথাও কখনো দেখি না। এর দ্বারাই প্রমাণ হয় চেতন দেহেরই এক বিশেষ গুণ, চৈতন্যময় আত্মা নামক দেহবিযুক্ত কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নেই।
এই সিদ্ধান্তের জন্যই চার্বাক দর্শনকে বলা হয় ভূতচৈতন্যবাদী বা দেহাত্মবাদী দর্শন। এই মতবাদ স্বভাববাদেরই একটা অঙ্গ।’- (চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩১)
সাথে সাথে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় এই চার্বাক-সিদ্ধান্তের তাৎপর্যটাও উল্লেখ করে দিতে ভুলেন না যে–
‘চৈতন্য ভৌতিক প্রাণিদেহেরই একটি বিশেষ গুণ– এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তা হলে দেহব্যতিরিক্ত, দেহবহির্ভূত চৈতন্যময় আত্মা নামক কোনো স্বতন্ত্র অজর অমর পদার্থ নেই যে পদার্থটি জন্ম-জন্মান্তর পরিভ্রমণের পর, সংসার চক্রের বাইরে ঈশ্বরের দরবারে মুক্ত পুরুষ রূপে অবস্থান করে। স্বতন্ত্র আত্মা না থাকলে, জন্ম-জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, স্বর্গ নরক, পারলৌকিক মুক্তি, সৃষ্টিকর্তা ও মুক্তিদাতা ঈশ্বর সব কিছুই অনাবশ্যক বলে বাতিল হয়ে যায়।’- (চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩১)
.
গ। স্মৃতির নজির।
প্রথমে, যুক্তিটা কী?
‘দেহ ছাড়া আত্মা বলে যদি আর কিছু না মানো তাহলে আত্মবাদীরা যে ধর্মগুলিকে আত্মধর্ম বলে স্বীকার করতে চান সেগুলিকেও আসলে দেহধর্ম বলে গ্রহণ করতে হবে। এজাতীয় ধর্ম বলতে শঙ্কর প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য ও স্মৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। দেহাত্মবাদীরা এই ধর্মগুলিকেও নিছক দেহের ধর্ম বলে স্বীকার করতে বাধ্য; অন্য কিছুর ধর্ম বলে মানতে গেলে তো দেহাতিরিক্ত অন্য কিছু– অর্থাৎ আত্মা– মানতে হয়। কিন্তু শঙ্কর দেখাতে চান এগুলিকে নিছক দেহধর্ম বলে প্রমাণ করা অসম্ভব। আসলে আমাদের ক্ষেত্রে দু-রকম ধর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। একরকম হলো নিছক দেহের ধর্ম; আর একরকম ধর্মকে দেহ-অতিরিক্ত কিছুর (আত্মার) ধর্ম বলে স্বীকার না-করে উপায় নেই। তফাৎটা কীভাবে নির্ণয় করা হবে? যা নিছক দেহধর্ম তার লক্ষণ হবে দেহের বিদ্যমানতায় ধর্মটিরও বিদ্যমানতা : যতক্ষণ দেহ থাকবে ততক্ষণ ধর্মটিও থাকতে বাধ্য। যেমন, রূপ। দেহ বর্তমান অথচ তার রূপ অবর্তমান– এ-হেন কথা কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু দেহ বর্তমান হলেও যদি কোন ধর্ম অবর্তমান হয় তাহলে আর কীভাবে তাকে নিছক দেহেরই ধর্ম বলা যাবে? পক্ষান্তরে, এজাতীয় ধর্মকে দেহান্যধর্ম– বা দেহ ছাড়া অন্য কিছুর ধর্ম, অর্থাৎ আরো সহজ কথায়, আত্মার ধর্ম– বলে মানতে আমরা বাধ্য।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯২)
এই যুক্তি মনে রেখে প্রাণ, চেষ্টা, চৈতন্য, স্মৃতি ধর্মগুলির কথা বিচার করা যাক। যদি দেখা যায়, দেহ বর্তমান থাক সত্ত্বেও এই ধর্মগুলি অবর্তমান হয় তাহলে এগুলিকে কিছুতেই নিছক দেহধর্ম বলার সুযোগ থাকে না। অথচ বাস্তবে এই ব্যাপারই দেখা যায়– দেখা যায় দেহ আছে অথচ এই ধর্মগুলি নেই। কোথায় দেখা যায়? মৃতদেহের দৃষ্টান্তে। মৃতদেহও দেহ। তাই মৃতদেহেও নিছক দেহধর্ম বর্তমান। যেমন, রূপ– মৃতদেহ থেকে রূপ বলে ধর্মটি উবে যায় না। কিন্তু প্রাণ, চৈতন্য, চেষ্টা ইত্যাদি? অবশ্যই ভারতীয় দর্শনে বোকা-হাবা বলে চার্বাকদের রকমারি গালিগালাজ দেবার প্রথা ছিলো। কিন্তু তাই বলে কি এমনই হাবা যে ওরা বলবে, মৃতদেহেও প্রাণ, চৈতন্য ইত্যাদির পরিচয় আছে? চার্বাকদের অতি-বড় সমালোচকেরাও ওঁদের ঘাড়ে এরকম অসম্ভব কোনো কথা চাপিয়ে দেননি। মড়াটা যে প্রাণহীন, চৈতন্যহীন ইত্যাদি– এই ব্যাপারটা এমনই প্রকট যে চার্বাকের মতো আকাট বোকাও তা যেন স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু একথা স্বীকার করলে আরো স্বীকার করতেই হবে যে প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি নিছক দেহধর্ম হতে পারে না। লাশটা তো রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে কি প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতি ধর্মের লেশমাত্র পরিচয় পাওয়া যায়? নিশ্চয়ই নয়। তা সত্ত্বেও কী করে চার্বাকেরা আত্মা বাদ দিয়ে প্রাণ, চৈতন্য প্রভৃতিকে নিছক দেহধর্ম বলে কল্পনা করতে পারেন?
আপাত-দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, চার্বাকদের বিরুদ্ধে এ যেন একেবারে মোক্ষম যুক্তি, যা থেকে চার্বাকপক্ষকে বাঁচানোর আর উপায় নেই। হয়তো এই কারণেই অন্যান্য দার্শনিকদের মধ্যে অনেকেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনের উৎসাহে মূলত এই যুক্তিই প্রয়োগ করেছেন। যদিও সকলের প্রকাশভঙ্গি সমান নয়– কারুর লেখা কঠিন, কারুর লেখা তুলনায় সহজ; কারুর লেখায় যুক্তির সঙ্গে আরো নানা কথা জুড়ে দিয়ে পুরো আলোচনা অনেক বেশি কঠিন-কঠোর করবার প্রয়াস, কারুর লেখায় সে-চেষ্টার পরিচয় তুলনায় কম। কিন্তু মূল যুক্তিটা একই।
এখানে আমাদের পক্ষে তাঁদের প্রতিটি উক্তি উদ্ধৃত করার সুযোগ নেই। দরকারও নেই। আমরা ইতঃপূর্বেই তার কিছু নমুন দেখেছি। চার্বাকপক্ষ সমর্থনের উদ্দেশ্যে খুচরো-খাচরা তর্ক-বিতর্ক তুলেও আলোচনা পল্লবিত করা যেতে পারে; কিন্তু সে-চেষ্টারও প্রয়োজন নেই। যেমন ধরা যাক, চার্বাকপক্ষ থেকে অনায়াসে বলা যেতে পারে, দেহ এবং মৃতদেহ এক নয়। নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক আত্মাবাদীর আচরণ থেকেই তার প্রকাশ পায়। কীভাবে? যে-গুরুজনকে আজ তিনি অতি ভক্তিভরে প্রণাম করেছেন তাঁরই মৃতদেহ আগামীকাল এমনই অপবিত্র হবে যে ছুঁলে স্নান করার বিধান। অতএব মৃতদেহর নজির দেখিয়ে দেহমাত্র প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্ত কতখানি যুক্তিযুক্ত তা আত্মবাদীকেও নতুন করে ভাবতে হবে। কিংবা, চার্বাকপক্ষ থেইে তর্ক তুলে বলা যেতে পারে যে মৃতদেহের নজির থেকে দেহমাত্র প্রসঙ্গে কোনো সিদ্ধান্তে বাধা আছে। যেমন নিছক দেহের একটা ধর্ম বা লক্ষণ হিসেবে শঙ্কর রূপ প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দেহ এবং মৃতদেহের রূপ প্রভৃতি ধর্মও কি সর্বাংশে সমান?
কিন্তু এখানে এজাতীয় খুচরো যুক্তির তালিকা তৈরি করার দরকার নেই। কেননা, আবার দেহাত্মবাদের খণ্ডনে আত্মাবাদীরা এজাতীয় খুচরো কিন্তু পাল্টা যুক্তির পাল্টা ফর্দ তৈরি করতে পারেন। সে-সবের জটিলতায় ফাঁসলে আসল বিতর্কটা থেকে অল্পবিস্তর বিচ্যুত হবার সম্ভাবনা। দেহাত্মবাদ-বিরোধী আত্মাবাদীদের চতুর উদ্দেশ্যটাও আসলে এখানেই। তাই, এ-জাতীয় আলোচনার না-তুলে এখানে ভারতীয় প্রমাণবিদ্যার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে বিতর্কটার সোজা ভাষায় পুনর্বিচারে প্রয়াস করা যায়।
দেহাত্মবাদের আলোচনায় আচার্য শঙ্কর দেহ এবং চৈতন্য প্রভৃতির মধ্যে ধর্ম-ধর্মী ভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষায় তাকে কারণ-কার্য সম্বন্ধেরই একটা নমুনা বলে ধরা যেতে পারে। এখানে পঞ্চভূতে গড়া দেহটি কারণ, এবং চৈতন্য প্রভৃতি ধর্ম তারই কার্য। একথা মানলে, ভেবে দেখতে হবে ভারতীয় প্রমাণ-বিদ্যার স্বীকৃত পদ্ধতি অনুসারে কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মূল পদ্ধতি কী এবং তা খণ্ডনেরই বা মূল শর্ত কী?
প্রমাণ-বিদ্যায় কার্য-কারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার প্রধান শর্ত বলতে দু’রকম– অন্বয় ও ব্যতিরেক–
এক। কারণ থাকলে কার্য থাকবে। যেমন, বহ্নি ধূমের কারণ হলে বহ্নি থাকলে ধূম থাকবে।
দুই। কারণ না থাকলে কার্য থাকে না। যেমন, বহ্নিশূন্য ধূমের অভাব।
প্রমাণ-বিদ্যার পরিভাষায়, প্রথমটিকে বলে ‘অন্বয়’, দ্বিতীয়টিকে বলে ‘ব্যতিরেক’। এবং কার্য-কারণ সম্বন্ধ খণ্ডনের প্রসিদ্ধ নিয়ম হলো, ‘অন্বয়’ এবং ‘ব্যতিরেক’ উভয়েরই গলদ দেখানো। সেক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের বিচারে দেহাত্মবাদীর পক্ষে ‘অন্বয়’ হবে– শরীর থাকলে চৈতন্য প্রভৃতি থাকবে। এবং ‘ব্যতিরেক’ হবে– শরীরের অভাবে চৈতন্য প্রভৃতিরও অভাব হবে।
কিন্তু মৃতদেহের নজির থেকে কতটুকু কথা প্রমাণ হয়? দেহাত্মবাদের পক্ষে শুধু ‘অন্বয়’টুকুর খণ্ডন– শরীর থাকলেও চৈতন্য প্রভৃতির অভাব হতে পারে। মৃতদেহের নজির দেখিয়ে আত্মাবাদীরা এটুকুই দেখাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু, তাছাড়াও প্রমাণ-বিদ্যার অনিবার্য শর্ত হিসেবে ‘ব্যতিরেক’টিও খণ্ডন করা দরকার। অর্থাৎ, দেখানো দরকার যে শরীরের অবিদ্যমানতা সত্ত্বেও চৈতন্য প্রভৃতির পরিচয় সম্ভব। আত্মবাদী মহলে এই দ্বিতীয় কথাটি প্রমাণ করবার উৎসাহ বড় একটা চোখে পড়ে না। তার কারণ হয়তো এই যে তা প্রমাণ করা সহজসাধ্য নয়, বা অন্তত সহজবুদ্ধির কাছে গ্রাহ্য হওয়া কঠিন। দেহ নেই অথচ শুধু চৈতন্য আছে– এহেন ঘটনার নজির দেখানো তেমন সোজা নয়।
আত্মাবাদীদের পক্ষ থেকে হয়তো দাবি করা হবে যে দেহের মায়া কাটিয়ে আত্মা মোক্ষলাভ করলে চৈতন্য থাকে, কিন্তু শরীর থাকে না। কিন্তু ব্যাপারটা একটু গোলমেলে হয়ে গেলো নয় কি? কেননা প্রত্যক্ষসিদ্ধ নজিরবিহীন মোক্ষলাভের কথাটা মেনে নিলেও– বিদেহী আত্মার অস্তিত্ব আপাত-কল্পনায় স্বীকার করলেও– মুক্ত আত্মার অবস্থাটা আসলে কীরকম, এ-বিষয়ে আত্মবাদীদের মধ্যেও মতে মিল নেই। যেমন শঙ্করের অদ্বৈতবাদ অনুসারে, মুক্ত আত্মা চৈতন্যস্বরূপ; কিন্তু ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা তা মানেন না। তাঁদের মতে মুক্ত আত্মার স্বরূপ জড়বস্তুর মতোই; তাতে চৈতন্যের কোন পরিচয় নেই। শুধুমাত্র দেহ, ইন্দ্রিয়, বিষয় বা বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযোগের ফলে আত্মাতে চৈতন্যের উদ্ভব হয়।
তার মানে, দেহের অনুপস্থিতিতেও চৈতন্যের পরিচয় পাওয়া যায়– এই দাবির পক্ষে সুনিশ্চিত প্রমাণ দেখাতে না-পারলে ভারতীয় প্রমাণবিদ্যার প্রথা অনুসারেই দেহাত্মবাদের খন্ডন সর্বাঙ্গীণ বা সম্পূর্ণ হয় না। মৃতদেহের নজির থেকে বড় জোর এটুকুই প্রমাণ হতে পারে যে দেহ বর্তমান থাকলেও চৈতন্যের অভাব সম্ভব। তার বেশি কিছু নয়। অতএব, দেবীপ্রসাদের ভাষ্য হলো–
‘জীবদেহ ও মৃতদেহকে দেহ অর্থে সম্পূর্ণ অভিন্ন বলে স্বীকার করলেও শুধুমাত্র তারই নজির থেকে দেহাত্মবাদের পূর্ণাঙ্গ খণ্ডন হয় না। অন্তত ভারতীয় ন্যায়বিদ্যার নিরিখে নয়। কিংবা, দাবাড়ে ভাষায়, শুধু মড়ার নজিরের চাল দিয়ে দেহাত্মবাদকে মাৎ করে দেওয়া সম্ভব নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯৫)
এ প্রসঙ্গে তাই হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ও বলেন–
‘যেহেতু চেতনা জীবদেহেরই একটা বিশেষ গুণ তাই দেহের সঙ্গে সঙ্গেই চেতনার জন্ম ও মৃত্যু। এর অকাট্য অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ হল :
যে পর্যন্ত দেহ জীবিত থাকে সে পর্যন্ত চেতনা থাকে। মৃতদেহে কোনো চেতনার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা চেতনা বিশিষ্ট দেহ দেখতে পাই, চেতনাশূন্য দেহও দেখতে পাই। কিন্তু দেহহীন স্বাধীন চেতনা কোথাও কখনো দেখি না। এর দ্বারাই প্রমাণ হয় চেতন দেহেরই এক বিশেষ গুণ, চৈতন্যময় আত্মা নামক দেহবিযুক্ত কোনো স্বতন্ত্র পদার্থ নেই।
এই সিদ্ধান্তের জন্যই চার্বাক দর্শনকে বলা হয় ভূতচৈতন্যবাদী বা দেহাত্মবাদী দর্শন। এই মতবাদ স্বভাববাদেরই একটা অঙ্গ।’- (চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩১)
সাথে সাথে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় এই চার্বাক-সিদ্ধান্তের তাৎপর্যটাও উল্লেখ করে দিতে ভুলেন না যে–
‘চৈতন্য ভৌতিক প্রাণিদেহেরই একটি বিশেষ গুণ– এই সিদ্ধান্তের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তা হলে দেহব্যতিরিক্ত, দেহবহির্ভূত চৈতন্যময় আত্মা নামক কোনো স্বতন্ত্র অজর অমর পদার্থ নেই যে পদার্থটি জন্ম-জন্মান্তর পরিভ্রমণের পর, সংসার চক্রের বাইরে ঈশ্বরের দরবারে মুক্ত পুরুষ রূপে অবস্থান করে। স্বতন্ত্র আত্মা না থাকলে, জন্ম-জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, স্বর্গ নরক, পারলৌকিক মুক্তি, সৃষ্টিকর্তা ও মুক্তিদাতা ঈশ্বর সব কিছুই অনাবশ্যক বলে বাতিল হয়ে যায়।’- (চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩১)
.
গ। স্মৃতির নজির।
দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে আরো নানা যুক্তির মধ্যে আরেকটি যুক্তি তুলনায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। তার একটা কারণ বোধহয় এই যে জয়ন্তভট্ট, উদয়নাচার্য প্রভৃতি মহানৈয়ায়িকেরা যুক্তিটির তুলনায় বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন। ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে তার্কিক হিসেবে এঁদের কোনোমতেই তুচ্ছ ভাবা যায় না। তাই এঁরা যে-যুক্তির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন তাও সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্যই এঁদের লেখা সহজপাঠ্য নয়; রচনার উৎকর্ষ সাধনে এঁরা যে-সব পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করেছেন তার পর্যাপ্ত সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছাড়া সাধারণ পাঠক হিসেবে আমাদের সহজে বোধগম্য হবার কথা নয়। তাই যুক্তিটির সহজ পরিচয়ের জন্য আমরা এক্ষেত্রেও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তা নিতে পারি।
ইতঃপূর্বে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের প্রাসঙ্গিক উক্তিটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। যুক্তিটির মূল কথা হলো স্মৃতির সাক্ষ্য। একথা না-মানার কোন কারণ নেই যে, বাল্যকালের অভিজ্ঞতা যৌবনে– এবং যৌবনের অভিজ্ঞতা বার্ধক্যকালে– স্মরণ হয়। কিন্তু বাল্যদেহ, যৌবনের দেহ ও বৃদ্ধদেহ অবশ্যই এক নয়। দেহ হিসেবে এগুলির মধ্যে এমনই মৌলিক পার্থক্য যে বরং এগুলির প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন দেহ বলে বিবেচিত হবার কথা। দ্বিতীয়ত, একের অভিজ্ঞতা অপরের পক্ষে স্মরণ করার প্রশ্ন ওঠে না– দেবদত্ত নামের ব্যক্তিটির অভিজ্ঞতা যজ্ঞদত্ত নামে অপর কেউ কি স্মরণ করতে পারে?
এই দুটি কথা মনে রাখলে স্বীকার করতেই হবে যে নিছক দেহকে স্মরণকর্তা বলে স্বীকার করা অসম্ভব। অথচ, স্মৃতি বলে ঘটনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে, স্মৃতির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হিসেবে মানতেই হবে যে স্মরণকর্তা অর্থে শুধু দেহকেই সত্য বলা সম্ভব নয়। দেহ ছাড়াও বাড়তি কিছু স্বীকার করতে হয়। সেই বাড়তি কিছুটিকে আত্মা বলে মানো। কেননা, দেহ নিত্য পরিবর্তনশীল হলেও আত্মা একই থাকে। বাল্য থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত আত্মাও বদলাতে থাকে– এমনতর দাবি করা যাবে না।
অবশ্যই সাধারণভাবে আমরা এটা জানি যে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা নিত্য আত্মা বলে কিছু মানতেন না। তাঁদের মতবাদ তাই নৈরাত্ম্যবাদ বলে প্রসিদ্ধ। এই কারণে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে নিত্য আত্মায় বিশ্বাসী নৈয়ায়িক প্রভৃতির সঙ্গে বৌদ্ধ দার্শনিকদের ধুমাধূম তর্ক আছে। কিন্তু এখানে সে তর্ক বিচারের প্রয়োজন নেই। নিত্য আত্মা মানুন আর নাই মানুন– এবং নিত্য আত্মা অস্বীকার করেও স্মৃতির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব কিনা, কিংবা নৈরাত্ম্যবাদী বৌদ্ধরা স্মৃতির কী ব্যাখ্যা দিতেন– বর্তমান অবস্থায় সে-আলোচনায়ও বিক্ষিপ্ত হবার কারণ নেই। কেননা নৈরাত্ম্যবাদী বৌদ্ধরা আর যাই হোন দেহাত্মবাদী ছিলেন না। কিন্তু চার্বাকী দেহাত্মবাদের আলোচনায় এই স্মৃতির সাক্ষ্য যে অন্তত দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে একটা মস্ত বড়ো অন্তরায়, এ কথাটুকু স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ, নিত্য আত্মা মানুন বা নাই মানুন, জয়ন্তভট্ট বা উদয়নাচার্য প্রভৃতির যুক্তি থেকে অন্তত আপাত দৃষ্টিতে এটুকু মনে হয় যে দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা একটা মোক্ষম নিদর্শন দেখিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন, চার্বাকেরা এ-তর্কের কী জবাব দেবেন?
সত্যি বলতে কী– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে– ‘প্রাচীনকালের সাধারণ পটভূমিতে এই তর্কের কোনো উত্তর দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তার কারণ, স্মৃতি বলে ঘটনাটির পর্যাপ্ত কোনো ব্যাখ্যা প্রাচীনকালে ও এমনকি মধ্যযুগেও কারুর জানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু তাই বলে এই তর্কের সম্মুখীন হয়ে চার্বাকপক্ষ থেকে একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া বা দেহাত্মবাদ বর্জন করারও কারণ নেই।…
প্রাচীন দার্শনিকদের কাছে বিজ্ঞানের তথ্যসম্ভাব প্রত্যাশা করার অবশ্যই কোনো কারণ নেই। তবুও প্রাচীন দর্শনের বিচারে একটি প্রশ্ন অবান্তর হতে পারে না। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দিক থেকে প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অনিবার্য সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে, কোনো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি– বা অন্তত কোনো অস্পষ্ট আভাস– খুঁজে পাওয়া যায় কি? যদি যায়, তাহলে স্বীকার করতে হবে অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় যার মধ্যে এই রকম ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ছিল তার অন্তত ঐতিহাসিক মূল্য উড়িয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯৬)
তার মানে, প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অধুনালভ্য বৈজ্ঞানিক তথ্যের সম্পর্কের মধ্যেই জবাবটি নিহিত। বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মৃতি বলে ঘটনাটির রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস শুধু আজকের ব্যাপার নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রয়াস চলেছে এবং এমনকি বিজ্ঞানীমহলেও এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ যুগ ধরে গবেষণার ফলে আজকের পরিস্থিতিটা অন্য রকম। স্মৃতির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া না-গেলেও অন্তত মোটের উপর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে। যে-ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে তার পরিচয় দেবার সুযোগ এখানে নেই; কেননা ব্যাখ্যাটা সহজ-সরল মোটেই নয়, এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছোট করে উল্লেখ করবার চেষ্টা করাও নিষ্ফল। কিন্তু বর্তমান আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা হলো যে সে-গ্রন্থ মূলতই শরীরবিদ্যা বিষয়ের। অর্থাৎ, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে যেটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা তা হচ্ছে আজকের বিজ্ঞান স্মৃতির ব্যাখ্যায় যতটুকু সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেয়েছে তার মূলে শরীর বা দেহ প্রসঙ্গেই গভীরতর জ্ঞান। দেহকে বাদ দিয়ে নয়, বরং দেহকে আরো ভালো করে বুঝেই আজ স্মৃতির সন্তোষজনক ব্যাখ্যার দিকে অগ্রগতি।
তাহলে প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোথায় আমরা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি পেতে পারি? দেহাত্মবাদের মধ্যে, না কি তার বিরুদ্ধমত আত্মবাদের মধ্যে? ঐতিহাসিকভাবে চার্বাকদের পক্ষে স্মৃতির রহস্য কতটুকু জানা ছিলো, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে লাভ নেই। সমস্যাটা নিয়ে তাঁরা একান্তই মাথা ঘামিয়েছিলেন কিনা, তাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হবার কথা নয় যে তাঁদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই বিজ্ঞানের বীজ খুঁজে পাবার কথা– কারণ, বিজ্ঞান স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত।
ইতঃপূর্বে নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের প্রাসঙ্গিক উক্তিটি উদ্ধৃত করা হয়েছে। যুক্তিটির মূল কথা হলো স্মৃতির সাক্ষ্য। একথা না-মানার কোন কারণ নেই যে, বাল্যকালের অভিজ্ঞতা যৌবনে– এবং যৌবনের অভিজ্ঞতা বার্ধক্যকালে– স্মরণ হয়। কিন্তু বাল্যদেহ, যৌবনের দেহ ও বৃদ্ধদেহ অবশ্যই এক নয়। দেহ হিসেবে এগুলির মধ্যে এমনই মৌলিক পার্থক্য যে বরং এগুলির প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন দেহ বলে বিবেচিত হবার কথা। দ্বিতীয়ত, একের অভিজ্ঞতা অপরের পক্ষে স্মরণ করার প্রশ্ন ওঠে না– দেবদত্ত নামের ব্যক্তিটির অভিজ্ঞতা যজ্ঞদত্ত নামে অপর কেউ কি স্মরণ করতে পারে?
এই দুটি কথা মনে রাখলে স্বীকার করতেই হবে যে নিছক দেহকে স্মরণকর্তা বলে স্বীকার করা অসম্ভব। অথচ, স্মৃতি বলে ঘটনাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাহলে, স্মৃতির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হিসেবে মানতেই হবে যে স্মরণকর্তা অর্থে শুধু দেহকেই সত্য বলা সম্ভব নয়। দেহ ছাড়াও বাড়তি কিছু স্বীকার করতে হয়। সেই বাড়তি কিছুটিকে আত্মা বলে মানো। কেননা, দেহ নিত্য পরিবর্তনশীল হলেও আত্মা একই থাকে। বাল্য থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত আত্মাও বদলাতে থাকে– এমনতর দাবি করা যাবে না।
অবশ্যই সাধারণভাবে আমরা এটা জানি যে বৌদ্ধ দার্শনিকেরা নিত্য আত্মা বলে কিছু মানতেন না। তাঁদের মতবাদ তাই নৈরাত্ম্যবাদ বলে প্রসিদ্ধ। এই কারণে, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে নিত্য আত্মায় বিশ্বাসী নৈয়ায়িক প্রভৃতির সঙ্গে বৌদ্ধ দার্শনিকদের ধুমাধূম তর্ক আছে। কিন্তু এখানে সে তর্ক বিচারের প্রয়োজন নেই। নিত্য আত্মা মানুন আর নাই মানুন– এবং নিত্য আত্মা অস্বীকার করেও স্মৃতির কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব কিনা, কিংবা নৈরাত্ম্যবাদী বৌদ্ধরা স্মৃতির কী ব্যাখ্যা দিতেন– বর্তমান অবস্থায় সে-আলোচনায়ও বিক্ষিপ্ত হবার কারণ নেই। কেননা নৈরাত্ম্যবাদী বৌদ্ধরা আর যাই হোন দেহাত্মবাদী ছিলেন না। কিন্তু চার্বাকী দেহাত্মবাদের আলোচনায় এই স্মৃতির সাক্ষ্য যে অন্তত দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে একটা মস্ত বড়ো অন্তরায়, এ কথাটুকু স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ, নিত্য আত্মা মানুন বা নাই মানুন, জয়ন্তভট্ট বা উদয়নাচার্য প্রভৃতির যুক্তি থেকে অন্তত আপাত দৃষ্টিতে এটুকু মনে হয় যে দেহাত্মবাদের বিরুদ্ধে তাঁরা একটা মোক্ষম নিদর্শন দেখিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন, চার্বাকেরা এ-তর্কের কী জবাব দেবেন?
সত্যি বলতে কী– দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে– ‘প্রাচীনকালের সাধারণ পটভূমিতে এই তর্কের কোনো উত্তর দেওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তার কারণ, স্মৃতি বলে ঘটনাটির পর্যাপ্ত কোনো ব্যাখ্যা প্রাচীনকালে ও এমনকি মধ্যযুগেও কারুর জানা থাকবার কথা নয়। কিন্তু তাই বলে এই তর্কের সম্মুখীন হয়ে চার্বাকপক্ষ থেকে একেবারে হাল ছেড়ে দেওয়া বা দেহাত্মবাদ বর্জন করারও কারণ নেই।…
প্রাচীন দার্শনিকদের কাছে বিজ্ঞানের তথ্যসম্ভাব প্রত্যাশা করার অবশ্যই কোনো কারণ নেই। তবুও প্রাচীন দর্শনের বিচারে একটি প্রশ্ন অবান্তর হতে পারে না। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের দিক থেকে প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির অনিবার্য সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখেও নিশ্চয়ই প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকে, কোনো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি– বা অন্তত কোনো অস্পষ্ট আভাস– খুঁজে পাওয়া যায় কি? যদি যায়, তাহলে স্বীকার করতে হবে অন্যান্য দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় যার মধ্যে এই রকম ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি ছিল তার অন্তত ঐতিহাসিক মূল্য উড়িয়ে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৯৬)
তার মানে, প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অধুনালভ্য বৈজ্ঞানিক তথ্যের সম্পর্কের মধ্যেই জবাবটি নিহিত। বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মৃতি বলে ঘটনাটির রহস্য উদ্ঘাটনের প্রয়াস শুধু আজকের ব্যাপার নয়। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রয়াস চলেছে এবং এমনকি বিজ্ঞানীমহলেও এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। কিন্তু সুদীর্ঘ যুগ ধরে গবেষণার ফলে আজকের পরিস্থিতিটা অন্য রকম। স্মৃতির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া না-গেলেও অন্তত মোটের উপর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে। যে-ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছে তার পরিচয় দেবার সুযোগ এখানে নেই; কেননা ব্যাখ্যাটা সহজ-সরল মোটেই নয়, এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছোট করে উল্লেখ করবার চেষ্টা করাও নিষ্ফল। কিন্তু বর্তমান আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা হলো যে সে-গ্রন্থ মূলতই শরীরবিদ্যা বিষয়ের। অর্থাৎ, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে যেটা সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কথা তা হচ্ছে আজকের বিজ্ঞান স্মৃতির ব্যাখ্যায় যতটুকু সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পেয়েছে তার মূলে শরীর বা দেহ প্রসঙ্গেই গভীরতর জ্ঞান। দেহকে বাদ দিয়ে নয়, বরং দেহকে আরো ভালো করে বুঝেই আজ স্মৃতির সন্তোষজনক ব্যাখ্যার দিকে অগ্রগতি।
তাহলে প্রাচীন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোথায় আমরা ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের প্রতিশ্রুতি পেতে পারি? দেহাত্মবাদের মধ্যে, না কি তার বিরুদ্ধমত আত্মবাদের মধ্যে? ঐতিহাসিকভাবে চার্বাকদের পক্ষে স্মৃতির রহস্য কতটুকু জানা ছিলো, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করে লাভ নেই। সমস্যাটা নিয়ে তাঁরা একান্তই মাথা ঘামিয়েছিলেন কিনা, তাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হবার কথা নয় যে তাঁদের বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই বিজ্ঞানের বীজ খুঁজে পাবার কথা– কারণ, বিজ্ঞান স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত।