মদশক্তির দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা

মদশক্তির দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা

মদশক্তির নজিরটা প্রকৃত চার্বাকমতের পরিচায়ক বলে স্বীকার করার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। এ-রকম নজির ব্যবহার করার মধ্যেই– বিশেষত প্রাচীন কালের পটভূমিতে– একটা বিজ্ঞান-সম্মত বাস্তব মনোভাবের পরিচয় খোঁজা অবান্তর হবে না বলে মনে হয়। মদ গিললে যে নেশা হয়, একথা অবশ্যই সকলের জানা। কিন্তু কেন হয়, তা দীর্ঘ যুগ ধরে দেশ-বিদেশের অনেকেরই জানা ছিলো না। তাই এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের নানারকম জল্পনা-কল্পনা চোখে পড়ে। সেসব জল্পনা-কল্পনার মূল কথা হলো, মদের মধ্যে বুঝি কোনো একরকম অপ্রাকৃত বা এমনকি অলৌকিক শক্তি আছে, যারই প্রভাবে মদ পেটে পড়লে মানুষ রকমারি অদ্ভূত আচরণ করে থাকে– চলতি কথায় যাকে আমরা বলি মাতলামি। এই জাতীয় বিশ্বাসের অনেক দৃষ্টান্ত হেস্টিংস্ সম্পাদিত ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজন অ্যান্ড এথিক্স’ (Encyclopaedia of Religion and Ethics, ed. Hastings)-এর ‘Drinks, Drinking’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে রয়েছে। নিবন্ধের দৃষ্টান্তগুলির বেশির ভাগই তুলনায় অনগ্রসর বা পিছিয়ে পড়ে থাকা মানুষদের বিশ্বাসের বিবরণ। এটাই স্বাভাবিক।

এ-প্রেক্ষিতে ঋগ্বেদের নজিরে প্রাচীন মানুষদের দেবতা-বিশ্বাসে ‘সোমরসে’র বিষয়টিও স্মরণ করা যেতে পারে। সোম নামে এক শ্রেণীর লতা ছিলো, যা পার্বত্য-অঞ্চলে জন্মাতো। বৈদিক কবিরা সোম-লতার পার্বত্য আবাস ও মর্ত্যে আগমন নিয়ে, সোম-লতা সংগ্রহ করা, জল দিয়ে ধোয়ে পাথরের সাহায্যে তা নিষ্কাশন করা, নিষ্কাশিত হরিৎবর্ণের রস ভেড়ার লোমের ছাঁকনীতে ছেঁকে কাঠের কলসে ভরা, তাকে দুধের সঙ্গে মেশানো, দেবতাদের উদ্দেশে তার আহুতি দেওয়া এবং অবশ্যই তা নিজেরা পান করা– ইত্যাদি বিষয়ে ঋগ্বেদে এমন অসম্ভব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, প্রক্রিয়াগুলির খুঁটিনাটি নিয়ে আদিম কল্পনার এমন জটিল জাল বুনেছেন যে বর্তমান সময়ে তার সমস্ত তাৎপর্য স্পষ্টভাবে বোঝা হয়তো সম্ভব নয়। এই রসের একমাত্র গুণটি হলো তা মদশক্তি বা মাদকত্বে ভরপুর। এই সোমলতার কোনও সন্ধান এখন পাওয়া যায় না। সরস্বতী নদীর মতো তা হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কেবল তার স্মৃতি এবং অশেষ গুণের কথা ঋগ্বেদের সূক্তগুলিতে রক্ষিত হয়ে আছে। এসব দৃষ্টান্তে নেশায় উন্মত্ত করা সোমকে কখনো অঢেল বলবীর্য দানকারী স্বর্গীয় মহিমা, কখনো হর্ষদায়ী দেবতা, কখনো অমরত্ব দানকারী অমৃত ইত্যাদি বিভিন্ন বিশ্বাস অঙ্কিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য বিষয়ক ভিন্ন অধ্যায়ে এই ‘সোম-দেবতা’ প্রসঙ্গে প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্তসহ বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে।

কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, ভিন্নতর প্রেক্ষিতে–
আজকের দিনেও ইংরেজরা কড়া মদকে বলেন স্পিরিট বা ‘spirit’– অর্থাৎ, আক্ষরিক অর্থে ভূত বা প্রেতাত্মা জাতীয় কিছু। এই শব্দ ব্যবহার থেকেই সন্দেহ হয় যে এর পিছনে এক বিশ্বাস লুকোনো আছে : মদের বোতলের মধ্যে ভূত-প্রেত জাতীয় অলৌকিক কিছু বুঝি পোরা আছে; মদ গেলার ফলে তারই প্রভাবে মানুষ রকমারি তাণ্ডব বা তাজ্জব ব্যবহার করতে শুরু করে। ব্যাপারটা বানানো কথা নয়। জে. ডি. বার্নাল রচিত ‘ইতিহাসে বিজ্ঞান’ (J. D. Bernal, Science in History) বই দেখুন। দেখবেন, একদা য়ুরোপের বিজ্ঞানী মহলেও অন্তত ষোড়শ-সপ্তদশ শতক পর্যন্ত এই রকম ধারণা চালু ছিল। নমুনা হিসেবে প্যারাসেল্সাস্ (Paracelsus : 1493-1541) নামে (বা আসলে ছদ্মনামে) রসায়নবিদের উল্লেখ করেছেন বার্নাল। তাঁর মতে, “The crucial process of chemistry, distillation, was essentially a process of capturing the invisible spirits that rose from a boiling liquid. That such spirits were indeed powerful was only too evident from the effect of drinking them.” (বার্নাল, পৃ-৩৯৯)।
অর্থাৎ, প্যারাসেল্সাস্-এর ধারণায় রসায়নবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মদ্য প্রস্তুতে বিশিষ্ট প্রক্রিয়াটি আসলে ফুটন্ত তরল পদার্থ থেকে অদৃশ্য প্রেত ধরবার এক রকম পদ্ধতি; এই প্রেতের শক্তিটা যে কতখানি তা মদ্যপানের ফলাফল থেকেই বস্তুত বোঝা যায়। এমনকি ভ্যান্ হেলমোস্ট (Van Helmost : 1577-1644) মনে করতেন মদ তৈরি করা বলে ব্যাপারটা আসলে শুঁড়িখানায় শুঁড়ির ভাঁট থেকে একরকম ভূত বা প্রেত ধরবার কৌশল।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৮০)

উপরিউক্ত কথাগুলি বিবেচনায় রাখলে চার্বাকদের মদশক্তির দৃষ্টান্তটিরই একটা চিত্তাকর্ষক তাৎপর্য অবজ্ঞান ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কিণ্ব প্রভৃতি কতকগুলি নেহাতই জাগতিক বস্তুর কোনো একরকম বিশেষ পরিণামের ফলে মদ্য বলে একরকম নেহাতই জাগতিক জিনিস প্রস্তুত করা হয়, এবং তারি মধ্যে নেহাতই জাগতিক এক নতুন গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘আত্মা’ বলে দেহাতীত কোনো অলৌকিক বস্তুর অস্তিত্ব খণ্ডন করবার উদ্দেশ্য প্রযুক্ত বলে মদশক্তির এই নজিরটির মধ্যে অজাগতিক কোনো কিছুর কল্পনা অবশ্যই অবান্তর হবে। ঠিক কবে– কীভাবে– চার্বাকদের মাথায় এই মদশক্তির দৃষ্টান্ত এসেছিলো, তা আমাদের জানা নেই, জানবার উপায়ও নেই। জানতে পারলে হয়তো বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা বিকাশের ইতিহাসে কিছুটা নতুন আলোকপাতের সম্ভাবনা থাকতো। কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, দেহ ছাড়া আত্মা বলে আলাদা কিছু মানবার বিরুদ্ধে– বা দেহাত্মবাদের সমর্থনে– তাঁরা এই মদশক্তির যে নজিরটি ব্যবহার করেছেন, নজিরটির স্বকীয় বৈজ্ঞানিক মূল্য তুচ্ছ নয়।

চার্বাকী দেহাত্মবাদে ‘মদশক্তিবৎ’-এর দৃষ্টান্ত প্রসঙ্গে আরেকটি বক্তব্য খুবই প্রণিধানযোগ্য মনে হয়, যেখানে বলা হয়েছে–
চার্বাকের যুগে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের পদার্থবিজ্ঞান বা ভৌতবিজ্ঞান এবং রসায়ন শাস্ত্র জানা ছিল না। তবু তিনি প্রাণিদেহে চৈতন্য নামক গুণটির উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যে উদাহরণটি দিয়েছেন তার মধ্যে কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রাথমিক উন্মেষ প্রতিফলিত হয়েছে। চার্বাক উদাহরণ দিয়েছেন ‘মদশক্তিবৎ’। মদের বিভিন্ন উপাদানগুলি বিশেষ পরিমাণে সমন্বিত করে জ্বাল দিয়ে চোলাই করে মদ তৈরি করা হয়। পৃথকভাবে অবস্থান কালে মদের উপাদানগুলির মধ্যে পৃথক পৃথক ভাবে মাদকতা শক্তি থাকে না। কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় সমন্বিত হয়ে মদ নামক যে নূতন জিনিসটি উৎপাদন করে সেই বস্তুটির মধ্যেই মাদকতা শক্তির আবির্ভাব ঘটে। এভাবে প্রাণিশরীরের মূল উপাদানগুলি বিশেষ প্রক্রিয়ায় সমন্বিত হয়ে দেহ নামক নূতন বস্তুটি উৎপাদিত হলেই দেহের চৈতন্য গুণটির আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং এই দেহনিষ্ঠ গুণটি দেহছাড়া থাকতে পারে না। পৃথক একটি আত্মার কল্পনা অনাবশ্যক। চার্বাক আধুনিক যুগে জন্মগ্রহণ করলে মৌলিক পদার্থ ও যৌগিক পদার্থের পার্থক্য দেখিয়ে উদাহরণটি সমৃদ্ধ করতে পারতেন। মদ না বলে অ্যালকোহল (C2H5OH) বলতে পারতেন, জল (H2O) বা গ্লুকোস (C6H12O6) থেকে উদাহরণ টানতে পারতেন। দেখাতে পারতেন যৌগিক পদার্থে প্রাকৃতিক নিয়মেই এমন সব নূতন গুণ বা আণবিক পরিবর্তনের সূচনা হয় যা মৌলিক পদার্থে থাকে না। কিন্তু অত প্রাচীন যুগে একজন ভারতীয় দার্শনিক যে অসাধারণ বিজ্ঞানমুখী চিন্তাধারার পরিচয় দিয়েছেন তার জন্য ভারতীয় হিসেবে আমরা বিস্ময় ও গর্ব অনুভব করতে পারি।’– (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, চার্বাকদর্শন, পৃষ্ঠা-৩২)

সে যাক্, আপাতত চার্বাকদের দেহাত্মবাদের দার্শনিক গুরুত্ব আরো কিছুটা খতিয়ে দেখবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কেননা, অন্যান্য বিদগ্ধ দার্শনিকেরাও এই মতটাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেননি। ফলে নিজেদের আত্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই দেহাত্মবাদ খণ্ডনের উদ্দেশ্যে যেন রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال