প্রত্যক্ষ-অনুগামী অনুমান
প্রত্যক্ষের পরেই প্রাধান্যের বিচারে ভারতীয় দর্শনে যে প্রমাণের অগ্রগামিতা সাধারণভাবে স্বীকার্য সেই অনুমানকেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তীব্রভাবে চার্বাকী আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর অনুমান প্রমাণ হিসেবে যাঁদের দ্বারা পূর্ণভাবে অনুমোদিত, প্রতি-আক্রমণে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরাও স্ব-স্ব মতবাদের ভিত্তিমূল দৃঢ় ও নিষ্কণ্টক করার মরিয়া প্রচেষ্টায় পশ্চাৎপদ হননি। অনুমান-প্রমাণকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দার্শনিকদের এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে প্রবেশের আগে দর্শনের পরিভাষায় অনুমানের লক্ষণ সম্বন্ধে কিছুটা প্রাথমিক পরিচয় সেরে নেয়া দরকার।
মহর্ষি গৌতমের ন্যায়সূত্রে প্রত্যক্ষলক্ষণের বর্ণনার পর অনুমানকে প্রত্যক্ষ-আশ্রিত বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে–
‘অথ তৎ পূর্বকম্ অনুমানম্’। (ন্যায়সূত্র-১/১/৫)।
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমিতিই অনুমান।
অনুমান প্রত্যক্ষের মতো স্বনির্ভর প্রমাণ নয়। ‘অনু’ শব্দের অর্থ ‘পশ্চাৎ’ এবং ‘মান’ অর্থ জ্ঞান। তার মানে, প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানের পর প্রত্যক্ষের মাধ্যমে সংগৃহীত উপকরণগুলির সাহায্যে নতুন জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয় এই অনুমান প্রমাণ।
ন্যায়বর্ণিত অনুমানের গঠন বোঝাতে সবচেয়ে প্রচলিত দৃষ্টান্ত হলো–
‘পর্বতো বহ্নিমান্ ধূমাৎ– যত্র যত্র ধূমোহস্তি তত্র তত্র অগ্নিঃ, যথা মহানসাদৌ।
অর্থাৎ : পর্বতে বহ্নি আছে যেহেতু পর্বতে আমরা ধোঁয়া প্রত্যক্ষ করছি। কারণ যেখানে যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে। যেমন রান্নাঘরের চুল্লি।
তার মানে, পর্বতে ধূম বা ধোঁয়ার অস্তিত্ব থেকে বহ্নি বা আগুনের অস্তিত্ব জানা গেলো। আগুনের এই অস্তিত্ব জানলাম অনুমান করে। অনুমানের ভিত্তি এখানে ধোঁয়া এবং আগুনের মধ্যে এক অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ, যে সম্বন্ধের অভিব্যক্তি ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে’ এই ভূয়োদর্শন-জনিত ধারণা। এ ধারণার উৎস আমাদের পুরাতন প্রত্যক্ষলব্ধ অভিজ্ঞতা, যথা– রান্নাঘর এবং অন্যান্য স্থানে ধোঁয়াকে সব সময়ে আগুনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতে দেখা গেছে।
এই অনুমানে তিনটি পদ আছে– ধূম, অগ্নি, পর্বত। ভারতীয় ন্যায়ের পরিভাষায় এখানে–
‘ধূম’ হলো ‘হেতু’ বা ‘লিঙ্গ’ বা ‘সাধন’
‘অগ্নি’ হলো ‘সাধ্য’
‘পর্বত হলো ‘পক্ষ’।
ধোঁয়া দেখে আগুনের অস্তিত্ব আমরা অনুমান করি; কাজেই ধোঁয়া এখানে আমাদের অনুমানলব্ধ জ্ঞানের ‘হেতু’, ‘সাধন’ বা ‘লিঙ্গ’। হেতুর সাহায্য নিয়ে যা অনুমান করা হয়– এ ক্ষেত্রে আগুন– ন্যায়ের পরিভাষায় তার নাম ‘সাধ্য’। যে স্থানে বা অধিকরণে সাধ্যের অস্তিত্ব স্থির করা হয় তার নাম ‘পক্ষ’। উপরের উদাহরণে পক্ষের ভূমিকা পর্বতের। কিন্তু ধূম (হেতু) থেকে পর্বতে (পক্ষতে) অগ্নির (সাধ্যের) অনুমান করা গেলো কী করে? কেননা হেতুর (ধূমের) সঙ্গে সাধ্যর (অগ্নির) নিয়ত-সম্বন্ধ জানা আছে এবং তার কোনো ব্যভিচার বা ব্যতিক্রম জানা নেই : যেখানেই ধূম সেখানেই আগুন, যেমন রান্নার চুল্লিতে; এবং জলাশয় প্রভৃতি অগ্নিহীন স্থানে ধূম কখনো দেখা যায় না। ‘সাধন’ বা ‘হেতু’র সঙ্গে ‘সাধ্য’র এই চিরকালীন বা নিয়ত এবং অব্যভিচারী সম্বন্ধকে ন্যায়ের ভাষায় বলা হয় ‘ব্যাপ্তি’ বা অবিনাভাব। ব্যাপ্তি হচ্ছে ব্যাভিচররহিত সম্বন্ধ। অতএব ‘ব্যাপ্তি’র ভিত্তিতেই অনুমান সম্ভব; ‘ব্যাপ্তি’ সম্ভব না-হলে অনুমানও অসম্ভব হবে।
অনুমানের ক্ষেত্রে ‘ব্যাপ্তি’র গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ অনুমানের প্রকৃত ভিত্তি হিসেবে এই ব্যাপ্তির জ্ঞানকেই নির্দেশ করা যেতে পারে। ‘যেখানে ধোঁয়া থাকে সেখানে আগুনও থাকে’– এই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে ভিত্তি করে আমরা ‘পক্ষ’ বা পর্বতের সঙ্গে ‘সাধ্য’ বা আগুনের যোগ সাধন করি। ধোঁয়া এখানে ‘সাধ্য’ এবং ‘পক্ষ’ উভয়েরই সাধারণ ধর্ম বা ‘লিঙ্গ’। ‘হেতু’ বা ‘লিঙ্গ’র সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে যুক্ত থাকার জন্য ‘সাধ্য’র অপর নাম ‘লিঙ্গী’।
প্রত্যক্ষজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে জ্ঞাত সত্য থেকে অজ্ঞাত সত্যে পৌঁছানোর যে পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া তাকে বলে অনুমান। অনুমানকে প্রত্যক্ষপূর্বক বলা হয়েছে, কারণ অনুমানগত জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রত্যক্ষের উপর আমাদের নানাভাবে নির্ভর করতে হয়। দৃষ্টি ও অনুভূত নিয়মকে ভিত্তি করে কোন অদৃষ্ট ও অননুভূত বস্তুর সত্তাকে আমরা অনুমান করি। উদাহরণে ধোঁয়াকে প্রত্যক্ষ করে তবেই ধোঁয়ার কারণ হিসেবে আগুনের সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়। নির্ভুল অনুমানের ভিত্তি যে লিঙ্গ এবং লিঙ্গীর অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধের জ্ঞান, সেই ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভের মূলেও আছে প্রত্যক্ষের কার্যকরিতা। অর্থাৎ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধোঁয়া এবং আগুন বা সাধন এবং সাধ্যের একত্র অবস্থানকে প্রত্যক্ষ করে তবেই এই ব্যাপ্তিজ্ঞানের ধারণা সম্ভব। ন্যায়সূত্রের ব্যাখ্যাকার বাৎস্যায়ন তাঁর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ তাই বলেন–
‘তৎপূর্ব্বকমিত্যনেন লিঙ্গলিঙ্গিনোঃ সম্বন্ধদর্শনং লিঙ্গদর্শনঞ্চাভিসম্বধ্যতে। (ন্যায়ভাষ্য-১/১/৫)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষপূর্বক অনুমিতিতে লিঙ্গ এবং লিঙ্গীর অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বা ব্যাপ্তিজ্ঞান নির্ণীত হয় পূর্বে কোন স্থানে লিঙ্গ ও লিঙ্গীর সম্বন্ধদর্শনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার (স্মৃতির) মাধ্যমে। (মুক্ততর্জমা)
এ-প্রেক্ষিতে অনুমান প্রমাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে ব্যাপ্তিজ্ঞানের সেই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই প্রধানত চার্বাকেরা অনুমানের প্রামাণ্যে সংশয় প্রকাশ করেছেন। যে ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তিতেই রচিত অনুমান প্রমাণের বিশাল সৌধ, চার্বাকেতর গ্রন্থগুলির বিভিন্ন নজির থেকেই অনুমান হয়, চার্বাকপক্ষের বিচারে এই ব্যাপ্তিজ্ঞানকে অভ্রান্ততার ছাড়পত্র পেতে নিশ্চয়ই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই প্রশ্নগুলির বিশ্লেষণমূলক সমাধানের মধ্যেই হয়তো সেই সিদ্ধান্তটাও নিহিত আছে যে, চার্বাকমত কি প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী অর্থাৎ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলে গণ্য করেন, না কি তাঁরা প্রত্যক্ষপ্রমাণবাদী তথা প্রত্যক্ষ ছাড়াও বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমানকেও প্রমাণ বলে স্বীকার করেন? এর সুরাহার জন্য নিরূপায় আমাদেরকে চার্বাকেতর দর্শন-সাহিত্যেরই আশ্রয় নিতে হবে।
Tags
চার্বাক দর্শন