পুরন্দরের মত এবং শান্তরক্ষিত ও কমলশীল
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যের সূত্র ধরেই আলোচনাটা আগানো যেতে পারে। চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই যে প্রমাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য, একথা প্রায় সকলেই বলেছেন। আর হরিভদ্র ও তাঁর ব্যাখ্যাকারেরা বিশদভাবে দেখাতে চেয়েছেন, এ-জাতীয় দাবির পেছনে আসল উদ্দেশ্যটা বস্তুত কী। একদল ধূর্ত প্রবঞ্চক লোক অনুমান ও শাস্ত্রপ্রমাণের দোহাই দেখিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ধর্ম-অধর্ম, পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক প্রভৃতি কাল্পনিক বিষয়ে অন্ধ বিশ্বাস প্রচার করে তাদের ঠকাতে চায়। এ-জাতীয় কথার সঙ্গে লোকায়তিকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলিরও সঙ্গতি সুস্পষ্ট। তাই চার্বাকমত প্রসঙ্গে এ-পর্যন্ত মোটের উপর সুনিশ্চিত হওয়া যেতেই পারে।
কিন্তু যে প্রশ্নটার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা আবশ্যক, তা হলো– একান্ত অপ্রত্যক্ষ ও অলৌকিক বিষয়ে অনুমান অগ্রাহ্য করলেও চার্বাক কি সমস্ত রকম অনুমান– এমনকি প্রত্যক্ষ-সাপেক্ষ লৌকিক বিষয়ে অনুমানও– অস্বীকার করতে চান?
মাধবাচার্যের বর্ণনাতেই আমরা দেখেছি তিনি বলেছেন, চার্বাক অনুমানমাত্ররই বিরোধী; কারণ ব্যাপ্তি ছাড়া অনুমান অসম্ভব, কিন্তু ব্যাপ্তি-নিশ্চয় কিছুতেই হওয়া সম্ভব হতে পারে না। আর বাচস্পতিমিশ্রের বর্ণনা মতে, এমনকি জন্তু-জানোয়ারের আচরণ থেকে অনুমান-পরায়ণতার যতটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, চার্বাক তাও মানেন না।
বাচস্পতির কথাটা যে অত্যুক্তির প্রকট নিদর্শন, স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলে তা হয়তো অনেকে স্বীকার করবেন। কিন্তু মাধবাচার্যের বর্ণনার বেলায় অন্য কথা। কেননা, উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পরবর্তীকালে অনেকেই এবং আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে প্রায় সকলেই মাধবাচার্যের কূটযুক্তিপূর্ণ বর্ণনাটুকু হুবহু মেনে নিয়েই চার্বাক-মতটিকে বুঝতে ও বোঝাতে চেয়েছেন। আধুনিককালের প্রায় সবক’টি পাঠ্যগ্রন্থেই চার্বাক-মতের বর্ণনায় মাধবাচার্য-বর্ণিত চার্বাক-মতেরই অনুসরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, প্রায় সকলেই ধরে নেন যে, চার্বাক-মতে অনুমানমাত্রই অপ্রমাণ, তা ইহলৌকিক বা পারলৌকিক যে-কোনো বিষয়েই হোক-না-কেন কোনো রকম অনুমানই চার্বাক-মতে সম্ভব নয়।
কিন্তু এ-হেন কথা স্বীকার করার বাধা আছে বলে দেবীপ্রসাদ মন্তব্য করেন। কারণ–
‘প্রথমত, একেবারে ঐকান্তিক অর্থে অনুমান অস্বীকার করলে সাধারণ-লোকব্যবহারই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ধোঁয়ো দেখে আগুন অনুমান অবান্তর হলে– বা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখে বৃষ্টির সম্ভাবনা অনুমান করা অসঙ্গত হলে– মানুষের পক্ষে বাঁচাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। চার্বাকরা যদি সত্যি অমন বেকুব হতেন তাহলে তাঁদের মত খণ্ডন করবার জন্যে দিকপাল দার্শনিকদের পক্ষেও মাথা ঘামাবার দরকার পড়তো না।
দ্বিতীয়ত, আগেই বলেছি, লোকায়তিকদের প্রামাণিক লোকগাথাগুলি বিদগ্ধ প্রমাণবিদ্যা-সম্মত অনুমানরূপে ব্যক্ত না-হলেও বিচারে বোঝা যায় যে, এগুলি অবশ্যই একরকম অনুমান-নির্ভর। অনুমান সম্পূর্ণ নস্যাৎ হলে কী করে ঠাট্টা করেও বলা যায় : যজ্ঞে নিহত জীবের স্বর্গপ্রাপ্তি হলে যজ্ঞে নিহত স্বীয় পিতারও স্বর্গপ্রাপ্তি মানতে হবে? অনুমান একেবারে না-মানলে লোকগাথাটির মূল শ্লেষই ব্যর্থ হতে বাধ্য।’
‘এ-জাতীয় কথা একেবারে অবান্তর না-হলে স্বীকার করতে হবে যে চার্বাকমতে প্রত্যক্ষই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হলেও লোকব্যবহার-প্রসিদ্ধ এবং প্রত্যক্ষসিদ্ধ ইহলৌকিক বিষয়েও অনুমানকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করার কথাটা অতিরঞ্জিত। চার্বাকমতে অবশ্যই অপ্রত্যক্ষ পরলোকাদি ব্যাপারে অনুমান স্বীকার্য নয়। কিন্তু লৌকিক ব্যবহারের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন এবং প্রত্যক্ষগোচর বিষয়েও অনুমান অস্বীকার করা চার্বাকের অভিপ্রেত মত হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।’- (ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫১)
চার্বাকদের নিজস্ব মত প্রকাশক গ্রন্থ বা সাহিত্য বিলুপ্তির অজ্ঞাত-অন্ধকারে পতিত ও দুর্লভ হওয়ায় উপরিউক্ত দাবি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক বিচারের উপরই প্রতিষ্ঠিত। তবুও আশার কথা হলো, দাবিটির পক্ষে কেবলমাত্র প্রাসঙ্গিক বিচারই এখানে একমাত্র সম্বল নয়। নানা দার্শনিক নানাভাবে পূর্বপক্ষ হিসেবে মতটি বর্ণনা করেছেন এবং সমস্ত পূর্বপক্ষ-বর্ণন সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য না-হলেও কোনো কোনো পূর্বপক্ষ-বর্ণনার মধ্যে এমন কথা স্পষ্টতই পাওয়া যায় যে, অলৌকিক বিষয়ে অনুমান না-মানলেও লোকপ্রসিদ্ধ এবং প্রত্যক্ষগোচর বিষয়ে অনুমান চার্বাক স্বীকার করতেন। তারই নমুনা পাওয়া যায় প্রখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক শান্তরক্ষিতের লেখা ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ এবং কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’ গ্রন্থে, যা কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত।
কমলশীলের এই বিশাল গ্রন্থ মূলত তাঁর গুরু শান্তরক্ষিত রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। শান্তরক্ষিত ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে স্বীয় মত স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রচলিত দার্শনিক মতগুলো খণ্ডন করে স্বীয় বৌদ্ধ মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু ওখানেও লোকায়ত হিসেবে বস্তুবাদী মতের সমালোচনা থাকলেও চার্বাক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’য় এই বস্তুবাদ সুস্পষ্টভাবেই চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। তাঁদের এই পূর্বপক্ষ বর্ণনার একটি বৈশিষ্ট্য হলো, চার্বাকমতের প্রবক্তা হিসেবে পুরন্দর নামে জনৈক পূর্ববর্তী দার্শনিকের উল্লেখ। তবে পুরন্দর রচিত কোন গ্রন্থের নাম আদৌ জানা না গেলেও অন্যান্য লেখকেরাও পুরন্দরকে ‘চার্বাকমতে গ্রন্থকর্তা’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং এজাতীয় উল্লেখ থেকে সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ আধুনিক বিদ্বানরাও পুরন্দরকে চার্বাকপন্থী বলেই ধরে নিয়েছেন।
শান্তরক্ষিতের লেখা ‘তত্ত্বসংগ্রহ’-র ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় কমলশীল বলছেন–
‘পুরন্দরঃ তু আহ লোকপ্রসিদ্ধম্ অনুমানং চার্বাকৈঃ অপি ইষ্যতে এব, যৎ তু কৈশ্চিৎ লৌকিকং মার্গম্ অতিক্রম্য অনুমানম্ উচ্যতে তন্নিষিধ্যতে।’ (তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা)।
অর্থাৎ :
পুরন্দর কিন্তু বলেন চার্বাকও লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার করেন; তবে কেউ যদি লৌকিক পথ অতিক্রম করে কোনকিছু অনুমান করতে চান তাহলে চার্বাক তার নিষেধ করবেন বা স্বীকার করবেন না।
মাধবাচার্য প্রমুখের বণিত চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে চার্বাকমতের এই প্রবক্তা পুরন্দর লৌকিক অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তাঁর অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট, অনুমানমাত্রই– বা সব রকম অনুমানই– অস্বীকার করার দরকার নেই। লোকপ্রসিদ্ধ বা ইহলোক সংক্রান্ত বিষয়ে সাধারণত অনুমানের যে প্রয়োগ তার বিরুদ্ধে চার্বাকেরও কোন আপত্তি নেই। আপত্তিটা অন্যত্র। পারলৌকিক বিষয়ে অনুমানের বিরুদ্ধে। লৌকিক পথ অতিক্রম করে পারলৌকিক বিষয়ে অনুমান অবশ্যই অচল ও অগ্রাহ্য।
কমলশীলের উপরিউক্ত মন্তব্য– এবং তারই সঙ্গে পুরন্দর প্রসঙ্গে জৈন লেখক বাদিদেব সূরির উক্তির সঙ্গতি রেখে– সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যে-ভাবে আধুনিক ভাষায় এই চার্বাকমত ব্যাখ্যা করেছেন, প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের তর্জমায় তা উদ্ধৃত করা হলো। দাশগুপ্ত বলছেন–
‘(আনুমানিক সপ্তম শতকের) চার্বাকমতানুগামী পুরন্দর নামে দার্শনিক প্রত্যক্ষসাপেক্ষ পার্থিব বা ইহলৌকিক বিষয়ে অনুমানের উপযোগিতা স্বীকার করেন; কিন্তু প্রত্যক্ষাতীত লোকোত্তর বিষয়ে বা পরকাল ও কর্মফল প্রভৃতি বিষয়ে কোনো মত অনুমানের নজির দেখিয়ে প্রমাণ করা যায় না। সাধারণ অভিজ্ঞতায় জানা ব্যবহারিক জীবনে অনুমানের প্রামাণ্য এবং অভিজ্ঞতাবহির্ভূত বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ে অনুমানের অনুপযোগিতা– এই দু-এর পার্থক্য প্রদর্শনের মূল যুক্তি হলো, দুটি বিষয়ের মধ্যে নিয়ত-সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত না-হলে অনুমান সম্ভব নয়; পরিভাষায় এই দুটিকে বলে ‘লিঙ্গ’ (যেমন ধূম) এবং ‘সাধ্য’ (যেমন বহ্নি)। (ধূম ও বহ্নির মধ্যে নিয়ত-সম্বন্ধ স্বীকৃত বলেই ধূম থেকে বহ্নির অনুমান হয়)। এ-জাতীয় নিয়ত-সম্বন্ধ স্থাপনের দুটি শর্ত। এক : বহু দৃষ্টান্তে উভয়কেই একত্রে দর্শন। যেমন বহু দৃষ্টান্তেই দেখা গেছে যে যেখানেই ধূম বর্তমান সেখানেই বহ্নি বর্তমান। দুই : বহু দৃষ্টান্তে একটির অভাবে অপরটিরও অভাব দর্শন। যেমন, বহু দৃষ্টান্তে দেখা গেছে বহ্নি-শূন্য স্থানে ধূম অবর্তমান। কিন্তু এই জাতীয় দ্বিবিধ পরিদর্শন পারলৌকিক বিষয়ে অসম্ভব, কেননা কোনো ক্ষেত্রেই পরলোক প্রত্যক্ষগোচর হতে পারে না। অতএব, পরলোকাদি বিষয়ে অনুমানও অসম্ভব। শুধুমাত্র প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে এজাতীয় দ্বিবিধ দৃষ্টান্ত দর্শনের সম্ভাবনা আছে। তাই প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে সাধারণ-স্বীকৃত অনুমানের উপযোগিতা মানা যায়।’- (সূত্র: ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে, পৃষ্ঠা-৫৩)
ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যের নানা নজির অবজ্ঞা না-করলে পুরন্দর নামের দার্শনিককে নিশ্চয়ই চার্বাকমতের প্রবক্তা বলে স্বীকার করতে হবে। অতএব পুরন্দরের উপরিউক্ত বক্তব্য চার্বাকমত-সম্মত বলেও স্বীকার করা প্রয়োজন বলে দেবীপ্রসাদ মনে করেন। তাহলে, চার্বাকরা কোনো রকম অনুমানই মানতেন না– এ-হেন দাবিকে অত্যুক্তি বলে সন্দেহ করারও কারণ আছে। বরং স্বীকার করা দরকার যে, চার্বাক-মতে পরলোকাদির অনুমান অসম্ভব হলেও প্রত্যক্ষগোচর ইহলৌকিক বিষয়ে লোকপ্রসিদ্ধ অনুমান স্বীকার্য। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই কথা মানলে চার্বাক প্রসঙ্গে প্রচলিত অনেক কথাই কল্পিত বলে প্রমাণিত হবে।
Tags
চার্বাক দর্শন