প্রমাণ প্রসঙ্গে চার্বাক-সিদ্ধান্ত

প্রমাণ প্রসঙ্গে অতঃপর চার্বাক-সিদ্ধান্ত


প্রত্যক্ষ প্রসঙ্গে :

প্রমাণ বিষয়ক উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমাদের ধারণায় এটুকু স্পষ্ট হয়েছে যে, পূর্বপক্ষ হিসেবে চার্বাকদর্শনের বর্ণনায় মাধবাচার্য প্রমুখ যদিও বলেছেন যে প্রমাণ হিসেবে চার্বাকেরা অনুমান প্রমাণ একেবারে বাতিল করে দিতে চেয়েছিলেন, তবু ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে একথা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কেননা, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, মাধবাচার্যের নিজের সম্প্রদায়ে (অর্থাৎ অদ্বৈত বেদান্তে) অবশ্যই সর্বপ্রমাণ বর্জনের– অতএব অনুমান বর্জনেরও– উপদেশ আছে। শঙ্করাচার্যের লেখা থেকে শ্রীহর্ষ ও তাঁর ব্যাখ্যাকারদের রচনায় সেকথা সুস্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এটাই হয়তো যৌক্তিক যে–
আসলে অনুমান খণ্ডনের প্রস্তাব মাধবাচার্য চার্বাকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তাদের দার্শনিক মতকে খেলো প্রতিপন্ন করবার সহজ পথ বেছে নিয়েছেন : অনুমানই যদি কেউ না মানে তাহলে দর্শনের দরবারে তাকে কী করে স্থান দেওয়া যায়? প্রসঙ্গত, এ-জাতীয় যুক্তির জবাব দিয়েই শ্রীহর্ষ তাঁর প্রখ্যাত ‘খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য’ বই শুরু করেছেন; অর্থাৎ তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে শূন্যবাদী এবং মায়াবাদীরা সব রকম প্রমাণ অগ্রাহ্য করেও শূন্যবাদ ও মায়াবাদ প্রচারের অধিকারী ছিলেন।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৬৩)

কিন্তু আমাদের বর্তমান আলোচনা অবশ্যই শূন্যবাদ বা মায়াবাদ নিয়ে নয়, প্রখর বস্তুবাদ নিয়ে– যে বস্তুবাদ লোকায়ত বা চার্বাক নামে ভারতীয় দর্শনে প্রসিদ্ধ। এবং বিভিন্ন নজির থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি যে প্রকৃত চার্বাকমতে প্রত্যক্ষ অবশ্যই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ, প্রমাণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে সেরা। কিন্তু প্রত্যক্ষ-অনুগামী ইহলোক প্রসঙ্গেও অনুমানকে প্রমাণ বলে মানায় বাধা নেই। কেবল পরলোক, কর্মফল, আত্মা প্রভৃতি একান্ত অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান নিষ্ফল– কেননা একদল ধূর্ত এজাতীয় বিষয়ে অনুমান প্রমাণ দেখাবার চেষ্টা করে লোক ঠকাবার আয়োজন করে।

এই যদি চার্বাকদের প্রকৃত অভিপ্রেত মত হয় তাহলে সাধারণত মতটিকে অধ্যাত্মবাদীদের কর্তৃক যতটা খেলো করে প্রচার করার চেষ্টা চোখে পড়ে তা মূলতই বিরূপ-প্রচারের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, বিশেষত আমাদের দেশে শ্রুতি-স্মৃতির দোহাই পাড়ার প্রয়োজন এমনই প্রবল হয়েছিলো যে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের গুরুত্ব নেহাতই গৌণ বা অনেকাংশে অবান্তর বলেই বিবেচিত হবার আশঙ্কা দেখা গিয়েছিলো এবং এমন একটা ধারণা চালু হয়েছিলো যে আমাদের সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যই বুঝি ঋষিদের ধ্যানলব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত অধ্যাত্মবিদ্যা– যার সঙ্গে চোখে দেখা মাটির পৃথিবীর বড় একটা সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া প্রকৃতি বিজ্ঞানের প্রথম ধাপই সম্ভব হয় না। অর্থাৎ বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিকাশের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষকে প্রমাণের জ্যেষ্ঠত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব না মেনে তা সম্ভবই নয়।

যেহেতু আমাদের আলোচনার নজিরগুলি ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যকে কেন্দ্র করে যুক্তিবিস্তৃত হচ্ছে, বিজ্ঞান-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সেরকম নজির উপস্থাপন করা যায় কিনা দেখা যেতে পারে। এ-প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদ তাঁর ‘ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা-৬৫) সুপ্রাচীন কালের শল্যবিদ্যর আকরগ্রন্থ ‘সুশ্রুত-সংহিতা’র নজির টেনে বলছেন, ‘সুশ্রুত-সংহিতা’-তেও প্রত্যক্ষজ্ঞানের প্রাধান্য প্রতিপাদন করা হয়েছে; এই কারণেই সুশ্রুত-মতে শবব্যবচ্ছেদ না করে প্রকৃত ভিষক্ হওয়া সম্ভব নয়। এ-প্রসঙ্গে তিনি ‘সুশ্রুত-সংহিতা’র প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন–
‘ত্বক্ পর্যন্ত সমস্ত দেহের যে সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উক্ত হইয়াছে, শল্যজ্ঞান ব্যতিরেকে তাহার কোন অঙ্গ বর্ণন করিতে পারা যায় না। অতএব শল্যাপহর্তা যদি নিঃসংশয় (সন্দেহরহিত) জ্ঞান লাভের ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে একটি মৃতদেহকে শোধন করিয়া তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গসকল সম্যক্রূপে দর্শন করা তাঁহার কর্তব্য। যাহা প্রত্যক্ষদৃষ্ট হয় এবং যাহা শাস্ত্রে দেখা যায় তদুভয়ই উভয় বিষয়ে সহজে অধিকতর জ্ঞান বর্ধন করিয়া থাকে।।’
‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি দর্শনার্থে যেরূপ শব গৃহীত হইবে, তাহাই বলা যাইতেছে। শবটির যেন সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থাকে, তাহা যেন বিষোপহত না হয়, দীর্ঘকাল ব্যাধিপীড়িত না হইয়া থাকে, শতবৎসর বয়স্কের দেহ না হয়। এনরূপ শবের অন্তঃপুরীষ নিষ্কাশিত করিয়া কোন নির্জন প্রদেশে তাহা একটি স্রোতহীন জলাশয়ে পচাইবে। মৎস্যাদিতে ভক্ষণ করিতে না পারে এবং অন্য কোথাও সরিয়া না যায়, এইজন্য এই জলাশয়ের জলের মধ্যে একটি মাচা বাঁধিয়া তাহার উপর ঐ শবকে রাখিতে হইবে, এবং মুঞ্জ বল্কল কুশ ও শণাদি রজ্জুর কোন রজ্জু-দ্বারা তাহার সর্বাবয়ব বেষ্টন করিয়া বাঁধিতে হইবে। সাতদিনের মধ্যেই উহা সম্যক পচিবে, তখন উহাকে তুলিয়া বেণারমূল, চুল, বাঁশের চেয়াড়ী বা কুঁচী দ্বারা ধীরে ধীরে ঘর্ষণ করিয়া ত্বগাদি সমস্তই অর্থাৎ যথোক্ত বাহ্যাভ্যন্তর অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমূহ চক্ষু দ্বারা দর্শন করিবে।।’
…‘যিনি শবচ্ছেদ দ্বারা শরীরের বাহ্যাভ্যন্তর অঙ্গপ্রত্যঙ্গাদি সকল প্রত্যক্ষ করিয়াছেন এবং শাস্ত্রে তৎসমস্ত অবগত হইয়াছেন, তিনিই আয়ুর্বেদবিশারদ। প্রত্যক্ষদৃষ্ট এবং শাস্ত্রশ্রুত বিষয় দ্বারা সন্দেহ নিরাকরণপূর্বক তিনি চিকিৎসা করিয়া থাকেন।’- (দেবেন্দ্রনাথ ও উপেন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর তর্জমা। শারীরস্থান, পঞ্চম অধ্যায়)

পাঠক হয়তো এখানে সরাসরি ব্যবহারিক জ্ঞানের উপদেশ দেখে ভাবতে পারেন যে দার্শনিক উপপত্তি কোথায়? কিন্তু উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রথা হিসেবেই প্রাচীন গ্রন্থগুলিতেও প্রাসঙ্গিক দর্শনালাপের খুব একটা কমতি দেখা যায় না কোথাও। এক্ষেত্রে আয়ুর্বেদের আকরগ্রন্থ– ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য়– প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের উপর চরম গুরুত্ব অর্পণের অজস্র নজির রয়েছে। তার দীর্ঘ তালিকায় না গিয়ে একটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
আয়ুর্বেদ-মতে অন্বষ্ঠ নামের একজাতীয় ফল আমাশয় জাতীয় রোগের চিকিৎসায় বিশেষ ফলপ্রসূ, কেননা বহু দৃষ্টান্তেই দেখা গেছে যে তা খেলে কোষ্ঠ বদ্ধ হয়। আয়ুর্বেদ-মতে প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতেই অন্বষ্ঠ জাতীয় ফলের এই উপযোগিতা স্বীকার্য। এবং প্রত্যক্ষের উপর প্রতিষ্ঠিত বলেই একই ফলের বিপরীত গুণাগুণ হাজার যুক্তিতর্ক দিয়েও প্রমাণ করা অসম্ভব। তাই ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় বলা হয়েছে–
‘প্রত্যক্ষলক্ষণফলাঃ প্রসিদ্ধাঃ চ স্বভাবতঃ।
নৌষধীর্হেতুভির্বিদ্বান্ পরীক্ষেত কথঞ্চন।।
সহস্রেণাপি হেতুনাং ন অন্বষ্ঠাদির্বিরেচয়েৎ।
তস্মাত্তিষ্ঠেত্তু মতিমানাগমে ন তু হেতুষু।।’ (সুশ্রুতসংহিতা-১/৪১/২৩-২৪)
অর্থাৎ :
সংক্ষেপে, প্রত্যক্ষজ্ঞানলব্ধ বিষয়কে শুধুমাত্র হেতু বা যুক্তি দিয়ে বিচার করতে যাওয়া বিদ্বানের লক্ষণ নয়। যেমন, সহস্র হেতু প্রয়োগ করেও প্রমাণ করা যাবে না যে অন্বষ্ঠ জাতীয় ফল বিরেচনের কারণ হতে পারে।

এখানে প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে বলে তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, আয়ুর্বেদে যুক্তিতর্কের– এবং সাধারণভাবে অনুমানের– গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। ‘চরক-সংহিতা’ গ্রন্থে অনুমান নিয়ে এতো দীর্ঘবিস্তৃত আলোচনা আছে যে, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের মতে এমনকি ন্যায়দর্শনের উৎস-সন্ধনে শেষ পর্যন্ত এই আলোচনায় উপনীত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এই বক্তব্য যে অমূলক নয় তা আরেকটু পরেই আমরা দেখবো। তবে আয়ুর্বেদের অভিপ্রেত মত এই যে যুক্তিতর্ক এবং অনুমানের গুরুত্ব যতই হোক না কেন, তা প্রসিদ্ধ প্রত্যক্ষ-বিরুদ্ধ হলে বস্তুত অচল হয়ে যাবে। এবং এই দাবিও ন্যায়দর্শনের কথাই মনে করিয়ে দেয়, কেননা, ইতঃপূর্বেই আমরা দেখেছি, ‘ন্যায়-সূত্রে’র ভাষ্যে বাৎসায়নও দেখাতে চেয়েছেন যে প্রত্যক্ষ-বিরুদ্ধ অনুমানের মূল্য স্বীকার করা যায় না। সংক্ষেপে, ন্যায়দর্শনের মতোই আয়ুর্বেদ-মতেও প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ– অর্থাৎ, প্রমাণের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে বলে রাখা আবশ্যক, চার্বাক আলোচনায় এই আয়ুর্বেদকে টেনে আনার কারণ আর কিছু নয়, চার্বাকদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযানের একটা বড় হাতিয়ার হলো তাদের প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা, এবং চার্বাকমতকে একেবারে খেলো প্রতিপন্ন করবার উৎসাহেই মনে হয় কথাটাকে বিকৃত করে বলা হয়েছে যে, চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ; এমনকি সাধারণ লোকব্যবহারসিদ্ধ অনুমানকেও প্রমাণের মর্যাদা দিতে চার্বাকেরা নারাজ। কিন্তু আমরা বিভিন্ন নজির থেকে অনুধাবন করতে পেরেছি, এই দ্বিতীয় কথাটি স্বীকার করা যায় না– অর্থাৎ, চার্বাকেরা একেবারে ঐকান্তিক অর্থে অনুমান অগ্রাহ্য করেননি। চার্বাক-মতে প্রত্যক্ষই প্রমাণ; তবুও প্রত্যক্ষ সাপেক্ষ বিষয়ে সাধারণ লৌকিক অনুমান মানায় তাঁদেরও আপত্তি ছিলো না। কিন্তু তা স্বীকার করলেও মানতে হবে, চার্বাকেরা অবশ্যই প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।
অথচ চার্বাক-বিরোধীদের মন্তব্য হলো, চার্বাকদের এই প্রত্যক্ষ-বিহ্বলতা স্বাভাবিক এবং এর থেকেই বোঝা যায় মতটা আসলে অত্যন্ত অসার। ইন্দ্রিয়লব্ধ সুখভোগের প্রতিই যাদের অমন টান– যাদের মনের মতো কথা শুধু এই যে খাও-দাও-ফূর্তি করো– তারা প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান ছাড়া আর কীই বা মানতে পারে?–
‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : (লোকায়ত মতে) যতদিন বেঁচে আছ সুখে বাঁচার চেষ্টা কর, ধার করেও ঘি খাবার ব্যবস্থা কর। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?

এর উত্তরে অনেক আধুনিক বিদ্বান গবেষকই দেখার চেষ্টা করেছেন যে, পরলোকের কাল্পনিক সুখের আশায় ইহলোকের বাস্তব সুখের প্রতি বিরাগ চার্বাকমতে অবশ্যই বেকুবের কথা। প্রত্যক্ষলব্ধ ইহকালের কথা ছেড়ে অপ্রত্যক্ষ পরকালের কল্পনাও তাইই। তবু এই নজির থেকে– অর্থাৎ চার্বাকের প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা থেকে– দার্শনিক মত হিসেবে নিকৃষ্টতা প্রতিপন্ন হয় না। বরং, চার্বাকের প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা একদিক থেকে দার্শনিক উৎকর্ষেরই পরিচায়ক। কেননা, প্রত্যক্ষ-পরায়ণতাই প্রকৃতি-বিজ্ঞানের ভিত্তি। এবং ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদের কাল থেকে মধ্যযুগের রসায়নবিদ্যা পর্যন্ত প্রকৃতি-বিজ্ঞানের যতটুকু উৎকর্ষ তার মূলেও এই প্রত্যক্ষ-পরায়ণতা। প্রত্যক্ষকেই প্রমাণজ্যেষ্ঠ বা প্রমাণশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার না করে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এদিক থেকে বলা যায়, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অন্যান্য দার্শনিক মতের তুলনায় চার্বাকমতই প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বিশেষ সহায়ক ছিলো। অতএব, চার্বাকমতের আলোচনায় ভারতীয় প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সাক্ষ্য অবান্তর নয়; পক্ষান্তরে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলেই দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন।

অনুমান প্রসঙ্গে :
প্রত্যক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হলেও অবশ্যই নিছক প্রত্যক্ষ বা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করেও প্রকৃতি-বিজ্ঞান সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষ ছাড়াও অনুমানের উপরও নির্ভর করা প্রয়োজন। আয়ুর্বেদের গ্রন্থেই তার ভূরিভূরি নিদর্শন রয়েছে। ফলে অনুমানের আলোচনাও আছে। ইতঃপূর্বে আমরা অন্বীক্ষা বা অনুমান শব্দের আলোচনা প্রসঙ্গে দেখেছি– অনু+ঈক্ষা হলো অন্বীক্ষা, বা অনু+মান হলো অনুমান। সহজ কথায়, পরবর্তী জ্ঞান– অর্থাৎ, অন্য কোনো জ্ঞানের অনুগামী জ্ঞান। কিন্তু কিসের পরবর্তী? প্রত্যক্ষ জ্ঞানের। মোদ্দা কথায়, কোনো পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষর উপর নির্ভরশীল আরেক রকম জ্ঞান হলো অনুমান। আয়ুর্বেদের আকর-গ্রন্থ ‘চরক-সংহিতা’য়ও কথাটা খুবই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে–
‘প্রত্যক্ষ-পূর্বং ত্রিবিধং ত্রিকালং চ অনুমীয়তে।
বহ্নিঃ নিগূঢ়ঃ ধূমেন মৈথুনং গর্ভদর্শনাৎ।।
এবং ব্যবস্যন্তী অুীতং বীজাৎ ফলম্ অনাগতম্ ।
দৃষ্টা বীজাৎ ফলং জাতম্ ইহ এব সদৃশং বুধৈঃ।।’ (চরকসংহিতা-১/১১/২১-২২)
অর্থাৎ :
যাহা প্রত্যক্ষপূর্ব, ত্রিবিধ এবং তিন কালেই অনুমেয় হয়, তাহাকে অনুমান বলে। অনুমান প্রত্যক্ষ-পূর্ব, অর্থাৎ পূর্বে যাহার প্রত্যক্ষ করা গিয়াছে, তৎসম্বন্ধেই অনুমান করা যায়। অপ্রত্যক্ষ বিষয়ের অনুমান কখনই হইতে পারে না। অনুমান তিন প্রকার বলাতে কারণ-অনুমান, কার্য-অনুমান ও সামান্যদৃষ্ট-অনুমান বুঝায়। অনুমানের গতি যে বর্তমান, ভূত ও ভবিষ্যৎ– এই তিন কালেই হইয়া থাকে তৎপক্ষে দৃষ্টান্ত যথা : ধূম দ্বারা বর্তমান বহ্নির অনুমান, গর্ভ দেখিয়া অতীত মৈথুনের অনুমান হয় এবং বীজ দেখিয়া সেই বীজে একবার যেরূপ বৃক্ষ ফলিয়াছিল, এবারেও তৎসদৃশ ফল ফলিবেক, এইরূপ ভবিষ্যৎ অনুমান করা যায়। (কবিরাজ সতীশচন্দ্র শর্মা কবিভূষণের তর্জমা)।

এই শ্লোকের উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, ‘চরক-সংহিতা’য় ত্রিবিধ অনুমানের কথা বলা হয়েছে– বর্তমান ধূম দেখে বর্তমান অগ্নির অনুমান, বর্তমান গর্ভ দেখে অতীত মৈথুনের অনুমান এবং বর্তমান বীজ দেখে ভবিষ্যৎ বৃক্ষ ও ফলের অনুমান। কিন্তু এই তিন রকম অনুমানেরই মূল শর্ত হলো পূর্ব-প্রত্যক্ষ। এই কারণে অনুমান প্রসঙ্গে প্রথম কথাই হলো ‘প্রত্যক্ষ-পূর্ব’। প্রথমে প্রত্যক্ষ; এবং সেই প্রত্যক্ষের উপর নির্ভর করেই অনুমান। বলাই বাহুল্য, এই মতে অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান জ্ঞানের কোনো স্থান নেই; অতএব আত্মা, কর্মফল, পরকাল, পরলোক প্রভৃতি প্রসঙ্গে অনুমান অবান্তর হবে, কেননা এ-জাতীয় বিষয়ে কোনো পূর্ব-প্রত্যক্ষর সুযোগই নেই।

এ প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য–
অধুনালভ্য ‘চরক-সংহিতা’য় আত্মা, পরলোক প্রভৃতি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা চোখে পড়ে। কিন্তু তার নজির থেকে আমাদের বর্তমান যুক্তি অগ্রাহ্য করা যায়।… আত্মা, পরলোক, প্রভৃতি আলোচনার সঙ্গে আয়ুর্বেদের প্রকৃত সারাংশের কোনো বাস্তব সম্পর্ক নেই। আসলে প্রকৃত চিকিৎসাবিদ্যার সমর্থনে আয়ুর্বেদ-বিদেরা গোমাংসাদি ভক্ষণ জাতীয় এমন অনেক কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা ধর্মশাস্ত্রকারদের– অর্থাৎ সুপ্রাচীন আইনকর্তাদের– বিধান-বিরুদ্ধ। এই কারণে ধর্মশাস্ত্রকারেরা চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিদ্যার তীব্র নিন্দা করেছেন। ফলে, আইনকর্তাদের আক্রমণ থেকে পরিত্রাণের আশায় অধুনালভ্য ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় এমন অনেক আলোচনা প্রক্ষিপ্ত হয়েছে যার সঙ্গে আয়ুর্বেদের সারাংশর প্রকৃত সম্পর্ক না থাকলেও অন্তত আপাতদৃষ্টিতে আয়ুর্বেদের উপর ধর্মশাস্ত্র আনুগত্যের এক রকম যেন মুখোশ পরানো যায়। কে বা কারা এই আয়োজন করেছিলেন তা আমাদের জানা নেই; শুধু এইটুকু জানা আছে যে দীর্ঘযুগ ধরে অনেকের হাত ঘুরে– অনেক অবান্তর কথা সংযোজিত হয়ে– ‘চরক-সংহিতা’ ও ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় বর্তমান সংস্করণ আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছেছে। অতএব পরবর্তী সংস্কারক ও সম্পাদকদের পক্ষে আত্মাদি বিষয়ে আলোচনা সংযোজনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মোট কথা, অনুমানের লক্ষণ ও তার ত্রিবিধ দৃষ্টান্ত থেকে যে-উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে সেই উক্তি অনুসারে একান্ত অপ্রত্যক্ষ আত্মা, পরলোক প্রভৃতি বিষয়ে আয়ুর্বেদ-মতে অনুমানের সুযোগ নেই।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৬৯)

আমরাও ইতঃপূর্বে দেখেছি, বহু প্রাসঙ্গিক নজির থেকে মনে করা যেতে পারে যে অনুমান প্রসঙ্গে চার্বাকদেরও আসল বক্তব্য মোটের উপর একই রকম হওয়া সম্ভব। প্রত্যক্ষ-অনুগামী লৌকিক বিষয়ে অনুমান চার্বাকেরাও অগ্রাহ্য করেন নি। অতএব এদিক থেকেও বলা যায়, বহু বিরূপ-প্রচারণা সত্ত্বেও চার্বাকমতকে একেবারে খেলো মনে করার কারণ নেই। পক্ষান্তরে ভারতীয় প্রকৃতিবিজ্ঞানের মূল ভিত্তির সঙ্গে চার্বাকমতের অন্তত অনেকাংশে আত্মীয়তা চোখে পড়ে।

এখানে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তর সেই চিত্তাকর্ষক মন্তব্যটি স্মর্তব্য– ন্যায়-দর্শনের উৎস সন্ধানে আমাদের পক্ষে ‘চরক-সংহিতা’য় ফিরে যাবার সম্ভাবনা; অর্থাৎ আয়ুর্বেদ-এর আকরগ্রন্থে প্রমাণ প্রসঙ্গে যে আলোচনা আছে তাই কালক্রমে ন্যায়দর্শনের রূপ গ্রহণ করেছিলো। দাশগুপ্তের এই মন্তব্য সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য কিনা তা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এ-কথাটি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক যে, ‘ন্যায়সূত্র’-তে অনুমান প্রসঙ্গে প্রায় হুবহু একই কথা বলা হয়েছে। প্রত্যক্ষর আলোচনার পরেই ‘ন্যায়সূত্র’কার বলছেন–
‘অথ তৎপূর্বকং ত্রিবিধমনুমানং পূর্ববৎ শেষবৎ সামান্যতোদৃষ্টঃ চ’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।।
অর্থাৎ : অনন্তর, অর্থাৎ প্রত্যক্ষনিরূপণের অনন্তর অনুমান (নিরূপণ করিতেছি)। তৎপূর্বক, অর্থাৎ প্রত্যক্ষবিশেষমূলক জ্ঞান অনুমান প্রমাণ ত্রিবিধ– পূর্ববৎ, শেষবৎ ও সামান্যতো দৃষ্ট।

ভারতীয় দর্শনের পরিভাষায় সূত্রটির ব্যাখ্যা অল্পবিস্তর কঠিন মনে হলেও মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ তাঁর ‘ন্যায়দর্শন’ গ্রন্থে সূত্রটির যথাসম্ভব প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়েছেন।–  ‘ন্যায়সূত্র’র আলোচ্য সূত্রটির সরল অর্থ হলো, অনুমান বলতে বোঝায় ‘প্রত্যক্ষ-পূর্বক’। অর্থাৎ আগেকার কোনো প্রত্যক্ষ-জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল প্রমাণ, তা তিন রকম– পূর্ববৎ (অর্থাৎ বর্তমান কারণের প্রত্যক্ষ থেকে ভাবী কার্যর অনুমান; যেমন মেঘ দেখে অনুমান হয় বৃষ্টি হবে), শেষবৎ (অর্থাৎ কার্য থেকে কারণ অনুমান; যেমন নদীর জলস্ফীতি প্রভৃতি দেখে অনুমান হয় অতীতে বৃষ্টি হয়েছিলো), এবং সামান্যতোদৃষ্ট (যেমন কোনো বস্তুর স্থানান্তরপ্রাপ্তি থেকে তার গতি অনুমান; সূর্যের গতি প্রত্যক্ষগ্রাহ্য হয়, কিন্তু আকাশে সূর্যের স্থানান্তরপ্রাপ্তি প্রত্যক্ষ করে অনুমান হয় তার গতি আছে)।

‘ন্যায়সূত্র’র সরল অর্থ অনুসারে অনুমান প্রমাণ প্রত্যক্ষ-নির্ভর। অর্থাৎ, আগে প্রত্যক্ষ এবং সেই প্রত্যক্ষর উপর নির্ভর করেই অনুমান। শেষ কথায় ফণিভূষণ যেমন বলেছেন, ‘প্রত্যক্ষের জ্ঞান ব্যতীত অনুমানের জ্ঞান হইতে পারে না। সুতরাং ঐ জ্ঞানদ্বয়ের কার্য-কারণ ভাব আছে।’- (ন্যায়দর্শন-১/১৩১)।
অনুমান প্রসঙ্গে এই কথাই যদি ন্যায়দর্শনের সারাংশ হয় তাহলে চার্বাকমতের সারাংশের সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায় এবং কতোখানি? চার্বাক কোনো অর্থেই অনুমান মানতেন না– একথা চার্বাকদের বিরুদ্ধে বিকৃত-প্রচারণা হওয়াই স্বাভাবিক। বরং আমরা দেখেছি যে, প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার করা চার্বাকমতসম্মত হওয়াই স্বাভাবিক।

অতএব, বহু প্রাসঙ্গিক সাক্ষ্য থেকে মনে হয়, প্রমাণ প্রসঙ্গে চার্বাকদের সিদ্ধান্ত হলো, চার্বাক-মতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে শ্রেষ্ঠ; পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেও প্রত্যক্ষগোচর– বা প্রত্যক্ষ-অনুগামী– লৌকিক অনুমান স্বীকার করায় চার্বাকদের আপত্তি ছিলো না।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال