চার্বাক-মত প্রসঙ্গে কৌটিল্যর সাক্ষ্য

চার্বাক-মত প্রসঙ্গে কৌটিল্যর সাক্ষ্য

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’র সাক্ষ্যে বার্হস্পত্য সম্পর্কে চমৎকার প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। চার্বাক বা প্রাচীনতর কালে লোকায়ত নামে খ্যাত দার্শনিক মতে অনুমানও যে প্রমাণ বলেই স্বীকৃত ছিলো– এ বিষয়ে মোক্ষম প্রমাণ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’।
এই গ্রন্থের প্রথম অধিকরণ ‘বিনয়াধিকারিকম্’ এর ‘বিদ্যাসমুদ্দেশ’ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকারের বিদ্যা ও তাদের সম্মন্ধে পূর্ববর্তী শ্রদ্ধেয় আচার্যগণের মতভঙ্গি উদ্ধৃত করতে গিয়ে কৌটিল্য বলেন–
[কৌটিল্যস্য স্বমতং চ।] আন্বীক্ষিকী ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বিদ্যাঃ।
ত্রয়ী বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি মানবাঃ। ত্রয়ীবিশেষো হ্যান্বীক্ষিকীতি।
বার্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্হস্পত্যাঃ। সংবরণমাত্রং হি ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদ ইতি।
দণ্ডনীতিরেকা বিদ্যেত্যৌশনসাঃ। তস্যাং হি সর্ববিদ্যারম্ভাঃ প্রতিবদ্ধা ইতি।
চতস্র এব বিদ্যা ইতি কৌটিল্যঃ। তাভির্ধর্মার্থৌ যদ্বিদ্যাত্তদ্বিদ্যানাং বিদ্যাত্বম্ ।। ১/২/১।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
অর্থাৎ :
কৌটিল্যের মতে, বিদ্যা চার প্রকারের, যথা– আন্বীক্ষিকী (হেতুবিদ্যা বা তর্কবিদ্যা বা মোক্ষদায়ক আত্মতত্ত্ব), ত্রয়ী (ঋক্-যজুঃ-সামবেদাত্মক বেদ-বিদ্যাসমুদায়), বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য বিষয়ক বিদ্যা) এবং দণ্ডনীতি (অর্থাৎ রাজনীতি বা নীতিশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্র)।
মানব সম্প্রদায় অর্থাৎ মনু-শিষ্যগণ বলেন– ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি– বিদ্যা এই তিনপ্রকার। কারণ, আন্বীক্ষিকী (বা হেতুবিদ্যা) ত্রয়ীর অর্থবিচার করে বলে সেটি ত্রয়ীবিশেষ-মাত্র অর্থাৎ ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত।
বৃহস্পতির শিষ্যগণের (বার্হস্পত্যগণের) মতে, বার্তা ও দণ্ডনীতি– এই দুই প্রকারের বিদ্যা ; কারণ, ত্রয়ী লোকযাত্রাবিদের অর্থাৎ বার্তা ও দণ্ডনীতির অনুষ্ঠান বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে, সংবরণের অর্থাৎ আচ্ছাদনের কাজ করে মাত্র (লোকতন্ত্রজ্ঞ হলেও ত্রয়ীজ্ঞান না থাকলে নাস্তিক বলে লোকসমাজে যে নিন্দিত হতে হয়, তার থেকে রক্ষার উপায়মাত্র হওয়ায় ত্রয়ীর স্বতন্ত্র বিদ্যাত্ব স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই)।
ঔশনস (উশনা-পুত্র শুক্রাচার্যের শিষ্য-) গণের মতে, দণ্ডনীতি বা অর্থশাস্ত্রই একমাত্র বিদ্যা, কারণ দণ্ডনীতিতেই অন্যান্য সমস্ত বিদ্যার আরম্ভ (অর্থাৎ কর্মনীতিপদ্ধতি এবং যোগক্ষেম) প্রতিষ্ঠিত আছে।
কিন্তু কৌটিল্যের মতে, (প্রথম উক্ত) চারটিই বিদ্যা। (এই চারটিকে বিদ্যা বলবার কারণ–) এই চারটির দ্বারাই ধর্মসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপার এবং অর্থ বা জাগতিক সকল প্রয়োজনবস্তু জানা যায় ; এবং এদের দ্বারা জানা যায় বলেই এদের ‘বিদ্যাত্ব’ সার্থক হয়েছে।

এবং এই বিদ্যাগুলোর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কৌটিল্য আবার বলেন–
সাংখ্যং যোগো লোকায়তং চেত্যান্বীক্ষিকী।

ধর্মাধর্মৌ ত্রয্যাম্ । অর্থানর্থৌ বার্তায়াম্ । নয়াপনয়ৌ দণ্ডনীত্যাম্ । বলাবলে চৈতাসাং হেতুভিরন্বীক্ষমাণান্বীক্ষিকী লোকস্যোপকরোতি, ব্যসনেহভ্যুদয়ে চ বুদ্ধিমবস্থাপয়তি, প্রজ্ঞাবাব্যক্রিয়াবৈশারদ্যং চ করোতি।

প্রদীপঃ সর্ববিদ্যানামুপায়ঃ সর্বকর্মণাম্ ।
আশ্রয়ঃ সর্বধর্মাণাং শশ্বদান্বীক্ষিকী মতা।। ১/২/২।। (কৌটিলীয়ম্ অর্থশাস্ত্রম্)।
.
অর্থাৎ :
সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত– এই তিনটি শাস্ত্রই উক্ত আন্বীক্ষিকী-বিদ্যারই অন্তর্ভুক্ত।
এই আন্বীক্ষিকীর দ্বারা এবং সূক্ষ্ম অন্বীক্ষার সাহায্যে ধর্ম এবং অধর্মের বিষয় ত্রয়ীতে প্রতিপাদিত হয় ; অর্থ এবং অনর্থ প্রতিপাদিত হয় বার্তা-নামক বিদ্যায় ; এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় (good policy and bad policy) প্রতিপাদিত হয়। এই তিন বিদ্যার বল ও অবল (সামর্থ্য ও অসামর্থ্য) বা প্রাধান্য ও অপ্রাধান্য যুক্তির দ্বারা নির্ধারণ করা হয় বলে আন্বীক্ষিকী লোকসমাজের উপকার করে থাকে, বিপৎকালে এবং অভ্যুদয়ের সময় মানুষের বুদ্ধি অবিচলিত রাখে এবং মানুষের প্রজ্ঞা, বাক্য-ব্যবহার ও কর্মশক্তির নৈপুণ্য সম্পাদন করে।
আন্বীক্ষিকীবিদ্যা (অপর-) সকল বিদ্যার প্রদীপস্বরূপ (মার্গদর্শক), সকল কর্মের (অর্থাৎ কর্মসাধনের পক্ষে) উপায়তুল্য, সকল (লৌকিক ও বৈদিক-) ধর্মের আশ্রয়স্বরূপ বলে সর্বদা পরিগণিত হয়ে থাকে।

এখানে কৌটিল্যের মতে বিদ্যা চারটি হলেও উল্লিখিত শ্লোক অনুযায়ী কৌটিল্যবর্ণিত বার্হস্পত্যদের মতে বিদ্যার সংখ্যা দুই– দণ্ডনীতি এবং বার্তা। বেদ অথবা আন্বীক্ষিকীকে বার্হস্পত্যরা বিদ্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেন না। তাঁরা বেদকে ‘লোকযাত্রাবিদ্’ বা লৌকিক ব্যবহারে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের ‘সংবরণ’ বা পোশাক বলে অভিহিত করেছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বার্হস্পত্যদের অভিমত অনুসারে সে সময়ে বেদজ্ঞ বলে যাঁরা নিজেদের প্রচার করতেন তাঁদের প্রকৃত স্বরূপ সব সময়ই বেদজ্ঞানের আবরণে গোপন থাকতো। তা থেকে অনুমিত হয় যে, ‘অর্থশাস্ত্রে’র সময়কালে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকেই বার্হস্পত্য মতবাদ বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী মতবাদ হিসেবে চিহ্নিত বা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। অনুরূপ বক্তব্য পরবর্তী অন্য দার্শনিকদের উক্তিতেও প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায়।

তাই, কৌটিল্যের এই বার্হস্পত্য মত বর্ণনার সাপেক্ষে পরবর্তীকালের সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের সাযুজ্য বিশ্লেষণ করতে একাদশ শতকের কৃষ্ণমিশ্র রচিত ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকটিকে গুরুত্বপূর্ণ নমুনা-উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এই রূপক নাটকে বর্ণিত চার্বাক সিদ্ধান্তে বলা হচ্ছে–
‘দণ্ডনীতিরেব বিদ্যা। অত্রৈব বার্তান্তর্ভর্বিষ্যতি ধূর্ত প্রলাপস্ত্রয়ী।।’ (প্রবোধচন্দ্রোদয়, পৃষ্ঠা-৬৫)।
অর্থাৎ : চার্বাক মতে, দণ্ডনীতিই একমাত্র বিদ্যা। বার্তা দণ্ডনীতির অন্তর্ভুক্ত এবং ত্রয়ী বা বেদ ধূর্তদের প্রলাপ।
আবার অষ্টম শতকের প্রখ্যাত অদ্বৈত-বেদান্ত দার্শনিক শঙ্করাচার্য লোকায়ত প্রসঙ্গে তাঁর ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন–
কৃষিগোরক্ষবাণিজ্যদণ্ডনীত্যাদিভির্বুধঃ। দৃষ্টৈরেব সদোপায়ৈর্ভোগাননুভবেদ্ ভুবি।। ২/১৫।। (সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : (লোকায়তরা) কৃষি, গোরক্ষা, বাণিজ্য, দণ্ডনীতি ইত্যাদি দৃষ্ট উপায়ের মাধ্যমে জাগতিক বস্তু উপভোগের পরামর্শ দেন।
অতএব, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-চার্বাক বা ‘সর্বসিদ্ধান্তসংগ্রহ’ গ্রন্থের বার্হস্পত্য-লোকায়তের আদি রূপ হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত বর্ণিত বার্হস্পত্যের অনুমান করা অসঙ্গত নয়।

তবে বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অধিকতর পর্যালোচনার দাবি রাখে। এ বিবেচনায় প্রথমে ‘অর্থশাস্ত্রে’ ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দার্থ আলোচনা করা যেতে পারে। কৌটিল্যের মতে (রাজার পক্ষে) শিক্ষণীয় বিদ্যা বলতে চার রকম– আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা এবং দণ্ডনীতি। এর মধ্যে বার্তা ও দণ্ডনীতির অর্থ নিয়ে বিশেষ কোন হাঙ্গামা নেই। বার্তা মানে কৃষি, পশুপালন, বাণিজ্য ইত্যাদি– এককথায় সেকালের অর্থনীতি। আর দণ্ডনীতি মানে রাজ্যশাসন বিদ্যা– মানে সেকালের পলিটিক্স বা রাজনীতি। আমাদের বিশ্লেষণের লক্ষ্য বাকি দুটি শব্দ– ত্রয়ী ও আন্বীক্ষিকী।

গবেষক জ্যাকবি ত্রয়ী শব্দের অর্থ করেছেন থিয়োলজি বা ধর্মতত্ত্ব। কিন্তু এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো, যে কোনো ধর্মতত্ত্বই ত্রয়ী নয়। প্রাচীন ভারতে প্রচলিত একটি প্রথা অনুসারে অথর্ববেদকে বাদ দিয়ে শুধু ঋক্, সাম ও যজুর্বেদকে তিন বেদ বলে ধরা হতো। সেই প্রথা অনুসারে এখানেও ত্রয়ী বলতে তিন বেদ। অর্থাৎ, ত্রয়ী মানে ধর্মতত্ত্ব হলেও শুধু এই তিন বেদমূলক ধর্মতত্ত্ব বা এই তিন বেদের বিদ্যা। যদিও সেকালে পাল্টা ধর্মতত্ত্ব হিসেবে বিশেষত বৌদ্ধ ও জৈন মত সহজেই অনুমিত হতে পারলেও বেদবাদীরা তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাবেন এমন কল্পনা কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু কৌটিল্য-বর্ণিত চার রকম বিদ্যার মধ্যে কৌটিল্য আন্বীক্ষিকী নামক বিদ্যাটির উপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছেন। আন্বীক্ষিকী মানে কী? দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যায়–

অন্বীক্ষা শব্দের অর্থ ‘পরবর্তী জ্ঞান’। অনু (অর্থাৎ পরবর্তী) + ঈক্ষা (বা জ্ঞান)। অনুমান শব্দটির অর্থও হুবহু একই : অনু (পরবর্তী) + মান (জ্ঞান)। অতএব ‘অন্বীক্ষা’ ও ‘অনুমান’ একই কথা, ভারতীয় পরিভাষায় যাকে বলে পর্যায়শব্দ। কিন্তু ‘পরবর্তী জ্ঞান’ বললে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে : কিসের পরবর্তী ? ভারতীয় ঐহিত্য অনুসারে ‘প্রত্যক্ষর পরবর্তী’। …মনে রাখা দরকার যে ভারতীয় ঐতিহ্য অনুসারে ‘অনুমান’ জ্ঞান প্রত্যক্ষজ্ঞানের অনুগামী– পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। প্রথমে কোনো প্রত্যক্ষ-জ্ঞান এবং তারই অনুসরণ করে অনুমান-জ্ঞান। কিংবা বলা যায়, অনুমানের একটি মূল শর্ত হলো পূর্ববর্তী প্রত্যক্ষ। ভারতীয় দার্শনিকেরা একথা বলছেন কেন? পূর্ব-প্রত্যক্ষ বাদ দিয়ে অনুমান কেন সম্ভব নয়? একটা খুব সহজ দৃষ্টান্ত থেকে কথাটা বোঝাবার চেষ্টা করা যাক। ধূম থেকে আমরা অগ্নি অনুমান করি। কী করে করি? কেননা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি (বা প্রত্যক্ষ করেছি) : যেখানে ধূম সেখানেই অগ্নি, যেমন রান্নার উনুনে। এ-জাতীয় পূর্বপ্রত্যক্ষ বাদ দিয়ে শুধু ধূম থেকে অগ্নির অনুমান সম্ভব নয়। তাই অন্বীক্ষা (অনু + ঈক্ষা) বা অনুমান (অনু + মান)। ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘ন্যায়সূত্র’তে বিষয়টি আরো বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।…
তাহলে, ‘আন্বীক্ষিকী’র শব্দার্থ হলো ‘অনুমানবিদ্যা’– আজকাল চলতি কথায় আমরা যাকে বলি ‘লজিক’। অবশ্য, কৌটিল্য এখানে বিশুদ্ধ অনুমানবিদ্যা অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেননি ; তাঁর মতে ‘আন্বীক্ষিকী’ শুধু অনুমানবিদ্যা ছাড়াও অনুমান-মূলক দার্শনিক মতও। কেননা একই সঙ্গে তিনি বলেছেন– ‘আন্বীক্ষিকী’ বলতে তিনি এবং শুধুমাত্র তিন : সাংখ্য, যোগ এবং লোকায়ত। এগুলি দার্শনিক মতের নাম। তাই এখানে ‘আন্বীক্ষিকী’ বলতে হেতুবিদ্যা বা অনুমানবিদ্যা ছাড়াও এমন দার্শনিক মতও বুঝতে হবে যার মূল ভিত্তি বলতে অনুমান বা অন্বীক্ষা। অর্থাৎ কৌটিল্য এখানে প্রকৃত অনুমান-ভিত্তিক– বা, চলতি কথায় হয়তো বলা যায়, যুক্তিমূলক– দার্শনিক মত হিসেবে শুধুমাত্র তিনটির উল্লেখ করেছেন। সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। তাঁর বিচারে আর কোনো দার্শনিক মতের যুক্তিবিদ্যা-ভিত্তির মর্যাদা নেই।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৯)।

.
উল্লেখ্য, আন্বীক্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত বিদ্যা হিসেবে কৌটিল্যবর্ণিত যে যোগের উল্লেখ রয়েছে, পণ্ডিতদের মতে সেটা আসলে পতঞ্জলির (২৫০ খ্রিস্টাব্দ) যোগদর্শন নয়, মূলত ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে প্রাচীন যোগ বোঝানো হয়েছে। কীভাবে? কেননা, দার্শনিক মত হিসেবে পতঞ্জলির যোগ-দর্শন এবং সাংখ্য-দর্শনের মধ্যে মূল পার্থক্য শুধু এই যে, সাংখ্য-দর্শনে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই; কিন্তু পতঞ্জলি সাংখ্য-দর্শনের বাকি সব তত্ত্ব মেনে নিয়ে কোনোরকমে কেবল তার সঙ্গে ঈশ্বরকেও জুড়ে দিয়েছেন। এবং এ-কারণে পতঞ্জলির যোগদর্শন নামান্তরে ‘সেশ্বর সাংখ্য’ (বা সাংখ্য + ঈশ্বর) নামেও খ্যাত। অতএব কৌটিল্যের বর্ণনায় যোগ নামে পতঞ্জলির যোগদর্শনকে বোঝানো সম্ভাবনা সুদূর-পরাহত। তাছাড়া দেবীপ্রসাদের ভাষ্যে জানা যায়, ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় সংশয়াতীতভাবে নির্ভরযোগ্য পণ্ডিত ফণিভূষণ তর্কবাগীশ এবং কুপ্পুস্বামী শাস্ত্রীর মতো মহাপণ্ডিতেরা মূল্যবান সাক্ষ্য ও যুক্তি প্রদর্শন করে নিশ্চিত করেছেন যে, পরবর্তীকালে যে-দার্শনিক মতকে আমরা ন্যায়-বৈশেষিক নামে সনাক্ত করতে অভ্যস্ত, প্রাচীন কালে তাকেই ‘যোগ’ নামে অভিহিত করার প্রথা ছিলো। কৌটিল্যর রচনাতেও যোগ শব্দ এই প্রাচীন অর্থেই ব্যবহৃত। অতএব সিদ্ধান্ত হয় যে, আন্বীক্ষিকী বা অনুমান-মূলক দর্শন বলতে শুধুমাত্র সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক অর্থে যোগ, এবং লোকায়ত।

এ-প্রসঙ্গে আমাদের বর্তমান আলোচনার মূল যে লক্ষ্য– চার্বাক বা লোকায়ত মতে অনুমান-মাত্রই অগ্রাহ্য কিনা– ‘অর্থশাস্ত্র’র উক্তি থেকে এর চূড়ান্ত উত্তর অনুসন্ধান। সে-ক্ষেত্রে চরম উত্তরটি হলো, অনুমান-মাত্রই অগ্রাহ্য করা তো দূরের কথা, ‘অর্থশাস্ত্র’র মতে মাত্র তিনটি দর্শনমত অনুমান-মূলক বা আন্বীক্ষিকী বলে স্বীকার্য, তার মধ্যে একটি হলো লোকায়ত। অতএব লোকায়তিকেরা সব রকম অনুমানই অস্বীকার করেছেন– পরবর্তীকালের এ-জাতীয় কথার সঙ্গে প্রাচীন নজিরের মিল হয় না।

কিন্তু এ-প্রসঙ্গে আরেকটি কৌতুহলের বিষয় হলো, কৌটিল্য শুধুমাত্র তিনটি মতকে প্রকৃত দর্শনের মর্যাদা দিয়েছেন, তার মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন, পূর্ব-মীমাংসা এবং বেদান্তর মতো প্রভাবশালী দর্শনের উল্লেখ নেই কেন?
এ-প্রেক্ষিতে প্রখ্যাত বিদ্বান গবেষক জ্যাকবির অনুমান হলো, কৌটিল্য বা চাণক্যের মতো প্রখ্যাত ব্রাহ্মণের পক্ষে বৌদ্ধ ও জৈন মতকে প্রকৃত দার্শনিক মতের মর্যাদা না দেবারই কথা। কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে জ্যাকবির এই অনুমান সহজে মানা যায় না। কেননা ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের ফলে কৌটিল্যর পক্ষে লোকায়তমতই সর্বপ্রথম অবজ্ঞা করার কথা এবং পূর্বমীমাংসা ও বেদান্তর মতো প্রভাবশালী মতের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাপ্রদর্শনই স্বাভাবিক। অতএব, জ্যাকবির মন্তব্য গ্রহণ না-করে বরং মনে করা যেতে পারে যে, কৌটিল্যের সময় বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রভাব তুলনায় সীমাবদ্ধ ছিলো; অন্তত প্রভাবশালী দার্শনিক হিসেবে কৌটিল্যপূর্ব কোনো প্রখ্যাত বৌদ্ধ বা জৈন মতের সমর্থক ঐতিহাসিকভাবে আবির্ভূত হননি– কিংবা হলেও তাঁদের কথা কৌটিল্যের জানা ছিলো না। তবে কেবল ধারণাগত মতাদর্শ থেকে বৌদ্ধ ও জৈন মতকে যাঁরা দার্শনিক প্রস্থান হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ করেছেন ভারতীয় দর্শনেতিহাসে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে কৌটিল্যর সময়কালের পরেই। মহারাজ অশোকের পর– অর্থাৎ কৌটিল্যর পরে– নাগার্জুনের মতো বৌদ্ধ বা উমাস্বাতির মতো প্রখ্যাত জৈন দার্শনিকদের পরিচয় পাওয়া যায়।

কিন্তু কৌটিল্যের লেখায় পূর্বমীমাংসা ও বেদান্তের উল্লেখ নেই কেন? পূর্বমীমাংসার আকরগ্রন্থ জৈমিনির ‘মীমাংসাসূত্র’ এবং বেদান্তর আকরগ্রন্থ বাদরায়ণের ‘ব্রহ্মসূত্র’র রচনাকাল সংক্রান্ত সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত সম্ভব না-হলেও ভারতীয় দর্শন-জগতে এ-বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, পূর্বমীমাংসা ও বেদান্ত দর্শন সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক (‘যোগ’) এবং লোকায়ত দর্শনের পূর্ববর্তী। অতএব দার্শনিক মত হিসেবে শুধু এই তিনটি উল্লেখ করেও কৌটিল্য কেন পূর্বমীমাংসা ও বেদান্ত সম্বন্ধে নীরব? প্রশ্নটি নিশ্চয়ই উপেক্ষা করার মতো নয়। কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে, কৌটিল্যের পুরো উক্তির সঙ্গে পূর্বমীমাংসা ও বেদান্তদর্শনের মূল দাবি মিলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন নয়। কেননা–
পূর্বমীমাংসকদের মূল দাবি কোনো স্বতন্ত্র বা স্বাধীন দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নয়। তার বদলে পূর্বমীমাংসা বেদেরই কর্মকাণ্ডের রূপায়ণ। তেমনি বেদান্তও কোনো স্বাধীন দার্শনিক মত নয় : বেদেরই জ্ঞানকাণ্ড বা উপনিষদ-উক্ত দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়সাধন। অর্থাৎ, সংক্ষেপে, এই দুটি দর্শনের স্বীয় দাবিই হল, এগুলি বেদ ছাড়া আর কিছুই নয়– বেদেরই তাৎপর্য ব্যাখ্যা। অতএব, কৌটিল্য-উক্ত বিদ্যার তালিকায় ‘ত্রয়ী’ বা বেদ ছাড়াও দর্শন হিসাবে পূর্বমীমাংসা এবং বেদান্তের উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন : উভয় দর্শনেরই সারাংশ ‘ত্রয়ী’-রই অন্তর্ভুক্ত।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৬১)

এখানে উল্লেখ্য, ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্যের বর্ণনায় প্রাচীনকালের মতাদর্শগত একটা বিতর্কেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কৌটিল্যর স্বীয় মতে বিদ্যা বলতে চার রকম। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, প্রাচীনেরা সকলেই এ-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত নন। এ প্রসঙ্গে তিনি মতান্তরগুলিও উল্লেখ করেছেন। যেমন, উদাহরণস্বরূপ, মানব বা মনু-র অনুগামীদের মত বর্ণনায় কৌটিল্য বলছেন, মনুর অনুগামীদের মতে বিদ্যা বলতে শুধুমাত্র তিনটি– ত্রয়ী, দণ্ডনীতি এবং বার্তা; আন্বীক্ষিকীকে স্বতন্ত্র বিদ্যা বলে মানার কোনো কারণ নেই, কেননা তা ত্রয়ীবিশেষই বা ত্রয়ীরই অন্তর্ভুক্ত।

তবে এখানে মনু নামে কৌটিল্য যাঁর উল্লেখ করেছেন তিনিই ‘মনুস্মৃতি’-কার কিনা– এ-বিষয়ে আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কিছু বিতর্ক রয়েছে। কারো কারো মতে, এখানে ‘মানব’ বা মনুর অনুগামী বলতে ‘মনুস্মৃতি’র অনুগামীদের বোঝা যুক্তিযুক্ত হবে না। কেননা, ‘মনুস্মৃতি’তে আন্বীক্ষিকী (বা নামান্তরে হেতুবিদ্যা, তর্কবিদ্যা) অবজ্ঞা করার উপদেশ নেই; বরং স্বীকৃতিই চোখে পড়ে। যেমন–
ত্রৈবিদ্যেভ্যস্ত্রয়ীং বিদ্যাদ্ দণ্ডনীতিঞ্চ শাশ্বতীম্ ।
আন্বীক্ষিকীঞ্চাত্মবিদ্যাং বার্তারম্ভাংশ্চ লোকতঃ।। (মনুসংহিতা-৭/৪৩)।
অর্থাৎ : রাজা ত্রিবেদবেত্তা দ্বিজাতিদের কাছ থেকে ঋগ্-যজুঃ-সাম এই বেদত্রয় আয়ত্ত করবেন। পরম্পরাগত দণ্ডনীতি অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র– যা চিরকাল বিদ্যমান আছে এমন রাজনীতিশাস্ত্র– রাজনীতিবিদ ব্যক্তিদের কাছে অধ্যয়ন করবেন। আন্বীক্ষিকী বা তর্কশাস্ত্র এবং আত্মবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা এবং বার্তা অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যপশুপালনাদি জ্ঞান সেই সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের কাছে শিক্ষা করবেন।

কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে এই মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, ‘মনুস্মৃতি’-তে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, শ্রুতি (বেদ) এবং স্মৃতি (ধর্মশাস্ত্র) চরম প্রমাণ; এমনকি কোনো দ্বিজও যদি হেতুশাস্ত্র অবলম্বন করে শ্রুতি-স্মৃতিতে কোনো সংশয় প্রকাশ করে তাহলে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাকে একেবারে দূর করে দেবেন। যেমন–
শ্রুতিস্তু বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্মশাস্ত্রস্তু বৈ স্মৃতিঃ।
তে সর্বার্থেষ্বমীমাংস্যে তাভ্যাং ধর্মো হি নির্বভৌ।। (মনুসংহিতা-২/১০)।
অর্থাৎ : ‘বেদ’ বলতে ‘শ্রুতি’ বোঝায় এবং ‘ধর্মশাস্ত্রের’ নাম ‘স্মৃতি’। সকল বিষয়েই (অর্থাৎ সকল রকম বিধি-নিষেধের স্থানে) এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত, কারণ, শ্রুতি ও স্মৃতি থেকেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছে।
.
যোহবমন্যেত তে মূলে হেতুশাস্ত্রাশ্রয়াদ্ দ্বিজঃ।
স সাধুভি র্বহিষ্কার্যো নাস্তিকো বেদনিন্দকঃ।। (মনুসংহিতা-২/১১)।।
অর্থাৎ : যে দ্বিজ হেতুশাস্ত্র অর্থাৎ অসৎ-তর্ককে অবলম্বন করে ধর্মের মূলস্বরূপ এই শাস্ত্রদ্বয়ের (শ্রুতি ও স্মৃতির) প্রাধান্য অস্বীকার করে (বা অনাদর করে), সাধু ব্যক্তিদের কর্তব্য হবে– তাকে সকল কর্তব্য কর্ম এবং সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করা (অর্থাৎ অপাংক্তেয় করে রাখা)। কারণ, সেই ব্যক্তি বেদের নিন্দাকারী, অতএব নাস্তিক।

মনুর এই ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী? এমন মন্তব্য করা মনে হয় অস্বাভাবিক হবে না যে, হেতুশাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধাই মনুর মতে বেদনিন্দা বা নাস্তিকতার উৎস। কেননা মনুর মতে হেতুশাস্ত্রের কাজ হলো শ্রুতি ও স্মৃতিকে বেদবিহিতরূপে প্রমাণ ও ব্যাখ্যা করা। এ হৈতুক যে বেদ-সমালোচক নয় বরং বেদ বা শ্রুতিকে প্রমাণ গণ্য করা হেতুবিদ, তা বোঝা যায় মনুর অন্য শ্লোকে–
ধর্মেণাধিগতো যৈস্তু বেদঃ সপরিবৃংহণঃ।
তে শিষ্টা ব্রাহ্মণা জ্ঞেয়াঃ শ্রুতিপ্রত্যক্ষহেতবঃ।। (মনুসংহিতা: ১২/১০৯)।।
অর্থাৎ : ব্রহ্মচর্যাদি ধর্মযুক্ত হয়ে যাঁরা ‘সপরিবৃংহণ বেদ’ অর্থাৎ বেদাঙ্গ, মীমাংসা, ইতিহাস ও পুরাণাদির দ্বারা পরিপুষ্ট বেদশাস্ত্র বিধিপূর্বক আয়ত্ত করেছেন সেই ব্রাহ্মণকে শিষ্ট বলে বুঝতে হবে; শ্রুতিই তাঁদের নিকট প্রত্যক্ষস্বরূপ এবং হেতুস্বরূপ অর্থাৎ অনুমানাদি অন্যান্য প্রমাণস্বরূপ।

আর হেতুশাস্ত্রকে যারা বেদ-বিরোধী বা বেদের সমালোচনায় নিযুক্ত করেন, মনু হয়তো বলতে চান যে ওই হৈতুকরাই হেতুশাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান। সেইসব হৈতুকই মনুর মতে পরিত্যাজ্য। এ কারণেই মনুশান্ত্রে এই বেদবিরোধী তর্কমূলক শাস্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা উচ্চারিত হয়–
যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুদৃষ্টয়ঃ।
সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাঃ স্মৃতাঃ।। (মনুসংহিতা-১২/৯৫)।।
অর্থাৎ : বেদবাহ্য অর্থাৎ বেদবিরুদ্ধ যে সব স্মৃতি আছে এবং যে সব শাস্ত্র কুদৃষ্টিমূলক অর্থাৎ অসৎ-তর্কযুক্ত মতবাদসমূহ যে শাস্ত্রে আছে, সেগুলি শেষ পর্যন্ত একেবারে প্রেত্য বা নিষ্ফল অর্থাৎ বৃথা বা অকিঞ্চিৎকর বলে প্রতিভাত হয় এবং সেগুলি তমোনিষ্ঠ বলে স্মৃত হয়ে থাকে।

তার মানে, শাস্ত্রবিশ্বাসে অবিচল থেকে শাস্ত্রকে হেতুস্বরূপ ব্যবহারে নিয়োজিত রাখাটাই মনুর মতে অনুমোদিত হেতুশাস্ত্র। তাকে অশ্রদ্ধা দেখানো চলে না। অশ্রদ্ধা দেখিয়ে হেতুশাস্ত্রকে যারা তার বিপরীতে ব্যবহার করেন তারা হচ্ছেন নিন্দিত হৈতুক, হেতুশাস্ত্রপরায়ণ বা তার্কিক।  কিন্তু কাদের মধ্যে এ-হেন হেতুশাস্ত্রের প্রতি অশ্রদ্ধা? এর ব্যাখ্যায় মেধাতিথি, কুল্লুকভট্ট প্রমুখ টীকাকার চার্বাক প্রভৃতির উল্লেখ করেছেন। যেমন, মনুসংহিতার ভাষ্যকার মেধাতিথির মতে হৈতুক অর্থ হচ্ছে–
হৈতুকা নাস্তিকা নাস্তি পরলোকো, নাস্তি দত্তম্, নাস্তি হুতমিত্যেবং স্থিতপ্রজ্ঞাঃ।
অর্থাৎ : নাস্তিক অর্থাৎ যারা এই রকম দৃঢ়নিশ্চয় করে যে, পরলোক নেই, দানেরও কোনও ফল নেই, হোম করারও কোনও ফল নেই, তারাই হৈতুক।
আবার মনুসংহিতার অপর ভাষ্যকার কুল্লুকভট্টের মতে হৈতুক হলো–
হৈতুকা বেদবিরোধিতর্ক ব্যবহারিণঃ।
অর্থাৎ : হৈতুক হচ্ছে বেদবিরুদ্ধ তর্কপরায়ণ।

চার্বাকেরা যে বেদনিন্দক নাস্তিক ছিলেন, একথা অবশ্যই সুবিদিত। কিন্তু কুল্লুকভট্টর বাখ্যা স্বীকার করলে মানতে হয়, তার আসল কারণ চার্বাকদের হেতুশাস্ত্র-পরায়ণতা। আর অবশ্যই অনুমানকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে হেতুশাস্ত্র-পরায়ণতার কথা ওঠে না। অতএব, দেবীপ্রসাদের মতে, মনু ও কুল্লুকের কথা মানলে– চার্বাকেরা ঐকান্তিক অর্থে অনুমান অস্বীকার করেছেন– এজাতীয় মাধবাচার্য প্রভৃতির দাবির বিরুদ্ধে যায়।

অতএব, দেবীপ্রসাদ-প্রযুক্ত ‘মনুস্মৃতি’র এজাতীয় নজিরগুলি মনে রেখে ‘অর্থশাস্ত্রে’ কৌটিল্যর বক্তব্যের বিশ্লেষণ করা যাক। কৌটিল্য বলছেন, তাঁর স্বীয় মতে (রাজার শিক্ষণীয়) বিদ্যা বলতে চার রকম হলেও ‘মানব’ বা মনুর অনুগামীরা তা মানেন না; তাঁদের মতে আন্বীক্ষিকীর কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই, তা ত্রয়ীর অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে তাহলে কৌটিল্যের কথা এবং মনুর কথা কি এক হয়? কৌটিল্য আন্বীক্ষিকী বলতে স্বাধীন যুক্তিবিদ্যা বা তর্কবিদ্যার কথাই বলেছেন। কিন্তু ‘মনুস্মৃতি’র মতে কেবল আন্বীক্ষিকী অবশ্য পরিত্যাজ্য; শুধুমাত্র শাস্ত্রানুগামী– বা বেদান্ত অনুগামী– অর্থে আন্বীক্ষিকীর কিছুটা মূল্য আছে, কেননা তা আত্মবিদ্যা বা অধ্যাত্মবিদ্যা বোঝবার পক্ষে সহায়ক হতে পারে।
এবং আন্বীক্ষিকী অর্থে কৌটিল্য শুধুমাত্র যে-তিনটি দার্শনিক মত স্বীকার করেছেন তার মধ্যে লোকায়ত বলতে যে পরবর্তীকালের নামান্তরে চার্বাক দর্শনই বোঝায়, ভারতীয় দার্শনিক ঐতিহ্য স্বীকার করলে তা বোধকরি অস্বীকার করা যায় না।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال