মাধবাচার্য’র সর্বদর্শনসংগ্রহ ও চার্বাকের অনুমান খণ্ডন

মাধবাচার্য’র সর্বদর্শনসংগ্রহ ও চার্বাকের অনুমান খণ্ডন

মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থের চার্বাক-প্রস্থানে প্রমাণ সম্বন্ধে চার্বাকমত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন–
‘প্রত্যক্ষৈক-প্রমাণবাদিতয়া অনুমানাদেরনঙ্গীকারেণ প্রামাণ্যাভাবাৎ’। (সর্বদর্শনসংগ্রহ)
অর্থাৎ : প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদিত্ব হেতু অর্থাৎ একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলেন বলিয়া, অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ অস্বীকার করেন বলিয়া দেহাতিরিক্ত আত্মাতে অনুমান প্রভৃতি প্রমাণ নহে।
তার মানে, মাধবাচার্য বলতে চান যে, চার্বাকরা শুধুমাত্র প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলে মানেন; অতএব তাঁদের মতে অনুমানের প্রামাণ্য নেই, বা সোজা কথায়, অনুমান বলে কোন প্রমাণ হয় না।
এক্ষেত্রে মাধবাচার্য চার্বাকদের অনুমান-বর্জনের বর্ণনায় তাঁদেরকে অত্যন্ত কূটতর্কপ্রবণ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে প্রসঙ্গক্রমে মাধবাচার্যের লেখার কায়দাটা সম্পর্কে বলে রাখা দরকার যে, বিপক্ষ-বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি এমনভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করেন যেন তিনি সাময়িকভাবে বিপক্ষ অবলম্বন করেছেন; অর্থাৎ তিনি নিজে যদি চার্বাক-মতানুগামী হতেন তাহলে কোন্ ধরনের বিচার করে ঐ বিপক্ষ সমর্থন করতেন যেন তারই পরিচয় দিয়েছেন। চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডনের বর্ণনায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মাধবাচার্য বলছেন–
‘তদেতদ্ মনোরাজ্য-বিজৃম্ভণম্ । ব্যাপ্তি-পক্ষধর্মতা-শালি হি লিঙ্গম্ গমকম্ অভ্যুপগতম্ অনুমান-প্রামাণ্য-বাদিভিঃ। ব্যাপ্তিশ্চ উভয়বিধোপাধি-বিধুরঃ সম্বন্ধঃ।’ (সর্বদর্শনসংগ্রহ-চার্বাকপ্রস্থান)
অর্থাৎ :
আপনার সেই এই কথাটি তো মনোরাজ্যের বিজৃম্ভণ। অনুমান-প্রামাণ্যবাদীগণ কর্তৃক ব্যাপ্তি ও পক্ষধর্মতা-বিশিষ্ট হেতুই গমক বা জ্ঞাপক (জ্ঞান-জনক) বলে স্বীকৃত হয়েছে। শঙ্কিত ও নিশ্চিত উপাধিদ্বয়-রহিত সামানাধিকরণ্য সম্বন্ধই ব্যাপ্তি।

এই জটিল দার্শনিক-ভাষা বোঝা সাধারণের কর্ম নয়। তবে এই কথাগুলোকে সহজবোধ্যভাবে বিশ্লেষণ করে বললে, মাধবাচার্য বলছেন, চার্বাক-মতে ‘ব্যাপ্তি’ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব, অতএব অনুমানও সম্ভব নয়। ‘ব্যাপ্তি’ অসম্ভব কেন? কেননা, ‘ব্যাপ্তি’ স্থাপনের জন্য সমস্ত ‘উপাধি’র সম্ভাবনা দূর করা দরকার। কিন্তু উপাধি মানে কী? মোটের উপর বলা যায় এক ধরনের শর্ত বা কন্ডিশন। যেমন– আগুন থাকলেই যদি ধোঁয়া থাকতো তাহলে তো তপ্ত লৌহপিণ্ডেও ধোঁয়া থাকার কথা! কিন্তু তপ্ত লৌহপিণ্ডে ধোঁয়া থাকে না। ভিজে কাঠ বা আর্দ্র জ্বালানিতে আগুন ধরালে ধোঁয়া থাকে, অতএব আর্দ্র জ্বালানি এই দৃষ্টান্তে হবে উপাধি বা শর্ত। মাধব আরো বলেছেন, চার্বাক মতে উপাধি আবার দু’রকম– ‘নিশ্চিত’ ও ‘শংকিত’। ভিজে কাঠ হলে উপাধিটি নিশ্চিত, কেননা তা আমাদের জানা আছে। কিন্তু এমন উপাধি তো থাকতে পারে যার খবর আমাদের জানা নেই। তাকে বলবো, শংকিত উপাধি। এই দু’রকম সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে দূর হলে পরই ‘হেতু’ এবং ‘সাধ্য’র নিয়ত-সহচার ও ব্যাভিচারের অভাব থেকে ব্যাপ্তি সুনিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু নিশ্চিত ও শংকিত সমস্ত রকম উপাধির সম্ভাবনা দূর করার কোনো উপায়ই সম্ভব নয়। অতএব, ব্যাপ্তিও সম্ভব নয়, এবং ব্যাপ্তি সম্ভব নয় বলেই অনুমানও অসম্ভব।

ব্যাপ্তি স্থাপন করা– বিশেষত নিশ্চিত ও শংকিত সমস্ত রকম উপাধির সম্ভাবনা দূর করে তা স্থাপনা করা– কেন একান্তই অসম্ভব, মাধবাচার্যের মতে চার্বাকরা নাকি তাই নিয়ে অনেক কূটতর্কের অবতারণা করে থাকেন। বর্তমানে আমাদের পক্ষে তার জটিলতায় প্রবেশ করার সুযোগ নেই। তবে সাধারণ কৌতুহল মেটানোর জন্যে সংক্ষিপ্ত ধারণাটা হলো এরকম–
মাধবাচার্য বলেন, চার্বাক-মতে ব্যাপ্তিজ্ঞান দুটি পদার্থের ব্যতিক্রমহীন, শর্তহীন বা উপাধিহীন, সুনিশ্চিত, সার্বিক, সার্বত্রিক সাহচর্যের জ্ঞান। ‘ব্যাপ্তি’ অর্থাৎ সাধ্যের সঙ্গে সাধনের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধের জ্ঞানকে যদি আমরা প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে লাভ করতে চাই তাহলে প্রয়োজন সাধ্যের সঙ্গে যুক্ত সাধনকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পৃথকভাবে প্রত্যক্ষ করা। এভাবে প্রতিটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করে উভয়ের মধ্যে সম্বন্ধের অবধারণের পথে প্রধান অন্তরায় হলো দেশ, কাল এবং স্বভাবের ব্যবধান। এইরূপ জ্ঞান প্রত্যক্ষসিদ্ধ হতে পারে না। প্রত্যক্ষের দ্বারা বর্তমানকালীন কোন বিশেষ বস্তু বা ব্যক্তিকেই জানা যায়। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় পদার্থকে প্রত্যক্ষের দ্বারা জানা যায় না। দুটি পদার্থের মধ্যে ব্যাপ্তিজ্ঞান ঐ দুটি পদার্থের ত্রৈকালিক ও সম্ভাব্য যাবতীয় দৃষ্টান্তকে প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমেই সম্ভব।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, যদি ধূম ও আগুনের মধ্যে ব্যাপ্তি সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা করতে হয় তাহলে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যাবতীয় ধূম ও আগুনকে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। ত্রৈকালিক যাবতীয় ধূম এবং আগুনকে পর্যবেক্ষণ করা হলে তবেই ধূম এবং আগুনের মধ্যে শর্তহীন নিশ্চিত সার্বিক সাহচর্যের জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু ত্রৈকালিক যাবতীয় ধূম ও আগুন প্রত্যক্ষের বিষয় হতে পারে না। যদিও বা ধরে নেওয়া হয় যে অতীত ও বর্তমানের যাবতীয় ধূম ও আগুনকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি, তবুও ভবিষ্যতের ধূমকে আমরা কোনভাবেই প্রত্যক্ষ করতে পারি না। যাবতীয় ধূম ও আগুনের প্রত্যক্ষ ব্যতীত তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমহীন সম্বন্ধ জানাও সম্ভব নয়। সুতরাং দুটি পদার্থের ব্যাপ্তি ও ব্যতিক্রমহীন, শর্তহীন, সুনিশ্চিত, সার্বিক ও সার্বত্রিক সাহচর্যের জ্ঞান নিছক কল্পনামাত্র।

মাধবের মতে, চার্বাকদের আরও বক্তব্য হলো, অনুমান প্রমাণের অনুগামীগণ বলতে পারেন যে একটি অনুমানের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিজ্ঞান অপর একটি অনুমানের সাহায্যেই লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু একথাও গ্রহণযোগ্য নয়। একটি অনুমানের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিজ্ঞান যদি অপর একটি অনুমানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে ঐ অপর অনুমানের ব্যাপ্তিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করার জন্য আবার একটি অনুমানের সাহায্য প্রয়োজন। এইভাবে অনবস্থা-দোষ অবশ্যম্ভাবী। তাছাড়া যদি অনুমানের সাহায্যে ব্যাপ্তিজ্ঞান এবং ব্যাপ্তিজ্ঞানের সাহায্যে অনুমানকে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাহলে অন্যোন্যাশ্রয়-দোষ দেখা দেয়। সুতরাং ব্যাপ্তিজ্ঞান অনুমানের সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

প্রমাণের অপর একটি মাধ্যম শব্দপ্রমাণ বা আপ্তবাক্যও যে চার্বাক-মতে ব্যাপ্তিজ্ঞানের কারণ নয়, মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’র বিবরণ থেকে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে চার্বাকপক্ষ থেকে বৈশেষিক মতের উল্লেখ করা হয়েছে, যে মত অনুসারে আপ্তবাক্য অনুমানের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় অনুমানের প্রামাণ্য স্বীকারের ক্ষেত্রে আপ্তবাক্যের সাক্ষ্য সম্পূর্ণ নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়। আপ্তবাক্যের সত্যতার ভিত্তি নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির উক্তি। আপ্ত বা বিশ্বস্ত ব্যক্তির বাক্যকে বলা হয় শব্দ-প্রমাণ। কিন্তু শব্দ পদজ্ঞান-নির্ভর। পদজ্ঞান বৃদ্ধ-ব্যবহার বা বয়স্ক ব্যক্তির শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে লব্ধ। পদজ্ঞান এককভাবে প্রত্যক্ষলব্ধ নয়। কয়েকটি ক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করে পদজ্ঞান আমরা অনুমান করি। পদজ্ঞান আংশিকভাবে অনুমান নির্ভর। আপ্তবাক্যস্বরূপ এ জাতীয় উক্তিতে নির্ভরতা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন বাক্যের সঙ্গে অর্থের সার্বকালীন সঙ্গতি সম্বন্ধে দৃঢ় প্রত্যয় থাকে, অর্থাৎ, বাক্যের সঙ্গে অর্থের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূচক অপর একটি ব্যাপ্তিজ্ঞানের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া যায়। অতীত অভিজ্ঞতায় যাকে আপ্ত বলে জেনেছি সে যে বর্তমানেও আপ্ত থাকবে তার পক্ষেই বা প্রমাণ কী? কাজেই আপ্তবাক্যে নির্ভরতার সঙ্গে ব্যাপ্তিজ্ঞানে বিশ্বাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকায় ব্যাপ্তিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে আপ্তবাক্য গণ্য হতে পারে না। এ-প্রেক্ষিতে মন্তব্য করা বোধকরি অসঙ্গত হবে না যে, অনুমানের আশ্রয় ব্যাপ্তিজ্ঞান আপ্তবাক্যের মাধ্যমে নির্ণয়যোগ্য নয়– চার্বাকদের এই উক্তি প্রকৃতপক্ষে অনুমানকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হলেও প্রমাণ হিসেবে আপ্তবাক্যের দুর্বলতারই ইঙ্গিত সূচিত করে।
এছাড়া উপমান বা অন্য কোন প্রমাণের দ্বারাও ব্যাপ্তিজ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। শব্দ, উপমান বা অন্য কোন প্রমাণ নিজেই সিদ্ধ নয়। পূর্বশ্রুত সাদৃশ্য-জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞাতপূর্ব পদার্থকে প্রত্যক্ষ করে যে জ্ঞান হয় তাকে বলে উপমিতি। সাদৃশ্যজ্ঞানও আংশিকভাবে অনুমান-নির্ভর। অনুমান অসিদ্ধ হওয়ায় শব্দ ও উপমান অসিদ্ধ হয়ে পড়ে। কোন অসিদ্ধ প্রমাণের সাহায্যে লব্ধ ব্যাপ্তিজ্ঞান সিদ্ধ হতে পারে না।

এখানেই শেষ নয়, চার্বাক-মতানুসারে বলা হয়, বৌদ্ধগণ যে কার্য-কারণ ও তাদাত্ম্য সম্বন্ধের মাধ্যমে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ। কার্য-কারণ বা তাদাত্ম্য নিজেই নিঃসন্দিগ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। সুতরাং তাদের সাহায্যে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কখনোই সার্থক হতে পারে না। বস্তুর স্বভাবের দ্বারাও ব্যাপ্তিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। দহনক্রিয়া ও নিম্নগতি যথাক্রমে অগ্নি ও জলের স্বভাবধর্ম। প্রতিটি বস্তুর স্বভাবধর্ম যেহেতু অপরিবর্তনীয় সেহেতু অনেকে স্বভাবধর্মের মাধ্যমেও ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু চার্বাকগণ বস্তুর কোন অপরিবর্তনীয় স্থির স্বভাবধর্ম মানতে রাজী নন। তাঁদের বক্তব্য হলো, বস্তুর স্বভাবধর্ম ব্যক্তির অতীত অভিজ্ঞতার দ্বারা স্থির করা হয়। এই অভিজ্ঞতা কোন কিছুর ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে মাত্র, কোন স্থির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অগ্নির দাহিকাশক্তি ভবিষ্যতে অগ্নির দহন করার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে, কিন্তু প্রকৃতির পরিবর্তনে ভবিষ্যতে অগ্নির এই স্বভাব যে কখনও পরিবর্তিত হবে না– এমন তথ্য স্থির নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠা করে না।

বস্তুতপক্ষে দুটির পদার্থের মধ্যে শর্তহীন, নিঃসন্দিগ্ধ ব্যাপ্তিজ্ঞান কোনভাবেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। যত বেশিসংখ্যক ক্ষেত্রই পরীক্ষা করা হোক না কেন দুটি পদার্থের সাহচর্য যে সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত তা কোনভাবেই নির্ণয় করা সম্ভব নয়। অনুমান ব্যাপ্তিজ্ঞান-সাপেক্ষ। ব্যাপ্তিজ্ঞান যেহেতু কোন প্রমাণের দ্বারাই লাভ করা সম্ভব নয় সেহেতু অনুমান অসিদ্ধ। অতএব চার্বাকদের সিদ্ধান্ত হলো প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ (প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম্)।

অনুমান-প্রমাণে সমস্ত রকম শর্ত বা উপাধির সম্ভাবনা দূর করে ব্যাপ্তি স্থাপনা করা কেন একান্তই অসম্ভব, উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’কার মাধবাচার্যের মতে চার্বাকরা নাকি তাই নিয়ে অনেক কূটতর্কের অবতারণা করে থাকেন। কিন্তু এখানে যদি বিপ্রতীপ-দৃষ্টিতে এরকম প্রশ্ন উত্থাপিত হয়– স্বয়ং মাধবাচার্যই চার্বাকদের মুখে এই রকম কঠিন ও জটিল যুক্তিজাল বসিয়ে দিয়ে উল্টো চার্বাকদেরকেই তিনি জটিল ও কঠিন যুক্তিবিশারদ আখ্যায় অতিশয়োক্তি করেছেন, তাহলে বাস্তব ইতিহাসের দিক থেকে তা কতোটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? প্রশ্নটা অবান্তর কিনা তা বিশ্লেষণ করতে হলে প্রসঙ্গত এখানে বলা যেতে পারে, চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডন হিসেবে মাধবাচার্য যে যুক্তিজাল বিস্তার করেছেন তা অন্তত অনেকাংশে মাধবাচার্যের নিজের সম্প্রদায়-উদ্ভাবিত বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে–
মাধবাচার্য ছিলেন অদ্বৈত-বেদান্ত মতে অতি-নিষ্ঠ অনুগামী। অদ্বৈত-বেদান্ত মতে শ্রুতি (বা বেদান্ত) ছাড়া আর কোনো প্রমাণই সম্ভব নয়। তাই স্বয়ং শঙ্করাচার্য তাঁর ‘ব্রহ্ম-সূত্র’-ভাষ্যের ভূমিকাতেই ঘোষণা করেছেন যে সর্বপ্রকার প্রমাণ-প্রমেয় ব্যবহারের ভিত্তি বলতে আসলে অজ্ঞান বা অবিদ্যা। তাঁর অনুগামীদের মধ্যে শ্রীহর্ষর কূটতর্কে পারদর্শিতা সুপ্রসিদ্ধ। এবং তিনি মাধবাচার্যের পূর্বেই অদ্বৈতমতকে দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘খণ্ডন-খণ্ড-খাদ্য’ নামে গ্রন্থে সব রকম প্রমাণ খণ্ডনের আয়োজন করেছেন। শ্রীহর্ষ কূটতর্কে পারদর্শী ছিলেন বলেই সর্বপ্রকার প্রমাণ বলতে তাঁর কাছে বিশেষত অনুমান-প্রমাণ। শ্রীহর্ষের বইতে তাই অনুমান খণ্ডনের বিশদ আয়োজন। তার জন্যে যথেষ্ট যুক্তিতর্কও। যুক্তিতর্কগুলি খুবই বিদগ্ধ, সহজবোধ্য নয়। তারই জের টেনে শ্রীহর্ষর ব্যাখ্যাকারেরা তর্কজাল আরো জটিল করেছেন। এইসব বই থেকেই মাধবাচার্য অনুমান-খণ্ডনের অতি-বিদগ্ধ বিচার চয়ন করে চার্বাকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন কিনা, যোগ্যতর বিদ্বানরা তা অনুসন্ধান করতে পারেন। সে অনুসন্ধান হয়তো নিষ্ফল হবে না।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৪৬)

আগেই বলা হয়েছে, মাধবাচার্যের লেখার কায়দাটা এরকম যে, বিপক্ষ-বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি এমনভাবে বিষয়কে উপস্থাপন করেন যেন তিনি সাময়িকভাবে বিপক্ষ অবলম্বন করেছেন; অর্থাৎ তিনি নিজে যদি চার্বাক-মতানুগামী হতেন তাহলে কোন্ ধরনের বিচার করে ঐ বিপক্ষ সমর্থন করতেন যেন তারই পরিচয় দিয়েছেন। চার্বাকদের অনুমান-খণ্ডনের বর্ণনায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা তাঁর জন্য যথেষ্ট সুবিধাজনকই হওয়ার কথা। কেননা, তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের প্রবক্তারাই অনুমান-খণ্ডনে বিশেষ পারদর্শিতার নজির দেখিয়েছেন। তা অনুসরণ করে অনুমান-খণ্ডনের অতি-বিদগ্ধ বর্ণনা রচনা করা সহজ ব্যাপার বলে দেবীপ্রসাদের অভিমত। যদিও মাধবাচার্য ঠিক এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন কিনা– এই প্রশ্ন নিয়ে অবশ্যই বিবাদের অবকাশ থাকতে পারে বলেও দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আদৌ চার্বাকরা মাধব-বর্ণিত এরকম জটিল ও কঠিন যুক্তিবিশারদ ছিলেন এই অতিশয়োক্তি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কেননা চার্বাকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলি থেকে বরং মনে হয়, তাঁরা কূট তার্কিকও ছিলেন না, আবার বাচস্পতি মিশ্রের আখ্যা অনুযায়ী একান্ত যুক্তিহীন অর্থে জানোয়ারেরও অধম ছিলেন না। তার বদলে হয়তো সাধারণ মানুষের বোধগম্য সাদামাটা যুক্তি দিয়ে সম্প্রদায়ান্তরের নানা মতামত নিয়ে হাসিতামাশা করেছেন। এই কিছু কিছু লোকগাথা মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থেই লোকায়ত-মত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, যেমন–
‘পশুশ্চেন্নিহতঃ স্বর্গং জ্যোতিষ্টোমে গমিষ্যতি।
স্বপিতা যজমানেন তত্র কস্মান্ন হিংস্যতে’।। (চার্বাকষষ্ঠি-৫০)।।
অর্থাৎ : জ্যোতিষ্টোমাদি যজ্ঞে নিহত পশুর যদি স্বর্গলাভ হয়, তবে যজ্ঞকারী যজমান কেন তার পিতাকে হত্যা করে না?
.
গচ্ছতামিহ জন্তৃ’নাং ব্যর্থং পাথেয়কল্পনম্।
গেহস্থকৃতশ্রাদ্ধেন পথি তৃপ্তিরবারিতা।। (লোকায়তিকমত-সর্বদর্শনসংগ্রহ)।।
অর্থাৎ : যে পৃথিবী ছেড়ে গেছে তার পাথেয় (পিণ্ড) কল্পনা করা বৃথা, কেননা তাহলে ঘর ছেড়ে কেউ গ্রামান্তর গমন করলে ঘরে বসে তার উদ্দেশ্যে পিণ্ড দিলেই তো তার পাথেয়-ব্যবস্থা সম্পন্ন হতো।

যজ্ঞে নিহত পশু যদি সোজা স্বর্গে যায় তাহলে নিজের পিতাকে স্বর্গে পাঠানোর অমন সোজা পথ থেকে বঞ্চিত করা কেন? কিংবা, শ্রাদ্ধক্রিয়ায় পিণ্ড দান করলেই যদি মৃতের ভোজনরূপ ক্ষুধা নিবৃত্তি ঘটে তাহলে গ্রামান্তরগামীর পক্ষে তো আর পাথেয় হিসেবে চাল-চিঁড়ে বয়ে নিয়ে যাবার দরকার হতো না! হাসিতামাশা হলেও কথাগুলি যুক্তিহীন নয়, আবার শংকিত ও নিশ্চিত উপাধি বর্জন করে ব্যাপ্তি প্রতিষ্ঠা করার অসম্ভাবনার মতো যুক্তিতর্কের কূটকচালও নয়। যেহেতু চার্বাকদের নিজস্ব মত ও বিতর্ক উপস্থাপন করে এমন গ্রন্থ প্রকৃতই অজ্ঞাত তাই স্থির সিদ্ধান্ত জানার উপায় নেই। কিন্তু দেবীপ্রসাদের মতে অন্তত আপাতদৃষ্টিতে মাধবাচার্যের চার্বাক-বর্ণনায় বেশ কিছুটা অসংগতি চোখে পড়ে। একদিকে মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে চার্বাকের নামে প্রচলিত একটি প্রামাণিক লোকগাথা উদ্ধৃত করেন–
যাবদ্ জীবেৎ সুখং জীবেদ্ নাস্তি মৃত্যোরগোচরঃ।
ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ ।।  -(সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।
অর্থাৎ : যতদিন বেঁচে আছ ততদিন সুখভোগ করে নাও। মরণ থেকে কারুরই রেহাই নেই। লাশ পুড়ে যাবার পর আবার কেমন করে ফিরে আসবে?
এবং এই লোকগাথাটি উদ্ধৃত করে তিনি এরপর মন্তব্য করেছেন–
-ইতি লোকগাথামনুরুন্ধানা নীতিকামশাস্ত্রানুসারেণার্থ-কামৌ এব পুরুষার্থৌ মন্যমানাঃ পারলৌকিকম্ অর্থম্ অপহ্নুবানাঃ চার্বাকমতম্ অনুবর্ত্তমানা এবানুভূয়ন্তে। অতএব তস্য চার্বাক-মতস্য লোকায়তম্ ইতি অন্বর্থম্ অপরং নামধেয়ম্ । -(সর্বদর্শনসংগ্রহ : চার্বাক-দর্শনম্)।
অর্থাৎ : এই লোকগাথার অনুবর্তন করে, নীতিশাস্ত্র ও কামশাস্ত্র অনুসারে অর্থ ও কামকে পুরুষার্থ মনে করে, পারলৌকিক স্বর্গ, দেবতা, পাপ ও পুণ্য প্রভৃতি অপ্রত্যক্ষ পদার্থ অগ্রাহ্য করে চার্বাকমতের অনুবর্তন করতে দেখা যায়। এজন্যে চার্বাক মতের অপর একটি সার্থক নাম লোকায়ত। প্রায় সমস্ত লোকে এই মতটি পরিব্যাপ্ত বলে তা লোকায়ত মত নামে প্রসিদ্ধ।

তার মানে, একদিকে তিনি বলছেন, চার্বাকেরই নামান্তর হিসেবে লোকায়ত শব্দটি বেশ জুৎসই, কেননা হাজার হোক এই দর্শন ইতর জনগণেরই দর্শন। তাদেরই মনে ধরবার মতো কথা। অন্যদিকে বলছেন চার্বাকেরা কঠিন ও জটিল কূটতর্কের অবতারণা করে থাকেন। ‘কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায়, ইতর জনগণ তো শিক্ষাদীক্ষার সামান্য সুযোগ থেকেই বঞ্চিত। তাই এই ইতর জনগণই ‘নিশ্চিত’ ও ‘শংকিত’ উভয় প্রকার ‘উপাধি’ বর্জন করে ব্যাপ্তি নিশ্চয় নিয়ে অতি-বিশুদ্ধ আলোচনার অবতারণা করতে পারে– এ-হেন কথা কষ্টকল্পনার পক্ষেও দুঃসাধ্য। সংক্ষেপে চার্বাকেরা যে সত্যিই অমন ফলাও করে অনুমান মাত্ররই অসারতা প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন, এ-হেন কথা কল্পনা করার কোনো কারণ নেই।’ দেবীপ্রসাদের এ-যুক্তি উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই।
আমরা পরে দেখবো, চার্বাকেরা একেবারে কোনো রকম অনুমানই মানতেন না।– এমন কি এজাতীয় কথা খুব জোর করে বলায় অনেক বড় বাধা আছে। বরং অন্যান্য নজির থেকে মনে হয়, আত্মা পরলোক ইত্যাদি একান্ত অপ্রত্যক্ষ বিষয়ে অনুমান অগ্রাহ্য করলেও প্রত্যক্ষ-গোচর বিষয়ে সাধারণ বা লৌকিক অনুমান মানবার ব্যাপারে তাঁদের মতে কোনো বাধা ছিলো না।
নবীনতর পূর্বতন

نموذج الاتصال