দেহাত্মবাদ বা ভূতচৈতন্যবাদ

দেহাত্মবাদ বা ভূতচৈতন্যবাদ

চার্বাকেতর দর্শন সম্প্রদায়গুলির পরবর্তীকালের প্রায় সকল দার্শনিকেরাই চার্বাকমত হিসেবে প্রচারিত প্রধানত দুটি দাবি খণ্ডন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। এই প্রধান দুটি চার্বাক-মত হলো–
এক : প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অতএব অনুমানের কোনো প্রামাণ্য নেই।
দুই : দেহাত্মবাদ। অর্থাৎ দেহ ভিন্ন আত্মা বলে স্বতন্ত্র কিছু নেই। আত্মা বলে একান্তই যদি কোনো শব্দ ব্যবহার করতে হয় তাহলে এই দেহকেই আত্মা বলে মানতে হয়।

ইতোমধ্যে প্রথম দাবির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রাপ্ত যুক্তি-তথ্য অনুসারে দৃঢ়ভাবে মনে হয়েছে যে, প্রকৃত চার্বাকমতের সঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিক মতের এবং আয়ুর্বেদশাস্ত্রের আকরগ্রন্থ ‘চরক-সংহিতা’য় স্বীকৃত বিজ্ঞানের খুব একটা তফাৎ থাকে না। বরং চার্বাক-প্রতিপক্ষরা চার্বাকদের প্রত্যক্ষ-সংক্রান্ত আরোপিত যে-কোন দাবিকে প্রতিষ্ঠার যত চেষ্টাই করুন না কেন সেগুলিকে অতিরঞ্জিত বিকৃত-প্রয়াস বলেই মনে হয়। বর্তমান আলোচনা চার্বাক-সংক্রান্ত দ্বিতীয় দাবি দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে।

মূলত যে বৈশিষ্ট্য চার্বাক-দর্শনকে ভারতীয় অন্যান্য দর্শন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে রেখেছে তাকে দেহাত্মবাদ বা ভূত-চৈতন্যবাদ সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়ে থাকে। চার্বাক-অনুমোদিত বস্তুজগতের উপাদান চার তত্ত্ব সম্বন্ধে ইতঃপূর্বে কিছু আলোচনা হয়েছে এবং এই মৌল উপাদানের সংখ্যা সম্বন্ধে ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের স্বীকৃতির সঙ্গে চার্বাকী ধারণার পার্থক্যও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই তত্ত্বগুলি চার্বাকেতর ভারতীয় দর্শনে মহাভূত সংজ্ঞায় পরিচিত এবং অন্যান্য বহু তত্ত্ব বা বিষয়ের মধ্যে স্থূলতম হিসেবে পরিগণিত। ভারতীয় অন্যান্য দর্শনে অনুমোদিত তত্ত্বগুলির পরিচয় এবং সংখ্যা দর্শন ভেদে বিভিন্ন। চার্বাক দর্শনের বর্ণনা প্রসঙ্গে সেগুলির খুঁটিনাটি বিবরণের প্রয়োজন নেই। সে যাক, এই স্থূল বস্তুজগত ভারতীয় মতে মহাভূতের সমবায়ে গঠিত এবং এ বিষয়ে চার্বাক মতও ভারতীয় সাধারণ ধারণার সমধর্মী বলে হয়। তবে যেটুকু প্রভেদ তাতেই চার্বাকের সাথে অন্যান্য দর্শনগুলির সাথে বিশাল এক মৌলিক ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে। পঞ্চমহাভূত প্রসঙ্গে ন্যায়সূত্রে বলা হয়েছে–
‘পৃথিব্যাপস্তেজো বায়ুরাকাশমিতি ভূতানি’। (ন্যায়সূত্র-১/১/১৩)
অর্থাৎ : ক্ষিতি বা পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ, এই পঞ্চদ্রব্য ভূতবর্গ।

বৈশেষিকের দৃষ্টিতে ক্ষিতি (মৃত্তিকা), অপ্ (জল), তেজ (আলোও উত্তাপের মূল উৎস), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) এই পাঁচটি পঞ্চমহাভূত নামে প্রসিদ্ধ। পঞ্চমহাভূত বৈশেষিক মতে নয়টি দ্রব্যের অন্তর্গত। বৈশেষিক মতে দ্রব্য আর ইংরেজি ম্যাটার এক কথা নয়। ‘দ্রব্য’ শব্দটির অর্থ এর চেয়ে ব্যাপক। কারণ বৈশেষিক মতে আত্মা, মন, কাল এবং দিক দ্রব্যের অন্তর্গত। ‘দ্রব্য’ মানে ইংরেজিতে সাবস্ট্যান্স, অর্থাৎ যার কোনো না কোনো গুণ আছে। বৈশেষিক মতে দ্রব্যও আবার মূল ছয়টি পদার্থের (দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সমবায় ও বিশেষ) অন্তর্গত। এখানে পদার্থ মানে ‘রিয়ালিটি’– মৌলিকতম বস্তু অর্থাৎ যার অস্তিত্ব আছে। সেজন্য বৈশেষিক দর্শনকে ষট্পদার্থবাদী বলা হয়। নয়টি দ্রব্যের মধ্যে প্রথম চারটি (ক্ষিতি, অপ্, তেজ ও মরুৎ) সূক্ষ্মতম বস্তুকণা (পরমাণু) দিয়ে গঠিত এবং বস্তুজগতের মূল উপাদান পরমাণু। এজন্য বৈশেষিক দর্শনকে পরমাণুবাদী বলা হয়।’– (হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়,চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-২৭)।

কিন্তু চার্বাক মতে ক্ষিতি, অপ্ তেজ ও মরুৎ এই চারটিই হলো মূল বস্তু যা বিশ্বজগতের উপাদান।  যেমন–
তত্র পৃথিব্যাদীনি ভূতানি চত্বারি তত্ত্বানি। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : এই চার্বাকমতে পৃথিবী, জল, তেজঃ ও বায়ু– এই চারটি ভূতই চারটি তত্ত্ব।
বার্হস্পত্য-সূত্রেও বলা হয়েছে–
পৃথিব্যপতেজো বায়ুরিতি তত্ত্বানি। (বার্হস্পত্যসূত্র-১)
অর্থাৎ : পৃথিবী, জল, অগ্নি ও বায়ু– এই চারটিই তত্ত্ব।

চার্বাক-স্বীকৃত এই চার মহাভূতের উপাদানে যে বস্তুজগতের সৃষ্টি, সেই জগতের জ্ঞান প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সাক্ষাৎভাবে হওয়া সম্ভব এবং সেইজন্যই চার্বাক দর্শনে এই ভৌতিক জগতের অনুমোদন আছে। অন্যরা এই চার রকম ভূতপদার্থ ছাড়াও আকাশ নামে যে পঞ্চম এক ভূতপদার্থ স্বীকার করার প্রস্তাব করেছেন, কেন করেছেন, সে-কথা বেশ জটিল। সে-প্রসঙ্গ বর্তমান আলোচনার বিবেচ্য নয়। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে, চার্বাকেরা আকাশ স্বীকার করেন না, কেননা আকাশের প্রত্যক্ষ হয় না এবং চার্বাকমতে যার প্রত্যক্ষ হয় না তা যথার্থ নয়।
আবার আকাশের জ্ঞান অনুমানের দ্বারা হয়ে থাকে। আমরা শব্দ শুনি। এই শব্দ গুণ বলে কোন দ্রব্যে অবশ্যই থাকবে। এই শব্দ পৃথিবী, জল, তেজের গুণ নয়, কেননা তাদের গুণ হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন। সেকারণে কোন কোন মতে, আকাশকে শব্দগুণের আশ্রয় দ্রব্য মনে করা হয়। কিন্তু চার্বাক সাধারণভাবে অনুমানের প্রামাণ্য স্বীকার করেন না বলে চার্বাকমতে আকাশের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।

আকাশকে চার্বাকগণ ভূতবৈরল্যের অতিরিক্ত কিছু মনে করেন না। ‘ভূতবৈরল্যে’র অর্থ ভৌতিক কণার বিরলতা। এই কথার তাৎপর্য যেখানে ভৌতিক কণার ঘনীভাব হয় না সেখানে আকাশের প্রতীতি হয় না। আকাশ বিষয়ক দু’টি বস্তুর প্রতীতি হয়। ১. একটি ভৌতিক কণার অভাব, ২. অন্যটি তার বৈরল্য অর্থাৎ তার বিরলতা। প্রথম পক্ষটি সঙ্গত নয়, কেননা ভৌতিক কণার অভাব স্বীকার করা কোনভাবে যুক্তিযুক্ত নয়। ফলে ভৌতিক কণার বিরলতা স্বীকার করতে হয়। চার্বাকগণের এক সম্প্রদায় অবশ্য অন্যান্য দার্শনিকের মত আকাশকে একটি বিশিষ্ট তত্ত্ব বলে স্বীকার করেন। কিন্তু পণ্ডিতেরা এই মতে আস্থাশীল নন। একারণে চার্বাকের নিজের বিশেষ মত হচ্ছে যে, মূল জগতে চারটি তত্ত্ব বর্তমান, পঞ্চম তত্ত্ব স্বীকার্য নয়। অনুরূপভাবে অন্য দার্শনিকদের স্বীকৃত দিক্, কাল, মন প্রভৃতি পদার্থের স্বতন্ত্র সত্তা চার্বাকগণ স্বীকার করেন না।’– (ড. বিশ্বরূপ সাহা, নাস্তিকদর্শনপরিচয়ঃ, পৃষ্ঠা-১৭)।

একইভাবে চার্বাকেরা আত্মা মানেন না। উল্লেখ্য, যেকোন দার্শনিক আলোচনারই একটি উদ্দেশ্য ও  সামাজিক তাৎপর্য থাকে। চার্বাকমত আলোচনার ক্ষেত্রেও আমাদেরকে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে, চার্বাকদর্শনের সামাজিক তাৎপর্যের সঙ্গে চার্বাকের দার্শনিক চিন্তা সংগতিপূর্ণ। ঈশ্বর, বস্তুনিরপেক্ষ স্বতন্ত্র চৈতন্য (আত্মা), পরলোক, জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, পারলৌকিক মুক্তি, স্বর্গসুখের আশ্বাস ইত্যাদি কল্পনাবাহুল্যের নিপীড়ন থেকে মানবচেতনাকে ভারমুক্ত করে মানবকেন্দ্রিক ধ্যানধারণা গড়ে তোলাই ছিলো চার্বাকমতের উদ্দেশ্য। অতএব, চার্বাকমতে নিছক ভূপদার্থ দিয়ে গড়া আমাদের দেহ ছাড়া আত্মা বলে আর কিছু মানবার কোনো কারণ নেই।

আমরা ইতঃপূর্বে ভিন্ন অধ্যায়ে অধ্যাত্ম দর্শনগুলিতে আত্মার ধারণা আমদানির ঔপনিষদিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু দর্শনক্ষেত্রে কেবল শ্রুতিপ্রমাণকে সম্বল করে দর্শনতত্ত্ব-প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যেকোন তত্ত্বের পক্ষে একটি দার্শনিক যুক্তির ভিত্তি রচনার প্রয়োজন হয়। আত্মা বা আত্মতত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। এর দার্শনিক ব্যাখ্যা কী?
অন্যান্য বস্তুর মতো প্রাণীদেহও ভৌতিক উপাদানে গঠিত এবং সহজেই প্রত্যক্ষযোগ্য। কিন্তু প্রাণী সংজ্ঞায় ভৌতিক প্রাণীদেহ ছাড়া আরও কিছু অভিব্যক্ত হয়, যা প্রাণীজগতের অন্যতম মানুষ হিসাবে ‘আমি’ এই অনুভূতির মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়তই অনুভব করি। ‘আমি’ এই অনুভূতির বিকাশ সচেতনতা বা চৈতন্যের পটভূমিতে এবং এই সচেতন ‘আমি’কে কেন্দ্র করেই মানুষ বা যে কোন জীবের বৈশিষ্ট্য। এই সচেতন ‘আমি’র নানাভাবে বিচিত্র প্রকাশ দেহের মাধ্যমে, যার ফলে ভৌতিক উপাদানে গঠিত হয়েও জীবদেহ স্বকীয় বিশেষত্বে মণ্ডিত এবং অন্য নানা ভৌতিক বস্তুর সঙ্গে এর প্রভেদ সহজেই বোঝা যায়। এই সচেতন ‘আমি’র নিজস্ব রূপ হিসাবে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে ভৌতিক জীবদেহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক অপর একটি তত্ত্ব আত্মপ্রকাশ করেছে। জীবদেহে নিবদ্ধ এই তত্ত্বের নাম ভারতীয় দর্শনে জীবাত্মা, যা শুদ্ধ আত্মস্বরূপের এক বিশেষ বা সংসারদশায় আবদ্ধ রূপ। এই জীবাত্মা প্রাক্তন কর্মের ভোগ ক্ষয় করার জন্য বিশেষ এক ভৌতিক দেহের আশ্রয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং সেই বিশেষ দেহে যে ভোগ সম্ভব তা সম্পূর্ণ করার পর দেহ ত্যাগ করে চলে যায়। জীবাত্মার এই দেহত্যাগকে আমরা মৃত্যু সংজ্ঞায় অভিহিত করি। প্রাক্তন কর্মের সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই জীবাত্মাকে নূতন নূতন পরিবেশে ভিন্নজাতীয় ভোগের জন্য নূতন নূতন দেহ ধারণ করতে হয় এবং এইভাবে চলতে থাকে মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত আত্মার দেহ থেকে দেহান্তরে পরিক্রমা।’– (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৯০-৯১)।

ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শন অনুসারে মৃত্যুর অর্থ জীবদেহের বিনাশ মাত্র, কিন্তু মৃত্যুর মাধ্যমে জীবদেহে অধিষ্ঠিত এই আত্মা বিনষ্ট হয় না। স্থূল দেহের একটি থেকে অপরটির উদ্দেশ্যে তার যাত্রার দীর্ঘ গতিপথে এক বিশেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি মাত্র। স্থূল শরীর থেকে বহির্গত এই আত্মার আশ্রয় তখন সূক্ষ্ম শরীর। উপনিষদীয় ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়া এই সূক্ষ্মশরীরের গঠন সম্পর্কে মতভেদও আছে। পঞ্চতন্মাত্র নামে অভিহিত পঞ্চভূতের সূক্ষ্মভাগ উত্তরকালের সাংখ্যমতে এই শরীরের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, ঈশ্বরকৃষ্ণের ‘সাংখ্যকারিকা’য় বলা হয়েছে–
তন্মাত্রাণ্যবিশেষাস্তেভ্যো ভূতানি পঞ্চ পঞ্চভ্যঃ।
এতে স্মৃতা বিশেষাঃ শান্তা ঘোরাশ্চ মূঢ়াশ্চ।। (সাংখ্যকারিকা-৩৮)
সূক্ষ্মা মাতাপিতৃজাঃ সহ প্রভূতৈস্ত্রিধা বিশেষাঃ স্যুঃ।
সূক্ষ্মাস্তেষাং নিয়তা মাতাপিতৃজা নিবর্ত্তন্তে।। (সাংখ্যকারিকা-৩৯)
অর্থাৎ :
(শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ– এই পাঁচটি) তন্মাত্রকে অবিশেষ (বা সূক্ষ্মভূত) বলে। সেই পাঁচটি (তন্মাত্র) থেকে (ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম– এই) পাঁচটি স্থূলভূত উৎপন্ন হয়। এই পাঁচটি স্থূলভূত (সত্ত্ব-রজঃ-তমো-গুণাত্মক বলে এদের) সুঃখ, দুঃখ ও মোহ-স্বভাব বলা হয়। (সাংখ্যকারিকা-৩৮)।।   বিশেষ তিন প্রকার (যথা–) সূক্ষ্মশরীর, স্থূলশরীর ও পাঁচটি মহাভূত। এদের মধ্যে সূক্ষ্মশরীর প্রলয়কাল পর্যন্ত (আপেক্ষিক) নিত্য, স্থূলশরীর (কিছুদিন থেকে) নষ্ট হয়। (সাংখ্যকারিকা-৩৯)।।

কিন্তু প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যা ধরা পড়ে সেই পাঁচ বা চার স্থূল মহাভূতের যে এক্ষেত্রে কোনই অবদান নেই সে সম্বন্ধে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদীরা সকলে একমত। তাঁদের উপনিষদীয় ধারণা মতে, স্থূল শরীরের বন্ধন ছিন্ন হলেই জীবাত্মার মুক্তি হয় না; প্রাক্তন কর্মের সংস্কারের বশে সূক্ষ্ম দেহে সে আবদ্ধ থাকে তার নিজস্ব মন, বুদ্ধি এবং পূর্বজন্মার্জিত কর্মের সঞ্চয় ইত্যাদির সঙ্গে। এই সূক্ষ্মদেহধারী জীব (আত্মা) আবার নতুন পরিবেশে নতুন স্থূল দেহে তার আবাস রচনা করে। জীবাত্মার এই পথ-পরিক্রমার অবসান হয় মুক্তির মাধ্যমে যখন ছিন্নবন্ধন এই আত্মা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দিয়ে শুদ্ধ আত্মস্বরূপে বিলীন হয়।

কিন্তু দেহাতিরিক্ত এই আত্মার অনুমোদন চার্বাক দর্শনে নেই। চার্বাকমতে মানুষের মৃত্যু তাই ‘দেহত্যাগ’ নয়, দেহাবসানের সঙ্গে তার সম্পূর্ণ সত্তারই অবসান। যেমন–
‘তেষু বিনষ্টেসু সৎসু স্বয়ং বিনশ্যতি।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) দেহের সংগঠক সেই চারটি ভূত বিনষ্ট হলে সেই চৈতন্যও স্বয়ংই বিনষ্ট হয়।
এবং ‘চার্বাকষষ্ঠি’র লোকগাথায়ও বলা হয়েছে, যা মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-তেও উদ্ধৃত হয়েছে–
‘ভস্মীভূতস্য ভূতস্য পুনরাগমনং কুতঃ।’- (চার্বাকষষ্ঠি-৩৩)
অর্থাৎ : ভস্মীভূত জীব বা দেহের পুনরাগমন কোন কারণেই হতে পারে না।

চার্বাকেরা প্রত্যক্ষগ্রাহ্য মহাভূতের উপাদানে গঠিত দেহকেই আত্মা বলেন। যে সচেতন ‘আমি’কে কেন্দ্র করে আত্মস্বরূপের প্রকাশ, সেই ‘আমি’ চার্বাক মতে দেহের সঙ্গে অভিন্ন। যেমন–
‘তচ্চৈতন্য-বিশিষ্ট-দেহ এব আত্মা, দেহাতিরিক্তে আত্মনি প্রমাণাভাবাৎ।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) চৈতন্য-বিশিষ্ট দেহই আত্মা। দেহ-ভিন্ন আত্মাতে প্রমাণ নাই।
.
‘ভূতচতুষ্টয়ং চৈতন্যভূমিঃ’। (ষড়্দর্শনসমুচ্চয়-৮৩)
অর্থাৎ : (লোকায়তমতে) চারটি ভূতই চৈতন্যের উৎস-ভূমি।

অধ্যাত্মবাদীদের দৃষ্টিতে সচেতন ‘আমি’র নিজস্ব রূপ হিসাবে ভারতের অধ্যাত্মদর্শনে ভৌতিক জীবদেহ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক যে তত্ত্বকে ‘আত্মা’ বলে প্রচার করা হয়েছে, চার্বাকদের বর্ণনায় এই ‘আমি’ তার প্রকৃত অর্থে প্রকাশমান ‘আমি গৌরবর্ণ’ ‘আমি স্থূল’ ইত্যাদি বাক্যে, যেখানে দেহের বিভিন্ন গুণ ‘আমি’ সংজ্ঞায় অভিহিত আত্মাকে আরোপ করা হয়। এই ‘আমি’ শব্দই ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত ‘আমার দেহ’ ইত্যাদি বাক্যাংশে, যেখানে ‘আমি’ দেহ থেকে পৃথক। চার্বাক মত অনুসারে এই বাক্যাংশগুলি ঔপচারিক, অর্থাৎ ‘আমি’ এ-সব ক্ষেত্রে তার প্রকৃত অর্থে প্রযুক্ত হয় না। এ-প্রসঙ্গে মাধবাচার্য ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’ চার্বাকমত বর্ণনায় বলছেন–
‘অহং স্থূলঃ কৃশোহস্মীতি সামানাধিকরণ্যতঃ।
দেহ-স্থৌল্যাদি-যোগাচ্চ স এবাত্মা ন চাপরঃ।
মম দেহোহয়মিত্যুক্তিঃ সংভবেদৌপচারিকী।।’- (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (চার্বাকমতে) আমি স্থূল ও কৃশ হচ্ছি– এইরূপ সামানাধিকরণ্য বা অভেদের প্রত্যক্ষবশত এবং দেহে স্থূলতা কৃশতার সম্বন্ধবশত দেহই আত্মা বলে সিদ্ধ হয়। দেহের অতিরিক্ত অপর কোন আত্মার সিদ্ধি হয় না। কারণ তার প্রত্যক্ষ হয় না। যার প্রত্যক্ষ হয় না, তার অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় না। ‘আমার দেহ’ ইত্যাদি বাক্যাংশে উক্ত ‘আমি’ ঔপচারিক ব্যবহার-প্রযুক্ত।

শঙ্করাচার্যের ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে লোকায়ত মতের প্রতিভূ হিসেবে প্রাসঙ্গিক লোকগাথার উদ্ধৃতি রয়েছে–
‘স্থূলোহহং তরুণো বৃদ্ধো যুবেত্যাদিবিশেষণৈঃ।
বিশিষ্টো দেহ এবাত্মা ন ততোহন্যো বিলক্ষণঃ।।’- (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ-২/৬)।।
অর্থাৎ : আমি স্থূল, তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ ইত্যাদি বাক্যে স্থূল প্রভৃতি বিশেষণের দ্বারা দেহই বিশেষিত হয়ে থাকে। দেহ থেকে ভিন্ন অন্য কোন আত্মা নামক পদার্থ ঐ বিশেষণের বিশেষ্য হয় না।

এ-বিষয়টি আরো সহজভাবে বুঝতে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য–
চলতি কথায় আমরা অবশ্য বলি “আমার দেহ”। অর্থাৎ, যেন “আমি” এক এবং দেহটি আলাদা কিছু। এবং “আমি” বা “আমার” বলতে যা উল্লেখ করছি– তাই-ই যেন ওই “দেহ”র মালিক। এ-হেন মালিক আত্মা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে? চার্বাকমতে এ-হেন যুক্তি ধোপে টেকে না। “আমার দেহ” নেহাতই কথার কথা; ভারতীয় পরিভাষায় তাকে বলে উপচার। কিন্তু এ-হেন ঔপচারিক ব্যবহার থেকে “আমি” আর “দেহ”-র মধ্যে তফাৎ করতে যাওয়াটা অবান্তর হবে। কথার কথা হিসেবে তো অনেক সময় “রাহুর মাথা”-ও বলা হয়। তাই বলে কি স্বীকার করতে হবে যে “রাহু” এক, এবং তার “মাথা” বলতে অন্য কিছু। রাহুর কথা তো পুরাণকারদের কাছে শোনা এবং তাঁদেরই মতে, ওই মাথাই রাহুর সর্বস্ব; মাথাটির মালিক হিসেবে রাহু বলে স্বতন্ত্র কারুর কল্পনা একান্তই অবান্তর। তাই অত সহজে– কথার কথা-র নজির দেখিয়ে– দেহ ছাড়াও আত্মা বলে কিছুর অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না, বা দেহাত্মবাদ খণ্ডন করা সম্ভব নয়। বরং, যাঁরা স্বতন্ত্র আত্মা মানেন তাঁদেরই বিপদে পড়ার ভয় আছে। যেমন, আমরা তো হামেশাই বলে থাকি, ‘আমি রোগা’, ‘আমি কালো’, ‘আমি ফর্সা’। এ-জাতীয় ক্ষেত্রে ‘আমি’ বলতে দেহ ছাড়া আর কি বোঝা যেতে পারে? কালোই বলুন আর ফর্সাই বলুন, রোগাই বলুন আর মোটাই বলুন– এ সবই দেহধর্ম বা দেহের গুণ। এ-জাতীয় দৃষ্টান্তেও আত্মাবাদীরা– অর্থাৎ, আত্মায় বিশ্বাসীরা– ‘আমি’ বলতে কি আত্মা বোঝাবেন? তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা তামাশার মতো শোনাবে : আত্মাটি মোটা বা রোগা, কালো বা ফর্সা– এ-জাতীয় কথা মানতে হবে।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৩)

এ-প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ আরো বলেন যে, অবশ্যই লৌকিক ভাষা-ব্যবহারের নজির থেকে কোনো মতের দার্শনিক মূল্যায়ন হয় না। দেহাত্মবাদেরও নয়। তার প্রকৃত মূল্যায়নের জন্য দার্শনিক বিচারের অবতারণা প্রয়োজন। দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে তিনি মূলত চারটি বিষয়ের প্রস্তাব করেন–
১। দেহাত্মবাদের সমর্থনে চার্বাকদের পক্ষে কোন্ ধরনের নজির দেখানো সম্ভব?
২। দেহাত্মবাদ খণ্ডনে বিপক্ষ দার্শনিকরা কী যুক্তি প্রস্তাব করেন?
৩। এজাতীয় যুক্তি দিয়ে দেহাত্মবাদ কি সত্যিই নস্যাৎ হয়?
৪। সাধারণভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেহাত্মবাদের প্রকৃত তাৎপর্য কী?

এই প্রস্তাবনা আলোচ্য বিষয়ের যথাযথ পর্যালোচনায় আমাদের সহায়ক হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে প্রথম প্রস্তাবটিই সবচেয়ে কঠিন বলে প্রতীয়মান হয়। কেননা আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি চার্বাকমত পুনর্গঠন তথা রূপরেখা তৈরির পক্ষে আজকের দিনে আমাদের আসল সম্বল বলতে খুবই সামান্য। তাই ‘দেহাত্মবাদের সমর্থন’ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদই বলছেন, এক্ষেত্রে আমাদের আসল সম্বল বলতে–
‘অর্থশাস্ত্র’ জাতীয় প্রাচীন পুঁথিপত্রের নজির ছাড়া কিছু প্রামাণিক লোকগাথা এবং পূর্বপক্ষ হিসাবে বিরুদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু রচনা। কিন্তু পূর্বপক্ষ হিসাবে বর্ণনার উপর নির্বিচারে নির্ভর করা নিরাপদ নয়। খণ্ডনের উদ্দেশ্যে বর্ণিত কোনো মত সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ না-হবারই সম্ভাবনা; পক্ষান্তরে কিছুটা কারসাজিই থাকতে পারে। অর্থাৎ, পূর্বপক্ষ বর্ণনায় এমন যুক্তি বা বিচার গুঁজে দেবার প্রবণতা অসম্ভব নয়, যার অন্তঃসারশূন্যতা দেখানো তুলনায় সহজ হয়। অবশ্যই ভারতীয় দর্শনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায় পরস্পরকে খণ্ডন করতে চেয়েছে, অতএব পূর্বপক্ষ হিসেবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের উল্লেখও করেছে। তবে ন্যায়-বৈশেষিক, বেদান্ত, পূর্বমীমাংসা, জৈন ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কথা আলাদা; এগুলির সমর্থনে রচিত নানা গ্রন্থ বর্তমান। পূর্বপক্ষ হিসাবে এগুলির বর্ণনায় কারসাজির কোনো চেষ্টা থাকলেও তা সনাক্ত করা কঠিন নয়। কিন্তু চার্বাকদের নিজস্ব রচনা এককালে যে বর্তমান ছিল– সে-বিষয়ে মোটের উপর সুনিশ্চিত নজির থাকলেও, বাস্তব পরিস্থিতিটা এই যে, যে-কোনো কারণেই হোক-না-কেন, আজ তা বিলুপ্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। সম্প্রতিকালে প্রকাশিত জয়রাশিভট্টর ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’ বলে বইটি নিয়ে অবশ্যই বেশ কিছুটা শোরগোল পড়েছিল। কেননা এর সম্পাদকেরা মনে করেছিলেন প্রসিদ্ধ চার্বাক সম্প্রদায়ের গ্রন্থ না-হলেও কোনো-এক-কালে কোনো-এক-দেশে কোনো একরকম “সর্বপ্রমাণ-বিরোধী” চার্বাক সম্প্রদায় সম্ভবত বর্তমান ছিল; এই গ্রন্থে তারই মত বিবৃত হয়েছে। কিন্তু বইটা নিয়ে শোরগোল আজকাল প্রায়াংশেই স্তিমিত। অগ্রণী বিদ্বানদের বস্তুনিষ্ঠ বিচারে প্রমাণ হয়েছে চার্বাকমতের সঙ্গে ‘তত্ত্বোপপ্লবসিংহ’-র সম্পর্ক মোটের উপর কল্পিতই : বইটিতে আসলে একরকম চরম সংশয়বাদেরই পরিচয়– অনেকটা শ্রীহর্ষর ‘খন্ডনখন্ডখাদ্য’র মতোই, যদিও স্বয়ং শ্রীহর্ষ সর্বপ্রমাণ খণ্ডন করে অদ্বৈত-বেদান্ত দর্শনের সমর্থন করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার তাৎপর্য যাই হোক-না-কেন, আমাদের বর্তমান আলোচনার পক্ষে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এই যে চার্বাকমতের সমর্থনে রচিত কোনো বই-এর অভাবে পূর্বপক্ষ হিসাবে বিরুদ্ধ দার্শনিকদের রচনায় কম-বেশি কারসাজি থাকলেও তা সনাক্ত করা সহজ নয়। এই প্রসঙ্গে আমাদের প্রধান অবলম্বন বলতে বোধহয় চার্বাকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলি : আলোচ্য পূর্বপক্ষের সঙ্গে প্রামাণিক লোকগাথাগুলির যতটা সঙ্গতি অন্তত ততটা পর্যন্ত ওই পূর্বপক্ষ-বর্ণনার যাথার্থ্য স্বীকার করায় বাধা নেই। তাছাড়া আরো একটা ভাববার মতো কথা আছে : সমস্ত বিরুদ্ধ দার্শনিকদের রচনায় দেহাত্মবাদের সমর্থনে বর্ণিত যুক্তিতর্ক সমান নয়। নানা দার্শনিক দেহাত্মবাদের বর্ণনায় নানা রকম যুক্তিতর্কের– এমনকি রকমারি কূটতর্কের– অবতারণা করেছেন। এদিক থেকেও ভেবে দেখার সুযোগ আছে কোন্ যুক্তি চার্বাকদের প্রকৃত অভিপ্রায় হবার সম্ভাবনা আর কোন্ যুক্তি বিরুদ্ধ কল্পনায় অনুপ্রাণিত।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৪)

এদিকে দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে ইতোমধ্যে প্রদত্ত গুটিকয় নমুনা-দৃষ্টান্ত থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, যে সচেতন ক্রিয়াকলাপ আত্মগত বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক, চার্বাকেরা তার উৎপত্তির ক্ষেত্র হিসেবে দেহকে নির্দেশ করে থাকেন। আত্মাকে দেহের গণ্ডির মধ্যে সীমিত রাখার মূলে কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গিটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ-অতিরিক্ত প্রমাণে চার্বাকদের স্বীকৃতি নেই; কারণ, যে আত্মা দেহতে আশ্রিত নয়, সেই বিদেহ চৈতন্য প্রত্যক্ষের মাপকাঠিতে ধরা পড়ে না। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থাকার জন্য স্বপক্ষ সমর্থনে অবশ্য যুক্তির সহায়তায় পূর্বপক্ষ হিসেবে আসরে অবতীর্ণ হতে হয়েছে প্রতিপক্ষ দার্শনিকদের রচিত গ্রন্থে। কাজেই চার্বাকী নীতি বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমানের বিরোধী হলেও এবং স্থূল দেহের অতিরিক্ত আত্মাকে অস্বীকার করার মূল এই নীতিতে নিহিত থাকলেও চার্বাকপক্ষের আশ্রয় এক্ষেত্রে যুক্তিভিত্তিক অনুমান। আর চার্বাকেতর অধ্যাত্মবাদী মতবাদের প্রধান ভিত্তিই যেহেতু আত্মা বা আত্মতত্ত্ব, অতএব নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই চার্বাকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে তাঁদের দ্বিধা করার কোন অবকাশ নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে ভারতীয় অধ্যাত্মদর্শনের বিভিন্ন শাখাও তাদের আত্ম-সম্বন্ধীয় ধারণার সমর্থনে যুক্তিকে বহুক্ষেত্রে টেনে এনেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিচারে তাঁদের এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণার মূল আপ্তবাক্য। কাজেই অনুমানকে যখন তাঁরা প্রমাণের আসনে বসান, তখন তা সব সময়ে সহজগ্রাহ্য হয় না, এবং কষ্টকল্পিত তাঁদের এই যুক্তিগুলিতে প্রচুর ত্রুটিও থেকে যায় বলে আধুনিক বিদ্বানেরা মনে করেন। আর তর্কের আসরে নেমে বিরোধীপক্ষকে পরাভূত করার ক্ষেত্রে এই ত্রুটির সুযোগ নিতে চার্বাকেরা ইতস্ততঃ করবেন বলে মনে হয় না। কেননা, ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি যে, প্রমাণের জগৎ থেকে লৌকিক ব্যবহার-বহির্ভূত অনুমানকে বহিষ্কৃত করার মূলে যে ভাবনা চার্বাকদের মধ্যে সাধারণভাবে কার্যকরি তা হলে আত্মা, ঈশ্বর, পরলোক ইত্যাদির ধারণার ক্ষেত্রে অনুমানের কোন উপযোগিতা নেই। এইভাবে আত্মপ্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দর্শনের আসরে এক বিরাট তর্কযুদ্ধের সূচনা হয়। চার্বাকী দেহাত্মবাদের বর্ণনা প্রকৃতপক্ষে এই তর্কযুদ্ধেরই আলোচনা; এবং বহুক্ষেত্রে তা নীরস হলেও বর্তমান প্রসঙ্গে এর প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য।

এই তর্কযুদ্ধে চার্বাকের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে দুভাগে ভাগ করা যায়– প্রথম, স্থায়ী আত্মায় বিশ্বাসী অধ্যাত্মদর্শনের বিভিন্ন শাখা; দ্বিতীয়, বৌদ্ধ দার্শনিক সম্প্রদায়, যাঁদের ধারণায় স্থায়ী আত্মার স্থান অধিকার করেছে সচেতন অনুভূতির পরস্পরাবদ্ধ প্রবাহ। প্রকৃতপক্ষে চৈতন্য বা বিজ্ঞানকে দেহাতিরিক্ত মর্যাদা দিয়ে বৌদ্ধ দর্শন আত্মাবাদী দর্শনগুলির সঙ্গে একইভাবে চার্বাকী দেহাত্মবাদের বিরোধিতা করেছে এবং জন্মান্তরবাদ, কর্মফল, পরলোক ইত্যাদি বিষয়ের ধারণাতে এই দর্শন আত্মবাদী দর্শনগুলির সমগোত্রীয়। আত্মবাদী দার্শনিকদের সঙ্গে চার্বাকী তর্কযুদ্ধের পরিচয় পাওয়া যায় সাংখ্য, ন্যায়, জৈন, বেদান্ত ইত্যাদি দর্শনের আচার্যদের রচিত পুস্তকে। বৌদ্ধ দার্শনিকদের সঙ্গে চার্বাকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিবরণ সংগৃহীত হয় প্রধানতঃ শান্তরক্ষিত এবং কমলশীল প্রণীত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থে। বস্তুতঃ উত্তর-প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে বৌদ্ধ আচার্যদ্বয় চার্বাক দর্শন প্রসঙ্গে যে আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছেন, দেহাত্মবাদ সম্বন্ধীয় চার্বাকী দৃষ্টিভঙ্গীর রূপায়ণে তা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতে সমর্থ।’- (লতিকা চট্টোপাধ্যায়, চার্বাক দর্শন, পৃষ্ঠা-৯৩)

এছাড়া, ‘জৈন দার্শনিক হরিভদ্রর ব্যাখ্যাকার– বিশেষত গুণরত্নে– দেহাত্মবাদ নিয়ে পাতার পর পাতা লিখেছেন; প্রভাচন্দ্র নামে অপর এক জৈন মহাতার্কিক তাঁর ‘ন্যায়কুমুদচন্দ্র’ এবং ‘প্রমেয়কমলমার্তণ্ড’ বলে বইতে দেহাত্মবাদের বিচারে বিস্তর বাগবিস্তার করেছেন। আরো অনেকেই করেছেন এবং তাঁদের রচনায় তর্কবিতর্কের মারপ্যাঁচ বোঝা সহজসাধ্য নয়। লোকায়তর অর্থ যদি হয় ‘লোকেষু আয়ত’ বা জনাসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত, তাহলে সহজেই সংশয় হবে, চার্বাক বা লোকায়তিকেরা সত্যিই অতশতর ধার ধারতেন কি না!
কিন্তু শঙ্করের লেখা একেবারে অন্য রকম। এমন সহজ সরল ভাষায় তিনি লোকায়তিকদের দাবিটা বর্ণনা করেছেন যে, সাধারণ পাঠক অল্প আয়াসেই তা বুঝতে পারেন। আরো কথা আছে।… শঙ্করের দেহাত্মবাদ বর্ণনার সঙ্গে লোকায়তিকদের প্রামাণিক লোকগাথারও অন্তত অনেকাংশেই মিল হয়। অবশ্যই এমন কথা জোর গলায় বলা যায় না যে শঙ্করের দেহাত্মবাদ বর্ণনায় একেবারেই কোনোরকম কারসাজি নেই। কিন্তু যদিই বা থাকে তাহলেও তিনি সেটা সহজ ভাষায় দেহাত্মবাদীদের বক্তব্যের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে দিয়েছেন যে তা সনাক্ত করা সহজসাধ্য নয়।’- (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৭৫-৭৬)
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال