চার্বাকমত-সম্পর্কে জয়ন্তভট্টর বক্তব্য প্রসঙ্গে

চার্বাকমত-সম্পর্কে জয়ন্তভট্টর বক্তব্য প্রসঙ্গে

ইতঃপূর্বে প্রত্যক্ষ-প্রমাণের আলোচনায় প্রখ্যাত নৈয়ায়িক জয়ন্তভট্টের বক্তব্য প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে। এবং এটাও বলা হয়েছে যে, চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তভট্টর প্রকৃত বক্তব্য নির্ণয় করার বেশ কিছুটা সমস্যা রয়েছে। কেননা তিনি তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থের একেক স্থানে একেকবার চার্বাক প্রসঙ্গে একেক ধরনের পরস্পর অসঙ্গত বক্তব্য দিয়েছেন, যা থেকে চার্বাকমত প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ-প্রমাণ বিষয়ক কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন।
যেমন ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে তার পরম্পরাহীন বক্তব্যগুলি ছিলো–
‘তথাহি প্রত্যক্ষং এব একং প্রমাণম্ ইতি চার্বাকাঃ।’ (ন্যায়মঞ্জরী : ১/২৬)।
অর্থাৎ : চার্বাকরা বলেন, প্রত্যক্ষই এক এবং একমাত্র প্রমাণ।
.
‘চার্বাকধূর্তঃ তু অথ অতঃ তত্ত্বং ব্যাখ্যাস্যামঃ ইতি প্রতিজ্ঞায় প্রমাণ-প্রমেয়-সংখ্যা-লক্ষণ-নিয়ম-অশক্য-করণীয়ত্বম্ এব তত্ত্বং ব্যাখ্যাতবান্’। (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৫৯)।
অর্থাৎ : ধূর্ত চার্বাক কিন্তু প্রতিজ্ঞা করলো- এবার আমরা তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো; কিন্তু ‘তত্ত্ব ব্যাখ্যা করবো’ বলে চার্বাক আসলে দেখাতে চাইলো যে প্রমাণ ও প্রমেয়র সংখ্যা ও লক্ষণ সংক্রান্ত কোনো নিয়মই সম্ভব নয়।
.
‘অশক্য এব প্রমাণসংখ্যানিয়ম ইতি সুশিক্ষিত চার্বাকাঃ।’ (ন্যায়মঞ্জরী : ১/৩৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিত চার্বাকদের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম করা সম্ভব নয়।

বলা বাহুল্য, সাধারণ পাঠকের পক্ষে চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্তর এই বিভিন্ন ধরনের বর্ণনার মধ্যে সংগতিসাধন সহজসাধ্য হবার কথা নয়। একই সঙ্গে কী করে বলা যায় যে চার্বাকেরা প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মনে করতেন এবং তাঁরা কোনো প্রমাণই মানতেন না; প্রত্যক্ষও তাঁদের কাছে সংশয়াতীত নয়! এবং আবার এও বলেন যে ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’দের মতে প্রমাণের সংখ্যা সম্বন্ধে কোনো নিয়ম মানা যায় না। এই মতে প্রমাণের সংখ্যা অসংখ্য, না কি প্রমাণ বলেই কিছু নেই, জয়ন্তর উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে আসলে কিছু বোঝারই উপায় নেই।

তাছাড়া অনুমানের বিরোধিতা প্রসঙ্গেও চার্বাক পক্ষের উক্তি নিয়ে জয়ন্তভট্ট ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনা অনেকটাই মাধবাচার্যের বর্ণনার অনুরূপ বলে মনে হয়। জয়ন্তভট্ট বলছেন, ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তি ভূয়োদর্শন, অর্থাৎ অসংখ্য ক্ষেত্রে সাধনকে সাধ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখা। চার্বাকপন্থীরা বলেন যে এই পরিবর্তনশীল জগতে দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুপ্রকৃতিও নিয়ত পরিবর্তনের অপেক্ষা রাখে। এই পরিবর্তনের পটভূমিকায় বিশেষ কোন ধর্ম বস্তুবিশেষের সঙ্গে সব অবস্থাতেই যুক্ত থাকতে বাধ্য, এটা আশা করা যায় না। কাজেই–
‘দেশকালদশাভেদবিচিত্রাত্মসু বস্তুষু অবিনাভাবনিয়মো ন শক্যা বস্তুমাহ চ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : দেশ, কাল ও পরিবেশের বিভিন্নতা অনুযায়ী বস্তুপ্রকৃতির নিয়ত পরিবর্তনের কারণে ভূয়োদর্শনের মাধ্যমে লব্ধ বিশেষ দ্রব্য এবং ধর্মের পরস্পর উপাধিমুক্ত সম্বন্ধ বা অবিনাভাবের সিদ্ধান্ত সঠিক হওয়া সম্ভব নয়। (মুক্ততর্জমা)

অসংখ্য ক্ষেত্রে সাধন এবং সাধ্যের একত্র অবস্থান যদিও দেখা যায়, তাহলেও এর থেকে আমরা চিরকালীন সত্য কোন ব্যাপ্তিজ্ঞানের আশা করতে পারি না; কারণ অতীতে যে অবিনাভাব দেখা গেছে, ভবিষ্যতে তার ব্যতিক্রম হবে না, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। ‘ন্যায়মঞ্জরী’র উক্তিতে বলা হয়েছে যে,–
‘বিশ্বের সমস্ত বস্তু যদি কোন ব্যক্তির প্রত্যক্ষগোচরে আনা সম্ভব হতো তাহলে সেই ব্যক্তি তাঁর বিশেষ শক্তির সাহায্যে হয়তো বলতে পারতেন সাধন বা ধূম সাধ্য বা অগ্নির সঙ্গে সব ক্ষেত্রেই প্রকৃতই যুক্ত কিনা। কিন্তু এই ধরনের শক্তিমান ব্যক্তির পক্ষে অনুমান এবং অনুমানের ভিত্তি ব্যাপ্তিজ্ঞান– দুইই নিষ্প্রয়োজন’- (‘ন প্রত্যক্ষাকৃতা যাবৎ……এষামনুমানপ্রয়োজনম্’)।

সর্বশেষ বাক্যে জয়ন্তভট্টে শ্লেষটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। জয়ন্তভট্টর লেখার কায়দাটাই ওই রকম রকমারি শ্লেষ বা ঠাট্টা-তামাসায় ঠাসা। তবে বোঝাই যায়, নিয়ত ব্যাপ্তি-সম্বন্ধ সম্ভব নয় বলে চার্বাকরা কোন অনুমানকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেন না– এই ব্যাখ্যারই দীর্ঘ আয়োজন করা হয়েছে।
আবার ব্যাপ্তিজ্ঞানের সমর্থকদের মতে ধূমের অগ্নিব্যাপ্যতা প্রমাণ করতে হলে ধূমের সঙ্গে অগ্নির সহাবস্থানের প্রতিটি ঘটনা লক্ষ্য করার প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন কেবল ‘ধূমত্ব’ এবং ‘অগ্নিত্ব’ এই দুটি সামান্যের মধ্যে কার্যকারণভাবে বিশ্বাস। ব্যাপ্তিগ্রহণ প্রকৃতপক্ষে ধূম ও অগ্নিসম্বন্ধীয় এই ‘সামান্য’কে কেন্দ্র করে। ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে জয়ন্তভট্টের আলোচনার মধ্যে ব্যাপ্তি শব্দের এই ধরনের অর্থ সূচিত হয়। তবে চার্বাকী ধারণায় কিন্তু এই সামান্যের কোন স্বীকৃতি নেই এবং ফলে সামান্যদ্বারক কার্যকারণভাবও এই দর্শন মতে অনিশ্চয়তার দোষে দুষ্ট– জয়ন্তের বর্ণনায় এসব দার্শনিক কূটযুক্তির ভিতরে প্রবেশ করার প্রয়োজন আমাদের নেই। মোটের উপর জয়ন্তের বক্তব্য থেকে চার্বাক-মত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা চয়ন ব্যাপক সমস্যাপূর্ণ বলে মনে হয়।

‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ গ্রন্থে (ন্যায়কুসুমাঞ্জলি-৩/৫,৬) উদয়নাচার্য বলেন,– চার্বাকী যুক্তির দ্বারা প্রভাবিত মানুষ যদি প্রত্যক্ষ বহির্ভূত সব বস্তুকে অস্বীকৃতি দেয় তাহলে ব্যবহারিক জীবনে অগ্রসর হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। জয়ন্তভট্টও অনুরূপ মন্তব্যে তাঁর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে বলেন–
‘অনুমানাপলাপ তু প্রত্যক্ষাদপি দুর্লভা। লোকযাত্রেতি লোকাঃ স্যুর্লিখিতা ইব নিশ্চলাঃ’। (ন্যায়মঞ্জরী)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষ বহির্ভূত সব অনুমানই যদি অপলাপ হয়, ব্যবহারিক জীবনে লোকযাত্রা নিশ্চল হতে আর বাকি কী।
এরপর চার্বাক মতবাদের খণ্ডনে জয়ন্তভট্ট তাঁর স্বভাবসুলভ বিদ্রূপাত্মক হেঁয়ালিপূর্ণ উক্তিতে বলেন,–
স্বামীর গৃহে অনুপস্থিতিকালে চার্বাক-পত্নী বিধবা হন, কারণ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষের মাধ্যমে গৃহবহির্ভূত চার্বাকের বর্তমানতাকে স্বীকার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।
উক্তিটি নিছক পরিহাসধর্মী হলেও ব্যবহারিক জীবনের গতিপথে বিশুদ্ধ চার্বাক-পন্থীরা যে ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে পারেন, এর মধ্যে তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাই প্রশ্ন হলো, সত্যি কি চার্বাকেরা কোন ক্ষেত্রেই– সীমিত আকারে হলেও– অনুমানকে স্বীকার করতেন না?

কিন্তু জয়ন্তর-উক্ত ‘সুশিক্ষিত চার্বাক’ নিয়ে আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে বেশ একটু শোরগোল পড়ে যখন দেখা যায় একই গ্রন্থ ‘ন্যায়মঞ্জরী’র আরেক জায়গায় তিনি বলেন–
‘সুশিক্ষিততরাঃ প্রাহুঃ… যত্ত্বাত্মেশ্বরসর্বজ্ঞপরলোকাদিগোচরম্ । অনুমানং ন তস্যেষ্টং প্রামাণ্যং তত্ত্বদর্শিভিঃ।’ (ন্যায়মঞ্জরী: ১/১১৩)।
অর্থাৎ : সুশিক্ষিততররা বলে থাকেন– অনুমান দু-রকম, উৎপন্ন-প্রতীতি এবং উৎপাদ্য-প্রতীতি। ধূম প্রভৃতি থেকে বহ্নি প্রভৃতির অনুমান কে অস্বীকার করে? এসব দ্বারা তার্কিক দ্বারা অক্ষত ব্যক্তিরাও সাধ্য-কে জানতে পারে। তবে আত্মা, সর্বজ্ঞ, ঈশ্বর, পরলোক ইত্যাদি বিষয়ে যে-অনুমানের কথা বলা হয় সেগুলির প্রামাণ্য তত্ত্বদর্শীরা স্বীকার করেন না। এইসব অনুমানের দ্বারা সোজা মানুষের অনুমেয় বিষয়ে জ্ঞান হয় না– অবশ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মন দুষ্ট তার্কিকদের দ্বারা কুটিল হয়ে ওঠে।

একে তো ন্যায়শাস্ত্রের জটিল পরিভাষা, তার উপরে জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্যপূর্ণ শ্লেষ বা ঠাট্টা-তামাশায় ঠাসা বক্তব্যের তীর্যক কায়দা থেকে সহজ-সরল অর্থ উদ্ধার করা চাট্টিখানি কথা নয়। এক্ষেত্রে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জয়ন্তর এ বক্তব্যকে আমাদের বোধগম্য করে সোজা ভাষায় উদ্ধৃত করেছেন এভাবে–
‘জয়ন্ত বলছেন, সুশিক্ষিততরদের মতে প্রত্যক্ষগোচর ইহলোক বিষয়ে সাধারণ লোক যা অনুমান করে থাকে তা অবশ্যই স্বীকার্য : যেমন ধূম থেকে বহ্নির অনুমান। কিন্তু আত্মা, পরলোক প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে কূট তার্কিকেরা যে-সব অনুমান প্রদর্শন করেন তা শুধু তাঁদের কূটবুদ্ধিরই পরিচায়ক, স্বীকারযোগ্য অনুমান হতে পারে না।’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় : ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৫)।

‘সুশিক্ষিততর’-দের মত হিসেবে জয়ন্ত এখানে যা বলেছেন তা অবশ্যই পুরন্দরের কথাই মনে করিয়ে দেয়। বক্তব্যের প্রকাশভঙ্গি যেরকমই হোক, মূল বক্তব্য আসলে একই। এবং পুরন্দর যে প্রকৃত চার্বাকপন্থীই ছিলেন এ বিষয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে তার একাধিক নজির রয়েছে। কিন্তু, দেবীপ্রসাদের মন্তব্য অনুসারে–
‘সুশিক্ষিততর’ বিশেষণ দিয়ে জয়ন্ত যাঁদের কথা বলছেন তাঁরাও যে চার্বাকপন্থী ছিলেন– এ বিষয়ে কোথাও নিশ্চিত নজির নেই; অন্তত জয়ন্তর ‘ন্যায়মঞ্জরী’তে নয়। তাঁর আলোচ্য উক্তির আগে বা পরে কোথাওই চার্বাক বা লোকায়ত শব্দ চোখে পড়ে না। উক্তিটি অবশ্য পূর্বপক্ষ বর্ণনার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু পূর্বপক্ষ হিসাবে এখানে ঠিক কাকে বা কাদের বোঝা হবে? জয়ন্ত যেহেতু এখানে এমনকি আভাসে-ইংগিতেও চার্বাকের উল্লেখ করেননি সেইহেতু এখানেও পূর্বপক্ষ বলতে ঐ চার্বাকই– এমনতর কথা কল্পনা করা ভিত্তিহীন হবে। পক্ষান্তরে, মৃণালকান্তি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে (Indian Logic in Its Sources, pp-31 f.) স্পষ্টই দেখিয়েছেন যে, জয়ন্তর আলোচ্য পূর্বপক্ষ-বর্ণনাটির মধ্যে অনেকগুলি শ্লোক ভর্তৃহরির ‘বাক্যপদীয়’তেও পাওয়া যায়– একেবারে হুবহু একইভাবে পাওয়া যায়। ভর্তৃহরিকে চার্বাপন্থী মনে করার কারণ নেই। তাই শুধুমাত্র শ্লোকগুলির নজির থেকেই বলা যায় যে ‘সুশিক্ষিততরাঃ’ বলে এখানে জয়ন্ত যাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের সরাসরি চার্বাক বলে কল্পনা করা নিরাপদ নয়।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৬)

আধুনিক বিদ্বানদের অনেকেই অতি-সারল্যের পরিচয় দিয়ে নির্বিবাদে ধরে নেন যে, জয়ন্তর লেখা থেকেই বোঝা যায়, চার্বাকদের দুটি সম্প্রদায় ছিলো। একটি হলো ধূর্ত চার্বাক এবং অপরটি হলো সুশিক্ষিত চার্বাক। তাঁরা আরো ধরে নেন যে, দুটির মধ্যে মূল প্রভেদ হলো, ধূর্ত চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোন প্রমাণ মানেননি; আর সুশিক্ষিত চার্বাকেরা অবশ্য তা ছাড়াও লোকপ্রসিদ্ধ ও প্রত্যক্ষগ্রাহ্য বিষয়ে অনুমান-প্রমাণ মেনেছেন, শুধু অপ্রত্যক্ষ লোকোত্তর বিষয়ে অনুমান অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁদের এ-জাতীয় মতের পক্ষে একমাত্র নজির বলতে জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’। কেননা, জয়ন্ত চার্বাকদের বিশেষণ হিসেবে এক জায়গায় ‘ধূর্ত’ এবং অপর জায়গায় ‘সুশিক্ষিত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া ধরেই নেয়া হয় যে ‘সুশিক্ষিততরাঃ’ বলে জয়ন্ত যাঁদের উল্লেখ করেছেন তাঁরা ঐ সুশিক্ষিত চার্বাকই।
কিন্তু এই মত স্বীকার করায় অনেক বাধা আছে বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। তাঁর মতে,–
প্রথমত, বিদ্বেষমূলক বিশেষণ ব্যবহারে পটু জয়ন্ত একই গ্রন্থে চার্বাককে ‘বরাক’ বলেছেন। বরাক মানে বোকা-হাবা– ধূর্ত নয়। তাহলে কি এই নজির থেকেই চার্বাকদের আরো এক সম্প্রদায় কল্পনা করতে হবে? দ্বিতীয়ত, চার্বাক প্রসঙ্গে জয়ন্ত যেখানে ‘ধূর্ত’ বিশেষণ ব্যবহার করেছেন, সেখানে চার্বাক বলতে যে-সর্বপ্রমাণ-বিরোধী দার্শনিকদের কথা বর্ণনা করেছেন তাঁরা কোনমতেই চার্বাকমতবাদী হতে পারেন না। এমনকি জয়ন্তর মতেও তা হওয়া কঠিন। কেননা একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, চার্বাকরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে স্বীকার করেন। তাই জয়ন্তর টীকাকার চক্রধর এখানে মতটির সমর্থক হিসাবে উদ্ভট বলে কোন এক ব্যক্তির কথা কল্পনা করতে বাধ্য হয়েছেন। তৃতীয়ত, ‘সুশিক্ষিততরাঃ’ বলে জয়ন্ত যাঁদের কথা বলেছেন তাঁরা যে কোনো এক সম্প্রদায়ের চার্বাকপন্থী– এ কথার পক্ষে কোনো নিশ্চিত নজির নেই।

তাই চার্বাকদের বিষয়ে জয়ন্ত ভট্টের বিবিধ বিশেষণ প্রয়োগকে আদৌ কোন শ্রেণীভেদ হিসেবে গণ্য করা হবে কিনা তাও সতর্ক বিবেচনার বিষয়। কেননা,– শ্লেষাত্মক বিশেষণ ব্যবহারপূর্ণ রচনাকৌশলে রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে জয়ন্ত ভট্ট ‘সুশিক্ষিত’ শব্দটিকে ব্যাঙ্গাত্মক অর্থেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন বলে মনে হয়। এই শব্দটি শুধু চার্বাকদের বেলায়ই নয়, ন্যায়মঞ্জরীতে অন্যান্য দার্শনিকদের সমালোচনায়ও একইরকম ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন, একই গ্রন্থে (ন্যায়মঞ্জরী: ১/১৬১) ঠাট্টা করে তিনি মীমাংসক প্রাভাকরদের সম্বন্ধে এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন। আবার অন্যত্র (ন্যায়মঞ্জরী: ১/২৭৩) যে দার্শনিকেরা ‘সামান্য বা জাতি’ (Universal) মানেন না তাঁদেরও পরিহাস করে ‘সুশিক্ষিত’ বলেছেন। তাই জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ থেকে চার্বাকমতের শ্রেণীভেদ সম্বন্ধে কোনো সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন বলে বিদ্বান গবেষকদের অভিমত। ফলে পাণ্ডিত্য ও তর্কবিদ্যায় পারদর্শী ও সুপরিচিত চার্বাক গোষ্ঠির সাধারণ সংজ্ঞা হিসেবে সুশিক্ষিত শব্দের ব্যবহার অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। কিন্তু শুধু জয়ন্তর রচনার নজির দেখিয়ে চার্বাকদের ‘ধূর্ত’, ‘সুশিক্ষিত’ এসব নামের স্বতন্ত্র সম্প্রদায়ের কল্পনা করা আদৌ সমীচীন হবে না বলেই মনে হয়।

একইভাবে, জয়ন্তভট্টর ‘ন্যায়মঞ্জরী’ থেকে চার্বাকমত সম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, বিশেষত চার্বাকেরা অনুমান মানতেন কিনা এ-বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার চেষ্টা নিরাপদ নয়। অতএব এ-হেন কল্পনারও কোন সুযোগ নেই যে ধূর্ত চার্বাকেরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে মানতেন, কিন্তু সুশিক্ষিত চার্বাকেরা প্রত্যক্ষ ছাড়াও লোকপ্রসিদ্ধ ইহলৌকিক বিষয়ে অনুমানকে প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন। বরং পুরন্দরের প্রামাণ্য উক্তি থেকে এটা মনে হয় যে, দ্বিতীয় কথাটিই চার্বাকপন্থীদের প্রকৃত অভিপ্রেত; অর্থাৎ তাঁদের কাছে প্রত্যক্ষই প্রমাণশ্রেষ্ঠ হলেও প্রত্যক্ষর অনুগামী অনুমানকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করায় বাধা ছিলো না।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال